কিছুদিন আগে বিদেশ যাব বলে এয়ারপোর্টের বিজনেস লাউঞ্জে বসে আছি - তখন প্রায় ভোর সাড়ে চারটে বাজে। এই সময় লাউঞ্জ বেশ খালি কারণ মাত্র কয়েকটা ইন্টারন্যাশানাল ফ্লাইট আছে এত ভোরে।
এত সকালে কি খাব বুঝতে পারছি না - আবার ফ্রী খাবার ছেড়েও দেওয়া যায় না, অধর্ম হবে। কিন্তু বেশী খেলেও চাপ, কারণ খানিক পরেই ফ্লাইট ছাড়লে তারা আবার ব্রেকফাষ্ট দেবে। সেটাও না বলা যায় না - আরো বড় অধর্ম হবে!
তো কি স্ট্র্যাটেজি নেব বসে বসে ভাবছি, একজন ওয়েটার টাইপের কেউ সামনে এসে বলল, "স্যার কিছু লাগবে"?
আমাকে কেউ স্যার বলে না এই এব ঘ্যামা জায়গায়। স্যার বলে আজকাল একজনই, ল্যাবে গ্যাস সাপ্লাই করে মন্ডল। মন্ডলের আবার বসিরহাটে বাড়ি - হাজার বার বারণ করলেও শোনে না। স্যার বলার জন্য তাকে রসগোল্লা ফাইন করা হয়েছে - দেশে গেলে নিয়ে আসবে। তবে সেদিন বুঝলাম মন্ডল-কে ফাইন করাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে – কারণ অফিসের গেটের বাইরে যে লোকটা ঠ্যালা নিয়ে চা-বিক্রী করে তাকেও দেখলাম সেদিন মন্ডল বলছে, “স্যার, এক কাপ চায়ে পিলাও”!
এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে স্যার আমাকে বলা হচ্ছে না ধরে নিয়েই আমি উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। আবার শুনলাম, "স্যার, কিছু লাগবে"?
ভাবলাম আমার পিছনের কাউকে বলা হচ্ছে - ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমার পিছনে দেওয়াল। ফলতঃ উত্তর দিতেই হল -
- আমাকে স্যার বলছ নাকি?
- আর তো কেউ নেই স্যার এখানে, কাকে বলব!
- আচ্ছা, আমার কিছু লাগবে না। পারলে এক কাপ ক্যাপ্পুচিনো দিয়ে যেও, না দিতে পারলেও চিন্তা নেই। অভ্যাস আছে, নিয়ে খেয়ে নেব
- না স্যার, এনে দিচ্ছি।
সে খানিক পরে ক্যাপ্পুচিনো এনে দিল, আমি আপ্লুত। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো -
- আচ্ছা, ভাই, তুমি আমাকে স্যার বলছিলে কেন বারবার - আরো তো রয়েছে লোক
- সত্যি কথা বলবো?
- হ্যাঁ, সত্যি শুনতেই তো চাইছি
- আপনার যা অবস্থা, তাতে করে কেউ আপনাকে স্যার বলে ডাকবে না আমাদের স্টাফরা। আপনার পাশের সবাইকে স্যার বলে খাতির করবে, কিন্তু হয়ত আপনাকে স্যার বলবেই না
- সে তো বটেই, আমাকে কেউ স্যার বলে না। ঠেলে বের না করে দিলেই আমি আর কিছু মনে করি না
- সেই জন্যই আমি ভাবলাম, আপনাকে স্যার বলি। কেউতো ডাকবে না - আহা - তাই আমি ডাকি। সকাল সকাল কিছু পুণ্যের কাজ করে দিনটা শুরু করি।
চোখটা ছলছল করে উঠলো!
বিদেশ ট্যুরটা ভালোই শুরু হল। এমন ট্যুর গুলো মাঝে মাঝে বেশ বোরিং হয় – সারাদিন কাজ কর্ম করে আবার রাতের বেলায় বিজনেস ডিনার। বিজনেস কি হয় বলতে পারব না – তবে পাবলিক গ্যালন গ্যালন মদ পান করে। আবার হোষ্ট-দের হালকা পাকা-ও থাকে – তারা আবার আগে থেকে জিজ্ঞেস করে নেব, আজকে কি ধরণের ক্যুজিনে যাওয়া যায়? কিছু ডায়েটারি রিকোয়ারমেন্ট আছে কিনা ইত্যাদি। আগে বলতাম, “আই ক্যান ইট এনিথিং”, অনেক দিন আগে চীনে এই বাক্য বলার পর পাতে যা পেয়েছিলাম তার পর থেকে হালকা মডিফাই করতে হয়েছে আমার দাবী। এখন বলি, “আই ক্যান ইট এনিথিং ডেড”।
সেদিন শহরের বিখ্যাত সী-ফুড রেষ্টুরান্টে যাওয়া ঠিক হল। সপ্তাহের মাঝে বলে বিশাল কিছু ভীড় ছিল না – তবে টেবিল সব মোটামুটি ভরা। সেই রেষ্টুরান্টের শেফ আবার ইতালিয়ান! তেনার পরামর্শ অনুযায়ী এক ডিস অর্ডার করলাম।
বেশ খানিক পরে ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়ে খাবারটা টেবিলে নামিয়ে দিয়ে গেল। সে জিনিস দেখে ভাবলাম মুড়িঘন্ট দিয়ে গেল বুঝি! মেন কোর্স, মানে আরো বেশী ভাত দিয়ে যাবে খানিক বাদেই। জিভে জল আসছে ভেবেই। বিদেশে বসে মুড়ি ঘন্ট ভাবা যায়! ডিসটায় চোখ বুলিয়ে মাছের মাথা ভাঙ্গার টুকরো খুঁজছি, কিন্তু চোখেই পড়ছে না কিছু!
নিজেকে প্রবোধ দিলাম এই বলে যে, সব সাহেব মানুষ এটুকু খামতি মাফ করে দেওয়াই যায়!
বসেই আছি - বাকিদের খাবার চলে এল, তারা খেতে শুরু করল। আমি বসে আছি দেখে একজন জিজ্ঞেস করল,
- কি হল, খাবে না?
- আসলে ওয়েট করছি মেন কোর্সের জন্য
- মানে?
তার 'মানে' প্রশ্ন শুনে আমার ব্রেন বিপদ সংকেত পাঠিয়েছে। বাস্তব বলছে এটাই তাহলে মেন কোর্স, কিন্তু মন মানতে চাইছে না!
খাবারের পরিমাণ দেখে হয়ে গেছে! এটা খেয়ে পুরো রাত কাটাতে হবে!! আমার ভাইপো ছয় মাস বয়সে এর থেকে বেশী ভাত খেয়েছিল নিজের অন্নপ্রাশনে!
ভেবে দেখলাম ভুল আমারই। আমাকে এই বিখ্যাত সী-ফুড রেষ্টু্রান্টে এনে মেনু কার্ড দিয়ে বলা হল কি খাবে? ইংরাজীতে লেখা থাকলেও একটা খাবারের নাম বুঝতে পারলাম না! কিন্তু চাষার ছেলে হলেও বুদ্ধি খাটিতে চাল দিলাম ভাঙলেও মচকাবো না এই টাইপের। বললাম,
"তোমরা যা রেকমেন্ড করবে তাই খাবো"
বিশাল ভুল করলাম! এটা শুধু ঐতিহাসিক নয়, একেবারে প্রাগঐতিহাসিক ভুল যাকে বলে
প্রায় কাঁচা চাল। দাঁতে কেটেই পাশের জনকে
- চাল তো সেদ্ধ হয় নি!
- মানে?
আবার আমার অ্যান্টেনা সংকেত পেল। কিছু না বলে সেই প্রায় কাঁচা চাল খেলাম, মাঝে মাঝে চিঙড়ি, শামুক এই সব মুখে এল
রিসোত্তো না কি যেন একটা নাম বলল! বিখ্যাত ইতালিয়ান ডিস নাকি এটা!
ইতালিতে কি আগুনের অভাব নাকি যে ব্যাটারা চাল সিদ্ধ করে না!
এমনটাই ভাবতে ভাবতে ফিরলাম যে তাহলে কি ইস্কুলে আমাদের ইতিহাস ভুল শেখালো?
রোম যখন পুড়ছিল তখন সম্রাট নীরো নাকি বেহালা বাজাচ্ছিলেন! তা আগুনই যখন পর্যাপ্ত ছিল, তখন বাপ চালটা আর একটু সিদ্ধ করলে কি ক্ষতি হত!
তার পরের দিন বিজনেস ডিনার কাটিয়ে নিজে নিজেই খেতে বেরোলাম – মানে এক্সপ্লোর করা যাকে বলে। আপনারা অনেকেই হয়ত নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন যে নামী বা জমকালো রেষ্টুরান্টে একা একা খেতে যাওয়ার থেকে বোরিং আর কিছু হয় না! তাই এবারে এক বিশাল জমকালো না হলেও দারুণ রেটিং এর এক রেষ্টুরান্টে খেতে ঢুকলাম। বিশাল খিদে পেয়ে গিয়েছিল – সামনে যে মেন কোর্সের বেশী দাম সেটাই অর্ডার করে দিলাম, পরিমাণে বেশী হবে ভেবে!
এদিন একা একা বসে আছি বলে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে চলেছিলাম – আর যাকে অর্ডার দিয়েছি তার গতিবিধির উপরে তো বটেই! কিচেন থেকে ডাইনিং-এ বড় রেকাবি-তে খাবারের প্লেট নিয়ে প্রবেশ করার পর থেকেই ওয়েটার এর উপর আমি তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলেছিলাম। কারণ সেই রেকাবিতে বসানো হরেক প্লেটের মধ্যে একটা আমার ডিনার।
অবশ্য এই ভাবে চোখে চোখে রাখা আমার কাছে নতুন কিছু নয়। হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইন লোকালে হকার ভাইদের মাঝে মাঝে এমন চোখে রাখতে হত – ধরুণ আপনি আপেল পছন্দ করে দিলেন হকার ভাইয়ের হাতে যেগুলো আছে তার মধ্যে পাঁচটা – এবার সাথে তার দাঁড়িপাল্লা নেই, বলল ঝাঁকা থেকে ওজন করে এনে দিচ্ছি! ব্যাস – আপনাকে এবার পুরো ট্র্যাক করে যেতে হবে চিকচিকি পলিথিন আপনার হাতে না আসা পর্যন্ত। সেই হকার ভাই আপনার কাছ থেকে যাবার সময় এবং আপনার কাছে ফিরে আসার সময় আপেল বিক্রী করতে করতেই যাবে! এদিকে আপনার টেনশন বাড়তেই থাকবে যে আপনার পছন্দের আপেল সে অন্য কাউকে দিয়ে দিল কিনা!
ঠিক তেমনি সেদিনের ওয়েটার ভাই রেকাবি থেকে একটা করে প্লেট অন্য টেবিলে দিচ্ছে আর আমার বুকে ধাক্কা লাগছে। অবশ্য কি খাবার অর্ডার দিয়েছি তা জানি না ঠিক – ছবি দেখে ভাতের মত মনে হল বলে আঙুল দিয়ে সেই ডিস দেখিয়ে ‘এই তাহলে কথা রইল’ বলে হেসেছি খানিক আগে। এবার ছবির সাথে বাস্তব না মিললে! রেষ্টুরান্টে সামনের টেবিল ছাড়া তখনো বেশী লোক আসে নি। রেকাবি থেকে অন্য প্লেট গুলো সেই টেবিলে ডাউনলোড হচ্ছে, আর একটু পাশে থাকা একটা জিনিস দেখে আমার মন নষ্টালজিয়ায় ভরে উঠছে লক্ষ্মী স্যারের কথা ভেবে।
লক্ষ্মী স্যার আমাদের ভূগোল পড়াতেন – অত্যন্ত ভালো মানুষ। সমস্যা একটাই হালকা ছিল যে - বাজারের আলু, পটল, মিষ্টির দোকানে খাজা উঠেছে কিনা, ফুলকপিতে ঠিক কোন সময়ে পোকা কমবে, কিষাণ বিকাশ পত্রের সুদের হার বাড়বে কিনা – সেই সব ব্যাপারে স্যারের যা জ্ঞান ছিল, তার কণামাত্রও ভূগোল বিষয়টায় ছিল না। সেই সময়ে ইন্টারনেট ছিল না – বইয়ে রঙীন ছবি তো দূরের কথা এমনি ছবিও ভাবা যেত না। ফলে টানা দুই বছর ‘জমাট বাঁধা লাভা’ শব্দবন্ধ শুনে শুনে মুখস্ত হয়ে গেলেও স্যার ছবি দেখিয়ে কোনদিন বোঝাবার সুযোগ পান নি।
তা খাবার প্লেটটা নিয়ে ওয়েটার কাছে এগিয়ে আসছে, আর আমার সন্দেহ গাঢ় হতে হতে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল টেবিলে এই থালা নামালেই! এ জিনিস দেখলে লক্ষ্মী স্যারকে আর ‘জমাটবদ্ধ লাভা’ আমাদের দেখাতে না পারার মনকষ্টে ভুগতেন না! নষ্টালজিক হয়ে তাই বাংলাতেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “এটা তো স্যারের জমাটবদ্ধ লাভা!” ওয়েটার জমাটবদ্ধ কি জিনিস বুঝতে না পরলেও, লাভা শব্দটি বুঝতে পেরেছে
- স্যার লাভা বলতে আপনি কি বলতে চাইছেন? ডেজার্টে আছে লাভা কেক। তবে আমাদের এই রেষ্টুরান্ট নেই
- দিস লাভা ইজ নট দ্যাট লাভা
- তাহলে?
আসলে ওয়েটারকে বলতে চাইছিলাম যে রান্না ঘরে এই প্লেটে প্রথমে ম্যাগমা ছিল – রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমে আসার সময় বাতাসের সংস্পর্শে সেই ম্যাগমা পরিণত হয়েছে লাভায়। কিন্তু ইংরাজী জ্ঞানে কুলাবে না বলে চেপে গিয়ে প্লেটের দিকে আঙুল দেখালাম। ওয়েটার আবার ভুল বুঝে উত্তর দিল, পাইয়া।
এমন আমার সাথে আগে হয়েছে, স্কিপোল এয়ারপোর্টে ইমিগ্রাশন ছোকরা স্ট্যাম্প মেরে পাসপোর্ট ফেরত দেবার সময় বলেছিল ‘নমস্তে’। আমি ঘাবড়ে গেলে সেই ছোকরা জানিয়ে ছিল যে তার ইন্ডিয়ান গার্লফ্রেন্ড হয়েছে তাই হিন্দী শিখছে দু-একটা। আমি তাই ভেবে নিলাম সেই ওয়াটারের হয়ত বাঙালী বান্ধবী – তাকে ইমপ্রেস করার জন্য বাংলায় ‘পাইয়া’ বলছে। তাই তার ভুল শব্দ প্রয়োগ ঠিক করে দেবার জন্য বললাম, “‘পাইয়া’ নয়, তুমি খাবার ‘আনিয়া’ দিলে কিচেন থেকে”। কিন্তু ভবি ভুলবার নয়, ডিসটার দিকে আঙুল দেখিয়ে আবার বলল ‘পাইয়া’।
আমার মাথায় বিদ্যুত ঝলকের মত খেলে গেল যেটার অর্ডার দিয়েছিলাম সেই খাবারের নাম ‘পাইয়া’ নয়ত! মনে পড়ল স্প্যানিশ রেষ্টুরান্টেই এসেছি যাদের প্রায় ন্যাশানাল ডিস। পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনের মতই ছবি আর বাস্তব মিলল না। ভাত মাছের ছবির মত দেখে পাইয়া অর্ডার করলাম, আর এল এই জমাট বদ্ধ লাভা! লাল রঙের ক্যাপিসিকাম ছড়িয়ে দিয়েছে প্লেটময়।
সি-ফুড ‘পাইয়া’ অর্ডার দিয়ে যা পেলাম, সেটার থেকে নিমোর বুধো কলু ভালো খিচুড়ি রাঁধে পুজোর বিসর্জনের দিন! কিন্তু সে খিচুড়ী খাওয়া যায় –
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।