সেবারে ব্রুনাই-য়ে এম্পায়ার হোটেলে তেমন কোনো কারণ ছাড়াই ঘুরতে গিয়ে দিনটা শুরু হল ব্রেকফাস্ট টেবিলে হালকা দাম্পত্য টানাপোড়েনের মাধ্যমে। প্লেটটা সবে নামিয়েছি কি – সেই দেখে বউ মুখে খাবার তুলতে গিয়ে থমকে গেল
-এই সকালে তুমি ভাত খাবে?
-না, মানে, ওই আর কি
-ফুটবল মাঠের মত বড় জায়গায় খাবার সাজানো আছে কাউন্টার জুড়ে, আর তুমি খুঁজে খুঁজে নিয়ে এলে ভাত! এত সকালে কেউ ভাত খায়!
কী আর বলি! বউয়ের তখনো মালয় থেকে শুরু করে ওদিকে ফিলিপিন্স – এদের খাদ্যসংস্কৃতি নিয়ে তেমন পরিচয় হয়নি। আমিও প্রথমদিকে অফিসে প্রচণ্ড অবাক হতাম – ওদিকে অফিস খুব সকালে শুরু হয়, যেমন আমাদের অফিস ৭.৩০ থেকে শুরু হত। স্থানীয় লোকেরা কম্পিউটার সুইচ অন করে ক্যান্টিনে চলল – আর সেখানে গিয়ে দেদার ‘নাসি লেমাক’ সাঁটাচ্ছে! এই যে সকাল থেকে শুরু হল ‘নাসি লেমাক’ খাওয়া – এটা কিন্তু সারাদিনই পাওয়া যায়, আপনি চাইলেই এবং এরা সারাদিনই সেই নাসি লেমাক বারে বারেই খেয়ে যেত! নাসি লেমাক হল গিয়ে নারকেলের দুধ দিয়ে সিদ্ধ ভাত – যা পরিবেশন করা হয় মশালাদার সম্বল, সিদ্ধ ডিম, বাদাম, শসার টুকরো এবং ভাজা অ্যাঞ্চোভি-র সাথে। অ্যাঞ্চোভি-কে একপ্রকার চুনো মাছই ধরতে পারেন। মাছভাত তো বেশির ভাগ বাঙালিরই খুব প্রিয়, কিন্তু তা বলে ঘুম থেকে উঠে, দাঁত মেজেই মাছ-ভাতে মন দিচ্ছে লোকে – এমনটা মানিয়ে নিতে ক’দিন সময় লেগেছিল, এই আর কি!
তবে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এইসব আর বউকে শেখাতে গেলাম না – হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে, বা নিজেই কালেকালে দেখে শিখে নেবে। এই সব ভেবে নম্রভাবে নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করলাম বউয়ের কাছে –
-আসলে কি জানো তো, যাচ্ছিলাম মুসলি-যোগার্টের দিকে, কিন্তু পথে চলে এল ভাতের স্টেশন
-তাতে কী হল, স্টেশন এলেই যে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়তে হবে, এমনটা কোনো কথা নয়!
-সেটা তুমি টেকনিক্যালি ঠিকই বলেছ। কিন্তু সবসময় টেকনিক্যাল জিনিস দিয়ে তো আর ইমোশ্যনাল ব্যাপার ব্যখ্যা হয় না!
-এর মধ্যে ইমোশন এল কোথা থেকে?
এবার আমার আরো ইমোশন্যাল হয়ে ওঠার পালা – বললাম,
-তুমি এটা বলতে পারলে চাষার বাড়ির বউ হয়ে! ভাতের সাথে ইমোশন নেই?
-ঠিক আছে, ঠিক আছে, এনেছ যখন ট্রাই কর, বেশি বকবক করলে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে
-তবুও তুমি তুললে যখন প্রসঙ্গটা, আমি খোলসা করেই বলি। ভাত যে খাব এমন প্ল্যান করে আমি যাইনি। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম – ধবধবে সাদা ভাত দেখে, কী চালের ভাত টেস্ট করার ইচ্ছে হল – মিনিকিট, নাকি লাল-স্বর্ণ?
-ফালতু কথা বলার অভ্যেসটা তোমার গেল না! বাসমতি আর গোবিন্দভোগ চালের পার্থক্য করতে পারে না, আর উনি করবেন ব্রুনাইয়ে বসে চালের বিচার!
মনে মনে খুবই অপমানিত হয়ে প্রতিবার যা করি এবারেও তাই করলাম – চুপ করে গেলাম। কিন্তু আমি চুপ করলেই কি আর চান্স পেলে বউয়ের জ্ঞান দেওয়া থামবে! তিনি বলেই চললেন
-সকালে একটু হেলদি খাবে তো! এই দ্যাখো আমি কী নিয়েছি ব্যালেন্স করে – খানিক সবজি, সসেজ, ফেটা চিজ, লেটুস, অলিভ। আর তোমার প্লেটে শুধু কার্ব!
-কার্ব বলে আমার প্লেটে কোনো খাবার নেই, ঠিক করে দেখ!
-উফ্! কার্ব মানে কার্বোহাইড্রেট! ভাত আর রাইস-নুডলস নিয়ে এসেছ প্লেট ভরে
-শুধু কি তাই এনেছি? সাথে লেটুস পাতা আর ডিম-ও তো এনেছি
-ও হ্যাঁ, বাই দি ওয়ে, তুমি আবার ডিম এনেছ? ডিমের কুসুম খাচ্ছ দেদার! একটু আগেই তো আরেকটা ডিমের ওমলেট বানিয়ে আনলে!
এই বলে বউ টেবিলের ওদিকে রাখা বেশ খানিকটা অভুক্ত ওমলেটের দিকে আমার নজর আনল। আমি জানালাম
-ওটা পুরোপুরি শেষ করতে পারিনি। অমলেট খেতে গিয়ে দেখি ভিতরটা একেবারেই কাঁচা, মনে হচ্ছে রানিং নোজের মত! মানে বাংলায় যাকে বলে...
-থাক খাবার সময় আর বলতে হবে না, তোমার উপমা আমি অনুধাবন করতে পারছি!
-দ্যাখো, একটা মনের ভাব প্রকাশ করে রাখি এইবেলা, শুধু ফেটা চিজ, অলিভ আর লেটুস পাতা খেয়ে লাঞ্চ পর্যন্ত আমি টানতে পারব না বেড়াতে বেরিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে খুবই ক্লান্ত হয়ে যাব! তাই কার্ব আমার চাই – যেকোনো ফর্মেই হোক না কেন!
যাই হোক, সেদিন এইভাবেই ব্রেকফাস্ট খতম হল – আর আমি ঠিক করে নিলাম সেই পুরানো সেফ স্ট্র্যাটিজিতেই ফিরে যাওয়া ভাল – “ইফ সামথিং ওয়ার্কস, ডোন্ট ট্রাই টু চেঞ্জ ইট!” অর্থাৎ সকালে বউ যখন সাজুগুজুতে ব্যস্ত থাকবে, আমি যুতসই টেবিলে গিয়ে বসছি বলে, কন্ট্রোভার্সিয়াল খাবারগুলি আগেভাগে সাঁটিয়ে নেওয়া!
এর কিছুদিন পরের কথা – জাপান ঘুরতে গেছি। সারাদিন ঘুরেফিরে ক্লান্ত হয়ে একটা ফ্যান্সি রেস্টুরান্টে প্রচুর খেয়ে ফেললাম। অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন, যে বিদেশে একটু উপরের দিকে রেস্টুরান্টগুলোতে যদি এক সন্ধ্যেয় ডিনারের জন্য টেবিল বুক করেন, তাহলে ওরা এটা ধরেই নেয়, যে গোটা সন্ধ্যেয় আপনারা সেই টেবিলে বসে খাবার নিয়ে ধ্বস্তাস্বস্তি করবেন এবং সাথে গুলতানি। তাই আপনার পাশে কেউ এসে ফিসফাস করে বলবে না, যে খাওয়া হয়ে গেল কিনা, বা বিলটা রেডি করবে কিনা! অবশ্য আপনি যদি তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে যান, সেই টেবিল ফাঁকা হলে পরের কাস্টমার বসবে। কিন্তু আপনার চাপ নেই বাঙালির বিয়ে বাড়ির মত, যে আপনি খাচ্ছেন আর আপনার চেয়ারটা ধরে সম্পূর্ণ অচেনা কেউ দাঁড়িয়ে আছে পরের ব্যাচ খাবে বলে! সে পারলে গরমজল-পাতিলেবু-নুন দিয়ে আপনার হাত-মুখটা মুছিয়ে দেয় আর কি!
তো যাই হোক, সেদিন রেস্টুরান্টে এইভাবে সারা সন্ধে খেয়েখেয়ে এত বেশি পেট ফুলে গেছে, যে কিছু ডাউনলোড না করলে ডেসার্ট আর আপলোড করতে পারব না। এদিকে রেস্টুরান্ট বন্ধের সময় হয়ে যাচ্ছে – আমি টয়লেটের দিকে রওনা দেবার আগে ওয়েটার-কে ডেকে ডেসার্ট মেনু-টা টেবিলে দিয়ে যেতে বললাম। আর বউকে বললাম, “তুমি একটা ভালো দেখে ডেসার্ট অর্ডার করে দাও, আমি আসছি চট করে। তুমি তো জানোই কী কী জিনিস পছন্দ করি”।
টয়লেট থেকে ডাউনলোড করে ফিরে এসে দেখলাম ডেসার্ট প্লেট তখনো আসেনি। বউ-য়ের কাছে কনফার্ম হবার জন্য জিজ্ঞাসিলাম –
-ঠিক ঠাক অর্ডার করেছ বেশি করে? মানে দুটো আলাদা ডিশ? ওই একটা ডিশ নিয়ে চামচ দিয়ে আমি কিন্তু ঠুকরোতে পারব না!
-হ্যাঁ গো, তোমায় চিন্তা করতে হবে না। সংসার করছি তো অনেকদিন হল!
-কী অর্ডার করলে? তিরামিসু? চিজ-কেক? আইস-ক্রিম?
-একটু ওয়েট কর না – সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।
খানিক পরে যে জিনিস নামিয়ে দিয়ে গেল টেবিলের সামনে, তাতে পুরোই সারপ্রাইজ! আমার প্রায় চোখে জল চলে এল। ওয়েটারের হাতে দুইখান ডিশ ছিল। আইসক্রিমের ডিশটা নামাতে গেলে, আমি বললাম – এদিকে, এদিকে। কিন্তু বউ মাঝে থামিয়ে আইসক্রিমের ডিশটা নিজে নিল – আর আমাকে দিল এটা –
-কী হল এটা? আমি এগুলো খাব?
-হ্যাঁ, খাবে তো! ক’দিন যা আজেবাজে খাচ্ছো – একটু স্বাস্থ্যকর খেতে প্রবলেম কী?
-তা বলে এই রাতের বেলা খাওয়ার পর ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট খাব! এর থেকে তুমি লেড়ো আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে পারতে, আমি কফিতে ডুবিয়ে খেয়ে নিতাম!
-বাজে না বকে চুপটি করে খেয়ে নাও
আমাকে চুপ করে যেত হল – কিন্তু মিষ্টি না খেতে দিয়ে আমাকে করা সেই অপমান আমি ভুলিনি! প্রতিশোধ নেবার জন্য ওঁত পেতে থাকতাম।
ওই ইংরাজি প্রবাদবাক্যে তো বলাই আছে, “রিভেঞ্জ ইজ্ এ ডিশ বেস্ট সার্ভড কোল্ড” – তো এটা পড়েই আমি বুঝেছিলাম যে ঠান্ডা আইসক্রিম ডিশের সাথেই প্রতিশোধ নিতে হবে।
আপনারা এটাও লক্ষ্য করেছেন হয়তো, যে মেয়েরা বাইরে বেরিয়ে – বিশেষ করে বেড়াতে গিয়ে – ছেলেদের থেকে কম যাতাযাত করে টয়লেটের দিকে। তাই বউয়ের অনুপস্থিতিতে যে অন্য ডেসার্টের অর্ডার করব, তেমন চান্স আর আসছিল না চট করে!
কয়েক মাস পরে অন্য এক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে সুযোগ এসে গেল – উপরের বর্ণিত ঘটনার ঠিক উল্টোটা ঘটল। বউ বলল –
-অ্যাই শোন না, তুমি ডেসার্টের অর্ডার আমারটাও দিয়ে দাও। একটু আসছি রেস্টরুম থেকে। তুমি তো জানই আমি কী ভালোবাসি!
মনে মনে ভাবলাম – বিলক্ষণ জানি! এস তুমি ফিরে। মুখে বললাম –
-অবশ্যই, তুমি নিশ্চিন্তে রেস্টরুমে ঘুরে এস। আমি অর্ডার করে দিচ্ছি।
খানিক পরে বউ ফিরল – ওয়েটার তারও খানিক পরে দুই ডিশ নিয়ে হাজির হল। এবার আইসক্রিমটা ওদিকে নামাতে যেতেই আমি হাঁইহাঁই করে উঠলাম, ওটা এদিকে দিন বলে। আর অন্য প্লেটটা ওনার
সেই প্লেট দেখে বউয়ের চোখ ঠিকরে এল – বলল,
-কী হল এটা? আমি এগুলো খাব?
-হ্যাঁ, খাবে তো! ক’দিন যা আজেবাজে খাচ্ছ – একটু স্বাস্থ্যকর খেতে প্রবলেম কী?
ফেরার সময় বউ অনুযোগ করল – “এমন করলে তুমি আমার সাথে”! রাতের বেলা বউয়ের সাথে ঝগড়া করতে নেই বলে, আমি পরিবেশটা হালকা করার জন্য বললাম – “আগের বারের কথা মনে নেই, একটু প্র্যাক্টিক্যাল জোক করলাম তোমার সাথে”।
ইংরাজি প্রবাদ বাক্য তো আর জানা নেই বেশি – তবুও দু’চারটে শিখে রাখতে হয়েছে ঠ্যাকায় পড়লে চালিয়ে দেবার জন্য; ‘রিভেঞ্জ ইজ্ এ ডিশ বেস্ট সার্ভড কোল্ড’ যেমন!