আগের কয়েক পর্বে ঘুরেফিরে কয়েকবার আরবিক খাবার নিয়ে লিখেছি। এই ক্যুজিন নিয়ে আমার হালকা দুর্বলতা আছে, দুর্দান্ত লাগে – ওদের সেই বিখ্যাত রুটি থেকে শুরু করে হমুস, ল্যাম্বের স্পেশাল ডিশগুলি, বিশেষভাবে বানানো রুটি-রাইস, মিষ্টি সহ আরো নানাবিধ খাবার। কাতারে আরবিক খাবার যে ভালো হবে সেটা বলাই বাহুল্য – তবুও বলে রাখি, এখানকার স্থানীয় ক্যুজিন এককথায় দারুণ এবং তার জন্য আপনাকে যে কোনো আপ-স্কেল রেস্টুরান্টে যেতে হবে তা নয়। কাতারের রাজধানী দোহা শহরে যে শুক্ (মানে ওই বাজার-টাইপের আর কি) আছে, সেখানে বেশ কিছু খুব ভালো আরবিক রেস্টুরান্ট আছে। আজকের পর্বে থাকবে কাতারে আপ-স্কেল কয়েকটা রেস্টুরান্টে খাবার গল্প – খাওয়ার সাথে সাথে পরিবেশন এবং পরিবেশ সব মিলিয়ে একটা ‘ডাইনিং এক্সপিরিয়েন্স’ যাকে বলে।
সেবারে কোম্পানির কাজে গেছি – শুধু কাজ হবে আর খাওয়া হবে না, সেটা তো আর হয় না! সারাদিন মিটিং-এর ফাঁকে প্রচুর খেলাম। কাতারে যে টিমের সাথে কাজ করি, সেই টিমের এক স্থানীয় মেয়ে আবার খুব ভালো বেক্ করে। সেই মেয়ে একদিন সকালে দেখি, সুন্দর সব কুকি এবং কেক বানিয়ে হাজির – অতিথি আপ্যায়ন হল আর কি। এ তো গেল সকালের স্ন্যাক্স্ – দুপুরের দিকে সেই করিৎকর্মা মেয়ে স্থানীয় কোনো – স্পেশাল ডেলিভারি দেয় এমন – খাদ্য সরাবরাহকের সাথে কথা বলে এলাহি আয়োজন করে ফেলেছে দেখি লাঞ্চের। সেইসব খেয়ে পেট পুরো ঠোস মেরে গেল – লাঞ্চের পর মিটিং করতে গিয়ে চোখ খুলে রাখা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে এল।
যাই হোক, পেট যতই ভরা থাকুক, রাতে অতিথির সাথে ডিনার হবে না এমন ভাবাও পাপ! একদিন ঠিক হল, দোহা মূল শহরে, ইদানিং বিশাল নাম করেছে এমন, একটা ইতালিয়ান রেস্টুরান্টে খেতে যাওয়া হবে। সেই রেস্টুরান্টটি আছে ‘আলহাজম্ মল’-এ, যেটা দোহা শহরের আপ-স্কেল নতুন মল। আল-হাজম-কে তর্জমা করলে দাঁড়াবে “দ্যা হায়ার গ্রাউন্ডস্” – তা সে উচ্চ জায়গাই বটে! লাক্সারি ব্যাপারের হদ্দমুদ্দ যাকে বলে।
ছবি দেখলে হয়তো হালকা টের পাবেন। এই শপিং মলের সব রেস্টুরান্টই প্রচণ্ড জমকালো টাইপের – তবে তেমন স্নবারি দেখলাম না। মানে বলতে চাইছি, কেমন খাচ্ছি, কে দেখল, কী ভাবে খেতে হয় – এই সব জাগতিক চাপ না নিয়ে জমিয়ে খেয়ে নেওয়া যায়। এই শপিং মলে ‘মিডিল ইস্টার্ন’ ক্যুজিন-এর মধ্যে আছে কাতারি রেস্টুরান্ট ‘আল মানচাব’। লেবানিজ রেস্টুরান্ট-এর মধ্যে আছে ‘ডার আল কারাম’; আর যেটা চট করে শপিং মলে দেখিনি খুব বেশি – ‘তখত-এ-জামসিদ’ নামে এক পার্সিয়ান রেস্টুরান্ট।
এছাড়া পৃথিবীর নানা দেশের নির্বাচিত কিছু রেস্টুরান্টও দেখলাম – যেমন লাতিন আমেরিকান রেস্টুরান্ট, ‘সিগনর সাসসি’ এবং ‘সাসো’ নামে ইতালিয়ান রেস্টুরান্ট দুইখান, মিক্সড ইন্টারন্যাশনাল মেনু পাওয়া যায় এমন খানকয়েক লাউঞ্জ, ফ্রেঞ্চ রেস্টুরান্ট ‘ল্যে ট্রেন ব্লিউ’, একখানি এশিয়ান রেস্টুরান্ট, ‘দিয়া’ নামে এক ভারতীয় রেস্টুরান্ট – আর বলার মত আছে এক জমকালো সি-ফুড এবং এক স্টেক-হাউস।
সেদিন আমরা সকাল থেকে আরবিক/মিডল-ইস্টার্ন খেয়ে যাচ্ছিলাম বলে আমাদের হোস্ট বাছল ইতালিয়ান রেস্টুরান্ট। আমাকে আর মুখ খোলার অবকাশই দিল না – কারণ ইতালিয়ান ক্যুজিন আমার সবসময়ই ফেভারিট, অবশ্য যদি ভালো করে বানাতে পারে তবেই! রেস্টুরান্টে গিয়ে দেখা গেল, দুটো অপশন আছে – ভিতরে বসে খাওয়া এবং আউটডোর ডাইনিং। অবশ্যই আউটডোর ডাইনিং বেশি আকর্ষণীয়, বাইরে ১২ ডিগ্রি ঠান্ডা এবং হালকা বাতাস বইছে। এই অবস্থায় আউটডোর ডাইনিং করার কী মানে কে জানে! আমি মৃদুভাবে ভাবপ্রকাশ করলাম, দাদা, বাইরে কি খেতেই হবে? এদিকে আমার হোস্টের সেই রেস্টুরান্ট খুব ভালো লেগেছে আগের বার খেয়ে, তাই এইবারেও অতিথিসৎকার করতে বাইরেই বসা ঠিক হল। আমাকে আশ্বস্ত করা হল এই বলে, যে দেশে প্রচুর গ্যাস – তাই নাকি খেতে বসে ঠান্ডা লাগলে আমার পিছনে গ্যাসবাতি জ্বেলে দেবে! তাহলে আর ঠান্ডা লাগার চান্স নেই।
বলাই বাহুল্য, স্টার্টার আসার আগেই আমার ঠান্ডা লাগল। মূল কারণ, অন্যদের মত আমি প্রস্তুতি নিয়ে যাইনি নিজের গায়ে ঢাকাঢুকি দিয়ে। বলতে নেই, বলার সাথে সাথে গ্যাসবাতি জ্বেলে দিল, কিন্তু সেই বাতি টেনে এনেও আমার পাশ পর্যন্ত পৌঁছাল না। টেবিলে বসে মেনুকার্ড দেখে উত্তেজিত হয়ে গিয়ে ঠান্ডা অনুভব করলাম না সেই ভাবে। অ্যাাপেটাইজার অর্ডার করা হল অনেকগুলি – আইডিয়া এই, যে শেয়ার করে খাওয়া হবে। সব কিছু মনে নেই কী খেয়েছিলাম, তবে এদের রেস্টুরান্টের স্পেশাল স্যালাড নেওয়া হয়েছিল – অ্যাসপারাগস, অ্যাভোকাডো, বাচ্ছা আর্টিচোক, আর মোজ্জারেল্লা চিজ দিয়ে বানানো – বেশ ভালোই খেতে ছিল – কেবল আর্টিচোক জিনিসটা আমি নিজে খুব একটা ভালো নজরে দেখি না, এই যা। এছাড়া ছিল মোজারেল্লা ইন কারোজ্জা (মোজারেল্লা চিজ ফ্রাই করে ট্যমেটো আর গার্লিক সস দিয়ে বানানো), ডিপ ফ্রায়েড কালামারি, স্প্রিম্প, স্ক্যালপ – চিলি সসের সাথে। এছাড়া আমাকে অবাক করে, কেউ একটা অর্ডার করল বেগুনের ডিশ – জানি বেগুন অনেক দেশে ডেলিক্যেসি, কিন্তু এত পয়সা খরচ করে বেগুন – পোড়া, ভাজা বা সিদ্ধ খাচ্ছি – তা সে ওরা যতই পারমাজন চিজ ছড়িয়ে দিক না কেন, এটা ভাবতেই কেমন লাগে চাষার ছেলে হিসাবে।
অ্যাপেটাইজারের উত্তেজনা থিতিয়ে গেলে বেশ ঠান্ডা লাগতে লাগল। তাই মেন কোর্সে পৌঁছনোর আগে আমাকে আবার ভাবপ্রকাশ করতে হল ঠান্ডা লাগার ব্যাপারে। এবার দেখলাম, ভিতর থেকে প্যাকেটের মধ্যে, কাচা, সুন্দর, মলমলে কম্বলের মত দিয়ে গেল হাত-পা ঢাকা দিয়ে বসতে। মেন ডিস শেয়ার করা হবে এমন ভেবে অর্ডার দেওয়া হল না – যে যার নিজের পছন্দ মত। এবার আমি অন্যেরটা নিয়ে একটু চাখলাম, সে ঠিক আছে – কিন্তু জন-প্রতি একটা করে মেন ডিশ অর্ডার দেওয়ার পক্ষেই আমি চিরকাল ভোট দিই। আমি নিজে অর্ডার দিলাম “ভিল-রিসত্তো”। ‘ভিল’ যাঁরা খাননি – তাঁরা ট্রাই করতে পারেন। আমি পৃথিবীর নানা দেশে ‘ভিল’ খেয়েছি এবং তার তুলনায় সেই দিনের দোহার ভিল খারাপ কিছু ছিল না। আসলে এদের ভিল ইমপোর্টেড ছিল – জিজ্ঞেস করে জানা গেল। অন্যেরা কেউ অর্ডার করল মাশরুম দিয়ে রিসত্তো, কেউ দিলো রাভিওলি (রিকোট্টা চিজ এর ফিলিং), কেউ দিল টর্টেলিনি (এদের শেফের হাতে বানানো) – সাথে চিজ এবং অ্যাস্পারাগস, এদের আর একটা ভালো ‘ভিল’-এর ডিশ ছিল মাশরুম ক্রিম এবং মাস্টার্ড দিয়ে সার্ভ করা। আরো ছিল কিছু কিছু ডিশ, সি-বাস এবং প্রনের। প্রথমে ঢুকে যেমন কুন্ঠা ছিল, যে খাবার কেমন হবে, মেন কোর্স শেষ করে তা উধাও হয়ে গেল। কারণ কাতারে পয়সার অভাব নেই বলে, মেক্সিকান বা বাংলাদেশী কুক দিয়ে ইতালিয়ান রেস্টুরান্ট চালাতে হয় না! খোদ ইতালি থেকে শেফ এসেছে এই রেস্টুরান্টে।
মেন কোর্স শেষ করে, বেশ করে কম্বল গায়ে জুত করে, ডেজার্টের মেনু দিতে হাঁক দিয়েছি কি দিইনি – হোস্ট জানাল ডেসার্ট-কফি হবে অন্য জায়গায়। বেশ জমিয়ে বসেছিলাম – কিন্তু কী আর করা, ভেবে উঠলাম –
তবে ডেসার্ট খেতে সেই অন্য রেস্টুরান্টে ঢুকে দিল-খুশ হয়ে গেল – বেশ মাথা খাটিয়ে এনেছে বটে! একটা ফ্রেঞ্চ দোকানে। সে এক এলাহি ব্যাপার – নাম ‘ল্যে ট্রেন ব্লিউ’। এই রেস্টুরান্ট আবার ফ্রেঞ্চ স্টাইলে সাজানো প্যারিসের গার-দ্যা-লিঁও রেলস্টেশনের মূল ‘ল্যে ট্রেন ব্লিউ’ রেস্টুরান্টের অনুকরণে। দোহার রেস্টুরান্ট কন্সেপচ্যুয়ালাইজ করতে এদের নাকি প্রায় দু’বছর সময় লেগেছিল আর বিগত একশ’ বছরে এই প্রথম নাকি ফ্রান্সের বাইরে দোহাতে এই রেস্টুরান্টের সেকেন্ড হোম যাকে বলে। চারিদিকে দেয়াল জুড়ে বিখ্যাত সব পেন্টিং এর রি-প্রোডাকশন, টেবিল চেয়ারের সাজসজ্জাও তেমন। গিয়ে বসলে এক রাজা-রাজা ভাব চলে আসতেই পারে আপনার মনের মধ্যে!
ফরাসীদের থেকে ভালো বেক কে আর করে! অভিজাত ফরাসী রেস্টুরান্টে মেনু কার্ডে খাবারের ছবি দেওয়া থাকবে, সেটা আশা করা যায় না – তাই উঠে গিয়ে ডিসপ্লে দেখে কেক-পেস্ট্রি পছন্দ করে এলাম – সাথে পান করলাম ওলং টি!
প্রচুর ডেসার্টের ভ্যারাইটি – পিস্তাচিও কেক, ভ্যানিলা ক্রিল ক্যারামেল, ফ্রেঞ্চ টোস্ট, প্যারিস ব্রিস্ট, স্ট্রবেরি কেক, চিজকেক উইথ বেরি, লেমন টার্ট, চকোলেট ও র্যাস্পবেরি সরবে – ইত্যাদি ইত্যাদি। মনটা খুশ হয়ে গেল। এমন খাবার বার বার খাওয়া যায় – এমন ভাবতে ভাবতে হোটেলে ফিরে এলাম।