ছেলে ছোকরাদের কাছে, বিশেষ করে ইউরোপিয়ান, তদুপরি বৃটিশদের কাছে আমস্টারডাম শহরের যে কি আকর্ষণ, সেটা হয়তো আপনাদের ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। তাই যখন ইংল্যান্ডে পড়াশুনা শেষ করে সবাই শুনল আমি আমস্টারডামে চাকরি নিয়ে শিফট হচ্ছি, বলাই বাহুল্য অনেকেই ঘুরতে আসতে চাইল। তারপরে যখন আমস্টারডামে গিয়ে থিতু হলাম, মাঝে মাঝেই অনেকে ঘুরতে আসত। তখনো ব্যাচেলর, আর সবারই বয়স তুলনামূলক কম – তাই থাকা নিয়ে চাপ কিছু ছিল না। আমার অ্যাপার্টমেন্টেই সবাই থেকে যেত – একটু অসুবিধা হত, অনেকে একসাথে চলে এলে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশ তো নয়, যে যেখানে সেখানে শুয়ে পড়লেই হল! তাই ক্যাঁথা-কম্বল ইত্যাদি কিনে এক্সট্রা জনাছয়েকের ব্যবস্থা করে রাখতে হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি বার আসত যোসেফ, আইরিন, জেন, ওলা, অ্যানা – এরা।
আমস্টারডামে তো টাইমপাস করার জিনিসের অভাব নেই! নানা জায়গায় খেয়ে, ঘুরে, দেখে বেড়াতাম। সেবারে বন্ধুবর্গ ঘুরতে এসেছে, কয়েকদিন জবরদস্ত খাওয়াদাওয়া, ছাদে বারবিকিউ হল। এমন অবস্থা হল খেয়ে খেয়ে – আমরা সকলেই প্রায় ক্লান্ত। তো সেদিন ঘুরতে ঘুরতে হালকা বিশ্রাম নেবার জন্য একটা পাবের সামনে বসেছি। খানিক পরে আমাদের টেবিলের কাছে এসে ওয়েট্রেস সবার ড্রিংকসের অর্ডার নিচ্ছে, যোসেফের পালা এলে, সে ছেলে বলে দেখি – “আজ আমি ‘মিন্ট-টি’ নেব”! আমি তো শুনে চমকে গেলাম – যোসেফকে জিজ্ঞেস করলাম, “মিন্ট-টি কি তুই জানিস, যে অর্ডার করছিস? চার বছর ধরে চিনি তোকে, কোকা-কোলা, এসপ্রেসো আর নানাবিধ অ্যালকোহল ছাড়া তো কোনোদিন কিছু পান করতে দেখিনি!”
যোসেফ বলল – ক’দিন বেশি খাওয়াদাওয়া হয়ে যাচ্ছে। তাই কন্ট্রোলে থাকতে হবে, স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে – বডি পিউরিফাই করতে হবে। এক্ষুনি বসে সে ঠিক করল – এবং আজ থেকেই তা চালু করবে। ততক্ষণে সেই মেয়ে অর্ডার নিয়ে চলে গেছে – আমরা ফালতু ভাটাচ্ছি। যোসেফকে এবার ওলা জিজ্ঞেস করল – জোয়ি, তুই জানিস, এই মিন্ট-টি কি?
ওলা জেনে অর্ডার দিয়েছিল মিন্ট-টি, আর যোসেফ না জেনে। কিন্তু সে দমবার পাত্র নয়, বলল, “শুধু তোদের ভারতের সাথেই কি বৃটিশদের কানেকশন আছে ভাবিস নাকি? আমাদের মলটা দেশ যে বৃটিশদের কলোনি ছিল, সেটাই তুই ভুলে যাচ্ছিস। এই দেখ না, কেমন সুন্দর কাপে গরম জল এবং পাশে মিন্ট-টি ব্যাগ দিয়ে যাবে। আমি ডোবাবো আর পান করব”!
এবার সুযোগ পেয়ে আমাকে হালকা জ্ঞান দিয়ে দিল মিন্টের উপকারিতা নিয়ে। মিন্ট-টি খেলে নাকি পেট পরিষ্কার থাকে, শরীরের রক্তের পরিশুদ্ধি, মুখের গন্ধ থেকে মুক্তি, ভিটামিন পাওয়া, মাথার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। সেইসব শুনে ভাবলাম, পুদিনার এত উপকারিতা জম্বুবানের জানা থাকলে, মনে হয় হনুমানকে আর ফালতু টেনশন নিতে হত না – পড়িমরি করে সঞ্জীবনী খুঁজতে বেরিয়ে!
এবার যখন দিয়ে গেল মিন্ট-টি, সেটা দেখে আমি ভাবলাম বলেই ফেলি যে মেয়েটা সার্ভ করছিল তাকে, যে, “ললিতে, বিছুটি পাতা গরম জলে ডুবিয়ে দেওয়া প্রকৃত অর্থে কেমন ব্যাপার!” নেহাত বিছুটির ইংরাজি জানি না বলে চুপ করে থাকলাম!
আমস্টারডাম বেড়াতে গেলে ভ্যান গগ মিউজিয়াম একবার অন্তত না ঘুরে আসা যেমন পাপ, তার থেকেও বড় পাপ হচ্ছে ‘অ্যাপল পাই’ না খেয়ে আমস্টারডাম ছাড়া! এই আপেল পাই-কে অবশ্য ওখানে অনেক সময় অ্যাপল টার্ট-ও বলা হয়।
আপেল পাই জিনিসটার সাথে যদি আগে পরিচিত না থাকেন, এবং আমস্টারডামে গিয়ে প্রথমবার ট্রাই করেন, তাহলে হয়তো আপনার মনে এটা হালকা ভাবে ভেসে উঠতে পারে, যে – এটা কি আর এমন ব্যাপার, যার জন্য এত নামডাক? খুব বেশি কারিকুরি তো দেখতে পাচ্ছি না এই আপেল পাই-এ! এই ভাবনাটা মনের মধ্যে এলেই নিজেকে একটু ক্যালিব্রেট করে নেবেন – ভেবে নিন আপনাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করছে প্যারামাউন্ট-এর সরবত, নকুড়ের সন্দেশ বা আমিনিয়ার বিরিয়ানি নিয়ে! এইসব খাদ্য এমন সুউচ্চ স্তরে পৌঁছে গেছে, যে পার্থিব তর্ক করে কিছু হবে না – যার হয়, তার হয় টাইপের কেস।
তাহলে এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, ডাচ আপেল পাই কি সত্যিই আলাদা কিছু – ফ্রেঞ্চ, আমেরিকান বা ইংল্যান্ডে যে আপেল পাই পাওয়া যায়, তার থেকে? দেখুন, একটা কথা বলে নিই, মিষ্টি জিনিস খেতে গিয়ে আমার মাথার ঠিক থাকে না প্রায় – তাই মিষ্টি নিয়ে কাউকে জাজ্ করতে গেলে আমি নিজেকে ক্রস-চেকড্ করিয়ে নিই। আমার যেটা মনে হয়েছিল, ডাচ পাইয়ের আসল পার্থক্য এদের সেই থিক ক্রাস্ট আর আপেল পাইয়ের উপরে মুখে জল আনা ক্রাম্ব টপিংটায়। এদিক-ওদিকে পড়ে এবং খোঁজ নিয়ে দেখলাম, বাকি জ্ঞানীগুণী লোকেরাও প্রায় সবাই একমত।
ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে গেলে, আপেল পাইয়ের উদ্ভাবন কিন্তু হল্যান্ডে নয় – অবশ্য ডাচেরা সেই দাবি করেও না। লিখিত ইতিহাসে আপেল পাইয়ের রেসিপি নাকি পাওয়া গেছে ইংলান্ডে, প্রথম সেই কোন ১৩৮১ সালে – আপেলের সাথে সেখানে মেশানো হয়েছিল পিয়ারস্, ফিশ, কিসমিস, হালকা স্যাফ্রন ইত্যাদি। ডাচেদের খাদ্য ইতিহাসে আপেল পাইয়ের প্রথম রেফারেন্স আছে ১৫১৪ সাল নাগাদ।
তবে যেমন তেমন আপেল ব্যবহার করলেই কিন্তু হবে না ডাচ আপেল পাইয়ে – জনতার দাবি দুই বা তিন ভ্যারাইটির আপেল মিশিয়ে কাজ সারতে হবে। জনপ্রিয় হচ্ছে ‘গোল্ডেন ডেলিসিয়াস’ এবং ‘গ্র্যানি স্মিথ’ আপেলের মিশ্রণ। আমার মনে হয় না অন্য প্রজাতির আপেল ব্যবহার করলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে! অনেক রেসিপি দেখেছি, যেখানে গালা, ফুজি, হনিক্রিস্প দেদার ব্যবহার করা হয়েছে। এবার ব্যাপার হল, রান্নার মধ্যে সায়েন্সের ব্যাপারটা তো হালকা থেকেই যায় – আপেলের মধ্যে ওয়াটার কনটেন্ট বেশ বেশি। তাই যখন আপনি বেক করতে গেছেন, তখন আপেল থেকে জল বেরিয়ে পেস্ট্রির ক্রাস্টটাকে বেশ ন্যাতন্যাতে করে দেয়। তো দাবি হচ্ছে, গ্র্যানি স্মিথ আপেল ব্যবহার করলে এমন জল কম বেরোয়, আপেল তার টেক্সচার ধরে রাখে বেকিং এর সময়েও। আর একটা জিনিস অনেকে করেন, তা হচ্ছে আপেলগুলোকে ফার্স্ট রাউন্ডে একবার বেক করে নিলেন, তাতে যা জল বেরোবার বেরিয়ে গেল।
আর আমস্টারডামে যদি আপেল পাই খেতেই হয়, তাহলে একটু টুক করে চলে যাবেন ‘উইঙ্কেল’ নামক ক্যাফে/রেস্টুরান্টে। ওই প্রিন্সেনগ্রাগট ক্যানেলের ধারে, বিখ্যাত ‘নুর্দমার্কট’-এর একদম পাশেই – যেখানে প্রতি শনিবার জমজমাট ওপেন মার্কেট বসে। আপনি যদি গাইড বুক ফলো করেন বা ট্রিপ অ্যাডভাইসার – প্রত্যেক জায়গাতেই উইঙ্কেল ক্যাফের নাম উল্লেখ থাকবেই আপেল পাই খাবার জন্য। আপেল পাই নেবেন, প্লেটের পাশে দিয়ে দেবে একটু হুইপড ক্রিম – সাথে থাকবে কফি এবং সামনের ক্যানালের অদ্ভুত সৌন্দর্য! যদি মিষ্টিতে এ্যালার্জি না থাকে, তাহলে মনে হবে শুধু এই জন্যই আমস্টারডাম ঘুরতে আসা যায়!