এবারে পুজোয় বাড়ি পৌঁছলাম একটু দেরি করেই। বাজারে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করার সময় ছিল না তেমন, আর অত ভিড়ে ইচ্ছেও ছিল না। তাই পরামর্শ পেলাম যে এমন সব মুহুর্তে শপিং মলে ঢুকে জিনিসপত্র কিনে নেওয়াই ভালো। সেইমত গিয়ে হাজির হলাম ওই বাইপাস ধরে ‘অ্যাক্রোপলিস’ মলে। আমার আবার শপিং মলে ঘোরার কথা শুনেই খিদে পেয়ে যায়। গিয়ে মলে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল। তাই প্রথমেই এই রুফটপের রেস্টুরান্টে হাজির হলাম। আমাকে বলা হল এই ‘ওজোরা’-র রিভিউ নাকি খুব ভালো। দিনের বেলা তেমন কেউ যায় কিনা জানি না, কিন্তু আমরা হাজির হলাম। একুশতলার সেই রেস্টুরান্ট – কার পার্ক থেকে রেস্টুরান্ট যাবার রাস্তা খুঁজে পেতেও বেশ বেগ পেতে হল।
যাই হোক, রেস্টুরান্টের প্রথম দর্শনে বেশ একটু হতাশ হলাম। যা নাম শুনেছিলাম, তাতে ভেবেছিলাম আরো জমকালো হবে ব্যাপারটা। এতে অবশ্য হয়তো আমারই দোষ – পাব কাম রেস্টুরান্টে হয়তো এর থেকে বেশি ব্যাপার আশা করা যায় না। সেই হতাশা খানিক মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলে আমাকে সাথীরা বলল, আরে এখানে পাবলিক আসে রাতের বেলায়, মূলত মাল খাওয়ার জন্য! তাই টেবিলের রঙ, চেয়ারের বিবর্ণতা এই সব নিয়ে মাথা ঘামাবার কার আর সময় আছে? এটা মূলত আমি বলছি ইন্ডোরের সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্টের কথাটা।
ভারতীয় সময়ে সাড়ে বারোটা মনে হয় লাঞ্চের ঠিক সময় নয়। আমরা ছাড়া তখনো কোনো খদ্দের নেই – কিছু টেবিল অবশ্য রিজার্ভ করা। দিনের বেলা বলে আউটডোর ডাইনিং তখনো চালু হয়নি। গিয়ে টেবিলে বসলাম, মেনু চাইতে ওয়েটার নিয়ে এল পুজো-স্পেশাল মেনু। সে কি অনুরোধ স্পেশাল মেনু থেকে চ্যুজ করার জন্য! বললাম, ভাই, স্পেশাল মেন ডিশ না হয় পছন্দ করছি – কিন্তু অ্যাপেটাইজার তো কিছু খেতে হবে নাকি? ড্রিংক্স আর অ্যাপেটাইজার অর্ডার দিয়ে বাইরেটায় বেরুলাম। ইন্ডোর ডাইনিং দেখে যেমন একটু খারাপ লেগেছিল, এই বাইরেটা দেখে মন ভালো হয়ে গেল। রোদ এবং গরম ছিল বলে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো গেল না, কিন্তু অনুমান করে নিতে কষ্ট হল না, যে রাতের দিকে এখানে বসে ডাইনিং করার অভিজ্ঞতা খারাপ হবে না খুব একটা – একুশ তলা থেকে দেখা যাবে রাতের কলকাতা। সেই ওয়েটার বলল, “ছবি তুলুন না ইচ্ছেমত, অসুবিধা নেই”। অসুবিধা কেন থাকবে, সেটা তখন বুঝতে পারিনি – কিন্তু সেদিন খেয়ে ফেরার পর লোকমুখে শুনেছিলাম ‘অসুবিধা’-র ব্যাপারটা।
তবে সেই ব্যাপারে রেস্টুরান্ট মালিকের দোষ দেওয়া যাবে না দেখতে গেলে। পুজোর সময়টা এদের খুব ভিড় হয়, আর অনেকদিন করোনার কারণে ব্যবসায় মন্দা চলার কারণে সব রেস্টুরান্টই চাইছিল পুজোর বাজারে জমিয়ে বিজনেস করতে। তা, সেই বিজনেস কি করে হবে, যদি দু’জনে গিয়ে ছয়শ’ টাকার পিৎজা কিনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি! যা শুনলাম, ইয়ং কাপল্দের কাছে এটা খুব জনপ্রিয় জায়গা। আমার নিজের অবাক লাগলেও সাথীরা মনে করিয়ে দিল যে, “সবার চক্ষু লজ্জা থাকে না”। নিয়ম না করে দিলে দু’জনে ছয়শ’ টাকা বিল করে সারা সন্ধ্যে কাটিয়ে দেবে! তাই এরা পুজোর সময় যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, সেটা একটু হালকা এক্সট্রিম মনে হলেও, নানা গল্প শোনার পর খুব একটা আর দোষ দেখতে পেলাম না। সন্ধ্যের দিকে ডাইনিং-এ গেলে প্রথমে পার হেড একহাজার করে ‘ডিপোজিট’ রাখতে হবে – মানে কাপল্-প্রতি দুই হাজার। এর কম টাকা বিল করলে টাকা ফেরত পাবেন না!
যাই হোক, টেবিলে ফিরে এসে স্টার্টার খেতে খেতে মেন ডিশের অর্ডার দিলাম সেই স্পেশাল মেনু থেকে বেছে। যে ডিশগুলো খেলাম তারই কয়েকটির বিবরণ নীচে রইল।
ডিশ – ১
যা সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল ওয়েটার, সেটা দেখে আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, “আমাদের খামখেয়ালিপনার আর কত মূল্য চোকাবে পৃথিবী?” খিদের মুখে সাধারণত আমি পৃথিবী নিয়ে ভাবি না – ইনফ্যাক্ট কিছু নিয়েই ভাবি না, কেবল খাবার ছাড়া। কিন্তু এই জিনিস খাওয়া যাবে কিনা বুঝতে না পেরে মাথাটা ঘুলিয়ে গেল একটু।
সে ছেলে দাবি করেছিল, যে তারা নাকি পরিবেশপন্থী, খুব সন্তর্পণে সব কিছু বাছাই করে। খুব ভালো লাগল শুনে – অর্ডার করেছিলাম।
কিন্তু যে ডিশ নামাল সামনে, তাই দেখে আমি সেই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম – “এই তোমাদের পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা?”
বাঁধাকপিগুলোকে বাড়তে দেয়নি পর্যন্ত! কুঁড়ি ছিঁড়ে নিয়ে প্লেটে সাজিয়ে দিয়েছে!
আর সিদ্ধ বাঁধাকপি – সে কেমন খেতে? তা আর নাই বা বললাম! আমাদের কালো জার্সি গরুটা পর্যন্ত শেষ বয়েসে মুখ ঘুরিয়ে নিত এ জিনিস দেখে!
ডিসক্লেমার: অনেকে আবার দাবি করেন, এগুলোকে বাঁধাকপির কুঁড়ি না, ব্রাসেলস্ স্প্রাউট বলে! চাষার ছেলে তো, অত কি আর বুঝি!
ডিশ – ২
এই ডিশটা ভ্যাগিস আমার বাপ দ্যাখেনি! না হলে এই বয়সেও বিশাল ঝাড় খেতাম – কাঁচা পেঁয়াজ আর বরবটি নিয়ে বাপের পুরানো আক্ষেপ মাথা চাড়া দিয়ে উঠত।
বাপের বন্ধু ন্যাড়া-কাকার বেয়াই সমুদ্রগড়ের দিকে জমিতে পেঁয়াজ লাগিয়ে লাখপতি হয়ে গেল, আর আমাদের দোঁয়াশ মাটিতে ফলন হয় না। আর ছাগলের অত্যাচারে যে জমিতে বরবটি চাষ করব, সেই শান্তি নেই।
খাবার শেষে রেস্টুরান্টের লোকেদের চাষবাস নিয়ে ক্র্যাশ-কোর্স হয়ে যেত নিশ্চিত।
আর বাকি রইল চিকেন আর হলুদ দেওয়া আলুভাতে – এগুলো যে মানুষ পয়সা দিয়ে কিনে খায়, সেটা নিষ্ফল বোঝাতে গিয়েই বাকি সন্ধ্যা পার।
পরের দিন আমাদের নিমো গ্রামের নারাণের চায়ের দোকানে ছেলেকে ঠিকঠাক মানুষ করতে না পারার আক্ষেপ।
ডিশ – ৩
যখনই ওয়েটার বলবে “স্যার, আমাদের স্পেশাল ডিশ পুজোতে বের করেছি, দেড় মাস ধরে মেনু ডিজাইন করা হয়েছে – ট্রাই করে দেখতে পারেন”, তখনি আপনার ভুরু কুঁচকে ওঠা উচিত ছিল, মনে ঢুকে যাওয়া উচিত ছিল সন্দেহের বীজ।
যদি আপনি নাদান সাজেন তখনো, তাহলে বিল দেখার পরে রবিবাবুর কবিতা আউড়াবার জন্য প্রস্তুত থাকুন, আমি যেমন সেদিন আমি ঘাঁটলাম -
আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম বিলে,
জ্বলে উঠল আলো
সামনের টেবিলে।
ওয়েটারের দিকে চেয়ে বললুম ‘মারলে তাহলে’,
সুন্দর হাসল সে।
প্লেটের লাল কারুকাজ সিম্বলিক – মনে হচ্ছে বিল মিটিয়ে দু’ ফোঁটা রক্ত চুঁইয়ে পড়েছে প্লেটে।
তবে এটাও বলে রাখি, সেদিন খাবার কিন্তু খুব ভালো ছিল। খাবার দেখে আমার চাষাড়ে মনে যা এসেছিল সেটাই লিখছি – খাবার কেমন লাগবে সে সব আপনা আপনা চয়েস। খাবেন কি খাবেন না – তা আপনার ব্যাপার। আমার ভালো লেগেছিল খাবার সেদিন।
তবে পরামর্শ একটাই – এইসব রেস্টুরান্টে নিজের বিচারবুদ্ধিতে খাবার অর্ডার করুন, ওয়েটারের বা সার্ভারের কথা শুনে নয়।