আমাদের ব্যক্তিগত গাইড তখন বলে চলেছে, “এই যে মন্দিরের গায়ে পাথরের খোদাই ভাস্কর্যগুলি – এগুলো এতই সূক্ষ্ম কারুকাজ করা, যে মনে করা হয় একমাত্র মহিলাদের হাতেই সেই সূক্ষ্মতা অর্জন সম্ভব ছিল।”
আমি মনে মনে ভাবছি, “গুল দেবার আর জায়গা পাও না! এমন বলছ বাপ, মনে হচ্ছে তুমি দাঁড়িয়ে দেখেছিলে কে বানাচ্ছে আর কার কেমন কোমল হাত”! কিন্তু যা ভাবছি, সেটা তো আর মুখে বলা যায় না! গাইড চটে গেলেও ম্যানেজ হয়ে যাবে – কিন্তু আমার বউয়ের আবার এই সব ব্যাপারে খুব ইন্টারেস্ট। গাইডের আষাড়ে গল্প হাঁ করে গিলছে। এখন যদি আমি মাঝখান থেকে নাক গলিয়ে রসভঙ্গ করি, তাহলে বউ বিশাল রেগে যাবে – এবং সেটা সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এই সব ঘটনা ঘটছে কাম্বোডিয়ার আঙ্কোরভাট থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার উত্তরদিকে ‘বান্তেই সেরি’ নামে সেই দশম শতাব্দীর অদ্ভুত সুন্দর হিন্দু মন্দিরের সামনে। বউকে না চটানোর জন্য আমি একদম হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছি আর গাইড যা বলছে তাতেই – দারুণ, বাহবা – এইসব বলছি।
গাইড বক বক করেই যাচ্ছে, “বান্তেই সেরি-র অর্থ হচ্ছে ‘সৌন্দর্য্যের দুর্গ’ বা ‘মহিলাদের দুর্গ’। অনেকে আবার রত্নস্বরূপ বা খেমের সাম্রাজ্যের স্থাপত্যের চূড়ান্ত নিদর্শন মনে করেন এই মন্দিরকে। আঙ্কোরভাটের আশেপাশে যে সব মন্দিরগুলো তৈরি করা হয়েছিল, তার সবগুলোই বানিয়েছিল তখনকার রাজারা – কিন্তু একমাত্র এই বান্তেই সেরি মন্দিরটি বানিয়েছিলেন রাজা রাজেন্দ্র বর্মণের এক পারিষদ যার নাম ছিল যজ্ঞবাহার। মন্দিরটি তৈরি শেষ হয় ৯৬৭ সালে এবং মূলত বান্তেই সেরি বানানো হয়েছিল শিবের মন্দির হিসাবে। মন্দির চত্বরের দক্ষিণ দিকের ভবনগুলি এবং মাঝের চূড়াটি ছিল শিবের জন্য উৎসর্গীকৃত। কিন্তু উত্তরদিকে কিছু ভবন আছে, যেগুলি বিষ্ণুর।”
যজ্ঞবাহারের নামে শুনে, আমার পেটের ভিতরে টিম টিম করে জ্বলতে থাকা খিদের আগুনটা যজ্ঞের আগুনের মত দপ করে উঠল। ঘনঘন হাতের ঘড়ি দেখছি। বউয়ের নজরে সেটা চলে আসতে জেরা শুরু হল:
- এত ঘন ঘন ঘড়ি দেখার কি আছে? কিসের এত তাড়া তোমার?
- না, মানে চারে চারটের মধ্যে হোটেলে ফিরতে হবে।
- হোটেলে ফিরতে হবে? কেন?
- তোমার মনে নেই, চেক ইন করার সময় বলে দিল যে বিকেল চারটে থেকে ছ’টার মধ্যে টেরাস রেস্টুরান্টে ফ্রি-তে স্ন্যাকস্ এবং ড্রিঙ্কস্ দেবে?
- হ্যাঁ, শুনেছিলাম তো। কিন্তু এত সুন্দর মন্দিরের সামনে তোমার এখন খাওয়ার কথা মনে এল? এই তো খানিক আগে গন্ডেপিন্ডে লাঞ্চ করলে। এর মধ্যেই আবার এক্ষুনি বিকেলের স্ন্যাকসের দিকে নজর? আর তা ছাড়া মন্দির-স্থাপত্য দেখার থেকে তোমার বিকেলের স্ন্যাকস কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
এবার আমার অবাক হবার পালা:
- অবশ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ! ভাঙা পাথর দেখে তো আর আমার পেট ভরবে না!
- এই মন্দির দেখতে আসার জন্যই তো নিজে তুমি ট্রিপ বুক করেছিলে, নাকি?
- কিন্তু তখন তো আর জানতাম না, যে বিকেলে ফ্রি স্ন্যাকস্ দেবে রেস্টুরান্টে!
আমাদের বাক্যালাপ গাইড কিচ্ছু বুঝতে পারছে না – হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বউ দেখল মান-সম্মানের ব্যাপার পাবলিকের সামনে। তাই একটা বিকল্প পথের সন্ধান দিল:
- ঠিক আছে, চারটে থেকে ছ’টা বললে তো স্ন্যাকসের টাইম? ছ’টার খানিক আগেই ঢুকলে হবে তো!
- তোমার মাথাটা একদমই খারাপ হয়ে গেল নাকি গরমে? ছ’টায় স্ন্যাকস্ শেষ হবার টাইম আর তুমি ঢুকবে তার কিছু আগে? হোটেলে দেখলে কারা আছে শুধু? বিদেশী! ওরা ভাবছ এমন গরমে মন্দির দেখে বেড়াবে? সব সুইমিং পুলে তোলপাড় করছে, চারটে বাজলেই স্ন্যাকস্ খেতে ঢুকবে – আর সাড়ে চারটের মধ্যে ফাঁক করে দেবে সব।
আমাদের ভাষা না বুঝতে পারলেও, বাক্য বিনিময় যে উত্তপ্ত হচ্ছে ক্রমশ, সেটা গাইড বুঝতে পারল – কারণ সে নিজে বিবাহিত। সিচ্যুয়েশন হালকা করার জন্য শেষ চেষ্টা দিল, “এই মন্দিরের মূল নাম নাকি ছিল ‘ত্রিভুবনেশ্বর’ মন্দির এবং বলাই বাহুল্য, মন্দির প্রধান চিহ্ন ছিল শিবলিঙ্গে। বলা হয়ে থাকে যে ‘ঈশ্বরপুর’ নামে একটা শহরও নাকি গড়ে উঠেছিল এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে। তারপরে কালক্রমে এই মন্দির প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। এই মাত্র একশ’ বছর আগে, ১৯১৪ সাল নাগাদ এই মন্দির পুনরায় আবিষ্কৃত হয় এবং আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে দেশ-বিদেশ জুড়ে, যখন আন্দ্রে নামে এক বিদেশী, চারটে দেবতার মূর্তি এই স্থান থেকে পাচার করে দেয়! অবশ্য কিছুদিন পরেই তাকে গ্রেফতার করে মূর্তিগুলি উদ্ধার করা হয়।”
চোখের সামনে ভাসছে আমাদের নিমোর শুভ ঠাকুরের মন্দির – সেখানেও সুন্দর কাজকর্ম করা, পার্থক্য একটাই – সেই মন্দিরের দুয়ার নিয়ে কোন বিদেশীকে হ্যাজানো হয় না – কেবল কামারদের বুধোর ছাগলগুলো সেই সৌন্দর্য্যের সাথে খেলা করে।
তাই আর থাকতে না পেরে গাইডের ফালতু গাইডেন্স শুনে আমি বউকে বলে দিলাম,
“দ্যাখো, তুমি একে থামতে বল – বা শর্টকাট করে যা শোনার ওর কাছ থেকে বিকেল চারটের মধ্যে শুনে নাও। না হলে আন্দ্রে নামক বিদেশীর মত সুকান্তর নামও পৃথিবীর লোকে জেনে যাবে ভাঙা মন্দিরের সামনে ধর্না দেওয়া ভারতীয় হিসাবে।”
তবে বুদ্ধি করে অ্যাড করলাম একটা ব্যাপার,
- তাছাড়া দেখো, এই ঘেমো জামা-কাপড় ছেড়ে হোটেলে ফিরে বেশ সেজেগুজে স্ন্যাকস্ খেতে যাওয়ার মধ্যেও একটা মজা আছে...
- সেজে যাওয়া যাবে?
- কেন যাবে না! কেবল সাজতে গিয়ে যেন ছ’টা পেরিয়ে না যায়, সেটা খেয়াল রাখবে।
এতে দেখলাম তিনি রাজী হলেন। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ-ইত্যাদি হয়ে গেলাম টেরাসে স্ন্যাকস্ খেতে। একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে বেশি লোক ছিল না তখন – কিন্তু আমি আশ্বস্ত হয়ে দেখলাম, খাবারের কমতি নেই তেমন। বেশ পেট ভরে নানাবিধ চেনা-অজানা খাবার দিয়ে সেদিনের বিকেলে পেট ভরালাম। টেরাসের ওদিকে সূর্য ঢলে আসছে – পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে ঝাপটা মারছে চোখেমুখে।
কি একটা ককটেল-মকটেল টাইপের দিয়েছিল খেতে – এক চুমুকে শেষ করে জানান দিলাম, “আহ, এরই নাম জীবন!”