মাঝে মাঝেই লোকজন জিজ্ঞেস করেন – বিদেশে ইন্ডিয়ান রেস্টুরান্টের ব্যাপার-স্যাপার কি রকম, এবং সেই প্রসঙ্গে আমার কোনো অভিজ্ঞতা আছে কি না। বিদেশে ইন্ডিয়ান রেস্টুরান্টে খেতে যাওয়ার আমার কোনোকালেই প্রবল বাসনা ছিল না – কিন্তু প্রায়শই যেতে হয়েছে – বন্ধুদের এবং পরবর্তীকালে কলিগদের পাল্লায় পড়ে। ইংল্যান্ডে তো সন্ধ্যে থেকে পাবে বিয়ার পান করে, একটু রাত হলে ‘কারি’ খেতে যাওয়া খুবই জনপ্রিয় এবং আমার মনে হয়, এটা প্রায় ‘নিয়ম’ বলেই মেনে চলা হয় ছাত্রসমাজে। পরবর্তীকালে, মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার অফিস-শেষে, রাতে ইন্ডোর ফুটবল খেলে, পাব ফেরত হয়ে, ইন্ডিয়ান রেস্টুরান্টে কারি খাওয়ার চল প্রায়শই চলেছে – অবশ্য সেটা অন্য দেশে।
এটা আজকাল প্রায় সবাই জানেন যে ইংল্যাণ্ডের ন্যাশনাল ডিশ কিন্তু ফিশ অ্যান্ড চিপস্ নয়, ওটা হল চিকেন টিক্কা মশালা। ভারতীয় সভ্যতায় ইংরেজদের অবদান নিয়ে জাদুঘর-ভর্তি বই আছে এবং ইদানীংকার পণ্ডিতরা প্রায় সবাই একমত হয়েছেন যে, বৃটিশ সভ্যতায় আমাদের মূল অবদানই হল নানাবিধ ‘কারি’। যেটুকু দ্বিমত, তা ওই টিক্কা মশালা নাকি চিকেন মাদ্রাস – কোনটা ন্যাশনাল ডিশ হওয়া উচিত – তা নিয়ে!
আমি এত রকমের ‘কারি’র নামই শুনিনি ইংল্যাণ্ড আসার আগে, আমাদের ছোটবেলায় ছিল শুধু মাংসের ঝোল! তবে ব্যাপার হল গিয়ে, অন্য যে কোনো বিষয়ের মতই, এর ভিতরেও প্রচুর জল আছে। এমন সব খাবার ভারতীয় বলে চালানো হয়, যার সাথে ভারত তো দূরের কথা, এশীয় ভূখণ্ডেরই কোনো সম্পর্ক নেই! যেমন ধরেন, ‘চিকেন ভিন্ডালু’ – এটা তো আর ক্লাসিক ভারতীয় খাবার নয়, পর্তুগিজ – গোয়া মিলে মিশে তৈরি হয়েছে, তবে ইন্ডিয়ান বলে দেদার বিকোচ্ছে। আর ইংল্যান্ডই বা বলি কেন, এই ভারতেই ‘চিকেন ভিন্ডালু’ কিছু কিছু জায়গায় বেশ ভালই বিক্রি হয়।
‘কারি’ শব্দটি তামিল – অধুনা অক্সফোর্ড অভিধানে ঠাঁই পেয়েছে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণবশত, ইন্ডিয়ান রেস্টুরান্টগুলি ‘বালটি’ রেস্টুরান্ট নামেই পরিচিত – বিশেষ করে লিভারপুল, বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার এবং লন্ডনের কিছু এলাকায়। আমার মনে হয়, কোনো বাঙালিই এ হেন নামকরণের পিছনে নিজের দেশপ্রেমের ছাপ রেখেছেন। হয়তো অভ্যস্ত হওয়ার আগে, প্রথমদিকে বৃটিশদের কারি খেয়ে পরের দিন যে অবস্থা হত, তাতে করে ওই ভদ্রলোক নিজের দেশের বালতি হাতে করে একটি বিশেষ জায়গার দিকে দৌড়োবার সিমিলারিটি খুঁজে পেয়েছিলেন! তবে কোনো কোনো রেস্টুরান্ট-এ এখনো ছোট্ট পিতলের বালতি করেই খাবার পরিবেশন করা হয়। মেনুকার্ড দেখলে আপনার মাথা ঘুরে যাবে – পাতিয়ালা, মাদ্রাস, হায়দরাবাদ সহ স্বাধীনতা-পূর্ব প্রায় সব রাজকীয় স্টেটগুলোই খাদ্যতালিকায় ঠাঁই পেয়েছে!
তবে আপনি পৃথিবীর যেখানেই যান, সেখানে যদি ইন্ডিয়ান রেস্টুরান্ট থাকে, তাহলে কিছু নামও কমন পাবেন – যেমন মোতিমহল, তাজমহল, জাইকা, তন্দুর হাট/হাউস ইত্যাদি। বার্মিংহামে আমাদের ইউনিভার্সিটির সামনেই বেশ কতকগুলো ইন্ডিয়ান রেস্টুরান্ট ছিল – যাদের মধ্যে একটার নাম আমার খুব পছন্দের ছিল – ‘সুন্দরবন’। বার্মিংহাম এলাকার কিছু রেস্টুরান্ট মালিকের সাথে চেনাশোনা থাকার জন্য, রান্নার অন্দরমহলে উঁকি দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। এঁরা প্রায় সবাই সিলেটি – ফলত দুই প্রকার বাংলা বলতেন – আমার সাথে একরকম এবং নিজের পরিবারের সাথে অন্যরকম। তো যাই হোক, যেটা বলার – মেনু কার্ডের ৯০টা কারি ডিশের মূল সারবস্তু কিন্তু তিনটি প্রাইমারি ডাব্বা থেকেই লব্ধ। লাল, সবুজ ও নীল প্রাথমিক রঙের মতোই ওই তিনটি ডাব্বার ঝোল থেকেই সবের উৎপত্তি। এরপর দাও ছড়িয়ে কিছু লঙ্কা, ধনে, জিরে বা এলাচদানা। সব খাবারই কিন্তু কাস্টমাইজড্ ইউরোপিয়ান পাবলিকদের জন্য। আমার এক্সট্রা-স্পাইসি অর্ডারে এক্সট্রা বলতে থাকত পেট চেরা কিছু সবুজ কাঁচালঙ্কা বা রকমফেরে, কিছু ছেটানো লঙ্কার গুঁড়ো।
ইংল্যান্ডের ভারতীয় রেস্টুরান্টে স্পেশাল একটা জিনিস পাওয়া যেত, তা হল – ‘ফ্যামিলি নান’। অন্য দেশে ইন্ডিয়ান রেস্টুরান্টে এ জিনিস আমি খুব একটা দেখিনি – আর এই নান আমি খুব মিস করি। এই ফ্যামিলি নান যে কত বড়, তা আপনি সাথের ছবি দেখে ঠিক বুঝতে পারবেন না। একটা ছবিতে লক্ষ্য করলে দেখবেন, যে সবার খাবার শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু নান তখনো শেষ হয়নি। মানে বলব কি, পুরো টেবিল জুড়ে থাকত সেই জিনিস! পাশাপাশি বসে তিনজনের কোলে একটা নান বেছানো আছে – এমন ভাবেও খেয়েছি।
তবে ভ্যাগিস ঠাকুমা ইংল্যান্ডে ইন্ডিয়ান রেস্টুরান্টে খাওয়ার এই ছবি দেখে যেতে পারেনি – না হলে নির্ঘাত বলত,
“হ্যাঁরে, তুই বিলেতে গিয়ে ধান-সিদ্ধর কড়াই করে পয়সা দিয়ে খাবার খাচ্ছিস! আর কড়াইয়ের তলাগুলো তো কতদিন মাজেনি মনে হচ্ছে! সাহেবদের নিয়ে আমার কি ধারণাই না ছিল!”
সেদিন বেশ সন্ধ্যে হয়ে এসেছে – আমি এক বন্ধুর সাথে হাঁটছি লন্ডনের থেমস নদীর ধার-বরাবর, ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজটা পেরিয়ে, নীচের দিকে নেমে, লন্ডন আই-এর সামনে দিয়ে। যাঁরা এদিকে গেছেন, তাঁরা জানবেন, যে এই এলাকাটা সারাদিনই ট্যুরিস্ট বা সাধারণ লোক-চলাচলের জন্য ব্যস্ত। আর পাশের জুবিলি পার্কের ধার ঘেঁশে, মাঝে মাঝেই টুকটাক মেলার মত বসে – ফুড-স্টল ইত্যাদি থাকে।
তা, সেদিন হাঁটার সময় দেখলাম, কি একটা উৎসবের মত হচ্ছে – নানা দেশের খাবারের স্টল। সারাদিন মনে হয় ভালোই ভিড় ছিল, কিন্তু এই পড়ন্ত সন্ধ্যেবেলায় তেমন ভিড় নেই খাবারের দোকানে, বেশি ভিড় ড্রিঙ্কসের স্টলগুলিতে। আর তা ছাড়া, বেশ ভালো ঠান্ডা পড়ে গেছে – তাই এই খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে/বসে খাওয়া ঠিক জমবে না, দিনের বেলায় রোদ পোয়াতে পোয়াতে খেয়ে সেই মজাটা আসে।
বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিল বলে টম-কে বললাম, ট্রাই করবি নাকি এই স্টলের খাবার? টম জানাল, কোনো অসুবিধা নেই। দেখলাম, একটা ইন্ডিয়ান স্টল রয়েছে, তার একপাশে থাই আর একপাশে মেক্সিকান। আমরা দু’জনাই ঠিক করলাম, মেক্সিকান ট্রাই করব। কাছে এগিয়ে যেতে দেখি, দুই ছেলে মাথায় মেক্সিকান বা ওই কাউবয়-জাতীয় হ্যাট লাগিয়ে গল্প করছে, খদ্দের নেই কেউ। পাশে থাই স্টলটাতেও – না বিক্রেতা, না খদ্দের – কেউ নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের চয়েসটা প্রায় অটোমেটিক হয়ে এল। টম দূর থেকে এদের টুপি দেখে বলল, “মনে হচ্ছে অথেন্টিক হবে”। আমি বললাম, হলেই ভালো!
কিন্তু কাছে এগিয়ে আমার কেমন যেন সন্দেহ হল – বিশাল কিছু আলো জ্বলছিল না বলে ঠিক ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু তবুও, মেক্সিকান এদের তো মনে হচ্ছে না! একদম কাছে গিয়ে খাবারের লিষ্টে চোখ বোলাচ্ছি, মনে হল যে বাংলা ভাষা শুনলাম! আরো ভালো করে বলতে গেলে, আমাদের কলকাতার উচ্চারণে বাংলা নয়, বাংলাদেশের বাংলা। লন্ডনে বাংলাদেশী বাংলা শুনতে পাওয়া কোনো অবাস্তব ব্যাপার নয়, কিন্তু টুপি পরে মেক্সিকান স্টলে খাবার বিক্রি করছে – এমনটাও চট করে দেখা যায় না! আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, বাঙালি নাকি”? একগাল হেসে উত্তর এল, “জি দাদা, আপনে কোথাকার?”
ব্যস, লাইনে চলে এল কেস। এদিকে টম পুরো কনফিউজড – স্প্যানিশ যে নয়, সেটা টের পেয়েছে, কিন্তু কি ভাষায় আমরা কথা বলছি সেটা বুঝতে পারছে না। এক্ষেত্রে আমি হলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম, “কি বলছে, কি বলছে?”, “কোথায় বাড়ি এর?”, “টুপিটা কোথায় কিনেছে আর দাম কত?”, “বাবার নাম কি?” – এই সব বলে। কিন্তু বিদেশীদের আদবকায়দা আজব – আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওয়েট করছে।
এদিকে যতই খিদে পাক, বাঙালির রান্না করা রাস্তার স্টলে মেক্সিকান খাওয়ার মত ইচ্ছে জাগেনি তখনো! আমি সেই স্টলের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম – তোমরা এই টুপি পরে মেক্সিকান স্টল চালাচ্ছ? তারা একগাল হেসে বলল, সারাদিন তো অনেক বিক্রি করলাম – অসুবিধা হয়নি। এবার জিজ্ঞেস করলাম, পাশের থাই দোকানটার ছেলে কোথায়? তারা বলল, দাদা – এই তিনটে স্টলই আমাদের মালিকের – ইন্ডিয়ান, থাই আর মেক্সিকান। টুপি খুলে নিয়ে আমরাই থাই স্টল চালাই, আর টুপি পরে মেক্সিকান!
আমি দেখলাম কেস কেলো – তখন টম-কে দেখিয়ে বললাম, “ভাই, এটা আমার বস্। সাথে করে সন্ধ্যেবেলা ঘুরতে বেরিয়েছি – খেতে খুব ভালোবাসে মেক্সিকান। কিন্তু খাবার খারাপ হলে আমার উপর কোপ পড়বে। এমনকি প্রোমোশন আটকে যেতে পারে। তা তোমাদের খাবার ভালো হবে তো?”
আমার প্রশ্ন শুনে, কাউন্টারের ছেলেটা মুখ বাড়িয়ে বলল, “দাদা কাছে আসেন, একটা কথা বলি”। আমি কাছে গেলে জানালো, খাবারের উপর প্রমোশনের ব্যাপারটা ঝুলে থাকলে, এখানে না খাওয়াই ভালো!
ওদের ধন্যবাদ দিয়ে টম-কে বললাম, চলো, অন্য জায়গায় যাওয়া যাক – এরা কাউন্টার বন্ধ করে দিচ্ছে। মেক্সিকান খাওয়ার ইচ্ছে চেপেছে মাথায় – খানিক আশেপাশে ঘুরে, মেক্সিকান রেস্টুরান্ট না পেয়ে, শেষ পর্যন্ত একটা স্প্যানিশ তাপস বার-এ ঢুকে খাওয়াদাওয়া হল। মিট সব ভালো ছিল, কিন্তু ব্রেড এমন ফালতু দিয়েছিল, যে এর থেকে বাংলাদেশী ভাইয়ের হাতে মেক্সিকান খাবার খুব একটা খারাপ হত না বলেই আমার বিশ্বাস!