সে বহুদিন আগের কথা – মানে বলতে গেলে ছাত্রজীবনের ব্যাপারস্যাপার। সেবারে একটা কনফারেন্সে গেছি আমেরিকায়, আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ওয়াশিংটন ডিসি-তে। আমি, রব উইন্সলি আর য়ুডি ওয়ান। আমি আর রব ক্লাসমেট এবং য়ুডি হচ্ছে আমাদের থেকে কয়েক বছরের সিনিয়ার তাইওয়ানের মেয়ে। সেই কনফারেন্সে আমাদের তিনজনের ভাষণ দেওয়ার ছিল। মেরিয়ট, নয়তো হিলটন হোটেলের কোনো একটায় ছিলাম, এই মুহুর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। একটা রুমে আমি আর রব ছিলাম ট্যুইন বেড শেয়ার করে – আর পাশের একটা রুমে য়ুডি।
তো কনফারেন্সে গেলে যা হয়, উইকএন্ড-গুলোতে আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো এবং দিনের শেষে এদিক-সেদিক খেয়ে বেড়ানো। ওয়াশিংটন ডিসি বেড়াবার গল্প অন্যদিন হবে’খন। রবের সাথে রুম শেয়ারের একটা হালকা অসুবিধা ছিল – তা হল পড়াশুনার ব্যাপারে প্রচণ্ড সিরিয়াস ছেলে। কনফারেন্সে টক দেওয়ার আগে হাজারবার ঝালিয়ে নেবে – শুধু প্রেজেন্টেশনে চোখ বোলাবে তাই নয়, থিওরিও পড়ে নেবে। আর আমার ব্যাপার বুঝতেই পারছেন – এইসব ঝালিয়ে নেওয়ার সাথে আমার কোনোদিনই তেমন সম্পর্ক ছিল না! রব-কে মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিতাম, যে সামনে বার বার ঝালিয়ে নিয়ে সে আমাকে টেনশনে ফেলছে – প্রত্যুত্তরে সে বলত, “তুই না ঝালিয়ে আমার টেনশন বেশি বাড়াচ্ছিস!” তো যাই হোক, রবের মনের কথা বলতে পারব না, কিন্তু এই সব ব্যাপারে টেনশন তেমন কোনোদিনই ছিল না। এর মূলে ছিল হিন্দি-তে শেখা এক বাক্য “তো কেয়া হুয়া?” যার ইংরাজি করলে দাঁড়াবে “সো”?
এই করেই চলছিল – সেদিন সন্ধেবেলা কনফারেন্সে শেষে রব-এর মনে বেশ খুশি, কারণ টক খুব ভালো হয়েছে। বলল, চল তাহলে আজকে একটু অন্য ধরণের খাবার ট্রাই করা যাক। রোজই অন্য ধরণের খাবার খাচ্ছি তেমনভাবে দেখতে গেলে – তা, অন্যধরণের খাবারের আবার অন্যধরণ কেমন হবে ভাবতে গিয়ে হালকা চাপ লাগল। য়ুডি পরামর্শ দিল, তাহলে আজকে ইথোপিয়ান রেস্টুরান্টে খাওয়া যাক। সত্যি বলতে কি, ইথোপিয়ান রেস্টুরান্টে আগে কোনোদিন খাইনি। এরা কি খায় বা খায় না সেই সম্পর্কেও কোনো ধারণাই ছিল না তার আগে! খাবারের স্বাদ ভালো হলে কোনোকিছুই খেতে কোনোদিন অসুবিধা হয়নি বলে সেদিন ইথোপিয়ান রেস্টুরান্টে না যাবার কোনোই কারণ ভেবে পেলাম না!
রেস্টুরান্টে গিয়ে যে খাবার দেখলাম, তাতে করে আমার মন আনন্দমিশ্রিত অনুভবে ভরে উঠল। এ তো একেবারে আমাদের পাড়ার পিকনিকের স্টাইলে খাবার – কিন্তু আবার একটা ইতস্তত ভাবও এল। নিজে চাষা হলেও, যতই হোক, সাহেবদের সাথে খেতে গিয়ে হালকা একটু এটিকেট বজায় তো রাখতেই হয়। যেমন ধরুণ, একদম ঝাঁপিয়ে পড়ে খেতে ইতস্তত করা বা হাপুস-গাপুস করে সাঁটানোর ধান্দা, এগুলো একটু কনট্রোলে রেখেছিলাম। ইথোপিয়ান রেস্টুরান্টে যেভাবে খাবার পরিবেশিত হল তাতে করে আমার পক্ষে সাহেবী কেতের আবরণ বজায় রাখা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে গেল! করেছে কি, একটা বড় প্লেটে রুটির মত কি একটা দিয়ে তার উপরে মাংসের যে ডিশ অর্ডার দিয়েছিলাম, সেটা বিছিয়ে দিয়েছে যাকে বলে! আলাদা কোনো প্লেট নেই – এই বড় প্লেট থেকেই সবাইকে নিয়ে খেতে হবে। আর কাঁটা-চামচেরও কোনো ব্যাপার নেই – পুরো ব্যাপারটা হাত দিয়েই সারতে হবে। মানে বুঝতেই পারছেন, আমার একেবারে হোম-গ্রাউন্ড!
একটু ইতস্তত করে বললাম রব আর য়ুডিকে – “তোরা দু’জনে একটা ডিশ খা, আমি বরং আর একটা আলাদা অর্ডার দিই”। তারা আমার প্রস্তাব শুনে অবাক, বলল, “কেন একসাথে হাত দিয়ে খেতে কি কোনো অসুবিধা আছে?”
অসুবিধা! তাও আমার! নিমোতে ছেলেছোকরাদের পিকনিক শেষ হলে হাঁড়িতে যাতে মাংসের ঝোল একটুও পড়ে না থাকে, তাই সেই হাঁড়িতে ভাত ঢেলে, মেখে, সবাই মিলে সাঁটানো পাবলিক। কী করে বোঝাই, যে ওদের নিজেদের ভালোর জন্যই আমি আলাদা ডিশ অর্ডার করতে যাচ্ছিলাম। একে তো জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মানুষ হয়েছি – তারপর হাত দিয়ে খাওয়া – মনের মধ্যে সেই প্রবল কম্পিটিটিভ ব্যাপারটা প্রকট হয়ে গেলে ওরা জাস্ট বেশি খাবার পাবে না! একে তো এদের হাত দিয়ে খাওয়া অভ্যেস নেই, তার ওপর ইথোপিয়ান খাবার বেশ মশালাদার। ওরা – এক গ্রাস নিয়ে কীভাবে মুখে চালান করবে আঙুল দিয়ে – সেটা ফিগার আউট করে ওঠার আগেই বাকি খাবারের বেশিরভাগটাই আমার পেটে চলে যাবে আমি নিশ্চিত ছিলাম।
সেদিনের আগে জানতাম না, যে এই রুটির মত জিনিসটাকে ওরা বলে ‘ইনজেরা’। এটা বেস করেই ওদের নানা খাবার গড়ে উঠেছে – আপনি নিরামিষ, আমিষ, ভাজাভুজি – যা-ই চান, এই রুটির উপর পরিবেশিত হবে। আর আমাদের ভারতীয় ক্যুজিন-এর মত ইথোপিয়ান ক্যুজিনেও ‘কারি’-র ব্যবহার প্রচুর, বেশ মশালাদার খাবার বানায় এরা। আমাদের মত এরাও ব্যবহার করে লঙ্কা, আদা, রসুন, দারুচিনি, লবঙ্গ এবং জিরা।
শোনা কথা, যে প্রথম ইথোপিয়ান রেস্টুরান্টে খেতে গিয়ে অনেক ট্যুরিস্ট নাকি এই ইনজেরা-কে টেবিলক্লথ বা খাবারের তলায় পাতা হয় – এমন পেপার বলে মনে করে টাচ্-ই করে না! এই ইনজেরা বানানো হয় ‘টেফ’ নামের এক শস্যকণা দিয়ে। এই শস্যকণা নাকি আজকাল সুপারফুড গ্রেন বলে বিবেচিত হচ্ছে, তাদের মধ্যে থাকা হাই প্রোটিন এবং ক্যালসিয়ামের জন্য। তবে আমি যা বুঝলুম, এই ইনজেরা অনেকটা আমাদের বাড়িতে শীত এবং পৌষ-পার্বণের সময় বানানো ‘সরুচাকলি’ এর মত। চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো – জানি না, বাঙলার অন্য অঞ্চলে এই জিনিসকে কী বলে।
ইথোপিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় নিরামিষ ডিশ হচ্ছে ‘বেয়াইনাটু’ – যার আক্ষরিক অর্থ ‘সব কিছু একটু একটু করে’। আমরা খেয়েছিলাম – যতদূর মনে পড়ছে – ‘ডোরো ওট’, চিকেন ড্রামস্টিক বা উইংস দিয়ে জমকালোভাবে বানানো মশালাদার কারি – আবার এই কারির ভিতর থেকে উঁকি দেবে সিদ্ধ গোটা ডিম! এটা নাকি দেওয়া হয় অতিথির মর্যাদা বাড়াবার জন্য। কথিত আছে, বিবাহের সম্বন্ধের সময় ভাবি বউ-কে নাকি এই ‘ডোরো ওট’ বানিয়ে, পোটেনশিয়াল শ্বশুরবাড়ির লোককে খাইয়ে, প্রমাণ করতে হয় – যে সে রান্না জানে! তবে শুধু চিকেন নয়, মাটন বা বিফ দিয়েও ডোরো ওট বানানো হয়। ইথোপিয়ার অনুষ্ঠান বাড়িতে বা সামাজিক কাজকর্মে সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিশ হল এটাই।
যদিও সেদিন খাওয়া হয়নি বেশি ডিশ – তবে এই ফাঁকে জানিয়ে রাখা যাক, যে ইথোপিয়ার অন্য ট্র্যাডিশনাল খাবারগুলির মধ্যে অন্যতম হল মিনচেট (গ্রাউন্ড বিফ স্টু-এর মত), টিবস্ (স্টার-ফ্রায়েড মিট), কিটফো (মিন্সড বিফের ডিশ, কটেজ চিজের মত জিনিস দিয়ে সার্ভ করা হয়), তেরে সিগা (কিউবের আকারের-মিট), ফির-ফির (ইনজেরা টুকরো করে কেটে সসে ডোবানো) ইত্যাদি।
দারুণ খাওয়া হল সেদিন – রব এবং য়ুডি-কে চান্স দেবার জন্য আমি আমার নিজস্ব স্পিডে সাঁটাতে পারলাম না। সেদিন খেলতে হল ‘স্লো সাইকেল রেস’-এর মত। তবুও খাবার দারুণ ছিল বলে কিছু মাইন্ড করলাম না – আর ডিনারের শেষে এককাপ করে ইথোপিয়ান কফি। কনফারেন্সে টক যেমনই হোক, এই রেস্টুরান্টে না এলে এই ট্যুরটা পূর্ণতা পেত না – এমনটাই সিদ্ধান্ত নিলাম।