-মেন কোর্সে কী আছে?
-ফুলকপির রোস্ট
-সিরিয়াসলি?
-তবে কি মজা করছি? বিখ্যাত শেফের বিখ্যাত রেসিপি!
আমস্টারডামের বুকে বসে, আসল স্টেক না খেয়ে, লেবার দিয়ে কলিফ্লাওয়ার স্টেক রান্না করে খাচ্ছি – এটা একটা বেশ আয়রনিক ব্যাপার হয়ে উঠল আমার কাছে। সে যতই শেফ বোঝানোর চেষ্টা করুক না কেন, যে এ মেনু হচ্ছে ‘সিজন্যাল’! আমি আর কী বলি – ফুলকপি তো ফুলকপিই নাকি! তাকে সিদ্ধই কর বা ভাজা, তাতে হলেন্ডিস সসই দাও বা থাউজেন্ড আইল্যান্ড ড্রেসিং – ফুলকপির ক্যারেকটার পালটানো আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মতই দুঃসাধ্য।
অক্টোবর মাসের লক্ষ্মীপুজোর দিনের ফুলকপির ডিমান্ডের কথা চোখে সামনে ভেসে উঠল – মেমারীতে আমাদের দোকানের সামনে দুলাল বসে বসে গাঁদা ফুল সাইজের ফুলকপি বিক্রি করছে ৭০ টাকা পিস! ওদিকে নিমো কোয়াপারেটিভ-এ কাজ করা হোঁদল বলছে, ‘সুকানদা, এগুলি কাল রাতে কুঁড়িই ছিল – এমন এক কেমিক্যাল বেরিয়েছে, যাকে ওষুধ বলে চালাচ্ছে – রাতের বেলা ফুলকপির উপরে স্প্রে করে দিলেই সেই কপি ফুটছে, ভোরে জমি থেকে তুলে, ব্যস ঝাঁকায় করে বাজারে!”
প্রফেশন্যাল লাইফে খুব বেশি জিনিস নিয়ে ভয় পাওয়ার কারণ ঘটেনি – যদিও অনেক উত্তেজক ঘটনার কমতি নেই খুব একটা। তবে নিষ্কণ্টক জীবন কি সত্যিই হয়!
আমার চাকুরিজীবনে তেমনি কাঁটার মত অবস্থান করে ‘টিম বিল্ডিং’ ইভেন্টসকল (আর সেদিনের পর যোগ হল ফুলকপির রোস্ট)।
এই ‘টিম বিল্ডিং’ জিনিসগুলির মত ওভারহাইপড এবং ভাটের জিনিস খুব একটা বেশি আছে বলে মনে হয় না। কোনদিন কী রান্না হবে, ছেলে-মেয়ে কোন স্কুলে ভর্তি হবে, কোথায় বেড়াতে যাওয়া হবে বা সেখানে গিয়ে কোন রেস্টুরান্টে গিয়ে খাওয়া হবে – এই নিয়ে যারা দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনের ততোধিক দৈর্ঘ্যের বাক্যালাপ চালিয়েও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি – একে অপরকে কনভিন্স করাতে পারেননি; সেই তাঁরাই নাকি ঘণ্টাকয়েকের টিম বিল্ডিং ইভেন্টের মধ্যে দিয়ে গিয়ে নিজেদের চিনে নেবেন, একে অপরের সাথে এমন যোগসূত্র গড়ে তুলবেন, যাতে করে কোম্পানির লাভ হয় আখেরে – এমন অবাস্তব প্রস্তাব শুনলে সেই একটাই চিরপরিচিত বাক্যবন্ধ মনে পড়ে যায় –
আস্তে কন কত্তা, ঘুড়ায় হাসবো!
চাকরি করে যখন খেতে হবে, তখন অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়, মন থেকে না চাইলেও। এবারে যখন শুনলাম, এক অফিসিয়াল মিটিং-এর প্রথম দিন সন্ধেয় ‘টিম বিল্ডিং’ ইভেন্টের আয়োজন হয়েছে, আমার গা-হাত পা শিউরে উঠল! দিনের অফিস টাইমের মধ্যে হলেও তবু ঠিক আছে, কিন্তু তা বলে সেটাকে টেনে-হিঁচড়ে সন্ধেবেলার ডিনার টাইমে নিয়ে যেতে হবে! খুবই দুঃখিত হলাম নিজের মনেই। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন – আমার সেই দুঃখীভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, যখন শুনলাম আমার এক কলিগ টিম বিল্ডিং ইভেন্ট হিসেবে এক ‘ডিনার কুকিং’ ইভেন্টের আয়োজন করেছে। সত্যি বলতে কি, বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলাম – মনে পড়ল না যে শেষ কবে এমন উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলাম টিম বিল্ডিং ইভেন্টে।
সেই কুকিং ইভেন্টের আয়োজন হয়েছিল আমস্টারডাম শহরের একপ্রান্তে, মানে মূল শহর কেন্দ্র থেকে কিছু দূরে ‘দি কুকফ্যাব্রিক’ (বাই ফার্ম কিচেন) নামে সেই কুকিং ওয়ার্কশপ। আইডিয়া বেশ সিম্পল – সব অংশগ্রহণকারী একসাথে রান্নাবান্না করবে। নিজেদের মধ্যে টিম বানিয়ে কম্পিটিশন করবে, পুরো কোর্স মিল বানিয়ে বা বেশি সময় হাতে না থাকলে এক একটা টিম ডিনার/লাঞ্চ-এর এক একটা পদ বানিয়ে। আমার যেখানে গিয়েছিলাম, কুকফ্যাব্রিক-এর সেই ওয়ার্কশপটা বেশ বড়সড় জায়গা জুড়ে আছে – প্রায় ১২০০ বর্গমিটার। বিখ্যাত ডাচ টিভি শেফ জুলিয়াস জেসপার এই মুহুর্তে জড়িয়ে আছেন এই সংস্থার সঙ্গে। তাঁর তৈরি মেনুই এখানে রান্না করা হয়। মোটমাট ১৮টি কুকিং স্টেশন আছে, আর আছে ৩টি ডেমোনস্ট্রেশন কিচেন। সব মিলিয়ে ২৭০ জন মত পাবলিক এখানে বসে খেতে পারে। আর মর্ডান কিচেনে যা যা থাকে, সবই পর্যাপ্ত সাপ্লাই দেওয়া হয় – তাই ছানা কেটে গেলে বলতে পারবেন না, যে হাতের কাছে নাড়ার কিছু ছিল না বলে এমন হল!
আমাদের হাতে খুব বেশি সময় ছিল না – সাকুল্যে সাড়ে তিন ঘণ্টা মত। ছিলাম আমরা আটজন – আমি ভারতীয়, এক কোরিয়ান, দুই আমেরিকান, এক চাইনিজ, দুইজন ডাচ, এক সুইডিশ – পৃথিবীর একেবারে পূর্ব থেকে পশ্চিম কভার করা। আগেই যেমন বলেছি, সময় অনুযায়ী পছন্দ করা যায়, আপনারা কী মেনু রান্না করতে চান। তবে সেইসব আগে থেকে বলে রাখতে হবে – কারণ সেইমত তারা ইনগ্রেডিয়েন্ট-ইত্যাদি যোগাড় করে রাখবে। অন্য দেশ হলে হয়তো বা চান্স ছিল – অকুস্থলে গিয়ে কোনো স্পেশাল রিকোয়েস্ট করবেন – কিন্তু নেদারল্যান্ডস্-এ ওসব চলে না। যদি ভেবে থাকেন, যে আমি চিনির সরবত বানাব – সেটাও এদের আগে থেকে বলে রাখতে হবে – সুন্দর করে আপনার জন্য টেবিলে একটা কাঁচের গ্লাস, চিনি, জলের জাগ ইত্যাদি সাজিয়ে রাখবে। ইহা পুরোই আলাদা অ্যাপ্রোচ ভারতীয় রেস্টুরান্ট সার্ভিসের থেকে।
আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি আগের এক ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল – ব্যাঙ্গালোরের পুরোনো এয়ারপোর্টের কাছে ‘লীলা প্যালেস’ ছিল শহরের সবচেয়ে জমকালো হোটেল। তখন গা থেকে ছাত্র-গন্ধ যায়নি – ফলতঃ প্যালেসই হোক বা দরগা – খেতে গিয়ে খাওয়াটাই মূল লক্ষ্য ছিল। আর সত্যি কথা বলতে কি, লীলা প্যালেস হোটেলের রেস্টুরান্টগুলি ছিল অপূর্ব। তো সেবারে ওদের ইতালিয়ান রেস্টুরান্টে খেতে গেছি এক আমেরিকান কলিগের সাথে – আমাদের বৃহত্তর টিমে এক দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ে ছিল। সে মেয়ে রাত ন’টার সময় ইতালিয়ান রেস্টুরান্টে বসে ‘কার্ড রাইসের’ অর্ডার করেছিল এবং তার পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে সেই অর্ডার তার টেবিলে পেশ করাও হয়েছিল – এমন ছিল সেই সময়ের কাস্টমার সার্ভিস। সেই তুলনায় নেদারল্যান্ডের ইতালিয়ান রেস্টুরান্টে বসে নিজ দায়িত্বে ‘ফাহিতা’ অর্ডার করার চেষ্টা করতে পারেন – লোকাল মিউনিসিপ্যালিটিতে কমপ্লেন করে আপনার ভিজিটর ভিসা রিভোক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা!
যাই হোক, মূল ঘটনায় ফিরে আসা যায়। আমাদের সেই সুইডিশ কলিগ (যার অরিজিন আবার সিঙ্গাপুর) চ্যুজ করে রেখেছিল ফোর কোর্স সিজন্যাল মেনু – একদম শুরুতে অ্যাপেটাইজার বাদ দিলে (এটা আমরা রান্না করিনি, আমাদের সার্ভ করা হয়েছিল), আমাদের রান্না করতে হবে তিন কোর্স।
অ্যাপেটাইজার: “লিটিল গার্ডেন” উইথ হুমুস, অলিভ ক্রাম্বস্, অ্যান্ড ক্রদিতে
স্টার্টার: ইন সল্ট ক্রাস্ট রোস্টেড বিটরুট উইথ অ্যাপেল অ্যান্ড ডাচ মোজারেল্লা
মেন কোর্স: কলিফ্লাওয়ার স্টেক উইথ ম্যাসড পটেট্যো, হেজেলনাট এবং হলেন্ডিস সস
ডেজার্ট: ফ্রেস মাসকারপোন উইথ মেরিনেটেড রেড ফ্রুটস অ্যান্ড মেডেলিনস
আমরা আটজন ছিলাম তাই তিনটি টিম তৈরি হল – তিনজন করে দু’টি টিম, আর আমার সাথে এক ডাচ কলিগ। বাকি দুটো টিমের একজন বেছে নিল স্টার্টার এবং অপরজন মেনকোর্স। ডাচ কলিগের সাথে আমি হাসিমুখে তুলে নিলাম ডেজার্টের ভার। হাসিমুখ বলছি বটে – কিন্তু মেনুতে কোনো আমিষ জিনিস না দেখে মন বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল।
ওদিকে শেফ তখন বুঝিয়ে চলেছে, যে সব কিছু অরগ্যানিক এখানে – এমনকি আলুও। ওদের যে সাপ্লাই করে আলু, সে নাকি এতই বেশি পরিবেশ সচেতন, যে সাইকেলে করে আলু দিয়ে যায় এই কিচেনে। আর সাস্টেনেবল প্রিন্সিপল নিয়ে চলা এই কিচেন, যত কাছে পারা যায় তত কাছ থেকে ইনগ্রেডিয়েন্স কেনে – তাতে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কম হয়। খুবই ভালো উদ্যোগ – তবে ভাবলাম, এতই ভাবলে শুধু আলুসিদ্ধ খাওয়াই উচিত, কারণ তার পরে যে পিপার ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা আসছে আমাদের কেরালা বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো জায়গা থেকেই হয়তো!
সেও না হয় ঠিক আছে, কিন্তু আলু নিয়ে ডায়লগ বেশি শুনতে ইচ্ছে করে না নিমোর ছেলে হয়ে – আলুবাজি আমাদের রক্তে। আচ্ছা, এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, সল্ট ক্রাস্ট রোস্টেড বিটরুট আমাদের টিম প্রিপেয়ার করলেও, ওদের তৈরি সেই রোস্টেড বিটগুলো আমরা খাইনি। কারণ এটা রোস্ট হতে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগে। আমাদের টিম ওটা বানিয়ে ওভানে ঢুকিয়ে দিল – আর শেফ আগে থেকে ওভানে যেটা বানিয়ে ঢুকিয়ে রেখেছিল, সেটা আমরা খেলাম। বিটরুট পোড়া নিয়েও সে বিশাল কিছু জানার! বাইরের সল্ট ক্রাস্ট-টা ভিতরের ময়েশ্চারটা শুষে নেয়, কিন্তু ফেল্ভারটা বেরোতে পারে না বিট-রুটের ভিতর থেকে। একটু কেটে চাখিয়ে বলল, “দ্যাখো, কী দারুণ ফ্লেভার – তাই কিনা?” কী আর বলি! পেট খিদেয় চড়চড় করছে – তর্ক করলে যদি পরে কিছু টেস্ট করতে না দেয় – সেই ভয়ে বললাম দারুণ খেতে। যদিও বিট যেমন খেতে হয়, তেমনই – ভেজিটেবল চপের পুর হিসেবেই এরা বেস্ট, আর বাসি হয়ে দরকচা মেরে গেলে গরুর ডাবায় দেওয়ার জন্য।
প্রথমে সব প্রিপায়েরেশন করে নেওয়া হল – এবার এক একটা কোর্স দিয়ে টেবিলে বসে খাবার শুরু। স্টার্টার শেষ হলে যেমন আমরা বসে রইলাম, আর যে টিমের দায়িত্বে ছিল মেন কোর্স, তারা ফাইনাল টাচ দিয়ে প্লেট সাজিয়ে নিয়ে এল। আমাদের ডেজার্টে ওই যে মেডেলিন কুকিটা ছিল, সেটা ওভানে হতে মিনিট দশেক লাগে। তাই খাওয়ার ফাঁকে উঠে গিয়ে ওভানে ঢুকিয়ে দিয়ে এলাম। আমাদের সময় এলে, আমি আর আমার ডাচ কলিগ উঠে গিয়ে সেই কুকি ওভান থেকে বের করে ডেজার্ট প্লেটিং করে নিয়ে এলাম।
বলতে নেই, সব টিমই ভালো রান্না করেছিল। প্লেট চেটেপুটে খাওয়া হল – কিন্তু ওই যে, মিষ্টি জিনিসের ব্যাপারে আমাকে টেক্কা দেওয়া ভার। আমার আর সেই ডাচ কলিগের বানানো ডেজার্টটাই সেই সন্ধ্যার সেরা ডিশ বলে রায় দিল সবাই।
এমন মাস্টারশেফ স্টাইলের কিচেনে বারে বারে রান্নার সুযোগ হয় না – তাই সেদিনের এই ডিনারটা বেশ স্মরণীয় হয়ে রইল।