অ্যাসপারাগস ইত্যাদি
তখন সবে নতুন নতুন একটা ইংরাজি গালাগাল শিখেছি। শিখেছি বললে মনে হয় ঠিক মর্যাদা দেওয়া হবে না, আসলে শিখেছিলাম আগেই – তখন ভালো করে প্র্যাকটিস করা শুরু করেছি। “হোয়াট দ্য ফাক”। তক্কে তক্কে আছি, কখন বলা প্র্যাকটিস করা যায় – এমন নয়, যে ঠিক কি প্রসঙ্গে এই গালাগাল প্রয়োগ হয় তা জানি – কিন্তু নতুন কাক গু খেতে শেখার মত, বারে বারেই বলতে ইচ্ছে করছিল সেই ইংলিশ গালাগাল। বিদেশে গিয়ে বাংলা গালাগাল দিয়ে ঠিক জমছিল না – যাকে দিলাম সে যদি বুঝতেই না পারল, তাহলে আর বৃথা বাক্যব্যয় কেন! সেই সব ভেবেচিন্তেই সিলেক্টেড ইংরাজি জিনিস প্র্যাকটিস শুরু করেছিলাম।
তো, সেদিন রেষ্টুরান্টে খেতে গিয়ে, অ্যাপেটাইজার হিসাবে এই ডিশটা সামনে যখন নামিয়ে দিয়ে গেল, মুখ দিয়ে আপনা আপনিই বেরিয়ে গেল “হোয়াট দ্য ফাক”! সেদিন না জেনে ওয়েটারের সামনে এটা বললেও – পরে জানার পর বুঝতে পেরেছিলাম, এর থেকে জুতসই গালাগাল আর হয় না এই ডিশের জন্য!
এই সব হচ্ছিল ‘ভ্যান স্পিক’ রেষ্টুরান্টে বসে। আমষ্টারডাম সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে যদি শহরের ভিতরের দিকে ডান দিক-চেপে হাঁটতে শুরু করেন তাহলে একটা রাস্তা পাবেন – স্পুই স্ত্রাট। এবং এই রাস্তার মাঝামাঝি সেই বিখ্যাত ডাচ ব্রাসেরী ভ্যান স্পিক – তবে এদের খাবার-দাবারে ডাচ জিনিসপত্রের সাথে ফ্রেঞ্চ ছোঁয়াও আছে। বুঝতেই পারছেন, একেবারে ডেডলি কম্বিনেশন – একে ফ্রেঞ্চে রক্ষা নেই, তার সাথে আবার ডাচ। তবে সৌভাগ্য এটাই, যে রান্না করা খাবারে ডাচ লোকজন আলু এবং সিদ্ধ জিনিস পত্রের বেশি উঠতে পারেনি। ফলে আপনি যা কিছু কারুকাজ দেখবেন খাবারে এবং খাবারের প্লেটে – তার প্রায় সবটায় ফরাসিদের অবদান!
দ্বিতীয়বারে বুড়ি অতটা বিচলিত হলেন না। এবারেও কাঁদিলেন তবে জার্মানি বিজ্ঞানের দেশ বলে তার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দিলেন; বললেন, চোখের কাছের যে স্যাক থেকে জল বেরোয়, বুড়ো বয়সে মানুষ নাকি তার উপর কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলে। হবেও বা, কিন্তু বিদেশে ছেলের কথা ভেবে মা যদি অঝোরে কাব্দে। তবে তার জন্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কি প্রয়োজন?
শুধালেন, ‘এসপেরেগাস খাবেন-একটুখানি গলানো মাখনের সঙ্গে?
আমি তো অবাক। এসপেরেগাস মানুষে খায় পশ্চিম বাংলায় যে রকম আসল খাওয়া হয়ে গেলে টক খাওয়া হয়। বলা নেই কওয়া নেই, সকাল বেলা দশটার সময় সুস্থ মানুষ হঠাৎ টিক খেতে যাবে কেন?
মজাটা সেইখানেই। আমি এসপেরেগাস খেতে এত ভালোবাসি যে রােত তিনটের সময় কেউ যদি ঘুম ভাঙিয়ে এসপেরেগাস খেতে বলে তবে তক্ষুনি রাজী হই। ভারতবর্ষে এসাপেরেগাস আসে টিনে করে-তাতে সত্যিকার সোয়াদ পাওয়া যায় না।–তাজা ইলিশ নোনা ইলিশের চেয়েও বেশি তফাৎ। সেই এসপেরেগাসের নামেই আমি যখন অজ্ঞান তখন এখানকার তাজা মাল!
মাই বললেন, ‘আমি যখন এর্নস্টের কাছ থেকে খবর পেলুম, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন, তখন বউমাকে লিখলুম, আপনি কি খেতে ভালোবাসেন সে খবর জানাতে। বউমা লিখলে পুরো লাঞ্চ খাওয়াতে হবে না, শুধু এসপেরেগাস হলেই চলবে। সৈয়দ সাহেব মোষের মত এসপেরেগাস খান—বেলা-অবেলায়।’
বুড়ি মধুর হাসি হেসে বললেন, ‘পুরো লাঞ্চ এখন আমি আর রাঁধতে পারি নে, বউমা জানে। তাই আমার মনে কিন্তু-কিন্তু রয়ে গিয়েছে, হয়ত আমাকে মেহন্নত থেকে বাঁচাবার জন্য লিখেছে আপনি বেলা-অবেলায় এসপেরেগাস খান।’।
আমি বললুম, ‘আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।’
‘দেশের চতুর পাঠকদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে আর কস্য লভ্য যে আমি পেটুক। উল্টে তাঁরা বুঝে যাবেন, মিথ্যেবাদীও বটে।
এসাপেরেগাসের পরিমাণ দেখে আমার চোখ দুটো পটাং করে সকেটু থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। মহা মুশকিল। সেগুলো কাপেট থেকে কুড়িয়ে নিয়ে সকেটে ঢুকিয়ে এসাপেরেগাস গ্রাস করতে বসলুম।
জানি, এক মণ বললে আপনারা বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু প্লীজ, আধা মণ না মানলে আমাকে বড় বেদনা দেওয়া হবে। সুকুমার রায়ের ‘খাই-খাই খানেওয়ালাও সে-খানা শেষ করতে পারত না।
আমি ঐ এক বাবদেই আমার মাকে খুশি করতে পারতুম—গুরুভোজনে। ধর্মসাক্ষী, আর সব বাবদে মা আমাকে মাফ করে দিয়েছেন। কোন-ভিনারের মা পর্যন্ত খুশি হলেন, তাতে আর কিমাশ্চৰ্যম!
হায় রে দুর্বল লেখনী-কি করে কোন-ভিনারের মায়ের এসপেরেগাস রান্নার বর্ণনা বতরিবৎ বয়ান করি। অমিত্ৰাক্ষর ছন্দে শেষ কাব্য লিখেছেন মাইকেল, শেষ এসপেরেগাস রোধেছেন কোন ভিনারের মা।