মধ্য-এশিয়ার গোটা দুয়েক প্রিয় খাবার নিয়ে দুকথা লিখি ভাবলাম আজ। তবে আজকের লেখা ইউরোপে বসে বা ঘুরতে গিয়ে মিডিল-ইষ্টার্ণ রেষ্টুরান্টে খেয়ে লেখা। মূল দেশের রেষ্টুরান্টে খাবার অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে অন্য পর্বে লিখব। তবে একটা কথা বলে রাখি, ভারতের ভিতরে রেষ্টুরান্টে ভারতীয় খাবার এবং বিদেশে ভারতীয় রেষ্টুরান্টের খাবারের মধ্যে যে পার্থক্য তত পার্থক্য কিন্তু আমি এই রেষ্টুরান্ট গুলির খাবারের মধ্যে পাই নি। মানে আমার জিহ্বায় ইউরোপের মিডিল-ইষ্টার্ণ রেষ্টুরান্ট এবং মিডিল-ইষ্টে রেষ্টুরান্টের খাবারের মধ্যে খুব বিশাল কিছু পার্থক্য পাই নি। অবশ্যই কিছু পার্থক্য আছে, কিন্তু আমাদের ভারতীয় রেষ্টুরান্ট গুলোর মত নয়।
এর কারণ দুটো হতে পারে – এক, আমি নিজে মিডিল-ইষ্টার্ণ পাবলিক নয়। তাই আমার জিহ্বায় হয়ত সেই পার্থক্য ধরতে পারি নি। সিরিয়া বা তুরষ্কের ছেলেরা হয়ত ইউরোপে তাদের দেশের রেষ্টুরান্টে খেয়ে ঠিক একই কথা বলবে, আমি যা ভারতীয় খাবার খেয়ে বলি! দুই, হয়ত এই মিডিল ইষ্টার্ণ খাবারে তত বেশী মশালার আধিক্য থাকে না বলে। এদের খাবারে বেশী মশালার ব্যবহার না হবার জন্য এদের অরিজিন্যাল স্বাদ-কে কাষ্টমাইজড করতে হয় না ইউরোপীয় জিহ্বার জন্য, যেমনটা আমাদের ভারতীয় খাবারকে করতে হয়।
যাই হোক, মূল খাবারের কথায় ফেরা যাক। প্রথমে বলে নেওয়া যাক 'বেইটি কাবাব' এর কথা। বেইটি কাবাব হচ্ছে এক বিখ্যাত টার্কিশ ডিস যার নামকরণ করা হয়েছিল শেফ বেইটি গুলের-এর নামে। তাঁর ছিল এক বেশ জনপ্রিয় রেষ্টুরান্ট ইস্তানবুলে। একবার তিনি সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার নামকরা কসাই-এর মাংস কাটার ধরণ দেখে ইন্সপিরেশন পান। দেশে ফিরে বানান নিজের ভার্শান ল্যাম্বের মাংস দিয়ে।
এই ডিসে ল্যাম্বের মাংস মিহি করে গুঁড়া করে শিকে গেঁথে কাবাব বানানো হবে, তাবে সেই গুঁড়া মাংসের গায়ে লেপ্টে থাকবে ফ্যাটের একটা পাতলা কভার উনানে ঢোকানোর আগে। উনুন থেকে কাবার বেরুলে তাকে জড়ানো হবে 'লাভাস' দিয়ে (একধরণের স্পেশাল পাতলা রুটি) এবং সার্ভ করা হবে ট্যামেটো সস এবং ইয়োগার্ট এর সাথে। পাশে থাকবে একটু স্যালাড।
আমষ্টারডামে বেশ কিছু টার্কিশ রেষ্টুরান্ট আছে - আমার প্রিয় ছিল সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে একটু হেঁটে গিয়েই 'ইস্তানবুল গ্রিল'। মাঝে মাঝেই সেখানে ঢুঁ মেরেছি - বেশীর ভাগ সময়েই প্রায় দুর্দান্ত লেভেলের খাবার পেয়েছি - বেশী কেতের রেষ্টুরান্ট নয়, খাবারেই এখানে পরিচয় –
এবার আসা যাক সিরিয়ান ক্যুজিন-এ। আসলে আমার সব মিডিল ইষ্টার্ণ খাবার দাবারই ভালো লাগে - তাই নানা সময়ে ঘুরে ফিরে অসংখ্য মিডিল ইষ্টার্ণ রেষ্টুরান্টে খেয়েছি।
আজকে 'সাম' নামে এক সিরিয়ান রেষ্টুরান্টের খাবারের কথা, এও সেই আমষ্টারডাম শহরে। সাম হল গিয়ে সিরিয়ার রাজধানী দামাসকাস শহরের ডাক নাম। তো সেই থেকেই এরা খুলে বসেছে পুরানো স্মৃতি ভরা নাম নিয়ে রেষ্টুরান্টে। কালে কালে এরা এত বেশী নাম করে ফেলে যে তিনটি ব্রাঞ্চ খুলে ফেলে এদিক ওদিক। আগে থেকে বুক না করে গেলে টেবিল পাবার চান্স প্রায় নেই। আমি এখানে অনেকবার একা একা খেতে গেছি - বলেছে টেবিল নেই, আমি নেগোশিয়েট করেছি - আপনাদের পরের রিজার্ভেশন কটায়? রাত আটটার রিজার্ভেশনের ওরা আসার আগেই আমি খেয়ে হাওয়া হয়ে যাব এখান থেকে। দয়া করা আমাকে কোনের দিকে টেবিলে অ্যাডজাষ্ট করে দিয়েছে অনেক বার।
এদের কাবাব আমার এত ভালো লাগে যে সে জিনিস তো খাবোই!। তবে তার আগে স্টার্টারে খেয়ে নিই এরা যাকে 'মাজাস' বলে।
উপরের ছবিতে আছেঃ
হামুসঃ চিক পীজ, অলিভ ওয়েল, গার্লিক, হালকা করে লেবুর রস, ইয়োগার্ট এবং তাহিনি দিয়ে বানানো, অনেক সমইয় হামুসের উপরে ল্যাম্ব দেওয়া থাকে
বাবা গনুসঃ রোষ্টেড বেগুনের সাথে মিক্সড ভেজিটেবল আর বেদানা থেকে নিসৃত ঝোল টাইপের
মুটাবলঃ রোষ্টেড বেগুনের সাথে তাহিনি ও ইয়োগার্ট
মুহাম্মারাঃ গ্রিলড বেল পেপার এর সাথে ওয়ালনাট, তাহিনি আর বেদানার রস
মুসাক্কাঃ নানা ধরণের সব্জী (বেল পেপার, টম্যাটো, পেঁয়াজ ইত্যাদি) সিদ্ধের সাথে গার্লিক ও অলিভ অয়েল
ফাটুসঃ সিরিয়ান স্যালাডের সাথে সিরিয়ান স্পেশাল ব্রেড
সেদিন মেন ডিসে খেয়েছিলাম 'সিস টাউক' - যেখানে শিক কাবাবের মত জিনিসের সাথে ছিল ফ্লেভারড রাইস আর স্যালাড।
আর শেষ পাতে বাকলাভা-র কথা আলাদা করে বললাম না। সেই গল্প অন্য কোনদিন -
যাঁরা মালয়েশিয়ার লাঙ্কাভি গেছেন, তাঁরা হয়ত অনেকেই ঘুরে এসেছেন ‘পাডাং মাতসিরাত’ এর নাইটমার্কেটে। এটা মোটামুটি জনপ্রিয় রাতের ঘোরাঘুরি, খাবার জায়গা – বিশেষ করে জনপ্রিয় কমবয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে। তবে বিশাল কিছু উন্নত এমন ব্যাপার নয় – যদি আপনি হাইফাই নাইট লাইফ চান এখানে তা পাবেন না।
একদিন সন্ধ্যাবেলা আমরা এখানে ঘোরাঘুরি বা হালকা কেনাকাটা করছিলাম – আগে থেকে প্ল্যান ছিল না এখানে খেয়ে যাব কিনা। কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেয়ে গেলে ঠিক হল আজকে এখানেই খেয়ে নেওয়া যাক। তাহলে কোন রেষ্টুরান্টে খাওয়া হবে?
ঘুরতে ঘুরতে এই রেষ্টুরান্টটা চোখে পড়ল – পিছনে নানা দেশের পতাকা লাগানো। অমৃতা বলল, “চলো আজ এখানেই খাওয়া যাক, বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মনে হচ্ছে”। আমি বললাম, “মাথা খারাপ নাকি? এটা মনে হচ্ছে ফিউশন রেষ্টুরান্ট, দেখছো না সব দেশের পতাকা টাঙানো আছে পিছনে”। আমাকে বলা হল যে, পতাকা টাঙানো মানেই এটা ফিউশন রেষ্টূরান্ট এমন নয় – এটা খুব সম্ভবত ডেকোরেশন।
আমি তবুও খুঁতখুঁত করতে লাগলাম – ফিউশন রেষ্টুরান্টে আমার প্রচুর ভয়। যদি ভালো ভাবে মেশাতে পারে দুই দেশের খাদ্য তাহলে নতুন দিগন্ত খুলে যায়, আর যদি না পারে সেই খাবার প্রচুর ছড়ায়। আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ফিউশন রেষ্টুরান্টে ভালো খাবারের থেকে তত ভালো নয় এমন খাবার পাবার চান্স বেশী।
যাই হোক, এগিয়ে গিয়ে দেখলাম যা ভয় পাচ্ছিলাম তাই! এখানে ফ্রেঞ্চ, থাই, মালয়েশিয়ান টুইষ্ট – সে এক কনফিউজিং ব্যাপার।
ড্রিংস এর অর্ডার দিলে বলতে নেই ভালোই ককটেল বানিয়ে আনল। মনে পড়ছে স্টার্টারও খারাপ ছিল না। অমৃতা বলল, দেখলে, আসতে চাইছিলে না – কত সুন্দর খাবার!
আমি ভাবছি আগে মেন ডিস আসুক। অমৃতা দিল ল্যাম্বের ডিস অর্ডার, আমি কি একটা ফিস-এর ডিস দিলাম –
বেশ খানিক পরে সামনে যা সার্ভ করল, তা দেখে আমার গ্রামের নিমোর বাউরি পাড়ার লক্ষণের কথা মনে পড়ে গেল
লক্ষণ তার দিদির ছেলের অন্নপ্রাশন খেয়ে এসে গ্রামে ফিরে ফুটবল খেলতে এল। সবাই কেমন খাওয়া দাওয়া হল জানতে চাইলে লক্ষণ বলল,
"সি আর কি বুলবো! মাংসের ঝোল এদিক সেদিক গড়াই যাচ্ছে - কলাপাতার কোণটা ধরি সাপটাই দিলাম"
সামনে সেদিন ল্যাম্বের ডিস দেখে ভাবলাম, আহা যদি প্লেটের বদলে পাতায় দিতিস রে, ফিউশন ইটিং কাকে বলে দেখিয়ে দিতাম হাত দিয়ে সাপটাই দিয়ে!
তবে খাবারের টেষ্ট ভালো ছিল – শুধু চামচে করে সেই ঝোল উদরস্থ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল এই যা!
এই লেখাটা খাই দাই ঘুরি ফিরি'তে যাবে না?
হ্যাঁ, ট্যাগটা মিস হয়ে গেছিল, জুড়ে দিলাম।
সেকেন্ড ছবিটা র আপেটাইজার গুলো কি একাই খেলে -? এরপর আবার মেন কোর্স ? বাপরে।
ধন্যবাদ দমু-দি, হুতো
অমিতাভদা - অ্যাপেটাইজার দুজনে খেয়েছি একা নয় :) একা খেতে পারতাম না তেমন নয় অবশ্য!