বেশ কিছু বছর আগের কথা – ভিয়েতনাম বেড়াতে গেছি, অনেক এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে তখন আমরা হ্যানয় শহরে। যাঁরা হ্যানয় গেছেন, তাঁরা সবাই মানবেন মনে হয় যে হ্যানয় কিন্তু বেশ আকর্ষনীয় একটা শহর। এখানকার স্থাপত্য, সংস্কৃতিতে বেশ কিছু ফরাসী ছাপ এখনো রয়ে গেছে। তাই সেবার যখন ঘুরতে গেলাম, একদিন রাতের ডিনারে ঠিক হল যে ফ্রেঞ্চ-ভিয়েতনামী মিশ্রণের ফিউশন টাইপের রেষ্টুরান্টে খেতে যাব।
আর হ্যানয়ে ফ্রেঞ্চ-ভিয়েতনামী ফিউশন টাইপের রেষ্টুরান্টের মধ্যে এক অন্যতম জনপ্রিয় হল ‘গ্রীণ ট্যাঞ্জেরিন’। এই রেষ্টুরান্টটি হোন কিম এলাকার হাং বে স্ট্রীটে, যা একেবারে হ্যানয়ের ওল্ড কোয়ার্টারের যাকে বলে মধ্যস্থলে অবস্থিত। রেষ্টুরান্টটি দেখতে কিন্তু দারুণ – কারণ এটা কলোনিয়াল স্টাইলের একটা ১৯২৮ সালের বিল্ডিং-কে সাজিয়ে গুছিয়ে বানানো হয়েছে। এর প্রধান আকর্ষণের একটা কারণ হল, এরা এখনো সেই পুরানো ফ্রেঞ্চ-ইন্দোচায়না সময়ের যে অ্যাম্বিয়েন্স সেটা মেনটেন করার চেষ্টা করেছে। বাড়ির ভিতরে ঢুকেই একটা চত্ত্বর আছে উঠান টাইপের, সেখানে বসেও খাওয়া যায়, আবার বিল্ডিং এর ভিতরের রুমের টেবিলেও বসা যায়।
বুঝতেই পারছেন এমন রেষ্টুরাণ্ট যার রেটিং ভালো, ইতিহাস জুড়ে আছে তাতে ভীড় হবেই – তাই আগে থেকে রিজার্ভেশন না করে গেলে টেবিল পাওয়া চাপের। এখানে খেতে যাবার প্ল্যান হলে আমার খুব ভয় ভয় লাগলো! একে ফ্রেঞ্চে রক্ষে নেই, তাতে আবার ফিউশন! ফ্রেঞ্চ রেষ্টুরান্ট নিয়ে আমার ভয় কেন, তাহলে ব্যাপারটে একটু খানি বলি – পুরো লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে।
সারা পৃথিবীতে দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশীবার উচ্চারিত হয় কোন ফ্রেঞ্চ খাবারের নাম? চোখ বুজে মনে হয় এর উত্তর আপনি দিয়ে দিতে পারেন – ‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাই’ (গোদা বাংলায় আলুভাজা)।
এবার এর মধ্যে প্রবলেম হল, অনেকে মনে করেন এই ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নামক খাবারটির উৎপত্তি আদৌ ফরাসী দেশ নয়! আরো অনেক কিছুর মত এই জিনিস-কে টুইষ্ট দিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িতে দেবার দায়িত্ব নিয়েছিল আমেরিকান-রাই।
কেউ কেউ দাবী করেন এই ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের জন্ম আদপে হয়েছিল বেলজিয়ামের দক্ষিণ দিকে। এই এলাকার নদী ম্যুস থেকে মাছ ধরে ভেজে খেত স্থানীয় লোকেরা। শীতকালে নদীতে মাছ ধরতে পারত না বলে ওই সময় বেলজিয়ামের পাবলিক আলু ভেজে খেত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এই এলাকায় আমেরিকান সৈন্যরা এসে নাকি সেই আলুভাজা খেয়ে পছন্দ করে ফেলেছিল – আর বেলজিয়ামের দক্ষিণে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলা হত বলে, সৈনরা এর নাম দিয়ে দেয় ‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাই’! সেই শুরু – তবে আজকাল যে ভাবে অনেক জায়গায় ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সার্ভ করা হয় তাতে করে ক্লাসিক্যাল ফরাসীরা খুব একটা খুশী নয়।
বিভিন্ন দেশের লোকেদের যেমন স্টিরিওটাইপ করে বাজারে জোকস চালু আছে – যেমন ডাচ বা স্কটিশরা খুব কৃপণ, জাপানীরা কর্মঠ ইত্যাদি – তেমন ফরাসীদের সম্পর্কে ইউরোপের অন্য দেশে ওরা একটু উন্নাসিক এবং অলস বলে গল্পগাথা চালু আছে। তবে এগুলো সব সাবজেক্টিভ ব্যাপার। কিন্তু আর যা নিয়েই বিতর্কের অবকাশ থাক, আমার মনে হয় না দুটো জায়গা নিয়ে বিশাল কোন তর্কের জায়গা আছে – ফরাসীদের মত সৌন্দর্য্যবোধ, আর এদের মত বেকিং এক্সপার্টিজ। খুব কম জাতির মধ্যে এমন দেখা যায়।
তাহলে খাবার গল্প করতে গিয়ে সৌন্দর্য্য বোধের কথা উঠছে কেন? এটাই মূল কারণ – যদি নামী কোন ফ্রেঞ্চ রেষ্টুরান্টে খেতে যান, তাহলে সেটা নিজেই টের পাবেন। ধরুণ – একটা বিশাল স্টাইলের সাদা প্লেট দেবে – কিন্তু মাঝখানে ১০ গ্রাম মাংস, দুটো বীনসের দানা, এককাছি সবুজ পাতা চেরা। আর সেই মাংসের অর্ডার নেবার সময় আপনাকে ওয়েটার/ওয়ের্টেস সেই চিকেনের (যদি চিকেন অর্ডার করেন) বাল্যকাহিনী শোনাবে! চিকেন এই খেত, বনেবাদাড়ে খেলে বেড়াতো, তার মামারবাড়ি ওখানে, জবাই করার আগে সে এই এই জায়গা ভ্রমণ করেছে ইত্যাদি। প্রথম দিকে ঘাবড়ে যেতাম – এখন আলতো করে বলে দিই, চিকেনের জীবনগাথা শোনায় আমার ইন্টারেষ্ট নেই!
আর কোন ফ্রেঞ্চ শেফকে তার কোন ডিস একটু অ্যাডজাষ্ট করে আপনার টেষ্ট মত বানিয়ে দিতে বলে দেখেছেন? আপনাকে মনে হয় রেষ্টুরান্ট থেকেই বের করে দেবে। একবার ফ্রান্সের বুরুগান্ডী প্রদেশে এক রেষ্টুরান্টের বিখ্যাত ডিস ‘পিজিওন ব্রেষ্ট’ খেতে ঢুকেছিলাম – আমি দোষের মধ্যে ওয়েটারকে অনুরোধ করেছিলাম আমার মাংসটা যেন ‘ওয়েল ডান’ হয়। ব্যাস! শেফ শুনে রান্না ঘর থেকে চলে এল – অ্যাই, এই ভাবে ওয়েল ডান করে খেলে মাংস এবং ডিস তার মর্যাদা হারাবে। যদি খেতে হয় যেমন দেব তেমন খেতে হবে – ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রায় মারতে বাকি রেখেছিল!
আমষ্টারডাম অফিসে কোন সেলিব্রেশন ডিনার বা বিজনেস ডিনার হলে মাঝে মাঝেই রেষ্টুরান্ট বেছে নেবার ভার আমার উপর এসে যেত। শুনলে হয়ত একটু অবাক হবেন যে গড়পড়টা ডাচ লোকজনের আমষ্টারডামের রেষ্টুরান্ট নিয়ে খুব একটা ধারণা ছিল না, এর প্রধান কারণ হল এই শহরে ডাইন-আউট করা বেশ খরচের ব্যাপার। ডাচেরা এমনিতেই কিপটে তারপরে সত্যি করেই খাবারের দাম এত যে সপরিবারে রেষ্টুরান্টে নিয়মিত খেয়ে বেড়ানো অর্থনৈতিক কারণেই সম্ভব নয়। আমার আবার উল্টো – খেয়েই ফতুর যাকে বলে, অনেকটা তেমন। তো যাই হোক, সেবারে যখন আমার উপরে ভার এল রেষ্টুরান্ট বাছার, আমি ভাবলাম তাহলে এবারে ফ্রেঞ্চ রেষ্টুরান্ট ট্রাই করলে কেমন হয়! আমার বাড়ির সামনেই, ব্রাউজারগ্রাগট ক্যানাল যেখান থেকে শুরু হচ্ছে সেখানে একটা বিখ্যাত রেষ্টুরান্ট ছিল। আমি নিজেও খেয়েছি – এবং এত জনপ্রিয় যে রিসার্ভেশন না করে সেখানে যাবার কথা ভুলে যান। আবহাওয়া ভালো থাকলে এরা রেষ্টুরান্টের বাইরে, মানে ক্যানালের ঠিক ধারে চেয়ার, টেবিল পেতে দিত – সে বিশাল এক রোমান্টিক ব্যাপার। এই রেষ্টুরান্টের কেত নিয়ে পরের একদিন লিখব বিস্তারে।
তো যাই হোক সেদিন অফিসের কলিগদের সাথে ডিনারের জন্য সন্ধ্যা ছয়টায় টেবিল রিজার্ভ করলাম। অফিস থেকে বেরুলাম পাঁচটা পনেরোতে, পৌনে ছয়টায় রেষ্টুরান্টে পোঁছে গেলাম। দরজায় দেখি তখনো ক্লোজড লেখা আছে, তবুও ভিতরে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমরা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে যিনি ছিলেন তিনি তখন ওয়াইন গ্লাসগুলিকে নিবিষ্ট মনে সাদা কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঘষে ঘষে আরো চকচকে করে তোলার চেষ্টা করছেন। আমাদের দেখে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন ব্যাপার কি। আমি বললাম আমাদের রিজার্ভেশন আছে – আবার প্রশ্ন ধেয়ে এল কয়টার সময়। ছয়টায় রিজার্ভেশন শুনে ঘড়ি দেখে বললেন, “এখনো তো ছটা বাজে নি, পনেরো মিনিটি দেরী আছে – আমরা এখনো বন্ধ”। ব্যাস আর কথা নেই, নিজের মনে কাজ করতে লেগে গেলেন। এমন জিনিস বাপের জন্মে দেখি নি – ফাঁকা রেষ্টুরান্ট, মাত্র পনেরো মিনিট পরেই রিজার্ভেশন আছে, কিন্তু তবুও উনি বসতে বললেন না ফাঁকা টেবিলে! জনতা ব্যবহার দেখে খাপ্পা – বলল, এখানে খেতেই হবে না – রিজার্ভেশন ক্যানসেল করে দেওয়া হোক। কিন্তু বাকি কয়েক কলিগদের এখানকার ঠিকানা দেওয়া আছে বলে আবার সবাইকে ফোন করে নতুন রেষ্টুরান্টের ঠিকানা জানাও ইত্যাদি ঝামেলার এড়াবার জন্য সেদিন সেখানেই খাওয়া হয়েছিল। তবে সেই শেষবার – এর পরে দলবেঁধে অফিস থেকে আমরা কোনদিন আর ফ্রেঞ্চ রেষ্টুরান্টে যাই নি। অনেকে তো মুখের উপর বলেই দিত, ফ্রেঞ্চ রেষ্টুরান্ট হলে তারা ড্রপ আউট করবে ডিনার থেকে।
তো এমন আরো নানাবিধ অভিজ্ঞতার জন্য ফ্রেঞ্চ রেষ্টুরান্ট নিয়ে আমার আগেও ভয় ছিল, আর এখনো আছে! যদি বেশ খিদে পেয়ে যায়, তাহলে আমি পরাত পক্ষে ফ্রেঞ্চ রেষ্টুরান্টে ঢুকি না।
কিন্তু সেদিন হ্যানয়ে গেলাম – মানে বেশ খুবই কুন্ঠিত ভাবে গেলাম - কেউ জোর করে নি যেতে। কিন্তু ওখানকার বিখ্যাত রেষ্টুরান্ট, তাই না খেলেও নয়! রেষ্টুরান্টের সেট-আপ এবং অ্যাম্বিয়েন্স দেখেই মন ভরে গেল। ঘরের মধ্যে টেবিলে না বসে আমরা বসলাম উঠোনের মাঝে টেবিলে খোলা আকাশের তলায়।
তবে বলতে নেই খাবার খুব ভালো ছিল – ফ্রেঞ্চ পরিমাণে সার্ভ করা। আমার কাকার ছেলে বাবু খেতে গেলে মিনিমান তিনটে মেন ডিস লাগতো পেট ভরাতে – তাতেও মনে হয় তিনটে ডিস সাঁটাবার পরে জিজ্ঞেস করত, “হ্যাঁরে আর কিছু অর্ডার দিবি না”?
মেনকোর্স ফিউশন ডিস খেয়ে হালকা টের পাওয়া গেলেও, ডেসার্টে ফ্রেঞ্চ টাচ্-ই বেশী ছিল। ডেসার্ট-ই বেশী এনজয় করলাম। মোটের উপর সন্ধ্যেটা খারাপ কাটলো না!
এই লেখাটা কেমন অসম্পূর্ণ। কী কী খেলে নামগুলো তো বলবে রে বাবা!
যাঃ, এই শেফের প্লেটিং আমার তেমন ভালো লাগছে না! একমাত্র ডেসার্টটা তাও ঠিক আছে। হ্যাঁ, খাবারের নামগুলো বললেন না তো?
দমু-দি ঠিকই - ফ্রেঞ্চ খাবার নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি নিজেই কনফিউজড হয়ে গেছি মনে হচ্ছে! তবে সত্যি বলতে কি এই ডিস গুলো রেষ্টূরান্টে ঠিক কি নামে মেনু কার্ডে লেখা ছিল তা মনে পড়ছে না! মাংস হিসাবে চিকেন আর বীফ ছিল -
কেকে, একদম - প্লেটিং আমারও ভালো লাগে নি! কিন্তু খেতে দারুণ ছিল। ডেসার্ট প্লেট টাই কেবল সুন্দর ছিল। তবে সত্যি বলতে কি এই ডিস গুলো রেষ্টূরান্টে ঠিক কি নামে মেনু কার্ডে লেখা ছিল তা মনে পড়ছে না এই মুহুর্তে! মনে করতে পারলে লিখছি।
বেশ ভালো লাগছে। মাখন মাখানো ঝরjhorbhatere মত
পড়তে পড়তে খিদে পেয়ে গেলো...
আমি রোজই ফরাসী খাই। রি ব্লঁ, লাত্যাঁ রুজ আভেক পিমঁ ভ্যের, পাতাত ফ্রিত এত সেতেহ্রা
ছয় পোঁটলা ভাত দেখছি , সেশের আগের ছবিতে। এর চেয়ে বেশী ভাত অন্নপ্রাশনে সুকির ভাগনের পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়, তবে বাবু পারবে :-)
ভ্রমণ হিসাবে দারুণ কিন্তু প্লেটগুলো মনে হচ্ছে বাপির দোকানের পেস্ট্রি বসানো।
আমার গুরু সত্যবান মিত্র ও আমি পড়ে প্রভূত আনন্দ পেয়েছি। গুরু টাইপ করতে অক্ষম তাই ওনার ও আমার হয়ে এই যৌথ মন্তব্য দিলাম। আরও লিখুন আপন হাতটি খুলে।
বেশ রোম্যান্টিক খাওয়া খবর
ওরে বাবা! খাবার নিয়ে এতো কেতা!!