সেদিন যে রেষ্টুরান্টে খেতে গেলাম, তার সামনের রাস্তা দিয়ে মনে হয় হাজার বার হেঁটে গেছি – কিন্তু এই রেষ্টুরান্টটা খেয়াল করি নি, আর তাই এখানে আগে খাবার তো প্রশ্নই নেই। প্রধান কারণ দুটো – এক তো এটি নিতান্তই ছোট্ট এবং দ্বিতীয়ত এটা ‘বেলজিয়ান’ রেষ্টুরান্ট বলে দাগিয়ে দেওয়া আছে বাইরে। চারপাশে এতো রেষ্টুরান্ট থাকতে খামোকা কেন বেলজিয়ান রেষ্টুরান্টে খেতে যাব! এই ভাবনা থেকেই আগে একে এক্সপ্লোর করা হয় নি বলে নিজেকে প্রবোধ দিলাম।
রেষ্টুরান্টের নাম বঙ্গানুবাদ করলে অনেকটা এমন হবে “রেষ্টুরান্ট জর্জ-তে” [Restaurant Chez Geroges] ফ্রেঞ্চ ভাষায় ‘এস’ সাইলেন্ট, তাই ইংরাজীতে জর্জ। আগে লিখলাম বেলজিয়াম আর এখন ফরাসী লিখছি কেন? আসলে ম্যাপ দেখলেই বুঝতে পারবেন বেলজিয়াম আর ফ্রান্স কেমন পাশাপাশি মিলেজুলে আছে – বেলজিয়ামের অনেক জায়গায় ফ্রেঞ্চ ভাষাই বলা হয়। আর ক্যুজিনের হিসেব করলে, বেলজিয়ামের অনেক রান্নায় ক্লাসিক ফ্রেঞ্চ ছাপ রয়ে গেছে। সব মিলে মিশে বললে, রেষ্টুরান্ট জর্জ খাবার দিয়েছিল ক্লাসিক ফ্রেঞ্চ – বেলজিয়ান মিশ্রিত।
আমষ্টারডাম সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে মিনিট দশেক লাগবে হেঁটে গেলে – হেরেনগ্রাগট ক্যানালের ধারে ‘হেরেনস্ট্রাট’ নামক রাস্তার ধারে। আরো একটি অধিক চেনা জায়গার হিসেবেও এই রেষ্টুরান্টটিকে সনাক্ত করা যায় – এর থেকে কোণাকুণি খানিকটা এগিয়ে গেলেই অন্য একটি ক্যানালের ধারে (প্রিন্সেনগ্রাগট) আনা ফ্রাঙ্কের সেই বিখ্যাত বাড়ি।
তো এই রেষ্টুরান্টের সন্ধান পাওয়া গেল আমার এক বেলজিয়ান কলিগের কাছ থেকে – বয়েসে সে আমার থেকে অনেক বড়, নিজে বেলজিয়ান হলেও ডাচ মহিলা-কে বিবাহ করে অনেক বছর ধরে সে নেদারল্যান্ডেরই বাসিন্দা। নিজের বেলজিয়ান পরিচয়ে অধিক গর্বিত বলে বেলজিয়ান রেষ্টুরান্টই যে সে রেকমেন্ড করবে বলাই বাহুল্য! তবে এই রেষ্টুরান্টে খাবার পর সেই খাবার নিয়ে গর্বিত হওয়াটাকে আমি অন্যায্য বলতে পারলাম না। রেষ্টুরান্টের শেফ এবং বাকি একজন যে সার্ভ করে দুজনাই দেখলাম আমাদের কলিগকে খুব ভালোভাবে নাম ধরে চেনে। ফলতঃ বিশেষ খাতির পাওয়া গেল একটু। মাত্র দুজন দেখলাম রেষ্টুরান্ট চালাচ্ছে দেখলাম – টিপিক্যাল আমষ্টারডামের সরু তিনতলা কাঠের বাড়ি। নীচের তলায় কিচেন এবং সামনে দুটো টেবিল – তার থেকে কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয় উঠে এসে তিনটি টেবিল, এবং তার উপরের ফ্লোরে আরো তিনটি টেবিল। সব মিলিয়ে সর্বাধিক জনা ৩০ অতিথি-কে আপ্যায়ন করা যায় এখানে।
সেদিন খাওয়া দাওয়া সেরে ফেরার সময় শেফ-কে বিদায় জানাতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – এই রেষ্টুরান্টের তেমন বিজ্ঞাপন দেখি না কেন! আবারো সেই টিপিক্যাল উত্তর পেলাম – “দরকার পড়ে না”! রোজই সব টেবিল বুক থাকে, বেশীর ভাগ কাষ্টমারই রিপিট কাষ্টমার। টুরিষ্ট তেমন কেউ আসেই না এখানে – প্রায় চোখের আড়ালে তাদের। টেবিল রিজার্ভ না করে গেলে চান্স কম। তবুও কোন কোন টুরিষ্ট ঘুরতে ঘুরতে এখানে খেতে ঢুকে পরে এবং টেবিল খালি থাকলে তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ধরে নিতে হবে। রিজার্ভ করলে পুরো সন্ধ্যেটাই সেই টেবিলে অতিথি কাটাবে ধরে নেওয়া হয় – ফলে টেবিল টার্ন-রাউন্ড এর কোন কনসেপ্ট নেই এদের। ধীরে ধীরে খাওয়া এবং পান চলতেই থাকে। এত বেশী সময় নিয়ে চলতে থাকে খাওয়া দাওয়া যে এর ফাঁকে একটা পলাশীর যুদ্ধ টাইপের ছোটখাট ইভেন্ট কিছু ঢুকে যেতেই পারে! আমরা যেমন সেদিন ঢুকলাম সন্ধ্যে ছয়টায়, আর বেরুলাম যখন তখনো আলো বাইরে, কিন্তু বেজে গেছে রাত সাড়ে দশটা! শেষ পাতে এসপ্রেসো পান যখন করলাম তখন ভুলে গেছি কি স্টার্টার দিতে শুরু হয়েছিল ডিনার! আর তার থেকেও বড় কথা, হালকা খিদে পাচ্ছিল আবার! হোটেলে ফিরে মিনিবার থেকে হালকা চকোলেট টাইপের কিছু একটা খেয়ে খিদে নেভালাম। তো এই সব মিলিয়েই “চেজ জর্জেস” এমন একটি রেস্তোরাঁ যা অন্যান্য রেস্তোরাঁর থেকে বেশ কিছু আলদা, আর মনে হয় সেটাই এখানে যারা বারে বারে ঘুরে ফিরে খেতে আসেন তাঁরা সবচেয়ে বেশী পছন্দ করেন।
বিভিন্ন কোর্সের ভিতরে ঢুকে গিয়ে উপভোগ করবে খেতে আসা অতিথিরা এবং একে অপরের সঙ্গ এমনটাই পছন্দ শেফের। ফেঞ্চ-বেলজিয়ামের মিশ্রণে ক্যুজিন হলে কি হয় ফরাসী কেতা কি আর অত সহজে ভোলা যায় খাবার পরিবেশনের সময়! সেই ইয়াব্বড় প্লেট আর তার মাঝে ইট্টু খাবার – সেই ছকের বাইরে আর বেরোতে পারলেন কৈ হে শেফ জর্জ! তবে এটাও ঠিক এই প্লেটিং পদ্ধতি থেকে বিচ্যুত হলে তাকে কি আর ক্লাসিক ফ্রেঞ্চ ঘেঁষা বলা যাবে!
আর বলাই বাহুল্য এমন সব স্পেশাল রেষ্টুরান্টে যেটা হয়, মানে মেনু মাত্র একপাতার। যদিও আমষ্টারডামে তত বেশী দেখি নি, কিন্তু টুরিষ্টপ্রধান জায়গায় দেদার রেষ্টুরান্ট দেখেছি যাদের মেনু এ টি দেবের ডিক্সেনারীর মোটাত্বর সাথে পাল্লা দেবে। তাদের থাকে পৃথিবীর সব বিখ্যাত ক্যুজিনের খাবার – ওদিকে সুসি থেকে শুরু করে এদিকের আটল্যান্টিক স্যামন। শেফ জর্জ সে সব ভাবতেই পারেন – তাই তাঁর মেনু মাত্রই এক পাতার। এবং আপনার চয়েস বলতে সেদিনের তিন, চার বা পাঁচ কোর্সের মেনু – একটা থাকে মাছ বেসড আর একটা মাংস বেসড। আগে থেকে বললে মনে হয় মিক্স-ম্যাচ করে দিতে পারবে। কিন্তু টেবিলে বসে এমন উদ্ভট দাবী করার আগে ভেবে চিন্তে নেবেন – বিখ্যাত ডাচ কাষ্টমার সার্ভিসের ঐতিহ্য মেনে আপনাকে বেরিয়ে যেতে বলতে পারে রেষ্টুরান্ট থেকে :) তবে আলা-কার্ট নেই এমন নয় – তিন চার রকম স্টার্টার, দুই-তিন রকম ফিস, তিন-চার রকম মিট এবং দুই-তিন রকম ডেসার্ট – এর মধ্যে থেকেই বেছে নিতে হবে। সেদিন আশে পাশে যাদের খেতে দেখলাম এবং আমার কলিগ যে এখানে প্রায়ই আসে, তার সাথে কথা বলে বুঝলাম যে বেশীর ভাগ জনতাই তিন বা চার কোর্সের মিল পছন্দ করে – এবং কম্বিনেশনটা শেফের উপরের ছেড়ে দেয়। তার থেকে আর ভালো কে জানবে কিসের সাথে কি যায়!
খাবারের মেনু চেঞ্জ হয় সিজিন অনুযায়ী – আর পাঁচটা ভালো শেফের মত ইনিও ফ্রেস এবং সিজিন্যাল জিনিস পত্র ব্যবহার করেন। একদম নিজে গিয়ে বাজার করে আনা থেকে সবটাই পার্সোনাল টাচ। আগেই যেমন লিখেছি খাবারের মূল সূর ফরাসী ক্লাসিকের। এর ফলে কিছু ডিস বিশাল ভালো মনমোহন কারী দেখতে না হলেও মুখে দিলে টের পাবেন খাবারের সাথে দেওয়া সস-টি জিহ্বা ভালোবেসে জয়কারী। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে ফ্রেঞ্চ রান্নায় সসের ব্যাপারটা আমাদের সাউথ ইন্ডিয়ার রান্নার রসমের মত। ওরা সস-সস আর এরা রসম-রসম করেই রান্না ঘর মাতিয়ে রেখেছে যুগের পর যুগ।
এই মাসে এদের মেনুতে রয়েছেঃ
স্টার্টারঃ
১) এ টাওয়ার অফ লাইটলি স্মোকড স্যামন, রাটাটুলি ট্রাফল মেয়োনিজ, টেরাগন সস
২) প্রণস্ পোচড ইন হোয়াইট ওয়াইন অ্যান্ড গার্লিক, লবষ্টার – ব্যুরে ব্ল্যাঙ্ক
৩) স্ক্যালপস্ ‘সেন্ট জ্যাকুয়ে’, সুইট প্যাটেটো ক্রীম, হলেন্ডাইজ সস
8) গুজ লিভার, বালসেমিক গ্লেজ এবং ট্রাফল মেয়োনিজ
ফিস ডিসঃ
১) কড ফিলে, রোসেভ্যাল পট্যাটো, ভেজেটেবল অ্যান্ড টেরাগন সস
২) ডুয়ো অফ নর্থ সী ফিস, রোসেভ্যাল পট্যাটো, লবষ্টার ব্যুরে ব্ল্যাঙ্ক
মিট ডিসঃ
১) ফিলে স্টেক, ভেজিটেবল, পট্যাটো গার্ণিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ড মাশরুম সস
২) ল্যাম্ব ফিলে অ্যান্ড ল্যাম্ব চপ, ভেজিটেবল, পট্যাটো গার্ণিশ, সার্ভড উইথ ল্যাম্ব গ্রেভী
৩) ‘গেন্ট ওয়াটারজুই’ – বেলজিয়ান লোকাল ডিস উইথ ডাক কনফি, ক্রিম, পট্যাটো সার্ভড উইথ ব্রেড
৪) ভীল ফিলে স্টেক, ভেজিটেবল, পট্যাটো গার্ণিশ, রেড ওয়াইন জ্যুস
ডেজার্টঃ
১) বেলজিয়ান ক্লাসিক প্যান কেক
২) শেফ স্পেশাল ম্যুস উইথ স্ট্রবেরী সরবে অ্যান্ড ফ্রেস ফ্রুটস
স্টেক খেয়ে খেয়ে কদিন জিহ্বা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল বলে আমি নিয়েছিলাম ফিস স্পেশাল মেনু। পাঁচ কোর্সের মেনু - মানে ডেজার্ট বাদ দিলে চার কোর্সের ফিস ডিস। অবশ্য একেবারে প্রথম ডিসটা ছিল স্পেশাল ফিস স্যুপ। সে জিনিস এমন ভাবে এনে দিল যে আমি তো ভেবেছিলাম এসপ্রেসো দিয়ে গেল বুঝি! খাবারের প্রথমেই কফি কেন সেই নিয়ে যখন হালকা ধ্বন্দে আছি, তখনই শেফ এসে সন্দেহ ভঞ্জন করে দিলেন। একচুমুকেই মেরে দিলাম – কাপটা নামিয়ে বুঝলাম চামচটা ব্যবহার করা উচিত ছিল! এটিকেট এক ইরিভার্সিবল জিনিস – তাই আর সামাল দেবার চেষ্টা করার মানে হয় না, কেবল পরের বার দেখা যাবে নিজে এই বলা ছাড়া।
প্রত্যেক ডিসের সাথে ম্যাচিং ওয়াইন তো থাকেই – বুরুগ্যান্ডির সাদা ওয়াইন সাথ দিল মাছের, আর বোর্দো সাথ দিল মিট ডিসের। সাথের পাবলিকরা রাত দশটার আরেক বোতল ওয়াইন অর্ডার করছিল – বললাম চার ঘন্টার বেশী ডিনার টেবিলে থেকে আমার পা ধরে গেছে – আরো পান করতে হলে অন্য পাবে যাওয়া যাক। সেই মত সেদিনের মত ডিনার শেষ করে গিয়ে ঢুকলাম ভিক নামক বারে। তবে সেই গল্প অন্য কোন দিন –
সেদিন যে ডিস গুলো খেলাম তাদের ছবি দিচ্ছি - এদের নাম জানতে ইচ্ছুক হলে উপরের মেনুতে যা যা নাম লিখেছি তাদের সাথে ম্যাচ করে নিন :)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।