সে অনেকদিন আগের কথা - বেড়াতে গিয়ে ব্রেকফাস্টে দেরি হয়ে গেল, মানে প্রতিদিনই হয় আর কি। যারা সেজেগুজে বেড়াতে যেতে পছন্দ করেন, তাঁরাই জানবেন, সকালের এই সময়টা কতটা ইমপর্টেন্ট। ওদিকে ট্রেন/বাস/ট্যুর ছেড়ে দেবে, বা যেখানে যেতে চাইছেন সেখানে যেতে দেরি হবে। আপনি সকাল থেকে তাগাদা দিচ্ছেন, “কৈ গো – হল তোমার?” উত্তর আপনি প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে একই পাচ্ছেন – “এই তো হয়ে গেছে, তুমি জুতোটা গলাও, আমার হয়ে গেছে।”
আপনি প্রথম প্রথম সেই কথায় বিশ্বাস করে জুতো গলিয়ে বসে থাকতেন – কিন্তু এখন দাম্পত্য জীবনে আপনি পরিপোক্ত হয়ে গেছেন। তাই উত্তর দেবেন – “জুতো পরতে আমার এক মিনিট লাগবে”! মানে রেডিনেসের প্রুফ নিজের চোখে না দেখে আপনি নড়ছেন না আর কি!
এখনকার দিন হলে আপনি হয়তো অত অধৈর্য্য হবেন না – স্মার্টফোনে টাইম পাস করে নেবেন। গিভ আপ অনেক আগেই করে দিয়েছেন, যা করছে করুক – এই মর্মে। আপনি ফেসবুকে কালকের তোলা ছবি পোস্টাচ্ছেন। কিন্তু প্রাক-স্মার্টফোনের যুগে? বা পরে যখন হালকা স্মার্ট এল, কিন্তু ওয়াইফাই ফ্রি নয় হোটেলের রুমে – তখন তো সময় কাটতেই চাইত না! হোটেলের রুমের টিভি চ্যানেল চালিয়ে বসে আছেন – যে চ্যানেলের ভাষা বুঝতে পারছেন, তার মধ্যে একটা সিএনএন আর একটা বিবিসি ওয়ার্ল্ড। সকাল থেকে আমেরিকায় কোন স্কুলে গুলি চলেছে, কোথায় বোমা ফেটেছে, কোন নেতা কোথায় মিট করেছে – এই সব শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আপনি আদার ব্যাপারি, জাহাজের খোঁজে আপনার দরকার নেই – তাই এখন টিভি মিউট করে খবর দেখছেন। তাই বা আর কতক্ষণ দেখবেন! ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে আপনি শেষ ব্রহ্মাস্ত্রটি প্রয়োগ করলেন –
“এর বেশি দেরি করলে কিন্তু ব্রেকফাস্টের টেবিল পাব না। কাল রাতে পাঁচটা বড় বড় বাস বোঝাই গ্রুপ ট্যুরের লোকজন ডাউনলোড হয়েছে দেখনি?”
এবার তেনার টনক নড়ল – “তাহলে এক কাজ কর। তুমি এগিয়ে গিয়ে টেবিল দখল করে বস। রুমের কার্ড নিতে হবে না। আমি রুম লক করে যাব।”
আপনি সেই ফাঁদে পা দিয়ে ব্রেকফাস্ট রেস্টুরান্টে গিয়ে বসলেন – অনেকক্ষণ বসলেন, বসেই রইলেন। দোনামনা করলেন, একা একা খাওয়া শুরু করব! কিন্তু সামনে সবাইকে ডিশ-ভর্তি জমকালো খাবার নিয়ে যেতে দেখে, খাবারের সুগন্ধে নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। খেতে শুরু করলেন ব্যুফে-র একদিক থেকে। এটা-সেটা খেয়ে ভাবলেন, বউ আবার আজকাল ডিমের কুসুম খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করছে, যাই, এই ফাঁকে ডিমের ওমলেট সাঁটাই।
আমিও সেদিন তাই করলাম। পাশ দিয়ে ওয়েটার যাচ্ছিল, তাকে বললাম, “আচ্ছা ওমলেট পাব কোথায়”? সে বলল ওমলেট স্টেশনে চলে যান! ওমলেটের যে আবার স্টেশন হয়, তা কে জানত! তো যাই হোক, যেন বেমানান না লাগে – এমনভাবে দুলকি চালে ওমলেট স্টেশন খুঁজতে বেরুলাম। সেই প্রকাণ্ড জায়গা পাক দিয়ে, প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার সময় দেখতে পেলাম, এক শেফ এক গাদা ডাঁই করে রাখা ডিমের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝতে পারলাম এই সেই মোক্ষ স্থান! গিয়ে চাইলাম ওমলেট – ব্যস, প্রশ্নবাণে গেলাম ফেঁসে! প্রায় ৫ মিনিটের ইন্টারভিউ দিয়ে, ১০ মিনিট বাদে ওমলেট নিয়ে টেবিলে ফিরলাম।
টেবিলে এসে ডিম শেষ করেছি কি বউ এসে হাজির! প্রায় কান ঘেঁসে গেল কেসটা। বউও এটা-সেটা খেয়ে আমাকে বলল, “শোনো না, বুঝতে পারছি একটু দেরি হয়ে গেছে – তাই বলি কি, তুমি আমার জন্য একটা ওমলেট বানিয়ে নিয়ে এস।” আবার ওমলেট আনতে যেতে হবে জেনে মুখ শুকিয়ে গেল আমার – মিনমিন করে বললাম, “আবার ওমলেট খাবে”? বউ বেশ বিরক্ত এবার, “খাব না কেন? আমার তো আর কোলস্টেরলের প্রবলেম নেই! আর তা ছাড়া একটা ডিম এনে দেবে, তার জন্য মুখটা এমন করছ, যেন তোমাকে পোস্ত বেটে দিতে বলছি”।
কি আর বলি! মিনিট ২৫ আগে ওমলেট স্টেশনে ঘটে যাওয়া ঘটনা তো আর বউকে বলতে পারছি না! সেই প্রথমবার গিয়ে শেফকে বলেছিলাম,
-একটা ওমলেট বানিয়ে দিন তো
-কি ওমলেট?
প্রশ্ন শুনে আমি অবাক – কি ওমলেট মানে? ডিম ফ্যাটানো হবে, এক চিমটে নুন, কুচো পেঁয়াজ, লঙ্কা – কড়ায় তেল হলে ফ্যাস করে ছেড়ে দেওয়া – ব্যাস, ওমলেট তৈরি! সেই শেফ আমাকে ফিরিয়ে প্রশ্ন করল,
-মানে আপনি কি ওমলেট নেবেন? আমেরিকান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ফ্রিট্টাটা, স্যুফলে স্টাইল?
আমি দেখলাম কেস কেঁচো – কি চাইব, কি দেবে। কিন্তু মোচকানো তো যায় না – তাই কথা ঘুরিয়ে বললাম,
-ঠিক আছে, আজ ভাবছি ওমলেট খাব না। আমাকে ডিম ভেজে দাও।
ভাবলাম ডিম ভাজার মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু জটিলতা থাকবে না। কিন্তু কি ভুলই ছিলাম আমি! এবার প্রশ্ন ধেয়ে এল,
-আপনি কেমন ফ্রায়েড এগ চান? সানি সাইড আপ? নাকি ওভার ইজি, ওভার মিডিয়াম বা ওভার ওয়েল?
ওমলেট খেতে গিয়ে তবু স্প্যানিশ ওমলেট বা আমেরিকান ওমলেটের মধ্যে ওমলেট নামটা ছিল! এবারে ফ্রায়েড এগ চেয়ে দেখি চেনা কিছু নাম তো কমন পড়ল না! তাই আবার লজ্জার মাথা খেয়ে ওমলেটে ফিরে গেলাম।
-আমাকে আপনি একটা সিম্পল ওমলেট দিন বরং চট করে
-ওকে, তাহলে কি কি দেব ওমলেটে?
কি কি দেব মানে! যা বুঝলাম, সামনে কয়েক গণ্ডা বাটিতে রাখা পেঁয়াজ, চিজ, ট্যমেটো, পিপার, অলিভ, চিলি, হ্যালাপিনো – এবং আরো হাবিজাবি সব আছে। আমি দেখলাম, নিচ্ছি যখন, সব মিশিয়ে নেওয়াই ভালো। একটা ভালো খেতে না হলে, অন্য যেটা খেতে ভালো – তার সাথে ব্যালেন্স হয়ে যাবে! আমার সব মেশানো অনুরোধ শুনে শেফ হালকা অবাক হলেও কিছু বলল না। সে এক গাবদা ওমলেট বানিয়ে দিয়েছিল, যেটা আমি খেয়ে শেষ করতে পেরেছিলাম বউ আসার জাস্ট আগে।
তাই এবারে ওমলেট আনতে গিয়ে সব আর দিতে বললাম না – কারণ অত গাবদা ওমলেট খেতে পারবে না। পেঁয়াজ, লঙ্কা, চিজ দিয়ে বানানো ওমলেট বানিয়ে সেদিন মুখরক্ষা হল!