আমার দাদু-ঠাকুমার গল্প : মলয় রায়চৌধুরী
টিপিকাল বাঙালি ট্যুরিস্ট হিসাবে নয়, বলা চলে উদ্দেশ্যহীনভাবে, ঘুরে বেড়াবার নেশা পেয়েছি পারিবারিক স্তরে। সারা জীবন ঘুরে বেড়িয়েছি, শহরে, গ্রামে, রাস্তায়-রাস্তায়, এদেশের রাজ্যগুলোতে, বিদেশে। আমার ঠাকুর্দা ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। গ্রামের মানুষদের জীবন দেখার লোভে আমি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভালো চাকরি ছেড়ে এআরডিসিতে জয়েন করেছিলুম। এখন আমার বুড়ি স্ত্রী বলে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ছাড়া বোকামি হয়েছিল, ওদের পেনশন কতো বেড়ে গেছে। সত্যি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একজন পিওনের সঙ্গে পাটনায় দেখা হয়েছিল, আমিই ওকে চাকরি পেতে সাহায্য করেছিলুম ; ওর পেনশন আমার চেয়ে বেশি। ঘোরাঘুরির নেশার দরুন আমার লেখালিখি ছেড়ে গিয়েছিল প্রায় দেড় দশক। অথচ ভারতবর্ষ চরে না বেড়ালে কিছুই জানতে পারতুম না।
আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী (জন্ম: জানুয়ারি ১১, ১৮৬৬ - মৃত্যু: নভেম্বর ৮, ১৯৩৩) ভারত উপমহাদেশের ‘ভ্রাম্যমাণ’ পেশাদার আলোকচিত্রী-চিত্রকরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। দাদু ১৮৬৬-তে, বর্তমানে যা পাকিস্তান, সেখানে রায়চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি - ফোটোগ্রাফার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস নামে একটা ‘ভ্রাম্যমাণ’ সংস্হা আরম্ভ করেছিলেন; সংস্হা বলতে তিনি আর তাঁর যুবক-তরুণ ছেলেরা, কেন-না কোনো নির্দিষ্ট দোকান উনি প্রথমে খোলেননি, যাঁরা ফোটো তোলাতে চাইতেন, বেশির ভাগই রাজ-ঘরানা বা ধনী পরিবারের সদস্যরা, তাঁদের বাড়ি গিয়ে ফোটো তুলে কিংবা সেই ফোটো থেকে পেইনটিং এঁকে ডেলিভারি দিতে হত, ফলে শহরে-গঞ্জে ঘুরে-ঘুরে ফোটো তুলতে হত ওনাকে। নবাব বা রাজাদের ঘোড়ার বা উটের গাড়ি এসে ওনাকে নিয়ে যেত। এখনকার পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত শহরে উনি ফোটো তুলতে যেতেন। সবই আমার ঠাকুমা এবং বড়োজেঠা ও বাবার মুখে শোনা। মহারাজা রঞ্জিত সিংহ সম্পর্কে গালগল্পে প্রভাবিত হয়ে ঠাকুমা বাবার নাম রেখেছিলেন রঞ্জিত।
১৯৩৩-তে দাদা সমীর রায়চৌধুরীর জন্মের কয়েকদিন পরেই দাদু মারা যান। দাদু মারা যাবার পর প্রথমে আমার বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী, আর এখন দাদা সমীর রায়চৌধুরীর বড়ো ছেলে হৃদয়েশ (টোটোন) সংস্হাটাকে চালান। দাদুর সময় থেকে তাঁর ছেলের পৌত্র হৃদয়েশ রায়চৌধুরীর ফোটোগ্রাফির প্রযুক্তিগত কাজ এত পালটে গিয়েছে বলেই শিরোনামে গল্প শব্দটা ব্যবহার করেছি। দাদু কেমন করে ফোটোগ্রাফির ব্যবসায় ঢুকলেন, তা-ও এক গল্প, কেন-না সেসময়ে ইংরেজরাই এই কাজটা দখল করে রেখেছিল। আর রাজা দীন দয়াল।
রায়চৌধুরী পদবি সম্রাট আকবর আর জাহাঙ্গিরের দেয়া, একবার রায় আর একবার চৌধুরী। আমাদের আদি নিবাস ছিল যশোহর আর সেখান থেকে কলকাতায় এসেছিলেন পূর্বপুরুষ লক্ষ্মীকান্ত-- যিনি প্রথম সাবর্ণ রায়চৌধুরী। ১৬৯৮-এ সাবর্ণ রায়চৌধুরীরদের থেকে কলকাতা, সুতানুটি আর গোবিন্দপুরের ইজারা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হাতবদল করার পর তাঁদের আর্থিক অবস্হা খারাপ হয়ে যায়। তাঁরা ব্রিটিশদের সমর্থন করার বদলে সিরাজ-উদ্-দৌলাকে সমর্থন করার দরুন ইংরেজদের নেকনজর থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। সম্রাটের দেয়া সোনার গিনি আর রুপোর টাকা খরচ হয়ে যাবার পর আঠারো শতক থেকে পরিবারের সদস্যরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জীবিকার খোঁজে ছড়িয়ে পড়েন। আসলে শরিকের সংখ্যাও বেশ বেড়ে যাচ্ছিল, কেন-না অনেক সদস্য একাধিক বিয়ে করছিলেন।
দাদুর বাবা ষোলো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে তেরো বছর বয়সি কলকাতার পটলডাঙা নিবাসী মুখোপাধ্যায় পরিবারের অপূর্বময়ীর সঙ্গে দেবার পর, শ্বশুরের দাক্ষিণ্যে দাদু কলকাতার তখনকার বুদ্ধিজীবী সমাজের সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হন, যাঁরা বেশিরভাগই ছিলেন ব্রাহ্ম, এবং তাঁদের সান্নিধ্যে ভালো ছবি আঁকতে শেখেন। ব্রাহ্মদের সঙ্গে মেশা অনুমোদন করেননি ঠাকুর্দার মা-বাবা। লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন অপূর্বময়ীর জেঠামশায়ের ছেলে। বাবার সংসারে বাবার দেয়া হাতখরচে, স্ত্রীকে নিয়ে থাকতে ঠাকুর্দার আত্মসম্মানে লাগছিল বলে তিনি ছবি আঁকার মাধ্যমে রোজগারের প্রয়াস আরম্ভ করেন। ত্রৈলোক্যনাথ যখন কলকাতা মিউজিয়ামের অ্যাসিস্ট্যান্ট কিউরেটার ছিলেন, তখন তাঁর সুপারিশে আমার বড়োজেঠা পাটনা মিউজিয়ামে চতুর্থশ্রেণির কর্মীর চাকরি পান, মূর্তি আর ছবি ঝাড়পোঁছ করার; স্বাধীনতার পর বড়োজেঠার পদের নাম হয়েছিল ‘কিপার অভ পেইনটিংস অ্যান্ড স্কাল্পচার’, মাইনে একশো টাকা। আরম্ভ করেছিলেন দশ টাকায়। আমি শৈশবে গরমের ছুটিতে বড়োজেঠার সাইকেলের পেছনের সিটে বসে মিউজিয়ামে যেতুম আর ঘরে-ঘরে ঘুরে বেড়াতুম; সে অভিজ্ঞতা আমার লেখালিখিতে কাজে দিয়েছে।
ব্যবসার কাজে সে সময়ে বাহওয়ালপুরের (বর্তমানে পাকিস্তানে ) আমিরের প্রতিনিধি কলকাতায় ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, আর তাঁর সঙ্গে ঠাকুর্দার পরিচয়ের সুযোগ হয়। আমিরের প্রতিনিধি দাদুর আঁকবার প্রতিভায় মুগ্ধ হন, এবং দাদুকে বাহাওলপুর রাজ্যে, রাজপরিবারের সদস্যদের স্কেচ আর তা থেকে পেইনটিং আঁকার জন্য, সস্ত্রীক অতিথি হিসাবে যাবার আমন্ত্রণ জানান। ঠাকুর্দা ছয় মাস পর বাহাওলপুর পৌঁছান; আমির তাঁর আঁকা পোরট্রেট দেখে দাদুকে প্রশংসার চিঠি দিয়েছিলেন ---- যাতে তিনি চিত্রাল, হুনজা, ফুলরা, মাকরান ইত্যাদি রাজপরিবারে গিয়েও ছবি এঁকে রোজগার করতে পারেন। বড়োজেঠা বলেছিলেন যে বাহাওলপুরের দুটি ডাকটিকিটের ড্রইং ঠাকুর্দার আঁকা, তা-তে সেখানকার আমিরের মুখাবয়ব ছিল। পাকিস্তানে এখন যেমন সামন্তবাদের রমরমা, তখন আরও বেশি ছিল, তাঁরা এমনকি কেনা গোলাম আর বাঁদি রাখতেন। বড়োজেঠার মুখে শুনেছি যে, যারা হাজার-হাজার একরের মালিক ছিল তাদের বলা হত তালুকদার, মনসবদার, মাহের, নবাব, নবাবজাদা, চৌধারি, খান, জাগিরদার, সরদার, মাহালওয়ার ইত্যাদি --- এদের কাছ থেকে দাদু ফোটো তোলার জন্য ডাক পেতেন। তাঁদের বাড়ির রান্নাবান্না শিখে ফ্যালেন ঠাকুমা।
বিভিন্ন রাজপরিবারের সদস্যদের মুখাকৃতি আঁকার সূত্রে ঠাকুর্দা আফগানিস্তানের রাজপরিষদের সদস্যদের ছবি আঁকার আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন। অন্যান্য সামন্তপ্রধান অথবা শিয়া ধর্মগুরুদের দরবারে আতিথ্যের সময়ে তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হন এবং ঠাকুর্দা লাহোর শহরে কিছুদিনের জন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন। লাহোর শহরে রোজগেরে কাজের খোঁজে তিনি তখনকার মেয়ো কলেজ অভ আর্টসের (বর্তমানে পাকিস্তানের ন্যাশানাল কলেজ অভ আর্টস) অধ্যক্ষ জন লকউড কিপলিংয়ের স্টুডিয়োয় কর্মচারীর চাকুরি পান। জন লকউড কিপলিং পরে লাহোর মিউজিয়ামের কিউরেটার হন। ইনি ছিলেন রুডিয়ার্ড কিপলিঙের বাবা।
জন লকউড কিপলিংয়ের বাড়িতে ও দফতরে কাজ করার সময়ে ঠাকুর্দা পরিচিত হন নতুন উদ্ভাবিত ফোটো তোলার ক্যামেরার সঙ্গে। ১৮৩০-এ লুই ড্যাগোরো ক্যামরা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু সেটিতে একবারে কেবল একটিই ফোটো তোলা যেত, সেই ফোটোকে নুনজলে চুবিয়ে স্হায়ীত্ব দেয়া হত, কিন্তু তা কিছুকাল পরেই হলদেটে হয়ে যেত। ১৮৪১-এ ফক্স ট্যালবট আবিষ্কার করেন ক্যালোটাইপ প্রক্রিয়া। ক্যালোটাইপের মাধ্যমে একাধিক ফোটো প্রিন্ট করা সম্ভব হতে লাগল, কিন্তু তখনও কাগজে। ১৮৮০ নাগাদ ভারতে জিলেটিন প্রক্রিয়ায় ফোটো তৈরির কৌশল এসে পৌঁছোয়, প্রধানত ব্রিটিশ ফোটোগ্রাফারদের মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ায় কোলোডিয়ান প্রক্রিয়ার বদলে জিলেটিনের শুকনো প্লেট ব্যবহার করা হত— কাচের প্লেটের উপর লাগানো সিলভার হ্যালিডেসের ফোটোর রসায়ন। নতুন বেলোলেন্স ক্যামেরাও এই সময়ে আবিষ্কার হয়। হারমোনিয়ামের যেমন বেলো হয়, বেলোলেন্স ক্যামেরাতেও তেমন বন্ধ আর খোলার ব্যবস্হা ছিল।
দাদু ফোটোগ্রাফি শিখতে লাগলেন, কিন্তু নতুন কাজের জন্য ডার্করুমের দরকার পড়ল। উনি একটা বেলোলেন্স ক্যামরা, ক্যামেরার তিন-ঠেঙে স্ট্যাণ্ড কিনে ১৮৮৬-তে লাহোরে স্হায়ী ব্যবসা আরম্ভ করলেন। বাড়িতে একটা ছোটো ঘরকে ডার্করুম হিসাবে ব্যবহার করতেন, জানলাগুলো কালো কাপড়ে ঢাকা দিয়ে। মুসলমান পরিবারের বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, পর্দাপ্রথার কারণে ঘরগুলোয় জানালা একটা বা দুটা ছিল। ব্যবসায়িক সংস্হার নাম রাখলেন রায়চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি - ফোটোগ্রাফার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস। বাবা যখন পাটনায় দোকান করেন তখন এই নামই বজায় রাখেন। আমার ভাইপো হৃদয়েশ. নামটা পালটে ফেলেছে, যা-তে অন্য শরিকরা গিয়ে ব্যবসার অংশ না দাবি করে; তাছাড়া বাবা নিজের পুঁজিতে ব্যবসা চালাতেন, তখন খদ্দেররা বক্স ক্যামেরা আর ভিউ ফাইন্ডার ক্যামেরা কিনত যা পনেরো টাকা থেকে সাতশো টাকায় পাওয়া যেত। ভাইপো যে-ক্যামেরা বিক্রি করা আরম্ভ করেছে তা এক লাখ-দুই লাখ টাকা দামের, যার পুঁজিনিবেশ ক্যামেরা কোম্পানিরাই করেছে, তারাই দোকানের ভোল মাঝে-মাঝে পালটে দিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে থাকে। ক্যানন, নিকন-এর বিশাল বোর্ডের পাশে ছোটো করে লেখা থাকে ‘রায়চৌধুরী ফোটোগ্রাফার্স’। অ্যানালগ ফোটোগ্রাফি পৌঁছেচে ডিজিটাল ফোটোগ্রাফিতে। স্টুডিয়ো আর নেই, পুরো দোকানবাড়ি নানারকম ক্যামেরা, কম্পিউটার আর যন্ত্রপাতিতে ভরা।
বক্স ক্যামেরা আর ভিউফাইন্ডার ক্যামেরায় ফিলমের রোল লাগাতে হত, বাইরে লাল আর ভেতরে কালো কাগজের রোলের কালো দিকে কাঁচকড়ার লম্বা ফিল্ম, ক্যামেরার সাইজ অনুযায়ী বারোটা বা ষোলোটা উঠত, ফিলমের সাইজ সম্ভবত ছিল ১২০; এই সাইজে কম ফোটো হত বলে ৩৫ এমএম ফিল্ম বাজারে আসে যা-তে ৩৫/৩৬-টা ফোটো তোলা যেত। বাবা এই ফিল্মগুলো ডিভেলপ করে একটা তারে ক্লিপ দিয়ে ঝুলিয়ে ফ্যান চালিয়ে দিতেন। এখন আমার ভাইপোর দোকানবাড়িতে প্রতিটি ঘরে এয়ারকাণ্ডিশান বসাতে হয়েছে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল রাখতে পারেনি বলে বিখ্যাত কোডাক কোম্পানি প্রায় উঠে যেতে বসেছে। লেন্স জিনিসটা এখন সর্বত্র, বাড়িতে, রাস্তায়, রকেটে, আকাশযানে, যুদ্ধাস্ত্রে, লুকোনো ছোট্ট গ্যাজেটে। বাবার বেলোলেন্স ক্যামেরার লেন্স কোনো কাজে লাগাতে না-পেরে দাদা সেটা উৎসব চট্টোপাধ্যায়কে দান করেছিলেন। উৎসব আমার মুখের একটা পেনসিল স্কেচ আর ‘জখম’ কাব্যগ্রন্হের কভার এঁকে দিয়েছিল।
ইতোপূর্বে মুখাকৃতি এঁকে তা থেকে দাদু তৈলচিত্র তৈরি করতেন। রাজপরিবারের সদস্যদের বেশ কিছুক্ষণ ঠায় তাঁর সামনে বসে থাকতে হত এবং সে কারণে তাঁরা বিরক্ত হতেন। পর্দাপ্রথার কারণে রাজপরিবারগুলোতে মহিলা সদস্যদের পেইনটিং আঁকতে ঠাকুর্দার অসুবিধা হত। ক্যামেরা কেনার পর আর তাঁর সামনে বসে থাকার সমস্যা রইল না। অন্যান্য রাজঘরানা ও ধনীদের ফোটোতোলারও সুযোগ পেলেন তিনি। বড়ো ছেলে প্রমোদের পর লাহোরে সুশীল, রঞ্জিত, অনিল, সুনীল, বিশ্বনাথ এবং একমাত্র কন্যাসন্তান কমলার জন্ম হয়। উত্তর-পশ্চিম ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ফোটো তোলার আমন্ত্রণ পেলে সেই সমস্ত মহারাজা, রাজা, রাজে, দেশমুখ, নবাব, বেগ, খান প্রমুখ পরিবারের সদস্যদের ফোটো তুলতে যেতেন। পুরো পরিবারকে সেখানে নিয়ে যাবার যানবাহনের ব্যবস্হা তাঁরাই করতেন।
দ্বারভাঙা মহারাজের ডাকে ঠাকুর্দা সপরিবারে পাটনা পৌঁছোন। অত্যধিক খাটুনি আর পাকিস্তানের চর্বিঠাসা মাংস খেয়ে-খেয়ে পাটনা শহরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে উনি ৮ নভেম্বর ১৯৩৩-এ মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে ঠাকুমা আর জেঠা-বাবা-কাকারা দিশাহারা হয়ে পড়েন, কেন-না ব্যবসায়ের জন্য যোগাযোগ পদ্ধতি ও বৈভবশালী ক্রেতাদের সঙ্গে আদান-প্রদানের কৌশল তখনও দাদুর ছেলেরা রপ্ত করতে পারেননি। আর্থিক অবস্হাও ভালো ছিল না। তাঁরা একটা চালাবাড়ি ভাড়া নিয়ে পাটনার বাজাজা নামে বস্তিতে বসবাস আরম্ভ করেন; মাটির এই বাড়িটা ১৯৩৪-এ পাটনার ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়েছিল। বাড়ির বউদের গয়না বিক্রি করে বড়োজেঠা পাটনার অন্ত্যজ বিহারি ও অত্যন্ত গরিব মুসলমান অধ্যুষিত পাড়া ইমলিতলা বস্তিতে একটা বাড়ি কেনেন। এই ইমলিতলার নানা ঘটনা আছে আমার বাল্যস্মৃতি ছোটোলোকের ছোটোবেলা বইতে। এই বস্তির মানুষগুলোই ছিল আমার শৈশবের শিক্ষক।
মেজোজেঠা সুশীল, মেজোজেঠিমা করুণা আর দুই মেয়ে ডলি আর মনুকে নিয়ে বিহারের ছাপরায় ফোটোগ্রাফির একটি শাখা খুলেছিলেন, কিন্তু প্রথমত চালাতে পারলেন না, আর দ্বিতীয়ত মেজোজেঠিমা যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলেন, তাই মেজোজেঠাকেও পাটনায় চলে আসতে হল। উত্তরপাড়ার দোকান চালাতে না-পেরে ন-কাকা অনিলও পাটনায় ফিরে যান। বাবা তখন পাটনায় বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে একটা ছোট্ট বাড়ি ভাড়া নিয়ে নীচের তলায় দোকান আর ওপরতলায় স্টুডিয়ো তৈরি করেন। মেজোজেঠা আর ন-কাকার ওপর ফোটো থেকে পেইনটিং তৈরির কাজ বর্তায়। কুড়ি জনের সংসার চালানোর দায় বাবার ওপর এসে পড়ে।
বড়োজেঠা পোরট্রেট আঁকতে পারতেন না, উনি প্রাকৃতিক দৃশ্য আর গ্রিক থাম, বাড়ি, প্রাসাদ ইত্যাদি পেইন্ট করতে পারতেন। স্টুডিয়োর পেছনের দেয়ালে বড়োজেঠা প্রাকৃতিক দৃশ্য এঁকে দিতেন আর একটা গুটোনো ক্যানভাস রোলে প্রাসাদ ইত্যাদি এঁকে দিতেন। যে খদ্দের যেমন ব্যাকগ্রাউন্ড চাইত তার জন্য তেমন ব্যবস্হা করা হত। জমিদার বাড়ির হলে কড়িকাঠের কাছে গুটিয়ে-ওঠানো ক্যানভাসটা নামানো হত। সেই সময়ে স্টুডিয়োতে ফোটো তোলার আলোর জন্য কুঁজোর মাপের বিরাট-বিরাট বালব উঁচুতে কড়িকাঠের কাছে লাগানো থাকত, এক হাজার আর দু-হাজার ওয়াটের। ভোলটেজ ফ্লাকচুয়েশানের কারণে বালবগুলো প্রায়ই ফিউজ হত, কেন-না তখনকার দিনে ভোলটেজ ফ্লাকচুয়েশান নিয়ন্ত্রণ করার যন্ত্র আসেনি। ফোটো তোলার সময়ে বাবা দোকানের সব আলো আর ফ্যান নিভিয়ে দিতেন।
অনেক খদ্দের তাঁদের মা বা স্ত্রীর পুরোনো ফোটো আনতেন, যা-তে কেবল তাঁদের মুখটুকুই আবছা দেখা যায়। এই মুখকে আরেকটি ফোটোর কাঁধে বসিয়ে একটা সম্পূর্ণ ছবি তৈরি করা হত। মহিলার কাঠামো অনুযায়ী মা কিংবা জেঠিমা মডেলের কাজ করতেন। খদ্দেরের ইচ্ছে অনুযায়ী, পুজোয় বসেছেন বা জমিদারের অ্যাণ্টিক চেয়ারে বসে আছেন, তেমন ফোটো তৈরি করার জন্য মা কিংবা বড়োজেঠিমা পোজ দিতেন আর তাঁদের মুখ সরিয়ে কাঁধের ওপর খদ্দেরের দেয়া মুখ বসিয়ে দেয়া হত। তাঁদের বিধবার থান কাপড়ও পরতে হতো। মা আর জ্যেঠিমা বেশ আহ্লাদিত হতেন যখন শুনতেন যে তাঁদের চেয়ে বয়সে বড় স্ত্রী-পুরুষ তাঁদের পা-জোড়াকে নিজের মায়ের মনে করে প্রতিদিন সকালে প্রণাম করেন,যাঁরা অনেকেই প্রতিপত্তিসম্পন্ন ভূস্বামী। মা ছিলেন একহারা, জেঠিমা একটু মোটার দিকে। এখন ডিজিটাল ফোটোশপিঙের যুগে এসবই অবিশ্বাস্য মনে হবে।
দাদুর ফোটোগ্রাফি ছিল সংসারের জন্য টাকা রোজগারের ব্যাপার। তিনি জানতেন যে তাঁর আগে পেশাদার ফোটোগ্রাফাররা ‘শিল্প’ হিসাবে পেশাটাকে বেছে নিয়েছেন, যেমন স্যামুয়েল বোর্ন হিমালয়ের ফোটোসংগ্রহ গড়ে তুলছিলেন, ফেলিস বিটো তুলছিলেন মহাবিদ্রোহের ফোটো, লিনিয়াস ট্রাইপ দক্ষিণ ভারতের ভাস্কর্য ও স্হাপত্যের কাজ ধরে রাখছিলেন ক্যামেরায়, মেজোর গিল তুলছিলেন অজন্তা-ইলোরার ফোটো, প্রত্নতত্ব বিভাগের জে ডি বেগলার এবং হেনরি হার্ডি কোল পুরাতাত্বিক সংগ্রহগুলোর ছবি তুলছিলেন, কলকাতা শহরকে ক্যামেরায় ধরে রাখছিলেন ফ্রেডরিক ফিবিগ। কিন্তু তাঁরা ক্যামেরার মাধ্যমে যা করছিলেন তা উপনিবেশের প্রসারণ, তাঁরা ভারতবর্ষকে দখল করছিলেন ছবির মাধ্যমে। ব্রিটেন থেকে খ্রিস্টধর্মের প্রচারকরা ভারতে এসে তাঁদের কাজ সম্পর্কে ব্রিটেনে সংবাদ পাঠাতেন ফোটোর মাধ্যমে, যা-তে বৈভবশালীরা তাঁদের আর্থিক সাহায্য করেন।
এই প্রসঙ্গে বিট আন্দোলনের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের কথা বলে নিই। গিন্সবার্গ কলকাতা, বেনারস, পাটনা যেখানেই গেছেন ফোটো তুলেছেন মূলত নুলো, খোঁড়া, অন্ধ, ফুটপাতে আধমরা, নিঃস্ব উদ্বাস্তু, ল্যাংটো সাধু ইত্যাদির। উনি আমাদের পাটনার বাড়িতে এসেছিলেন ১৯৬৩ সালের এপ্রিল মাসে। গিন্সবার্গ আমার বাবাকে একটা ফিল্ম ডিভেলপ করতে দিলে, নেগেটিভটা সম্পূর্ণ দেখে বাবা গিন্সবার্গকে বলেছিলেন, ‘তোমরা বিদেশিরা কবি হও বা ট্যুরিস্ট, ভারতে এসে ভালো কিছু দেখতে পাও না, কেবল এই সবই দেখতে পাও’। বস্তুত গিন্সবার্গ তাঁর নিজের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী লেন্সের দৃষ্টির মাধ্যমে একটি থার্ড ওয়ার্ল্ড তুলে ধরতে চাইছিলেন তার ‘ইনডিয়া জার্নালস’-এ, যাকে এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন ‘ওরিয়েন্টালিজম’। উনিশ শতকে ব্রিটিশদের উপনিবেশবাদী ফোটোগ্রাফিও ছিল ‘ওরিয়েন্টালিস্ট’। বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড এবং জনস্টন অ্যান্ড হফম্যান কোম্পানিগুলোর ফোটোগ্রাফিও ছিল উপনিবেশবাদের প্রসার।
ব্রিটিশ দৃষ্টিকোণকে টক্কর দেবার উদ্দেশ্যে ১৮৬২-এ জয়পুরের মহারাজা দ্বিতীয় সওয়াই মান সিং একটা ক্যামেরা কিনেছিলেন, তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের শৌর্য ধরে রাখার জন্য। ব্রিটিশ শাসকদের অনুকরণ করে রাজা-মহারাজা-নবাবরাও বাঘ বা হরিণ মেরে তার ওপর পা রেখে ফোটো তোলাতে লাগলেন। ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য উনিশ শতকের মাঝামাঝি একটা ডাগেরোটাইপ ক্যামেরা কিনে রাজকীয় শখ হিসাবে ফোটো তোলা আরম্ভ করেন। তাঁর ছেলে বড়োঠাকুর সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মণ বাবার হবিকে গুরুত্ব দিয়ে ব্রিটিশ পেশাদার ফোটোগ্রাফারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামেন। লখনউ শহরের ফোটো ভারতীয় চোখে ধরে রাখার দায়িত্ব নেন শৌখিন ফোটোগ্রাফার আহমদ আলি খান আর হাজি আব্বাস আলি, দুজনেই শিয়া মুসলমান, যাঁদের নবাবি ব্রিটিশদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা বা ‘ওরিয়েন্টালিজম’এবং দেশজ দৃষ্টিভঙ্গি বা ‘অকসিডেন্টালিজম’এই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য গড়ার কাজটি করেন রাজা দীন দয়াল (১৮৪৪ - ১৯০৫ ), যিনি হায়দ্রাবাদের নবাবের আনুকূল্য পেয়ে ভারতীয় অভিজাত সমাজ ও ব্রিটিশ শাসকদের মাঝে ফোটোগ্রাফির একটি সেতু গড়তে পেরেছিলেন এবং তাঁকে কাজে লাগিয়ে অঢেল টাকাকড়ি করতে পেরেছিলেন। তিনিও তাঁর দুই ছেলেকে ফোটোগ্রাফির ব্যবসায় লাগিয়েছিলেন; দুর্ভাগ্যবশত তাঁর দুই ছেলে তাঁর আগেই মারা যান। ১৮৭৪-এ থেকে রাজা দীন দয়াল ফোটো তোলা আরম্ভ করেন। লর্ড নর্থব্রুক এবং প্রিন্স অভ ওয়েলসের সফরের ফোটো তুলে দীন দয়াল নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সফল হন। তারপর সাঁচি স্তূপে প্রত্নতত্বের সংরক্ষণকর্ম আর মহুতে ব্রিটিশ ফৌজি মহড়ার ফোটো তুলে শাসকদের নেকনজরে পড়েন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার ব্রিটিশ কর্মচারীদের পরামর্শ দিয়েছিল যে ফোটোগ্রাফি আর পেইনটিঙ হল সবচেয়ে সস্তা মাধ্যম যার সাহায্যে তাদের শাসন সম্পর্কে ব্রিটেনে বার্তা পৌঁছে দেয়া যায়, আর পেইনটিঙ বা ফোটোগুলো দেখে ব্রিটিশ যুবক-যুবতীরা ভারতবর্ষে আসতে আগ্রহী হয়। ব্রিটেনের রাজার শাসন কায়েম হলে, ওরিয়েন্টালিজমের প্রসার হিসাবে ভারতে নতুন ধরণের স্হাপত্য দেখা দেয়, যেমন ভিকটোরিয় গথিক, নিও ক্লাসিকাল, প্যালাডিয়ান স্টাইল ইত্যাদি। এই নতুন স্হাপত্যও শাসক ধরে রাখতে চাইছিল ভবিষ্যতের জন্য। ভারতীয়দের সতীপ্রথা, শবদাহ, সাধু-সন্ন্যাসীদের ছবিও তুলে ব্রিটেনে পাঠানো হচ্ছিল। আমি অ্যামস্টারডামের ‘রিকস মিউজিয়ামে’ দেখেছি, ঢুকেই যা-তে চোখে পড়ে, তাই সতীদাহের একটা বিশাল পেইনটিং, যিনি এঁকেছিলেন, তিনি বিশেষ নামকরা নন, ওই মিউজিয়ামে দর্শকরা প্রধানত রেমব্রাঁর আঁকা পেইনটিং দেখতে যান।
দীন দয়ালের প্রসঙ্গে তুললুম আমার দাদুর সঙ্গে তুলনার জন্য। দাদু ফারসি, আরবি আর উর্দু পড়তে-লিখতে জানতেন, কিন্তু ইংরেজি ভালো বলতে আর লিখতে পারতেন না, কোনো স্কুলে কখনও যাননি, ওনার ট্যুরের কাজের দরুন ওনার ছেলেরাও কেউ স্কুলে পড়াশুনা করেননি। আমাদের বাড়িতে আমার দাদা প্রথম স্কুল-কলেজে পড়েছেন। দীন দয়াল পড়াশুনা করেছিলেন রুড়কির টমসন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে; সেখান থেকে পাশ করে ইন্দোর পূর্তবিভাগে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি পান। তিনি ভালো ইংরেজি এবং হিন্দি বলতে, লিখতে ও পড়তে পারতেন। ইন্দোরের মহারাজা দ্বিতীয় তুকোজি রাওয়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সফল হন, যার দরুন তিনি হায়দ্রাবাদের ষষ্ঠ নিজাম মেহবুব আলি খানের সংস্পর্শে যেতে সক্ষম হন; এরপর ব্রিটিশ ভাইসরয় এবং ইংরেজ উচ্চ আধিকারিকদের কাছাকাছি যেতে তাঁর অসুবিধা হয়নি, এবং তাঁর তোলা ফোটোর সংরক্ষণ ব্যবস্হারও অবহেলা হয়নি। দেশীয় আর ব্রিটিশ শাসকরা রাজা দীন দয়ালকে ঘিরে একটি ‘মিথ’ গড়ার প্রয়াস করেছিলেন যা-তে তাঁদের চাকর-বাকররা যে উপেক্ষিত হয়েছে তা চাপা পড়ে যায়। দীন দয়াল তাঁর দোকানে ব্রিটিশ কর্মচারী রাখতেন, শাসকদের মাঝে প্রচারের উদ্দেশ্যে।
বর্তমান পাকিস্তান অঞ্চলে দাদু গিয়েছিলেন মূলত ভারতীয় ও ব্রিটিশ পেশাদার ফোটোগ্রাফারদের সঙ্গে যা-তে তাঁকে পাল্লা দিতে না হয়। অঞ্চলটি ছিল মুসলমান অধ্যুষিত এবং তাঁর ফারসি, আরবি ও উর্দু প্রয়োগ করার জন্য উপযুক্ত। সাবর্ণ চৌধুরীদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের নবাবদের নৈকট্যের কারণে তাঁরা সতেরো শতক থেকে বংশানুক্রমিকভাবে ফারসি, আরবি এবং উর্দু শিখতেন। রাজা দীন দয়াল এবং ব্রিটিশ ফোটোগ্রাফারদের যে ইতিহাসবোধ ছিল, তা দাদুর ছিল না, তিনি কিছুই সংরক্ষণ করা প্রয়োজন মনে করেননি। কেবল দাদু নয়, আমি আর দাদা, আমাদের ছেলে-মেয়েরা, কারোর মনে ইতিহাসবোধ কাজ করেনি। আমাদের বাড়িতে সেসময়ের বহু মুদ্রা ছিল, যেগুলো আমার ছোটোকাকা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। দাদুর সম্পর্কে কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না দীপালি দেওয়ান, ডেবোরা হাটন, জুডিথ গিটম্যান, নরেন্দ্র লুথার, সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রমুখের বইতে। এনারা সকলেই কলকাতা, মুম্বাই, মাদ্রাজ-কেন্দ্রিক তথ্য সংগ্রহ করে বই লিখেছেন।
১৯৫০ নাগাদ বাবার দোকানের বাড়িঅলা (বি এন কলেজের সামনে ) বাড়ি ছেড়ে দেবার নোটিস দিলে বেশ কিছুকাল মামলা-মোকদ্দমা চলেছিল। শেষ পর্যন্ত বাবা মামলায় হেরে যান। হেরে যাবেন আঁচ করে উনি পাটনার দরিয়াপুরে একটা কুঁড়েঘর কিনে সেখানে দোকান করার মতন একফালি বাড়ি তৈরি করান, একতলা জুড়ে দোকান আর স্টুডিয়ো, রিটাচ করার জায়গা, ফোটোর ওপর মুখে নল লাগিয়ে স্প্রে করার জায়গা, ফোটো ডিভেলপ, এনলার্জ, প্রিন্ট, করার জায়গা, অনেক বড়ো প্রিন্ট হলে তাকে বহুক্ষণ জলে ডুবিয়ে রাখার জায়গা, তার জন্য জলের চৌবাচ্চা, রসায়নে চুবিয়ে সিপিয়া ফোটো বহুক্ষণ ধোবার জায়গা, প্রিন্ট কাটবার টেবিল, নেগেটিভের রোল শুকোবার জায়গা, মেজোজেঠা আর ন-কাকা যা-তে একান্তে পোরট্রেট পেইনটিং করতে পারেন তার জায়গা করিয়েছিলেন বাড়িটায়। ফোটো প্রিন্ট করা হত দু-রকম: ম্যাট আর গ্লেজড। প্রিন্টকে চকচকে বা গ্লেজ দেবার জন্য আয়নার মতন ধাতুর বোর্ডে শুকোনো হত। বাবার দোকানে প্রায় দশটা অমন গ্লেজিং বোর্ড ছিল। প্রায় প্রতিদিন দেখতুম কলের তলায় বিশাল ট্রেতে নগ্ন অপ্সরাদের ফোটো এনলার্জ করার পর ধোয়া হচ্ছে। শৈশবে নগ্ন নারীদেহের সঙ্গে পরিচয়ের পরে কখনও তা অশ্লীল মনে হয়নি।
এখন ফোটোকে সেপিয়া করে তোলার জন্য ফিলটার প্রয়োগ করা হয়। দাদুর সময়ে তা করা হত মাছের তেল থেকে তৈরি সালফাইডের সাহায্যে। সাদা-কালো ফোটোর টোনিং আরম্ভ করেছিলেন হ্যামিলটন স্মিথ এবং মাছের তেলের সালফাইড প্রয়োগ করার চল ছিল ১৮৬০ থেকে ১৯২০-এর মাঝে। রসায়নের বোতলে লেখা থাকতো কাটল ফিশ সেপিয়া কেমিকাল। পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইডে ধুয়ে স্হায়ীত্ব দিতে হত সেপিয়াকে। তিন রকমের সেপিয়ার চল ছিল। সোডিয়াম সালফাইডে রাঙানো, থিয়োইউরিয়ায় রাঙানো আর পলিসালফাইডে রাঙানো। স্মার্টফোনেই এখন এত ধরনের ফিলটার থাকে যে ফোটোগ্রাফারদের সেই সময়ের শ্রমকে অবিশ্বাস্য মনে হয়। সেপিয়ার বিপরীত ছিল মোনোক্রোম ফোটো, অর্থাৎ সাদা-কালো ফোটো।
দরিয়াপুরের স্টুডিয়ো বেশ বড়ো ছিল, যা-তে কুড়িজনের গ্রুপ ফোটো ফিল্ড ক্যামেরায় তোলা যেত। স্টুডিয়ো অনেক বড়ো ছিল বলে কুঁজো মাপের বালবও এক হাজার-দুহাজার ওয়াটের ছিল। আমরা ওপরতলায় থাকতুম। একবার কাজের মাসি বাটনা বাটার সময়ে নোড়া ঠুকে হলুদ ভাঙতে গেলে একটা বালব ফিউজ হয়ে গিয়েছিল, বাবা সেসময়ে ফোটো তুলছিলেন। তারপর থেকে বাবা চেঁচিয়ে জানিয়ে দিতেন যে ফোটো তোলা হচ্ছে, কোনোরকম মশলাবাটা বা লাফালাফি যেন না-হয়। বাবা যখন বাইরে গ্রুপ ফোটো তুলতে যেতেন, তখন বেলোলেন্স ক্যামেরার বাক্স দোকানের কাজের লোক রামখেলওয়ন সিং ডাবরের কাঁধে চাপিয়ে, নিজে তিনঠেঙে স্ট্যান্ড আর মাথায় ঢাকা দেবার কালো কাঁথা নিয়ে যেতেন। তখন গ্রুপ ফোটো তোলার জন্য ফ্ল্যাশ লাইটের ব্যবস্হা ছিল না। ডাবর দুটো ম্যাগনেশিয়াম তারের বান্ডিলে আগুন ধরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত যা-তে ফোটো তোলার সময়ে দিনের মতন আলো হয়। এই কাজটা দাদা আর আমিও করেছি, যখন ডাবর ধান কাটার ঋতুতে নিজের গ্রামে যেত।
একটু আগেই বলেছি, সেসময়ে মেয়ো স্কুল অভ আর্টসের অধ্যক্ষ এবং লাহোর মিউজিয়ামের কিউরেটার ছিলেন রাডিয়ার্ড কিপলিঙের বাবা জন লকউড কিপলিং, যাঁর সঙ্গে পরিচয়ের ও তাঁর অধীনে কাজ করার সূত্রে তাঁর কাছ থেকেই দাদু ফোটো তোলা শেখেন। ফোটো তোলা হত সরাসরি ব্রোমাইড পেপারে। পরে, কাচের প্লেটে নেগেটিভ ফিল্ম তোলা হত, সেই নেগেটিভকে রসায়নে চুবিয়ে রেখে ফোটো গড়ে উঠত; তারপর সেই প্লেটের ওপর ফোটোর কাগজ রেখে, ডার্করুমে প্রয়োজনীয় আলো দেখিয়ে ফোটো প্রিন্ট করা হত, আর সেই প্রিন্টকে রসায়নে চুবিয়ে, শুকিয়ে, স্হায়ীত্ব দেয়া হত।
বেলোলেন্স ক্যামেরা ছিল বেশ ভারী; বাইরে গিয়ে ফোটো তুলতে হলে তাকে বয়ে নিয়ে যাবার লোক দরকার হত। বাইরে তোলা হচ্ছে বলে একসঙ্গে অনেকগুলো তুলে যেটা ভালো হল সেটা থেকে ফোটো তৈরি করা হত। ফোটো তোলা হত তিন-ঠেঙে ক্যামেরা স্ট্যান্ডের ওপরে ক্যামেরা রেখে। ফোটো তোলার সময়ে হাত দিয়ে লেন্সের ঢাকনা খুলে, ‘স্মাইল প্লিজ’ বলে দু-এক সেকেণ্ডে আবার লেন্স পরিয়ে দেয়া হত। স্টুডিয়োতে ফোটো তুলতে হলে প্রথম দিকে কুঁজোর মাপের হাজার-দুহাজার ওয়াটের বাল্বের আলোয় ফোটো তুলতে হত, পরে অবশ্য বাল্বের মাপ ছোটো হয়। এখন প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে যে বেলোলেন্স ক্যামেরাকে ঝঞ্ঝাটকে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক। সেসময়ে প্রতিবিম্বও উল্টো দেখা যেতো। বাবা ডিজিটাল প্রযুক্তি দেখে যেতে পারলেন না। শৈশবে তাঁকে দেখতুম শহরের বাইরে ফোটো তুলতে যাচ্ছেন কাজের লোক রামখেলাওন সিংহের কাঁধে ক্যামেরার বাক্স চাপিয়ে, নিজে ক্যামেরার তিন-ঠেঙে স্ট্যান্ড আর মাথায় চাপা দেবার কালো মোটা কাপড় নিয়েছেন। দাদুর অমন ঘোরাঘুরির কারণে বড়োজেঠা, মেজোজেঠা, বাবা, পিসিমা আর ন-কাকার স্কুলে পড়া হয়ে ওঠেনি। জেঠাকাকাদের যেটুকু পড়াশোনা হয়েছিল তা রাজদরবারগুলোর শিক্ষকদের অবদান।
দাদু বিভিন্ন সময়ে আফগানিস্তানের কাবুল-কান্দাহার এবং পাকিস্তানের বাহাওলপুর, চিত্রাল, হুনজা, ফুলরা, মাকরান ও লাহোরে ছিলেন। আফগানিস্তানে ব্রিটিশদের যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর লাহোরে চলে যান। ওই অঞ্চলের ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির মাংস আর শুঁটকিমাংস খাওয়ার সঙ্গে বাবার ভাইরা নিজেদের মানিয়ে নিলেও বাবা পারেননি, এবং তিনি সারা জীবন শাকাহারী হয়ে যান। বাবার মুখে শুনেছি যে বাজারে ঝোলানো গোরু, মোষ, ইয়াক আর কাটা উটের মাংস দেখার পর উনি আর মাংস খেতে পারতেন না, তাই নিরামিশাষী হয়ে যান। দুম্বা একরকমের ভেড়া যার ল্যজের জায়গায় বাড়তি মাংস গজায়, আর বাড়তি লেজের মাংস, বড়োজেঠার বক্তব্য অনুযায়ী, ছিল খুবই সুস্বাদু।
আবার, ফোটোগ্রাফির সূত্রেই দাদুর সঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগণার পানিহাটি-নিবাসী আমার দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় হয়েছিল। কিশোরীমোহন ছিলেন ম্যালেরিয়া রোগের উৎস আবিষ্কারক রোনাল্ড রসের সহগবেষক। রোনাল্ড রস স্বদেশে ফিরে যাবার পর কিশোরীমোহন ম্যালেরিয়া রোগের কারণ ও তা প্রতিরোধ করার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ম্যাজিক লন্ঠনে স্লাইড দেখিয়ে প্রচার করতেন। এই স্লাইডগুলো তৈরি করে দিয়েছিলেন দাদু, সাদা-কালো কাচের প্লেটের ওপর তুলি দিয়ে স্বচ্ছ রং করা হত। কিশোরীমোহন তাঁর বড়ো মেয়ে অমিতার সঙ্গে বাবার বিয়ে দেন। বিয়ের সময়ে মায়ের বয়স ছিল ১৪ বছর আর বাবার ১৮ বছর। কিশোরীমোহন সম্পর্কে উইকিপেডিয়া আর নেটে অন্যত্র তথ্য আছে। বাবা নিজে শাকাহারী হলেও মাকে বাধ্য করেননি তাঁর আহারের রুচি অনুসরণ করতে; আমি আর দাদা দুজনেই আমিষাশী আর যাবতীয় সীমালঙ্ঘনকারী। দাদু প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সময়ে উত্তরপাড়া ফিরে যেতেন; ছেলেদের বিয়ে দেয়ার কাজটাও সেরে নিতেন সেই সময়টুকুর মধ্যে।
দুঃখের বিষয়, দাদু, লকউড কিপলিঙ, রুডিয়ার্ড কিপলিঙ এবং রাজা, মহারাজা, নবাবদের ফোটো তো সংরক্ষণ করেনইনি, তাঁদের সঙ্গে নিজের ফোটোও তুলিয়ে রাখেননি। আমি আর দাদা কখনও ভাবিনি যে ওকতাভিও পাজ, আরনেস্তো কার্দেনাল, অ্যালেন গিন্সবার্গ, ডেইজি অ্যালডান, কমলকুমার মজুমদার, নিসিম এজেকিয়েল, ধর্মবীর ভারতী, খুশওয়ন্ত সিং, পুপুল জয়াকর, সমর সেন, শিবনারায়ণ রায়, উদয়ন ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, সন্তোষকুমার ঘোষ. প্রকাশ কর্মকার, যোগেন চৌধুরী, ফণীশ্বরনাথ রেণু, রামধারী সিং দিনকর, রাজকমল চৌধুরী, পারিজাত প্রমুখ, যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তাঁদের পাশে বসে ফোটো তুলিয়ে রাখা দরকার, যেমনটা বিট আন্দোলনের কবি-লেখকরা করেছেন। এমনকি হাংরি আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন তাঁদের সঙ্গে গ্রুপ ফোটো তুলিয়ে রাখিনি, যেমনটা গিন্সবার্গ-ফেরলিংঘেট্টি করেছেন। যে দুটো গ্রুপ ফোটো হাংরিদের আছে তার একটা টাইম ম্যাগাজিনের রিপোর্টারের নেয়া, অন্যটা হিন্দি জ্ঞানোদয় পত্রিকার সম্পাদক শরদ দেওড়ার আগ্রহে তোলা। একশোর বেশি হাংরি বুলেটিন, কার্ড, পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছিল, ইতিহাসের বোধ না থাকায়, সেগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন মনে হয়নি।
দাদা সমীর রায়চৌধুরীর ছেলেদের মনেও ইতিহাসবোধ একেবারেই কাজ করেনি; বাবা মারা যেতেই দেয়াল থেকে ঠাকুমা, জেঠিমা, নকাকিমার বিরাট পোরট্রেটগুলো নামিয়ে ফেলে দিয়ে দোকানকে বিশাল-বিশাল কাচে মুড়ে ঝকঝকে আধুনিক করে তুলেছে। চিলেকোঠার ঘরে বাবা প্রায় হাজার পাঁচেক তোলা-ফোটোর কাচের প্লেট রেখেছিলেন, বছর অনুযায়ী সাজিয়ে। সেগুলো কাচের দরে বেচে দিয়েছে, অথচ সেগুলো ছিল উনিশ শতকের শেষ দিকে যাঁরা ফোটো তুলিয়েছিলেন, তাঁদের প্লেট।
আর তাই এখন পূর্বপুরুষ ফোটোগ্রাফারদের কথা বলতে গিয়ে স্মৃতির জাদুবাস্তব জগত ঘাঁটা ছাড়া উপায় বা কি! মনে হয় ছোটোবেলায় যেমন বড়োজেঠার হাত ধরে মিউজিয়ামে ঢুকে পড়তুম আর দৌড়ে এক থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে বেড়াতুম, চৌকাঠ ডিঙোতেই প্রাগৈতিহাসিক থেকে মহেঞ্জোদরোয়, সেখান থেকে অশোকের রাজত্বে—তেমনই দৌড়ে বেড়াচ্ছি পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া স্মৃতির সলতে ধরে—আফগানিস্তান, উত্তরপাড়া, বাজাজা পাড়া, ইমলিতলা, দরিয়াপুর, পেনেটি—চারপাশে নবাব, বেগ, সাহেব, দিশি রাজা, দেহাতি বিহারি—সব জায়গা সব মুখ বোধহয় এখন আর চিনতে পারছি না। দেশ-বিদেশের লোকেদের মাঝে মনে হতো ওদেরই দেখছি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।