কিছুদিন আগে নেপালের প্রকৃতি লামসাল, যে ওড়িশার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল, হোস্টেলে মারা যায়। সমস্ত জায়গার মত এখানেও প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকদের পক্ষ থেকে মৃত্যুকে প্রেমঘটিত আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রকৃতির সহপড়ুয়ারা বেঁকে বসে ও দাবি করে প্রেমঘটিত নয়, নেপালি হবার জন্য প্রকৃতির প্রাক্তন প্রেমিক [ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র] তার ওপর অত্যাচার করত। আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেবার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার ও তদন্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপিকা তাদের সঙ্গে সরাসরি তর্কে জড়িয়ে পড়েন। নিরাপত্তারক্ষীরা পড়ুয়াদের মোমবাতি মিছিল করতে বাধা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় অবিলম্বে সমস্ত নেপালি পড়ুয়াদের হোস্টেল খালি করার ফরমান জারি করে ও তাদের অনেককে অল্প কয়েক ঘন্টার নোটিশে বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন ইত্যাদি জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়েরই বাসে করে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়। ইতিমধ্যে নেপাল সরকার বিষয়টি জানতে পেরে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর প্রভূত চাপ সৃষ্টি হয়। প্রকৃতির প্রাক্তন প্রেমিককে পুলিশ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে, দুই অধ্যাপিকা ও কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন। কিন্তু পড়ুয়ারা অনেকেই চত্ত্বর থেকে নেপালের উদ্দেশ্যে চলে গেছে।
সাম্প্রতিক পাওয়া খবর অনুযায়ী, কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলা গেছে। পুলিশ, নিরাপত্তারক্ষী-সমেত আরো কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। নেপালের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আবেদন করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরত আসার জন্য।
এই খবর নাড়াচাড়া করতে গিয়ে আরো কিছু তথ্য চোখে পড়ল। যেমন, ভারত সরকারের ২০২১–২২ সালের সর্বশেষ উচ্চশিক্ষার সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে প্রায় ১৭০ দেশ থেকে আসা আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ছিল ৪৬৮৭৮।
এদের মধ্যে ২০২২ সালে সবথেকে বেশি এসেছেন নেপাল থেকেই। দ্বিতীয় স্থানে আফগানিস্তান। পিছিয়ে গেলে, ২০১৬ সালেও সংখ্যাটা এরকমই ছিল, শুধু বাংলাদেশ, তানজানিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তখন অপেক্ষাকৃত কম পড়ুয়া ভারতে আসত। তারা তালিকা থেকে সরিয়ে দিয়েছে ইরাক, ইরান, মালয়েশিয়ার মত দেশগুলিকে –
এই আন্তর্জাতিক পড়ুয়ারা ঠিক কী নিয়ে পড়তে ভারতে আসেন? সমীক্ষা অনুযায়ী, ৭৪.৮৫ শতাংশ আসেন স্নাতকস্তরে পড়াশুনোর জন্য। স্নাতকোত্তরের জন্য ~১৬ শতাংশ। নিচের তথ্য দেখলে বিশদে সংখ্যা বোঝা যাবে –
এই যে এত সংখ্যক পড়ুয়ারা ভারতে আসেন, ঠিক কোন কোন রাজ্যে যান তারা ? সেই তথ্যও সমীক্ষায় আছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে ২০২২ সালে শীর্ষে ছিল কর্ণাটক, পশ্চিমবঙ্গ নিচের দিকে –
এমনিতেই স্নাতকস্তরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ভারতে টাকা লাগে। আন্তর্জাতিক পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি হবার কথা। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে যেমন এন.আর.আই. কোটাতে বাইরের ছাত্ররা টাকা দিয়ে ডাক্তারি পড়তে পারে। ভারতে নব্বইয়ের দশকে উদারীকরণ শুরু হলেও বাকি রাজ্যগুলিতে এরকম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যত তাড়াতাড়ি গজিয়ে উঠেছিল, তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে শুধুই বেসরকারি কলেজ ছিল বহুদিন, যাদের ডিগ্রি দেবার ক্ষমতা ছিল না। ২০১১-র পর রাজ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন বাড়ন্ত। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা সম্ভবত বিশ্বভারতী, যাদবপুর ইত্যাদিতে স্নাতকোত্তর, গবেষণা করতে আসা পড়ুয়াদের সংখ্যা। বাকি রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ নানাবিধ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরে পড়তে আসা, অর্থাৎ এখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির রোজগারের সুবন্দোবস্ত।
এর পাশাপাশি, রাজ্যসভায় করা এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ২০২৩ সালে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক পাঁচ বছরে কত বিদেশী নাগরিককে ভারতে আসার জন্য ছাত্র ভিসা দেওয়া হয়েছে সেই সংখ্যা জানায়। এর মধ্যে অনেকে আছেন যারা কয়েক মাসের জন্য এক্সচেঞ্জ পড়ুয়া অথবা কোনো প্রোজেক্টের কাজে, সেমিনারে ভারতে এসেছেন। ফলে এই সংখ্যা উচ্চশিক্ষা দফতরের করা সমীক্ষার থেকে অনেক বেশি। এখানে নেপাল ও ভুটানের পরিসংখ্যান নেই কারণ সম্ভবত তাদের আলাদা করে ছাত্র ভিসা লাগে না –
এখানে দেখা যাচ্ছে, বাইরে যাওয়া ভারতীয় পড়ুয়াদের ওপর আক্রমণ ও তা থেকে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। তবে এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে বর্ণবিদ্বেষ ইত্যাদির ফলে আত্মহত্যা করা পড়ুয়াদের সংখ্যা আলাদা করে জানা নেই। বাইরের কথা বাদ দিয়ে, মাঝে মাঝেই দেশে নানা আইআইটিতে আত্মহত্যা, ফৈজান আহমেদের খুন, ৱ্যাগিংয়ের ফলে মৃত্যু, কোটায় মৃত্যুমিছিল, আত্মহত্যা ঠেকানোর জন্য আইআইএসসি বেঙ্গালুরুর হোস্টেল ঘর থেকে পাখা খুলে নেওয়া এইসব খবর ভেসে ওঠে, আবার হারিয়ে যায়। আর-জি-কর মামলায় নিম্ন আদালতের বিচারকের রায়ে লেখা কোনো প্রতিষ্ঠানে কিছু ঘটলেই তাড়াতাড়ি তাকে ঢাকা-চাপা দিয়ে নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলার চেষ্টার সমালোচনা পেরিয়ে, যেহেতু আন্তর্জাতিক পড়ুয়ার মৃত্যু, আশা করা যায় পুলিশ এক্ষেত্রে আত্মহত্যায় প্ররোচনায় অভিযুক্তকে তদন্ত ও শাস্তির জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ দিতে পারবে।
সূত্র –
The Kathmandu Post – 1
The Kathmandu Post – 2
উচ্চশিক্ষা দফতরের সমীক্ষা – 1
উচ্চশিক্ষা দফতরের সমীক্ষা – 2
উচ্চশিক্ষা দফতরের সমীক্ষা – 3
বিদেশ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য – 1
বিদেশ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য – 2
বিদেশ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য – 3
বিদেশ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য – 4