দাচু ওয়াইফু
—আইসক্রিমে এফিড্রিন ছিল।
—আমি এখন ডলার মিলিয়নেয়ার।
—স্টার্ট আপের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছি।
—ভাবছিলুম।
—ঝিমিয়ে পড়েছিলুম।
—ঘুম।
একা জীবন, একা থাকতে আমার ভালোলাগে, আমার স্পেসে আরেজনকে সহ্য করতে পারি না, কাজের লোকও নয়, ফ্ল্যাট পরিষ্কারের কনট্র্যাক্ট দিয়ে দিয়েছি, সপ্তাহে একদিন ওদের টিম এসে ঝকঝকে করে দিয়ে যায়।
দুই বেলা খাবারের অর্ডার দিয়ে খাই কিংবা কিনে এনে ফ্রিজে রেখে দিই।
এবার ডলার খরচের জন্যে বেঁচে থাকার আনন্দ।
—ভাবছিলুম।
—ডলারকে টাকায় কনভার্ট করে, কোথায় কোথায় ইনভেস্ট করব।PORT THIS AD
নেশার আমেজে আঠারো ডিগ্রিতে সুইঙ মোডে এসি চালিয়ে কম্বল চাপা দিয়ে নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।
ল্যাপটপ লাগানো ছিল চার্জে, রাত তিনটেয় আগুনের টুকরোগুলোকে আওয়াজ যখন লেলিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে ঘরময়, টের পেলুম, কম্বলে আগুন ধরে গেছে, ঘরের ভারি পর্দা জ্বলছে, সোফাগুলো জ্বলছে, আগুন দখল করে ফেলেছে শোবার ঘর, শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আগুন চলে গেছে ড্রইংরুমে।
আমার স্লিপিং স্যুটে আগুন ধরে গেছে, চামড়ায় বসে যাচ্ছে যন্ত্রণা।
সব ফেলে ছুটলুম টয়লেটে।
উলঙ্গ।
শাওয়ার খুলে শুয়ে পড়লুম।
তারপর জানি না।
মুখে এসে বিঁধে গিয়েছিল কয়েকটা আগুনের টুকরো, উঠে, তাড়াতাড়ি টয়লেটে ঢুকে শাওয়ার খুলে শুয়ে পড়লুম তার তলায়, আগুন সবচেয়ে বেশি আদর করেছে আমার মুখ।
প্রেম করিনি কখনও। নারীসঙ্গ করিনি কখনও। নিজের স্পেস শেয়ার করতে হবে ভেবে কোনো তরুণীকে ঘেঁষতে দিইনি কাছে।
আগুন আমার প্রেয়সী হয়ে দেখা দিল, ঢুকে পড়ল বেডরুমে, বিছানায়।
পরে জানলুম, প্রতিবেশি কাঞ্চন ব্যানার্জি নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলেন হাসপাতালের জ্বলে যাওয়া রোগিদের ওয়ার্ডে।
ল্যাপটপে খরচের তালিকা তৈরি করছিলুম, কেমন করে এবার থেকে জীবন কাটাবে, আর তো চাকরি করার দরকার নেই।
বাবা আর মাও মারা গিয়েছিলেন বিস্ফোরণে, ভোটাভুটির দু’দল মাস্তানের ফাটানো বোমার মাঝে পড়ে। ভাই-বোন কেউ নেই।
বোঝা উচিত ছিল আমার, ইঞ্জিনিয়ারিঙে এই সবই তো পড়েছিলুম। ল্যাপটপের ব্যাটারিতে থার্মাল রানঅ্যাওয়ে ঘটে বেশি গরম হয়ে গেলে। লিথিয়ম-ইয়ন ব্যাটারিতে কোবাল্ট অক্সাইড থাকে, তাতিয়ে তোলে থার্মাল রানঅ্যাওয়ে। তিন বছরে হয়ে গিয়েছিল, আজ বদলাবো, কাল বদলাবোর চক্কোরে ব্যাটারি বদলানো হয়নি। পুরোনো গ্যাজেটের অংশগুলো বুড়িয়ে যেতে থাকে, তাও জানতুম।
ভাগ্যিস এয়ার প্রেশারের দরুণ বিস্ফোরণে ঘরের দরোজাটা ভেঙে ছিটকে পড়েছিল, নয়তো জ্বলন্ত অবস্হায় ঘর থেকে বেরোতে পারতুম না।
টপ ফ্লোরের কনডোমিনিয়ামের প্রশান্ত মুখার্জি দমকলকে খবর দিয়েছিল, যাতে আগুন ওর ঘরে গিয়ে সেঁদিয়ে না যায়। ও আমারই মার্সিডিসে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিয়েছিল। সঙ্গে কাঞ্চন ব্যানার্জি।
ওরা বলতো, এতো রোজগার করি, তবু দুই রুমের ফ্ল্যাটে কেন থাকি।
ঘরগুলো তো বিশাল, ছয়টা রুম এঁটে যাবে, তিন হাজার স্কোয়ারফিট।
ডাক্তার : আপনার রক্তে এফিড্রিন পাওয়া গেছে, ওটা তো ব্যানড, কোথ্থেকে পেলেন উনি ?
প্রশান্ত : অনেকে ডলার মিলিয়নেয়ার হয়ে গিয়েছে নিজেদের শেয়ার বেচে। যারা ইস্তফা দিয়ে স্বাধীন কিছু করতে চাইলো তারা ইস্তফা দিয়েছিল। রেজিগনেশান পার্টির আইসক্রিমে এফিড্রিন মেশানো ছিল। উনি কয়েকটা আইসক্রিম খেয়েছিলেন।
ডাক্তার : ইনশিয়োর্ড ?
প্রশান্ত : তা বলতে পারব না, তবে ডলার মিলিয়নেয়ারের হেল্থ ইনশিয়োরেন্সের দরকার হয় না ; ওনার কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই।
নার্স : ওনার ফ্যামিলি জিওয়েল ইনট্যাক্ট, আগুনের একটুও ছোঁয়া লাগেনি।
প্রশান্ত : আরে ও তো ভারজিন, কোনো কাজেই লাগেনি ফ্যামিলি জিওয়েল, কোনো মহিলাকে ঘেঁষতে দেয়নি নিজের কাছে। ও বলে, ওর নিজস্ব স্পেসে আর কাউকে চাই না।
এই সমস্ত কথাবার্তা মনে আছে আমার।
তারপর আবার জ্ঞান হারিয়েছিলুম। যখন জ্ঞান ফিরে পেলুম তখন আমাকে এয়ার অ্যামবুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হোমি হায়দারের কাছে।
শুনলুম ওনার মশারির ভেতরে শুইয়ে চার মাস আমার চিকিৎসা করা হয়েছিল।
আরও অনেক রোগী ছিল হাসপাতালে, বেশির ভাগই আগুনে আত্মহত্যা করার চেষ্টায় পুড়ে গিয়েছিল।
এক আমিই দুর্ঘটনায় পুড়েছিলুম।
জ্ঞান ফিরলে হোমি হায়দার বললেন, আপনার পঞ্চাশ পার্সেন্ট বার্ন। সেরে গেলে প্লাসটিক সার্জারি করাতে হবে। এসব কথা আপনার আত্মীয় থাকলে তাদের বলতুম, কিন্তু আপনাকেই বলতে হচ্ছে। বেশি টাকাকড়ি মানুষকে ইররেসপনসিবল করে তোলে। ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন ?
—ডক্টর, বেদ সব কয়টা পড়েছিলুম এককালে, ইংরেজিতে, কোনো ঈশ্বর তো খুঁজে পাইনি, শুধু ইন্দ্র নামের একজন দেবতার হইচই। হিন্দুদের বোধহয় ঈশ্বর নেই, তৈরি করে নিতে হয়েছে, আমার বাবা-মা ঈশ্বর তৈরি করে নিয়েছিলেন, তাদের বলতেন ভগবান।
ডক্টর হায়দার : যাক বেশি কথা বলবেন না, আপনার ভাগ্য ভালো যে অমন এক্সপ্লোজান আর ফায়ারের পর বেঁচে গেছেন। আপনার মুখ, দেহের ওপরের অংশ, পিঠ আর পা অ্যাফেক্টেড। পোড়া জায়গাগুলো বেশ গভীর। আপনার কান, নাক, কনুই, বলতে গেলে, হাড় বেরিয়ে এসেছে। বেশ কিছু সার্জারির দরকার হবে। তবে আপনার বায়োমেট্রিকসে বদল হয়নি। চোখ ঠিক আছে। আঙুলের ছাপও পোড়েনি। তবুও আপনাকে নতুন পাসপোর্ট আর নতুন আধার কার্ড করাতে হবে, মুখটা পালটে যাচ্ছে বলে। বছর খানেকে আপনার মুখকে আপনি চিনতে পারবেন।
—মুখকে চিনতে পারবো মানে ?
ডক্টর হায়দার : মুখ ক্রমশ প্রতিটি সার্জারির সঙ্গে একটু একটু করে অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে তো, তাই।
—কবে নিজের মুখ দেখতে পাবো ?
ডক্টর হায়দার : আর মাস ছয়েক পরে, কিছু হিলিং বাকি আছে। সম্পূর্ণ সুস্হ হয়ে উঠলে আপনাকে ছাড়া হবে।
আমি যে বেঁচে গেছি তা এক রহস্য। বোধহয় টাকাগুলো খরচ করার জন্য বেঁচে গেছি। ছয়মাস ছিলুম ইনটেভসিভ কেয়ারে, ভেনটিলেটরে ছিলুম চার মাস।
চামড়ার ব্যাংক থেকে অ্যালোগ্রাফ্ট এনে পোড়া জায়গাগুলোকে নতুন করে তুলতে হয়েছে, যাতে সেই সব জায়গাগুলোয় আবার আমার নিজের চামড়া গজিয়ে ওঠে।
সেরে উঠে, হাসপাতালের তিরিশ লাখ টাকার বিল মিটিয়ে বাইরের জগতে বেরিয়ে নিজেকে প্রথমবার একা বোধ হলো, মনে হলো আমার স্পেসটায় অন্তত আরেকজন মানুষের উপস্হিতি বড়োই প্রয়োজন।
হাসপাতালে তো চারিপাশে কতো মানুষ ছিল, তারা আমার স্পেসে কেন ঢুকতে পারেনি !
প্রথমবার দেখলুম নিজেকে, আয়নায় নয়, ফোটোতে, পাসপোর্ট আর ভিসার জন্য দরকার। ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ডে যদিও মুখটা অন্যরকম এসেছে, তবে আমি হয়ে গেছি অনেকটা মোঙ্গোল চেহারার, যেন চেঙ্গিজ খানের বংশধর।
প্রতিদিনই আয়নায় নিজের মুখ দেখি আর সেই লোকটাকে খুঁজি, যার মুখ আমার কাঁধের ওপর ছিল, দুজনে একেবারে আলাদা মানুষ।
মোঙ্গোল মুখ নিয়ে মোঙ্গোলিয়ায় যাবো ভেবেছিলুম প্রথমে।
নেটে সার্চ করে দেশটা পছন্দ হলো না। দুই কুঁজের উট, বেঁটে ঘোড়া, ভেড়ার দুধ, ঘোড়ার-উটের-ভেড়ার শুকনো মাংস সেদ্ধ করে খেতে হবে। কেউই বোধহয় চান-টান করে না।
নেট সার্চ করে আমার মতন মুখের যুবতীদের কেমন যেন পছন্দ হতে লাগলো।
ভয়ও পেলুম। কেন এরকম হচ্ছে ! আমি তো একা থাকতে চাই, কোনো যুবতীকে চাই না নিজের আশেপাশে, আরেকজন ঘুরঘুর করবে সব সময়, কথা বলতে চাইবে, সে এক অসহ্য ব্যাপার।
আগে আমার যে ধরনের বাঙালি মুখ ছিল, তেমন মুখের তরুণী তো ভাব করতে চেয়েছিল, আমিই তাদের পাত্তা দিইনি।
মোঙ্গোল মুখের বাঙালি তরুণী হয়না ? হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু সেও আমার ফ্ল্যাটে সব সময় থাকবে, এটা ওটা জিগ্যেস করবে, তার সঙ্গে আউটিঙে যেতে বলবে।
ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটগুলোতে দেখলুম, নেপালি মেয়ে আছে বেশ কয়েকজন, ভারতীয় বিয়ে করতে আপত্তি নেই। কিন্তু তাদের দেখে খুব একটা আমার মুখের সঙ্গে মিল খুঁজে পেলুম না।
চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যাণ্ড, ভিয়েৎনাম, ক্যাম্বোডিয়া, ফিলিপিন্স যাবো কি যাবো না ভাবতে-ভাবতে নেট সার্চ করার সময় জাপানে বেড়াতে যাবার একটা সাইটে গিয়ে বুঝতে পারলুম যে জাপান দেশটাই আমার মনের ভেতরে পছন্দের রসায়ন গড়ে ফেলেছে।
ওদের দেশে ফ্ল্যাটের অভাবে বিয়ে করছে না যুবক-যুবতীরা।
সকলেই মৌমাছির মতন ব্যস্ততার ভোঁ-মেরে রাস্তা ক্রস করছে, কে জানে কে কোথায় যাচ্ছে।
ওদের ওইভাবে দৌড়োদৌড়ি দেখে আমি জাপানি ক্লাস অ্যাটেণ্ড করে নিলুম তিন মাসের জন্য, যাতে অন্তত কাজ চালাবার মতন জাপানি বলতে পারি আর আশেপাশের জাপানি লোকজনের কথা বুঝতে পারি। ছোট্ট ডিকশনারি রাখলুম পকেটে।
ট্র্যাভেল এজেন্টকে বলতেই ও বিজনেস ভিসা পাইয়ে দিল, আমার ছেড়ে দেয়া চাকরি আর শেয়ার বেচে ডলার মিলিয়নেয়ার হবার তথ্য এমব্যাসিতে পাঠিয়ে।
শিনজুকু নামে টোকিওর কোনো পাড়ার ব্যবসাদার জিনুকিচি ইলেকট্রনিকসের ইনভিটেশান চিঠি আনিয়ে একজন জাপানি গাইডের ব্যবস্হাও করে ফেললে, সে আমাকে বিমানবন্দর থেকে তুলে নেবে আর টোকিও শহরের আনাচ কানাচ দেখাবে।
হানেদা বিমানবন্দর আর নারিতা বিমানবন্দর। হানেদা টোকিওর কাছে, সন্ধ্যাবেলা পৌঁছোলে নানা রঙের বিজ্ঞাপন আর সাইনবোর্ড দেখতে দেখতে যেতে পারব।
হানেদা বিমানবন্দরের বাইরে আমার ইংরেজিতে লেখা নামের বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক জাপানি যুবক, বছর পঁচিশের, বলল, আমার হাত থেকে ট্রলিটা নিয়ে বলল, কোনবানওয়া সা, কাইতো আমাকে পাঠিয়েছেন, কাইতো জিনুকিচি, চলুন, আপনার হোটেল একটু দূরে।
—কোনবানওয়া, তোমার নাম বললে না ?
—আপনি জাপানি বলতে পারেন, সা ?
—কয়েকটা কথা বলতে পারি। সা মানে স্যার, তা জানি।
—আমার নাম হারুতো। গাড়ির ডিকিতে স্যুটকেস রেখে বলল কাইতো। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললুম, আরিগাতু গোজাইমাসু।
ড্রাইভারের সিটে বসে কাইতো ইংরেজিতে বলল, আপনি আমার পাশেই বসুন যদি আপত্তি না থাকে, পাড়াগুলোর নাম বলতে পারব আপনাকে। এই গাড়িটা আমারই, গাইডের কাজে সুবিধা হয়। তবে ট্রেন, মনোরেল আর বাসে যাতায়াত করা সুবিধাজনক, তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়, আপনার অভিজ্ঞতাও হবে।
—হ্যাঁ, তুমি ইংরেজিতেই কথা বলো, আমি যদি পারি তাহলে জাপানি ভাষায় যতটুকু পারি বলব।
—টোকিও প্রিফেকচার অনেকগুলো শহর নিয়ে তৈরি। আপনি কোথায় যাবেন বলবেন, সা, আমি নিয়ে যাবো।
—হারুতো, আমি জাপানে এসেছি কেন জানো ? যদিও আমার গায়ের রঙ তোমাদের তুলনায় ময়লা, আমার মুখটা তোমাদের মতন। তাই মনে হলো তোমাদের দেশটাই দেখব।
—সা, আপনার গায়ের রঙ ময়লা নয়, সাধারণ ইনডিয়ানদের চেয়ে আপনি ফর্সা , আমার মা বলতেন, নিজেকে ভালোবাসাতেই সৌন্দর্য আছে, এর বাইরে সুন্দর বলে কিছু হয় না। আপনি ছেলেমেয়েদের আর স্ত্রীকে আনতে পারতেন, সা।
—আমি তো বিয়ে করিনি হারুতো। আরেকজন কেউ আমার চারিপাশে ঘুরে বেড়াবে, যখন ইচ্ছে কথা বলতে চাইবে, এসব আমার ভালো লাগে না, আমি একা থাকতে ভালোবাসি।
—সা, তাহলে আপনি এখান থেকে দাচু ওয়াইফু বিয়ে করে নিয়ে যান।
—দাচু ওয়াইফু ? বোবা-কালা জাপানি তরুণী ?
—সা, তা নয়, এখন যাবেন দেখতে ?
—অমন দেখা যায় নাকি একজন তরুণীকে, যখন ইচ্ছে ?
—সা, যখন বলবেন, নিয়ে যাবো তাদের কাছে, নিজেই পছন্দ করে নেবেন।
—হারুতো, তার আগে টোকিওর নাইট লাইফ দেখতে হবে তো। এখনই দুইধারে এতো ঝলমলে আলো।
হারুতো আমাকে কাবুকিচো, আকিহাবারা, সাততলা এম সেন্টার, দোন কুইজোতে পাড়া, তেঙ্গা দোকান, শিনজুকু পাড়া সবই ঘুরিয়ে দেখালো। কাবুকিচো নাকি মাফিয়াদের আড্ডা, তা সত্ত্বেও রাস্তাঘাট কতো পরিষ্কার, মনে হয় সব সময়ে কেউ পরিষ্কার করে দিয়ে যাচ্ছে।
একদিন আমার জন্যে কনে দেখতে নিয়ে গেল হারুতো। বিরাট হলঘর, কনেরা কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ নৃত্যের ভঙ্গীতে, অথচ সকলেই নগ্ন। কারোর নাম হিনাত–শাশ্বত আলো, কারোর ইচাকা–আনন্দদায়িনী, কারোর আকারি–লাল প্লাম। আমি এক এক করে তাদের সবাইকে কোনিচিওয়া, মানে হ্যালো বললুম। তাদের মুখে ছড়িয়ে পড়েছে হাসি, যেন পৃথিবীতে দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা বলে কিছু নেই।
মার্কেটিঙ ম্যানেজার বলল, মেডিকালি চেক আপ করা, আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।
শুধু জিগ্যেস করেছিলুম, মুখ থেকে কাঁচা মাছের গন্ধ বেরোবে না তো ?
উনন, বলল মার্কেটিঙ ম্যানেজার, মানে, ওহ, না। ভুলে গিয়েছিলুম, জাপানিরা সরাসরি না বলে না।
—মার্কেটিং ম্যানেজারকে বললুম, নিয়ে যাবো কেমন করে, ভারত সরকার তো ঢুকতে দেবে না।
হারুতো আমার কথা শুনে বলল, সা, আপনি চিন্তা করবেন না, জিনুকিচি সান হঙকঙ দিয়ে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্হা করবেন, ওনার কতো মাল প্রত্যেকদিন ইনডিয়া যায়, হঙকঙ হয়ে।
প্রেমিকের চাউনি মেলে ধরে, একজন বোবা-কালা সুন্দরীকে কিনে নিলুম, তিন হাজার ডলারে।
বিমানবন্দর থেকে সঙ্গে করে বোবা-কালা সুন্দরীকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল জিনুকিচির প্রতিনিধি, তারও ভালো লেগেছে যুবতীকে, বলল, সুকি দেসু।
মাঝরাতে এনেছিল যাতে কেউ না জানতে পারে যে আমি বিয়ে করেছি। এতোদিন সবাইকে বলে এসেছি যে একা থাকতে ভালোবাসি আর এখন একজন সুন্দরী জাপানি বউকে বাড়ি নিয়ে এলুম। এমনিতেই আমার পয়সাকড়ির জন্যে লোকে হিংসে করে। অপূর্ব সুন্দরী বোবা-কালা বউ দেখলে তো ঢি-ঢি পড়ে যাবে।
জীবনে কখনও কোনো তরুণীকে ভালোবাসিনি। হিনাতকে দেখেই ভালোবেসে ফেললুম, কোলে তুলে নিয়ে গেলুম বিছানায়, শুইয়ে দিলুম, আর নিজেও শুয়ে পড়লুম ওর পাশে।
প্রেম করছি যখন, হিনাত বলে উঠল, আঃ, লাগে।
আমি উঠে বসলুম। বললুম, কী বলছ তুমি ? কথা বলছ ?
ভালোবাসা পেলে প্রাণ জেগে ওঠে, বলল হিনাত, চোখের পাতা কাঁপিয়ে, ভালোবাসার ক্ষমতা তুমি জানো না।
আমি হিনাতের দিকে তাকিয়ে বসে রইলুম।
ও মিটিমিটি হাসছে, যেমন দেখেছিলুম জাপানে।
এসি চালিয়ে হিনাতকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লুম। সত্যিই, ভালোবাসার ক্ষমতা অপরিসীম, সিলিকনে তৈরি নকল যৌনপুতুল বা সেক্স ডলের মধ্যেও প্রাণ সঞ্চার করতে পারে।
সুন্দরীতমা সে, কেমন করেই বা নিখুঁত হবে। খুঁত কেবল এই যে ওর হৃদয় ছিল না।
দার্শনিকরা তো বলে গেছেন যে চোখ হলো আত্মায় প্রবেশের পথ। ওর চোখে রয়েছে সৌন্দর্যের ক্ষমতা, হাসিতে রয়েছে পুরুষকে জয় করে নেবার ক্ষমতা।
হিনাতের হাত দুটো তুলে আমাকে জড়িয়ে ধরতে সাহায্য করলুম, ও তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।
আজ থেকে হিনাত আমার দাচু ওয়াইফু, জাপানি ভাষায় যেমন বলে, ওলন্দাজ স্ত্রী বা রহস্যময়ী পত্নী।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।