কয়েকজন ঝুরোগল্পকার–এর ঝুরোগল্প
অভিজিৎ মিত্র
চ্যাটার্জী ইন্টারন্যাশনাল
আমি এখনো কলকাতা এলে চ্যাটার্জী ইন্টারন্যাশনালের সামনে দাঁড়াই। মাথা তুলে উচ্চতা আর সময় মাপার চেষ্টা করি। ওপর থেকে কাউকে ফেলে দিলে এইচ ইকোয়াল টু হাফ জি টি স্কোয়ার। আজও দাঁড়ালাম। এই জৈষ্ঠ্যের ঠা ঠা গরমে। দুপুর ঠিক একটা। এই বিল্ডিংয়ের ন’তলায় উঠে যেতে হবে। পাশ থেকে উঁকি মারলে মেট্রো রেল ভবনের ছাদ দেখা যায়। এখানে বড্ড মাছি। ভনভন করছে। এত খাবার আর কাটা ফল যে মাছি থাকাই স্বাভাবিক। একটা ঘাড়ে এসে বসল। বিরক্তিকর! ঘাড়ে এক চাপড় মারলাম। মাছিটা উড়ে গেল।
ন’তলায় আবার যেতে হবে সেই কনজিউমার ফোরামের ম্যাডামের কাছে। যতবার আসি, ততবার ঘুরিয়ে দেন। কোন না কোন খুঁত বের করেন। ছোট্ট কেস – মধ্যস্থতার জন্য এই মহিলার কাছে, মাঝে মাঝেই। কনজিউমার ফোরামের জোনাল অফিসার। এবং হাজারো প্রশ্ন। কে জানে, ইনি মাছ ধরেন কিনা।
ন’তলার অফিসে ঢুঁ মারলাম।
- আসতে পারি ম্যাডাম?
- ওহ, আপনি? আপনাকে তো বললাম দু’সপ্তা পরে আসতে। আজ এলেন কেন?
- আজ কি কোন অশুভ ব্যাপার আছে?
ম্যাডাম চোখ তুলে চাইলেন। রাগছেন।
- না না, আমি জাস্ট জানতে চাইছি আজ কি আপনার ব্রত আছে? নাকি শুভকাজে আজ মানা আছে? আমার ফাইলটা খুলে দুটো কমেন্ট লিখে ওটা কমপেনসেশন ডিপার্টমেন্টে পাঠাতে কতক্ষণ সময় লাগে ম্যাডাম?
- আপনি আমায় জ্ঞান দেবেন না। বাইরে যান।
- রাগবেন না ম্যাডাম। টিফিন খাবেন? বাড়ির খাবার। আপনার জন্যই এনেছি।
- কই, দেখি।
বাড়ি থেকে আনা আধখাওয়া ভাঙা কচুরির টিফিনকৌটো খুললাম। পিঁপড়ে ঘুরছে।
- এসব কী? ইউ ডেভিল – আমার সঙ্গে ইয়ার্কি? এক থাপ্পড়ে মুন্ডু ঘুরিয়ে দেব।
ঐ থাপ্পড় শব্দটা শুনে মাথা জ্বলে গেল। মেয়েমানুষের এত সাহস? তবুও মাথা ঠান্ডা রেখেই বললাম,
- আজ্ঞে ম্যাডাম, আমি নিরামিষাশী। পিওর ভেজ। আপনার মত হাড় চামড়া মাংস রক্ত চিবিয়ে খাই না। পিঁপড়েগুলো ফুঁ দিয়ে ফেলে দিন। দেখুন, কী সুন্দর টেস্ট -
- শাট্ আপ আই সে। জাস্ট গেট আউট। কোথাকার এক জংলি বুড়ো ভাম এসে জ্বালিয়ে মারছে। দারোয়ান ডাকতেই হবে দেখছি, ঘাড় ধাক্কা দেবার জন্য।
আমার মাথায় রক্ত জমছে। মেয়েমানুষ এত কর্কশ হয়? আমিষ খেতে ইচ্ছে করছে। সামনে গিয়ে আচমকা ওর পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়লাম। ওর ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা চেপে ধরে সিধে মুখে নিয়ে চুষছি। দেখলাম ও আতঙ্কিত হয়ে উঠল। মুখ থেকে স্বর বেরোচ্ছে না। চুষতে চুষতে বাঁ গালে সেই রহস্যময় হাসিটা জিইয়ে রেখে কট্ করে কামড়ে আঙুলটা কেটে নিলাম। চুষে চুষে রক্ত থামালাম। ওর চোখে তখনো আতঙ্ক আর ঝট্কা।.
কুকুর ও সকাল
পাতা খসতে খসতে হেমন্তকাল। একটু পরে উঠবে। সালভাদোর দালির এক স্বপ্ন মনে পড়ল। একটা হাত। কিছু চাইছে। পিঁপড়েদের সঙ্গে হামাগুড়ি। দেখতে দেখতে আবার কুত্তার মত সকাল হল। আন চিয়েন আন্দালু। আজ এক নতুন ক্ষমতা হাতে আসবে। ক্ষমতার গন্ধ ভালবাসি। সকালে ভোদকার মত স্বচ্ছ, বিকেলে হুইস্কির মত আর রাতে গভীর রামের মত। আমি বদলে যাই, সময়, জায়গা, আসবাব, টাকার রং, সবাই বদলে যায়, কিন্তু গন্ধের ইচ্ছেটা রয়ে যায়। আমি বিজ্ঞান কিস্সু বুঝি না, পদার্থবিদ্যা-আপেক্ষিকতা জানি না, আইনস্টাইন না, আলোর গতিবেগ না, লোরেঞ্জ ফ্যাক্টর না – শুধু গন্ধ চিনি।
আবার কুত্তার মত সকাল হল। আন চিয়েন আন্দালু।
আমার প্রথম পরিচয়, আমি এক টোটোওয়ালা ও সমাজসেবী নেতা। রোজ রাতে কাউকে ফালাফালা করে এসে আরসি-র একটা পাঁইট মারি। বউ এসে জিজ্ঞেস করে ‘কি গো, খাবে না?’ আমি হেসে উঠি। ‘খাচ্ছি তো’! ‘ওসব ছাইপাঁশ আর না খেয়ে ঘরের খাবার খাও’। ‘এটা খাচ্ছি না, অন্য কিছু খাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছিস?’ বউ অবাক হয়। ‘আবার কী খাচ্ছো? আর তো কিছু দেখছি না’। ‘মূর্খ মেয়েছেলে, চোখ খোল্। দেখতে পাবি। কাছে আয়, নাভি কই?’
তারপর আবার কুত্তার মত সকাল হল। আন চিয়েন আন্দালু।
আমার দ্বিতীয় পরিচয়, আমি এক স্কুলছুট শিক্ষকর্মী ও রাজনৈতিক নেতা। রোজ রাতে কাউকে ফালাফালা করে এসে তিন পেগ স্মার্নফ মারি। পাশের পাড়ার বিধবা বৌদির দোতলার প্ল্যান হচ্ছিল না, দখলি জমি, আমি পৌরসভার পেছনের দরজা দিয়ে পাস করিয়ে দিলাম। এখন সন্ধেবেলা বৌদি আমার গ্লাসে স্মার্নফ ঢালে। আমি সেই গ্লাসের কাচে চোখ রেখে বৌদির বুকের ভাঁজে পোকা খুঁজি।
এরপর আবার কুত্তার মত সকাল হল। আন চিয়েন আন্দালু।
আমার তৃতীয় পরিচয়, আমি শহরের এক শপিং মলের মালিক ও অর্থনৈতিক নেতা। রোজ রাতে কাউকে ফালাফালা করে এসে টনিক ওয়াটার দিয়ে বোম্বে স্যাফায়ার মারি, যতটা ইচ্ছে জাগে। মলের সেলসগার্লগুলো একেকজন একেকদিন আসে। রাত ন’টা থেকে বারোটা। ওদের ওভারটাইমের টাকা দিই। কোলে বসিয়ে জিজ্ঞেস করি ‘ছোলা খাবি নাকি পাগলি? পোকা খাবি? উচ্ছে খাবি? আরশোলা খাবি? মাকড়সা খাবি? উচ্চিংড়ে খাবি? রামপুরি খাবি? ব্যাং খাবি? সাপ খাবি? কাঁচা বাদাম খাবি?’ ওরা খিলখিল হেসে গ্লাসের নীলজলে বরফ ফেলে দেয়। আর আমি ওদের সাপের পাঁচ পা দেখাতে শুরু করি।
আজো আবার কুত্তার মত সকাল হল। আন চিয়েন আন্দালু।
আমার একটা চার নম্বর পরিচয় ছিল। ভুলে যাচ্ছি। একটু ভেবে নিই।
.
আমি মাধুরী দীক্ষিতের বাড়ির চাকর হতে চাই
রাজভবনের উল্টোদিক দিয়ে ট্রামলাইন ধরে যেতে গিয়ে রাজা হোঁচট খেল। এখানে এমনভাবে ট্রামলাইন পাতা যে এবড়ো-খেবড়ো ইঁট যে কোন কাউকে একবার না একবার ধাক্কা মারবেই। নিচু হয়ে রাজা দেখতে পেল জুতোর শুকতলা একটু ফেটেছে। জুতো পরীক্ষা করার জন্য নিচু হতেই সামনে চোখ গেল। এক স্লিম তরুণীও একটু দূরে স্লিপ কেটে পড়তে পড়তে বাঁচল। আলুথালু। বুক থেকে ওড়না খসে গেছে। পাশের ব্যাগ নিচে পড়ব পড়ব করছে। ফর্সা বুকের খাঁজে স্পষ্ট তিল। অপূর্ব। রু রু রু রু রু...রু, রু রু রু রু। দিল তো পাগল হ্যায়। রাজা মুচকি হেসে ফেলল। ওকে আড়চোখে দেখতে পেয়ে তরুণীও। তারপর ওড়না গুছিয়ে আবার হাঁটা লাগাল।
‘সো গয়া য়ে জাঁহা, সো গয়া আসমা... সো গয়ি, হ্যায় সারি মঞ্জিলে... সো গয়া হ্যায় রাস্তা’ রাজার বুকের মোবাইলটা বেজে উঠল। বিশু।
‘কী বলছিস?’
‘কোথায় বস্? বার? নাকি কোন প্রেমিকা জুটিয়ে মোহনবাগান মাঠ?’
রাজার মুখে একটা খিস্তি উঠে এসেছিল। কোনমতে আটকাল।
‘কী ভাবিস রে আমাকে? পেট চালানোর দায় নেই? একটা অর্ডার সাপ্লাই দিতে চলেছি’।
‘ওকে ওকে। রাত্রে কথা হবে। ক্লাবে আসবি?’
‘দেখি’।
রাজা ব্যাগপত্র তুলে এদিক ওদিক তাকাল। খানিক দূরে একটা মুচি দেখা যাচ্ছে। দুবার ঘাড় ঘুরিয়ে সেই তরুণীকে দেখার চেষ্টা করল। ভোঁ ভাঁ। ভ্যানিশ্।
মুচি এক কমবয়সি ছোকরা। ওর বাক্সে পা তুলে দাঁড়ানোর সময় খেয়াল করল বাক্সে মাধুরী দীক্ষিতের ছবি। সেই হাসিমুখ। সাজন।
মুচি মোবাইলে ওর এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে। কোথাও ফাংশন দেখতে যাবে, সেই নিয়ে।
‘দে বাপ, আমার জুতোটা একটু তাড়াতাড়ি ঠিক করে দে। তারপর কথা বলবি’।
‘থোড়া সবুর কর বাবু... এক দো তিন, চার পাঁচ ছে...’
রাজা হেসে ফেলল, ওর কথা বলার ধরনে।
ট্রিং ট্রিং ট্রিং ট্রিং... ট্রাম এগিয়ে আসছে। বৌবাজারের। ফাঁকা ট্রাম। ট্রাম দেখলেই রাজার মনে পড়ে মাধ্যমিকের পরে একবার মাধুরী দীক্ষিতের বাড়ি যাবে বলে ভুল করে শ্যামবাজারের ট্রামে চেপে বসেছিল। সেখানে গিয়ে অচেনা রাস্তা দেখে খানিক দমে গেছিল। অবশ্য রাস্তায় মাধুরীর মালা পরানো বিশাল কাট-আউট দেখে আবার মন ভাল হয়ে গেছিল। সেদিন কিন্তু রাস্তার কেউ মাধুরীর বাড়ির ঠিকানা বলতে পারেনি।
হাতল ধরে রাজা উঠে পড়ল। ওর ব্যাগভর্তি রূপোর গয়না। আজ দোকানে সাপ্লাই দিতেই হবে। এখনো অনেকটা রাস্তা।
.
তিনটে চলরাশি
শরৎকাল। সদ্য পুজো থেমেছে। ঢাক চলে গেল। অথচ মরা কাশগুলো এখনো, রোজ। আর তিনটে চলরাশি ধরে রিগ্রেশন অ্যানালিসিস। তিনজনকে যা খুশি নাম দেওয়া যায়। কিন্তু আমরা কেউ জানি না কনস্ট্যান্ট কে কে, কোথায়! শুধু জানতে পারলাম, আজ রবিবাবুর জীবনের শেষদিন। আজ আমার প্রথমবার ভ্যাক্সিন হবে। আজ সন্দীপ রায়ের সঙ্গে আমার হাসিখুশি ফটো হোয়াটস্অ্যাপ স্ট্যাটাসে আপডেট হবে।
রবিবাবু পুরোটা জানে। অথচ জেনেও সারা সকাল না জানার ভান করে বসে আছে। দেখতে দেখতে সকাল এগারোটা, এই সময়েই ডাক্তারবাবু বলেছিলেন ফোন করে জেনে নিতে কোভ্যাক্সিন আজ পাওয়া যাচ্ছে কিনা। সন্দীপ রায় আসবে বলে আমার ফটো আজ সারা সকাল আয়নার সামনে ফ্রেমবন্দী নিজেকে দেখেছে।
রবিবাবুর নজর বারবার দরজার দিকে – ঝাপসা দৃষ্টিতে শব্দ শোনার চেষ্টা। দৃষ্টির ওপাশে অনেকবার বাজার পর ডাক্তারবাবু ফোনটা ধরলেন। এক প্রকান্ড হাই তুলে বললেন, চলে আসুন। সেই শেষ বিকেলে দেখা হতেই আমার ফটো সটান গিয়ে সন্দীপ রায়ের পাশে বসে পড়ল।
যদি যমরাজ আসে অথবা তার কোন স্যাঙাৎ, তাহলে দৌড়ে গিয়ে পা ধরে ফেলতে হবে। রবিবাবুর যেন হাল্কা তন্দ্রা। এই মওকায় বেশ আনন্দ হল। কেউ যেন বলেছিল, ভ্যাক্সিন না নিলে নাকি আমার আয়ু কমে যাবে। ফটো মোবাইল ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করছে, ওর নিজের কোন ফেসবুক বা টুইটার প্রোফাইল আছে কিনা।
আর কয়েকটা দিন দেওয়া যায় না, স্যার? তাহলে বড় নাতিকে আরেকবার দেখে আসতাম। আশি পেরনো রবিবাবুর কথা আটকে আসছে। বন্ধু বান্ধব আত্মীয়, সবাইকে রেখে গুটি গুটি পায়ে এগোলাম। কোভ্যাক্সিন পাওয়া যাচ্ছে না – হঠাৎ কেউ আমি কী নিচ্ছি জিজ্ঞেস করলে জবাব দিতে পারব না। সুতরাং চুপিচুপি কাজ সেরে ফেলাই ভাল। পিনড্রপ ফটো সেঁটে যাচ্ছে। স্ক্রিনে আস্তে আস্তে, অনেকটা ক্ষীরের মত।
অথবা যদি রোজ যে ওষুধটা চারবার খেয়ে বেঁচে আছি, তার ডোজ একটু কমিয়ে দেওয়া যায়? রবিবাবুর চোখ ছলছল। হাতে অনেকদিন পর ইঞ্জেকশন নিলাম, মনে হচ্ছে এদ্দিনে হাল্কা হলাম। তাহলে আয়ু বাড়ল, কিন্তু কদিন? আর ফটো পাচ্ছি না, সে কোথায় কোন্ পেজে গিয়ে বসে পড়েছে, সন্দীপ রায়ের পাশে পরপর ছবি হবার পর। এই না ফটোজন্ম!
বাইরে টেম্পারেচার বাইশ, আকাশে কিউমুলাস, একিউআই দেড়শো। আমাদের সবার কেমোথেরাপি চলছে। রবিবাবুর ম্যালিগন্যান্ট কোষগুলোর বিরুদ্ধে, আমার নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস আর অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রক্সাইড জেল দিয়ে, ফটোর ডি-৭৬ ডেভেলপিং পাউডার দিয়ে। আমরা যৌবনে ফিরছি, রসায়নের স্টুডেন্ট হিসেবে।
কুকুর, ছাগল আর মুরগিগুলোর পৌষাড়ে গল্প
এবার থেকে প্রতি বৃহস্পতি আর রবি সমস্ত দোকান বাজার বন্ধ থাকবে। বাকী দিনগুলো বেলা বারোটা অব্ধি খোলা। প্রশাসনের নতুন নির্দেশ। এর আগের যে নির্দেশ ছিল, সেই নিয়ে প্রচুর হৈ-চৈ। তাই নির্দেশ বদল। কিন্তু এই নতুন নির্দেশে প্রশাসন কয়েকটা শর্ত চালাকি করে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যেটা সাধারণ মানুষ এখনো বুঝতে পারেনি। প্রথমত, প্রতি বৃহস্পতি আর রবি শহরের প্রতি রাস্তায়, প্রতি গলিতে ১৪৪ ধারা জারি থাকবে। রাস্তায় একমাত্র পুলিশ অথবা বিশ্বস্ত কুকুর ঘুরবে। ইচ্ছে হলে গান গাইবে। দ্বিতীয়ত, ঐদিন ভোরবেলা সমস্ত মাছওয়ালা, মুরগিওয়ালা আর ছাগলওয়ালাদের ডেকে পাঠিয়ে পুলিশ মেপে দেখবে যে কারো দোকানে যদি কোন মাছের ওজন ১ কিলোর কম, মুরগির ওজন ২ কিলোর কম আর ছাগলের ওজন ৫ কিলোর কম হয়, সেগুলো রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হবে। ওপরের মহল থেকে স্পষ্ট নির্দেশিকা আছে, মোটা মোটা মাথার নধর মুরগি, নধর ছাগল আর গভীর জলের পাকামাছ ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ব্যবসা করা যাবে না। তৃতীয়ত, কেউ যদি ফাঁদ পেতে ঐসব চরে বেড়ানো ছাগল-মুরগি ধরে নিজের বাড়িতে ঢুকিয়ে নেয়, তাহলে পেট ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্টে তার ৭ বছর জেল হবে।
পৌষমাসের শেষ দিন। উত্তুরে হাওয়া। ভোরবেলা বৃষ্টি হয়ে রাস্তার দুদিকের ড্রেন ভেসে গেছে। এই ঠান্ডায় গোটা শহর যখন ভাবছে এবার চা খেয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য ছাদে উঠবে, তখনি ভেসে এল সেই অদ্ভুত কোরাস। আস্তে আস্তে সারা শহর, সব গলি ছেয়ে গেল সেইসব শব্দে। রাস্তার দুদিকের ড্রেনের উপচে পড়া জলে ছলাক ছলাক লাফিয়ে ভাসতে ভাসতে চলেছে প্রচুর ছোট ছোট মাছ। রাস্তার ওপরে খাঁচামুক্ত অনেক মুরগির কঁকর-কঁ কঁকর-কঁ আর রাস্তাজোড়া দুপাশের গাছের আশেপাশে লাগামহীন কচি ছাগলের ম্যা-হ্যা-হ্যা-হ্যা। কুকুরগুলো এরকম দৃশ্য জীবনে দেখেনি। কী করবে বুঝতে না পেরে ওরাও কোরাস গেয়ে উঠল।
আজ বৃহস্পতি। সারা শহরে ১৪৪ ধারা। নিচে রাস্তায় নামা যাবে না। অগত্যা গোটা শহর বাড়ির দরজায় খিল তুলে ছাদ থেকে আকাশের ঘুড়ি থেকে দেখছে ছাগলগুলো কীভাবে উঠোনের পাশের সাধের ফুলগাছগুলো মুড়িয়ে খেয়ে যাচ্ছে আর মুরগিগুলো ফেলে দেওয়া ভাত আর মুড়ির টুকরো খুঁটতে খুঁটতে পাল্লা দিয়ে রাস্তা ভর্তি সাদা ডিম পাড়ছে। মাছেরা লাফিয়ে রাস্তায় উঠছে আবার ড্রেনে নেমে যাচ্ছে। খানিক দূরে চৌরাস্তায় পুলিশ গান বাজাচ্ছে – ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে / পাগল আমার মন জেগে ওঠে’।
এরকম অপার্থিব দৃশ্য দেখে আমার হঠাৎ কিছু দিতে ইচ্ছে হল। দৌড়ে গিয়ে বাক্স-প্যাঁটরা ঘেঁটে ২০২০ সালের একটা ফুরফুরে কাগজের মাস্ক এনে ছাদ থেকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলাম। সেটা চড়কির মত ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায় নামতে লাগল।
.
মুখের ভিড়ে একটা মুখোশ। পাগলা হাওয়ায় নামছে।
অর্ক চট্টোপাধ্যায়
জেনারেটর
জেনারেটর। আগে আলো দিত। এখন স্মৃতি দেয়। ৯০এর লোডশেডিংয়ের শৈশবে ছিল হাতে টানা ডায়নোসরের মতো হোন্ডা কোম্পানীর জেনারেটর। এখন লোডশেডিং এবং জেনারেটর দুজনেই ডোডোপাখি। এখন ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমি, চাঁদের আলো, তবুও কেন যে এতো অন্ধকার! কেন দলিত বলে পিটিয়ে মারা, পুড়িয়ে মারা মানুষের কঙ্কাল চতুর্দিকে? অমনভাবে মরা একেকটা মানুষ কতটা অন্ধকার তৈরী করে বলুন তো পাঠক? পোড়া হাড় উজিয়ে অন্ধকার উঠে আসে, ভেসে আসে, তেড়ে ধরে, গিলে নেয়। তবে কি সত্যিই দরকার ফুরিয়েছে জেনারেটরের?
জেনারেটর এসেছিল মায়ের বাড়ি থেকে। দাদুর দেওয়া উপহার। লোডশেডিং হলে বারান্দায় গিয়ে সবার আগে অনাবৃত করা হতো তাকে। তারপর দড়ি ধরে মারো টান। কখনো একবারের টানেই স্টার্ট নিয়ে নিত। কখনো আবার একযুগ ধরে টানামানি করতে হত। সে জেনারেটরে একটা ঘরের আলো-পাখা চলে যেত আরকি। জেনারেটর চালানোর যুদ্ধের দায় সাধারণত বাবার কাঁধেই থাকতো। কখনো সখনো বাবা বাড়ি না থাকলে ছেলেও হাত লাগতো। জেনারেটরের দড়ি টানতে টানতেই কি ছেলে বড়ো হয়ে গেল, পুরুষ হয়ে উঠলো?
ছেলে থেকে বাবা, বাবা থেকে ছেলে, ৯০ থেকে দশকের মোড় ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন শতাব্দী। প্রযুক্তির উন্নয়নে প্রথমে ইনভার্টার এসে বাজার হাত করলো হোন্ডা জেনারেটরের। তারপর বিশ্বায়নের জেরে লোডশেডিংয়ের অন্ধকারখানই বিদায় নিল। সাথে নিয়ে গেল প্রাক-বিশ্বায়নযুগের রেলিকস্বরূপ সেই জেনারেটর। ছেলেটা ততদিনে বড় হয়ে গেছে। অন্ধকার লোডশেডিং ভুলে অন্য পরিসরের নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছে। ছেলেটা বুড়ো হয়ে গেলেও বুঝে উঠতে পারেনি ঠিক কতবার দড়ি ধরে টান মারলে জেনারেটর চালু হবে।
কতবার? আর কতবার?
বয়েস বাড়লে সংখ্যার এক অন্য চেহারা সামনে আসে। চেনা জায়গা, চেনা লোকেদের সঙ্গে মোলাকাত হলেই মনে হয়, আর কতবার? আর কতবার দেখা? আর কতবার আড্ডা? কতবার গল্প-কবিতা? কতবার মধ্যরাত? কতবার রাজনীতি-প্রেম? কতবার মাঠ-ঘাট-ময়দান, ধোঁয়া-তরল? আরেকবার হল কিন্তু এরপর, আর কতবার?
সংখ্যামাত্রেই যখন কাউন্টডাউন হয়ে যায়, তখন মনে হয়, মেঘের ভেতরে মেঘ জমেছে, বছরের ভেতর বছর আর বয়েসের ভেতর বয়স। আর কতবার? সংখ্যারা উত্তর দেয় না। প্রতিধ্বনি ফিরে আসেঃ 'আর কতবার?'
বাতিল জেনারেটর দিয়ে কি সচল বোমা বানানো যায়? উড়িয়ে দেওয়া যায় লিনচারদের? তাতে কি অন্ধকার বাড়বে না আলো? পুরনো ইলেকট্রনিক্সের ধ্যারধ্যারে দোকানের কোণে পড়েছিল অকেজো হোন্ডা কোম্পানীর জেনারেটর। জন্তুটার দিকে চোখ এক করে তাকিয়ে ছিল ছোটু। বছর ১৩ বয়েস। এই দোকানে হেল্পারের কাজ করে। পুড়িয়ে মারা মানুষের দেহ থেকে যে অন্ধকার বের হয় তা লেগেছিল ওর শরীরের সর্বত্র। কীI ভাবছিল ও জেনারেটরটার দিকে ঠায় তাকিয়ে?
আর কতবার? আর কতবার?
.
চিন্তামৃত্যু
মুখ ফেরানো দিন থেকে মুখ তুলে তাকানো রাত পর্যন্ত চোখ চলে গেলেও নড়ে না মৃত্যু-পরবর্তী নিথর শরীর। তবে? কী এমন ছিল দরজার কোণের ঐ অন্ধকারে যে মরে শক্ত হয়ে আসা টিকটিকিটার শরীর দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকে আসতে লাগলো তরতরিয়ে?
সকালবেলায় দিব্বি খেলাধুলো করছিলো টিকটিকিটা। ঘরময়। কী এমন বিষ ছিল সেই সন্ধ্যায় যে কয়েক ঘন্টায় মরে কাঠ! হঠাৎ চোখে পড়লো দরজার কোণে কালো হয়ে আসা নিকষ দেহ। চোখদুটো ফ্যাটফ্যাট করে খোলা। অথচ তারপর দেখা গেল প্রতি ঘন্টায় একটু করে এগোচ্ছে। গুটি পায়ে! তবে কি মরেনি, স্রেফ মরার ভান করে পড়েছিল এতোক্ষণ?
লাঠির ডগা দিয়ে দেহ উল্টে দিতেই বেরিয়ে পড়ল সত্যিটা। টিকটিকির অন্তর্দেহে পিপীলিকা সমাবেশ। অনেকক্ষণ ধরে কুরে খাচ্ছে ভেতর থেকে ওর শরীরটাকে। ওর ভেতর-শরীরটাকে। খেতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোন সে অন্ধকার ডেরায় যেখানে বাকিটা খাবে! সবটা খাবে! সবটা। শবভক্ষণ এবং শববাহনের এই সমাপতন চমৎকৃত করে!
তবে কি পিঁপড়েগুলোই খুন করলো জ্বলজ্যান্ত টিকিটিকিটাকে? তারা কি কেবল মৃত শরীরের খাদক নাকি হন্তারকও বটে? কিন্তু তা কী করে সম্ভব। খুদে লাল কালো পিঁপড়েগুলোর কাছে ঐ টিকটিকি তো নেহাৎই গডজিলা। মরলেই কেবল তার কাছে ঘেঁষবে পিঁপড়ের দল, নচেৎ নয়। তবে কি বিষ ছিল নীল আকাশে ঘনায়মান অন্ধকারে যে এক সন্ধ্যায় মরে কাঠ হয়ে গেল?
পিঁপড়েরা মরলে কি টিকটিকিরা খেতে পারবে ঐ লিলিপুট শরীর? টেনে নিয়ে যেতে চাইবে কোন অজানা গুহার ভিতর? ভিতরশরীর খাওয়ার পর খোলশ পড়ে থাকবে সে গুহায়। বাহিরশরীরের খোলশ।
এসব চিন্তা অজ্ঞতাপ্রবণ মনুষ্যজাতির। পিঁপড়ের শুধু পরিশ্রম। সুসংহত পরিশ্রম। টিকটিকির খোলা চোখ কি দেখে নিচ্ছে তার খাদ্য হয়ে ওঠার উত্তরকাল? নাহ। তা নিতান্তই অসম্ভব এবং ফলত চিন্তার অতীত। চিন্তার ভবিষ্যৎ হল মৃত্যু। মুখ ফেরানো দিন থেকে মুখ তুলে তাকানো রাত পর্যন্ত চোখ চলে গেলেও নড়ে না মৃত্যু-পরবর্তী নিথর শরীর।
.
বটুকবাবু ফিল্মমেকার
বটুকবাবু ইউটিউবে একটা চ্যানেল খুলেছিলেন। সারাজীবন ফিল্ম জাঙ্কি। চাকরি থেকে অবসর নেবার পর ভাবলেন বলিউডজ্ঞান একটু ভাগ করে নেবেন। নানা কারণে মুক্তি না পাওয়া হিন্দী ফিল্ম নিয়ে ভিডিও বানাতে লাগলেন। পুরনোদিনের নানা ছবি-- ৭০, ৮০র দশকে যেগুলো আদৌ তৈরী হয়নি কিম্বা কয়েক রিল শুটিং হবার পর বন্ধ হয়ে যায় অথবা পুরো তৈরী হওয়ার পর ডিস্ট্রিবিউটর না মেলায় বা অন্য কোন কেচ্ছার জন্য বন্ধ হয়ে যায়, এমন ছবি বিষয়ে নানা তথ্য দিয়ে ভিডিও বানান। দৃশ্যে থাকে সেসব ছবির পোস্টার, ট্রেইলার, ক্লিপিংস।
বটুক প্রযুক্তিতে বাঘা। অডিও ভিডিও নিজেই এডিট করেন। সপ্তাহে একটা ভিডিও তো আসেই। দেব আনন্দ, দিলীপকুমার, হেমা, বিনোদ খান্না হয়ে
শ্রীদেবী, অমিতাভ, অনিল কাপুর, সঞ্জয় দত্ত, মাধুরী দীক্ষিতের ক্যানড ছবির ভিডিও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ৫০০-৬০০ ভিউজ, ভালো সংখ্যক কমেন্টস এবং সেখানে বেশ কিছু জানা-অজানা ফিল্ম নিয়ে ভিডিও বানানোর অনুরোধ। বটুক অনুপ্রাণিত বোধ করেন। খবর লাগান। নার্ড স্টাইলে ডিপ ওয়েবে ঢুকে পড়েন। গহীন সমুদ্রে গায়েব জাহাজের পেটে রাখা মোহরের মোহমায়ায় খুঁজে চলেন হারানো ছবি। যোগাযোগ করেন পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে। তাদের টুইট করে শুধোন ছবি রিলিজের ব্যাপারে। ওটিটিতে রিলিজ করা যায়? নয়তো ইউটিউবে সরাসরি?
সম্পূর্ণ হওয়া স্বত্ত্বেও মুক্তি না পাওয়া ছবিগুলোর পেছনে পড়ে থাকেন বটুক। অবাক লাগে কেমন করে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বানানো ছবি সম্পর্কে উদাসীন হয়ে গেছেন মেকাররা, অ্যাক্টররা! প্রশ্ন করলেও উত্তর দেন না, আগ্রহ দেখান না। ঐ ছবিগুলো রিলিজ হলে কি ভাগ্য বদলাতে পারত সেইসব অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক-প্রযোজকদের? কে জানে ঐ ছবি হয়ত কাউকে-কাউকে সুপারস্টার বানিয়ে দিতো! কালস্রোতে সবই কেমন বয়ে গেছে। ওরা অস্বীকার করেন ওদের সৃষ্টিকে! মনে করেন ভদ্রা লাগা ওসব ছবি, মুক্তি নেই, তাই অভিশপ্ত! কারুর দেউলিয়া হয়ে যাবার স্মৃতি, কারুর স্বজন হারানোর আবার কারুর মুখ থুবড়ে পড়া প্রেমের স্মৃতি লেগে থাকা সেসব ছবি ডাস্টবিনে পড়ে!
একজন পড়তি নায়ককে একদশক আগে বন্ধ হওয়া ছবি নিয়ে জিগানোয় তিনি উত্তর দিলেন। বাজারদরে টান, কাজের চাপ নেই, সময় অঢেল বলেই হয়ত মেসেঞ্জারে উত্তর এল দিন তিনেক পর। একটি হরর ফিল্ম। ওর নিজেরই প্রোডিউস করা। কো-প্রোডিউসর ছিলেন স্ত্রী। সে বছর ওর একটা হোম প্রোডাকশন বক্স অফিসে মার খাওয়ার পর এই ফিল্ম আর রিলিজ করতে পারেননি। মেসেঞ্জারে এককালের জনপ্রিয় হিরো আফসোস করে বলেন, "আহা ঐ ছবিটায় কি ভালো কাজই না করেছিলাম! ভেবেছিলাম ওটা আমার কেরিয়ারের টারনিং পয়েন্ট হবে! হায়!" বটুকের রিসার্চ বলছে, ছবিটার ফুল প্রমোশন হয়েছিল ট্রেলার, গানসহ। গানগুলো বেশ পপুলারও হয়েছিল। অথচ রিলিজ হল না। গল্পখান ছিল এরকম:
মনোরোগবিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিজেই এখন মনোরোগী। পাগল হয়ে গেছেন পরিবারের সবাই খুন হবার পর। হত্যাকারী ধরা পড়েনি। ১৫ বছর পর বৃদ্ধ ডাক্তার মনোকষ্টে আর বাঁচতে চান না। নিজের খুনের সুপারী দেন নিজেই। যে কিলারকে কাজ দেওয়া হয় সেই আমাদের অ্যান্টি-হিরো। কিন্তু কথামত ডাক্তারকে খুন করতে সেদিন রাতে বাড়ি ঢুকেই বুঝতে পারে ডালমে কুছ কালা হ্যায়। খুনি নিজেই ফেঁসে যায়। এই হিচককসুলভ প্লটের সিনেমার ট্রেলারও ছিল রুদ্ধশ্বাস! কেন যে রিলিজ হল না কে জানে! পরিচালক বেশ নাম করেছেন পরে। বটুক যতবারই ট্রেলার দেখেন আর সিনেমাটার কথা ভাবেন, অবসেসড হয়ে পড়তে থাকেন। কে ঐ মুখোশপরা খুনী যে সুপারী কিলারকে খুন করতে আসে? সেই কি খুন করেছিল ডাক্তারের বৌ বাচ্চাকে ১৫ বছর আগে? সে কি ডাক্তার নিজেই? সান্ধ্য আলোয় কে মোমবাতি জ্বালায় ঘরের কোণে? কার হাত থেকে লাল বল নিচে পড়ে যায় রিভলভিং স্টেয়ারকেসের ফাঁক দিয়ে? ক্যামেরা ওপর থেকে নীচে আর নীচ থেকে ওপর তুলে ধরে বলটাকে? বটুক বারবার নিজেকে দেখতে পান বসন্তোত্তীর্ণ সেই নায়কের পরিবর্তে।
বটুক চান যেভাবেই হোক সিনেমাটা রিলিজ হোক। নাহলে তিনি নিজেই হয়ত বানিয়ে ফেলবেন অমন একটা ফিল্ম। কিন্তু বটুক কি আর সিনেমা বানাতে পারবেন? সে কী চাড্ডিখানি কথা! তবে কি দেখবেন, সিনেমাটা নিজে থেকে তৈরী হয়ে যায় কিনা? তার জন্য কী করতে হবে? হয় বৌ বাচ্চাকে খুন, নাহলে সে খুনের সুপারী। দেখা যাক না তারপর কী হয়!
.
শ্বেত-তত্ত্ব
পুরনো সাদা বাড়ির ভেতরকার ঠাসা আসবাব, কিউরিও, মূর্তি, দেবতা, শয়তান, শিল্প, স্থাপত্য -- ট্র্যাক করে এগিয়ে চলছিলো ক্যামেরা। সন্ধ্যা আসন্ন। অন্ধকারে সাদা বাড়ির কালো বৈঠকখানার, কালো বারান্দার, কালো ঘরের নিকষ কৃষ্ণবর্ণ ফার্নিচার চুপিচুপি কথা বলছে, যেন ক্রাইজ অ্যান্ড হুইস্পারস এর বিখ্যাত ওপেনিং ট্রলি।
সন্ধ্যা
সাদা বাড়ির গায়ে দিনের অন্তিম লাল আলো তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, যেমন নরম গালে আচম্বিতে ছুঁয়ে যায় নশ্বর অথচ আসক্ত আদর। আসক্ত কিন্তু অশক্ত। রাত নামছে। কাল সকালের আগে তার আর দেখা হবার নয় সাদা বাড়ির সঙ্গে। কিন্তু সকাল যদি না হয়, তবে? বাড়িটা যদি এই রাতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে? সকালবেলার লাল আলো আর যদি খুঁজে না পায় শ্বেতপাথরের বাড়িকে? উদ্বিগ্ন বাড়ির রাতে ঘুম হবে না আজ। যে লোকটা রোজ রাতে ঘুমোনোর সময় ভাবে, সকালে যদি আর ঘুম না ভাঙে, আজকের রাতই যদি শেষ রাত হয় তার জীবনের, আর এমনটা ভাবতে যে ইন্সমনিয়াক লোকটা একদিন না ঘুমোতে পেরে মধ্যিরাতের আকাশে নক্ষত্রের হাতছানি শুনতে পায়। এ বাড়িও তেমন। ঠাসা জিনিসপত্র ঘরে। কত ছবি, টেবিল, চেয়ার, খাট, সোফা, আলমারি, কত ঝাড়লণ্ঠন! নানা দেশ থেকে এনে জড়ো করা! দিনের বেলা কত মানুষ শহরের নানা প্রান্ত থেকে দেখতে আসে। টিকিট কেটে দেখে যায় থোক থোক জিনিস। আর রাত নামলে? রাত নামলে কে দেখে ওদের? কি দেখে? কে, কী বা কারা ক্যামেরা রোল করে অন্ধকারে?
রাত
আসবাবেরা দর্শনীয় বস্তু হয়ে রয়ে গেছে। কেউ তাদের ব্যবহার করে না। রাত্রদিন তারা কারুর না কারুর দৃষ্টিবদ্ধ হয়ে থাকতে চায়। দৃষ্টিবদ্ধ না হলে যেন অস্তিত্ব নির্মূল হয়ে যাবে। তাই তো ক্যামেরা লাগানো আছে ঘরে-বারান্দায়। লোকে ভাবে সিসিটিভি পাহারা দেবার জন্য, পাছে দামি জিনিস চুরি হয়ে যায়! কিন্তু ক্যামেরাগুলো আসলে আছে ওদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে! সাদা বাড়িটায় কি এককালে বিশপ বার্কলে থাকতেন? রাতে কেউ আসে না বাড়ির ভেতর। পাহারাদাররা আউটহাউসে থাকে। ক্যামেরাগুলো ট্র্যাক করতে থাকে সারারাত। স্থানু বস্তুপৃথিবীর অপলক যন্ত্রণা উথলে আসে আবয়বিক দৃশ্য পরম্পরায়। গলার কাছে আটকে থাকে বেয়াদপ দুঃখবিলাসী ঠান্ডা লাগার মত।
সকাল
প্রভাতকালীন রক্তিমতা ঘিরে ধরে সাদা বাড়িকে! আসবাবগুলোর সরণহীন শরীর জুড়ে কত রঙের রামধনু খেলে যায় কে জানে! সরণহীন হতে পারে কিন্তু স্মরণহীন নয় তারা! আরও একটা দিন বেঁচে থাকবে সাদা বাড়ি আর এই নির্মোহ স্থবিরতার ক্লান্ত প্রদর্শনশালা! বাঁচবে আর বলবে, 'আবয়বিক' বললে কেমন 'অবায়বিক' শব্দের মত শোনায়! বস্তুরা জানে সকল কিছুই একদিন বায়বীয় হয়ে যাবে! বাতাস দৃষ্টিবদ্ধতার তোয়াক্কা করে কই? লোকটা ঘুমোতে পারে না, পাছে ঘুম আর না ভাঙে! নিদ্রাহীন রাত্রি শেষে নিষ্পলক এক সকাল আসে। প্রাতঃকালীন লাল আলোয় লোকটার ঘুমহীন চোখ ঝাপসা হয়ে সফেদ বাতাসে মিশে যায় একলা হরীতকীর মত।
.
দরজাটা
চিলেকোঠার ঘরে আঁক কষতে হঠাৎ চোখ পড়ল নাফিসার। জানলার বাইরে পাশের বাড়ির ছাদের ওপর আরেকটা উপর-ছাদ। তারও ওপরে পড়ে রয়েছে একটা দরজা। এত ওপরে দরজা কোথা থেকে এলো? কে রেখে গেল বা ফেলে গেল? ওপরের দিকের কাঠ ভেঙে গেছে। যেন কেউ আছড়ে ফেলেছে।
এতো ওপরে এতো বড় কাঠের দরজাকে তোলা কিন্তু মুখের কথা না। নাফিসা আসমানের দিকে তাকায়। তবে কি জন্নত থেকে এসে পড়লো দরজাখান? যেভাবে একদিন শহরের ওপর নেমে আসে বোমারু বিমান? কিম্বা যেভাবে আম্মিজানের চোখে সুরমার মত নেমে এসেছিল মৃত্যু?
নাফিসার মন উদাস হয়ে গেল এসব ভাবতে। অঙ্কে মন বসাতে চেষ্টা করলো কিন্তু পাটিগণিতও করোনায় সদ্যমৃতা আম্মিজানের কথাই মনে করিয়ে দিল তাকে:
পিতা পুত্রের বয়সের সমষ্টি কত?
নাফিসা পিতার জায়গায় মাতা আর পুত্রের জায়গায় কন্যা বসিয়ে দিল। বয়সের সমষ্টি আর কোনোদিন দুদিক থেকে বাড়বে না! আম্মির কি আর বয়েস বাড়বে? ইন্তেকাল হয়ে গেলে আর বয়সে বাড়ে নাকি? নাফিসার বাড়বে। তাতে মাতা-কন্যার বয়েসের সমষ্টিও বদলাবে। কিন্তু এজন্মে আর আম্মিজানের সঙ্গে মোলাকাত হবে না।
ঠিকমত জানাজাও করা গেল না কোভিডের জন্য। বডি পেল না আব্বু। পিপিই পরা নাফিসকে একবার পা ছুঁয়েই আম্বুলেন্স থেকে বেরিয়ে আসতে হল। গোর দেবার পর ফুল দিয়ে আসা ছাড়া আর দেখা হল কই? কতই বা বয়স আম্মির? এক সপ্তাহ কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট। তারপর সব শেষ। অথচ আব্বু আর নাফিসা নেগেটিভ! যেন আম্মিকে নিয়ে যাবার জন্যই এসেছিল করোনা।
আবার জানলার বাইরে পাশের বাড়ির উপরছাদের উপর পড়ে থাকা দরজার দিকে তাকালো নাফিসা। অমন এক দরজা দিয়েই চলে গেছে আম্মিজান। এমন এক দরজা যার ওখানে থাকার কথাই ছিল না! অস্থানের অযাচিত দরজা
আম্মিকে আসমানে নিয়ে গেছে আর দরজাটা এসে পড়েছে উপরছাদে, ধড়াম করে।
এখন ঐ দরজার দিকে তাকিয়ে আম্মির ছবি মনে ভাসিয়ে তোলার চেষ্টা করে নাফিসা। ভাঙা দরজার ওপরদিক যেন দুটো চোখ। সুরমা লাগানো। সেখানে আজানের সুর শুনতে কখনো আম্মির মুখ দেখতে পায় নাফিসা। প্রথম দরজাটাকে ঘেন্না করতো। ঐ দরজাই তো আম্মিকে নিয়ে গেছে। ওটার তো ওখানে থাকার কথা নয়। দরজা না থাকলে আম্মিজানও যেত না। কিন্তু আজকাল নাফিসার মন বদলেছে। দরজাটা আছে বলেই তো এখনও আম্মিজানকে মাঝে দেখতে পাচ্ছে। তাই এখন নাফিসা চায় দরজাটা অমন করেই পড়ে থাকুক। থেকে যাক।
চিলেকোঠার ঘরে আঁক কষতে কষতে মাঝে মাঝেই আড়চোখে দেখে নেয় নাফিসা। আছে তো দরজাটা? উবে যায়নি তো?
মাসপিছু দরজার বয়স এক বছর বাড়ায় নাফিসা। মাতা কন্যার বয়েসের সমষ্টি দুদিক থেকেই বাড়ছে। তার এক বছর মানে আম্মিজানের বারো বছর। যতদিন না হাওয়া-জল খেয়ে নিচ্ছে জলপাইকাঠ।
.
কাজল সেন
পাগল
-জানেন হালদার স্যার, আমার বরটা না পাগল। পুরো পাগল।
-এ কী বলছেন মিসেস পোদ্দার! আপনার বর পাগল হলো কবে থেকে? বিয়ের আগে, নাকি পরে?
-এটা স্যার আপনি কোটি টাকার প্রশ্ন করেছেন। সত্যি বলতে কী, এই প্রশ্নটা আমার মনেও হয়েছে। আসলে কী জানেন, আমাদের বিয়েটা তো সম্বন্ধ করে হয়েছিল, বিয়ের আগে চিনতাম না, তাই ঠিক বুঝতে পারি না, আমার বরটা আগে থেকেই পাগল ছিল কিনা!
-তা বুঝতে পারলেন বিয়ের কতদিন পর থেকে?
-কয়েকদিন পরেই স্যার। আপনাকে বলতে আমার লজ্জা নেই, আপনি আমার অফিসের বস, বয়সে অনেক বড়, আমার বাবার বয়সী, তাই না স্যার?
-হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো বটেই মিসেস পোদ্দার। বিশেষত একবার যখন মন খুলেছেন, তখন মনের কথা বাইরে বেরিয়ে যাওয়াই ভালো। না হলে আবার মনটা ফুলতে ফুলতে কবে যে ফেটে কালিদাসের ঢোল হয়ে যাবে, কে বলতে পারে!
-আপনি ঠিক কথা বলেছেন। মনের দুঃখ কষ্ট ব্যথা বেদনা জমতে জমতে আমার বুকের ভেতরটা একেবারে সাগর হয়ে গেছে। তাছাড়া কী জানেন স্যার, সবাইকে তো আর মনের কথা খুলে বলা যায় না! যাকে বললে বুঝবে, শুধু তাকেই বলা যায়।
-হ্যাঁ, তা তো বুঝলাম, কিন্তু আপনার কেন মনে হলো যে আমার কাছে আপনার মনের কথা বলা যায়?
-সে কী স্যার, ঐ যে বললাম আপনি আমার বাবার মতো!
-হ্যাঁ, সেটা তো ঠিকই। কিন্তু শুধু কি এটাই একমাত্র কারণ?
-না স্যার, আরও একটা কারণ আছে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে। আসলে আপনি তো আমার অফিসের বস। আমি কীভাবে কথাটা বলি, বলুন তো!
-দেখুন মিসেস পোদ্দার, আমি আপনার বস ঠিকই, কিন্তু সেটা তো অফিসের ভেতর। এখন তো আমরা অফিসের বাইরে রেস্টুরেন্টে বসে চা খাচ্ছি। এখানে আপনি অনায়াসে বলতে পারেন।
-হালদার স্যার, কিছু মনে করবেন না, শুনেছি আপনার বউটাও নাকি পাগল?
-এ্যঁ! সব্বোনাশ! আপনি একথা জানলেন কীভাবে?
-জেনেছি স্যার। কিন্তু আপনিও কি আমার মতো না জেনে পাগল বৌ বিয়ে করেছিলেন, নাকি বিয়ের পর পাগল হয়েছিল?
-আপনি দেখছি আমাকেও পাগল করে ছাড়বেন! কী যে বলি আপনাকে! জেনেশুনে কেউ কোনো পাগল ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে করে নাকি! আমারও তো সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর বেশ কিছুদিন ভালোই সংসারপাতি করেছিল। কিন্তু তারপর কী যে হলো, আমার বউ যখন সুস্থ স্বাভাবিক থাকে, তখন খুব বাজে রান্না করে, আমাকে একটুও যত্ন করে না, এমনকি ভালো করে কথাও বলে না। আর যখন তার মাথাটা বিগড়ে যায়, তখন জমিয়ে রান্না করে, কত গল্প করে, যত্ন করে, একী পাগলামি বলুন তো! আর আপনার বর কী করে?
-আমার তো স্যার আরও সিরিয়াস ব্যাপার। আমার বর যখন সুস্থ স্বাভাবিক থাকে তখন আমাকে ছোঁয়ও না। আর যখন মাথাটা খারাপ হয়, আমাকে তখন তার সে যে কী বীভৎস আদর…
পেশা অথবা নেশা
ট্রিমেন্ডাস ওয়ার্কলোড। প্রচন্ড কাজের চাপ। আর পেরে উঠছেন না ধনঞ্জয়বাবু। একদিকে পেশা, অন্যদিকে নেশা। যে বেসরকারী অফিসে তিনি চাকরি করেন, সেখানে জুতোসেলাই থেকে চন্ডীপাঠ তাঁকেই সামলাতে হয়। একাউন্টস, পার্চেজ, সেলস, আইন-আদালত সবকিছুই। গালভরা ডেজিগনেশন অফিস ম্যানেজার। ধনঞ্জয়বাবু রীতিমতো হাঁপিয়ে ওঠেন। কিন্তু পেশাকে পাশ কাটিয়ে যাবারও কোনো উপায় নেই। আয় না থাকলে ব্যয়ের কোনো অপশন নেই। আর ব্যয় না করলে সংসার অচল। সংসারে তাঁর একটা বউ, দুটো ছেলে আর দুটো মেয়ে বর্তমান। এক একজন একেক কিসিমের। সবারই মন যুগিয়ে চলতে হয় তাঁকে। আর মন যুগিয়ে চলা মানে, প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদা বিহেভ করতে হয়, মানে অভিনয় করতে হয়। অবশ্য অভিনয়টা তাঁর জন্মজাত গুণ বা বৈশিষ্ট্য। নিতান্ত ছেলেবেলা থেকে তিনি জড়িয়ে আছেন অভিনয়ের সঙ্গে। বিভিন্ন নাটকের দলে তিনি যে আজ পর্যন্ত কত কত চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এখন যে নাটকের দলের তিনি সদস্য, সেই দলে তিনি শুধু অভিনয় করেন না, বরং নাটক পরিচালনাও করেন। আবার শুধু পরিচালনা নয়, নাটকের জন্য মঞ্চসজ্জা, আবহসঙ্গীত, পোশাক পরিকল্পনা, এমনকি শিল্পীদের জন্য মনোমত জলখাবারের ব্যবস্থা করা, সবকিছুই তিনি করেন। স্বেচ্ছায় সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। আসলে অভিনয় ও নাটকের প্রতি তাঁর তীব্র ভালোবাসা ও প্যাশন তাঁকে নেশাগ্রস্ত করে রেখেছে। কিন্তু ইদানীং মনে হচ্ছে, পেশা ও নেশার দরুন যে ট্রিমেন্ডাস ওয়ার্কলোড বা প্রচন্ড কাজের চাপ, আর ব্যালান্স করে চলা সম্ভব হচ্ছে না। বয়স বাড়ছে, শরীর দুর্বল হচ্ছে, নানা ধরনের উটকো সমস্যা ও ঝামেলাও প্রায়শই গজিয়ে উঠছে। যত দিন যাচ্ছে, পেশা ও নেশার চাপে তিনি ঘেঁটে ঘ হয়ে যাচ্ছেন। এবার যে কোনো একটা বোঝা কাঁধ থেকে না নামালেই নয়! হয় পেশা, নতুবা নেশা কোনো একটাকে বেমালুম বাদ দিতে হবে। কিন্তু কোনটা বাদ দেবেন! কীভাবেই বা দেবেন! পেশা ছাড়লে তাঁর জীবন ও সংসার ভোগে চলে যাবে। আর নেশা ছাড়লে তাঁর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
ধনঞ্জয়বাবু শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি তাঁর নাটকের দলের সব দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন, শুধুমাত্র অভিনয় করবেন। দলের অন্যান্য সদস্যরা হৈ হৈ করে উঠলেন… তাই কখনও হয় নাকি… আপনি না্টক পরিচালনা না করলে আমরা তো ঠুঁঠো জগন্নাথ হয়ে যাব… আপনিই তো আমাদের অভিনয় করতে শিখিয়েছেন… সংলাপ বলতে শিখিয়েছেন… মঞ্চসজ্জা ও সঙ্গীতের ব্যবহার শিখিয়েছেন…
ধনঞ্জয়বাবু হাসতে হাসতে বললেন, তোমরা যা বলছ, তা সবই ঠিক আছে। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখো, আমরা সবাই শুধু অভিনয় করি, বিভিন্ন চরিত্রে, নাটকে এবং সংসারে। নাটকের লিখিত চিত্রনাট্য ও সংলাপ থাকে, সংসারের কোনো লিখিত চিত্রনাট্য বা সংলাপ থাকে না। আমি যদি সত্যিই অপরিহার্য পরিচালক হয়ে থাকি, তাহলে আমি আমার সংসারটা ঠিকঠাক পরিচালনা করতে পারলাম না কেন! আমার একটা ছেলে চোর, আর একটা ছ্যাঁচোর, একটা মেয়ে ঠগবাজ, আর একটা জাঁহাবাজ… আর বউটা সেয়ানা পাগল…
খুন
.
খুনটা আদৌ ইচ্ছাকৃত নয়। খুনের জন্য বৈদ্যনাথকে কখনই দায়ী করা যায় না। বিশেষত বৈদ্যনাথ স্বভাবে এতটাই শান্ত ও লাজুক যে, খুনের মতো কোনো কাজ সে করতেই পারে না। সে সাহসও তার নেই। কিন্তু মজার ব্যাপার, খুনের ঘটনাটা তার উপস্থিতিতেই ঘটল। খুন হলো তারই বন্ধু শঙ্খর নিয়োগ করা এক সুপারিকিলার। অথচ খুনটা হবার পরও বৈদ্যনাথের মনে হয়নি যে, এইমাত্র একটা খুনের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি স্কুলের পেছনের যে মাঠে রাতের অন্ধকারে এই খুনের ঘটনাটা ঘটেছে, তার সাক্ষী থাকার দুর্ভাগ্যও কারও হয়নি। জায়গাটা নিতান্তই নির্জন এবং জনবসতিহীন।
ইদানীং বৈদ্যনাথের সঙ্গে শঙ্খর বিবাদ শুরু হয়েছিল মুক্তমালাকে কেন্দ্র করে। মুক্তমালা খেলুড়ে মেয়ে। তার দুই প্রেমপ্রত্যাশীকে নিয়ে ভালোই খেলছিল। অথচ বৈদ্যনাথ ও শঙ্খ দুজনেই নিতান্ত আনাড়ি। ঠিক বুঝে উঠতে পারত না, কার প্রতি মুক্তমালার পক্ষপাতিত্ব বেশি। তবে তাদের প্রেম নিবেদন ছিল আগমার্কা, এই ভেজালের জমানাতেও। কিন্তু যেহেতু শঙ্খর গ্রে ম্যাটার বৈদ্যনাথের তুলনায় কিছুটা ইনফিরিয়ার কোয়ালিটির ছিল, তাই সে ঠিক করল প্রেমের ময়দানে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকা বিপজ্জনক। আর তাই বৈদ্যনাথকে নিকেষ করতে পারলে সে বাজিটা মেরে দেবে।
মুক্তমালা তুখোড় খেলোয়াড় হলেও এই জটিল খেলাধুলোর ব্যাপারে আদৌ অবগত ছিল না। তার ধারণাতেও ছিল না যে, তাকে কেন্দ্র করে এমন একটা বিপজ্জনক খেলার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করা হচ্ছে। শঙ্খ জানত, নিজের হাতে বৈদ্যনাথকে সরিয়ে দেওয়ার হিম্মত তার নেই। সুতরাং সে যোগাযোগ করল স্থানীয় এক মাফিয়া গ্রুপের সৌজন্যে এক সুপারিকিলারের সঙ্গে। মোটা টাকার বিনিময়ে চুক্তি হলো। সুপারিকিলার বলল, এটা তার বাঁহাতের খেল। স্কুলের পেছনের মাঠে রাতের অন্ধকারে শঙ্খ বৈদ্যনাথকে ডেকে পাঠাবে মুক্তমালার ব্যাপারে একটা কংক্রিট সিদ্ধান্ত নেওয়ার অছিলায়। শঙ্খ সরাসরি জানাবে, সে আর মুক্তমালার সঙ্গে সম্পর্কে থাকবে না। মুক্তমালা এখন থেকে শুধু বৈদ্যনাথের। আর এই কথোপকথনের সুযোগে সুপারিকিলার ভোজালিটা ঢুকিয়ে দেবে বৈদ্যনাথের তলপেটে।
শঙ্খর ফোন এসেছিল যথাসময়ে। বৈদ্যনাথ অবাক হয়েছিল। জটিল সমস্যার এমন সরল সমাধান সে ভাবতেও পারেনি। তবে একটা সন্দেহও তার মনে উঁকি দিয়েছিল। এই কথাটা বলার জন্য রাতের অন্ধকারে স্কুলের পেছনের নির্জন মাঠে কেন শঙ্খ তাকে দেখা করতে বলল! সময়টা তো দিনের আলোতেও হতে পারত, আর জায়গাটা ক্লাবের লাইব্রেরিতে! তবু বৈদ্যনাথ গেছিল। শঙ্খ ছিল না। বরং একজন অচেনা লোক এগিয়ে এসেছিল। বৈদ্যনাথ কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটির হাতে চকমক করে উঠল একটা উদ্যত ভোজালি। লোকটা দৌড়ে এসে ভোজালি চালালো বৈদ্যনাথের তলপেট লক্ষ্য করে। বৈদ্যনাথ এক আশ্চর্য রিফ্লেক্সে বাঁদিকে সরে গেল, আর লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে। এবং বৈদ্যনাথ অবাক হয়ে দেখল লোকটার ডানহাত আচমকা ঘুরে যেতেই ভোজালিটা আমূল ঢুকে গেল লোকটির তলপেটে। নিতান্তই শান্ত ও লাজুক স্বভাবের বৈদ্যনাথ মৃত লোকটিকে মাঠে ফেলে রেখে ঘরে ফিরে গেল।
পরদিন বৈদ্যনাথ ফোন করল শঙ্খকে, সরি, আমি যেতে পারিনি গতকাল। আজ দেখা হবে?
.
চিরকুমার
পিতৃদত্ত নাম তার যাইহোক না কেন, যখন তার বয়স এই চোদ্দ-পনেরো, তখন সে নিজেই নিজের নাম রেখেছিল কিশোরকুমার। না, গান সে গাইত না, সঙ্গীতচর্চাও করত না, কিন্তু বয়সে যেহেতু ছিল কিশোর, হাফপ্যান্ট পড়ত, মা- বাবার কথা না শোনার জন্য প্রায়ই ঝাড় খেত, খেলার মাঠে ভুল পাস করার জন্য দাদাদের খিস্তি খেত, তাই সবদিক বিবেচনা করে কিশোরকুমার নামটাই তার পছন্দ হয়েছিল। তা সেই চোদ্দ-পনেরো বছরের জীবনে আচমকাই কোথা থেকে উড়ে এসেছিল প্রেম, যে জন্য আদৌ কোনো প্রস্তুতি ছিল না তার। সেই প্রেমের মুখোমুখি হয়ে একেবারে ল্যাজেগোবরে অবস্থা হয়েছিল। দোষটা আদৌ কিশোরকুমারের ছিল না, সে তখনও পর্যন্ত কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের কথা ভাবেনি, একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে তার হাতে প্রেমপত্র গুঁজে দিয়েছিল ললনা। সেই প্রেমপত্র পড়ে কিশোরকুমার ভেবে আকুল, সে এর উত্তরে কী লিখবে! ললনা যে এই বয়সে এতটা পেকে গেছে, তার ধারণাই ছিল না। তাছাড়া ললনা যে আবেগ ও স্বপ্নের ককটেল রীতিমতো সাহিত্যের সাধুভাষায় ব্যক্ত করেছে, তার ছিটেফোঁটাও যে কিশোরকুমারের আয়ত্বে নেই! সুতরাং সে ললনাকে মুখেই জানালো, এসব আমার দ্বারা হবে না, মা-বাবা টের পেলে আমার পিঠের চামড়া তুলে ডুগডুগি বাজাবে। অর্থাৎ কিশোরকুমারের জীবনের প্রথম প্রেম এভাবেই মাঠে মারা গেল।
কিশোরকুমার এরপর তার নাম পরিবর্তন করে রেখেছিল তরুণকুমার। কেননা তখন সে পরিপূর্ণ যুবক, গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকরি করছে, বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ আসা শুরু হয়েছে। কিন্তু তরুণকুমার ঠিক করেছে, যেসব মেয়ের এমনিই বিয়ে হয়ে যায়, তাদের কাউকে বিয়ে করবে না, বরং যেসব মেয়েদের বিয়ে হয় না, মানে পাত্র জোটে না, যারা অনাদৃতা বা নির্যাতিতা, সেইরকম কাউকে বিয়ে করবে। এখন সে বয়সে তরুণ, মা-বাবার কথা না শোনার জন্য ঝাড় খেতে হবে না। কিন্তু তরুণকুমারকে বিপদে ফেলে যে তরুণী হঠাৎ একদিন প্রেম নিবেদন করে বসল, সে তরুণকুমারের অফিসের বসের বউ কাঞ্চনা। তরুণকুমার প্রায়ই যেত বসের বাড়িতে। বৌদি কাঞ্চনার সঙ্গেও আড্ডা মারত। কিন্তু সেই সুন্দরী বৌদি যে তাকে ভালোবেসে ফেলতে পারে, তা তার কল্পনাতেও ছিল না। কৈশোরে সে বেকুবের মতো ললনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু এই ভরা যৌবনে তার পক্ষে অসম্ভব ছিল কাঞ্চনাকে প্রত্যাখ্যান করা। তরুণকুমার তাই ঝুলেই পড়ল। কাঞ্চনা তাকে বোঝালো, তার বর একটা জড়ভরত। তাকে সুখি করতে পারে না। সে অনাদৃতা ও নির্যাতিতা। তরুণকুমার তো এমনই বউ চায়। তাহলে চল, আমরা পালাই। কাঞ্চনার কথা শুনে তরুণকুমার হকচকিয়ে গেল। পালালে তো কেলেঙ্কারী হবে! হয়তো চাকরিটাও যাবে! তাহলে! না, তরুণকুমারের জীবনের এই প্রেমটাও কেঁচিয়ে গেল।
নামটা আবার বদলাতেই হলো। বয়স ও জীবনের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে এবার নাম হলো প্রবীণকুমার। না, প্রেমের আর কোনো স্কোপ নেই। কিন্তু এমনও তো হয়, প্রবীণ বয়সেও তো কারও কারও সঙ্গীনি জুটে যায়। হয়তো থাকবে না কোনো রোমান্স। তবুও একটা চান্স!
.
পদ্মিনী ও সন্ন্যাসী
করোনা যখন ছিল না, তখন বেপরোয়া ভাবে সারাটা দিন টইটই করে ঘুরে বেড়াত পদ্মিনী। অনেকটা ভবঘুরের মতোই। তবে যেহেতু একটা দায়সারা পেশায় যুক্ত ছিল, সংবাদপত্রের ফ্রিল্যান্সিং, তাই কখনও সখনও কিছু ফিচার লেখার প্রয়োজনে নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় যেতে হতো। এমনিতে থাকত একটা লেডিজ হস্টেলে। শুধুই থাকা, খাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত নেই। ফিচার লেখালেখি করে যেটুকু উপার্জন হতো, তাতেই নিজের থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য খরচ পুষিয়ে যেত। আসলে বাধ্যতামূলক একটা পেশাতে অনিয়মিতভাবে বাঁধা থাকলেও তার প্রবল নেশা ছিল ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়ানো। আর এই ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কতরকম যে উৎপাত তাকে সামলাতে হতো!
যেমন সেদিন সকাল থেকে ঘোরাঘুরির পর ক্লান্ত হয়ে দুপুরে আলুর টিকিয়া খেয়ে শুয়ে পড়েছিল গড়ের মাঠে। ঘুমে চোখটা টেনে এসেছিল। হঠাৎ মনে হলো, কে যেন ঠিক তার পাশেই শুয়ে আছে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠল পদ্মিনী। দেখল একটা গাঁট্টাগোঁট্টা লোক শুয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। পদ্মিনী বলল, কে আপনি? আমার পাশে শুয়ে আছেন কেন?
লোকটা চোখ খুলে বলল, আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন ঘুম ভাঙবে তোমার!
-মানে? আমার সঙ্গে আপনার কী দরকার?
লোকটা ক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, এ আবার কেমন কথা! তোমাকে কত দিতে হবে, তাই বল। বেশি দিতেও আমি রাজি আছি।
পদ্মিনীর বুঝতে অসুবিধে হলো না, লোকটা তাকে কী ভাবছে। সে খুব শান্ত স্বরেই বলল, সরি, আপনি যা ভাবছেন, তা আমি নই। আপনি বিরক্ত করলে আমি পুলিশকে ফোন করব।
কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে এসে একদিন আচমকাই দেখা হয়ে গেছিল কবি সম্বরণের সঙ্গে। পদ্মিনীকে দেখে পালাতে চেয়েছিল। পদ্মিনী পাকড়াও করল। সঙ্গে সম্বরণের বউ। পদ্মিনী প্রায় হামলে পড়ল, এটা তোমার কত নম্বর বউ?
সম্বরণের বউ বলল, মানে? আপনি কী বলছেন?
-বিয়ের পরেই জেনেছি, আমাকে বিয়ের আগে দুটো বিয়ে করেছিল। তুমি কত নম্বর?
আবার একদিন এই গড়ের মাঠেই আলাপ হয়েছিল এক সাধুবাবার সঙ্গে। সেদিন বিকেলবেলা পদ্মিনী একঠোঙা ভাজাবাদাম কিনে গড়ের মাঠে বসে খাচ্ছিল। এমন সময় এক সাধুবাবার আবির্ভাব। না বুড়ো নয়, চল্লিশের কোঠায় বয়স। পদ্মিনী অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, এত কম বয়সে সাধু হয়েছেন কেন?
হেসে সাধুবাবা বলেছিল, সাধু হবার কোনো বয়স থাকে নাকি?
পদ্মিনী বলেছিল, না তা নয়, এখন তো আপনার সংসার করার বয়স!
সাধুবাবা বলল, তোমার বয়স কত?
-পঁচিশ।
-বিয়ে করেছ?
-করেছিলাম। কিন্তু টেকেনি।
-হ্যাঁ, এটাই আসল কথা। তুমি যেমন বিয়ে করেও একা আছ, আমিও তেমনি বিয়ে সংসার সবকিছু করেও একাই আছি।
-সেকী! আপনার বউ কোথায়?
-পালিয়েছে। আসলে আমি মানুষটা ভালো ছিলাম না। জীবনটা খুব ভোগ করেছি। গাঁজা-মদের নেশা, মেয়েমানুষের নেশা। কিন্তু মন ভরল না। সবকিছু ছেড়ে সাধু হয়ে গেলাম। এখন আমার আর অন্য কোনো নেশা নেই, শুধু ঘুরে বেড়ানোর নেশা।
-তাই! আমারও তো সেই একই নেশা!
-বেশ! তাহলে তুমি আমার সঙ্গে চল!
.
তথাগত চট্টোপাধ্যায়
অপেক্ষা
প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে আসছিল অরূপ। লম্বা স্টেশন রোড যেখানে শেষ হয়েছে তার খুব কাছেই বাসস্ট্যান্ড। প্রায় দিন পনেরো পর আবার বাড়ি ফিরছে সে। অরূপ কর্মসূত্রে বহরমপুরে থাকে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মী। আগে প্রতি সপ্তাহেই বাড়ি ফিরত। ইদানিং সেটা দুই সপ্তাহের অন্তরে এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকের কাজের চাপ তো কম নয়!
মাসের চতূর্থ শনিবার ব্যাংক ছুটি। শুক্রবার রাতেই ব্যাগ মোটামুটি গুছিয়ে রেখেছিল অরূপ। ফলে সকালের ভাগীরথী এক্সপ্রেসে উঠে পড়তে তেমন অসুবিধা হয়নি।
স্টেশন রোডে এদিক ওদিক অল্প কিছু মানুষের জটলা। তাদের কথাবার্তায় মুখর হয়ে আছে জায়গাটা। প্রায় ঘন্টা পাঁচেকের লম্বা ট্রেনযাত্রায় অরূপ ক্লান্ত। ট্রেন ধরবার তাগিদে বেশ ভোরেই তাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছিল। অসম্পূর্ণ ঘুমের কারণে চোখেও লেগে আছে ক্লান্তির আবেশ। অরূপের মনে হল এখন এককাপ চা হলে বেশ ভালো হত।
কাছাকাছি কোনও চায়ের দোকান নেই। লম্বা রাস্তার দুই পাশে নানা ধরনের দোকান। জামাকাপড়, ষ্টেশনারী, জুয়েলারি, মোবাইল, নামী কোম্পানির ঘড়ির মস্ত শোরুম ইত্যাদি। ফুটপাথও রকমারি জিনিসে ঠাসা। বাসস্ট্যান্ডের অনেকটাই কাছে এগিয়ে গিয়েছিল অরূপ। কিন্তু চা-পানের প্রবল ইচ্ছেয় আবার পেছনে ফিরল সে।
স্টেশনের ডান দিকের রাস্তা ধরে একটু এগোলেই একটা চায়ের দোকান। অরূপ দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়।
লম্বা কাঠের বেঞ্চিতে বসে কড়া লিকার চায়ে চুমুক দিল সে। ডাউন লাইনে আবার ট্রেন আসার খবর হয়েছে। লেভেল ক্রসিঙে আটকে পড়েছে রিকশা, বাইক, অটো, ক্যাব।
ইস্পাতের পাতের উপর চেনা শব্দ তুলে চলে গেল গাড়ি। ছুটন্ত ট্রেনের দিকেই তাকিয়ে ছিল অরূপ। ট্রেনটা চলে যেতেই নড়াচড়া করে উঠল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা, বাইক, অটো, ক্যাব। আর ঠিক তখনই লেভেল ক্রসিঙের উল্টো দিকে একটা বাড়ির দিকে নজর পড়ল অরূপের।
বাড়িটা নানা ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। সে নিজেও বেশ কয়েকটি বিবাহ, অন্নপাশন, উপনয়নের অনুষ্ঠানে গিয়েছে সেখানে। আজ সেই বাড়ির সামনেই লোকজনের আনাগোনা, ফুল দিয়ে সাজানো সুদৃশ্য প্রবেশদ্বার। অরূপের মনে হল, নিশ্চয়ই কোনও বিয়ের অনুষ্ঠান।
চায়ের দাম মিটিয়ে লেভেল ক্রসিঙের কাছে এগিয়ে যায় অরূপ। এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাড়িটা। হ্যাঁ, বিয়েবাড়িই। মূল প্রবেশদ্বারে ফুল দিয়ে সাজানো অক্ষরে লেখা, ‘মধুমিতা ওয়েডস'...
চমকে ওঠে অরূপ। এ কি সেই মধুমিতা? নাকি অন্য কেউ? হতেও তো পারে সমনামী কেউ! মধুমিতা বসুরায়ই যে হবে তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই! আবার হতেও পারে। অরূপ চেনে মধুমিতার বাড়ি। এই অনুষ্ঠান বাড়ির খুব কাছেই। সিমেন্টে বাঁধানো রাস্তাটা ধরে এগিয়ে গেলে দু’মিনিট।
কিন্তু সেই কথাটা যে আজও বলা হয়ে উঠল না মধুমিতাকে! অরূপ মনে মনে ভাবে, এই বিয়েবাড়ির মধুমিতা যদি সমনামী অন্য কেউ হয় তাহলে সেই না বলা কথা নিশ্চয়ই বলা যাবে।
.
উপহার
বাঁদিকে টার্ন নেবার সময় স্কুটারের গতি সামান্য কমাতেই একটা সুগন্ধ নাকে এল তীর্থর। থামল সে। আশপাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ছোট বড় নানা মাপের গাড়ি। কাছেপিঠে কোনও ফুল গাছটাছ নেই। তবু সুগন্ধটা পেল সে। কোনও চেনা পারফিউম বা ধূপকাঠির গন্ধ না। তবে খুব পরিচিত মন ভালো করা এই সুবাস। হেলমেট খুলে কপালে আর ঘাড়ের পাশে জমে ওঠা ঘাম মুছতে মুছতেই হারিয়ে গেল গন্ধটা।
মধ্য চল্লিশের তীর্থ হাইস্কুলের শিক্ষক। এখনও অবিবাহিত। তার প্রচুর বান্ধবী আছে। খুব সহজ স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের। তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে অনেক সময়ই ভেসে আসা পারফিউমের গন্ধে মোহিত হয়েছে সে। কিন্তু একটু আগে পাওয়া সেই গন্ধ ঠিক তেমন নয়। খুব চেনা চেনা, অথচ মনে করতে পারছে না কিসের গন্ধ। নাকি মনের ভুল? হেলমেট চাপিয়ে আবার স্কুটার স্টার্ট দিল সে।
দোসরা আগস্ট রবিবার তীর্থর জন্মদিন। অর্থাৎ আগামীকাল। সহশিক্ষকদের অনেকেই ফেসবুকের বন্ধু। তাঁরা অবশ্য ক’দিন আগে থেকেই খবরটা জানতে পেরেছে। তাই স্কুলে পৌঁছে তীর্থ একদিন আগেই উষ্ণ সম্বর্ধনা পেল তার সহশিক্ষকদের তরফ থেকে। রবিবার স্কুল ছুটি। তাই এই অগ্রিম শুভেচ্ছার আয়োজন। উপহার হিসেবে পেল খুব সুন্দর একখানি কলম।
দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অনেক কলম উপহার পেয়েছে তীর্থ। তার মধ্যে অনেকগুলি এখনও অব্যবহৃত রয়ে গেছে। বুকশেলফের একটি তাক এমন অনেক নতুন, পুরনো কলমে সাজানো।
সন্ধ্যেবেলা স্কুল থেকে ফিরে জন্মদিনের প্রাপ্তিটা শেলফে রাখতে গিয়ে একটি পুরনো কলমের দিকে হঠাৎই চোখ পড়ে যায় তীর্থর। বহুকাল আগে কলেজে পড়ার সময় বাবার কাছ থেকে জন্মদিনে উপহার পেয়েছিল কলমখানি। বল পয়েন্টর সেই কলমের রিফিলে ছিল সুগন্ধি নীল কালি। লেখার সময় এক সুন্দর গন্ধ ভেসে আসত। অনেকদিন ব্যবহার করেছিল সে ঐ কলম। কিন্তু সেই রিফিল বাজার থেকে হারিয়ে গেল একদিন। অনেক খুঁজেও সুগন্ধি রিফিল আর পাওয়া যায়নি। সেই থেকেই অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে কলমখানি। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান। তীর্থর স্পষ্ট মনে পড়ল সকালে হঠাৎ ভেসে আসা সেই সুগন্ধ এই কলমের রিফিলের কালির! দু’যুগেরও বেশি সময় আগে বাবার কাছ থেকে পাওয়া জন্মদিনের উপহার। বাবা প্রয়াত হয়েছেন অনেকদিন আগে। তীর্থ ভাবল, কিন্তু তাই বা কি করে সম্ভব? ঘটনাটা ব্যাখ্যার অতীত এক অলীক প্রত্যক্ষণ ছাড়া আর কিছুই না! পুরনো কলমখানি অনেকদিন বাদে আবার স্পর্শ করল সে।
.
কোনও একদিন
দেবজিত নেমে এল বাস থেকে। অফিস যাবে না। অনেকদিন ধরেই সে ভেবেছে সপ্তাহের মাঝে একদিন কামাই করবে। তারপর সারাটাদিন শুধু তার নিজের। বাসে বসে থাকতে থাকতে এই স্বিদ্ধান্ত নিল – আজই হোক সেই প্রত্যাশিত দিন। নয়না মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে সকালে। আগামীকাল ফিরবে।
রবিবার তার অফিস থাকে না। কিন্তু সংসারের বিবিধ কাজও তো থাকে! সব মিলিয়ে সেই সত্যিকারের ছুটি সে পায় না। বাস থেকে নেমে সে হাঁটতে লাগাল দক্ষিণ দিকে। ওদিকে একটা খেলার মাঠ আছে। কিন্তু মাঠের সামনে গিয়ে সে চমকে যায়। ভারী গ্রিলের ব্যারিকেড বসেছে চারদিকে। গেটে ঝুলছে একটা মস্ত বড় তালা। আপাতত প্রবেশ নিষেধ।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদও চড়ছে। দেবজিত মনে মনে তার সেই পুরনো চেনা শহরটা খুঁজতে থাকে যা আধুনিক জীবনের গতির কাছে হেরে গিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কিছু সব্জিওয়ালা এখনও বসে আছে শেষ বেলার কিছু বিক্রির অপেক্ষায়। অবিক্রিত থেকে যাওয়া আলু, টমেটো, পেঁয়াজ, পটল, কাচালংকা এখন সস্তায় বিকোবে। আগে এদিকটায় ফাস্টফুডের রমরমা বাজার ছিল না। এখন এরকম অসংখ্য দোকান গজিয়ে উঠেছে অলিগলিতে। সব্জিগুলি হয়তো এখন ওইসব দোকানেই যাবে।
চক্কর মারল দেবজিত এদিকওদিক। শহরটা সত্যিই খুব দ্রুত পাল্টাচ্ছে। এরপর চলে গেল কাছের রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে। এখানে কত ধরনের মানুষ যে চোখে পড়ে! ম্যাগাজিনের স্টলে দু’একটা বই আর খবরের কাগজে চোখ বোলাল সে। হেডলাইন প্রায় সব কাগজেরই এক – প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দারিদ্র্য দূরীকরণে তার সরকার আগামী দিনে যুগান্তকারী সাফল্যের মুখ দেখবে।
প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসেই টিফিন খেল দেবজিত। এরই মাঝে কখন যেন দুটো বাচ্চা মেয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গানবাজনা শুরু করে দিয়েছে। ভোজপুরী ভাষায় অপরিণত কণ্ঠের গান। গান শেষে হাত পাতল তার কাছে। দেবজিত দেখল তার নিজের মেয়ের বয়সীই হবে এই বাচ্চাটা।
সে বলল – দাঁড়া। হাতটা ধুয়ে আসি।
পকেটে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ছিল। টাকাটা পেয়ে মেয়েটি অবাক। খুচরো পয়সা আর হাসি মস্করার বাইরে নোটটা ওর কাছে আশাতীত!
দেবজিত বলল – যা, পালা এবার।
হাসিমুখ নিয়ে ওরা ছুটে গেল সামনে। জোরালো হর্ন বাজিয়ে ট্রেন এল প্ল্যাটফর্মে। দেবজিত উঠে পড়ল ট্রেনে। রোদের তাপ আরও অসহ্য হয়ে উঠছে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে।
ঘরে ফিরতে ফিরতে বেলা গড়াল অনেকটাই। বাড়ি নিস্তব্ধ। অনেক সাংসারিক জিনিস ডাইনিং হলে এলোমেলো ছড়ানো। নয়না একদমই গুছিয়ে রাখতে জানে না। এজন্য দেবজিতের সাথে লেগেও যায় তার কখনসখনও। কিন্তু দেবজিতের মনে হল – হ্যাঁ, এটাই তো চলমান সংসার। এলোমেলো জামাকাপড়, মেয়ে অনন্যার বইখাতা যেন সেই প্রবহমান সংসারেরই প্রতীক। ওদের অনুপস্থিতিতে ডাইনিং হলটার আয়তন বেশি বলে মনে হল দেবজিতের। সব গুছিয়ে রাখলে যদি হলটা আরও বেশি বড় বলে মনে হয় তাই সে একটু থমকে গেল। ভাবল – ক্ষতি কি? যেখানে যেমন আছে সেখানে তেমনটাই থাক না!
.
বই
প্ল্যাটফর্মের পুরনো বইয়ের দোকানে অনেকদিন বাদে এল সন্দীপ। দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে একটা চায়ের দোকানের পাশেই। ট্রেন আসতে এখনও অনেক দেরী। আগের ট্রেন অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়েছে তার। পরের গাড়ি আসার আগে এখনও মিনিট দশেকের মত সময় হাতে আছে। দুপুরবেলা দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে চড়া রোদ এসে পড়ে। ছাতা ছাড়া দাঁড়ানোই যায় না। মাথার ওপর শেড নেই যে! কিন্তু এখন বিকেলের মরা রোদের তেজ নেই তেমন। সন্দীপ স্বচ্ছন্দে দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল।
দোকান জুড়ে পুরনো বইয়ের জগৎ। সন্দীপ বই ঘাঁটতে থাকে। কাঠের তাকে হরেক কিসিমের ম্যাগাজিন এবং বাংলা ইংরেজি বইয়ের সম্ভার। একটা একটা করে বই দেখতে দেখতে সন্দীপের চোখ আটকে যায় একটি বইয়ের দিকে। কোথায় যেন দেখেছিল সে এই বইটা? সামনে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে সন্দীপ টেনে আনে বইটা – ‘দিগন্তের আলো’। লেখক অনিমেষ মজুমদার।
বইয়ের প্রচ্ছদ বেশ ধূসর। মলাটের পাতলা বোর্ডের কোণাগুলিও সামান্য ছেঁড়া।
প্রথম পাতা ওলটানোর পরই চমকে গেল সন্দীপ। নীল কালিতে কৌণিক অবস্থানে লেখা দু’লাইন।
“প্রিয় সন্দীপ,
প্রিয় ভালোবাসা”।
দেবলীনা।
২৮/০১/২০১৪
সন্দীপ চকিতে ফিরে যায় সাতবছর আগে। বইমেলায় সেদিন দেবলীনাকে পাশে নিয়ে সে খুব ঘুরছিল। দেবলীনা বলেছিল, আমি কিন্তু সব স্টলে ঢুকব সন্দীপ। তোমাকেও যেতে হবে।
সন্দীপ বলেছিল, যাঃ, তাই কি হয়? এত স্টল, এত মানুষের ভিড়! হাতে অত সময়ই বা কোথায়? একদিনে হবে না।
কথা বলতে বলতে ওরা পৌঁছে গেছিল লিটিল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে। কবি অনিমেষ মজুমদার সেদিন তাঁর কবিতা সংকলন ‘দিগন্তের আলো’ প্রকাশ করছেন। লিটিল ম্যাগাজিনে লেখা কবি। ক’জনই বা চেনেন। তবুও অনুষ্ঠানের সামনে একটা ছোট জমায়েত। অল্প কিছু কবিতা অনুরাগীদের ভিড়। দেবলীনা সন্দীপের হাত ধরে প্রায় জোর করেই ঢুকে পড়েছিল সেই বৃত্তে।
সন্দীপ কবিতা পড়ে না। অনেকের মত তারও দুর্বোধ্য মনে হয় আধুনিক কবিতার ভাষা। বরং গল্পের দিকেই তার টান বেশী।
দেবলীনা জানত সে কথা। কিন্তু সদ্য প্রকাশিত ‘দিগন্তের আলো’ বইটি হঠাৎই কিনে উপহার দিয়েছিল সন্দীপকে। খস্ খস্ করে দু’কলম লিখেও দিয়েছিল সে।
-নেবেন বাবু বইটা? হাফ্ দামে দিয়ে দেব।
স্তম্ভিত সন্দীপের সংবিৎ ফেরে। কিন্তু কিছুই বলে না। দোকানীর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আবার বইয়ের পাতা ওলটাতে থাকে। কমদামী কাগজে ছাপা। কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে পাতাগুলো।
যেমন বিবর্ণ হয়ে গেছিল দেবলীনার সঙ্গে তার সম্পর্ক। অথচ সন্দীপ কিন্তু কোনও ত্রুটি রাখেনি সম্পর্ক মেরামতের।
সম্পর্ক ছিঁড়ে যাওয়ার পর প্রাক্তন প্রেমিকার কোনও স্মৃতিই আর বাড়িতে রাখেনি সন্দীপ। ‘দিগন্তের আলো’ বইটিও পুরনো খবরের কাগজের সঙ্গে বিক্রি করে দিয়েছিল একদিন।
প্ল্যাটফর্মে গমগমে গলায় ঘোষণা হচ্ছিল গাড়ি আসার খবর। তৎপর হয় সন্দীপ। এবার গাড়ি মিস্ করলে বাড়ি পৌঁছতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। দোকানের লোকটি আবার বলল, নিয়ে নিন বাবু বইটা। কুড়ি টাকায় দিয়ে দেব।
.
সন্ধান
ইচ্ছে করেই অনেকটা পিছিয়ে পড়ল শৌনক। অনেকক্ষণ ধরেই হাঁটার গতি সে কমিয়ে আনছিল। স্ত্রী অনসূয়া মেয়ে কাকলীর হাত ধরে ফুটপাথ ধরে এগোচ্ছিল। শৌনক ছিল সামান্য পেছনে।
লম্বা রাস্তার দু’পাশে গাছগাছালি অনেক। রাস্তায় পথচারী তেমন নেই তবে মাঝেমাঝেই দুরন্ত গতি নিয়ে ছুটে যাচ্ছে ছোটো, বড় নানা আকারের গাড়ি। কাকলীই বলেছিল, চল না বাবা বাসস্ট্যান্ড অবধি হেঁটেই চলে যাই। একটুখানি তো পথ, সবাই মিলে কথা বলতে বলতে...
এ রাস্তায় শৌনকের যাতায়াত খুব ঘন ঘন। তবে সেটা গণপরিবহনে। হেঁটে হেঁটে নয়। আজ হাঁটতে হাঁটতে প্রায় দু’যুগ আগের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল তার। নয়ের দশকের মাঝামাঝি একদিন কলেজ থেকে পালিয়ে অনসূয়াকে পাশে নিয়ে অনেকটা পথ সে হেঁটেছিল এই রাস্তা ধরে। সেই সময়ের পরিবেশ আজ ঠিক কতখানি বদলে গেছে, হাঁটতে হাঁটতে শৌনক সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এতদিন আগেকার ছবি কি আর মনে ধরে রাখা যায়? নাকি তা সম্ভব? অনসূয়ার হাত ধরে পাশাপাশি চলতে চলতে কত কীই যে সেদিন সে বলেছিল, তাও আজ মনে পড়ে না। সমস্ত স্মৃতির ওপর যেন কুয়াশার এক ধূসর আবরণ। শৌনক কিছুতেই তা ভেদ করতে পারছে না।
-বাবা, এত পিছিয়ে পড়লে কেন? তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এস।
কাকলীর সুরেলা মিহি আওয়াজ অনেকদূর থেকে শৌনকের কানে আসে। শৌনক চেঁচিয়ে জবাব দেয়, আসছি রে আসছি। হঠাৎই তার চোখে পড়ে একটি ছোট্ট দোকান। জায়গাটাও যেন চেনা চেনা। সামনের মোড় থেকে বাস ধরার আগে সেদিন সে আর অনসূয়া এখানেই বোধহয় চা আর কেক খেয়েছিল। আজ অবশ্য সেই চায়ের দোকানটি আর নেই। এখন এখানে একটি গিফট আইটেমের দোকান।
কী ভেবে শৌনক ঢুকে পড়ে দোকানে। অনসূয়ার সাথে তার দাম্পত্য জীবন প্রায় দু’দশকের। বছর ঘুরলেই আরও একটি বছর পুরনো হয়ে যাবে তারা। শৌনক ভারী আশ্চর্য হয়ে যায় এই ভেবে যে বিবাহবার্ষিকীতে অনসূয়াকে তো অনেকদিন কোনও উপহার দেওয়া হয় না! বিয়ের পর পর তো বটেই তারপরও অনেক বছর বিয়ের দিনে দামী দামী উপহার হাতে নিয়ে শৌনক অফিস থেকে ফিরেছে। কিন্তু সেসবও অনেকদিন আগেকার কথা।
দোকানে ঢুকে এদিক ওদিক কী যেন খুঁজতে থাকে শৌনক। আগামী বিবাহবার্ষিকীতে অনসূয়াকে সে নতুন কিছু উপহার দিতে চায়, যা আগে কখনই সে দেয়নি!
.
দেবযানী বসু
কুমারসম্ভব
নীরবের কাজ সব কম্পিউটারে। আর অফিসিয়াল ভিডিও কনফারেন্স করবে নিয়মিত। বিয়ে হয়েছে তিনবছর। ঘর সাজাতে আর বেড়াতে দিন কেটে যাচ্ছে। আরো একটা ব্যাপার আছে। ওদের ভিতর যৌনতা নেই। অথচ খুব ভালো বন্ধু। পাশাপাশি বসে ছবি টবি তোলে। পর্নো দেখে, সিনেমা দেখে। কিন্তু একেবারেই আবেদনহীন। এরপর বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি সামলানোর ব্যাপার আছে। বিয়ের আগের যে বিশেষ কোনো প্রেমঘটিত ধাক্কার গল্প আছে তাও না। দুজনেই মেধাবী পড়ুয়া ছিল। দুজনেই চাকরি করছে। ছিমছাম মসৃণ সবকিছু। শুধু শরীরটা ক্লিক করে না। অন্য কোন নারী বা পুরুষের প্রতিও আকর্ষণ বোধ করে না। ডাক্তারের কথামতো নানা কসরৎ করে অবশ্য। কাজের কাজ কিছু হয় না। মানে এতদিন হয়নি।
এবারো মার্চ মাসে উত্তর ভারত বেড়াতে যাবার সব ঠিকঠাক। কিন্তু করোনার কারণে হয়নি। একে অন্যের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখুন -- এই বিজ্ঞপ্তিতে পৃথিবীর আকাশ মাটি জল ছেয়ে গেছে। দুজনেই ভাবছে ওরা কি অসমাপ্ত থেকে যাবে? ঋতি একদিন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেই দিল একে অন্যকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। ঋতির কান্না দেখে নীরব অবাক। ঋতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে যেভাবে আগে কখনো ধরেনি। নীরবের মনে হল ঘরের পর্দাগুলো খুব হাততালি দিচ্ছে। সোনামনি কাঁদে না দাঁড়াও তোমার জন্য চকোলেট নিয়ে আসি ফ্রিজ থেকে! ঘরবন্দীর কারণে এখন প্রচুর সঞ্চয়। প্রয়োজনাতিরিক্ত সময় ধরে একে অন্যের ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে চকোলেট খেল। আর সারাদিন পোষাক ফেলে দিয়ে হনুমানের মতো চলাফেরা করতে লাগল। সোফা খাট ডিভান চেয়ার ঘরের মেঝে রান্নাঘরের সিমেন্টের বেদি বাথরুমের শাওয়ার সবকিছু কামাধিকরণের কাজে লাগছে। কাজের লোকেরা এসে বিরক্ত করবে না। কী একটা গুপ্তধন খোঁজার মত করে নীরব ঋতির শরীরে তন্ন তন্ন করে পঞ্চেন্দ্রিয়কে কাজে লাগাচ্ছে। ঋতিই মনে করিয়ে দিল আলমারিতে তুলে রাখা চিভাসরেগালের কথা। প্রচুর ঢালাঢালি ঢলাঢলি করে মদিরা পান করতে লাগল। আর বাচ্চাদের মতোই আঙুলের সাহায্যে নানা মুদ্রা তৈরি করে একে অন্যকে দেখাচ্ছে হাসছে। আজ কম্পিউটার চালু করতেই ভুলে গেছে নীরব। নীরব দেখল ওর হাতের তালু পায়ের তালু ঘামছে। হঠাৎ মনে হল গ্ৰামের বাড়িতে গরুদের সঙ্গমের দৃশ্য। এবং ঋতিকে কোলে বসিয়ে হনুমান শিম্পাঞ্জি বাঁদর কচ্ছপ জিরাফ সিংহ বাঘ বিড়াল ইত্যাদির সঙ্গম প্রক্রিয়া দেখে যেতে লাগল একের পর এক। উলঙ্গ অবস্থায় খাওয়া দাওয়া ভুলে জড়াজড়ি করে থাকল। ঋতি যেন ওর জমিয়ে রাখা সমস্ত প্যাস্টেল কালার গলিয়ে একটা শক্ত মোটা কিছু তৈরি করতে চাইছে। শেষে নীরবও হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। সেদিন সারাদিন রোজা সিনেমার গান আর জবাফুলের পুংকেশরটিতে প্রাণ সঞ্চারের খেলা। মানুষ মরে যাচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে! সময় কম! দ্রুত অমৃত তৈরি করে নিতে হবে।
.
কোমর্বিডিটি
রোশনি রাস্তায় বেরোয় বটে তবে কোথাকার বাস কোথায় যায় সে সব কিছু জানে না। জানলেও মনে রাখতে পারে না। বেরোতেই হয়। মনে যে রাখতে পারে না সেটা স্বীকারও করে না। সেদিন মামার বাড়ির নোনা চন্দনপুকুর বাজারে নিজের ছোট ছেলেটিকে একটা জলসার জমায়েতে বসিয়ে দিয়ে চলে এল বাড়ি। ভাবল থাক ওখানে বসে কাজ শেষ হলে ঘরে নিয়ে আসবে। এ পাশে কাজ সাগরের ঢেউয়ের মতো ফুলে ফুলে উঠল। প্রচুর বিরিয়ানি রাঁধতে হল অতিথিদের জন্য। অতিথিরা অচেনা ও অভিজাত। রোশনির খুব লজ্জা লজ্জা করতে লাগলো। সবাই অবশ্য খেতে বসে গাজর খেতে চাইল। সেদিন অল্পই গাজর ছিল ফ্রিজে। অতএব মূলো দিয়ে কাজ সারতে হল।
মামার বাড়ির জমি ভাগাভাগি করে পাঁচিল উঠে গেছে। এই জমির একাংশ বিক্রি করা হল ছোটমাসির বিয়ের পণ দেবার জন্য। একদিকে আছে ডোবা। রোশনি ছিপ হাতে ডোবার ধারে চলে গেল। কী জলভরা ডোবা! তালশাঁসের জলের সঙ্গে মিলে যায়। দাদুও ছিপ নিয়ে বসে পড়ল ওর পাশে। পুঁটি ফেলে ল্যাটা টপাটপ কেঁচোমিশ্রিত ভাত খেতে লাগল। আচমকা ডোবা থেকে উঠে এলেন চিকিৎসকের ধড়াচূড়ো পরা উকিল হাতে একগুচ্ছ কাগজ। রোশনি এভাবেই খালি সুতো রিলেতে গুটিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে ছেলেকে দেয় খেলতে। ছেলে? তাকে তো বাজারের জলসায় বসিয়ে রেখে এসেছে। যারা ইঁট পেতে দেখছিল তারা ভোঁভা। সে ছোটাছুটি করে নাম ধরে তীব্র চিৎকার করতে লাগল। ছেলেকে পেল না।
দেয়াল থেকে কাচের ছবিটা ভেঙে পড়ল ঝনঝন শব্দে। প্রচুর কোমর্বিডিটি ছিল নাকি ছবিটার? একটি ত্রিশ বছরের যুবক ডোবাটির দিকে হেঁটে চলেছে ধীরে। পরনে শর্টস। মাথার চুল সব ঝরে পড়ছে ধীরে ধীরে। সারা গায়ে কালির ছোপ ফুটে উঠছে। রোশনি অনুভব করছে মুখগহ্বর থেকে ওর দাঁত বেরিয়ে ঝরে পড়া। ক্রমশ শীর্ণ পিঠের পাঁজর ফুটে উঠছে। অযত্নলালিত দাঁড়ির জঙ্গলের আভাস গালের পিছন থেকেও বোঝা যাচ্ছে। ও: হাত ও পায়ের নখ কী বড় বড় হয়ে গেল! হঠাৎ চামড়া ফেটে জলরস বেরিয়ে আসছে। এরপর... ঝাপসা হয়ে যায় রোশনির চোখ।
.
ঝুঁকি নিয়ে বলছি
ঐন্দ্রিলাদের কাছে পুজোটা স্রেফ আনন্দের ব্যাপার। বিজয়া দশমীর দিনে সিঁদুর মাখা মুখগুলো হয়ে যায় লালমুখো বিদেশিদের মতো। আর মাটির দেবদেবীর ঠোঁটে ধ্যাবড়া করে মিষ্টি লেপ্টে দেওয়া দারুন মজার খেলা। গতবার ফ্ল্যাটের মহিলারা পুরুষদেরও সিঁদুরে রাঙিয়ে দিয়েছিল। ঐন্দ্রিলা ওর খুড়তুতো বোন বর্ণিতাদের ফ্ল্যাটে যায় কিন্তু পারতপক্ষে ওদের বাথরুমে যায় না। ওদের বাড়িতে আত্মীয় বন্ধুবান্ধব তারাই যায় তাদেরও একমত। ঐ বাথরুম ব্যবহার করা যায় না। ক্রমশ কোনো গেটটুগেদারে ঐন্দ্রিলাদের আড়ালে এই নিয়ে হাসাহাসিও হয়ে গেল।
ঐন্দ্রিলার দাদা মিষ্টুন বেশ ঘুরে ঘুরে বেড়ায় সম্ভ্রান্ত মানুষদের বাড়িতে কাজের সূত্রে। থ্রি ফাইভ সেভেন স্টার হোটেলের বাথরুমকেও হার মানায় এক একজন মানিওয়ালা লোকের বাড়ি। পুরোপুরি স্বর্গের বাথরুম। স্বর্গে লোকে অত ভালো ভালো জিনিস খায় আর পটি করে না কী? তাদের বাড়িতে কাজের লোক, পোষা কুকুর, গৃহকর্ত্রীর সব আলাদা আলাদা এমন কী শিশুদের ব্যবহারযোগ্য বাথরুমও আছে। ছাদের ওপরে হাঁটাপথ আছে আবার সেখানেও বাথরুম আছে। মিষ্টুন দেখেছে বাথরুমে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি টাঙানো আছে। আন্তঃগৃহ গাছপালার টব বসানো আছে। একজনদের বাথরুমে এত রকমের নল আর যন্ত্রপাতি যে পুরো বাথরুমটা অক্টোপাসের মতো দেখতে লাগে। নিউজপেপার রাখার জায়গা আছে, তোয়ালে তো কোন ছার! সেইসব মারবেলের মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করবে।
বর্ণিতাদের ব্যাপারটা ঠিক কী বোঝা যায় না। কাকু সরকারি চাকরি করেন ভালো মাইনের। তিন সদস্যের পরিবার। খুবই অতিথিবৎসল। কাকিমা তো লোক খাওয়াতে ওস্তাদ। ওদিকে বাথরুমের কমোডে এত চিত্র বিচিত্রময় ময়লা যে মাছি পর্যন্ত বসতে ভয় পায়। ঐন্দ্রিলা আর মিষ্টুন অনেকবার ভেবেছে জমাদার হাতের কাছে থাকতেও এরকম দুরবস্থা কেন। আসলে ছোটবেলায় এসব নজরে পড়েনি। বর্ণিতা ওভাবেই অভ্যস্ত, বড় হয়েছে। কেউ সাহস করে বর্ণিতাদের বলতে পারেনি। মিষ্টুন কতবার ভেবেছে অনলাইন অর্ডার করে লোক পাঠিয়ে দেবে পরিষ্কার করার জন্য। তারপর কী হাঙ্গামা হবে ভেবে চুপ করে গেছে। কারণ কাকিমা কেমন যেন রূঢ়ভাষিনী, অন্যান্য অনেক ভালো গুণের সঙ্গে যা কাটাকাটি করে যায়।
এবার দুর্গাপুজোর আগে বর্ণিতার বাবা মিষ্টুনকে বরাবরের মতো প্যান্ট ও শার্টপিস দিয়েছে। ঐন্দ্রিলা দাদার টেবিলে প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিতে মিষ্টুন লাফ দিয়ে উঠল। তারপর কাউকে কিছু না বলেই সোজা বর্ণিতাদের ফ্ল্যাটে ছুটল। কাকু দরজা খুলতেই প্যাকেটটা কাকুর হাতে ধরিয়ে বলল: এই গিফ্ট আমি নেব না যতক্ষণ না তুমি তোমার বাথরুম পরিষ্কার করাবে। তোমাকে টাকা দিয়ে অপমান করতে চাই না।' কাকু ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ থাকার ভঙ্গি করলেন। বললেন যা, তা শুনে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল মিষ্টুনের। মিষ্টুন বেরিয়ে আসার আগে বলল: ‘এতদিন চেপে রেখে ভালো করোনি কাকু! আমি চিকিৎসা করাব কাকিমার, সমস্ত রকম ঝুঁকি নিয়ে বলছি।'
অতএব তুই মিসলেনিয়াস
গোরে মুহ সো মোরে মন ভাওয়ে -- আমার চন্দ্রাকে চিনিস তুই? এত নারী এল গেল কিন্তু চন্দ্রাকে ভুলতে পারি না। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে বেদনা জিইয়ে রাখতে ভালোবাসে মানুষ। মাঝে মাঝে সেই বেদনার স্থান ঝাঁপি খুলে দেখতে কত যে সুখ! এই যে তুই আমার এখনকার প্রেমিকা সচিব সখা, তোকে সব বলা যায়। তোকে সব জানিয়ে যত সুখ, এরকম আর কোথাও পাইনি। মাঝে মাঝে মনে হয় তুই আকাশ আর মহাকাশের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছিস। আমার অহমিকার ঘরে কিতকিত খেলছিস। সব ঘর কিনে নিচ্ছিস।
চন্দ্রা মানে ষোল সতেরো আঠারোর দিনগুলো। নকশাল আমল। কিছু লিফলেট জমে ঘরে। চন্দ্রার হারিয়ে যাওয়া প্রমাণ করে না যে সে মারা গেছে। খেলার মাঠ ধানক্ষেত পোড়ো মসজিদ লক্ষ্মীকান্তদের ফলের বাগান আর রামদাস বাবাজির মঠ ঘিরে প্রেমপর্ব। ঐখানে দেশি সবেদাগাছ থেকে আমি ফল পেড়ে চন্দ্রাকে দিতাম। শুধু চুম্বন আর জড়িয়ে ধরা ছাড়া আর এগোতে পারিনি -- যেখানে হল না খেলা, সে খেলাঘরে আজি নিশিদিন মন কেমন কেমন করে। জানতাম ভালো শরীর শরীর খেলতে পারি আর সময়মতো চক্রব্যূহ ভেদ করে পালাতে পারি। আর একটা মানুষ সত্তরে পৌঁছতে পৌঁছতে, অনেক গোল দিতে দিতে, নারীকে নীরা করতে করতে প্রথম ধাপটা সিঁড়ির ভুলেই যায়। আদরী মনে হয় তুইই আমার শেষ প্রেমিকা। হৃদয়ের জোর কমে যাচ্ছে মানে মস্তিষ্কের জোর কমে যাচ্ছে। সেভাবে টানাপড়েন আর খেলতে পারি না। তোর সঙ্গে হিসেব নিকেশ চুকিয়ে দেব শীঘ্র। তোকে নিয়ে আমার স্বপ্নটা শুরু হয়।
সেলিমপুরের এই বাড়িটা আমার ব্যক্তিগত বাড়ি। আর মুকুন্দপুরের বাড়িটা শরীকি বাড়ি। এ ছাড়া পুরুলিয়ায় বাগানবাড়ি। রাসমঞ্চের দোলায় কত দোল দোল দুলুনীরা এল আর গেল। বসুন্ধরা বীরভোগ্যা না হলে চলবে কেন? নারী বাড়ি গাড়ি সুরা সম্রাট সব মিলিয়ে একাকার। বৌকেও সব দিই রে। ইদানিং বৌ খুব ঠাকুর ধর্ম করে বলে আস্তে আস্তে সরিয়ে দিয়েছে আমাকে। ফুলশয্যা নিয়ে ভাবালুতা ছিল বিয়ের সময়ে, তা সে যত গন্ডা আপাদমস্তক ঘনিষ্ঠতা করার পর ফুটিয়ে দিই না কেন। ফুলশয্যা মানে 'তু অব সে পহলে সিতারোমেঁ বস রহি থী। তুঝে জমিনপে বুলায়া গয়া হ্যায় মেরে লিয়ে।' সত্যি বলতে কী চন্দ্রাকে আমি বলেছিলাম তুই আমার আমানত।
শোন্ চন্দ্রা ও আমি একসাথে স্কুলে পড়তাম। একই কোচিংয়ে পড়তাম। আদরী তোকে আমার কামসূত্র মুভিটার রেখার মতো মনে হয়। স্বপ্নে তোকে পেতে গিয়ে দেখি চন্দ্রা হাজির। তোকে জানি। কিন্তু চন্দ্রার শরীর তো অচেনা। খুব মুস্কিল। সেই অতীতের ফুলশয্যার ঘরে চন্দ্রা স্কুলের ইউনিফর্ম পরা কিশোরী হাসছে। আমার টোপর। ওর স্কুল শু। আমার ধুতি পাঞ্জাবি। ওর হাতে বইপত্র। ক্রমশ ফুলশয্যা ঘরের দরজা জানলা দেয়াল মিলিয়ে যাচ্ছে। এল স্কুলের বেঞ্চ টেবিল। শোব কোথায়!
চন্দ্রাকে তুই চিনিস আদরী? তুইও তো ঐ একই স্কুলের ছাত্রী ছিলিস!
.
হে মহাজীবন
আতিথেয়তায় পরম মুগ্ধ ও পরিতৃপ্ত জনা পাঁচেক আমরা। আমি ব্যাঙ্কার। রুমা সেক্রেটারি। সুরঞ্জনা ম্যানেজিং ডিরেক্টার। মানে এভাবে দাবার ছক সাজানো থাকলেও আমরা পরস্পর মিলেমিশে কাজ করি। এবারের অভিযান ছিল চিরহরিৎ দেশের মালভূমি এলাকায়। রাজা জনকের মতো ঋষিতুল্য এক ব্যক্তি যিনি পূর্বপুরুষের জমিদারি সম্পত্তি নয়ছয় হয়ে যেতে দেননি। বিশাল এলাকা জুড়ে নামিদামি গাছগাছালি লাগিয়ে ও পশুপাখি পালন করে সুবিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। আমার নামের সঙ্গে তার মিলও আছে। আমি অমলকান্তি। উনি নিজেকে পরিচয় দেন বৃক্ষমিত্র অমলকান্তি বলে।
যাতায়াত নিয়ে সাড়ে চারদিন কোথা থেকে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। আমি বোটানির ছাত্র। একটুও ক্লান্তি লাগেনি ওনার চাষবাস দেখতে। এক একটা বৃক্ষ দেখান আর আদিগন্ত বৈজ্ঞানিক নাম সহ সব বলে যান। একেকটা ক্ষেত দেখান আর সেই ফসলের চাষ পদ্ধতি সব বলে যান। ওহ্ বাঁধাকপির কী সাইজ! তার সঙ্গে মিশিয়ে দেন সংস্কৃত শ্লোক। বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক গুরুদের প্রতি ওনার শ্রদ্ধা দেখবার মতো।
এই নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সেও তিনি শালপ্রাংশু ঋজু শরীর নিয়ে শ্বেত শ্মশ্রুগুম্ফমন্ডিত মুখ ও সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরনে দ্রুত চলাফেরা করছেন।
ওনার ট্যুরিস্ট লজে থাকা খাওয়া ছাড়া কিছু অনুদান দিতে হয়েছিল। আমাদের ক্যামেরাম্যান গোস্বামীদা প্রবল দমে ছবি তুলেই যাচ্ছেন আমাদের ও গাছের ফসলের। শেষে এলাম গ্ৰন্থাগার ও কম্পিউটার ভবনে। অনেক কম্পিউটার আর দেশি বিদেশি বইয়ে ভরা অনেক আলমারি। বইগুলি সভ্যতার ইতিহাসের, জীববিজ্ঞানের, প্রকৃতি বিজ্ঞানের। সাহিত্যের বইও আছে। কয়েকজন ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা বসে কাজ করছে।
সার তৈরির ভাঁটিটাও ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
দেখে মনে হল অবিবাহিত উনি। সারাজীবন এরকম তপস্যা করেছেন। কলকাতায় ফিরে এসে বান্ধবী জয়াকে সব গল্প করেছি। আমার বৌ প্রমীলা ওকে আবার সন্দেহ করে। জয়া আবার একটু আধটু লেখে টেখে। জয়া একেবারে আকাশ থেকে পড়ল -- ওমা তোরা ওখানে গিয়েছিলি! কী কান্ড জানিস না, ওনার দুটো বিয়ে। প্রথমজন ওনাকে ছেড়ে দিয়ে টরেন্টো চলে গেছেন। সোমাশ্রীদিকে দেখিসনি? ওই তো দ্বিতীয় বৌ। অমলদার থেকে কুড়ি বছরের ছোট।'
আমার মনে পড়ল কম্পিউটার রুমে বয়স্কা ভদ্রমহিলাই তাহলে এই বিরাট কর্মবীরের সাধনসঙ্গিনী!
.
শতাব্দী দাশ
বৈতরণী
গাড়ুখানা রেখে ধুতি তোলে দীনদয়াল। বসে পড়ে ঝোপের আড়ালে। কানের উপর পৈতেটা তোলে। গমক্ষেতের হুই পারে একটা মাথা উঠল। সারা হল তার। ও ছগন, নিচুজাত। মাঠের মজদুরি ফেলে গিয়েছিল শহরে। লকডাউনে ফিরেছে। দুদিনের ঝকমকি ঘুচে গেছে। বাঁহাতে গাড়ু, ডান হাতে দাঁতন, ছগন ঘাটের দিকে এগুচ্ছে। আগের দিনকাল হলে, অর্ধ উলঙ্গ বামুনকেও পেন্নাম ঠুকত। সেসব দিন গ্যাছে। দীনদয়ালের মুখ দিয়ে যে শব্দটি বেরোয়, তা উদরে চাপ দেওয়ার কৌশলজনিত, নাকি হতাশাজনিত, বোঝা দায়।
গমক্ষেতের সোনালিতে ঈষৎ লাল আভা। নদীতেও সিঁদুরের ছিটে। মেয়েদের প্রাতঃকৃত্যের জায়গা আলাদা। শুদ্ধাচারী লছমি এতক্ষণে ফিরেছে ঘরে। কাপড় ছেড়ে উনুন ধরিয়েছে। রামলালার ভোগ তৈরি হবে। অতিমারীর কালে পুজো- আচ্চা কমেছে। নিজের সংস্থান নেই, লোকে ঈশ্বরকে খোরাক জোগায় কোত্থেকে? ভীতি শ্রদ্ধা বাড়ায়। কিন্তু কলিকালে তা দিয়ে নৈবেদ্য জোটে না। আয় কমলেও দীনদয়ালের আছে এক বিঘে। যজমান সেবাইত বাপকে যেটুকু দিয়েছিলেন। তার, লছমির, রামলালার গুজরান হয়ে যায়। ভোগে তেলমশলার বালাই নেই। ঈশ্বরের অভিযোগও নেই। জিভে চড়া পড়ে মানুষের শুধু।
সূর্য এক লাফে উঠেছে নদীর মাথায়। চিকচিকে ঢেউ। ছগনের কি শৌচ হল? দীনদয়াল উঠছে ধুতি ঝেড়ে। ছোটলোকটা উঠল কি? একসঙ্গে জলে নামা…
ছগন অথচ ফেরে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে দূরের পানে। দীনদয়াল এগোয় ঘাটের দিকে। গলা খাঁকারি দেয়। ছগনের খেয়াল নেই। সম্ভ্রমের অভাব দীনদয়ালকে পীড়া দেয়। পায়ে পায়ে দীনদয়াল নামে সিঁড়ি দিয়ে। ছোটলোকের ছোটলোকামিতে রামলালার নিবেদনে দেরি না হয়!
ছগনের চক্ষু বিস্ফারিত। যা বিড়বিড় করে, তা রামনাম। দীনদয়াল ছগনের দৃষ্টি অনুসরণ করে। কী ভেসে আসে? এক, দুই, তিন, চার... সার বেঁধে...
মানুষ বা মানুষের মতো। দেহ বা দেহর মতো। ফুলে গোলগাল। আসছে তো আসছেই। কেউ আটকে যাচ্ছে দূরের তীরে, পাথরে, খাঁজেখোঁজে। মিছিল করে বৈতরণী পার হচ্ছে। বৈতরণীতে এত ভিড় ছিল?
ছগন আর্তনাদ করে ওঠে। দূরের তীরগুলোতে চিল শকুনের অবতরণ দ্যাখে দীনদয়াল। তারপর এই তীরে প্রথম দেহটি ঠ্যাকে।
গাঁয়ে প্রাতঃকৃত্যের সময় আরও এগিয়েছে এখন। রাত থাকতে মেয়েবউরা মাঠে যায়। সকালে আসে ভিনদেশী ক্যামেরা, সাংবাদিক, মাইক। মড়া ইউপি’র না বিহারের, তা নিয়ে তরজা টিভিতে। পুরুষমানুষরা বাইট দিতে উন্মুখ। ছগন আর দীনদয়ালের খোঁজ পড়ে বেশি। তারাই প্রথম দেখেছিল।
ছগন খুশ। টিভিতে মুখ দেখিয়ে নয়, কাজ পেয়ে। মড়া টানতে সরকারি লোকদের সাহায্য করে সে। শুধু পিপিই দেবে বলে দেয়নি এখনও। কোমরে দড়ি বেঁধে অচেনা মানুষ বা মানুষের মতোদের বৈতরণী পার করায় সে।
দীনদয়াল ভি খুশ। যজ্ঞ হবে অনেকদিন পর। লাশ ভেসে এসে অপবিত্র ঘাট, রাম রাম! মোড়লরা বিহ্বল মুখে মেনে নিয়েছিল দীনদয়ালের কথা। রাত হলে দিনদয়াল বৈতরণীর স্বপ্ন দেখে। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে যে নদী। পাড়ে স্তূপাকার অস্থিসজ্জা। শোণিতবর্ণ স্রোত। লাশেরা ভেসে চলে। দীনদয়াল যে কোনো লাশের মুখের চাদর সরিয়ে দেয়।
নিজের মুখ দ্যাখে৷
.
দূরের কথামালা
বিট্টু আজ বসল না পাশে। লাস্ট বেঞ্চে সরে বসলাম। আড়চোখে একবার দেখল, তারপর ফিফথ বেঞ্চের কোণে ব্যাগ রেখে অপুকে আলতো হাতে ঠেলা দিল। কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। বিট্টু আর কথা বলবে না। কাল ওর চোখে ঘেন্না ছিল। দলা দলা থুতু, বমি দৃষ্টিতে। এমনিতে আর দুটো মাস। তারপর টেস্ট। স্কুল শেষ। কেন যে বলতে গেলাম বিট্টুকে! আর কাঁধে হাত রাখবে না। ছ’ বছরের দোস্তি, স্কুল পালানো, নদীর ধার, রেললাইনে ব্যালেন্স করে হাঁটা — সব শেষ!
সামনের বেঞ্চে বিজু ঢলে পড়ছে রাজীবের গায়ে। খুব হাসছে। বায়োলজি ক্লাসে মোহিনীবাবু চার্ট ঝুলিয়ে বোঝাচ্ছেন। হাসাহাসি দেখে অনুমান করি, জননতন্ত্র। একটা সুঠাম ছেলের ভিতর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পেলভিসের মধ্যে প্যাঁচ পয়জার। ঝাপসা চোখে লিঙ্গ দেখি। পিছনে দুই থলি শুক্রাশয়দের ধারণ করেছে যত্নে। পা দুটো জড়ো করে বসি। ভুলে যেতে চাই শত্তুরকে। যেন কিছু নেই পায়ের ফাঁকে।
টিফিনে বেরিয়ে গেল বিট্টু। আমিও বেরোলাম। সুদাস আচারওয়ালার কাছে ঘুরঘুর করলাম। ‘কা বাবুয়া? আজ বোন্দু এল না?’ সুদাস আজও বিনি পয়সায় কারেন্ট নুন দিল। কাল নুন চাটতে চাটতে আমরা স্কুলবাড়ির ছাদে উঠেছিলাম। আমি আর বিট্টু। শনশন হাওয়া। দুটো ঘুড়ি উড়ছিল। বিট্টু বলছিল, 'সবুজ লালকে কাটবে।’ অথচ আমি সবুজ আর লালের ঢলাঢলি দেখছিলাম। যেন হঠাৎ চুমু খেয়ে পালাচ্ছে। কথাগুলো বলতে চাইছিলাম। বিট্টুকেই বলা যায় শুধু। ছেলেরা 'লেডিজ' বললে বিট্টু আমায় আগলায়।
বলতে চেয়েছিলাম, আনন্দলোক থেকে নায়িকাদের ছবি কাটা হলে ও যখন আমায় বইটা দিয়ে দেয়, আমি খালি গা ছেলেদের দেখি। শিরশির করে। মাঝে মাঝে বিট্টু কাঁধে হাত রাখলেও আজকাল… বিট্টু ছিটকে সরে গিয়েছিল। চোখ দিয়ে ওয়াক তুলেছিল।
পাঁইপাঁই সাইকেল চালিয়ে নদীর ধারে এলাম ছুটির পরে। নেমে সাইকেলটাকে লাথ কষিয়ে দিলাম। নীরবে কাত খেয়ে পড়ল সে মাঠে। মাথার উপর ঘুড়িরা কাছে আসে, সরে যায়। জাম গাছের ছায়ায় বসে কাঁদি। গাছ বলে, ‘কী হল?’ ভয়ে চুপ থাকি। গাছ যদি ওয়াক তোলে? পাতারা সরসর করে বলে, ‘হলটা কী?’ চিৎকার করে বলি, 'আমি কি মন্দ? আমায় ঘেন্না পাও না?’ গাছ মৃদু হেসে দুটো জাম ঝরিয়ে দেয় কোলে। পচাৎ করে জাম ফাটে। সাদা প্যান্টে ঋতুমতীর মতো লজ্জার দাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াই।
সাইকেলে নদীর পাড়ের চায়ের দোকান পেরোচ্ছি। রেডিওতে তিনশ সাতাত্তর নামের কোনো আইন বদলের খবর পড়ছে। কঠিন শব্দ সব। যেন কত দূরের কথামালা। কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। কাকুরা চা খাচ্ছে নির্বিকার। আমি নামি। কান খাড়া করে সাইকেল গড়াই। দূরের ভাষা আমায় ডাকে।
.
অ-লৌকিক
অতএব মহীতোষের হাসি পায়। মিসপ্লেসড প্রেফারেন্সেস। জীবনের নিশ্চয়তা নেই। তবু গরীবের র্যাশনের মাল হাওয়া করছে। দলাদলি করছে কে কাকে হটিয়ে ত্রাণ দেবে, তা নিয়ে। ব্যাবসায়ী বলছে লকডাউন তুলে ব্যবসা চলুক।
অতএব মহীতোষের কান্না পায়। শ্রমিক হেঁটে পেরোচ্ছে শত মাইল। ঢলে পড়ছে। শিশুও ছিল সে মৃতের দলে। মৃত্যুসংখ্যার হিসেবে কী কী সরকারি গোঁজামিল? মানুষ কি সংসদীয় রাজনীতির কাঁচামাল? আদি-অনন্ত কাল ধরে সার্কাস চলছে। কমেডি অফ মিসপ্লেসড প্রেফারেন্সেস। এবং তা ব্ল্যাক কমেডি। ক্রূর। এমতাবস্থায় সহমানুষকে নিছক ব্যালটপেপার বা কাঁচামাল মনে হওয়া অসম্ভব নয়।
মহীতোষের অতলে একটা তপতপে মন আজও বেঁচে। মহীতোষ টের পায়, আশ্বস্ত হয়। রোদ-ঝড়-জল থেকে আড়াল করে সেই গভীর স্তর তপতপে রাখা গেছে। ব্যথা সেখানে নিবিড় আঁচড় কাটে। বাকি সকলে, বড় পাথুরে। তাদের নেই ওই মোম-নরম সান্দ্র রিসেপটর।
এইসব এলোমেলো ভাবতে ভাবতে মহীতোষ লিখতে বসে। লকডাউনে কাঙ্ক্ষিত অবসর পাওয়া গেছে ভাবনার, লেখার। লেখা হল সাধনা। প্রাণায়মে মনকে একটি বিন্দুতে স্থির করতে হয়। তেমনই লেখাতে। স্রষ্টা মাত্রেই সৃষ্টির মুহূর্তে একা। আত্মমুখী। জ্ঞান, বোধ, সংবেদনা - এসব স্রষ্টার শস্ত্র। মহীতোষ এখন একমোবদ্বিতীয়ম, কর্তৃকারক, বিভক্তি শূন্য।
সৃষ্টির এই অ-লৌকিক মুহূর্ত নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ হয়েছে। ওয়েল-মেইন্টেন্ড তপতপে মনের অধিকারী মহীতোষ সংবেদন উজাড় করে লিখছে।
মানুষ, জীবন, জগৎপ্রপঞ্চ, মারী, দারিদ্র… আবারও, আরও একবার, পাতি কাঁচামাল হয়ে যাচ্ছে।
.
আম
আমটার গায়ে একটা দাগ ছিল। মা বলল, জন্মদাগ। যে আমের গায়ে জন্মদাগ, তা ছেলেদের খেতে নেই। তা মাতৃভক্ষ্য। বীথি ঠোঁট বাঁকাল। আমি অপ্রস্তুত। বীথিদের বাপের বাড়ি বামপন্থী। দেওয়াল জোড়া কমরেড অমুক, কমরেড তমুক। মায়ের ফালতু আচারবিচারগুলো ওর সামনে ঢেকেঢুকে রাখি।
সকালে অম্বুবাচীতে মা আম-দুধ খেতে চেয়েছিল।
বীথিকে ইম্প্রেস করতে আমি তড়িঘড়ি বলি, 'আহ্ মা! যত্ত বাজে সংস্কার।'
মাকে নার্ভাস দেখায়। বলে, 'থাক তবে, খাব না।'
বীথি বলে, 'নিশ্চয় খাবেন। খাবেন না কেন?' কথা ট্যারাব্যাঁকা হলেও, জানি, বীথি সহজেই আর্দ্র হয়। হাঁফ ছেড়ে বাজারে যাই।
রাতে মা অতগুলো আমের মধ্যে খুঁজে পেতে ঠিক খুঁতোটাকে বের করেছে। স্বভাব। কাটা বেগুনের পোকায় খাওয়া প্রান্তটি কায়দা করে কেটে রেখে দিত, পুড়িয়ে খাবে বলে। আমাদের পাতে পড়ত চাকা চাকা সুচারু বেগুনভাজা। আজকাল মায়ের রান্নার পাট চুকেছে। বীথি যখন রান্না করে, মা ঘুরঘুর করে আশেপাশে। কিছু নির্দেশ দিতে যায় রন্ধন বা পরিবেশন সংক্রান্ত। সাহস পায় না। বরং চকচকে চোখে ঘ্রাণ নেয়। 'আজ লটে মাছ রাঁধলে? বেশ বেশ।'
আমটির গায়ে আড়াআড়ি চলে গেছে এক ইঞ্চি কালো দাগ। পচে উঠেছে, নাকি স্রেফ পাতার দাগ? মা অবিচল বলে চলেছে, 'জন্মদাগ, জন্মদাগ'। বীথি গজগজ করে। মা বালিকার জেদে জন্মদাগওয়ালা আমটিকে দখল করেছে। বীথির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে।
'ভুলভাল কথা যত! দাগওয়ালা বা পোকাধরা জিনিষ যাতে সংসারে মা-এর ভাগেই জোটে, স্বামী-সন্তান যাতে ভালোটা পায়, তাই এসব লোকঠকানো ব্যবস্থা।' বীথি সপাট উত্তরে হামেশাই মাকে স্তব্ধ করে দেয়। মা কুঁকড়ে যায়।
'আমি, আসলে শুনেছিলাম... তাই... আসলে অম্বুবাচীও বটে… অবশ্য পুরো আমটা বুড়ো পেটে সহ্য হবে না... তাও ঠিক।'
বীথি পিঠে হাত রাখে মায়ের।
'সব সহ্য হবে, মা। খেতে ইচ্ছে করলে, খেতে হয়। সুগার-টুগারও নেই, খাবেন না কেন? কিন্তু শুধু অম্বুবাচীতে কেন? আর খুঁতোটাই বা আপনাকে খেতে হবে কেন, শুনি?'
সলাজ মা আমার, ধরা-পড়ে-যাওয়া বালিকা যেন। বলে, 'মেয়েমানুষের নোলা ভালো নয়। বিধবার তো নয়ই। কিন্তু বুড়ি হতেই কেমন যেন নোলা বেড়ে গেছে, বৌমা…'
মায়ের খাওয়া দেখেছি কি কোনোদিন? সবার শেষে সেই যে মানদাদিকে সঙ্গে করে খেতে বসত, দেখেছি কি? কী খেত মা? কী ভালোবাসে? মা কি আম ভালোবাসে? আমার বাম কানের জুড়ুল, জন্মদাগ। মা, তোমার জন্মদাগ আছে? ডাকনাম?
ছুরি দিয়ে মুখ কেটে জলে ভিজিয়ে রেখেছি টুকটুকে আম। মা জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে একখানি গোটা জলমগ্ন আমের দিকে। ভাগ্যিস বার্ধক্যে মানুষ শৈশব ফিরে পায়। সত্যি কি ফিরে পাওয়া যায়?
তোমার কোনো শৈশব ছিল, মা? দাদুদের ওই বিরাট আমগাছ... বিকেলরোদে তুমি কি পাকা আমের চিকণ গায়ে ড্রাকুলার দক্ষতায় দাঁত ফুটিয়ে টেনে নিতে সোয়াদ? হাত বেয়ে গড়াত হলুদরস? ফেরো মা, একটিবার, চোখ বোজার আগে। অসমাপ্ত শৈশবে। ডাকনামে ফেরো। ফেরো জন্মদাগে।
.
হ্যাঁকাতে
'এ ছেলে ভারি হ্যাঁকাতে।' কাগজের ঠোঙায় চিনি ঢালতে ঢালতে বলে শ্রীনিবাস। গৌতম মাস্টার হাসে। 'হ্যাঁকাতে' শব্দটার মানেই বুঝবে না শহরের লোক। অথচ চব্বিশ পরগণায় খুব চলে। খাতাতে ছাত্ররা লিখে ফেললে, বাংলার মাস্টার গৌতম মণ্ডল কেটে করে দেন 'একরোখা' বা 'জেদি'। যদিও সেই জোশটা আসে না, তবু মান্য ভাষার উপর জোর দেওয়া তাঁর জরুরি মনে হয়।
মুজিবরের ছেলে ফজলুল। আজ স্বয়ং মুদির দোকানে এসেছে আলু-পেঁয়াজ নিতে। ফজলুল এখন সেলিব্রিটি। অথচ এ ছেলে গৌতম মাস্টারের স্কুলের ড্রপ আউট। উদোম গা চুলকাতে চুলকাতে এখন লাজুক হাসছে। সে মহারাষ্ট্রে কবে ভিড়েছিল, খবর রাখেনি গৌতম মাস্টার। শ্রমিকের ম্যারাথনের কথা কাগজে পড়েও, দড়ি-পাকানো হ্যাঁকাতে ছেলেটার কথা মাথায় আসেনি।
মুজিবর নকি সর্বস্ব বেচে সাইকেল কেনার টাকা পাঠিয়েছিল। কুঁচকিতে টান যতই ধরুক, বাড়ি ফিরেছে ফজলুল সেই সাইকেলে। তাকে দেখতে আশপাশের গাঁ থেকে লোক আসছে। খবরওয়ালা এসেছিল দুই চ্যানেল থেকে। গৌতম মাস্টারের খানিক ঈর্ষা হয়।
অন্ধকার হয়ে এল৷ শ্রীনিবাস ঝাঁপ ফেলছে।
'কাল আর এ দোকান থাকবে কিনা বলতে পারি না, মাস্টার৷ হ্যাঁকাতে একটা ঝড় আসছে।'
'সাহস বলিহারি তোর!' প্যাডেলে পা মেরে মাস্টার বলে।
ফজলুল বলে, 'সাহস! ও তো মরণের ডাক, স্যার। মরতি হলে নিজের গাঁয়েই মরব’।
ওর চোখের ভাষা কোন শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায়?
আকাশ মাথায় ভেঙে পড়বে এইবার। ঝড়ের বিপরীতে সাইকেল ঠেলতে কষ্ট খুব। রাস্তার আলো নিবে এল। এও সাইকেল, কিন্তু সুখী। বাড়ি পৌঁছতে হাঁফিয়ে উঠেছে হ্যান্ডেল, প্যাডেল।
বউ হ্যারিকেন হাতে বলছে, 'পিছনের বাড়িগুলোর অ্যাসবেস্টস উড়ে গেল মনে হয়।'
ওদিকেই মসজিদপাড়া, ফজলুলদের বাড়ি। দিনকতক সরগরম ছিল। এমএলএ-ও এসে দেখা দিয়ে গেছে। এখন অ্যাসবেস্টস উড়ে ঘর থৈ থৈ। এইবার? বাঁকা হাসি গৌতম মাস্টারের চোখে।
সে রাত জেগে কাটল। সে কী অশরীরী গোঁ গোঁ অন্ধকার চিরে! দোতলা বাড়িটা টাইম মেশিন। কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে, শ্বাপদদের মধ্যে একলা ক’টা মানুষ অন্ধকারে। জলের পাইপ ফাটল কি? বাথরুমের জানলার পাল্লা উড়ে গেল।
সকালে আড়ালহীন বাথরুমে যাওয়া দুষ্কর। সাইকেল ছেতরে পড়ে আছে উঠোনে। যে গাছ পড়ে পাইপ ফেটেছে, সেটা কেটে সরানো দরকার। মসজিদ পাড়ায় লোক মিলতে পারে।
করাত নিয়ে ফজলুল আর তার ভাই এল গুরুঋণ শুধতে। প্লাম্বার, ইলেক্ট্রিক অফিস, কাউকেই ফোনে পাওয়া যায় না।
'কদিন জল টেনে কাজকম্ম সারুন স্যার। তেরপল এখন মেলা মুশকিল হবে, তবে আমরা পেলে আপনাকেও একটুকরো দে যাব'খন। বাত্থোমের জানলাটা ঢেকি নেবেন।'
করাত ঝুলিয়ে চলে যাচ্ছে মুজিবরের দড়িপাকানো ছেলে। মান্য বাংলা শব্দ দিয়ে ওর চোখের ভাষা প্রকাশ করা যায় না। গৌতম মাস্টার বিড়বিড় করে, 'শালার হ্যাঁকাতে ঝড়!
.
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
ভৈরব
গাড়িতে উঠলে রেবেকার ভৈরবকে মনে পড়বেই। ভৈরব বারুই – সাধারণ খর্বকায়, মাঝারি চেহারা, পাতলা হয়ে আসা চুল। টুপি নামিয়ে লম্বা একটা সেলাম ঠুকে দিয়ে বলত,
-নেমস্তে মেডাম। গাড়ি মেঁ পধারিয়ে। টিয়াকো ঠিক ব্যঠাও।
লজ্জা আর খুশি মিলিয়ে হেসে ফেলত রেবেকা। তখন ডাক্তার বরের সঙ্গে সবে গেছে অখণ্ড বিহারে। কোলে তিয়াস। সেসব গতজন্মের কথা। রেবেকা দারুণ ফর্সা, সাহেবি চামড়ার জন্যে রেবেকা নাম হয়েছিল। আড়ষ্ট গলাতে বলত,
-তুম বাংলাতে বলো ভৈরব। আমি হিন্দী পারিনা ভালো। আসলে তুম তো বাঙালিই হোতা হ্যায় না?
-হাঁ মেডাম, আমি বাংগালি হচ্ছি। বহুতদিন এদেশে থাকছি, হিন্দীটা পহেলে আসে পড়ছে।
সরকারি হাসপাতাল, কাজের চাপ কম থাকলে সফর ভালবাসত অনুপম। ভৈরবকে ডাকতে হতনা, চলে আসত। একলা মানুষ, বিয়ে-থা করেছিল বা করেনি জানা হয়নি রেবেকার। কতবার বিরক্ত হয়েছে অনুপম,
-লোকটার জ্বালায় ড্রাইভিং ভুলে যাব! স্টিয়ারিং ছুঁতে দেয়না!
-থাক্না, দূরের রাস্তা—প্রফেশ্যনাল লোক।
টেরিয়ে হাসত স্বরাজ,
-হুঁ সুন্দরী মালকিন— সঙ্গী জাম্বুবান।
-কীসব বাজে!
দেড়শ-দুশো কিলোমিটার রাস্তা হাল্কা ঢেউয়ের মাথায় নৌকো ভেসে চলত। স্পীডোমিটারের কাঁটা কখন একশ ছাড়িয়ে যেত টের পাওয়া যেতনা। তখন রাস্তাঘাট তত ভালোও নয়। ভৈরবের অনায়াস মুঠোতে স্টিয়ারিং জীবন্ত, নির্লিপ্ত আত্মবিশ্বাসী চোখ। পেছনে জানালার বাইরে চোখ-ফেলা রেবেকার পাশে ত্বরিতগতিতে দৃশ্যান্তর।
চালাতে চালাতে বকবক করত, মূলত দেশীয় রাজনীতি নিয়ে। সেটা রাজ্য ভাগাভাগির অশান্ত সময়। গাড়ি তীক্ষ্ণ মোড় নিলে সতর্ক করত স্বরাজ,
-আঃ কেয়ারফুল!!
-চিন্তা নহীঁ সাহেব।
-তবু—!
-দেখবেন সাহেব আলাদা আদিবাসী স্টেট হলে, ইয়ে জামশেদপুর কেপিটল হয়ে যাবে।
-তোমার কী ফায়দা? তুমি তো এখানকার নও!
-বাঁকুড়ায় ঘর ছিল সাহেব। কবে এখেনে চলে এসেছি।
-ভালো। দেখ কী হয়।
অভিজ্ঞতার কাহিনির খুচরো কানে ঢুকত রেবেকার। আলগা মন্তব্য করে ফেলে অনুপমের দিকে তাকাত। হয়ত সমীচীন নয়, রীতিবিরুদ্ধ - যতই হোক ড্রাইভার! তবু রেবেকার মনে হত লোকটা স্বাধীনভাবে ভাবতে পারে।
-বাঁকুড়ায় যাওনি আর কখনও?
-গেছি মেডাম, ভালো লাগেনি। বচপনে যা দেখেছি তার কত বদলে গেছে।
-আচ্ছা।
-শহর-বাজার হয়ে গেছে মেডাম, মানুষজন আপনাপন হারিয়ে ফেলেছে। ব্যাস ধান্দা—।
-এখানে?
-এখেনে ভী ওহী, তবু থোড়াসা আলাদা।
-সত্যি?
-দেখবেন মেডাম, আগে যে পাখপাখালি দেখা হমেশা যেত, কেমন কমে গেছে। এইযে ছাইয়ের মতো রঙের পাখিগুলো আজকাল, আগে কোনোদিন দেখেছেন?
-পাখি?
রেবেকা হাসত। বিজ্ঞানের বিলুপ্ত আর লুপ্তপ্রায় জীবের তত্ব না বুঝিয়ে চুপ করে ভৈরবের পাঁচালি শুনত।
রাজ্য আলাদা হলই। রেবেকা-অনুপম জামশেদপুরে বছরতিন, তারপরে নানাঘাটে। অনুপমের পদোন্নতি আর বদলি, জার্নি থামেনি। ইদানিং তাড়াহুড়োর সকালে সোনা রোদের কাঠি টুং করে ঘুম ভাঙায়। অনুপম বেরিয়ে গেলে রেবেকার এন-জি-ও অফিসে যাওয়ার নির্দিষ্ট গাড়ি এসে দাঁড়ায়। টিপটপ অবাঙালি ড্রাইভার যথোচিত সৌজন্য দেখিয়ে দরজা খুলে দেয়। ভারিক্কি ম্যাডাম চশমা আর শাড়ির আঁচল সামলে পেছনের সীটে বসে। মিনিট পনেরোর নিঃশব্দ জার্নি। কোন্ এক জানালা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে নির্ভেজাল হাসিমুখ একখানা।
.
বিধুর
.
দু-বছর পরে সে চাতালে এসে দাঁড়ায়, মূর্ঝে যাওয়া বাসী নয়নতারার মতো দেখায় তাকে।
রোদ ভালো ওঠেনি। শীতসকালে মাথামুখ ঢেকে রোদের পলকা আঁচে ইশকুলের পড়া মুখস্থ করছিল মৌ, চেঁচাল,
- ও ঠাম্মু বাসনা এসেছে। অ্যাদ্দিন পরে কী মনে করে অ্যাঁ?
এবাড়িতে ছেলেপিলেরা এরকম বুড়োদের মতো করে কথা বলে। পলির চেঁচানিতে বেরিয়ে এলো বড়ো আর মেজোবউ, তাদের কুচোগুলো। সেজোবউ নিজের বর-বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত, ঘর ছেড়ে কমই বেরোয়। ইউনিভার্সিটিতে পড়া পলি বাসী বেণী খুলতে খুলতে মুখ খুলল,
- তুই! কী চাই এখানে? নাটক করতে এসেছিস? তোর জন্য কম হ্যাঠা হয়েছে আমাদের?
- ছোড়দি... আমি...।
- অ্যাই যা ভাগ্...।
জপে বসতে যাচ্ছিল কর্ত্রী, চেঁচামিচিতে বেরিয়ে আসে,
- পলি চেয়ার আইন্যা দে আমারে।
হুমড়ি খেয়ে পায়ে পড়তে যায় বাসনা, বুড়ি দু-হাত দূরে ছিটকে যায়,
- রাখ্ রাখ্ ছুঁবি না।
সে জড়োসড়ো, ঘোমটা সরে মাথা দেখা যাচ্ছে, মোটা সিঁথিতে সিঁদুর, পায়ের আঙুলের ফাঁকে হাজা। বাড়ির বউয়েরা আশেপাশে। পলি খরখর করে ওঠে,
- বসলি যে? যা! কী চেহারা করেছিস, কাঁকলাসের মাথায় আবার সিঁদুর... শখ কত!
কর্ত্রী খেঁকিয়ে বলে,
- পলি তুই ঘরে যা, নিজের কাম কর গিয়া।
হারামজাদী তুই অহন থাকস কোন চুলায়? আবার বিয়া করছস? বিধবা মাইয়ারে তর বাপে দিয়া গেছিল। চাইছিলাম লেহাপড়া না হইলে হাতের কাজ শিখাইয়া তরে কামে দিমু। তুই না কইয়া পলাইয়া গেলি?!
মাথা তোলে না বাসনা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শাড়ির খুঁট আঙুলে পেঁচায়, বুড়ি আর বউয়েরা বোঝে সে গর্ভিণী। বুড়ি জিজ্ঞেস করে,
- কয়মাসের পোয়াতি?
- সাতমাস।
- কার লগে থাকস?
- ওই বস্তির লগেন, আমার বর… যে বিয়ে করেছেল...
বাচ্চাগুলোকে ধমকে ঘরে পাঠানো হয়েছে। বড়োবউয়ের দেওয়া চা-টোস্ট হামড়ে গেলে বাসনা।
এবাড়িতে রোজই এরকম কিছু না কিছু চলে। বাড়ির ছেলেদের অফিস-কাছারি, বড়ো, মেজো, ছোটো পাত্তা না দিয়ে এক-এক করে, "মা আসলাম" বলে বেরোয়। সেজোছেলে আসে একটু পরে, পেছনে তার মোটাসোটা ফর্সা বউ খ্যাঁকখ্যাঁক,
- কী ব্যাপার? সাতসক্কালে যাত্রাপালা চলছে? বাসনা! তুই এসছিস? সাহস কম না!
সেজোছেলে একটু বুঝি থতমত, চেষ্টা যেন পাশ কাটিয়ে সরে বেরিয়ে যাওয়ার মতো। বাসনা টলমল চেহারা তুলে ঠিক সামনে এসে পথ আটকায়, হাসে।
- ওই বাচ্চাটা শ্যাষ অব্দি বাঁচলনি গো সেজদা... প্যাটেই মরে গ্যালো। ডাক্তারদিদি খুব বকছেল, পাঁচটা মাসের গভ্ভো কিনা। লগেন কয়েছেল, সে-ই ওর বাপ হবে... তা তারও হতে হল নিকো, সে চলেই গেল অমনি।
আচ্ছা আমি এখুন আসি গো মাসিমা, বউদিরা। দেরি হলে দুটো বাড়িতে বড্ড মুক করে।
.
ফ্রেমে মুখ
দিনের আলোয় ফ্রিজ্ শট্! আটকে গেঁথে গেছে গোটাকয় মুহূর্ত। পরিচিত কারো সঙ্গে মিল-টিল নেই অথচ—! সময়ের চলতিতে আচমকা থমকে যাওয়া ঝলক। লম্বা শিক-গাঁথা পুরনো কাঠের জানালা, ওপরে নিচে দুপাল্লায় খোলা যায় ইচ্ছেমতো। চারপাল্লাই খোলা ছিল। নিচের খোলা অংশ জুড়ে গরাদের ফাঁকে মুখ, অচেনা বয়স্ক ঠোঁটে ঝুলন্ত সিগেরেট।
রোহিত মামুলি এই ছবি থেকে বেরোতে পারছে না।
ওরা ছুটি কাটাতে এখানে এসেছে, ঐতিহাসিক ভ্রমণ। অবশ্য একসঙ্গে থেকেও বরাবর রোহিত দলছুট অন্যমনস্ক। পাশের হাসাহাসি খাস্তাখিস্তি কানে ঢোকেনা। বড়ো গাড়ি, স্টিয়ারিং সায়নের হাতে। চিড়বিড় করে উঠেছে সায়ন,
-শালা এখানে লুঙ্গি, হাওয়াই চটি পরে আসা উচিত!
সরু ঘিঞ্জি রাস্তা অলিগলি, গরু থেকে বাস পাশাপাশি চলমান। রাস্তার একদিকে বাজার, ছত্রাকার জঞ্জাল। ফুটপাথ ঘিরে ধুলোমলিন নীল-সাদা গ্রিল। অন্যদিকে আদ্যিকেলে রং-চটা বসত বাড়িরা, একতলা, দোতলা। ছাতে শায়া, লুঙ্গি বা বাচ্চার জামা মেলা - যেন ঠাকুর্দার ক্যামেরায় তোলা সাদাকালো কলকাতা রঙিন চেহারা নিয়ে। রোহিতের পায়ের কাছে এস-এল-আর ক্যামেরা, গোটানো ট্রাইপডের ব্যাগ। নির্বিকার চোখ বাইরে। আচমকা কোমরে খোঁচা মারল জগ্দীপ,
-কাবে, খণ্ডহ্রমেঁ হারেম ঢুঁড়তা হ্যায়? মিল গয়া? ক্যামেরা নিকাল দুঁ?
ব্যথা পেয়ে রক্তচোখে ঘুরে তাকাল রোহিত।
হাত পাকানোর সময়ে রোহিত প্রচুর এলোমেলো ফোটো তুলত। এখনও জাল ফেলার মতো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়েছে, নেই তেমন কিছু। খাপছাড়াভাবে আধুনিক হওয়ার কৃপণ চেষ্টায় মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যের শহর। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল,
-ধুৎ!
ঠিক তক্ষুণি গাড়ি জানালার পাশ কাটিয়ে গেল। অন্ধকার একতলা বাড়ির জানালায় মুখ, ঠোঁটে সিগারেট। চশমা ছিল, না ছিল না? কেন যেন মনে হল, আগে দেখেছে। বয়স্ক সেই মুখে চিন্তা, বিরক্তি, বিস্ময়, ঔদাসীন্যের কোনটা ছিল? কিম্বা ভদ্রলোক বাড়ির বাইরে সিগেরেটের ধোঁয়া উড়িয়ে দিচ্ছে হয়ত, বাড়িতে ধূমপান নিয়ে অশান্তি হয়। রোহিতের কাছে ছবির অবজেক্টের তাৎক্ষণিক অভিব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ।
চিন্তার সমাধান হওয়ার আগে দ্বিতীয়টি ঢুকেছে মগজে, এঁকে কোথায় দেখেছে?
আধঘন্টার মধ্যে গাড়ি সরকারি গেস্ট হাউসের গেটে, সায়ন পার্কিং প্লেসে ঢোকাচ্ছে। রোহিত এতক্ষণ নিজের প্রশ্নের জবাব খুঁজছিল, কথা বলেনি। ব্যাকপ্যাকগুলো নামিয়ে ক্যামেরার ব্যাগ সামনে রাখল রূপম,
-ধর এটা। কী ব্যাপার তোর?
-কিসের?
রোহিত রিসেপশনের সোফায় বসে, বাকিরা কাউন্টারে। গৈরিক এসে ডাকল,
-ডাউন যাচ্ছিস মনে হচ্ছে? চল ওঠ, রুমগুলো দেখি।
-আচ্ছা—শোন্?
রূপম বলল, মৃণাল সেন এক্সপায়ার করলেন।
-ডিরেক্টর মৃণাল সেন? খুব এজেড্।
-এঁরা প্রিভিয়াস জেনারেশনের জিনিয়াস।
-আরেকজন হৃতিক না কে যেন?
-হৃতিক নয়, ঋত্বিক ঘটক—।
করিডর ধরে রোহিত দুকাঁধে ব্যাগদু-খানা বয়ে বন্ধুদের ছাড়িয়ে সামান্য এগিয়ে গেল। চোখের সামনে থেমে থাকা জমাট জানালাদৃশ্য। তার বাবা ফিল্ম ম্যাগাজিন রাখে, দেশী-বিদেশী ফিল্মের বইও। সেখানে সাদাকালো, গভীর চোখে মোটা ফ্রমের চশমা, অপাট কাঁচাপাকা চুল, ঋদ্ধ, চিন্তাশীল মুখের রেখা।
কোন এ্যাঙ্গেলে, লাইট স্পিডে নিলে আজ ছবিটা বেশী জীবন্ত হত? আফশোষে পুড়ছে রোহিত, অযথা রাগ হচ্ছে সায়নের ওপরে।
.
নন্দ চলে গেছে
বেরনোর আগে তপতী বাগানে টহল দেওয়ার সময় পায়নি। চটি গলিয়ে গেট খুলে চেঁচিয়ে অম্লানকে বলল,
-আমার সাধের গাছগুলো রোদ্দুরে দফারফা, নন্দকে বলবে যেন ভালো করে জল দেয়। দু’দিন ধরে পাত্তা নেই, খবরও দেয়নি।
স্বর্ণচাঁপার নিচের বেদীতে চা হাতে আলসেমি করছিল অম্লান। বছর ঘুরেছে সে অবসরপ্রাপ্ত। তপতীর আরও মাসছয় টানতে হবে। সামান্য স্বর উঁচিয়ে আলগা ছুঁড়ল,
-নন্দ কাজ ছেড়ে দিয়েছে, আর আসবে না। এখানের মাতব্বরেরা অন্য পার্টির লোক টিকতে দেবে না। কাজে ঢুকতেও না।
-কী?
তপতীর এখন দাঁড়াবার সময় নেই মুহূর্তও। শাড়ি সামলে রিক্সায় উঠে স্টেশন, লোক্যাল ধরে শিয়ালদা।
ট্রেনের জানালার বাইরে থসথসে উত্তাপে মফস্বলীয় আম, কাঁঠাল, কলা, পুটুস, আগাছার চেনা মাটি-মাটি গন্ধ। ভীড়, বিজবিজে ঘাম অন্যান্য দিন এঁটে থাকে বিরক্তিতে। তপতীর সময় আনমনে বয়ে যাচ্ছিল। আসবে না নন্দ? কদমছাঁট মাথা, খেটো ধুতি, বেঁটেমতো মাঝবয়সী লোক মাসপাঁচ আগে গেটে দাঁড়িয়েছিল।
-মালীর কাজ করি, রাখবেন বউদিমনি?
নরম গলা কচি দুব্বোঘাসের মতো। শীতকালটাও আলো ফোটার আগে এসেছে রোজ, সপ্তাহে চারদিন। মাটি-ভালোবাসা মানুষ ঝারি করে জল দিয়েছে। ওকে দেখে কাকভোরের কনকনানিতেও উঠে সাগ্রহে এসেছে তপতী।
-কী করছ নন্দ?
-এবেলা মুখ ধুইয়ে দিচ্চি এগুলাকে।
-মুখ ধুইয়ে দিচ্ছ? শিশিরে ভিজেছে না শেষরাত্তিরে?
-সেজন্যেই দিই বউদিমুনি। হিমের ঝাঁঝে বাচ্ছা চারাগুলো জ্বলে যায়।
বুকের ভেতরে ঢবঢবে ফাঁপা বল গড়িয়ে যাচ্ছে এধার-ওধার। বাগানের হাসিটুকু তুলে নিয়ে গেছে লোকটা। রান্নাঘরের বাইরে পেয়ারাগাছে টুনটুনির বাসা, উদাস পাখিটা ডেকে চলেছে। গাছের তলায় উই ধরে গিয়েছিল, পরিষ্কার করেছে নন্দ। নরম ভোরে খুশিমুখে ঝিঙের মাচা, শশার মাচা, লালশাক। শেষ হয়ে শুকিয়ে যাওয়া টম্যাটোর বেড। বলছিল, পরিষ্কার করে অন্য সবজি বসাবে। ছোটো বাগানের চৌহদ্দির প্রত্যেক কোণ যত্ন পেয়েছে ক’মাস। গ্যাস কমিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে তপতী, বিষণ্ণতা চোখের কোলে। কেন যে এত বিশ্রী লাগছে ওর! মনের বেহাল কিছুতেই সারাতে পারছে না। অম্লান পাত্তা দেয়নি। বলেছে,
-পয়সা দিলে লোক ঠিক অন্য লোক পেয়ে যাব।
-না, ওকেই খুঁজে আনো। আগে কতবার কতজন এল গেল... দূর্।
-ও আর কাজ করতে পারবে না এপাড়ায় বললাম তো তোমাকে।
চোখে জল নিয়ে চলে গেছে নন্দ, তপতী জানে না। পার্টির ব্যাপারে তো কথাও বলেনি কখনও। শুধু গোড়াতে কাজে ঢুকে বলেছিল একবার,
-আগে উইদিকের গেস্ট হাউসটোতে কাজ করতাম আমি। সব্বাই বাগানটার পশংসা করত। তা আমি লালপাট্টির লোক কিনা, নতুন পাট্টি হওয়ার পরে উরা সব তাড়িয়ে দিলে। বউদিমুনি, এদিককার কাউকে ভুলেও বলে ফেলবেন নি যেন...।
মনে পড়ে, ম্যাক্সির হাতায় চোখ মোছে তপতী। এতবছর মাটি মেখে, পাতা ঘেঁটে পার্টির রঙ এখনো কি গায়ে লেগে থাকে?
শিউলি
আকাশপ্রদীপ আকশের বুকে ছোট্টো, তীব্র, মিষ্টি হয়ে ফুটে আছে। আলোরও বিশেষ গন্ধ হয়। হেমন্তের গন্ধ! জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশে কুচোকুচো সাজানো ডায়মণ্ড তারা। একদৃষ্টে দেখার মতো ঝলক নেই, বড্ড মায়া-মায়া। চোখ বুজলেও ছুঁয়ে থাকে।
কুঁচকির দুপাশ থেকে আড়ষ্ট অচেনা-ব্যথা নেমে যাচ্ছে, বুকের মধ্যে তোলপাড়। অস্থির লাগছে শরীর। বাবার ঘর থেকে গান বয়ে আসছে, ‘শুধু এই পথ চেয়ে থাকা ভালো কি লাগে’?
তানিশক থেকে ওরকম হীরের নেকলেস কিনে দিয়েছিল অরণ্য। বিয়ের জন্মদিনে।
“ডাস্কি-স্কিনে ডায়মণ্ড-গ্ল্যাম দেখাচ্ছে” বলেছিল।
তনু বেঢপ পেটে কাত হয়ে কুঁকড়ে আছে, ফোঁপানির মতো শ্বাস। কান্না আটকে ছাতিতে ব্যথা হচ্ছে, উঠে বসে দম ফেলার চেষ্টায় হাঁকপাক করে। খড়খড়িঅলা পুরনো জানালা খুলে ফেলে। পারলে ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে দিত। হাঁ করে বাতাস নিতে গিয়ে চেঁচায়,
-মা, ও-মা... মা।
হেমন্তের নিঝুম সন্ধ্যেতে জটপাকানো বাড়ির মাথা, ক-খানা ঝিমোনো গাছ, তিনমাথা ল্যাম্পপোস্ট, আলো, মিলে-টিলে বিমূর্তচিত্র। ওসব বোঝেনি অরণ্য, চান্স পেতেই ওয়াশিংটনে চলে গেছে লাফিয়ে।
-হোয়াট শ্যালাই ডু রণ? অফিসে নোটিস দেবো?
-এত অস্থির হয়ে পড়ছ কেন? গিয়ে ব্যবস্থা করে জানাচ্ছি।
আটমাস কেটে গেছে, অরণ্য জানাচ্ছে না। হয়ত ব্যবস্থা করতে পারছেনা! এ-মাসের শেষে তনুর ডেলিভারি ডেট। অফিসে ছুটি স্যাংশন হয়েছে, কিন্তু ব্যথাটা কমছেনা। বিন্দুবিন্দু ঘাম হচ্ছে,
-মা–ওমা–মা।
শান্ত পাড়ায় শিউলিগাছ দুখানা। ছাতিমও আছে। ছাতিমের ধরা গন্ধ আর শিউলির টাটকা গন্ধ মেলানো। বাবা রোজ কুড়িয়ে তার ঘরে ডিশে রাখে। তনু হাতের চেটো দিয়ে গাল ঘষে-ঘষে চোখের জল মোছে। মুখের খসখসে চামড়ায় গন্ধ ফেস-পাউডার হয়ে সেঁটে যাচ্ছে। একটানা পাখির ডাকের মতো বিরক্তিকর সময়। সে বিছানার চাদরে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি করতে থাকে। এই বিছানায়, চাদরে শুয়ে দেড়মাস আগে মা চলে গেছে। তনু চাদরটা আঁকড়ে ধরেছিল, নিতে দেয়নি।
আকাশপ্রদীপ ছোট্ট আগুনফুল। সারা বাড়িতে মা, আলনায় মা’র শাড়ি, হাল্কা সবুজে লাল ডট্স্। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মতো খসখস শব্দ উড়ছে। কেউ এল নাকি? ছোটোবেলায় পপিন্স নামের পুঁচকে কুকুর ছিল তনুর, ভুকভুক ডাকত। দৌড়ে বেরিয়ে আচমকা গাড়ির ধাক্কায় গড়িয়ে গিয়েছিল। কয়েকফোঁটা রক্ত আর চোখের জল নিয়ে চিরস্থির। কী সর্বনেশে ওই সন্ধ্যেটা। মা-র কোলের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল তনু। আবার কান্না আসছে, জল নামছে প্রপাত হয়ে।
-মা–ওমা–মা!
-তোর ছেলে হবে মামন।
-একটা হলেই হল। রণ কিছু জানাচ্ছে না কেন বলো তো?
-থাকনা, ক’টা মাস আছিস!
-আ-হা, যাবো না নাকি?
টুপটুপ বৃষ্টি, টপটপ করতে করতে মুষলধার। সটান ছুটে এসে গেঁথে যাচ্ছে মাটিতে। ছাঁট আসছে ঘরের মধ্যে, কাঠের ফ্রেমের জানালা ঠাসঠাস করে পড়ছে। ফ্যান দুলছে। তিরের ফলার মতো ব্যথা একবার করে জাগছে, নিভছে। কেঁপে উঠছে তনু। বাবাকে এবারে না ডাকলেই নয়।
মায়ের কাপড়খানা উড়ে এসেছে। তনুকে ঢেকে নিচ্ছে। কোত্থেকে গন্ধ ছুঁচ্ছে টিপ-টিপ-টিপ। মাথায় মুখে কাপড়টা পেঁচিয়ে সে গোঙাচ্ছে,
-মা–ওমা–এসো—!
.
সুবল দত্ত
অন্তিম কুরুকুল
আমার এখানে ফুটফুট করছে দিনের আলো কিন্তু ফোনের ওপাশে যেন ঘন দুঃসহ আঁধার, যদিও ও আমার এখান থেকে মাত্র আশি কিলোমিটার দূরে। এটা ও বলছে না, ওর গলার আওয়াজে বুঝতে পারি। ও ভয় পেয়ে নিশ্চয় অন্ধকার একান্ত কোণায় ঢুকে রয়েছে। কিংবা ভয়ানক অবজ্ঞায়, বহুজনের তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার।
-হ্যালো, কীরে বল কী বলবি? ফিসফিস করে কেন, একটু জোরে বল। ভয় পাচ্ছিস? আজ তোর বড়দার ক্রিয়াকর্ম জানি। নিশ্চয় তোর সব ভাইবোনেরা এসেছে। দারুণ জমঘট। না? সেরকম কিছু নয়? তোর দাদা ভাই বোনেদের কারা এসেছে তবে? কেউ না? সেকীরে? তোর তো সাকুল্যে ছয়ভাই আর দশবোন। জীবিত। শুনেছি সাতটা নেই। তোর বড়দারই তো আটমেয়ে আর একছেলে। ছেলের অপেক্ষাতে পর পর মেয়ে হচ্ছিল। ছেলেটা যখন নবম গর্ভে তখন ভাগ্যিস সঞ্জয় গান্ধীর কোপে পড়েনি। তা ছেলে তো হীরে। জুয়েল। প্রায় চল্লিশ বছর বয়েস হলো, এখনো নাকি কলেজে পড়ছে। কী বললি? কী কলেজ? বেশ্যালয়? তা হবে। আচ্ছা এখন ওখানে সবার বিয়ে বাচ্চা এমনকি নাতিপুতি মিলিয়ে মনে হয় একশ। কীI বললি? তারও বেশি? হ্যাঁ তো হেলদি ব্রিডিং কুরু বংশ, হবে না? তোকে অনেকে চেনে না? বলছিস না একই রক্ত? একই বংশ? অবশ্যি তুই তো নবম সন্তান। তার ওপর তোর কপর্দকশূন্য অবস্থা। তোকে কে পুছে! আমার আবছা মনে পড়ে আমি যখন তোদের বাড়িতে যেতাম তখন তোর পাশে শুতাম। ঢালাও বিছানা। সর্বসাকুল্যে বাবা-মা ছেলেমেয়ে নিয়ে কুড়িজন। তারমধ্যে দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, সেখানে নেই। আধো ঘুমে অস্বস্তি। তোর বাবা-মা উদোম। জড়াজড়ি করে আমাদের পাশেই শুয়ে সবরকমের ক্রিয়া। কী বলছিস? ভাল লাগছে না? আচ্ছা বল তাহলে কী বলবি! তুই বলছিস ঘাটে ওঠার জন্যে কেউ ছিলো না? আচ্ছা বেনেগাছ পুঁতেছিল কিনা পুকুরঘাটে? না? একটা পুটুস ঝাড়ের ডাল ঘরের এক কোণায়? স্নান ওখানেই? হবিষ্যি অন্নরান্না হচ্ছিল না? হোটেল থেকে মুর্গারান্না চলছিল। আর তুই কী করছিলিস? তুই মুখে আগুন দিয়েছিস? তুই পালন করছিস? একমাত্র ছেলে বেঁচে থাকতে? আচ্ছা, তুই যে করলি তো তোর কী লাভ? কিছু টাকা? কী বললি? কিছু না? বড়দার আত্মার শান্তি হোক। বুঝেছি রে বুঝেছি। হিন্দুধর্ম। জাহাজ রসাতলে যাবার আগে এক দুজনই জাহাজি থাকে জাহাজের সাথে নিমজ্জিত হতে। বুঝলি রে? এই তোদের মত। খেতে পরতে পাস না, কোনো প্রতিবাদ নেই, যে মারা গেছে ও যারা জিন্দা তাদের কল্যাণের কাজে লেগে থাক। হ্যাটস অফ।
ছুঁচিবাই-এর রাত
ভোরের সূর্যও যেন অষ্টাঙ্গ এঁটো করে দেয়, এই ভয়ে রোদ ওঠার পর বিছানা ছাড়ে ময়না। জল বাদে দুনিয়ার সবকিছুই বাসী, সকড়ি। পায়ের কাছে একটা বড় থালাতে জল থাকে। বিছানা থেকে সেটাতেই পা ডুবিয়ে নামে। রাতে পেচ্ছাপ পেলে উলঙ্গ হয়ে কোমর থেকে জল ঢালে। নাঃ তবে জীবন দুর্বিষহ নয়। ভালো লাগে ময়নার। জলের স্পর্শ তাকে শান্তি দেয়, সুরক্ষা দেয়। স্বামীর স্বভাব ঠিক জলের মত। তরল বুঝদার। রাতে ইচ্ছা তৃপ্তির পর দিব্যি চুপচাপ একপাশে শুয়ে থাকে। ময়না বাথরুমে গিয়ে আধঘণ্টা ধরে ঘৃণা ধুতে থাকে। ডাক্তার বলেছে পনেরোবছর হলো, এইকারণেই বাচ্চা হচ্ছে না। কিন্তু ময়না পারে না। স্বামীও চুপ। অতিথি এলে কিন্তু পরিশ্রম বাড়ে। ঘরে ঝি রাঁধুনি বারণ। অতিথির প্রস্থানে চামড়ায় মোড়া সোফা টেবিল রান্নাঘরের বাসন মেঝে সবেতেই জল ঢালতে ঢালতে দম বেরোয়। তাই এক ওই স্বামী ছাড়া আর কাউকে বরদাস্ত করতে পারে না। অসহায় বুড়িশাশুড়ি অভিশাপ দিতে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর আত্মীয়স্বজন আর সম্পর্ক রাখে না। ময়না এতে খুব খুশি। কারোর নজর সইতে পারে না এখন। কেমন করে তাকায় সব? ভিতরের হাড়-মাংস-কলেজা খেয়ে ফেলবে যেন! এমনকি ফটোর শ্বশুর এমন তাকাতো যে সেটাও দূর করে ফেলে দিয়েছে ময়না। কেউ কেউ বলে, তুই দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছিস যে বড়? আজকাল স্বামী মিনমিন করে বলছে, তোমার ভেজা হাড়গুলো বড় খটখট লাগে। বা, রোজ বিছানার চাদর বালিশ কাচো কেন? ভেজা বিছানায় শুয়ে নিউমোনিয়া হয়েছিল আমার, মনে নেই? শুধু বিছানা নয়। ওই দূরের যত জানালা দেখা যায়, জোড়া জোড়া চোখ যেন ঘরটাকে চাটতে থাকে। তাই ময়না দেওয়ালগুলোও মগের জল ছুঁড়ে ধোয়। কদিন ধরে স্বামীর মুখে মদের গন্ধ। খাবো না, বলে একপাশে শুয়ে পড়ে। আহা! তরল মদ বইতো নয়? শান্ত নির্বিকার পুরুষ। এরচাইতে আর কী ভালো? ময়না অবাধে অন্ধকার ও জলের সাথে স্বাধীন রাত কাটায়।
তবে আজ নয়। আজ রাতে নোংরা বাসীকাপড়ে কোন একটা বারোভাতারি ঢুকেছে ঘরে। স্বামীকে জাপটে ধরে বিছানায় বসেছে। স্বামীর মুখ থেকে তুবড়ির মত গাল ছুটছে। আজ থেকে ওই মেয়েটা রোজ রাতে আসবে। মেয়েটা পান খায়। থুকদানীটা সঙ্গে রেখেছে। যে লাঠি দিয়ে বাথরুমের নালী পরিষ্কার হয়, সেটা দিয়ে এই প্রথম দু’ঘা খেল ময়না। এতদিনের সযত্নে লালিত শৌচ হুহু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। মদের নেশায় স্বামী মা মা বলে হাপুস নয়নে কাঁদছে আর তার রাখেইল নোংরাকাপড়ে চোখ মুছছে। ময়না নিজের চোখ মুছতে পারছে না। চোখের জল অশুচি লাগছে। ওই মেয়েটার আগুনচোখ সহ্য হচ্ছে না। স্বামীর টুকরো টুকরো কথায় বুঝল, আজ শাশুড়ির দাহ কাজ হল। শ্মশান থেকে সোজা ঘরে এসেছে রাখনি সঙ্গে করে? তাহলে এই পৃথিবীতে কি আমি একা? আর কি হবে বেঁচে? এই ভাবতে ভাবতে ময়না একটা মোটা দড়ি সাবান দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল।
তমোনীলছবি
কেউ যেন ইচ্ছাকৃত পরিবেশ অশ্লীল করছে। নাকি পরিবেশ স্বয়ং অশ্লীল? সময় রাত বারো। জোরালো আলোর পাশে অন্ধকার সুকঠিন দেয়ালের কাজ করে। জোরালো আলোয় একদল কুকুরের প্রাকৃতিক যৌনক্রিয়া। অন্ধকার দেয়ালে ঠেস দিয়ে চরমেরা কাজ সারে। মাথার ওপর সমিয়ানা। গুমোট ও বাষ্পীয় উষ্ণতায় ভিডিও তুমুল। প্রতিচ্ছবি ও প্রতিধ্বনি সমেত তমোনীল ছবি। কুকীর্তিরও ছন্দ আছে। ঘাম ও সেন্টের মিশ্রণ। নিস্তব্ধতা খানখান করে পুরুষের রেতঃপাত ও নারীর উত্তেজক শীত্কার মাইক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। একজন ধবধবে সাদা পোশাকের মাথায় সাদা টুপি, পরে আর খোলে। তার পাশেবসা কমবয়েসি টেনিয়া একজন হঠাৎ সোজা হয়ে বসে, চোখ বিস্ময়ে চকচক করে।
-বিশ্বাস হয় না!
-কী বিশ্বাস হয় না? বিরক্ত সাদা পোশাক।
-এই যে একটু আগে মেমসাব কোমর নাচাচ্ছিল আর এখন কোমর উঠিয়ে বাচ্চা দিচ্ছে। তাও আবার জলের ভেতর? আরিব্বাপ! কী জন্মানো রে বাপ!
-কেন? ফুটপাথে, শুওর খুপরীতে, ছোটোলোক পট্টিতে হামেশাই হয়। এতে আশ্চর্য হবার কী আছে?
সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের বর্তুলাকার মাথা এপাশে ঘোরে। ঠং করে ধাতব শব্দ। হিসহিস নিশ্বাসের আওয়াজ। সাইকেল মেকানিক ফিসফিস করে বলে, এখানে বেশি খাপ খুলবেন না সাব, সবার সাথে মিলে মিশে থাকুন। এখানে সবাই সাহেব মেমদের কাজ দেখতে ভালোবাসে। সাদাদের দেখতে ওদের খুব পছন্দ। সুইমিং পুল, দামী গাড়ি, দামী ব্রা-পেণ্টী।
শুভ্র পোশাকের ভয়। বিকৃতকাম, লোভ ও ভয়ের বিভাগটি ঘিলুর ভিতরে এক জায়গাতে রয়েছে।
ভিডিওর ভিতরে মেমসাব। লাইব্রেরীতে ঢুকে নগ্ন হলেন। অ্যালসেশিয়ান হ্যা হ্যা করতে করতে লাফ মারলো। মেমসাব মোটা-মোটা বইগুলো পেড়ে ওর বসার জায়গা করে দিল। এবার ওর কান দুটো ধরে...। আচ্ছা সাব আপনি ওই ওরকম মোটা-মোটা বই পড়েছেন? পড়তে ভাল লাগে?
চোপ চোপ চোপ চোপ!
নানাদিক থেকে আওয়াজ। শুভ্র পোশাকের এবার উত্তেজনা। সাদা পোশাক এখানে বড় বেশি বেমানান। সাদাখাদি সে খুলে ফেলে। দপ করে আলো জ্বলে ওঠে। বিরতি। বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সবাই নিজেকে লুকোবার চেষ্টা করে। কেউ কেউ থুতু ফ্যালে। চটচটে থুতু। কেউ হাসে। কেউ সময় দ্যাখে।
-সাব কী সাদা জামা নষ্ট করে ফেলেছেন?
-না না, তা কেন? ধুর এখেনে কী এসব, ছি ছি!
তাড়াতাড়ি সে খাদি কুর্তা ও টুপি পরে ফ্যালে।
আবার আলো নেভে। পাহাড় ঘেরা নির্জন জলাশয়। লাইন দিয়ে দাঁড়ানো বেশ কয়েকটি নগ্নিকা। জলে একটি মাত্র পুরুষ সাঁতার কাটছে। ঝাঁপিয়ে পড়ল। দশটি উলঙ্গ নারী জলে একসাথে গোল হয়ে পুরুষটিকে ঘিরে ফেলল। যৌন উত্তেজনা জাগাবার নানারকম কলা কুশলী। ক্লোজআপে অঙ্গসমূহ। পুরুষটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। যৌনতার চরম মূহূর্তে তার পুরুষালী আনন্দসূচক হঠাৎ ভয়ার্ত চিৎকারে বদলে গেল। অন্ধকারে মাথাগুলো সোজা হয়ে গেল।
-কে? কে হিরোটা?
সাইকেল মেকানিকের চাপা ভীত স্বর। সাদাকুর্তার অস্পষ্ট দুর্বোধ্য আর্তনাদ। স্ক্রীনে উন্মুক্তঅঙ্গ সমেত প্রতিটি নারী অসম্ভব বিষণ্ণ। প্রতিটি দর্শক ‘আমি ও যে আমি’ বলে চিত্কার করে ওঠে।
.
তালকাঠের মূর্ধা
অনতিক্রম প্রান্তর। যতদূর চোখ যায় সিঁড়ির মত শুখা জমির উপর গাছের গুঁড়িপোড়া কালো কালো ছোপ। আছে কয়েকটা ন্যাড়া পোড়া মৃত তালগাছের স্তম্ভ। কালবোশেখের সময় ফাঁকা জমিতে নির্বাধ প্রতিদ্বন্দ্বীহীন বিদ্যুৎ খেলে বেড়ায়। তখন ওই তালস্তম্ভগুলি দিয়ে চিড়চিড় করে বিজলি নামে।
ধরিত্রী যে বিপুল বিদ্যুতাধার! আগে যখন সারি সারি তালগাছের বন ছিল তখন মানুষজনের ছিল নির্ভয় বাস। এখন ফাঁকামাঠ বজ্রপাতের ভয়ে সুনসান। তখন তালবনের মাঝে গ্রামের হাট বসতো, মুন্ডমালা হাট। মাটির হাঁড়িতে তাড়ি, কখনো তালশাঁস, পাকাতাল। আর থাকতো তালপাতার পাখা, কুলো চাটাই বাহারি সাজ এবং ঘর ছাওয়ার নানা উপকরণ। মরা হাতি আর মরা তালগাছ দুইই লাখ টাকার। তখন প্রতি হপ্তায় থাকতো পাইকারিদের ভিড়। এখন পশুপাখিও নেই। বছরকয়েক আগে মেহেরপুর চাঁদপুর থেকে বেশ কয়েকজন লোক এসে গোড়াশুদ্ধু গাছ কেটে নিয়ে গেছে তালকোন্দা বানিয়ে ব্যবসা করবে বলে। তালকোন্দা ডিঙির চেয়েও জলে বেশি তীব্র।
বহুদিন বাঁঝা হয়েছিল মাঠ। আবার লোকজন আসতে শুরু হলো। সার্ভেয়ার খনিতত্ত্ববিদ এম-এল-এ ধনী ব্যবসায়ী। দামী দামী গাড়ি, মাপজোক। এবং একটা অস্থায়ী কুঁড়েঘর ও জমির রক্ষক। সে স্থানীয় বাসিন্দা দামোদর মহতো। অচিরেই মাটির নিচ থেকে বেরোবে অতি সুপরিবাহী আকরিক তামা।
এককালে তালকাঠের সাঙা (কড়িকাঠ), ভাগটান, বাটাম ও ছালা তৈরির শিল্পী ছিল দামোদর। চালাঘরের কাঠামো বানাতে সারাজীবন তালকাঠ ছাড়া আর কিছু চিনল না। কোন কাঠ কত পুরনো, বাজ টেনেছে কি না, কতদিন ধরে কত হাঁড়ি রস বানিয়েছে, কত ঝড় সয়েছে, এমনকি সংলগ্ন মাটি শুকনো না ভেজা সেও বলে দিতে পারতো। কিন্তু পঞ্চাশ ফুটের ঢ্যাঙা গাছ বাদে মানুষ চিনতে পারেনি সে। দুটো জিনিষে ভয় ও ঘেন্না। ধনী মানুষের সহানুভূতি আর বাজপোড়া তালকাঠ।
দুইই ধোঁকাবাজ। এখন দুটিই তার অভাগা কপালে জুটল। কাকে দিয়ে যে এই ঘুপচি চালাঘরের মূর্ধাসাঙা ভাগটান বানিয়েছে, স্পষ্ট দেখা যায় ওই কড়িকাঠ বেশ কয়েকবার বাজ খাওয়া। এই ঘরে থেকেই দিনরাত দামোদরকে জমি পাহারা দেবার কাজ করতে হবে? হে ভগবান!
আজ জমির ভিতপূজো। দামীগাড়ি। বিরাট মঞ্চ। খননমন্ত্রী, সার্ভেয়ার, অঞ্চলপ্রধান, খনিবিশেষজ্ঞ, স্বপার্টি, বিরোধী পার্টি আরও অনেকজন। রাতভর পার্টি, মদের ফোয়ারা। বড়লোকেরা মেয়েছেলে নিয়ে বাজপোড়া গাছের নিচে উদোম। চক্ষুলজ্জ্বায় ছোটোলোক দামোদর ঝুগ্গির ভেতরে। ভেতর বাহির অস্বস্তি। দামোদরের কাছে ঝোপড়ির ভিতরে থাকাই ঠিক লাগলো। বৈশাখী আকাশে ধুলোমেঘ। অস্পষ্ট গুম গুম শব্দ। আসছে বিদ্যুৎ ঝড়বৃষ্টি। ভাঙ্গুক মূর্ধা। যাই হয়ে যাক, মরি মরবো তবু ওই ন্যাংটামো দেখবো না। আজ কোনমতেই বাইরে বেরব না!
বাইরে অশ্লীল চিত্কার ও উন্মত্ত মিউজিক ছাপিয়ে এবার কানফাটা বজ্রের শব্দ। সারারাত ধরে চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ খেলে বেড়াতে লাগলো ফাঁকা মাঠে। দামোদর সেই যে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল ঘরের ভিতর, চোখ খুলল ভোরে। দামোদর ঘরের ভিতরে ঢুকে কড়িকাঠকে প্রণাম করল। বাইরে বেরিয়ে দেখল মাঠ যেন মৃতপুরী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিদ্যুৎপৃষ্ট শব।
.
পৃথিবীর অন্তিম খাটা পায়খানার মেথর ও তার মনিবেরা
থানার পাশে যাদের ঘর তাদের নিজেদের মনের সাথে খুব সমঝোতা করে চলতে হয়। হরেকরকম পুলিশ তার হরেকরকম চাউনি। হরেকরকম হরকত। সেই তুলনায় হাতকড়ি বেড়ি আর দড়িতে কোনো কয়েদিকেই কাতর দেখে না চদু, মানে চন্দন। ওরা কিন্তু মনের দিক দিয়ে নিশ্চিন্ত। যা হবার তাতো হয়েইছে। দু একটা ডান্ডা পড়বে আর কী! থার্ডডিগ্রি আজকাল উঠে গেছে। আর জেল বা হিসসা তো ভবিতব্য। কিন্তু ভাবের রকমফের যত ওই পুলিশদের। থানার পাশে বাস, তাই বুঝি ওদের মুখের ভাব পড়তে একটা আদত হয়ে গেছে চন্দনের না কি? একটা বিচ্ছিরি নেশা। মনের আর দোষ কী? সারাদিনে তো ওই একটিই কাজ। থানার পিছনে ডোবা। পাড়ে রাখা একটা খালি টিন নিয়ে পাশেই খাটা পায়খানার পিছনে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে মালবোঝাই টিন টেনে এনে খালি টিন জায়গায় সেট করে দেওয়া আর ভর্তিটা মাথায় করে নিয়ে গিয়ে ওই ডোবায় ঢেলে দেওয়া। ব্যাস। সারাদিন আর কোনো কাজ নেই। মাস গেলেই মাইনে বরাদ্দ। চন্দন নামের পাশে টিপছাপ দিয়ে টাকা নেবার সময় কখনো কখনো জমাদার চন্দন নামটি মনে করিয়ে দেয়। মলয় চন্দন বলে হাঁক পাড়ে আর হা হা হাসি। চদু জানে না চন্দনের গন্ধ কেমন। কথাটা ভাবে আর ভুলে যায়। রোজ চদুর শুধু থানার গেটের পাশে ওর ঝোপড়িতে বসে পুলিশ চোরের আনাগোনা দেখা। পুলিশ দেখলেই ওর চাউনি দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে চদুর। মনে ধন্দ, বছর বছর এমনিভাবে দেখতে গিয়ে আমি বকস (ডাইনির পুং লিঙ্গ) হয়ে গেলাম না তো? তা নাহয় হলে কী ক্ষেতি? আমি কি ওদের দুশমন? ওদের চোখে মুখে রকমারি লোভ নানান অতৃপ্তি। হ্যাঁ, একটা বড় তৃপ্তি, ওই পোশাক। পোশাক হলো ওদের বড় অস্ত্র, বড় খোলস। এটা সার বোঝে চদু। ওই যে পুলিশ পোশাকে মানুষটা আসছে? ওর চোখে চাকু ছুরি ঝলকায়। ওর খুন করার বড় শখ। কাউকে ও ভালো দেখতে চায় না। আমাকেও না। ও মাথায় বাড়ি মারে। দুচারবার মারতে লাঠি উঠিয়ে ছিল, মারেনি। ঘেন্না। চদু ভাবে, ভালোই। যে জিনিষটায় মানুষের সবচে ঘেন্না পিত্তি, সেটাই তার আত্মরক্ষার অস্ত্র হতে পারে। তো কিসের ভয়? তবে সবাই কি সেরকম? একজন আছে। সে কাছ দিয়ে পেরোলেই মিষ্টি ফুলের গন্ধে ভরে যায় চারপাশ। অমায়িক হাসে। চদুকে বলে, আর কটা দিন সবুর কর রে। পাকা পায়খানা হবে। আর তোকে গুয়ের টিন বইতে হবে না।
.
সোনালি বেগম
সংক্রমণ : ঘরে এবং বাইরে
ভোর দুটো-তিনটে বাজে। মোবাইলে টেক্সট মেসেজ আসছে। আমি গুঞ্জন ত্রিপাঠী, একজন ফিমেল কোভিড ভলেন্টিয়ার। মোবাইল রিং হচ্ছে। এটা আমার তথা আমাদের ডিউটির মধ্যেই পড়ে।
হাসপাতালে অনেকগুলো বেড দরকার। ক্রিটিকাল পেশেন্টদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স অ্যারেঞ্জ করতে হচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার হন্যে হয়ে খুঁজছি সারাদিন। অসংখ্য মানুষের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। এই প্যানডেমিকের দ্বিতীয় ওয়েভ ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রতিটি ক্ষণ কী ভয়ংকর হতে চলেছে। হায় রে, এপ্রিল-মে ২০২১! গভীর রাতেও কত অসহায় মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। অ্যাম্বুলেন্সের হুটার জানিয়ে দিচ্ছে এমারজেন্সির ব্যাকুলতা। অ্যাত-অ্যাত মৃত্যু! সংক্রমণ সাড়ে চার লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন।
এরই মাঝে কিছু ননসেন্স টেক্সট বা ফোনকল্ আসছে–––‘Can you find a bed for both of us?’, ‘Can you share your picture?’, ‘ডার্লিং বুলায়া তোহ্ গলতি ক্যায়া হ্যায়?’
কোভিড পেশেন্টদের সাহায্যে দিল্লি, গাজিয়াবাদ, ফরিদাবাদ, নয়ডা, গুরুগ্রাম-এ ব্যস্ত কিছু ফিমেল কোভিড ভলেন্টিয়ার। অক্লান্ত পরিশ্রম করে দিনরাত এক হয়ে যাচ্ছে আমাদের।
ভোর চারটে। ‘হ্যালো’
‘Where are you located?’
‘I am in Delhi. What is the patient’s SpO2 levels?
‘ম্যায় নেহি বাতা রাহা, ম্যায় তেরে ঘর আকে বাতায়ুংগা...’
স্তব্ধ হয়ে সেই-সেই পুরুষকণ্ঠের ফোননম্বরগুলো ব্লক করে দিই। অন্ধকার শেষে পুবের আকাশে তখন আলো ফুটে উঠছে...
হারিয়ে যাওয়া ক্যানভাস
তেরে ক্যানভাস পর উতরুংগী
ইয়া তেরে ক্যানভাস পর
এক রহস্যময়ী লকীর বন
খামোশ তুঝে দেখতী রহুংগী
---- অমৃতা প্রীতম
ঘন কালো মেঘের চাদরে বিজলি চমকাচ্ছে। প্রেম কি শুধুই মানসিক ক্ষুধা নাকি শারীরিক, শুভা ভাবছে। ছন্দাও ভাবছে। আবার অ্যাডি অর্থাৎ অধিরথও ভাবছে। একটি ত্রিভুজের তিনটি কোণে বিরাজমান অদ্ভুত ত্রিকোণ প্রেম বিনির্মাণ হতে চলেছে। শুভা অ্যাডির কথা ভাবছে। অ্যাডি ছন্দাকে চায়। কিন্তু ছন্দার মধ্যে কিছু মানসিক অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। সে একান্ত ভাবেই শুভাকে চায়। এ আবার কেমন ধারার ভাবনা!
অ্যাডি বাঁশি বাজাচ্ছে, সেই বাঁশির সুরে কেঁপে উঠছে কদমগাছের ডালপালা। চাঁপাফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। নানারকম নাম-নাজানা ফুলের সৌরভ ছেয়ে আছে। ঘন জঙ্গল আনন্দে মেতে উঠেছে। সামনেই সিমেন্টের বেদিতে ওরা তিনজনেই বসে পড়ল। কয়েকটি কদমফুল ঝরে পড়ল মাটিতে। দুটি চামূর্তি ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে। ঘোড়া খুবই সমঝদার জীব। নিজের সম্পর্কে সে খুবই সচেতন। অ্যাডি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে। শুভা এবং ছন্দার প্রতিক্রিয়া পেতে সে একাই ঘোড়া ছুটিয়ে খানিকটা চক্কর কেটে ফিরে আসে।
অ্যাডি ছন্দার পাশে এসে বসে, কিন্তু ছন্দা নির্বিকার ছন্দে বলে যে তার কোনো পিতৃপরিচয় নেই। প্রতিউত্তরে অ্যাডি জানায় যে তার কোনো মাতৃপরিচয় নেই। শুভা দুহাত ছড়িয়ে জানায় যে সে তো মাতৃ এবং পিতৃ পরিচয়হীন!
বাদানুবাদ শুরু হয়ে গেল। এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা। গাছের পাতার জল ঝরে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে এখন। আকাশে মেঘগর্জন আর অঝোর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ছন্দা ও শুভা দুজনে দুটি ঘোড়ায় চড়ে বনের পথে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। বংশ পরিচয়ের লতাপাতায় কিছু খড়কুটো খুঁজতে থাকল অ্যাডি।
.
মাঝনদীর বটবিক্ষ-লতা
রাস্তার ওপাশে ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে। আর রাস্তার উল্টো দিকে মজুরদের অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা। দরজা বলতে ময়লা কাপড়ের পর্দা ঝুলছে আর ইঁট সাজিয়ে তিনটে দেয়াল উপরে উঠে গেছে। কিন্তু পলিথিন চাদর শুকনো গাছের ডালপালা বিছিয়ে ঘরের চাল তৈরি হয়েছে।
মাঝরাতের অন্ধকারে কুকুরের ঘেউ ঘেউ একটানা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দরজার পর্দা সরিয়ে দেখতেই একজন লোক ছুটে পালাচ্ছে নজরে এল। লোকটি চোর নাকি ভালোমানুষ! ভালো করে চারপাশটা দেখলাম। একপাল কুকুর ঐ লোকটির পেছনে শুধু ছুটছে। দরজাটা মানে পর্দাটা সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। অমাবস্যা রাত। শুধু স্ট্রিট লাইটের আলোয় পা রাখলাম রাস্তায়।
লোকটা সামনে আসতেই দেখি, এতো এ পাড়ার মদন মজদুর। সারাদিন বালি সিমেন্ট ইঁট নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে। আমাকেও মাথায় ইঁট তুলতে সাহায্য করে। আর এখন রাতের অন্ধকারে বেশ ভালোই দেশি বোতল সেবন করেছে। টলমল পায়ে কাছে এগিয়ে এল মদন, বলল, ‘চল্, তোর ঘরে নিয়ে চল্, বুলটি’
আচমকা মদন আমার ঘরে আসার বায়না শুরু করে দিল। কী আপদ!
‘তোমাকে কীসে ভর করল আবার?’
‘বুলটি, তোর জন্য ভেবে ভেবে’
এক প্রকার জোর করে আমার হাত ধরে রাস্তায় ছুটতে থাকল মদন। মাঝ রাতের শুনশান পথে শ্মশান পৌঁছে গেলাম আমরা। সামনে বয়ে যাচ্ছে ময়ূরাক্ষী নদী। শ্মশানঘাটে কতক্ষণ আমরা বসে থাকলাম।
‘জানিস বুলটি, আর কটা দিনই বা বাঁচবো! আমার টিবি হয়েছে রে’
‘মালিকের কাছে দুদিন ছুটি নিয়ে হাসপাতাল যাও। ডাক্তার-বদ্যি করো’
‘চল্, নৌকায় মাঝনদীতে যাই। যাবি?
বুলটি গান গাইতে থাকে সেই গানটা, ‘তুমি হইব বট বিক্ষ আমি হইব লতা / দু-জনেতে জইড়ে রইব / কইব পেমের কথা...’
ময়ূরাক্ষী নদীর ধার ঘেঁসে চলতে চলতে সেই অমাবস্যার অন্ধকারে কিছু স্বপ্ন ভাঙাগড়ার মাতাল-আচ্ছন্নতা জড়িয়ে ধরল আমাদের।
মদন আক্ষেপ করল, ‘আর মজদুরি করবো না আমরা। তোকে বিয়ে করবো। একটা মুদির দোকান দেবো। তুই হিসেব ভালো পারিস। চলে যাবে সংসার...’
সন্ধ্যের পর কাচা জামাকাপড় পড়লে মদনকে বেশ হিরো-হিরো লাগে আমার। যেমনটা হিন্দি সিনেমায় দেখি।
মদন হিপ পকেট থেকে মোবাইল বের করল। আমাদের দুজনের ক্লোজ সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে দিল। বেশ জোরে জোরে খানিক হাসলো সে। ‘আমি থাকতে কোনো গুন্ডা বদমাইশ তোকে ছুঁতে পারবে না, বুলটি।’
দরজার এপার-ওপার
“দুনিয়া জিসে কহতে হ্যাঁয় জাদু কা খিলৌনা হ্যায়
মিল জায়ে তো মিটটী হ্যায় খো জায়ে তো সোনা হ্যায়”
----- নিদা ফাজলী
সব দিকে শুধু কনফিউশন। জোলো বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সব সময় টেনশন, বুক ধড়ফড়। গাঢ় নিশুতি রাতে, বাড়ির পথে এগিয়ে যায় মাধুরী। একটি প্রাইভেট নার্সিংহোমের নার্স সে। একটু উপরি টাকার জন্য ওভারটাইম করতে হয় তাকে। ঘরে অসুস্থ বাবা, মা। ছোটোবোনের স্কুলের খরচ। সবটা তাকেই সামলাতে হয়।
কী আশ্চর্য! আজ স্ট্রিট লাইটগুলো সব ফিউজ হয়ে গেছে। ভয়ার্ত চোখে মাধুরী ধীরে ধীরে পথ ধরে সামনের দিকে এগোতে থাকে। হঠাৎ হাতের উপর আর একটি শক্ত হাত চেপে ধরল। উঃ... উঃ... যন্ত্রণার স্মৃতির সরণি ধরে মাধুরী বুঝতে পারল পাড়ার সেই ভদ্রলোক স্বপন মাল। খ্যাঁকখেকে হাসি হেসে সে বলল, ‘মাধু, আজ তাহলে চল আমার ফ্ল্যাটে?’ আচমকা এই তথাকথিত ভদ্রলোকটির গালে সপাটে একটা থাপ্পড় কষালো মাধুরী।
‘আ হা, রাগ করিস কেন? জানিস তো তোকে কত ভালোবাসি।’
ছিটকে সরে যায় মাধুরী। তার মাথার ভেতরে অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে। সে কোনোরকমে হাত ছাড়িয়ে দৌড়োতে শুরু করে।
বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছে দেখে খোলা দরজায় ছোটোবোন দাঁড়িয়ে। আবছায়া আলোয় সেই অশুভ শক্তি গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকে।
‘দিদি, তুই এত রাতে বাড়ি ফিরলি?’
হাঁপাতে হাঁপাতে মাধুরী দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে। বাবার কাশিটা বেড়েছে। মায়ের সুগার। সাইডব্যাগ থেকে ওষুধগুলো বের করে সে।
‘রোজ রোজ ঐ মাতাল লোকটার সঙ্গে ঘরে ফিরিস, লজ্জা করে না তোর?’ মায়ের চোখেমুখে আগুন ঝরে পড়ছে।
‘মা, লোকটাকে তো কোনো পাত্তা দিই না আমি, বিশ্বাস করো’!
‘ঘর থেকে বেরিয়ে যা মুখপুড়ি। মরে যাবো আমরা, তবুও তোর আয় করা টাকায় খাবো না।’
বাবা মা-র দুর্বল হাতগুলি ঠেলতে থাকলো তাকে দরজার বাইরে। বোন মল্লিকা দরজার কপাট সপাটে বন্ধ করে দিল।
মেঘের অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে মাধুরী চলন্ত অটো-য় চড়ে বসলো। চারদিকে তখন বজ্র-বিদ্যুৎসহ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
.
ডোরবেল বাজছে
স্মৃতিকণা অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। বাইরে রাস্তায় আলো জ্বলে উঠছে। অন্ধকার বারান্দায় আবছায়া-আলো ছড়িয়ে পড়ছে। রাতের স্তব্ধতা চুরমার করে রাস্তায় গাড়িগুলো ছুটে চলেছে। রাস্তার পাগলমেয়েটার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। স্মৃতিকণারও ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। সে এই মুহূর্তে একদম একা। তাই অচেনা কাউকে তার ঘরে আশ্রয় দিতে পারছে না। একতলা বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকায় স্মৃতিকণা। এমন সময় ডোরবেল বেজে ওঠে। একটা ঘোরের মধ্যে দরজাটা সে খোলে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বছর কুড়ির সেই পাগলমেয়েটি আর পাড়ার কতকগুলো বাচ্চা ছেলে-মেয়ে। ছেলে-মেয়েগুলো ছুটে পালিয়ে যায়। মেয়েটি হাসতে থাকে এবং ঘরের ভেতর এক প্রকার জোর করেই ঢুকে পড়ে। স্মৃতিকণা পেছোতে থাকে, ধীরে ধীরে বারান্দায় পৌঁছে যায় সে, সঙ্গে সেই মানসিক বিক্ষিপ্ত মেয়েটিও।
‘তোর নাম কি?’
‘পাগলি, পাগলি বলেই সক্কলে ডাকে।’
স্মৃতিকণা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে যে সে কোথা থেকে এপাড়ায় এসেছে। পাগলি এদিক-ওদিক ফ্যালফ্যাল করে দেখতে থাকে, কোনো উত্তর দেয় না।
স্মৃতিকণা রান্নাঘর থেকে ভাত-ডাল-সবজি নিয়ে আসে। পাগলি গোগ্রাসে খেতে বসে যায়।
এই নির্জনতায় মানসিক বিক্ষিপ্ত সঙ্গীর সঙ্গে খানিকক্ষণ বসে থাকা যায় হয়ত। কিন্তু এরপর কাউকে সাহায্যের জন্য ডেকেও সাড়া পাবে না সে। সদর দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে সে দেখে, খাওয়া-শেষে বারান্দার মেঝেতে শুয়ে পাগলি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।
মনের অশান্তভাব সরাতে স্মৃতিকণা সিগারেট ধরালো। চেয়ারে বসে একফালি তারায় ভরা অমাবস্যার আকাশ দেখতে থাকলো সে। টেবিলে রাখা ছাইদানি ছাই-এ-ছাই-এ ভরে উঠতে থাকলো। গভীর রাতের সদর দরজায় আবার ঘন-ঘন ডোরবেল বেজে চলল। সঙ্গে কুকুরের ডাক। কে এল? কোনো সমাজবিরোধী? কোনো চোর? নাকি কোনো পাগল?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।