বোঁচকার দিকে : মলয় রায়চৌধুরী.
ডায়েরি লিখেছিলুম বটে। পুড়িয়ে ফেলতে হল। তার কারণ আমি একজন লেচার। সবকিছু আমি পুরে দিয়েছি আমার উপন্যাসগুলোতে আর ছোটোলোকের জীবন বইতে। ছোটোলোকের জীবন লেখার কারণে জ্ঞাতিগুষ্টির গালাগাল খেয়েছি, খাচ্ছি। গালাগাল ব্যাপারটা ফালতু, শৈশবে ইমলিতলায় জেনেছিলুম। এখন মনে হচ্ছে বেশ কিছু ঘটনা পাঠকরা মেলাতে পারেনি। তাছাড়া আচমকা এমন কথা মনে পড়ে যা উপন্যাসে আর স্মৃতিকথায় ঢোকাইনি। সেগুলোই এক, দুই, তিন করে লিখছি।
.
১. পাপিয়া জেরিনের বৈভব স্টলে একজন তরুণীর ছবি দেখে, যিনি মাথায় নানা রকম ফুলের মালা পরেছিলেন, পাপিয়ার কাছে জানতে চাইলে উনি বললেন, ‘উনি সেঁজুতি আপা, আপনার প্রবন্ধের বই কিনেছেন।’ বাংলাদেশের যুবতীদের কাউকে আমি আপা বলি না, ওনারা চটে যান; নাম ধরে ডাকতে বলেন। যেমন উপমা আফরীন খেয়া, আসমা অধরা। পাপিয়া জেরিন বেশ মোটা আর ফর্সা। বাজুবন্ধ-পরা ওনার হাতের ফোটো পাঠিয়ে ছিলেন; সেটা বইপোকা গ্রুপে পোস্ট করায় সে কী গালাগালির ধুম, বিশেষ করে তরুণীদের। তরুণীরা জানেই না যে তাদের গালাগালের থুতুর ছিটে আমার কাছে শীৎকার হয়ে পৌঁছোয়। দেশভাগের ফলে সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, তাঁরা ওই পারে।
.
২. মুকুলের প্রোস্টেট অপারেট করা যাবে না, মাপে বড়ো হয়ে গেছে আর ব্লাডারের দেয়াল পাতলা হয়ে গেছে। অহরহ পেচ্ছাপ বেরিয়ে যায়। বেলা ওর পেচ্ছাপ সামলাবার জন্যে লেংটির মতন করে রোজ একটা কাপড় বেঁধে দেয়। পুরুষের যৌনাঙ্গের সঙ্গে নারীর অদ্ভুত এই সম্পর্ক। মনে আছে, বাসর ঘরে মুকুল গেয়েছিল, ‘আমি যে জলসাঘরের বেলোয়াড়ি ঝাড়।” গানের মাঝে কেউ একজন ফুট কেটেছিল, ওরে ওটা ঝাড় নয়, উত্তমকুমারের আঁড়।
.
৩. রবীন্দ্রনাথ প্রোস্টেট অপারেট করাতে চাননি। তখনকার দিনে লিঙ্গের ভেতর দিয়ে তার ঢুকিয়ে প্রোস্টেটকে কুরে কুরে ছোটো করা হতো। যন্ত্রনা হতো অসহ্য। ভূমেন্দ্র গুহ বারণ করেছিলেন সমরেন্দ্র সেনগুপ্তকে, তবুও উনি করিয়েছিলেন, আর মারা গেলেন পেচ্ছাপের সঙ্গে রক্ত বেরোনোর যন্ত্রণায়। সুনীল গাঙ্গুলি ভূমেন্দ্র গুহের পরামর্শ মেনে নিয়েছিলেন; অপারেশন করাননি।
.
৪. মুকুলের ভাই তপনের মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল বড়োলোক পাত্র, ভালো আয়, বাড়ি, গাড়ি দেখে। বরটা তপনের মেয়েকে মারতো, কামড়ে দিতো। মেয়েটা বেশ সুন্দরী; নাটকে অভিনয় করতো, ছেড়ে দিতে হলো শাশুড়ি আর বরের বেদম প্রহার সহ্য করতে পারেনি মেয়েটা। একদিন শশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে মোবাইলে মুকুলকে ফোন করে দৌড় লাগায়। মুকুল ওর স্কুটারে তুলে নিজের বাড়ি নিয়ে এলো। নানা ঝামেলার পর ডিভোর্স হলো বটে কিন্তু বরটা মোবাইলে নানারকমের যৌন মেসেজ পাঠাতো। তপন অনেক খোঁজাখুঁজি করে বিদেশের এক বাঙালি যুবকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে অতীতের সঙ্গে মেয়েটাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ভারতমুখো হয় না মেয়েটা। সলিলা বলেছিল, যখন ছেলের সম্বন্ধ আসে, ফিল্মস্টারের মতন সুন্দরী মেয়ে চলবে না; ওরা সংসারের ক্ষতি করে।
.
৫. গাঙ্গুলি। নামটা মনে নেই। লখনউতে আমার অধস্তন কর্মচারী ছিল। ছেলের বিয়ে দিল, বাচ্চা হল, ডিভোর্স করে চলে গেল মেয়েটা। গাঙ্গুলি এসেছিল মুম্বাইতে আমার সঙ্গে দেখা করতে, অবসরের পর। ছেলে চাকরি করতো মুম্বাইতে। ডিভোর্সি বউ চাকরিতে বদলি হয়ে মুম্বাইতে এসে ডিভোর্সি বরের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে। বয়স ফুরিয়ে যাবার আগে যৌন সম্পর্কের আশ পুরোপিরি মিটিয়ে ফেলতে চায়।
.
৬. জীতেন্দর প্রসাদ। পাটনা থেকে বদলি হয়ে মুম্বাই এসেছিল। দুটো কলেজগোইঙ ছেলে। বউটা মারা জেতে জিতেন্দর প্রসাদ কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে এক মারাঠি বিধবাকে বিয়ে করে ফেলল। বলেছিল, বিছানায় একা শুতে পারে না; একজন মেয়েমানুষ তো চাইই চাই। জীতেন্দর প্রসাদ মারাঠি ভাষা জানে না। বউটা বিহারি রান্না জানে না। জিতেন্দর প্রসাদ বলেছিল, ভাষার দরকার হয় না বিছানায়।
.
৭. লিফলেট ছাপিয়ে লেখালিখি শুরু করেছিলুম। বিনামূল্যে বিতরণ ছিল লক্ষ। তারপর এক ফর্মা বা দেড় ফর্মা। তারপর মহাদিগন্তের সস্তা বই। তারপর দাদার হাওয়া৪৯ পত্রিকায় উপন্যাস। কুড়ি টাকা দাম ছিল ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, নামগন্ধ, নখদন্ত বইগুলোর। বীজেশ যখন আমার বইয়ের দাম ৫০০, ৬০০, ৭০০ টাকা রাখা আরম্ভ করল, আমার কেমন যেন ভয় করতে লাগল। সেই হয়ে ওঠা জিনিসটার ভয়, যা আমি হতে চাই না; ইমলিতলার লোকগুলোর মতন থাকতে চাই। রাজীব সিংহ যখন আমার একটা বইয়ের দাম রাখল ১০০০ টাকা কেমন যেন হারিয়ে যাবার বোধ হল, মানে, নিরুদ্দেশ। রাজীব দাম কমাবার পরও সূদীপ্তা চৌধুরী নামের তরুণী কিনে নিয়ে গেলেন। আমি হারিয়ে যাই অথচ কেউ কেউ আমাকে খুঁজে নিয়ে আসে। যেমন ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো।
.
৮. কপুলেশানকে বাঙালিরা বলে ‘শোয়া’। তার মানে মিশনারি পোজ ছাড়া বাঙালিরা অন্য পোজিশান পছন্দ করে না। ডগি স্টাইল, লেডি অন টপ, লেগস ইন দি এয়ার, ওরাল, কাউ গার্ল, রিভার্স কাউ গার্ল, স্পুনিঙ, লোটাস, দাঁড়িয়ে ইত্যাদি কতো রকমের পোজিশান আছে। কপুলেশানের সঠিক বাংলা নেই। নেই বলে আমি প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতায় ধর্ষণ শব্দটা প্রয়োগ করেছিলুম, ফলে যা বলতে চেয়েছিলুম তার বদলে ভিন্ন বার্তা চলে গেছে পাঠকের কাছে। ড্যানিয়েলা নিজের আলোচনায় লিখেছে যে কবিতাটায় মেডিকাল শব্দ বেশি প্রয়োগ করা হয়েছে।
.
৯. সান্মানিক স্নাতক পড়ার সময়ে উমা ভর্মাকে একদিন গৌর সিনহা জিগ্যেস করল, ক্লাসরুমের বাইরে বারান্দায়, “তুমি যখন পেচ্ছাপ করো তখন কি বাঁশি বাজাবার শব্দ হয় ?” উমা ভর্মার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছিল, হাই হিল জুতোটা খুলতে যাচ্ছে, দেবে পিটুনি। তার বদলে বলল, “তুই কেমন করে সান্মানিক স্নাতকে সিট পেলি”। গৌর সিনহা আইপিএসে সফল হয়ে এসপি হয়ে গেল আর উমা ভর্মা মজফফরপুর কলেজে অধ্যাপিকা, পরে হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট।
এটা চলবে
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।