শীতল চৌধুরী : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’
দেশে-দেশে যখনই স্রষ্টার কলম নিয়ে নতুন পথের পথিক হতে চেয়েছেন যে সব কবিরা, তখনই অগ্নিশর্মা হয়ে বাধাস্বরূপ দাঁড়িয়েছেন চিরাচরিত ভাবধারায় আচ্ছন্ন ছুঁৎ-মার্গীরা। বহু কবিকুলকে এ-জন্য ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হজম করতে হয়েছে; সময়ে-সময়ে আ-জন্য দণ্ডভোগও করতে হয়েছে। কঠিন জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
ফরাসিদেশের আধুনিক কবিদের পুরোধা বোদলেয়ারের নাম বিশেষভাবে করা যায়। ছুঁৎ-মার্গীদের কাছে তিনি জীবিতাবস্হায় ছিলেন অচ্ছুৎ। হাংরি জেনারেশনের প্রধান পুরোহিত তাঁর সময়কালে যে নতুন সাহিত্য পথের পথিক হয়ে ছুঁৎ-মার্গীদের কোপে পড়বেন এটাই স্বাভাবিক লএজন্য স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীকে শ্রীঘরেও অতিথি হতে হয়েছে। কবি চসারের In the sowre hungry tyme পংক্তিটি থেকে হাংরি শব্দটি তুলে নিয়ে ১৯৬১-এর নভেমবরে নতুন বাংলা কবিতা আন্দোলনের পুরোহিত মলয় রায়চোধুরী যে পত্রিকা প্রকাশ করেন তার নাম রাখা হয় হাংরি জেনারেশন। এই শব্দের আড়ালে প্রচ্ছন্ন রয়েছে যে অর্থটি তা হলো ক্ষুধা।
এ-ক্ষুধা যে মানবিক, দৈহিক ও শারীরিক, এবং চিরাচরিত বস্তাপচা মূল্যবোধকে ভাঙার, তা বোধকরি বলা অনুচিত হবে না। রোমান্টিসিজমের ছাঁচে বন্দী চিরাচরিত ভাবলোক থেকে আত্মানুসন্ধানে বেরিয়ে এসে মলয়বাবু বাংলা কবিতাকে অস্তিত্ব-সংকট থেকে মুক্তি দিয়ে এক নতুন আত্মদীপের সন্ধানে মুখর করতে চেয়েছেন। কবিতাকে দাঁড় করাতে চেয়েছেন যৌনতা, জান্তব ক্ষুধা ও জৈবতার মধ্যে এক জীবন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি। প্রচণ্ড জান্তব ক্ষুধাকে সঙ্গী করে তিনি চেয়েছেন বাংলা কবিতার দিকবদল ও অন্তরাত্মার মুক্তি। হাংরি জেনারেশন-এর মূল মন্ত্র এটাই।
মলয়বাবুর প্রথম বুলেটিনের তাত্ত্বিক ভাঢ়েই তা পরিঢ়্কার: “ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিবে চালাবার খেলা এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন। টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেকসে কলম ডুবিয়ে কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে। এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে। সেহেতু ত্রশ্নু বলাৎকারের পরমূউর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে সচেতনভাবে বিহ্বল হলেই কবিতা সৃষ্টি সম্ভব। শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত।
শখ করে, ভেবে-ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু কবিতা রচনা তেমন করে আর কোনোদিনই সম্ভব নয়। অর্থব্যম্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনিপারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধানিবৃত্তির শক্তি না থাকলে , কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতো অনুন্মেষিনী হয়ে যেতে পারে। ” অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির সামর্থে তিনি কবিতাকে স্হাপন করতে চেয়েছেন বস্তুগত জীবন ও আত্মিক জীবনের পারস্পরিক মেলবন্ধনে। এ-কারনেই কিনা জানি না, মলয়বাবু তাঁর বহু বিতর্কিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটিতে অস্তিত্বের সংকটকে বড়ো করে দেখিয়েছেন। কবিতাটির শুরুতেই তিনি যখন সোচ্চারে এ-কথা বলেন— “ওঃ মরে যাবো মরে যাবো মরে যাবো আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে আমি কী কোর্বো কোথায় যাবৌ ওঃ কিছুই ভালো লাগছে না সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবো শুভা শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায় সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর আমি পার্ছি না, আজস্র কাচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে” আমরা এখানে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি কবি মলয়ের আন্তরের আস্তিত্বের সংকট কি ভয়ানকভাবে চেপে বসেছে, তাই তিনি চামড়া জ্বলার মধ্যে দিয়ে তাঁর যন্ত্রণার কথা যেমন ব্যক্ত করেছেন, তেমনি সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবার কথাও প্রেমিকা শুভাকে বলছেন।
তবু আস্তিত্ত্বের সংকট থেকে পালিয়ে যাওয়া তো জীবনের ধর্ম হতে পারে না —তাই পরক্ষণে তিনি শুভার তর্মুজ-আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে আকেঙ্খা করেছেন। এ-আকাঙ্খার মধ্যে রয়েছে কবি মলয়ের একদিকে যেমন আস্তিত্ত্বের সংকট থেকে ক্ষণিক মুক্তি, তেমনি যন্ত্রণা জ্বালা থেকে ক্ষণিক মুক্তিও। যে যন্ত্রণা-জ্বালা অভুক্ত ঋদয়ের, শরীর ও মনের। একটা কথা মনে রাখতে হবে, পঞ্চাশের দশক থেকে সাহিত্য একটা বন্ধ্যা যুগ তৈরি হয়েছে। একথা বলার কারণ পঞ্চাশের কবিদের সৃষ্টি নির্মাণে পূর্বজদের রোমান্টিসিজমের গড়া সাহিত্যধারারই চর্বিতচর্বণ হয়েছে।
চল্লিশের বা তিরিশের কবিদের মতন তেমন কোনো সাহিত্য-পট পরিবর্তনের স্বাক্ষর তঁরা রাখতে পারেননি। এমনকি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ছত্রছায়ায় লালিত পরবর্তী সময়ের ভেঙে পড়া মূল্যবোধের যন্ত্রণা-জ্বালা বুকে নিয়ে যে-সব চল্লিশের কবিরা পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের বাণী নির্মাণের চেতনায় লিপ্ত হয়েছিলেন, তাঁদের মত ও পথের চর্বিতচর্বণ-বাহকরূপেই পঞ্চাশের কবিরা কাটিয়ে দিয়েছেন পরবর্তী সময়কে কবিমানসের অনুশিলনে। বোউ ও মেধাচর্চাব আর নতুন কোনো আলোকিত জীবন মন্হনের হদিশ দিতে পারেননি। সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর সভ্যতা ক্রমশঃ অন্তঃসারশূন্য হয়ে মানুষকে ও তার ভাবনা ও চেতনাকে এক নৈরাজ্যের বাসিন্দায় পর্যবসিত করে ক্রমশ অস্তিত্ব সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে , এ-সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলে কবি মলয় রায়চৌধুরী ‘হাংরি আন্দোলন’-এর মধ্য দিয়ে জীবনজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাহিত্যনির্মাতাদের বুকে যেমন আগুন ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন, তেমনি চেয়েছেন চিরাচরিত ভাবধারা থেকে সাহিত্যের মুক্তি, শিল্পের মুক্তি। তা নাহলে কবি মলয় একথা বলবেন কেন— আমি জানি শুভা যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঋদয়াভিগর্ভে শাশ্বত অসুস্হতায় পছে যাচ্ছে মঘজের সংক্রামক স্ফূলিঙ্গ যৌনতায় ডুবে যাওয়া নয়, কেবল যুগযন্ত্রণার অসুস্হতায় আচ্ছন্ন থাকাই কবি মলয়ের কাম্য নয়।
তিনি চান জীবনযাপনের সত্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রেমে-অপ্রেমে-বিদ্রোহে ওলোটপালোট করে মানবিক, দৈহিক ও শারীরিক ক্ষুধায় জীবনের এক পূর্ণতা, আমনকি শিল্পেরও। পরবর্তী কয়েকটি পংক্তিতে যার আভাস আমরা পাই। কবি মলয়ের তির্যক কথায়— মা তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পৌঁদে চুমো খেতুম কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয় ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে এসব কি হচ্ছে কানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ সব ভেঙে চুরমার করে দেবো শালা ছিন্নভিন্ন করে দেবো তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবো আমারক্ষুধায় আসলে, অনুপযুক্ত পৃথিবীর ধ্বস্ত সময়েরফাঁস ছিন্ন করে কবি মলয় দাঁড়াতা চান প্রকৃত সত্যসন্দর্শন শিল্পের কাছে। তাই তাঁর অকপটে বলতে বাধে না—‘ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন’। আবার পরক্ষণে তিনি যখন বলেন ‘কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে/এসব কি হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘতে যাচ্ছে অহরহ/সব ভেঙে চুরমার করে দেবো শালা’—তখন বুঝতে বাকি থাকে না শিল্পের চর্বিতচর্বণ-সূতিকাগারে তিনি আবদ্ধ থাকতে চান না, তিনি চান গতানুগতিক বিশুদ্ধ শিল্পের নামে ধর্ষিত শিল্পভাবনার জগঃটিকে ভেঙে চুরমার করে দিতে।
‘ছিন্নভিন্ন করে দেবো তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব’, এই পংক্তির মধ্য দিয়ে কবিতা রচনাকারদের শিল্পের নামা বাহারি ‘সন্মেলন নামক ভণ্ডামির প্রতি তাঁর তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ একই সঙ্গে ব্যক্ত হয়েছে। নারী-ই যুগেযুগে যেহেতু কবিদের কাছে কবিতার প্রতিমূর্তিরূপে উদভাষিত হয়েছে, কবিকে করেছে সমৃদ্ধ, সেহেতু কবি মলয় রায়চৌধুরীও শুভাকে চেয়েছেন শিল্পের জন্য। ‘হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবো আমার ক্ষুধায়’, একথার মধ্য দিয়ে শিল্পের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাই প্রকাশ পেয়েছে। একথা বলার কারণ, কবিতাকে তিনি নারীর মতনই সম্ভোগ করতে চান নিজস্ব আত্মদর্পণে। কোনো গতানুগতিক ধারার অনুসরণে নয়।
শিল্প গড়ে উঠুক কবির মননসমৃদ্ধ ব্যক্তিক আত্মদর্পণের নিজস্ব নিয়মে, সময় কালের প্রেক্ষিতে, আত্মশ্লাঘা ও আত্মজিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে। কবি মলয়ের ইংরেজি বা বিদেশি ভাষানবীশ কবিওয়াকাদের প্রতি ব্যঙ্গোক্তিও দেখি এ-কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে। যারা নিজস্ব অন্তরাত্মার দিকে না তাকিয়ে পর-দেশীর ভাবনার অবগাহনে শিল্পের মুগ্ধতার চমৎকারিত্বে সদাই মশগুল, বিশেষত শহর কলকাতার শিক্ষিত কবিকুলের যা একান্ত ধর্মরূপে প্রতিভাত। আর এজন্যই কবি মলয়ের কন্ঠে এক অসহায়তাবোধ জেগে উঠেছে, সঙ্গে-সঙ্গে এক ধিক্কার ও ব্যঙ্গও। তাই তিনি বলতে দ্বিধা করেননি— কলকাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কি করব বুঝতে পারছি না আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসী চামড়ার ব্যবহার কবি মলয়ের আস্তিত্বের সংকট ও আত্মদর্পণের বিস্ময়প্রসূত আত্মজিজ্ঞাসার একটি সার্থক সুন্দর দলিল হল এই ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি।
একথা বলার কারণ মলয়ের আত্মধিক্কারের মধ্য দিয়ে নতুন পথ-খোঁজার আত্যন্তিক ইচ্ছের ব্যপারটি কবিতার মধ্যে বারবার ব্যক্ত হয়েছে, কখনো সরাসরি ভদ্র প্রতিবাদীর মোড়কে, কখনো শ্লীলতার মাত্র ছাড়ানোর অভিব্যক্তিতে। শ্লীলতার মাত্রা ছাড়ানোর অভিব্যক্তির দৃষ্টান্ত যেমন— অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা যোনিকেশরে কাচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা একটা কথা বলা বোধ করি এখানে উচিত হবে, এই শ্লীলতার মাত্রা ছাড়ানো অভিব্যক্তি কিন্তূ কখনো অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে না। কবিতাকে নারীদেহরূপে দেখাতাই সাধারণত সৎ কবির ধর্ম। বৈষ্ণব সাহিত্যেও প্রেমের অভিব্যক্তির চরম প্রকাশ বার বার উঠে এসেছে নারীদেহের সুধা মন্হন ও সৌন্দর্য বর্ণনায়। যোনিই যেহেতু সন্তানের জন্মদ্বার—সেহেতধ যোনির সুস্হতা চাওয়ার মধ্য দিয়ে কবি মলয়ের সার্থক কবিতা নির্মাণের ভাবটিই এখানে ব্যক্ত হয়েছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি।
সময়ে সময়ে ধর্ষণ শব্দটি দেখি তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে। ‘ধর্ষণ’ শব্দটিকে ধ্বস্ত বা নষ্ট অর্থে ধরতে হবে। যা চর্বিতচর্বণে বহু ব্যবহৃত তাকেই সম্ভবত তিনি ‘ধর্ষণ’ অর্থের দ্যোতনায় চিহ্ণিত করতে চেয়েছেন। ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটিকে শল্যচিকিৎসকের মতন যদি প্রথম থেকে শেষাবধি কাটাছঁড়া করা যায়, তাহলে যে সত্য চালচিত্রটি ধরা পড়ে তা হলো এক নবীন কবির আত্মবীক্ষণের ও আত্মমন্হনের এক সুগভীর প্রশ্নবিহ্বল সুতীব্র আর্তনাদ, এবং এক অসহায় অস্তিত্বের তীব্র সংকটের বার্তা। শিল্পকেই একমাত্র জীবনযন্ত্রণার নিস্তার ও মুক্তি বলে মনে করেছেন বলেই তাঁর কবি-অন্তরে দ্বান্দ্বিকতা দেখা দিয়েছে।
কবি মলয় এ-কারণে যেমন বলতে বাধ্য হয়েছেন—‘ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন’, আবার তেমনি বলতে বাধেনি — ‘আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই’। কৃত্রিম ভাবনালোক ত্যাগ করে মলয় চান সত্যসন্দর্শনেরপ্রকৃত জীবনযন্ত্রণার অক্ষরের পিনবিদ্ধ রক্তঘামে ভেজা রক্তমাংসজনিত সাবলীল ভাবনালোক। কবিতে তাঁর কাছে ঈশ্বরী না হয়ে হয়ে উঠুক সময়কালের দর্পণে জীবনযন্ত্রণায় পোড়া সত্যিকারের মানবী। তাই দেখি শুভাকে তিনি শিল্পের মানবীসত্তার প্রতীকীব্যঞ্জনায় আমাদের কাছে তুলে ধরছেন, তাকে বার বার রমণে ও মননে। ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির সারসত্য এটাই।
কবিতাকে তিনি তাঁর চূড়ান্ত অসহায়তা বোধ থেকে শৈষ পর্যন্ত গভীর তৃষ্ণায় নিশ্চিন্তবোধের জগতে ফিরিয়ে দিতে চান। কল্পনার রঞ্জিতবিলাসে তিনি যে গা ভাসাতে ইচ্ছুক নন, তা স্পষ্ট করেছেন বিশেষত মাতৃগর্ভে ফিরে যাবার পর ফেরসমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে জীবনের আস্বাদকে লেহন করার মধ্য দিয়ে। শুভা কেউ নন, কবি মলয়ের জীবনের আস্বাদনের প্রতিভূ—শিল্পের মানবী বা আধার। মলয়বাবু শিল্পরূপী কবিতাকে টেনে আনতে চেয়েছেন প্রকৃত জীবনের কাছে, প্রকৃত বাস্তবের সত্যসন্দর্শনে। এ-আলোচনার সমাপ্তিকালে কটি কথা বলা বোধ করি উচিত হবে : হাংরি আন্দোলনের পুরোহিত কবি মলয় রায়চৌধুরী প্রকৃত কালসত্যের সন্দর্শনটি মেলে ধরেছিলেনতাঁর সুবলিষ্ঠ লেখার মাধ্যমে বলেই বাংলা কবিতায় আজ শ্লীল-অশ্লীলের কাল্পনিক বা সমাজবিদদের চাপানো কতকগুলি ধারণার বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে বাংলা সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে সাবালকত্বের দুয়ার খঁজে পেয়েছে, তা সত্তর দশকের কবিকুলের দিকে নজর রাখলেই বোঝা যায়।
বিশেষ করে সত্তর দশকে প্রখ্যাত কবি জয় গোস্বামীকে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বমহিমায় ‘দশচক্র’ কবিতায় যেভাবে পেয়েছি তার কথা বলা যাতে পারে: স্বয়ং মা সরস্বতী বীণা ও পুস্তক ফেলে দু-হাত দিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালেন আমার রাস্তায় পরনে কিচ্ছুটি নেই, একদম ন্যাংটো শুধু আঙুলে নেলপালিশ সরু সরু নখসুদ্ধ আঙুল ঢুকিয়ে দিলেন চোখে, মরে গেলাম মরে গেলাম, মরতে মরতে কী দেখলাম বলব কী ভুতুম আমি কী বলব তোমায় দেখতে দেখতে আমি স্বয়ং ভগবান হয়ে যাচ্ছি মাকে ডাকছি বাপকে ডাকছি চৌদ্দগুষ্টিকে ডাকছি আয় আয় আয় বাপকে মেয়ের সামনে ছেলেকে মায়ের সামনে মেরে শুইয়ে দিচ্ছি কেটে। জয়ের এ-উচ্চারণে হাংরি আন্দোলনের পরোক্ষ প্রভাব পাওয়া যায় না কী? হাংরি আন্দোলন যে বৃথা যায়নি তা টের পাই সত্তর দশকের বহু কবির বেশ কিছ্ রচনাতে। সত্তর দশকের কবিদের গতানুগতিক বৃত্তভাঙার মন্ত্রবীজটি যে হাংরি আন্দোলনের কাছ থেকেই এসেছে তা বোধ করি মনে কোনো দ্বিধা না রেখেই বলা যায়। কবি মলয় রায়চৌধুরীর হাংরি আন্দোলনের পুরোহিত বা পুরোধা হিসাবে সার্থকতা এখানেই। তিনি প্রকৃত কবিতার বিবর্তনের স্রোতটী খুব অনায়াসভাবে পৌঁছে দিতে পেরেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের বোধে, মননে ও হৃদয়ে।
‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি যথার্থই একটি সার্থক কবিতা। কি উপমা প্রয়োগে, কি শব্দচয়নে, কবি মলয়ের মুন্সীয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। বিশেষ করে ‘নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা’ ও ‘কাঁচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা’ উপমা দুটি নজর কাড়ে। তর্মুজ আঙরাখা, জাফ্রান, আদিত্যবর্ণা, সূর্যজখম, রূপালী য়ুটেরাস, সবুজতোষকের, আঁচমেরে, ক্লিটোরিসের, লাবিয়া ম্যাজোরার, হিপ্নটিক, যৌনপরচুলায়, এসব শব্দ যেমন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কবিতাটিকে অর্থবহ করে তুলেছে, তেমনি রসঘনভাবেএকটা বিশ্বাসের ভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সব অর্থেই একটি তারিফযোগ্য কবিতে এটি, এবং হাংরি আন্দোলনের প্রকৃত মন্ত্রবীজ হয়ে উঠেছে।
কবিতাটির যথার্থ মূল্য এখানেই।
( এই কবিতাটির জন্য ১৯৬৪ সালে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মকদ্দমা করেছিল তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মলয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে ও কোমরে দড়িবেঁধে প্রথমে থানায় এবং থানা থেকে ছয়-সাতজন অপরাধীর সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মলয়ের বিরুদ্ধে ৩৫ মাস মামলাটি চলে প্রথমে নিম্ন আদালতে, যেখানে মলয়ের একমাস জেলের সাজা ঘোষিত হয় ও তারপর কলকাতা উচ্চ আদালতে, যেখানে তিনি বেকসুর ছাড়া পান। মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তরুণ সান্যাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, সত্রাজিৎ দত্ত ও অজয় হালদার। পাঠকের হয়ত আশ্চর্য লাগবে, মলয়ের বিরুদ্ধে পুলিসের পক্ষের সাক্ষী ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু। দুজন পুলিস ইনফর্মার, পবিত্র বল্লভ ও সমীর বসু, ছিলেন পুলিসের ভুয়ো সাক্ষী, যাঁরা মলয়ের পরিচিত না হওয়া সত্ত্বেও কোর্টে জানান যে মলয়ের সঙ্গে তাঁদের বহুবার কফিহাউসে দেখা হয়েছে। সবচেয়ে লজ্জার যে দুজন হাংরি আন্দোলনকারী রাজসাক্ষী , অর্থাৎ অ্যাপ্রুভার, হয়ে মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন; তাঁরা দুজন হলেন শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ।এঁদের সাক্ষ্যের কারণেই নিম্ন আদালত মলয়কে সাজা দিয়েছিল।)
[ স্বপ্ন পত্রিকায় প্রকাশিত। শরৎ সংখ্যা ২০০৮।]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।