আওয়ার লেডি অফ দি জিজুয়া : মলয় রায়চৌধুরী
স্কুলে ভর্তি হইয়াছিলাম অত্যন্ত অল্প বয়সে, জনৈক পাদ্রির বদান্যতায়, তাঁহার নাম ফাদার হিলম্যান, সম্পূর্ণ নাম জানা হয় নাই, কী করিয়াই বা জিজ্ঞাসা করিব যে, ফাদার আপনার নাম কি। তিনি জার্মানি হইতে ভারতে আসিয়াছিলেন, তাহা তিনি আমার পিতৃদেবকে একদা বলিয়াছিলেন, এবং ভারতের বৈচিত্র্য ও বৈভিন্ন্যের বহুমাত্রিকতা তাঁহাকে অত্যন্ত মুগ্ধ করিয়াছিল; তিনি মনে করিতেন যে এই দেশ সূর্যরশ্মির সাতটি রঙের বিস্ফোরণ হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে ।
পাদ্রিসাহেবকে প্রথমবার দেখিয়া আমি অবাক হইয়া গিয়াছিলাম, কেননা তৎপূর্বে এই প্রকার ধবলত্বক মানুষ আমি দেখি নাই। তাঁহার দেহ একটি শ্বেত বস্ত্রে ঢাকা, কেবল মুখ ও দুইটি হাত কনুই হইতে ঢাকা নহে। এইরূপ পোশাকও পূর্বে দেখি নাই।
গীর্জার যাযক ফাদার হিলম্যান তাঁহার মুগ্ধতাকে জাগতিক রূপ দিবার নিমিত্ত ফোটো তুলিতে ভালোবাসিতেন। সেসময়ে ডিজিটাল ক্যামেরা ও হাই রেজোলিউশান ফোটোগ্রাফি আবিষ্কার হয় নাই। কাঁচকড়ার রোল ফিল্মে ফোটো তোলা হইত, এবং একটি ফিল্মে বারোটি অথবা ষোলোটি ফোটো তোলা যাইত। কাঁচকড়ার ফিল্মটি অন্ধকার ঘরে রক্তবর্ণ আলো জ্বালাইয়া, রসায়নে চোবাইয়া প্রস্ফূটিত করা হইত, এবং তাহা শুকাইয়া গেলে সেই অন্ধকার ঘরে সেগুলি হইতে ফোটোগ্রাফির কাগজের উপর প্রিন্ট করা হইত। অজস্র ফোটো তুলিতেন তিনি, এবং ফোটোগ্রাফির সূত্রেই পিতৃদেবের সহিত তাঁহার পরিচয়। অজস্র ফোটো তুলিতেন বলিয়া প্রায়ই পিতৃদেবের সন্নিকটা আসিতেন ও কোথায় কী তাঁহাকে অবাক করিয়াছে তাহার গল্প করিতেন।
পিতৃদেবের কৈশোরে তাঁহার পিতা, অর্থাৎ আমার পিতামহ, হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া দেহত্যাগ করিয়াছিলেন। পিতৃদেব এবং তাঁহার ভাইবোনগণ কেহই স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ পান নাই। পিতামহ ফোটোগ্রাফি ও ছবি অঙ্কনের একটি ভ্রাম্যমাণ সংস্হা স্হাপন করিয়াছিলেন, এবং তৎকালীন রাজা ও নবাবদিগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজপরিবারের সদস্যদিগের ফোটো তুলিয়া তৈলচিত্র অঙ্কনের উদ্দেশে বিভিন্ন রাজদরবারের অতিথিরূপে এক-একটি শহরে সপরিবারে আশ্রয় লইতেন, এবং বহুদিবস অতিথিরূপে অতিবাহিত করিতেন। পিতৃদেব ও ভাইগণের যেটুকু পড়াশুনা, তাহা রাজপরিবারের শিক্ষকদের অবদান। বাংলা ভাষার তুলনায় তাঁহারা ইংরেজি ও ফার্সিতে সড়গড় হইয়াছিলেন।
পিতৃদেবের নিকট তাঁহার জীবনের বহু আকর্ষণীয় কাহিনি শুনিয়াছি। তাঁহাদের আতিথ্য সম্পর্কিত, খাদ্য ও ভ্রমণ সম্পর্কিত। এক্ষণে যাহাকে পাকিস্তান বলা হইয়া থাকে, পিতামহ ও ভাইগণের সহিত তিনি তথাকার প্রতিটি রাজ্যে নবাব ও রাজাগণের আতিথ্য লইয়াছিলেন এবং রাজপরিবারের বিলাসিতা তাঁহাদের উপরও কিঞ্চিদধিক বর্ষিত হইত। কিন্তু পিতামহের মৃত্যুর কারণে আমরা অকস্মাৎ আর্থিক দারিদ্র্যে আক্রান্ত হইয়াছিলাম, শেষে ভাইগণ পাটনা শহরের মহাদলিতগণের পাড়ায় আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিল।
ফাদার হিলম্যানের সহিত ইংরেজিতে বার্তালাপ করিতে পিতৃদেবের অসুবিধা হইত না। কোনো এক দিবসে পিতৃদেব আমাকে তাঁহার স্টুডিও-দোকানে লইয়া গিয়াছিলেন। ফিল্মের কাঁচকড়া মুড়িবার যে লাল কাগজ থাকিত, তাহাকে লাঠির মতো পাকাইয়া দিয়াছিল রামখেলাওন সিং ডাবর, বাবার স্টুডিও-দোকানের কাজের লোক। আমি সেই লাঠিটিকে তরোয়ালের ন্যায় আমার চারিধারে ঘুরাইতে ছিলাম ও অদৃশ্য শত্রুদিগকে অসিযুদ্ধে পরাজিত করিতে ছিলাম। অকস্মাৎ ফাদার হিলম্যান স্টুডিও-দোকানে প্রবেশ করিলে, তাঁহার দিকেও অসি চালনা করিলে, ফাদার হিলম্যান পিতৃদেবকে প্রশ্ন করিলেন, এই বালকটি কি আপনার সন্তান , এখনও স্কুলে দেন নাই কেন, এই বয়সে যাহা শিখিবে তাহা সম্পূর্ণ জীবন স্মরণে রাখিতে পারিবে।
ফাদার হিলম্যান ও পিতৃদেবের পরস্পরের কথোপকথন আমি তৎক্ষণে বুঝিতে পারি নাই, কিন্তু রাত্রে খাইতে বসিয়া পিতৃদেব মাকে যাহা বলিয়াছিলেন তাহা এইরূপ:-
পিতৃদেব ফাদার হিলম্যানকে কহিলেন, এতো কম বয়সে কি স্কুলে ভর্তি লয়? দুই বৎসর পর দিব মনস্হ করিয়াছি, আমার প্রথম পুত্র যে সরকারি স্কুলে শিক্ষালাভ করিতেছে, সেই স্কুলেই দিব, তথায় এতো কম বয়সের বালকদের ভর্তি লয় না।
ফাদার কহিলেন, আপনি আমার স্কুলে এই বালককে ভর্তি করিয়া দিতে পারেন, আমাদের স্কুলে একটি প্রাথমিক ক্লাস আছে, আপনার সন্তানের বয়সী বালক-বালিকাদের জন্য।
পিতৃদেব কহিলেন, আপনাদের ক্যাথলিক স্কুলের মাসান্তিক ফিস তো আমি গণিতে পারিব না, আমাকে আমার ভাতৃগণের সংসারও প্রতিপালন করিতে হয়।
ফাদার পিতৃদেবকে কহিলেন, আমি ওই স্কুলের সর্বময় কর্তা, ফিস মুকুব করিবার বন্দোবস্ত করিব, আপনি নামমাত্র টাকা দিয়া উহাকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করিয়া দিন। কল্য আপনার ছেলেটিকে সঙ্গে লইয়া নয়টার সময় আসিবেন, দরখাস্ত পূরণ করিয়া কর্ম সমাধা করিলে কল্য হইতেই ক্লাস করিতে পারিবে।
পরের দিন পিতৃদেবের সহিত ক্যাথলিক স্কুলে গিয়া ভর্তি হইয়া গেলাম। ফাদার হিলম্যানের ঘরের ছাদ বহু উচ্চ এবং চারিদিকের প্রতিটি দেয়ালে বিশালাকায় তৈলচিত্র, দেখিয়া মনে হইল চিত্রগুলি সন্তদিগের, যাহাদের গল্প বড়োজ্যাঠাইমা সন্ধ্যাবেলায় লন্ঠনরশ্মির চারিধারে বসিয়া শোনাইয়া থাকেন। সকলেই আলখাল্লা-পরা মানুষ, দাড়ি রহিয়াছে, মাথার পিছনে গোল রশ্মি। বিশাল ঘরটি তাঁহার একার; আমরা যে গৃহে বসবাস করি তাহার দ্বিতলের সবকয়টি ঘরের ক্ষেত্রফল এই ঘরটির মাপের হইবে।
স্কুলে প্রবেশ করিবার পর সিংহদ্বারের সন্মুখেই একটি শ্বেতপাথরের মূর্তি দেখিয়াছিলাম, জনৈক মা তাঁহার সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে লইয়া বসিয়া আছেন, তাঁহার পিছনে লম্বা-দাড়ি একজন মানুষ, গায়ে আলখাল্লা, পায়ের নিকটে দুইটি মেষ শাবক লইয়া , দাঁড়াইয়া আছেন। সিংহদ্বার হইতে ভিতরে প্রবেশ করিবার পর, দক্ষিণ দিকে বিশাল সবুজ মাঠ, বালক বালিকারা খেলা করিতেছে, তাহাদিগের মধ্যে বেশ কয়েকজন ফাদার হিলম্যানের ন্যায় ধবলত্বকের বালক ও বালিকা, চুলগুলি স্বর্ণবর্ণ। বাম দিকে একটি ফুলের বাগান, বালক বালিকারা কেহই ফুলগুলি তুলিতে আগ্রহী নহে। আমার পাড়ার বালকেরা যদি এই ফুলগুলি দেখিত তাহা হইলে তৎক্ষণাত তুলিয়া পূজার জন্য বাড়ি লইয়া যাইত অথবা মন্দিরের সামনে বসিয়া বিক্রয় করিত।
ঢং ঢং করিয়া কয়েকবার কাঁসরের ন্যায় ঘণ্টা বাজিলে, বালক বালিকারা বিভিন্ন ঘরের দিকে দৌড়াইয়া চলিয়া গেল, নিমেষে মাঠ ফাঁকা।
পিতৃদেব আমাকে কহিলেন, ভালো করিয়া ক্লাস করিবে, দ্বিপ্রহরে স্টুডিও-দোকানের কাজের লোক রামখেলাওন সিং ডাবর টিফিন লইয়া আসিবে, তাহা ভক্ষণ করিয়া লইও, কল্য হইতে স্কুলে আসিবার সময়ে তুমি নিজের সঙ্গে টিফিন লইয়া আসিবে। স্কুল ছুটির সময়ে দ্বারপ্রান্তে ডাবর তোমার জন্য অপেক্ষা করিবে, তাহার সাইকেলে বসিয়া গৃহে ফিরিও।
যে ক্সাসঘরে আমাকে লইয়া যাওয়া হইল, তথায় বালক বালিকারা সকলেই আমার বয়সী; আমার চেয়ে কম বয়সীও রহিয়াছে কয়েকজন। আমি অদ্য প্রথম ক্লাস করিতেছি বলিয়া ক্লাসের শিক্ষিকা আমার নিকটে আসিয়া নিচু হইয়া আমার মুখের নিকট মুখ আনিয়া কিছু প্রশ্ন করিলেন, ইংরাজি প্রশ্নের কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; তিনি আমার হস্তা কয়েকটি কার্ড দিলেন, যাহাতে সন্তদিগের ছবি এবং তুষারের ভিতর দিয়ে হরিণের যান লইয়া একজন লালপোশাক বৃদ্ধ, শাদা দাড়ি, ছুটিয়া চলিয়াছে। ইহার পর তিনি আমাকে কয়েকটি গ্রন্হ দিলেন, একটিকে গ্রন্হ বলা চলে অন্যগুলি পুস্তিকা, ইংরেজি অক্ষর সম্বলিত।
ক্লাসের শিক্ষিকাও ধ্ববলত্বক, কেবল তাঁহার মুখ দেখা যাইতেছে। পোশাককে এতো বেশি শ্বেত কি করিয়া রাখেন বুঝিয়া পাইলাম না। আমার মা কাপড় কাচেন, সোডা দিয়া কাচিলেও শ্বত বস্ত্র এতো বেশি শ্বেত হয় না। শিক্ষিকা আমার মুখের নিকটা তাঁহার মাথা নামাইয়া আনিলে, তাঁহার গভীর দৃষ্টিতে অভয় দর্শন করিয়া আশ্বস্ত হইলাম।
ক্রমে স্কুলে কার্যক্রমে অভ্যস্ত হইয়া গেলাম। আমার ন্যায় একটি বালিকা ইংরেজি জানিত না, সে ফিসফিস করিয়া বাংলায় বলিয়াছিল যে সুযোগ পাইলে আমরা দুইজনে লুকাইয়া বাংলায় কথা কহিব, ইংরেজি শিখিয়া গেলে তৎক্ষণে ইংরেজিতে বার্তালাপ করিব। আমি একজন বন্ধু পাইলাম। প্রতিদিন দ্বিপ্রহরে আমরা আমাদের জলখাবার দুইজনে অর্ধেক বিনিময় করিয়া লইতাম। তাহার খাদ্যবস্তু দেখিয়া বুঝিতাম সে কোনো ধনী গৃহের সন্তান; তদ্যপি আমার টিফিন খাইতে তাহার আনন্দ হইত, বলিত যে এইপ্রকার স্বাদু খাবার সে খায় নাই।
প্রথম সপ্তাহের পর একটি আনন্দের ঘটনা ঘটিল। ফাদার হিলম্যান আমাদের সবাইকে বলিলেন গ্রন্হের মতো দেখিতে যাহা, তাহা লইয়া অন্য একটি ক্লাসে শিক্ষণের জন্য যাইতে হইবে। আমাদিগের সকলকে তাঁহার পিছন-পিছন লইয়া চলিলেন স্কুল সংলগ্ন একটি বিশাল অট্টালিকায়, তাহার গম্বুজ অতিউচ্চ। ভিতরে প্রবেশ করিয়া অবাক হইয়া গেলাম। একটি দালানঘর, দুই পাশে বসিবার বেঞ্চ ও তাহার সামনে টেবিলের ন্যায়, ঝকঝকে পালিশ করা । সন্মুখে একটি পাথরের মূর্তি, একজন মানুষের দুই হাত দুইদিকে করিয়ে পেরেক দিয়া কাষ্ঠখণ্ডে পোঁতা হইয়াছে, তাহার পদদ্বয়ও সেইরূপে পেরেকে বিদ্ধ করা হইয়াছে, আরেকটি লম্বালম্বি কাষ্ঠখণ্ডে।
আমাদিগকে আশ্বস্ত করিয়া ফাদার হিলম্যান প্রথমে ইংরেজিতে কিছু বলিয়া কহিলেন যে উনি ইরেজিতে যাহা কহিবেন তাহাকে হিন্দিতেও বলিবেন। বড়োই আনন্দ হইল। উনি বলিলেন যে প্রতিদিন একটি ক্লাস হইবে যাহার নাম বাইবেলের গল্পের ক্লাস। যে গ্রন্হটি আমাদের দেয়া হইয়াছে তাহাতে বাইবেলের কয়েকটি গল্প রহিয়াছে, এবং তিনি সেইগুলিই শোনাইবেন। যাঁহাদের গল্প তিনি বলিবেন তাঁহাদের তৈলচিত্র এই গীর্জাঘরটিতে আছে। ইংরেজিতে এই ঘরটিকে বলে চার্চ এবং হিন্দিতে গির্জাঘর।
পোশাকহীন যে মানুষটিকে কাষ্ঠখণ্ডে পেরেক দিয়া ঝুলাইয়া রাখা হইয়াছে, তাহার গল্প দিয়া তিনি আরম্ভ করিলেন। কাষ্ঠখণ্ডে ঝুলাইবার পূর্বে তাঁহাকে ঐ ভারি কাষ্ঠখণ্ড বহু পথ পরিভ্রমণ করিয়া বহন করিতে হইয়াছিল, তাঁহাকে শান্তির ধর্ম প্রচারের জন্য ঐরূপ শাস্তি প্রদান করা হইয়াছিল। যে কাষ্ঠখণ্ডে তিনি বিদ্ধ তাহার নাম ক্রস এবং যাঁহাকে বিদ্ধ করা হইয়াছে তাঁহার নাম জিজাস খ্রাইস্ট।
আমাদের গৃহে বহু কাষ্ঠখণ্ড আছে যাহা প্যাকিং বাক্সের রূপে পিতৃদেবের স্টুডিও-দোকানে প্রায়ই বিক্রয়ের সম্ভার লইয়া ভারতের বিভিন্ন স্হান হইতে আসে। প্যাকিং বাক্স খুলিয়া বিক্রয়ের দ্রব্যাদি স্টুডিও-দোকানে রক্ষিত হয় এবং প্যাকিং বাক্স হইতে পেরেকগুলি খুলিয়া রাম খেলাওন সিং বিক্রয় করে, নিজ খইনি খাইবার দাম সংগ্রহের নিমিত্ত। কাষ্ঠখণ্ডগুলি ক্রয়ের জন্য কয়েকমাস অন্তর ক্রেতা আসিলে তাহাকে বিক্রয় করিয়া জঞ্জাল পরিষ্কৃত হয়।
জিজাস খ্রাইস্টের জীবনকাহিনীতে উৎসাহিত হইয়া স্কুলের ছুটির পর গৃহে প্রত্যাবর্তনান্তে বৈকাল বেলায় দুইটি কাষ্ঠখণ্ডকে দড়ি দিয়া বাঁধিয়া ক্রস তৈয়ারি করিয়া লইলাম, পাড়ায় পথে বাহির হইলে সমবয়সী বালক-বালিকাগণ জানিতে চাহিল ইহা কী বস্তু, কোনো নূতন ধরণের খেলা? বলিলাম, ইহা কাঁধে লইয়া পথে-পথে ভ্রমণ করিতে হয় এবং যাহারা পিছনে আসে তাহারা চিৎকার করিয়া জনগণকে সংবাদ জানাইতে থাকে।
পাড়ার বালক অথবা কিশোর ফুটবল দল জিতিয়া ফিরিলে যদ্রুপ ‘হিপ হিপ হুররে’ চিৎকারধ্বনিতে উল্লাস প্রকাশিত হয়, আমার পিছনের বালক-বালিকাগণ তদ্রুপ ‘হিপ হিপ হুররে’ চিৎকার করিতে লাগিল। আমি পাড়ার বিভিন্ন গলির ভিতর দিয়া পরিক্রমা করিতে লাগিলাম।
বিরজুর মা, যিনি ছোলাভাজা বিক্রয় করিয়া জীবন অতিবাহন করেন, তাঁহাকে দেখিলাম গালে হাত রাখিয়া অত্যন্ত দুঃখী মুখে চুপচাপ বসিয়া আছেন। তাঁহার মাটির গৃহের দ্বারপ্রান্তে বসিয়াছিলেন। ইহা তো বিরজুর মায়ের ছোলা বিক্রয়ের সময়। কাষ্ঠখণ্ডের ক্রস কাঁধ হইতে মাটিতে নামাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কী হইয়াছে, বিরজু কি আবার কোনো অপকর্ম করিয়াছে?
বিরজুর মা কহিলেন, বিরজুকে আবার পুলিশ ধরিয়া লইয়া গেছে; চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়িয়া গিয়াছিল, এক্ষণে গৃহে কাষ্ঠ নাই যে আগুন ধরাইয়া ছোলা ভাজিব।
তাঁহার কথা শুনিয়া আমি আমার ক্রস মাটি হইতে তুলিয়া বিরজুর মাকে দিয়া দিলাম। উনি প্রশ্ন করিলেন, ইহা কী বস্তু, তুই কী লইয়া খেলা করিবি।
আমি বলিলাম, ইহা জিজাস খ্রাইস্টের কাষ্ঠখণ্ড, তিনি মহাপুরুষ ছিলেন, স্কুলে শিখাইয়াছে; বিরজুকে পুলিশ যতদিবস ধরিয়া রাখিবে, আমি বৈকালে পরিক্রমার পর একটি করিয়া ক্রস তোমাকে আনিয়া দিব।
বিরজুর মা আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন ও আদর করিয়া কহিলেন, তুইই আমার জিজুয়া মহাপুরুষ।
বুঝিতে পারিলাম স্হানীয় ভাষায় নামের সংক্ষিপ্তকরণ প্রক্রিয়া প্রয়োগ করিয়া বিরজুর মা জিজাস খ্রাইস্টকে জিজুয়া নামে অভিহিত করিয়াছেন।
বিরজু গৃহে প্রত্যাবর্তনের দিন পর্যন্ত আমি প্রতিদিন বৈকালে ছোলাউলিকে দুইটি করিয়া কাষ্ঠখণ্ড দিয়াছি, এবং জিজুয়া মহাপুরুষরূপে আদৃত হইয়াছি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।