'বিন্যাস' আপনার শ্রেষ্ঠ লেখা। বাংলা সাহিত্যের ২০টি উপন্যাসের একটা। -- তুমি বলছো! সবাই 'মাধুকরী', 'একটু উষ্ণতার জন্য' 'কোয়েলের কাছে'-র কথা বলে।
ওগুলো ভালো, খুবই ভালো। কিন্তু আপনার 'বিন্যাস', সমরেশ বসুর 'উত্তরঙ্গ' বাংলা সাহিত্যের বিরল উপন্যাস। সে তো সবাই সমরেশ বসু নিয়ে আলোচনা হলেই প্রজাপতি, বিবর, দেখি নাই ফিরে, অমৃতকুম্ভের সন্ধানে--এই সব বলে। 'উত্তরঙ্গ' নিয়ে নিস্তরঙ্গ সাহিত্য জগত।
সেই শুরু।
তারপর কত কত দিন কেটেছে শিবির সভায়, আড্ডায়, ফোনে।
বন্ধু কৌশিক লাহিড়ীর সঙ্গে বুদ্ধদেব গুহর চিঠি মারফত সম্পর্ক। কৌশিক লাহিড়ীর কাছে সবুজে ভরা প্যাডে ছবির মতো লেখা চিঠি দেখতাম। কৌশিকদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক।
কৌশিক লাহিড়ীর সূত্রেই সরাসরি আলাপ। ছিলেন মাঝে প্রয়াত সুশান্তদা, চিড়িয়াখানার সহ অধিকর্তা, লেখক বামাদা।
২০০৪ এ বার্ণপুরে এক সভায় যাওয়া। বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে নিয়ে গেছি হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের চেয়ারম্যান তপন মিত্রকে। অতিথিশালায় রাতে আড্ডা। জ্যোৎস্না রাত।
দুজনে গান গেয়ে চলেছেন একের পর এক।
কখনো একক কখনো যৌথ।
সে এক স্বপ্ন রাত।
আমি তো ক্যামেরা টেপ রেকর্ডার কিছুই রাখতাম না তখন।
আফশোস করেছিলাম, কেন রাখতে পারলাম না এই আশ্চর্য রাত।
ওখানেই প্রথম বলেন, মাওবাদীদের প্রতি মানুষের সমর্থন কেন বাড়ছে।
বলেন, আমি নিজের চোখে দেখেছি জমিদারের গুন্ডাদের গুলিতে কিষাণ ছেলে মারা গেছে, মা রক্তমাখা ধান কুড়োচ্ছে বাড়িতে ছোটো ছোটো বাচ্চা আছে তো-- খাওয়াতে হবে তো!
শুধু জঙ্গলের সৌন্দর্য দেখলে হবে না, জঙ্গলের মানুষের জীবন দেখতে হবে তো।
আরেকবার নবনীতা দেবসেন ও বুদ্ধদেব গুহকে নিয়ে গেছি ভারতী ভবনের অনুষ্ঠানে। গৌতম মুখোপাধ্যায় ছাত্র নেতা ছিল। এখন প্রয়াত। ওঁর আগ্রহে। নবনীতা দেবসেন বলে দিয়েছেন, শোনো আমাদের লেখা কবিতা পড়ে লোকে পয়সা নেয়, আমাকেও দিতে হবে।
তা উদ্যোক্তাদের বললাম।
বুদ্ধদেব গুহ কিছুই চান নি। ফিরছি ট্রেনে। ট্রেন লেট।
নবনীতাদিকে বললেন, নবনীতা তো তখন নায়িকা প্রেসিডেন্সি কলেজে।
তুমি তো ভাই ঋতুমগ্ন।
দুজনের খুনসুটি উপভোগ করলাম।
আরেকবার ইস্কোর অনুষ্ঠান। ট্রেনে যাচ্ছি। সেদিন আমার জন্মদিন।
জেনে একগাদা কলম কিনে দিলেন। বললেন, এই কলমে লিখবে। তখন আমি 'প্রতিদিন'-এ পাক্ষিক কলাম লিখি।
কলম বিক্রেতার সঙ্গে কলম নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। আমার মনে হল, কলম বিক্রেতা অনেক বেশি দাম নিচ্ছেন।
পরে বললাম।
বললেন, ইচ্ছে করেই বেশি দিলাম। ও কলম বেচে। কলম চেনে। ওঁর সঙ্গে গল্প কজন করে? ওঁর কটা দিন কী রকম ভালো মনে যাবে ভাবো।
প্রথম নিয়ে যাই ২০০৩ এ। সেবার নেমেই মহাবিপত্তি।
উদ্যোক্তারা এক লজঝড়ে জিপ গাড়ি নিয়ে এসেছেন।
সামনের দরজা পর্যন্ত নাই।
বুদ্ধদেব গুহ বললেন, আমি এক্ষুনি ফেরৎ যাবো।
আমার পায়ের সমস্যা। এই গাড়িতে বসবো কী করে। ট্রেন কটায়?
বললাম, দেরি আছে।
এক্ষুনি গাড়ি দেখো, ভাড়া করে হলেও ফিরবো।
আমি তো মহাবিব্রত।
উদ্যোক্তাদের একজন পায়ে পড়ে গেলেন, বললেন, আপনি এসে ফিরে গেলে আমার মেয়ে আমাকে ক্ষমা করবে না। সে বসে আছে আপনাকে দেখবে বলে।
মেয়ে? কত বয়স?
সতেরো, ইলেভেনে পড়ে। আপনার সাঙ্ঘাতিক ফ্যান।
বাচ্চা মেয়ে অপেক্ষা করে আছে-- আচ্ছা চলুন। আপনার মেয়ের জন্য যাচ্ছি।
গাড়িতে উঠেই অন্য মানুষ।
বললেন, জীবনে অনেক গাড়ি চড়েছি। এ-গাড়ি অযান্ত্রিকের বাড়া।
গেস্ট হাউসে এসেছি।
উদ্যোক্তারা বললেন, আপনি আর ইমানুলবাবু এক ঘরেই থাকবেন।
আমি জানি, উনি নিভৃতি পছন্দ করেন রাতে শোয়ার সময়।
আমি বললাম, করেছেন কী?
উদ্যোক্তারা বললেন, আসলে ইস্কোর বড়সাহেব এসেছেন। দুটো ঘর ছিল। কিন্তু ..
উনি বললেন, আমি পরস্ত্রী ছাড়া কারো সঙ্গে ঘর শেয়ার করি না। ইমানুল কি পরস্ত্রী?
বলেই হো হো করে হাসি।
এবার খাওয়ার পালা।
প্রচুর খাবার। ঋতু গুহ বলেছিলেন, নিয়ে যাচ্ছো যাও-- ওঁর তেল ঝাল ঝোল খাওয়া নিষেধ। খেয়াল রেখো।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, এইসব খাবেন?
বললেন, খাওয়ার জন্য বাঁচা? না বাঁচার জন্য খাওয়া?
দিয়ে সব খেলেন।
বক্তব্য, যতদিন বাঁচবে রাজার হালে বাঁচবে।
কথায় গানে বিমোহিত করে দিলেন শ্রোতাদের।
২০০৭-এর জানুয়ারি।
চন্দননগর সরকারি কলেজে ৭৫ বছর। তিনদিনের অনুষ্ঠান। রাজ্যপাল উদ্বোধক।
তৃণমূল নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর প্রতিবাদে দুদিন বন্ধ ডেকেছে। অনুষ্ঠান বাতিল।
সামনে ন্যাক।
তড়িঘড়ি অনুষ্ঠানের দিন পাল্টাতে হলো।
উদ্বোধন করবেন কে?
আগের দিন রাত ১০ টায় বললাম, পরদিন দুপুরে যেতে হবে।
ও বদলি। পারবো না।
না করবেন না।
আচ্ছা, এবার কিন্তু জানালাওয়ালা গাড়ি এনো।
গেলেন ।
মাতিয়ে দিলেন।
অধ্যক্ষ ছিলেন শুভাশিস দত্ত। খুব কাজের মানুষ। তাঁকে নিয়ে রসিকতা করে বললেন, এঁর তো অনেক প্রেমিকা থাকা দরকার। এতো সুদর্শন পুরুষ, মিষ্টভাষী।
একজনকে বললেন, তুমি প্রেম না করে আছো কী করে?
ছেলেমেয়েদের সামনে মজার মজার কথা বলে মাতিয়ে দিলেন।
সেবার ২৪ ঘন্টার নোটিশে সমাপনী ভাষণ দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী। উনিও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। কলকাতা এলেই খবর দিতেন। ১৯৯৫ এ আজকাল পত্রিকায় আমি তপন রায়চৌধুরীর আধপাতা সাক্ষাৎকার ছেপেছিলাম।
এরপর বুদ্ধদেব গুহ টাইমস অফ ইন্ডিয়া গ্রুপের একটা বাংলা শারদ সংখ্যা 'সময়'-এ আমাকে চরিত্র করে ও প্রিন্সিপ্যালকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখেন।
সরাসরি আমার নাম ছিল তাতে।
পয়লা বৈশাখ নববর্ষ উৎসব উদযাপন উদ্বোধন করেছেন ২০০৮-এ আকাদেমির সামনে রাস্তার ধারে। তখনো স্থায়ী মঞ্চ হয় নি।
বাঙালিকে ব্যবসা করার উপর জোর দিয়েছিলেন।
একবার ইচ্ছে ছিল, ওঁকে বাংলাদেশ নিয়ে যাব। সেটা নানা কারণে হয় নি।
ওঁর মৃত্যুর পর খুব বেশি মানুষ আসতে পারেন নি। করোনা কালের অবসান হয়নি।
সিপিএম নেতা রবীন দেব, মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, সাহিত্যিক হিমাদ্রি কিশোর দাশগুপ্ত, প্রকাশক সুধাংশু দে, অপু এসেছিলেন।
আমিও ছিলাম দীর্ঘ সময়।
ফেসবুকে লাইভ করেছিলাম শেষ যাত্রা। অনেকেই তো ইচ্ছা থাকলেও আসতে পারেননি সেকারণে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।