এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • একজন ডাইনোসর (গল্প)

    শুভ রায়চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ জুলাই ২০২৫ | ২৯ বার পঠিত
  • ['আমার সেপ্টেম্বরের দিনগুলি'-তে রয়েছে। লেখার সময় কামু-কাফকা-লাকাঁ ইত্যাদি কিছুই মাথায় ছিল না। ফ্যান্টাসি বা অন্য কোনও একটা জঁর-এ ফেলতে পারব না। উইয়ার্ড ফিকশন বলা যায়। সেটাও পরে বুঝেছি। যখন এখনকার মতো সামান্য কিছুও লিখতে জানতাম না, তখনকার লেখা এই বিরক্তিকর গল্পটি। ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ পছন্দের। কিছু সময়ের জন্য থাকুক।]

    || একজন ডাইনোসর ||

    আমি, আমার হবু-স্ত্রী'কে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এক আসামী। তার বাড়ির লোকজন আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে খুন করতে, পুলিশও আমাকে খুঁজছে শাস্তি দিতে। যদিও আমার শাস্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল মূল অপরাধ করার অনেক আগেই, সেই ভোরবেলায়, যখন আমি হাতের তালুতে আমার ভাগ্য রেখা দেখতে পাইনি।
        আমার ক্ষেত্রে, জীবনের সমাপ্তি আকস্মিকভাবে উদয় হবে না, আবার এমনটাও নয়, আমি শেষ হয়ে যাব অনেক যন্ত্রণায়। আমার জীবনের সমাপ্তি ঘটবে এক শূন্যতার মাঝে, যে-শূন্যতার এক ভিন্ন তুরীয় রূপ আমাকে ধ্বংস করবে।
        আকস্মিক বিক্ষুব্ধ আবেগে তাড়িত হয়ে, আমি অন্য এক বাস্তবতার আভাস পাই, যেখানে যেকোনও দিগন্তই ক্ষণিকের প্রভা মাত্র।
        এই কাগজ—আমার টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার দলিল।

    ফেব্রুয়ারি ২২
    আমি যেখানে থাকতাম, তার পাশের রাস্তা দিয়ে পিছনে হেঁটে গেলে, একজন পাগলীকে সারাক্ষণ বসে থাকতে দেখা যেত। কেউ ওঁর সঙ্গে কথা বলত না। ওঁর গায়ের গন্ধে কাছে ঘেঁষা যেত না। বয়স নব্বই ধরে নেওয়া যায়। কেউ তাকে জানুক বা না-জানুক, আমি ওঁকে আবিষ্কার করেছিলাম—তিনি একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। সেটা জানার পর, আমি ওঁর থেকে অনেকবার অনেক বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছি। আমার ওঁকে কখনই পাগল বলে মনে হয়নি। এই দিনেও, আমি ভেবেছিলাম অন্যান্যবারের মতো তিনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।
        পাগলী আমার ডান হাতটা ওঁর কোলের কাছে টেনে নিয়ে ছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে ময়লা জমে থাকা প্রাচীন নখ এবং চামড়ায় কড়া পড়া আঙুলগুলো, আমার হাতের তালুতে বোলাচ্ছিলেন তিনি। তারপর ওঁর মুখটাকে একদম আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন। কয়েক মুহূর্তের জন্যে ওঁর কালো চোখ যেন সূর্য হয়ে উঠেছিল।
     —তোর ভবিষ্যৎ শূন্য। নিষ্ফলা। কিচ্ছু নেই।
     ওঁর কণ্ঠস্বর যেন কোনও দূর দেশ থেকে আমার কানে ভেসে আসছিল।
     —আপনি বলতে চাইছেন, আমি খুব তাড়াতাড়ি মরে যাব?
     —তোর সত্যিকারের নিয়তি এবার শুরু হবে।
     —আমি কী করতে পারি এখন?
     আমার দিকে চোখ রাখলেও, পাগলী তখন আমাকে দেখছিলেন না। যেন আমার গভীরে লুকিয়ে থাকা অলৌকিক কিছুকে পড়ছিলেন। তারপর নিচু স্বরে বলেছিলেন, "শূন্যতা তোর পিছনে ধাওয়া করছে। একটা ঝড়, সেটা তোকে গিলে খাবে, যতক্ষণ না তুই ডুবে যাবি।"

    মার্চ ৫
    সকালে আয়নার সামনে নিজেকে দেখে চিনতে পারিনি—রোগগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। আয়না যেন কোনও এক ভিনগ্রহীকে প্রতিফলিত করছিল। আমার চুল অদৃশ্য, আমার ভ্রূ-জোড়া, চোখের পাপড়ি, বুকের লোমও অদৃশ্য… সেদিন, আয়নায় আমি আমার মুখ খুঁজে পাইনি। সেই সকালে আমি অফিসের একটি মিটিংয়ে ছিলাম, আর বিকেলে আমার বাগদত্তা সৈনীর সঙ্গে আমাদের বিবাহ অনুষ্ঠানের সাজসজ্জার বিষয়ে আলোচনা করতে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। রাস্তায় বেরিয়ে, আমি পথচারীদের উপহাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু তারা কেউই আমার লোমহীন মুখ দেখে চমকে ওঠেনি। অফিসেও আমার অসহ্যকর সহকর্মীরা আমার চেহারায় ওই উদ্ভট পরিবর্তন নিয়ে মন্তব্য করেনি। শুধুমাত্র ম্যানেজার সাহেব আমাকে ওয়াশরুমে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমার শরীর খারাপ লাগছে কি না? জানি না ঠিক কতক্ষণ অফিসের ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম!
      আমি যাকে আয়নায় দেখছিলাম, সেই মানুষটা যে আমি নই!

    বিকেলে সৈনীর সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল, রাস্তার অত লোকের মাঝেই আমাকে চুমু খেয়েছিল সে। আমার দমবন্ধ হয়ে এসেছিল। আমি লজ্জা পেয়েছিলাম। আমার ভালো লাগেনি। ও আমাদের বিয়ে নিয়ে বকবক করতেই থাকে, আমি শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ওর বাজে বকা, মজা, রসিকতা আমি সহ্য করতে পারি না, থুতুর মতো ছিটকে আসে সে-সব। আমি বারণ করেছিলাম মানুষজনের মাঝে এইসব কথা বলতে না, কিন্তু ও অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনি। আসলে সৈনী আমাকে বোঝেই না। কত কী বলে আমায়: ‘তোমার জন্য আমার খারাপ লাগে, তুমি বাকিদের মতো স্বাভাবিক কেন নও?’, বা, ‘তুমি অত্যন্ত সাধারণ, কিন্তু নিজেকে কত কুল মনে কর, নিজেকে দেখেছ?’, কিংবা, ‘আমি ঠাকুরকে ডাকি, তিনি যেন তোমাকে একটু বুদ্ধি দেন। তোমাকে নিয়ে ভদ্র সমাজে চলা যায় না।’
      তবুও, আমাদের বিয়েটা ঠিক হয়েছিল।

    মার্চ ১৪
    এই পৃথিবীতে আমিই একমাত্র মানুষ নই, যে বাড়ির দরজায় তালা দেয় এবং কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পর আবার ফিরে আসে এই ভেবে, যে, দরজায় তালা দেওয়া হয়নি। কিন্তু দেখা যায়, তালা দেওয়াই ছিল। আমিই একমাত্র পুরুষ নই, যে আয়নার সামনে নিজেকে নগ্ন করে, সম্পূর্ন লোমহীন শরীরটাকে দেখে আতঙ্কিত হয়। আমি একমাত্র নই, যে ঘুমের মধ্যে অনুভব করে উঁচু বাড়ির ছাঁদ থেকে পড়ে যাচ্ছে। আমিই একমাত্র নই, যে পকেটে একটা ছুরি নিয়ে সর্বদা ঘোরে। আমিই একমাত্র নই, যে প্রত্যেকদিন সকালে বা রাতে দাঁত ব্রাশ করে আচ্ছন্ন হয়ে... দাঁতের সারি তারপর আয়নায় উধাও হয়ে যায়।
     আমিই একমাত্র মানুষ নই, যে তার আশেপাশের লোকজনের মৃত্যু কল্পনা করে, তাদেরকে ছুরিকাহত করার ইচ্ছে মনে পোষণ করে, প্রতিবেশীদের লাথি মারার সুযোগ খোঁজে, অথবা আরও ভয়াবহ ইচ্ছে মনে রাখে, যেমন, বোতল দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়ার, বা, চলন্ত ভিড় ট্রেনে হাওয়া রুদ্ধ করে দরজায় দাঁড়ানো যাত্রীকে ধাক্কা দিতে চাওয়া…
     কোনও মানুষ কি নিজের চিন্তাকে সম্পূর্ন আয়ত্তে রাখতে সক্ষম?

    মার্চ ১৯
    গড়িয়াহাটের সব রাস্তায়, সব দোকানে দোকানে পায়ে হেঁটে গরম রোদ মাথায় নিয়ে ঘোরাঘুরি করা সম্ভব ছিল না এবং আমি মনেপ্রাণে চাইছিলাম বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু আমার বাগদত্তা, দোকান থেকে দোকান ঘুরে, দেখে, বেশ আনন্দেই ছিল। সে প্রেসার কুকার, বাসনপত্র, ব্যাগ, মেকআপ সামগ্রী কিনছিল, আরও এমন সব দ্রব্যাদি সে কিনছিল যেগুলো নিশ্চিতভাবে আমরা ফেলে দেব। যেন এই পৃথিবী আরও আরও আবর্জনা চায়!
        গড়িয়াহাট মোর থেকে বাঁ দিকে ঘুরতেই সৈনী আমাকে অনেকগুলো কথা শুনিয়েছিল, কারণ আমি নাকি ওকে বিয়ের প্রস্তুতিতে কোনও সাহায্য করছি না। আমি চা-এ চুমুক দিয়ে যতটা সম্ভব বোকা বোকা না-সাজার অভিনয় করলাম আর সৈনীর বাজে কথা না-শোনার চেষ্টা করছিলাম। কারণ আমার দুই হাতের আঙুলের নখ উধাও হয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে। আমি পায়ের জুতো খুলে অতিবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম—আমার পায়ের আঙ্গুলের কোনওটাতেই নখ নেই।
     মাঝ রাস্তায় আমার পায়ের জুতো খোলা দেখে, সৈনী আমার দিকে ভয়ানক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছুটা দূরে গিয়ে কপালের ঘাম রুমালে মুছে নিয়ে বলেছিল, ‘তুমি সম্পূর্ন পাগল।’
     সৈনীর কথার স্রোত আমাকে প্রায় সবরকম উপায়ে নরকে পাঠানোর চেষ্টা করছিল। ভিড়ের মাঝে ও হেঁটে চলে যায় আমাকে সেখানে রেখেই।
     আমি সৈনীকে খুঁজতেও যাইনি।

    মার্চ ২১
    চোখ বুঝলেই দেখতে পাচ্ছিলাম, পাগলীর কালো চোখে সূর্যের ঝলকানি, ওঁর কথাগুলো আমার মাথার ভিতর ব্রাউনীয় গতিতে চলাফেরা করছে। কী অসহ্যকর!
     আমার ভবিষ্যৎ শূন্য। নিষ্ফলা। কিচ্ছু নেই সেখানে। ওই শূন্যতাই আমার শাস্তি, নিষ্ফলতাই আমার বিরুদ্ধে যাবতীয় নিন্দার কারণ আর নিয়তি হল জাগতিক সকল উপাদানের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। এই শূন্যই কৃষ্ণগহ্বর, শূন্য যেকোনও কিছুর আকার নিতে পারে। শূন্যতা হল বর্ণহীন, গন্ধহীন, নিঃশব্দ অনুভূতি। নিয়তি এমন একটি তীর, যা সর্বগ্রাসী শূন্যের অতল গহ্বর অতিক্রম করতে পারে। এই সংখ্যাটি, মানে শূন্য, অন্যদের কাছে অর্থহীন হলেও আমার কাছে যেন সে এক মহাবিশ্বের অতিপ্রাকৃত ঝড়। শূন্যতা আমাকে ধ্বংস করতে চলেছে। আমার শরীরে বিভিন্ন জ্যামিতিক আকার ছিন্নভিন্ন করে ফেলছিল—বর্গক্ষেত্র, পরাবৃত্ত, উপবৃত্ত, রেখা আমার শিরা উপশিরাকে ভেদ করে যন্ত্রণাদগ্ধ করছিল, আমার ভিতরে তখন সমুদ্রের ক্রোধ। আকস্মিক বিক্ষুব্ধ আবেগে তাড়িত হয়ে, আমি অন্য এক বাস্তবতার আভাস পাই, যেখানে যেকোনও দিগন্তই ক্ষণিক প্রভা।

    মার্চ ৩১
    আমার বন্ধুরা ব্যাচেলর পার্টির আয়োজন করে। একজনের বাড়ির ছাদে, আমরা সবাই গোল করে বসে মদে ডুব দিয়েছিলাম। সেই পার্টিতে একজন বন্ধুর প্রতিবেশী একটি মেয়েও এসেছিল। মেয়েটির সঙ্গে বন্ধুই আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর সে আমার পাশে এসে বসে। আমি বিয়ে করছি শুনে সে ভ্রূ কুঁচকে, ঠোঁট সামান্য বেঁকিয়ে বলেছিল, ‘আমি জানি না আপনাকে অভিনন্দন জানাব, না-কি সমবেদনা।’ তার কথা শুনে, আর মুখের ভঙ্গিমা দেখে আমি বিরক্ত হয়েছিলাম। আমি সৈনীর ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম। যদিও বন্ধুদের কয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি বিয়েটা কেন করছি? ওরা জানত আমি অত্যন্ত বোরিং, প্রাচীনপন্থী, অন্তর্মুখী মানুষ, যার টেকনোফোবিয়া আছে, যাকে ফেসবুকে পাওয়া যায় না, যে দিনের অধিকাংশ সময় ফোন বন্ধ করে রাখে। কেউ কেউ আমাকে আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর মনে করত। আদতে সৈনীর সঙ্গে আমার কোনও চরিত্রিক বৈশিষ্ট্য মেলে না। কিন্তু আমি আলাঁ বাদিউ'র দর্শনে ভরসা রেখেছিলাম তখনও। 
     সবাই অত্যাধিক নেশায় ঢুলছিলাম, একজন মাংস পোড়ানোর চেষ্টা করছিল। আমি একটু দূরে, একটা অন্ধকার কোনায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, একটানা সবার সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না তাই। মেয়েটি কখন যেন আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল, টের পাইনি। সে আমার শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে বুকে হাত বোলাতে থাকে। জানি না তখন আমার কী মনে হয়েছিল, আমি মেয়েটিকে চুমু খেতে চেয়েছিলাম। আর তার দিকে ঘুরে চুমু খেতে গিয়ে দেখলাম, মেয়েটির সামনের দাঁতগুলো নেই। ফোকলা। আমি তাকে সজোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলাম।
     বাকি মাতালরা সেই দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেছিল। মেয়েটির প্রতিবেশী, আমার বন্ধুটি তাকে টেনে তোলে। সবাই আমার দিকে বোকা বোকা চোখে তাকিয়েছিল, সবাই অপেক্ষা করছিল আমার কিছু করার বা বক্তব্যের জন্য। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার নিজেকে দেখার প্রয়োজন ছিল, যে, আমার অস্তিত্ব তখনও রয়েছে কি না; আমি দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে, বন্ধুর ফ্ল্যাটের বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আয়নায় আমার লোমহীন মুখখানা দেখলাম, ততদিনে আমার এই মুখশ্রী দেখতে দেখতে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি চোখে-মুখে জল দিলাম। উপরে সবাই আবার কথা বলছিল, গান গাইছিল। আমি বাথরুম থেকে বেড়িয়ে ছাদে গিয়ে দেখলাম, মেয়েটি চুপচাপ বসে মদ্যপান করছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করি।
     এরপর রাত বাড়লে, আগুনকে অনুভব করতে ইচ্ছে করছিল। আমার ভিতরটাকে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম; সম্পূর্ন অচেতনে ডুবে যাওয়া পর্যন্ত সেদিন মদ্যপান করেছিলাম।

    এপ্রিল ১৫
    অফিস যেতে গিয়ে দেখলাম, আমার যাওয়ার রাস্তা উধাও। আমিও যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক রোগী। আমি গাড়ি চলাচলের শব্দ, মানুষের কণ্ঠস্বর শুনছিলাম, কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হল একটা কুকুর আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল, কুকুরটাকে দেখতে পাইনি শুধুমাত্র তার লেজের দুলুনি ছাড়া। বায়ুস্তর বাড়ি আর গাছের উপরে মেঘের মতো স্থির হয়েছিল। আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম বায়ুর মেঘ। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল, তাই সৈনীকে ফোন করলাম।
        ‘এখনই দেখা করতে চাই।’
        ‘এখন? আজ তোমার অফিস নেই?’
        ‘ছিল। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আমি কোথায়?’
        ‘তুমি সকালবেলাতেই নেশা করেছ?’
        ‘বিগত কয়েকদিন ধরেই দেখছি, আমার পৃথিবী অ্যালকোহলের মতো উবে যাচ্ছে। আমি কী করব?’
        ‘মেরুদণ্ড সোজা রেখে পরিষ্কার করে বলেই দাও, তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইছ না। এইসব আজগুবি গল্প সকাল সকাল আমাকে না শোনালেই পারতে। এমনিতেই মাথা ধরে আছে।’
        বিয়ের থেকে পিছিয়ে আসার কোনও লক্ষ্য আমার ছিল না।
        ‘আমি মিথ্যে বলছি না। বিশ্বাস করো।’
        ‘ঠিক আছে। আমি ক্লান্ত। এখন ফোন রাখো।’
        ‘তুমি ক্লান্ত নও, অবুঝ। আমাকে তুমি বুঝবে না।’

    এপ্রিল ২৪
    বিবাহ রেজিস্ট্রি অফিসে পৌঁছতে আমার দেরি হল, কারণ রেজিস্ট্রি অফিসে যাওয়ার পথটাও উধাও হয়েছিল। প্রথমে গাড়ির চালক ভেবেছিলেন আমি মজা করছি। পরে সম্ভবত আমাকে পাগল ভেবে তিনি বোঝালেন, সবকিছু ঠিক আছে, আমি যেন শান্ত হয়ে বসে থাকি। ভয়ে আমি চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। যদিও রেজিস্ট্রি অফিসের দরজাটি সটান দাঁড়িয়েছিল আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য। সৈনী সেখানে আমার অপেক্ষায় ছিল। ওর বাড়ির লোকজন ওকে বেশ তোয়াজ করছিল, যাতে আমার সঙ্গে অন্যান্য আত্মীয়দের সামনে অপমানজনক ব্যবহার না-করে। আমি ওর কাছে যেতেই, একগুচ্ছ অভিযোগ আমার দিকে নিক্ষেপ করেছিল, ‘তোমার জন্যই আমার মেকআপ নষ্ট হয়েছে, আর দেখো আমাকে কেমন রাত জাগা বেশ্যার মতো দেখাচ্ছে!’ আমি সৈনীকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই, ও আমার গালে কষিয়ে থাপ্পড় মারে। অবশ্যই সবার আড়ালে। আমি নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম।
     অফিসার আমাদের কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমি যখন আমার পরিচয়পত্রের জেরক্স কপি এগিয়ে দিচ্ছিলাম, দেখলাম সেটায় আমার মুখ নেই। যদিও তিনি সেটাকে গ্রহণ করেছিলেন। তারপর আমাদের সই করতে বলেন তিনি—দেখলাম ফর্মে কোথাও কিছু লেখা নেই। আমি সে কথা সৈনীকে জানিয়েছিলাম।
        ‘দয়া করে আজকের দিনটাতে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা কর।’ কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলেছিল সৈনী। 
     আমি একরকম শূন্যেই সই করেছিলাম, যদিও আমার কলমে কালি ছিল না। অফিসারটি অন্ধ। তিনি কি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না?
     খেয়াল করলাম, সৈনীর বাড়ির আত্মীয়দের ঠিক মানুষের মতো দেখতে লাগছিল না, আমার খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল। সৈনীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি একবার চিৎকার করতে পারি কি? ও কটমট করে আমার দিকে তাকায়।
     কী অপরূপ ওর চোখ দু’টো! ও যে এত সুন্দর, আমি আগে কখনও অনুভব করিনি। আমি ওকে অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলাম। আর পরমুহূর্তেই ওকে চুমু খাওয়ার ইচ্ছেটাকে আটকাতে পারলাম না। ও আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। আমি জোর করেই ওকে আমার দু’হাতের মাঝে চেপে ধরেছিলাম। আমার জিভ ওর ঠোঁট খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, আর সৈনী মুখ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই আমি ওর ঠোঁট কামড়ে দিয়েছিলাম। 
     সৈনীর আত্মীয়রা কী যেন বলাবলি করছিল, আমি সে দিকে তাকাতেই দেখলাম, তারা সবাই এক চোখের, এক হাতের এবং এক পায়ের বীভৎস আকৃতির জীব। কোন সার্কাস থেকে পালিয়ে তারা সেখানে এসেছিল?
     সৈনীর ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছিল, ও যথাসম্ভব চেষ্টা করছিল রক্ত ঢেকে রাখার। যদিও আমি ওর দিক থেকে আমার চোখ সরাতে পারছিলাম না। আমি দেখলাম, সৈনীর শাড়ি একটু একটু করে উধাও হয়ে গেল। পরনে তখন শুধুই অন্তর্বাস। অথিতিদের কথার স্রোত থামছিলই না। মনে হল, তারাও ওকে প্রায় উলঙ্গ অবস্থাতেই দেখতে পাচ্ছে! আমি বিব্রত বোধ করলেও নিজেকে শান্ত রেখেছিলাম। অথিতিরা ঠিক কী নিয়ে গুঞ্জন করছিল, সেটা শোনার চেষ্টা করলাম। আমি নিজেকে শেষ পর্যন্ত সংযত রাখতে না-পেরে চেঁচিয়ে উঠে বলেছিলাম, ‘আপনারা দয়া করে চুপ করুন। অন্য দিকে তাকান। ওকে কেউ একটা কাপড় এনে দিন।’
     সৈনী আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলেছিল, ‘পাগলের প্রলাপ বন্ধ করো। রেজিস্ট্রি হয়ে যাক, আমরা আলাদা করে কথা বলব।’ একজন বিকৃত মানুষকে নিজের জীবন সঙ্গী করার অর্থ কী?
     তবুও আমি চুপ করে থাকতে পারছিলাম না, সৈনী ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়ে ফেলছিল—ওর হাত দুটো, নাক, কান… আমি ওর শিরা দেখতে পাচ্ছিলাম, ভিতরের মাংসপেশী, ওর ভিসেরা… সৈনীর রক্তের গন্ধে আমার গা গুলিয়ে আসছিল।
     মানুষের শরীর কত লিটার রক্ত ধারণ করতে পারে? আমার বমি পাচ্ছিল।
     অফিসারটি জানালেন, ‘আজ থেকে আপনারা আইনত স্বামী-স্ত্রী হলেন। দু’সপ্তাহ পরে সার্টিফিকেট পেয়ে যাবেন। এছাড়া ইমেলে সফ্‌টকপি পাঠিয়ে দেব।’ অথিতিদের একজন কেশে একই কথা পুনরাবৃত্তি করলেন এবং আরও সংযোজন করেছিলেন, ‘নাও হে, মালা পরিয়ে দাও।’
     আমি অবশেষে সাহস সঞ্চার করে নিজের মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি সৈনীর পাশে থাকব। তারপর মালা পরানোর জন্য আমি সৈনীর দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম, সে যে শুধুই কংকাল! ওর মাথার খুলি যেন আমাকে বিদ্রূপ করছিল। আমি কি ভুল দেখছি? সৈনী যে কংকাল নয়,  সেটা নিশ্চিত করতে, আমার প্যান্টের পকেটে হাত রেখেছিলাম। ছুরিটা শক্ত করে ধরে, আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ওর পাঁজরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। আমার মনে পড়ছিল আমাকে নিয়ে বলা সৈনীর আজেবাজে কথা, ওর রসিকতা, ওর চেহারা, আর ওর সেই বীভৎস হাসি, যেন আমি একটা গাধা ছিলাম। আমি ওর বুক থেকে ছুরিটা বের করে নিতে সৈনী মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল।
     আমি দেখছিলাম রেজিস্ট্রি অফিসের ছাদ উধাও হয়ে, সূর্যরশ্মি সব পুড়িয়ে দিচ্ছে। সবাই চিৎকার করছিল, সৈনীর বাড়ির লোকজন হুমড়ি খেয়ে ওর নিথর শরীরের পাশে বসে পড়েছিল। তারপর তারা যখন আমাকে ধরার চেষ্টা করে, আমি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলাম। আমি সেখান থেকে চলে আসার সময় দেখলাম রাস্তা ঝাপসা, সূর্য বাষ্পীভূত হয়ে গলে গলে পড়ছে। আমি দৌড়তে থাকলাম, আমার পা অবশ হয়ে আসছিল। চারদিকটা তখন বাতাসহীন, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না… শুধুই চিৎকার, কোলাহল… আমার হৃদস্পন্দনের শব্দ এইসব কিছুকে ছাপিয়ে আমার কানে বাজছিল।

    আমি যখন আমার বাড়িতে পৌঁছলাম, তখন সামনের দরজাটা বন্ধ ছিল। কিন্তু আমি সেটাকে ভেদ করে ভিতরে ঢুকতে পেরেছিলাম অশরীরীর মতো। ভিতরে আসবাবপত্র মেঝে ছাদ সব বাষ্পীভূত হয়ে উবে যাচ্ছিল।
     আর আমি তখনই, এই সাদা পাতাগুলো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে এই কথাগুলো দ্রুত লিখতে শুরু করলাম…
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2607:fb91:1027:4e3c:a4a7:fd0:9ddd:***:*** | ২৫ জুলাই ২০২৫ ১৯:৪৮732700
  • আমার ভালো লাগলো এই গল্পটা। খুব ভিজুয়াল লেখা। পড়তে পড়তে মনে হলো এটা গল্পের থেকেও বেশি যেন একটা শর্ট ফিল্ম। শূণ্যতার কনসেপ্টও বেশ ছুঁতে পারলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন