এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অপার বাংলা  উৎসব

  • চোত-বোশেখের পালা 

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    অপার বাংলা | উৎসব | ১৩ এপ্রিল ২০২৪ | ৫৭৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • চৈত্রসংক্রান্তি, ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ

    আমাদের কালে সে সব দিন অন্যরকম ছিল। আমরা, সওদাগরি আপিসের কেরানি বাবুরা কাছাকাছি জেলার গেরাম গঞ্জ থেকে কলকেতায় আসিতাম রুজি রোজগারের আশায় কিংবা ছেলে পিলেরা আসিত ভালো নেকাপড়া শিকিয়া দেশের দশের উবগার করার আশায়। মৌমাচির চাকের মতো আমরা বাসা বাঁধিতাম কলকেতার মেসবাড়িগুনোতে। সে সব মেসবাড়িতে দিনরাত ভনভন ভ্যানভ্যান লাগিয়াই থাকিত। আমাদের সংগে কলকেতার তকনো এত মাকামাকি হয়ে ওটেনি, আমারা হপ্তা-পনেরদিন কলকেতায় থাকিতাম ঠিকই, কিন্তু ছুটিছাটা পাইলেই ন্যাজ তুলিয়া গেরামের বাড়িতে পলাইতাম। কলকেতাকে আমরা তকনো পরবাস ভাবিতাম, গেরামের বাড়িতে  ফিরিয়া ডাঙ্গার মাচ জলে পড়িয়া পরাণ ফিরিয়া পাইতাম।

    চোত মাসের প্রায় পুরোটাই আমরা গেরামেই থাকিতাম। বাসন্তীপুজো, রামনবমী, চড়কের মেলা সব মিলিয়ে গেরামে টানা মোচ্ছব চলিত। এই মাসে বাড়িতে কুটুম্বদের আসা যাওয়া চলিতেই থাকিত। ঘরে ঘরে খাওয়া দাওয়া, বাহিরে ড্যাং ড্যাংআ, ড্যাং ড্যাং ঢাকের বাদ্যি; গেরামের লোকেরা মজায় খুব মজিয়া থাকিতাম।

    বেলা একটু বাড়িলেই, মাঠের দিকে চাহিয়া দেকিতাম চোতের রোদ্দুরে দূরের ঝোপঝাড়, গাছপালা ঝিলিমিলি করিত। এলোমেলো শুকনো দোকনো হাওয়া বহিত শনশন। শীতের ঝরাপাতারা, সেই হাওয়ার হাত ধরিয়া ঝরঝর শব্দে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ঘূর্ণী নেত্য করিত । আর জলখাবারের বেলা পার হইলেই আমারা সেই ডাক শুনিতাম “বাবা তারকনাতের চরণের সেবা লাগি, বাবা মহাদেব”। মাঠের ওধার থেকে ডাক দিয়ে দিয়ে একমাসের ব্রত নেওয়া সেই সন্নিসির দল গেরস্তর বাড়ির দুয়োরে দুয়োরে ভিখ মাগিয়া বেড়াইত। আমাদের দোরের সামনে আসার আগেই ঠাকমা বলিতেন “অ বউমা, ওই সন্নিসির দল আসছে, সিধে ঠিক করো, বাছা”। সিধে মানে সিদ্ধ করিয়া খাইবার যোগাড়। তাহার মধ্যে থাকিত, আতপ চাল, একটু মুগ, ছোলা কিংবা মটর ডাল, আর টুকটাক কিছু সবজি, আলু, বেগুন, কাঁচকলা কিংবা কুমড়োর ফালি। ছোট বেতের বোনা ধামায় মা সিধে সাজাইয়া তুলিতেন। ছোট্ট একটি মাটির ভাঁড়ে একটু সরষের তেল, অন্য আরেকটি ভাঁড়ে নুন, কাঁচালংকা। আমাদের দুয়োরের সামনে সেই সন্নিসিদের দল এসে দাঁড়াইত আর বলিত “জয় বাবা তারকনাতের জয়”। ঠাকুমা কিংবা মা তাদের ঝোলায় সেই সিধে ঢালিয়া দিত। সিধে নেওয়ার পর সন্নিসিরা বলিয়া উঠিত “বাবা মহাদেব”।
    এই ধরনের ব্রত রাখা সন্নিসিরা ছিল একাহারী, দিনের বেলায় একবার মাত্র দুপুরের ভোজন, সূর্যাস্তের পর খাওয়া নিষিদ্ধ। সন্নিসিদের আরো নিয়ম ছিল, তাদের দলের সকলের একবেলার মতো খাবার যোগাড় হইলেই ভিক্ষার সমাপ্তি। একেই মাধুকরী বলা হইত। পরের দিনের জন্য খাবার জমাইয়া রাখিলে ব্রতর বিধি ভাঙ্গিয়া যাইত, আর বাড়তি চাল ডাল সবজি বিক্রি করিবার কোন প্রশ্নই ছিল না, সে ছিল মহাপাপ। পর্যাপ্ত সিধে যোগাড় হইয়া গেলে, তারা মাঠের ধারের পায়ে চলা পথ ধরিয়া চলিয়া যাইত চড়ক মেলার মাঠে। খোলা মাঠের মধ্যে কাঠকুটা যোগাড় করিয়া, ইঁট কিংবা পাথরের টুকরোর ওপর মাটির বড়ো মালসার মধ্যে রান্না করিত ফ্যানভাত, সবজিসেদ্ধ, ডালসেদ্ধ। রান্না সারিয়া, পুকুর হইতে ডুবকি স্নান সারিয়া, তাহারা সবাই গোল হইয়া বসিয়া সরিষার তৈল আর নুন মাখিয়া সিদ্ধান্ন সেবা করিত। হাপুস হুপুস শব্দ উঠিত, জিভে কাঁচালংকার ঝাল লাগিলে আওয়াজ করিত সি সি সি সি। খাওয়া সাঙ্গ হইলে মাটির যতো মালসা আর পাত্র ফেলিয়া দিত আস্তাকুঁড়ে। বাসনপত্র, তৈজস সামগ্রী কোন কিচুর প্রতিই লোভ কিংবা মায়া যেন না আসে, তাই এই বিধান। যাহাদের এই মায়া থাকে তাহারা তো সন্নিসি নয়, তাহারা গেরস্ত।
    একমাস অবধি এই সন্নিসিব্রতর পর শেষ দিনে এই সন্নিসিরা এবং আশে পাশের অন্য গ্রামের সন্নিসিরাও আসিয়া জড়ো হইত চড়ক মেলার মাঠে। মোটা শালের লম্বা বল্লীর অনেকটা মাটিতে গাড়িয়া খাড়া হইতো চড়ক গাছ। তাহার মাথায় লোহার তৈরি মোটা শূল। শক্ত পোক্ত লম্বা একটি বাঁশের ঠিক মাঝখানে গোল ফুটা করিয়া লোহার রিং পড়ানো থাকিত। গোল এই ফুটার মধ্যে শালের মাথার শূলের উপর বসাইলে, চড়কগাছ প্রস্তুত, মস্ত এক T-র মতো দেখিতে হইত।  সেই বাঁশের দুই প্রান্তে থাকিত লোহার মোটা হুক, সেই হুকের মধ্যে লম্বা রশি পড়ানো থাকিত। রশির এক প্রান্ত ধরিয়া থাকিত বয়স্ক আর অভিজ্ঞ কয়েকজন সন্নিসি। আর অন্য প্রান্তে থাকিত পোক্ত লোহার তৈরি বঁড়শির মতো হুক। দুই প্রান্তের দুই হুকে, কোমরে দড়ি বাঁধিয়া এবার দুই সন্নিসি বলিয়া উঠিত “বাবা তারকনাথের সেবা লাগি”। সমস্বরে উপস্থিত সমস্ত লোক চিৎকার করিয়া উঠিত “বাবা মহাদেব”। এইবার অন্য প্রান্ত ধরিয়া থাকা অভিজ্ঞ সন্ন্যাসীরা, রশিতে টান দিতেই, কোমরে হুক বাঁধা ওই দুই সন্নিসি ঝুলিয়া পড়িত শূণ্যে। রশির টানে তাহারা দুইজন, উঁচুতে আরো উঁচুতে উঠিতে উঠিতে, চড়ক গাছের T-র দুই প্রান্তে  দুলিতে থাকিত। ওপর থেকে সন্নিসি দুইজন চিৎকার করিয়া বলিত “বাবা তারকনাথের সেবা লাগি”। নিচেয় দাঁড়ানো, অভিজ্ঞ সন্ন্যাসীরা স্বস্তির শ্বাস লইয়া বলিত “বাবা মহাদেব”। এই দুই জয়ধ্বনির অর্থ একটু অন্যরকম, অনেকটা সংকেতের মতো। ওপরের দুই সন্নিসি জয়ধ্বনি দিয়ে আসলে বলিল, তাহারা ঠিক আছে, কোন অসুবিধে নেই।  আর নিচের সন্নিসিরা জয়ধ্বনিতে নিশ্চিন্ত হইয়া যেন বলিল, যাক বাবা, এবার তবে শুরু করিতেছি।
    এই শুরু হইবার সময়টাতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসিত। কারণ, নিচের সন্ন্যাসীদের দড়ির টানে তখন চড়ক গাছের মাথা ঘুরিতে শুরু করিয়াছে। ঘুরিবার গতি বাড়িতে বাড়িতে চড়ক গাছের মাথা বন বন করিয়া ঘুরিতে লাগিত। সুতোয় বাঁধা ঢিলের মতো, ঝুলিতে থাকা দুই সন্ন্যাসীও মহাশূণ্যে ঘুরিতে থাকিত বন বন করে। সেই দৃশ্যে ভয়ে আমার চোখ বন্ধ করিয়া ফেলিতাম, সর্বদা মনে হইত, যদি কিছু একটা ঘটিয়া যায়, সন্নিসি দুইজনার কি হইবে! আশেপাশের দর্শকরা ভয়াকুল বিস্ময়ে চিৎকার করিয়া উঠিত “জয় বাবা মহাদেবের জয়”।
    সেকালে চড়কের মেলায় চড়কগাছের ওই ভয়ংকর খেলা ছাড়াও আরো অনেক খেলা দেখিয়া শিহরিত হইতাম। সন্নিসিরা জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়া নগ্ন পদব্রজ করিতেন। কেহ কেহ জিহ্বায় লৌহ শলাকা বিদ্ধ করাইত; কেহ বা হাতের জ্বলন্ত মশালে মুখ হইতে মাটির তেল নিক্ষেপ করিয়া, আগুনের তীব্র হলকা সৃষ্টি করিত। সন্নিসিদের এইসব ভয়ংকর খেলা দেখিয়া বাল্যকালে আমরা অভিভূত হইতাম। এই সব খেলা দেখিবার পর পিতার হাত ধরিয়া আমরা মেলার নানান পসরা দেখিতাম। পাঁপড় ভাজা, উষ্ণ জিলিপি, আলুর চপ, বেগুনি সহযোগে মুখের স্বাদ বদল করিতাম। মায়ের জন্যে লোহার সাঁড়াশি, তেল উঠাইবার পলা, আলতা, সিঁদুর, ভগিনীদের জন্য কাঠের পুতুল, কাঁচের রঙিন চুড়ি। আমরা ভ্রাতাগণ মাটির তৈরি কলা ও পেয়ারা, সুভাষ বোস ও রবি ঠাকুর, কাঠের গোশকট, জিভ বের করা তুলার কুকুর লইয়া বাবার সঙ্গে যখন ফিরিতাম, সূর্য তখন পাটে বসিবার যোগাড় করিতেছেন। মেলায় দীর্ঘক্ষণ ঘুরিয়া পরিশ্রান্ত কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে আমাদের পিতা কাঁধে তুলিয়া লইতেন। পিতার কাঁধে উঠিয়া পথচলার মজাই আলাদা। কনিষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি স্নেহ মিশ্রিত ঈর্ষা লইয়া, পিতার হাত ধরিয়া আমরা গেরামে ফিরিতাম। 
     

     
    পয়লা বৈশাখ, ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ

    সেই কালে মোকাম কলকেতার নানান অঞ্চলে চড়কের মেলা বসিত। আমাদের শৈশবে কিংবা বাল্যে দেখা আমাদের গেরামের মেলার সহিত তাহার বিস্তর ফারাক। কলকেতার মেলায় অনেক বেশি জাঁকজমক। কাঠের নাগরদোলা। কাঠের হাতিঘোড়ায় বসিয়া বন বন করিয়া ঘুরিবার মেরিগোরাউণ্ড। চোখধাঁধানো মনোহারি পসরা কিংবা খাদ্যসামগ্রী, সব ব্যাপারেই কলকেতার মেলা বিশিষ্ট। কাঁচের ও চিনামাটির তৈরি সায়েব-মেম পুতুল। রূপার তবক দেওয়া মিঠা পান। নানান রঙের সিরাপ দেওয়া, বরফ শীতল রঙিন সরবৎ। মালাই কুলফি। যুবাবয়েসে বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়িয়া  কলকেতার মেলা বেশ কয়েকবার দেখিয়া অবাক হইয়াছিলাম, কিন্তু তাহাতে প্রাণের সাড়া পাই নাই। বরং মজা পাইয়াছিলাম অন্যত্র।
    কলকেতার চেতলার হাট মশারি আর মাছের জালের জন্যে বহুদিন হইতেই বিখ্যাত। কিন্তু আমি চেতলার যে মোহজালে মুগ্ধ হইলাম তাহা সংয়ের সাজ। পয়লা বোশেখের আগে ও পয়লা বোশেখের দিন চেতলার সং দেখিতে জন সমাগম হইত বিস্তর। কার্বাইড গ্যাসের চোখধাঁধানো উজ্জ্বল আলোয় বিচিত্র বেশে বেশ কিছু লোক সাজিয়া উঠিত। কলকেতার বাবুদের নষ্টামি, আখড়ার মহারাজদের ধ্যাষ্টামি, কূলবধুদের গোপন ভ্রষ্টামি, মোহান্ত এলোকেশী সম্বাদ; এসব নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ তো ছিলই। তাহার উপর আরো থাকিত নির্ভেজাল হাসির উপস্থাপন। বুকফাটা কান্না, দমফাটা হাসি, আহ্লাদে আটখানা, কাজের ভারে কুঁজো। সন্ধ্যার পর জেলেপাড়ার সঙদের সেই মিছিল সমাবেশ, উপস্থিত জনগণের সহিত আমরাও অত্যন্ত উপভোগ করিতাম।
    পয়লা বোশেখের দিন সকালে ভৃত্যের মাথায় বেতের ধামায় লালশালুমোড়া জাব্দা খাতা, শ্রীগণেশ ও শ্রীলক্ষ্মীর মূর্তি, লক্ষ্মীদেবীর ঝাঁপি লইয়া বাবুদের কেরানীরা দলে দলে আসিতেন কালীঘাটের কালী মন্দিরে। মন্দিরে পুজার ভিড়ে রীতিমতো হট্টগোল উপস্থিত হইত। দাপুটে বাবুদের কেরানীরা অর্থের দাপট দেখাইতে কসুর করিতেন না, তাঁহাদের উৎকোচে মন্দিরের পুরোহিতগণের মধ্যে হুড়াহুড়ি পড়িয়া যাইত। এই পুরোহিতগণ মাকালীর সহিত সরাসরি যোগাযোগ ঘটাইয়া সম্বৎসরের ব্যবসার সুবন্দোবস্ত করিয়া দিবার আশ্বাস দিতেন। পুজার পর তাঁহারা জাব্দা খাতায় আলতাকালিতে উপরে ‘ওঁমা’, তাহার নিচে ‘শ্রীশ্রীকালিমাতা সহায়’ লিখাইয়া লইতেন। তাহার নিচে স্বস্তিকা চিহ্ন আর একদম নিচের দুই কোণায় আলতায় ডোবানো রৌপ্যমুদ্রার দুই পিঠের মোহর।
     
    সজনে ডাঁটার শুক্ত, রুই মাছের মুড়ো দেওয়া ভাজা মুগের ডাল, ঝিরিঝিরি আলুভাজা, পটল-আলুর মাখোমাখো তরকারি, রক্তরাঙা ঝোলের মধ্যে দুইখানি অর্ধগোলক আলু সহ অনেকটা কচিপাঁঠা, কাঁচা আমের পাতলা অম্বল। সবার শেষে মিঠে দধি। এইরূপ আকণ্ঠ মধ্যাহ্ন ভোজের পর, গালে গৃহিণীর হাতের পান লইয়া, পয়লা বোশেখের দুপুরটি দিবানিদ্রায় অতিবাহিত হইত, জানালা দরোজা বন্ধ প্রায় অন্ধকার ঘরে।
     
    দিবানিদ্রা সারিয়া বারান্দায় যখন বসিতাম, পথের আলো জ্বালাইবার জন্য পুরসভার কর্মচারি লম্বা আঁকশি হাতে দৌড়াইয়া চলিত। পাড়ার যতো বাড়ির দরোজায় দরোজায় বেলফুলের মালা লইয়া ফিরিওয়ালা ডাক পাড়িত “বেইলফুউউল”। তাহার চিকন কণ্ঠের সুরে ও বেলফুলের সৌরভে প্রথম বৈশাখের সন্ধ্যাটি বড়ো মধুর হইয়া উঠিত। তাহার পশ্চাতে আসিত মালাইবরফ এবং কুলফি মালাইয়ের ফিরিওয়ালা। পাড়ার বখাটে ছোকরার দল তাহাকে আড়ালে ডাকিয়া সিদ্ধি মিশ্রিত কুলফি মালাই খাইত ও অকারণ হাসিতে পাড়া মাতায় তুলিত।
    সন্ধ্যার পর, পাটভাঙা ধুতি আর গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি পড়িয়া রাশভারি মুখে বাহির হইতাম। পায়ের পাম্পশুতে মচ মচ ধ্বনি তুলিয়া যখন হাঁটিতাম নিজের ভারিক্কি চালে নিজেই অবাক হইতাম। গেরামে থাকিতে যাহারা আমাকে ‘আঁত্তা’ বলিয়া চিনে, তাহারা আমার এই ‘আত্মারামবাবু’ মার্কা চেহারা দেখিলে কিরূপ ভিমরি খাইত কল্পনা করিয়া, বড়ো আল্লাদ পাইতাম।  
    কালেজ স্ট্রিটের মেডিক্যাল কলেজের বিপরীতে কল পাইপের বিপণিগুলির অধিকাংশই আমাদের দেশজ সুহৃদদের মালিকানা। সেই কালে হালখাতা উপলক্ষে এই সব বিপণির উদার হৃদয় মালিকেরা অতিথি আপ্যায়নের বিপুল আয়োজন করিত।
     
    দোকানের প্রবেশ পথেই একজন কর্মচারী পিচকারি হইতে মাথায় মুখে গায়ে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করিয়া গোলাপজল ছিটাইত। সদ্য গ্রাম হইতে আসিয়া কলকেতা নিবাসী হইবার পর যেবার প্রথম হালখাতা অনুষ্ঠানে আসিয়াছিলাম, এই ঘটনায় অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছিলাম। বলা নাই কওয়া নাই, খামোখা আমার গাত্রে জল ছিটাইয়া দেওয়া, এ কী ধরনের রসিকতা? সৌভাগ্যক্রমে সেই ক্ষণে বিপণির মালিকপুত্র “আসুন খুড়ামহাশয়” বলিয়া আমার হাতে ঝাউপাতায় মোড়া গোলাপকলি উপহার দিয়া ভিতরে বসাইয়াছিল। নচেৎ সেদিন হয়তো কুরুক্ষেত্র বাধাইয়া নিজেকেই হাস্যাস্পদ করিতাম। বসিবার পর দেখিলাম ওই কর্মচারি সকলকেই ওই জল ছিটাইতেছে, ও তাহাতে গোলাপের সুবাস। ক্রোধ প্রশমিত হইলে, নিজ গাত্রেও ওই গোলাপজলের সুবাস উপলব্ধি করিয়া চমকিত হইলাম।
     
    বিপণির ভিতরের প্রাত্যহিক ব্যবসায়িক পরিবেশ আজ নাই। উজ্জ্বল আলোর নিচে ফরাস পাতা, তাহাতে ধবধবে চাদর বিছানো। ফরাসে বসিয়া অশীতিপর এক মুসলিম বৃদ্ধ সানাই বাজাইতেছেন। তাঁহার সহিত তবলায় একজন সঙ্গত করিতেছেন। সেই সানাইয়ের মাঙ্গলিক সুর যেন নতুন বর্ষের শুভদিনের সূচনা করিতেছে। কিন্তু আশ্চর্য, সেই সুরের প্রতি উপস্থিত কাহারো মনোযোগ নাই। সকলেই নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপে ব্যস্ত। সকলের হাতেই কি এক পানীয়ের বোতল, তাহাতে সরু পাইপ বসানো। সেই পাইপে ঠোটঁ লাগাইয়া হাল্কা চুমুকে সকলে পানীয়ের মজা লইতেছে। এই পানীয় কি সুরা জাতীয় কিছু? কলকেতার নব্য বাবুরা কি প্রকাশ্য সন্ধ্যালোকে নির্লজ্জের মতো মদ্যপান করিয়া থাকে?
     
    এই সব ভাবিতে ভাবিতে বিপণির মালিক অমিয়ভূষণ মহাশয়, আমার কাছে আসিয়া নমস্কার করিয়া বলিলেন, ‘সব ভালো তো আঁত্তাবাবু, কোন রকম সংকোচ করবেন না। আরে একি, আপনাকে কোল্ডিংক দেয় নি? অ্যাই ব্যাচা, এদিকে একটা কোল্ডিংক নে আয়। বাড়ির সব খপর ভালো? বাচ্চা পরিবার, সবাই? হে হে হে, খুব ভালো। আরে আসুন আসুন বিপত্তারণবাবু, আজকাল আপনার আর দ্যাকাই পাওয়া যায় না, আমি ওদিকটা একবার দেকে আসি, যেদিকটা না দেকবো, সেকানেই ...বোয়লেন না’? অমিয়ভূষণবাবু অন্যদিকে যাইবার পরেই ব্যাচা আমার হাতে এক বোতল শীতল পানীয়ের মধ্যে সরু পাইপ ডুবাইয়া দিয়া গেল। অন্যদের দেখাদেখি কায়দা করিয়া আমিও পাইপে অধর চাপিয়া পানীয় টানিয়া লইলাম। স্বাদ মন্দ নয়। স্বাদ ও গন্ধে মদ বলিয়াও মনে হইল না, কারণ ইহার পূর্বে কুসঙ্গে পড়িয়া দু একদিন ব্রান্ডির স্বাদ লইয়াছিলাম।
     
    কিন্তু ও কী ও, আমার এ কী হইল? পানীয় গলাধঃকরণের পরই পেটের মধ্যে বিশাল উদ্গারের উদ্গম হইল। আমি রোধ করিতে পারিলাম না, আমার কণ্ঠ হইতে অদ্ভূত এক শব্দ নির্গত হইল। মনে হইল আমার উদরের অজ বালক পুনর্জীবন পাইয়া তাহার মাতার সন্ধানে ডাকিতেছে। আমার আশেপাশে উপবিষ্ট, বিশিষ্ট জনের দুই চারিজন আমার বাণীতে চমকিত হইলেন, ঘাড় ফিরাইয়া আমার আপাদমস্তক মাপিয়া লইলেন। ইহার পর ওই ভুল আর করি নাই, পাইপে হাল্কা টানে অল্প পানীয় পান করিতে লাগিলাম। তাহাতেও ছোট ছোট উদ্গার উঠিতেছিল, কিন্তু আমি সেগুলিকে নাসিকা পথে ছাড়িতে লাগিলাম। তাহাতে নাসিকা জ্বলিতে লাগিল, কিন্তু সম্মান রক্ষা হইল। এমন পানীয় মনুষ্যজাতির সভ্যতায় কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত করিবে, বলিতে পারি না।
    অমিয়ভূষণবাবুর বিপণি হইতে দুইখানি বাঙ্গালা ক্যালেণ্ডার ও দুই বাস্কো মিষ্টান্ন লইয়া বিদায় লইলাম। তাহার পর আরো ছয়খানি পরিচিত বিপণিতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়া টানা রিকশয় গৃহে ফিরিলাম। আমার বগলে তখন পাঁচখানি বাঙ্গালা ক্যালেণ্ডার ও দুই হাতে নয় বাস্কো মিষ্টান্ন। আরো দুইখানি হাত থাকিলে, আরো কয়েকটি বিপণিতে যাইতে পারিতাম ভাবিয়া আক্ষেপ হইল। কিন্তু বিধির বিধানে হাত মাত্র দুইখানি!
     
    রাত্রের রন্ধন হইতে মুক্তি পাইয়া আমার গৃহিণী আনন্দিতা হইলেন। দুই পুত্র ও দুই কন্যা সহ আমরা সকলে নয়খানি বাস্কো উদরসাৎ করিয়া পরিতৃপ্ত হইলাম। গৃহিণীর বানানো একখানি পান গালে লইয়া বাহিরের বারান্দায় দাঁড়াইলাম। ভাবিলাম পয়লা বোশেখের মঙ্গলরাত্রি বড়ো আনন্দে যাপিত হইল। জানি না কেন এই সময় মনে পড়িল সেই শীর্ণ বৃদ্ধ সানাইশিল্পীর কথা। তাঁহার সানাইবাদনের প্রতি আমাদের কাহারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। একদল শূকরের সম্মুখে মুকুতার মতো তাঁহার শিল্প প্রয়াস তিনি বিতরণ করিতেছিলেন, শুধুমাত্র তাঁহার নিজের ও পরিবারের উদরপূর্তির প্রত্যাশায়।  একজন শিল্পীর, নামজাদা নাই বা হইল, এ হেন অবহেলা আমরা না করিলেও পারিতাম। 
    পয়লা বৈশাখে নববর্ষের এই শুভ দিনটিতে তাঁহার সানাইয়ের সেই মাঙ্গলিক সুর কলকেতার স্বার্থ সন্ধানী মানুষের অন্তরে এতটুকুও দাগ রাখিতে পারিল না। আগামী কল্য দোসরা বৈশাখ, আর পাঁচটা সাধারণ কর্মব্যস্ত দিনের সহিত এতটুকুও ফারাক থাকিবে না। সকালে গৃহিণীর প্রস্তুত মৎস্যের ঝোল-ভাত নাকে মুখে গুঁজিয়া দপ্তরে যাইব। দিনগত পাপক্ষয় করিতে করিতে আরও একটি বৎসর পার হইয়া জীবনে আরও এক পয়লা বৈশাখ আসিবে, ভাবিতে ভাবিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িলাম মনেও নাই।
    • ০০ –

    [আত্মারাম বাগচি মহাশয়ের জন্ম প্রাক-স্বাধীনতা যুগে, কর্ম উত্তর-স্বাধীনতার দিনগুলিতে। তাঁর দিনলিপির আংশিক পরিমার্জিত রূপ “চোত-বোশেখের পালা”, বানান ও শব্দ ব্যবহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।]
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অপার বাংলা | ১৩ এপ্রিল ২০২৪ | ৫৭৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 172.56.***.*** | ১৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:১১530599
  • হ্যাঁ, আমারও খুব ভালো লেগেছে। এই লেখার জন্য ধন্যবাদ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন