স্বর্ণ জয়ন্তী রাজধানী জয়পুর , আজমের , আবু রোড হয়ে আহমেদাবাদ পৌঁছয় বারো ঘন্টায়। শেষ স্টেশন সবরমতী জংশন , যেটা আহমেদাবাদ মূল শহরের বাইরে। সিন্ধু সভ্যতার আমল থেকে চালুক্য হয়ে গুজরাট দিল্লির সুলতানের হাতে যায় আলাউদ্দিন খলজির সময়। তিমুরের দিল্লি জ্বালানোর পর গুজরাটের প্রশাসক নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে আলাদা রাজবংশের পত্তন করেন। ~১৪১৫ য় সেই বংশের সুলতান আহমেদ শাহ রাজধানী হিসেবে আহমেদাবাদের পত্তন করেন। আকবরের সময় আবার গুজরাট মুঘল সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায়।
এই মোটামুটি দেড়শো বছরের স্বাধীন গুজরাটের সুলতানের শাসনামলে আহমেদাবাদে প্রচুর ইসলামিক স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল , বর্তমানে সেজন্য শহরের পুরোনো গোটা চৌহদ্দিই ইউনেস্কো হেরিটেজের তকমায়। এই একই সময়ে বরোদার অদূরে চম্পানরেও বহু ইসলামিক স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল যেগুলো মুঘল স্থাপত্যের থেকে অনেকখানি আলাদা। চম্পানের পাভাগড় পুরাতত্ত্ব পার্কও ইউনেস্কো হেরিটেজ।
সকালবেলা সবরমতী জংশনে নেমে দেখা গেল বর্ষাকাল শেষ হয়ে এসেছে বলে আকাশের মুখ ভার। প্রথমে পাটান এবং মেহসানার কাছে মোদেরার সূর্য মন্দির যাবার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সে এখান থেকে বাসে তিনঘন্টা লেগে যাবে। ফিরতে ফিরতে বিকেল হলে আর আহমেদাবাদের বাকি কিছু দেখা যাবেনা। ফিরতি রাজধানী সন্ধ্যেবেলায়। তার থেকে উবের অটো নিয়ে কাছেই আদালাজ। সকালবেলার ভেজা ফাঁকা জাতীয় সড়কে কুড়ি মিনিট।
আদালাজে জাতীয় সড়ক থেকে বাঁদিক বেঁকে পাঁচমিনিট গেলে আছে রুদাবাই কুয়ো , গুজরাটিতে কুয়োর প্রতিশব্দ ভাভ। বাইরে এ এস আই ফলকে লেখা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে মাঘ মাসে মাহমুদ বাদশার রাজত্ত্বকালে রাজা বীরসিংহের স্ত্রী রুদা এই 'আদালাজ নি ভাভ' তৈরী করান।ওপর লোহার জালে ঢাকা যাতে কেউ নিচে না পড়ে যায়। টিকিট কেটে ভেতরে গন্ডাখানেক পর্যটকের ফটোসেশন করার ভিড়। এই কুয়োগুলো মাটির তলায় দু তিনতলা নিচু। লম্বা লম্বা স্তম্ভ আর তাদের গায়ে । রাজস্থানের কুয়োগুলোর মত চৌকো নয়। দিল্লির কুয়োগুলো এরকম লম্বাটে হলেও ভেতরে আলাদা আলাদা তলা করা নেই। প্রতি তলারই ধারের কার্ণিশ দিয়ে হেঁটে একদম শেষে পৌঁছে যাওয়া যায়।
প্রদীপের মোটিফ বনস্পতির বারান্দাও আছে নামতে নামতে অন্যরকমের খিলান বৃষ্টির জমে থাকা সবুজ জল। কাঠের ছোট বেড়া দিয়ে বন্ধ করা যাতে কেউ জলে না নামতে পারে। আদলাজ থেকে ফেরার পথে গান্ধীনগর - আহমেদাবাদ এয়ারপোর্টের রাস্তায়। রাস্তার ধারে ন্যায়ারা এনার্জি , আদানি সিএনজির পাম্প। গুজরাতের রাজধানী আহমেদাবাদ থেকে কুড়ি কিলোমিটার উত্তরে গান্ধীনগর। মণিভূষণ ভট্টাচার্যের 'গান্ধীনগরে এক রাত্রি' মনে পড়তে পারে। ১৯৭৪ সালে এই অঞ্চল নবনির্মাণ ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। কম করে একশো জনের মৃত্যু এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের চিমনভাই প্যাটেলের ইস্তফা। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের একমাত্র আন্দোলন যা একটি নির্বাচিত সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল। বাংলার নকশালবাড়ি আর গুজরাটের এই ছাত্র আন্দোলনের অজুহাতেই জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
সবরমতির ওপরের সেতু পেরিয়ে আহমেদাবাদ এয়ারপোর্ট। পুরোনো আহমেদাবাদ শহর। যেতে হবে বাই হরির সুলতানি। মাহমুদের হারেমখানার মুখ্য অফিসার এখানে হরিরপুর বানিয়েছিলেন এবং ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে এই কুয়ো , তৎসংলগ্ন মসজিদ চত্ত্বর তৈরী করান।
এই স্থানে ভিড় কম , টিকিট নেই। প্রি ওয়েডিং শুট করতে গেলে এ এস আইয়ের অনুমতি লাগবে , দরজায় এরকম নোটিশ ঝোলানো। কুয়োতে আঁকার ক্লাস। পাঁচ ছ জন কলেজ ছাত্রীকে নিয়ে এসে স্থাপত্য , ওপর থেকে চুঁইয়ে পড়া আলো ছায়া এইসব বোঝাচ্ছেন শিক্ষিকা।
এখানে ওপরে জাল দিয়ে ঢাকা নেই নিচে নামার আগে জলের কাছে সিমেট্রি অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে আছে ভাভ সংলগ্ন মসজিদ। অর্ধেক মিনারের গায়ে খুঁটিনাটি অলংকরণের কাজ করা আছে। বিজ্ঞপ্তি
এবার ঝুলতা গম্বুজ যেতে হবে। যেখানে এক গম্বুজ থেকে জোরে আওয়াজ করলে পাশের এক নির্দিষ্ট দূরত্ত্বে বানানো গম্বুজ কাঁপতে থাকে। আহমেদাবাদ জংশন স্টেশনের কাছেও আগে এরকম আরেক ঝুলতা গম্বুজ ছিল।
অটো নিয়ে যাচ্ছে পাড়ার ভেতর দিয়ে। বিমানবন্দরের পিছন দিকে এই সংখ্যালঘু মহল্লা। উড়ালপুলের নিচে আর ট্রেন লাইন পেরিয়ে ঘিঞ্জি রাস্তার ধারে জমে থাকা জল। সারি দিয়ে পাঁঠার মাংসের দোকান। ফেজ টুপি পরা বাচ্চা ছেলেরা তিনচাকা সাইকেল চালাচ্ছে। হিজাব পড়া মেয়েরা রাস্তার ধারে পুরুষ্ট ছাগলদের ঘাসপাতা খাওয়াচ্ছে। ম্যাপে দেখেছি এখান থেকে গুলবার্গ সোসাইটি , নারোদ পাটিয়ার এলাকা বেশিদূর নয় , যেখানে বাইশ বছর আগে গণহত্যা হয়েছিল।
বিখ্যাত ঝুলতা মিনার মসজিদ মিনারের গায়ের অলংকরণ। এরকম কোনো মুঘল স্থাপত্যে দেখা যাবে না। দ্বিতীয় গম্বুজকে ঘিরে টিয়াপাখিদের ঝাঁক।
দশ মিনিট হেঁটে গেলে আপ্যারেল পার্ক মেট্রো স্টেশন। যেতে হবে ঘিকাঁদা। দশ টাকার কিউ আর কোডের টিকিট। মেট্রো দশ মিনিট পর পর। তিন কোচের , হুন্ডাই রোটেমের তৈরী করা। এই নীল রেখার মেট্রো চলছে থালতেজ থেকে ভস্ট্রাল গাম। দু তিন স্টেশন যাবার পর মেট্রোর পাতাল প্রবেশ।
ঘিকাঁদা স্টেশনের বাইরে এখানে চামড়ার বেল্ট , জুতো , মেয়েদের চুড়ির সারি সারি দোকান। হাঁটতে হাঁটতে আমেদাবাদ জামা মসজিদের গলি। যা ১৪২৩ সালে মানেক চকে সুলতান আহমেদ শাহর আমলে তৈরী।
আহমেদাবাদের জামা মসজিদ। এর গায়েও প্রদীপ আর গাছের মোটিফ। ভেতরে মোট ২৫৬ খানা এরকম স্তম্ভ আছে। তিন দরজার বাজার। পাঁচিলওলা এই পুরোনো আহমেদাবাদের এক একদিকে এক একরকম নামের দরজা আছে। পুরোনো দিল্লির শাহজাহানাবাদের মত। ১৫৭২ সালে সিদি সৈয়দ নামে ইয়েমেনের একজন এবিসিয়ান সুলতান তৃতীয় নাসির উদ্দিন মাহমুদের সময় গুজরাটে আসেন। এই সিদি সৈয়দের মসজিদটা আছে দুতিনটে বড় রাস্তার ক্রসরোডে , একফালি সবুজ জমির ওপর। যাতে গাড়িতে অথবা বাসে যেতে যেতেও সবাই দেখতে পারে। ইন্ডিয়া গেট বা ভিক্তোরিয়া মেমোরিয়ালের মত এ শহরের প্রদর্শনী। এখানেও দুখানা মোটিফ খুব স্পষ্ট , গাছ এবং প্রদীপের।
সিদি সৈয়দ মসজিদের প্রথম ঝাঁঝরি দ্বিতীয় ঝাঁঝরি পিছন দিক থেকে এখান থেকে বেরিয়ে একটু গেলেই সবরমতীর ওপর নেহেরু সেতু। পেরোলেই ওদিকে ঝাঁ চকচকে নতুন আমেদাবাদ। রাস্তা ঘাট পরিষ্কার , ফাঁকা। ওদিকে আছে মেট্রোর বাদামি লাইন। গান্ধীগ্রাম থেকে রানিপ স্টেশন , এও দশ টাকা। রানিপে নেমে দশমিনিট হেঁটে সবরমতি আশ্রম। এই রাস্তার দুদিকে প্রচুর ফাঁকা জায়গা , মনে হল আগে এই এলাকা ধাপার মত ছিল। সবরমতি আশ্রমের চারপাশের বাড়িগুলি পুরোনো আমলের রেখে দেওয়া হয়েছে , পন্ডিচেরির রাস্তার কথা মনে এল। লাল টালি , হলদেটে সাদা দেওয়াল।
রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মতোই একটা মডেল। আশ্রমিকদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। গান্ধীজি মদ্যপান অপছন্দ করতেন , দিনে মাত্র পাঁচ পদ আহার করতেন , খাদি পরতেন , চরকা কাটতে বলতেন যাতে যারা খাদি পড়ে তারা নিজেদের সুতো নিজেরাই বানাতে পারে। কোন একটা কংগ্রেস অধিবেশনে চরকা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে। গান্ধীজি মনে করতেন সত্য , অহিংসা , ব্রহ্মচর্য্য , অপরিগ্রহ , অস্তেয় -- এই পাঁচ পতঞ্জলি বর্ণিত যম। এর সঙ্গে যোগ করেন অস্পৃশ্যতা নিবারণ , স্বশ্রয় , সর্বধর্ম সমাভব , স্বদেশী , অভয় , অস্বাদ। অর্থাৎ আশ্রমে থাকতে গেলে এই সমস্ত নিয়ম মেনে চলতে হবে। তার দিদি রালিয়াতবেন যেমন হরিজন শিক্ষক দুদাভাইয়ের সঙ্গে বসে খেতে রাজি হননি বলে আশ্রম ছেড়ে চলে যান।
বাইরে প্রথম এই ভাবনা প্রয়োগ করেছিলেন ডারবানের ফিনিক্স সেটলমেন্টের ওপর। তারপর ১৯১০ সালে টলস্টয় ফার্ম। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে গান্ধী প্রথমে আহমেদাবাদেই আশ্রম খুলতে চেয়েছিলেন। বহুদিন থেকেই আমেদাবাদ কাপড় ব্যবসার কেন্দ্র , ফলে ভেবেছিলেন ব্যবসায়ীরা তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করলেও করতে পারেন। সেখানকার কোচরাব প্রথম আশ্রম ছিল। তারপর শেঠ মঙ্গলদাস নাথুভয়ের কথায় সবরমতীতে সরিয়ে আনার টাকা জোগাড় হয়। প্লেগের পর পাঞ্জাভাই হীরাচাঁদ নামে ব্যবসায়ীর কথায় সবরমতি জেলের পাশে এই টুকরো জমিতে ১৯১৭ সালে আশ্রম গড়ে ওঠে। বিখ্যাত আশ্রমিকদের মধ্যে ছিলেন ম্যাডেলিন স্লেড , যিনি পরে মীরাবেন নাম পেয়েছিলেন এবং ভিনোবা ভাভে। এখান থেকেই ডান্ডি যাত্রা ইত্যাদি শুরু। এখান থেকে চলে যাবার পর গান্ধীজি ১৯৩৬ -৪৮ মহারাষ্ট্রের সেবাগ্রামেও এরকম আশ্রম করেছিলেন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।