এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  জাদু দুনিয়া

  • বিদিশা

    দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | জাদু দুনিয়া | ১৬ অক্টোবর ২০২৩ | ৯১৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • নামটা শুনে ‘বনলতা সেন’ মনে পড়লে অবাক হবেন না কারণ এটা সেই একই জায়গা। মধ্যপ্রদেশের ভোপালের একটু আগে এই স্টেশনটায় বর্ষাকালের একদিন ভোর ছটার সময় নামলাম প্রধানত দুটো জায়গা দেখার জন্য। সাঁচি স্তুপ এবং উদয়গিরি গুহামালা। ট্রেনটা ভোপালের দিকে চলে গেল। 

    স্টেশন প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রিজ থেকে নামতেই অটো পাওয়া গেল। সাঁচি আলাদা রাইসেন জেলায় পড়ে তাই সাঁচি পাহাড়ের ওপর যাবার জন্য বিদিশার অটো চালকদের কর দিতে হয়। সে পাহাড়ের ওপর যাবে না। সাঁচি পাহাড়ের নিচের রাস্তায় ছেড়ে দেবে। দুশো টাকা। সেখান থেকে আবার সাঁচি ঘুরিয়ে বিদিশা পৌঁছে দেবার আলাদা অটো ধরে দেবে বলল। 
    স্টেশন চত্ত্বর থেকে অটো নিয়ে বেরোতেই জিজ্ঞেস করল -"চা খাবেন ? আমিই খাওয়াচ্ছি। আসলে ভোরবেলা তো, সবে ঘুম থেকে উঠে এলাম। এক কাপ চা না হলে ঠিক ..." তার কথামতন স্টেশনের বাইরেই একটা দোকানে দুধ চায়ে চুমুক দেওয়া গেল। দোকানটার বাইরে আমাদের মতোই সবে ঘুম ভেঙে উঠে আসা লোকজনের ভিড়। গতরাতে বৃষ্টির জন্য রাস্তা হালকা ভেজা। 
    বিদিশা ছোট ঘিঞ্জি শহর। শহর থেকে বেরিয়ে চওড়া জাতীয় সড়ক। পনেরো মিনিট বাদে দূরে সবুজ পাহাড় দেখা গেল। ওটাই সাঁচি পাহাড়। আমার এতদিন ধারণা ছিল স্তূপগুলো সমতলের ওপর কিন্তু তা নয়। 
    "এটা ভারতের একেবারে কেন্দ্র। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম লাইন টানলে এখানে এসে মিলবে।  ভোপাল পেরিয়ে অল্প কিছুটা গেলেই কর্কটক্রান্তি রেখা। অনেকদিন আগে স্কুলে পড়ার সময় ভেতরে গেছিলাম। পর্যটকদের ছাড়তে আসি প্রায়ই কিন্তু অনেকদিন আর ভেতরে ঢোকা হয়নি। সারা পৃথিবী থেকে লোকজন আসে পাথরের গায়ে ছবি খোদাই করা স্তুপ দেখতে।" - অটোওলা এইসব বলছিল - "এই ভারতের কেন্দ্র হবার জন্যই সাঁচিকে সবাই এত গুরুত্ত্ব দেয়।" 
    সে ছেড়ে দিল পাহাড়ের নিচে সাঁচি সংগ্রহশালার সামনে। সংগ্রহশালা দেরী করে খুলবে। এখানে অটো বদল হল। সাঁচীর এক অটোওয়ালা দাঁড়িয়ে ছিল , আমাকে উঁচু পাহাড়ের ওপর নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল প্রধান সাঁচি ক্যাম্পাসের সামনে। 


    অটো থেকে নেমে প্রথমেই চোখে পড়ল স্তুপ ক্যাম্পাসে ঢোকার আগেই বাঁদিকে চেতিয়াগিরি বিহার। সিংহলী বৌদ্ধদের মহাবোধি সোসাইটি দ্বারা নির্মিত। 

    ক্যাম্পাসের ভেতর ব্যাগ নিয়ে ঢোকা বারণ। ব্যাগ নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরে জমা রেখে খাতায় সই করতে হল। 


    ভোর সাতটার সময় বৃষ্টিভেজা সাঁচি। মাঝে মাঝেই কোথাও ট্রেন যাবার অদ্ভুত ঝমঝম শব্দ হচ্ছে। সবথেকে আশ্চর্য - ট্রেনের শব্দই পাওয়া যাচ্ছে কেবল , অনেক চেষ্টা করেও দেখতে পেলাম না। আর কেকার আওয়াজ। বর্ষাকাল , এত গাছপালা , ঘাস , দু তিনটে ময়ূরকে দেখে প্রথমেই যেটা মনে হল - সাপ আছে নাকি? 

    ঘোরা শুরু করার আগে ঐতিহাসিক স্তম্ভ্যের স্থাপত্য নিয়ে একটা কথা বলে রাখা যাক।  যেকোনো স্তম্ভের আসলে তিনটে অংশ থাকে - একদম ওপরে ক্যাপিটাল , মাঝখানে এবাকাস এবং বাকিটা আসল স্তম্ভটা যার গায়ে অনেক সময় লিপি খোদাই করা থাকে স্তম্ভটার ব্যাপারে। 

    এই ক্যাম্পাসটা অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়ানো। ~২৫০ খ্রিস্টপূর্বে, অশোকের আমলে তৈরী হয়েছিল শুধু ইঁটের স্তুপ, ঘোরানো সিঁড়ি আর স্তুপের মাথার ওপরের তিনটে ছাতা। আর একটা বালিপাথরে বানানো স্তম্ভ। যার মাথায় পাথর কেটে তৈরী চারটে সিংহের প্রতীক। তারপর ~১৭৫ খ্রিস্টপূর্বে শুঙ্গ বংশের সময়ে ইঁটের স্তুপকে পাথরে মুড়ে দেওয়া হল , চারদিকে তুলে দেওয়া হল গোল পাঁচিল [circumambulatory]। এরও পরে ~৫০ খ্রিস্টপূর্বে সাতবাহন বংশের দ্বিতীয় সাতকর্নির সময় সেই স্তুপের গলির চারদিকে চারটে তিনথাকওয়ালা তোরণ [architrave] তৈরি হল। তাদের গায়ে খোদাই করা হল নানান রিলিফ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানারকম বৌদ্ধ বিহার, মন্দির ইত্যাদি স্তুপগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠতে লাগল। চোদ্দোশো শতাব্দীর পর কোনো অজ্ঞাত কারণে এই সমস্ত পরিত্যক্ত হয়। বেঙ্গল ক্যাভালরির জেনারেল হেনরি টেলর ১৮১৮ সালে আবার সাঁচি পুনরাবিষ্কার করেন। জন মার্শাল পাহাড়ের নীচে সাঁচি সংগ্রহশালাটা বানান তারও একশো বছর পর। 



    রিলিফগুলোর মধ্যে বৌদ্ধ জাতকের গল্প , জলের ওপর হাঁটা ইত্যাদি অতিপ্রাকৃত ঘটনা বা মিরাকল , মারবিজয় , মৃত্যুর পর গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ নিয়ে কুশিনগরের মল্ল এবং আরো সাতজন রাজার মধ্যে যুদ্ধ এরকম নানা ছবি খোদাই করা হয়েছে। বুদ্ধের দেহাবশেষ আটটা রাজ্যের মধ্যে ভাগ হয়। তার কয়েক শতাব্দী পর অশোক সমস্ত দেহাবশেষ সাতটা রাজ্য থেকে সংগ্রহ করে আবার ৮৪০০০ স্তুপ তৈরি করে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। একমাত্র নেপালের শক্তিশালী নাগ বংশের অধিকারে থাকা রামগ্রামের ছাই অশোক সংগ্রহ করতে পারেননি। এই বিদিশার এক বণিকের মেয়ের সঙ্গে অশোকের বিয়ে হয়েছিল বলে নিরিবিলি পাহাড়ের ওপর এই সাঁচিকে তিনি একটা বড় স্তুপ তৈরীর জন্য বেছে নিয়েছিলেন। 

    সবথেকে মজা রিলিফগুলোর কোথাও কোথাও গৌতম বুদ্ধকে দেখানো হয়নি। কোথাও ধর্মচক্র , কোথাও ধর্মপথ আবার কোথাও একটা ফাঁকা সিংহাসন দিয়ে বোঝানো হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ জন মার্শাল তার বই 'a guide to sanchi' তে সাঁচীর প্রত্যেকটা রিলিফের ওপর বিশদে লিখে রেখে গেছেন। এছাড়া তোরণগুলোর উল্টোদিকে ঘাসজমির ওপর লাল পাথরে কালো অক্ষরে খোদাই করেও লেখা আছে কত নম্বরে কিসের ছবি। 


     
    বিদিশার শিল্পীরা এই সমস্ত অলঙ্করণের কাজ করেছিলেন। 


     
     

    সাঁচি পশ্চিম দিকের তোরণের সামনের দিকের অলঙ্করণ। এই তোরণের মূল বৈশিষ্ট দুদিকে দুই গাছের ডালে ঝুলন্ত যক্ষিণীর মূর্তি।  
     সাঁচি পশ্চিম তোরণের পিছনের দিকের অলঙ্করণ 


    সাঁচি উত্তর তোরণের সামনের দিক , এই তোরণের মূল বৈশিষ্ট যক্ষদের ক্যাপিটাল।  

    সাঁচি উত্তর তোরণের পিছনের দিক , এদিককার মূল বৈশিষ্ট একগাদা গ্রিফিনের অলংকরণ। 
     

    সাঁচি পূর্ব তোরণের সামনের দিক , চারটে হাতির ক্যাপিটাল এবং শুধুমাত্র ডানদিকের যক্ষিণীর মূর্তি দেখে এটিকে আলাদা করা যায়। এখানেও ডানাওলা সিংহের অলঙ্করণ আছে। 
     
    আলাদা করে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় প্রতিটা প্যানেল আলাদা। 
     

    শুধুই সামনে বা পিছনের দিকে নয় , পাশের দিকেও প্যানেল আছে। 
     

    সাঁচি পূর্ব তোরণের পিছনের দিক।  


    সাঁচি দক্ষিণ তোরণের সামনের দিক। চারটে সিংহের ক্যাপিটাল। 


    সাঁচি দক্ষিণ তোরণের পিছনের দিক।  


    সাতবাহনদেরও পরে পাঁচশো খ্রিস্টাব্দে মালওয়ার শাসক ক্ষত্রপদের আমলে মথুরা থেকে আনিয়ে এই চারটে বুদ্ধমূর্তি স্তুপের চার দিকে স্থাপন করা হয়েছিল। 


     
    গলির মেঝেতে ব্রাহ্মীলিপিতে খোদাই করা লেখা। চার্লস ম্যাসন বলে একজন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য [ইনি প্রথম হরপ্পার ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পেয়েছিলেন] , জেমস প্রিন্সেপ এবং আলেক্সাণ্ডার কানিংহ্যাম ১৮৩৮ সালে ব্রাহ্মীলিপির পাঠোদ্ধার করেন। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ যখন প্রথম তৈরী হয় , লর্ড ক্যানিং ক্যানিংহ্যামকেই সেটা চালানোর দায়িত্ত্ব দিয়েছিলেন। 


    দক্ষিণ তোরণের পাশে ১৮ নং মন্দির। মৌর্য্য শাসনকালে এর ভিত্তি তৈরী হয়েছিল, পরে পুষ্যভূতি বংশের হর্ষবর্ধনের সময় তৈরী শেষ হয় ~৬০০ শতাব্দী। 



    সাঁচি দক্ষিণ তোরণের পাশে সাঁচীর অশোক স্তম্ভের অবশেষ। ভাঙা স্তম্ভটা পাশেই একটা চালার নিচে রাখা। সিংহের ক্যাপিটালটা রাখা আছে পাহাড়ের নিচে সাঁচি সংগ্রহশালায়। 


    সাঁচি প্রথম স্তুপের উত্তর দিকে কিছুটা নেমে এই ৫১ নম্বর গুম্ফা। 


    সাঁচি দ্বিতীয় স্তুপটা প্রথম এবং তৃতীয় স্তুপের থেকে অনেকটা দূরে , সেখানে যাবার জন্য ৫১ নং গুম্ফার পাশ দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। পাথর ফেলে ফেলে হাঁটার রাস্তা করা আছে।


    দ্বিতীয় স্তুপটা এবং ঘেরা রেলিংগুলো শুঙ্গদের সময় বানানো কিন্তু অলংকরণ গুলো হয়েছিল সাতবাহনদের সময়। 



    ২য় স্তুপের পাঁচিলওয়ালা গলি [balustrade]র গায়ে গোল গোল গ্রীক উপকথার গ্রিফিন , সেন্টর ইত্যাদি খোদাই করা দেখে বোঝা যায় এগুলো গান্ধার শিল্প। গ্রীক ছাপ আছে। তক্ষশীলার [বর্তমান পাকিস্তানে]  থেকে আসতেন এই শিল্পীরা। মহাভারতের গান্ধারী সেই এলাকারই রাজকন্যা। কুষাণরা এই অঞ্চলের রাজা ছিলেন। কণিষ্কের শাসনকাল গান্ধারের স্বর্ণযুগ। সেই সময় ব্রাহ্মীলিপির স্থান নিয়েছে খরোষ্ঠীলিপি। 


     
    রেলিংয়ের গায়ে উল্লেখযোগ্য গান্ধার শিল্পকলা 



    ধর্মচক্র মাথায় রাজকীয় সিংহের দল 


    ফিরে এসো , চাকা 

    তারপর আবার প্রথম স্তুপের কাছে ফেরত এলাম। দক্ষিণ দিকে আরো ওপরের দিকে উঠলে অনেকগুলো বিহারের ধ্বংসস্তুপ এবং একটা মন্দির আছে। 


    ১ম এবং ৩য় স্তুপের কাছে ৩৭ নং বৌদ্ধবিহার  


    ওপর থেকে তোলা। 


    সপ্তম শতাব্দীতে বানানো এই বৌদ্ধ বিহার এবং মন্দিরের দরজা তোরণের খোদাই করা গঙ্গা যমুনার মূর্তি থেকে বোঝা যায় বৌদ্ধদের শিল্পকলায় ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্যবাদের মোটিফ যুক্ত হচ্ছিল। 


    মন্দির এবং গুম্ফার দিক থেকে সাঁচি স্তুপ।  

    মন্দিরের গায়ের বুদ্ধমূর্তি। 

    এই মন্দিরের পাশে আছে আরো কয়েকটা - ৩৬ এবং ৪৪ নং বৌদ্ধ বিহারের এবং কিছু সাধারণ ঘরের অবশেষ। 

    সাঁচি পাহাড় থেকে চাষের সবুজ 

    তৃতীয় স্তুপের মাথায় একটাই ছাতা 


    শুঙ্গদের সময় বানানো তৃতীয় স্তুপটা প্রথম স্তুপের একটা ছোট সংস্করণ। পাঁচিলটা নেই। আর একটামাত্র তোরণ। বুদ্ধের দুই অনুগামী সারিপুত্র এবং মহামোগ্গল্লানার দেহাবশেষ এখানে রাখা আছে বলে মনে করা হয়।

    তৃতীয় স্তুপের তোরণটা সাতবাহনদের সময়কালে বানানো। 
     
     
    জাতীয় পাখি 
     
     
    চেতিয়াগিরি বিহারের জিনিসগুলো নাকি কানিংহ্যাম দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন যা পরে শ্রীলঙ্কায় ফেরত দেওয়া হয়। 
     
     
    আড়াই ঘন্টা ঘোরাঘুরির পর ফোন করতে সাঁচীর অটোওলা এসে উপস্থিত। তাকে বললাম উদয়গিরি গুহা ঘুরিয়ে বিদিশায় ছেড়ে দিতে। এই রাস্তায় রেললাইনটা পড়ল। মালগাড়ি যাচ্ছে বলে সে নেমে খৈনির পকেট বার করল। মধ্যপ্রদেশে এই একটা ব্যাপার - সবাই হাতে কিছু একটা ডলছে বা এদিক ওদিক তাকিয়ে একফাঁকে একটা প্যাকেট থেকে কিছু একটা ঢালছে মুখে। একটা প্যাকেট থেকে অন্য প্যাকেটে কিছু একটা ঢেলে বড় প্যাকেটটা মন দিয়ে ঝাঁকিয়ে নিচ্ছে। রেল স্টেশনে দেখেছি অনেকে পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সুপারি আর জাঁতা। 
     

     
    মালগাড়ি চলে যাবার পর অটোওলা পিছনে গিয়ে একটা দড়ির টুকরো দিয়ে ইঞ্জিনে বেঁধে দু তিনবার টান মারল ইঞ্জিন চালু করার জন্য । 
     
    সাঁচি থেকে প্রায় কুড়িমিনিট দূরে উদয়গিরি গুহামালা। ঘিরে রাখা উদয়গিরি গুহাগুলোতে একদিকের সমতল দিয়ে ঢুকে ওপরের দিকে হেঁটে উঠতে হয়। তারপর আবার অন্য দিকে দিয়ে নেমে এসে সমতলে বেরোবার জায়গা। কালো আগ্নেয় শিলার পাহাড় কেটে এই কুড়িটা গুহা বানানো হয়েছিল চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীতে , যখন চন্দ্রগুপ্ত বিক্রামাদিত্য শকদের হারান। দুটো গুহার মধ্যে জৈন মূর্তি এবং বাকিগুলোতে হিন্দু মূর্তি পাওয়া গেছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন এই উদয়গিরি থেকেই দিল্লির কুতুব মিনারের পাশে লোহার স্তম্ভটা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কারণ এখানে ইলতুৎমিশ দাপিয়ে বেড়াতেন একটা সময় , আর জিনিসপত্র ভাঙতেন।
     

    ঢোকার মুখেই এই ১৯ নং গুহায় দেখানো হয়েছে সমুদ্র মন্থন করে অমৃতের উত্থান। 
     
    সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসে 
     
    রাস্তা দিয়ে হেঁটে অন্যদিকে চলা 
     
    উদয়গিরি পাহাড় থেকে দূরে বিদিশা জেলার গ্রাম। এই পাহাড়ের ওপর আছে দুটো জৈন গুহা। 
     

    তেরো নং গুহায় ক্ষীরসাগরে অনন্তশয়ানে বিষ্ণু। চতুর্থ শতক। শ্যাওলা জমা মূর্তিটা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের। এটা অনন্তশয়ানে বিষ্ণুর পাওয়া প্রাচীনতম মূর্তি। বর্তমানে কাঁচ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। 
     

     
    ১২ নং গুহায় বিষ্ণুর নরসিংহ অবতার। এই গায়ের চারশো শতাব্দীতে করা কালো প্যাঁচানো চিন্হগুলো মূর্তিগুলোর থেকে পুরোনো। এবং এই শঙ্খলিপির পাঠোদ্ধার করা যায়নি। 
     

    ৪নং গুহা বীণা গুহা বলে পরিচিত। বাঁদিকের মূর্তিটি বীণা এবং ডানদিকের মূর্তিটি সারেঙ্গী বাদ্যরত। গুহার ভেতরে শিবের একটি একমুখী লিঙ্গ [শিবলিঙ্গের একদিকে শিবের মুখ খোদাই করা] মূর্তি আছে। 
     

    বীণা গুহার পাশে ৩ নং গুহায় আছে শিবের পুত্র কার্তিকেয়র মূর্তি। 
     
    দূর থেকে ৩ এবং ৪নং গুহা। 
     

     
    এর পর পাঁচ নং গুহায় আছে গুপ্তযুগে এই পাহাড়ের গায়ে কেটে বানানো সবথেকে বিখ্যাত বিষ্ণুর বরাহ অবতারের একটা মূর্তি। আগে সামনের এই রেলিংটা ছিল না। 
     
     
    ভূদেবীকে অপহরণ করেছিল হিরণ্যকশিপুর ভাই হিরণ্যাক্ষ। পৃথিবী হারিয়ে গেছিলেন মহাজাগতিক সমুদ্রে। সমুদ্রের তলা থেকে সেই পৃথিবীকে উদ্ধার করার জন্য বিষ্ণু বরাহ অবতার ধারণ করলেন। সমুদ্রে নামলেন এবং ডানদিকের দাঁতে করে তুলে আনলেন ভূদেবীকে।  
     
    এই মূর্তির ডানদিকের একদম ওপরের সারিতে ছোট মূর্তিগুলোয় আছেন আদিত্যরা , অগ্নি , বায়ু এবং অষ্টবসু। তার নিচের সারিতে এগারোজন রুদ্র এবং গণদেবতারা। তাদের নিচে তিনটে সারিতে আছেন নানা ঋষিরা। 
     

    এই ৬ নং গুহার ভেতরে পাওয়া লিপি থেকে জানা যায় 'শঙ্খনিকা' বলে একটি স্থানীয় উপজাতিদের হারিয়ে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এই মালওয়া অঞ্চল জয় করেন। 
     

    কানিংহ্যাম এই ৮ম গুহাটার নাম দিয়েছিলেন তাওয়া গুহা। এটার ভেতরে পিছন দিকের দেওয়ালে লিপি থেকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এবং তার সেনাপতি বীরসেনের প্রশস্তি পাওয়া গেছে।
     
    গণেশ এবং মহিষাসুরমর্দিনীর সবথেকে প্রাচীন দুটো মূর্তিও এই উদয়গিরি গুহায় পাওয়া গেছে।  
     
    এছাড়া বিদিশায় আছে হেলাডোরাস স্তম্ভ। গরুড়কে উৎসর্গ করে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে তৈরি করেছিলেন শুঙ্গ রাজা ভগভদ্র। তক্ষশীলা [বর্তমান পাকিস্তানে] র ইন্দো গ্রীক রাজা এন্টিয়ালসিডাসের পাঠানো দূতের নাম ছিল হেলিডোরাস। স্তম্ভ আবিষ্কারের পর সেই দূতের নামেই স্তম্ভের নাম দেন কানিংহ্যাম। যার মাথার প্রতীকটা  [ক্যাপিটাল] ক্ষয়ে গেছে। গায়ে খরোষ্ঠী লিপি অবিকৃত। স্থানীয়রা একে খাম্বা বাবা বলে ডাকে। স্তম্ভের গায়ে ব্রাহ্মীলিপিতে কৃষ্ণ বাসুদেব এবং রাজা ভগভদ্রের প্রতি বন্দনা পাওয়া গেছে। এই স্তম্ভের কাছে একটা খ্রিস্টপূর্ব চারশো বছরে বিষ্ণু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। 
    হাতে আরো সময় আছে বলে এরপর মধ্যপ্রদেশ সরকারের সংস্কৃতি দফতরের অধীনে বিদিশা জেলা সংগ্রহশালায় গেলাম। স্টেশনের কাছেই কিন্তু উল্টো দিকে , যেদিকে উদয়গিরি , হেলিডোরাস স্তম্ভ , সাঁচি সেদিকে এটা নয়। 
     
    মিউজিয়ামের বাগানে রাখা অনন্তশয্যায় বিষ্ণু 
     

     
    বরাহ অবতারের মূর্তিও আছে সেখানকার বাগানে। 
     

     
     
    এরকম বড় একটা বরাহ অবতারের মূর্তি আছে খাজুরাহোর বরাহ মন্দিরেও। এছাড়াও মধ্যপ্রদেশের বেত্রবতী নদীর এক উপনদী বীণার তীরে মধ্যপ্রদেশের আরেকটা ঐতিহাসিক জায়গা এরানে সবথেকে বড় বরাহ অবতারের মূর্তির গায়ের লিপি থেকে জানা গেছে এরানে পাঞ্জাবের আলকান হুন রাজা তোরমানের সঙ্গে বিদিশার রাজা ধন্যবিষ্ণুর যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধ জেতার পর তোরমান পরবর্তী দু বছরে পশ্চিম এবং মধ্য ভারত দখল করেন। 
     

     
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ১৬ অক্টোবর ২০২৩ | ৯১৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2607:fb90:ea0c:cd31:3cc4:d8c8:8f77:***:*** | ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ০৩:৪৮524601
  • দারুণ তো! ছবি, লেখা দুইই।
  • | ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:৪৯524623
  • দারুণ দারুণ
  • যোষিতা | 194.56.***.*** | ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:০৪524626
  • চমৎকার ছবি ও বর্ণনা।
  • সমরেশ মুখার্জী | ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:৪৭524628
  • ভেবেছিলাম "একা বেড়ানোর আনন্দ" সিরিজে প্রথম পর্বে প্রাককথনের পর দ্বিতীয় পর্বে রাখবো এটা। কিন্তু আজকেই দেখি দীপাঞ্জন পোষ্ট করেছে বিদিশা। ওর লেখা‌য় ছবিগুলি সুন্দর, বর্ণণা‌ বিশদে। খাসা হয়েছে। 
     
    আমার লেখা একটু কাছাখোলা ধরণের। আশকথা পাশকথার বাহুল‍্য। তবু লিখে যখন ফেলে‌ছি, আমি‌ও পোষ্টে দি ওটা।
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৫২525573
  • উদয়গিরি গিয়ে তেরো নম্বর গুহার পাশ দিয়ে যে সিঁড়ি ওপরে চলে গেছে সেটা দিয়ে গিয়ে আর কোনো গুহা নেই সেটা আমি বুঝতে পারিনি। বেশ অনেকটা হেঁটে রোদের তেজে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর নেমে আসার পথে বাঁয়ে দেখি আতা গাছে পাকা পাকা আতা ঝুলছে। সাইজে একটু ছোটো। ঝোলাতে ভরে নিলাম চারখানা। অত মিষ্টি আতা খুব কমই খেয়েছি। তাই উদয় গিরি অনেকদিন মনে থাকবে।
     মূর্তি গুলো অবশ্যই খুব সুন্দর। বিশেষ করে অনন্ত শয্যায় বিষ্ণু ও বরাহ অবতার মূর্তি দুটি। বিদিশা মন্দিরেরই শহর। প্রচুর প্রাচীন মন্দির আছে। জৈন ও হিন্দু মিলিয়ে।
  • দীমু | 182.69.***.*** | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ২১:৫৬525584
  • রমিত , আতার গল্পটা laughlaugh
     
    হ্যাঁ , ওই ওপরে উঠে হাঁটার ব্যাপারটা কেউ বলে না দিলে বোঝা মুশকিল। আমাকে অটোওলাই বলে দিয়েছিল ওপরে উঠে হেঁটে পিছনদিকে এসে আবার নামতে হবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন