এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • প্রেম দেহ মন - পর্ব ১২

    Sukdeb Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৮৯ বার পঠিত
  • প্রেম দেহ মন - পর্ব ১২

    অর্চনা     

    বীণা কাকিমা শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে আমাদের ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। অনেকবার আসা বাড়িতে নতুন ভাবে আর নতুন রূপে প্রবেশ করলাম। আনন্দ, রোমাঞ্চ, সব মিলিয়ে মনের মধ্যে তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কথা ছিল আমার শাশুড়িমা এসে কটা দিন এখানে থাকবেন। কিন্তু হঠাৎ জ্বর হওয়ায় আসা হল না। তাই সেই ভূমিকায় বীণা কাকিমা। মা, শাশুড়িমা, পিসিমা, বীণা কাকিমা, এতগুলো মায়ের স্নেহস্পর্শ পাওয়া বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার।

    কয়েক দিন বাদে অমিত খুব উৎসাহ নিয়ে বলল, “আমাদের ফ্ল্যাটের একটা নাম রাখলে হয় না!”  আমি বললাম যে লোকে বাড়ির নাম রাখে, ফ্ল্যাটের নাম রাখে বলে তো কখনো শুনিনি। শুনে ও বলল, “ফ্ল্যাটের নাম  দেয় না বলছ,  বেড়াতে গেলে দেখতে পাবে অনেক রিসোর্টে এক একটা ঘরের এক একটা নাম। এটা তো আমাদের বাড়ি। তার একটা পছন্দসই নাম আমরা রাখতেই পারি।”  
    জিজ্ঞেস করলাম, “তা কি নাম ভেবেছ শুনি।”
    --‘মিলন তীর্থ’ নামটা কেমন?
    হাসতে হাসতে বললাম, “ভাল নাম। নাম দেখেই লোকে বুঝতে পারবে ভেতরে কি হয়।”
    --তোমার যত কু দিকে চিন্তা। পরিচিত জনেরা কলকাতায় এলে মাঝে মাঝে আমাদের এখানে এসে থাকবে ভেবেই ওই নামটা ভেবেছিলাম। তোমার কু ইঙ্গিতটা মাথায় ঢুকিয়ে গণ্ডগোল করে  দিলে। আচ্ছা আমরা দুজন আমাদের খুশী মত জীবন যাপন করব তাই তো?
    --কোন সন্দেহ নেই। কেবল খুশির বাড়বাড়ন্তে চাকরিটা না গেলেই হল।
    --কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছেমত যেমন খুশী  থাকব। সেক্ষেত্রে সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ নামটা একেবারে ম্যাচ করে যাচ্ছে। তুমি তো বাংলা নিয়ে পড়াশুনো করেছ, আর কোন ভাল নাম যদি মনে পড়ে তো বলো না।
    --‘আবোল তাবোল’ নামটা দিতে পার, তবে তার নিচেই লিখ ‘ডাঃ অমিত পাগোল।’
    ফ্ল্যাটের নামকরণের পরিকল্পনা আর এগোয়নি।
    তখন আমাদের সব সুখের ঠিকানা ছিল দুই আনাড়ির পাতা  ‘যেমন খুশী থাকো’ সংসার। দৈনন্দিন জীবনে সামান্যতম অনুপ্রবেশ না করেও নিজেদের ছত্রছায়ায় কমল কাকুরা আমাদের সব সময়  আগলে রাখতেন। পরিচিত জনের আসা যাওয়া লেগেই থাকত। প্রাইভেসিতে একটু ব্যাঘাত হলেও লোকজন এলে খুব ভাল লাগত। একটু গুছিয়ে বসার পর এক রবিবার বিদিশা ওর ছেলে আর পিসিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এল। দুই বন্ধুতে গুছিয়ে আড্ডা মারলাম।  অনেকদিন বাদে বিদিশাকে আগের মত প্রাণখোলা মেজাজে পেলাম। খুব ভাল লাগল। ইচ্ছে করেই তনুর ব্যাপারে কোন কথা বলে ওকে বিব্রত করিনি।
    একদিন   অমিত ফোন করে ব্জানাল যে ওর ফিরতে একটু দেরী হবে। কি কারণে তা আর  জিজ্ঞেস করিনি। রাত নটা নাগাদ  আমার মাকে নিয়ে হাজির হল।
    বলল—হাসপাতাল ফেরত তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম খবরাখবর নেওয়ার অজুহাতে কাকিমার হাতের একটু ভালমন্দ  রান্না খেতে। মুখ দেখে বুঝলাম মেয়ের জন্যে খুব মন খারাপ করছে। তাই একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে চলে এলাম। মাস খানেক এখানে রেখে দাও।
    মা তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে—জোর করে আমাকে নিয়ে চলে এল। কোন কথা শুনল না। দিনকাল ভাল নয় তাই বিমলকে ডেকে পাঠিয়ে রাতে আমাদের বাড়িতে শুতে বলে এলাম।
    আমার মায়ের প্রতি অমিতের এই দরদ আর ভালবাসা দেখে মেয়ে হিসেবে আমারও মনটা ভরে গেল। অবশ্য অমিত প্রথম থেকেই আমার মাকে খুব পছন্দ করে। সকলে মিলে খুব হৈ হৈ করে কাটল সেই রাতটা। পরদিন সকাল হতেই মা বাড়ি যাওয়ার জন্য বায়না ধরল।
    আমি ধমক লাগিয়ে বললাম—বাড়ি যাওয়ার জন্য অমন ঘ্যান ঘ্যান করবে নাতো! তুমি থাকবে বলে আমি অফিস কামাই করছি আর তুমি কিনা  কেটে পড়ার ধান্ধা করছ। তুমি বাইরে নিজেকে যেমনই দেখাও ভেতরে ভেতরে কিন্তু বেশ সেকেলে। তাই মেয়ে জামাইয়ের কাছে এসে থাকতে এত সংকোচ।
    বিস্তর কথা শুনিয়ে মাকে আটকে রাখলাম। অবশ্য  ওই একদিনই রইল, পরদিন সকাল  হতেই বাড়ি ফিরে গেল। সারাদিন মায়ে ঝিয়ে অনেক গল্প করলাম। আদরের স্বাদ বদল হল।  অমিতের আদর খেয়ে অভ্যস্ত হওয়া শরীর আর মন নিয়ে অনেক দিন পর মায়ের কোলে মাথা রেখে মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর খেলাম। গল্প করতে করতে মা একসময় বলল, “বুলি, ক’দিন আগে তনুর মা এসেছিল। একাই এসেছিল। ওরা তো বিয়েতে আসেনি, অনেকবার অনুরোধ করল যদি একবার অমিতকে নিয়ে কোন ছুটিছাটার দিনে ওদের বাড়িতে যাস। আমি বলি কি যাই হয়ে থাকুক, এতবার করে বলল, একবার দুজনে ঘুরে আয়।  বৌদি মানুষটা খুব ভাল রে।”

    বুঝলাম, মা চায় যে আমরা ওদের বাড়িতে একবার যাই। কিন্তু আমার যাওয়ার একেবারেই ইচ্ছে  নেই। মাকে সরাসরি মুখের ওপর না বলতে খারাপ লাগল। বলেছিলাম অমিতের সাথে কথা বলে তোমায় পরে জানাব।  তবে ওরা যেন একবার নিজেরা অমিতকে  ওদের বাড়িতে যাওয়ার কথাটা   বলে।  অমিত আমার কাছে শুনেই যেতে রাজি হয়ে  গেল। বলল, “ওনাদের আবার আলাদা করে আমায় নেমন্তন্ন  করার কথা বলতে গেলে কেন? কাকিমাকে  ওনারা তো বলেছেন।” এইসব ব্যাপারে ও কখোনো আপত্তি করে না। পরের দিনই মামির  ফোন এল। অনেক কিন্তু কিন্তু করে যেতে বলল।  মামিকে আগে থেকে জানিয়ে এক রবিবার সকালে  দুজনে বালিগঞ্জে গেলাম। বাড়ি দেখে অমিত বলল, “বাবা, এতো প্রাসাদ।” আমি বললাম, “হ্যাঁ, ওরা পুরুষানুক্রমে ধনী। তাছাড়া মামাও খুব বড় পোষ্টে চাকরি করে, ফলে টাকা  পয়সা  প্রচুর আছে। প্রচুর টাকার সাথে আছে প্রচুর দেমাক। মামার অনেক  কিছু আছে নেই শুধু ভাল মন। আমার কাছে লোকটা একটা পাষণ্ড। তবে মামি মানুষটা খারাপ নয়।” 

    অমিত সবই জানে তাই মজা করে আমাকে একটু রাগাবার জন্য বলল, “ছিঃ, নিজের মামাকে পাষণ্ড বলছ! গুরুজনদের ওভাবে সম্বোধন করতে নেই।”
    বাড়ির বাইরের গেটের সামনে দেখি একটা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ফলে অমিতকে আর উত্তরটা দেওয়া হল না। গেটের সামনে যেতেই ছেলেটা “দিদি জামাইবাবু ভেতরে এস” বলে গেটটা খুলে  দিল। ছেলেটাকে আগে কখনো দেখিনি ফলে আমাদের চেনার কথা নয়। বুঝলাম একে আমাদের আসবার কথা জানিয়ে রিসিভ করার জন্য এখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। নিজেই নিজের  পরিচয় দিল, “আমি চন্দন, আমিই এখন এ বাড়ির দেখাশোনা করি। আগে আমার সেজকাকা বলাই এ বাড়িতে ছিল।” আমাদের গলার আওয়াজ পেয়ে মামি দরজার  সামনে এসে দাঁড়াল। আমার  ভেতরে ভেতরে খুব  অস্বস্তি হচ্ছিল। সেদিনের সেই তুলকালামের পর এতদিন বাদে এই বাড়িতে পা রাখছি। যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। ঘরে ঢুকে মামিকে নমস্কার করলাম, আমার দেখাদেখি অমিতও পেন্নাম করল। আমাকে জড়িয়ে ধরে “বুলি কতদিন বাদে এ বাড়িতে এলি রে, তাও তো আমি ডাকলাম তাই”,  এইসব বলে মামি কান্নাকাটি করতে  শুরু করল। কাউকে কাঁদতে দেখলে আমার খুব অস্বস্তি হয়। মামির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে কান্না থামালাম। ছোটবেলা থেকে কত এসেছি এ বাড়িতে। একেবারে যখন ছোট ছিলাম আমাকে আর তনুকে পাশাপাশি বসিয়ে মামি গল্প বলে  গাল করে করে খাইয়ে দিত। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে এ বাড়িতে। মামি চিরকালই  খুব ঠান্ডা মানুষ, কথাও খুব আস্তে আস্তে বলে। তনুর একটা ঘটনাই সব সম্পর্ক বিগড়ে দিল।  আমরা ভেতরের ঘরে গিয়ে বসলাম। চন্দন এসে সরবত দিয়ে গেল। একটু পরে মামা ঘরে ঢুকল। দেখা মাত্রই মেজাজটা চড়াং করে গরম হয়ে গেল। মানুষটার সেদিনের অসভ্য আচরণ মাথার মধ্যে পাক খেতে শুরু করল। নিজেকে সামলে  নিয়ে উঠে গিয়ে নমস্কার করলাম, অমিতও যথারীতি আমায় ফলো করল। সামনের সোফাটায় আমাদের মুখোমুখি গিয়ে বসল।  অপেক্ষা করছি কখন বড় বড় চালিয়াতি কথা শুরু হবে তার জন্য। সাময়িক নীরবতার পর মামাই কথা শুরু করল।
    --আমি ভাবতে পারিনি তুই আর এ বাড়িতে আসবি। কি যে আনন্দ হচ্ছে তা বলে বোঝাতে পারব না। তু্‌ই, তনু, সবাই এক এক করে আমাদের ছেড়ে চলে গেলি.... আমরা বড় একা হয়ে গেছি রে... অন্যায় তো আমি করেছি যা সাজা দেওয়ার আমায় দে... তোর মামিকে এত কষ্ট দিসনা... ও বেচারির তো কোন দোষ নেই... এত মানসিক চাপ ও আর নিতে পারছে না।
    ঠিক দেখছি তো, এ তো অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। ব্যাপারটা ঠিক বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ মামা উঠে এসে আমার দু হাত ধরে বলল—আমি সেদিনের ঘটনার জন্যে খুব অনুতপ্ত, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস বুলি। আমার সাথে তো ও আর দেখা করবে না, তাই  তুই  বিদিশাকে বলিস এই বুড়োটা ওর কাছেও ক্ষমা চেয়েছে।
    পরিস্থিতি মানুষকে কত বদলে দেয়। হৃদয়হীন মানুষটাকে সেদিন দেখে করুণা হচ্ছিল। আমি মামাকে সোফায় বসিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে অমিতের সাথে ইন্ট্রডিউস করিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে মামির কাছে চলে গেলাম। কিছু সময় পরে ভারী আবহাওয়া অনেকটাই হালকা হয়ে গিয়েছিল। অমিত মিশতে পারে,  মামা মামি দুজনের সাথেই অনেক গল্প করল। হঠাৎ  দেখলে মনে হবে ওরা বোধহয় ওরই আত্মীয় আমার নয়। আমি পরে একটু সহজ হলেও আড়ষ্ট ভাবটা পুরোটা কাটাতে পারিনি। আসার আগে মামি দুজনকে সুন্দর দুটি উপহার দিল, বিয়ের উপহার। দু একবার না না করে কষ্ট পাবে বলে নিলাম। অবশ্য উপহার পেলে ভালোই লাগে।
    --আবার আসিস মা, আমাদের একেবারে বাতিল করে দিস না। আর পারলে তনুটাকেও ওর মা বাবার কথাটা একটু মনে করিয়ে দিস।...       চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মামি অতি কষ্টে কথাগুলো বলল। পাশেই মামা দাঁড়িয়ে, তারও চোখের কোনায় জল। বাইরে বেরিয়ে অমিত বলল, “এই মানুষগুলো সম্পর্কে তুমি কত খারাপ খারাপ কথা বলছিলে!” 
    --মানুষগুলো নয়, আমি যা খারাপ কথা বলেছি  তা সবই আমার মামাকে উদ্দেশ্য করে। তুমি বাল্মীকি কে দেখলে, আমি দেখেছি রত্নাকরকে। মানসিকভাবে রিক্ত হয়েই ওনার আজ এই পরিবর্তন।
    বাড়ি ফিরে একটা ব্যাপারে একটু মন খচখচ করছিল, তা হল আমাদের মামার বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারটা বিদিশাকে জানান হয়নি। ওর সাথে ওরই কারণে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। জানি যাওয়ার ব্যাপারে  বিদিশা কখনই অসম্মতি জানাত না তবু ওকে জানিয়ে যাওয়াটাই উচিৎ ছিল। অবশ্য মামির সাথে বিদিশার যোগাযোগ আছে। মামি মাঝে মাঝে  নাতিকে দেখতে পিসির বাড়িতে যায়। বিদিশার সায় আছে বলেই যেতে পারে।
    বিয়ের পরে কয়েকটা মাস আনন্দে  কেটে গেল। হানিমুন পর্বটা  বাকি রয়ে গেছে। বিয়ের প্রায় তিনমাস কেটে গেলেও নানা কারণে তা তখনো আমাদের হয়ে ওঠেনি। সেদিন বাড়ি ফিরে অমিত বলল, “নাও এবার  গোছগাছ শুরু করে দাও।”
    জিজ্ঞেস করলাম, “কিসের গোছগাছ?”
    --বাঃ, পরের সোমবার রওনা হতে হবে না!
    --ভণিতা না করে কি বলতে চাও খুলে বল ত।
    --আমরা কাশ্মীর যাচ্ছি। দিন দশেকের ট্যুর। আরো কটা দিন বেশি হলে ভাল হত, কিন্তু নিরুপায়, আর ছুটি ম্যানেজ করা গেল না। হাতে এখনো পনের দিন সময় আছে, কাল অফিসে গিয়েই ছুটির দরখাস্ত দিয়ে দাও। আর  এত ভাল খবর শোনানোর জন্য আমার পাওনাটা এখনই  দিয়ে দাও।
    মধুচন্দ্রিমা নামটাতেই মধু আছে। দারুণ আনন্দ হল। পাওনা মেটাতে যাওয়ার আগেই পাওনাদার নিজেই এসে তা অসুল করে নিল।
    টুকটাক এদিক ওদিক ঘুরতে গেলেও তেমনভাবে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। বাবা ছোটবেলায় মারা যাওয়ায় জীবনে এই অভাবটা ছিল। দূরপাল্লার ট্রেনের অনেক মজার অভিজ্ঞতার  কথা পড়েছি। তাই আমার ইচ্ছে ছিল একদিক অন্তত ট্রেনে যাওয়ার। কিন্তু অমিত ছুটি বেশি পাবে না তাই ট্রেনে চার পাঁচ দিন নষ্ট করতে চায়নি। প্লেনে কোলকাতা থেকে দিল্লী আর দিল্লী থেকে শ্রীনগর এভাবেই টিকিট কেটেছে। ফেরার সময়েও তাই। প্লেনেও জীবনে প্রথম ওঠা তাই তারও একটা ভয় মিশ্রিত আকর্ষণ ছিল। আমাদের শ্রীনগরে সাত দিন হাউস বোট  আর পহলগাঁও এ দুদিন হোটেল বুক করা ছিল।
    প্লেনের টেক অফের সময় গাটা একটু সিরসির করলেও বাকি সময়টা খাওয়া দাওয়া থেকে আরম্ভ করে সবকিছু দারুণ উপভোগ করেছি। কানে কানে বলি, ওদের দেওয়া লাল জলেও এক দু চুমুক দিয়েছি। শ্রীনগরে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোবার পর মনে হল এক অন্য জগতে এসেছি। গাড়ি থেকে অবাক বিস্ময়ে চারিদিক দেখছি আর ভাবছি এ কোন স্বপ্নরাজ্যে এলাম। একটা বিশাল লেকের ধারে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। অমিত জানাল ওটাই বিখ্যাত ডাল লেক। শ্রীনগর শহরের অনেকটা জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই হ্রদ। আমাদের আগমন বার্তা পেয়ে দুজন লোক এসে আমাদের সব জিনিসপত্র নিয়ে সামনেই এক ভাসমান নৌকা বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। ভেতরে ঢুকে দেখি বড় হোটেলের মত এলাহি ব্যবস্থা। একটু ফ্রেস হয়ে ডেকের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। দূরে বরফে ঢাকা পাহাড়ের সারি, নিচে স্বচ্ছ জলে  সুন্দর করে সাজান ছোট ছোট শিকারা, কোনটা  পর্যটক নিয়ে কোনটা পর্যটকের  সন্ধানে ইতি উতি ঘুরে  বেড়াচ্ছে, পাশে আরো অনেক হাউস বোট সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তা দিয়ে প্রকৃতির মতই সুন্দর মানুষেরা যাতায়াত করছে, প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলাম।
    শ্রীনগরের অনেকটাই শিকারাতে করে দেখলাম। অল্প বয়সী একটি ছেলে আমাদের হাউস বোটে এসে  তার শিকারাতে আমাদের ঘোরাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক করে ধরল। নিষ্পাপ মুখখানা দেখে বড় মায়া হল, রাজি হয়ে গেলাম। অভাবের সংসারে এই বয়সেই অন্নের সংস্থানে বেরতে হয়েছে।  তবরেজই তার ছোট্ট সুন্দর সাজান গোছান শিকারাতে দু দিন ধরে  অনেক যত্ন করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শহরের নানান দ্রষ্টব্য স্থান দেখাল। ছেলেটার আপনজনের মত ব্যবহারে  খুশী হয়ে ওকে আমরা ওর প্রত্যাশার থেকে একটু বেশিই দিয়েছিলাম। যে কদিন ছিলাম রোজ সকালে এসে আমাদের সাথে দেখা করে  নয় ফুল নয় ফল কিছু না কিছু দিয়ে যেত। অনেক চেষ্টা করেও তার বিনিময়ে কোন পয়সা দিতে পারিনি। দু দিন পহলগাঁও এ ছিলাম, এছাড়া গুলমার্গ, সোনমার্গ, এইসব জায়গাগুলো শ্রীনগর থেকে গাড়ি বুক করে ঘুরে এসেছি। চারপাশে যা দেখি তাই সুন্দর লাগে, চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রকৃতি এখানে রূপের ডালি সাজিয়ে বসে আছে, ভূস্বর্গ নামে এতটুকু অতিশয়োক্তি নেই।  আমাদের  মধুচন্দ্রিমা আক্ষরিক অর্থেই মধুময় হয়েছিল। প্রতিটি ক্ষণ কেটেছিল মায়াবী এক উৎফুল্লতায়। রূপসী প্রকৃতির কোলে অহরহ ভেসেছি সেই চরম  সুখে যা শরীর ও মনকে আবিষ্ট করে  পৌঁছে দিত সন্তুষ্টির শীর্ষে।
    ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই নতুন অতিথির আগমনবার্তা অনুমান করলাম। টেস্ট রিপোর্ট পজিটিভ এল, অতিথির আগমন নিশ্চিত হল।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৮৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • তাপস দাশশর্মা | 103.24.***.*** | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০১:৩৮538058
  • এখানেই গল্পের শেষ হলে আমার মতে সবচেয়ে ভালো হত । 
    অনেকদিন পর একটা জমজমাট গল্প পড়লাম । 
     
     
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন