এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • প্রেম দেহ মন - শেষ পর্ব  

    Sukdeb Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৯১ বার পঠিত
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | শেষ পর্ব
    প্রেম দেহ মন - শেষ পর্ব  

    অতঃপর

    সেদিন তন্ময়দের বিষাদ পুরিতে  খুশির হাট বসে গিয়েছিল। তন্ময় অনেক খাবার  কিনে  এনেছিল আর  ওর মায়ের স্টকেও ভাল ভাল কিছু আইটেম ছিল, গুছিয়ে খাওয়া দাওয়া হল।  উদরপূর্তির পর কবে, কিভাবে, কিরকম অনুষ্ঠান হবে তাই নিয়ে চলল বিস্তর আলোচনা। অর্চনাই মুখ্য উপদেষ্টা। বৈঠকখানাতে মামি আর পিসিকে এনে বসিয়ে  নিজে সামনের  সোফার ওপর দু পা তুলে আরাম করে বসল। বিদিশা আর তন্ময়  একটু তফাতে বসেছিল, অর্চনা ধমকে ওদের  পাশাপাশি বসাল। অয়ন আর অলি এই আলোচনায় ঢোকার ছাড়পত্র পায়নি। ওরা দুজনে দাদুর কাছে বসেছিল।
    --সবাই শোন। আমার বন্ধুর সাথে তনুর আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হবে আর তা বেশ জাঁকজমক করেই হবে। পিসির বাড়িতে বিয়ে হবে আর মামি তোমাদের এখানে হবে বৌভাত।
    বিদিশা বলল—দেখ, এই বয়সে লোক জড় করে বিয়ের অনুষ্ঠান  করলে লোকে হাসবে। অয়ন আর অলির  বন্ধু বান্ধবরাই বা ভাববে কি। ওদের কাছে তো লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না। বলি কি শুধু  রেজিস্ট্রি করলেই তো হয়, অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা বাদ দে না।
    “বাদ দে মানে?” অর্চনা ফুঁসে উঠল।  “অনুষ্ঠানের মজাই আলাদা। একেকটা পর্বের এক এক রকম মজা। বিশেষ করে সিঁদুর পরার সিনটাতো দারুণ থ্রিলিং। যে পরাচ্ছে আর যাকে পরাচ্ছে,  তাদের কাছে তো রোমাঞ্চকর  বটেই এমনকি যারা দেখছে তারাও দারুণ  উপভোগ করে। এসব বাদ দিলে বিয়ের আর রইল কি? আসব, একপেট খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বাড়ি ফিরে হজমের আর অম্বলের দুটো বড়ি গিলে শুয়ে পড়ব—এমন বর্ণহীন বিয়ের কথা তুই ভাবলি  কি করে?  তুই এ ব্যাপারে কোন কথা বলবি না। আমরা বড়রা যা ঠিক করব তাই হবে। কি তাই ত!” সম্মতির আশায় পিসি আর মামির দিকে তাকাল।
    ওঁরা হাসিমুখে মৌন থেকে বুঝিয়ে দিলেন “তোরা যা ভাল বুঝিস কর।”
    বিদিশার অবস্থা আন্দাজ করে অমিত বলল—বিদিশা কথাটাতো খুব একটা ভুল বলেনি। অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে চিন্তা করা যায় না।
    “তুমি মাঝখানে ফুট কেটনাতো! বিয়ের অনুষ্ঠান আবার অন্যভাবে কি চিন্তা করব”, প্রস্তাব  বিশদে পেশ করার আগেই অর্চনা অমিতকে থামিয়ে দিল।
    “পিসি, তুমি কিছু বল, অর্চনা তো রীতিমত ডিক্টেটরশিপ চালাচ্ছে”, বৌয়ের সাথে একা এঁটে উঠতে না পেরে অমিত পিসিকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করল।
    অনেক সওয়াল জবাবের পর পিসি আর মামির মধ্যস্থতায় সকলের সুবিধেমত কিছু অদল বদল করে বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। আর একদম দেরী করা চলবে না তাই পরের মাসের দ্বিতীয় রোববারে বিয়ের ভোজের  দিন ঠিক হল আর বুধবারে কিসের যেন একটা ছুটি আছে, ওইদিন হবে বৌভাত। বিয়ের অনুষ্ঠান পুরোপুরিই হবে তবে তা হবে শনিবার দিন,  হাতে গোনা আপনজনদের মাঝে। আর রোববারের ইনভাইটেশন কার্ডে লেখা থাকবে বিশতম বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে নিমন্ত্রণ। ২০টা অনেক ভেবে চিন্তেই ঠিক করা হল। প্রথমত, অয়নের বয়স আঠের ফলে তার সাথে মানানসই হবে, এছাড়া বিবাহ বার্ষিকীর বড় করে ভোজ  লোকে সাধারণত দশ, কুড়ি, পঁচিশ, এইসব পূর্তিতেই দেয়, সেদিক থেকেও ঠিক আছে।    সকলেরই  কথা রইল। অর্চনা খুশি, বিদিশাও খুশি। আর লজ্জার কোন ব্যাপার নেই, অয়নের বন্ধু বান্ধবদের নিঃসঙ্কোচে নেমন্তন্ন করা যাবে। অনেক ভালো কাজের জন্যেও কখনো কখনো একটু মিথ্যের আচ্ছাদনের দরকার পড়ে।  
    রঙ্গরসিকতা, আলোচনা, মজা আর গল্পে মসগুল হয়ে সেদিনের আসর অনেকক্ষণ গড়িয়েছিল। বহুদিন বাদে আনন্দালোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল বালিগঞ্জের ওই নিঝুম প্রাসাদ। সকলকে গাড়ি  করে যার যার ঠিকানায়  পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে এসে তন্ময় দেখে ডাইনিং টেবিলের পাশে হুইল চেয়ারে বসে বাবা অপেক্ষা করছে একসাথে ডিনার করবে বলে। তন্ময় ভাবে মানুষের শরীরের ওপর মনের কি দখল, যে মানুষটার বিছানাতে উঠে বসতেই কষ্ট হয় সে কিনা ছেলের সাথে ডিনার করবে বলে খাওয়ার জায়গায় এসে  বসে রয়েছে।

    নির্ধারিত দিনে বিয়ের অনুষ্ঠান হল, রীতিনীতি মেনেই হল, তবে একান্তই একান্তে। পাত্র পাত্রীর  বাবা মায়েরা ছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার ছাড়পত্র পেয়েছিল অর্চনারা  তিনজন ও জয়িতা দিদিমণি  আর তার স্বামী  অরুণ। পরে বিদিশার অনুরোধে অর্চনা তার মা আর কমল কাকুদের নাম যোগ করে। অর্চনার দাদা বাইরে থাকে এত অল্প সময়ে ওর পক্ষে ছুটি ম্যানেজ করে আসা সম্ভব নয়। গোকুল আর সন্ধ্যা তো বাড়ির লোক, থাকবেই। তবে ‘আমার বাড়ি’র বাচ্চা কটাকে বড়দের ব্যাপার বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনুষ্ঠানের দিকটায় ঘেঁসতে দেওয়া হয়নি।  হ্যাঁ সেদিনও শরীরকে উপেক্ষা করে মনের ডানা মেলে তন্ময়ের বাবা এসেছিল। বিদিশার বাবাকে  কন্যাদান করতে বলা হলে সে পিসিকে বলে,  “ দিদি আপনি এতদিন ওকে নিজের সন্তানের মত আগলেছেন, ও এখন আপনারই কন্যা। এটা  আপনারই অধিকার।” প্রথমে কিন্তু কিন্তু করলেও পিসিই কন্যাদান করল। বিদিশার আগমনে   পিসির জীবনের অপ্রাপ্তির শূন্য পাত্রগুলো সব একে একে ভরে  গিয়েছিল।
    অয়ন একমনে বিয়ের কাণ্ডকারখানা দেখতে দেখতে ভাবছিল যে তার মত নিজের বাবা মায়ের বিয়ে দেখার  এমন  অভিজ্ঞতা  আমাদের দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার ছোটবেলা থেকে চাতক পাখীর মত চাওয়াটা এতদিন বাদে পাওয়া হল। অমিতকাকুও তার মত প্রথম থেকে দুজনের মিলমিশ চাইত, তার চেষ্টাতেই আজ এই সুন্দর দিনটা  সকলে দেখতে পেল। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা অমিতের হাতটা ধরে অয়ন বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, কাকু।” অমিত  কাছে টেনে  জড়িয়ে ধরতে  কাকুর বুকে মুখ লুকিয়ে অয়ন একটু চোখের জল ঝরিয়ে নিল।
    বিয়ের কোন অংশটাই বাদ যায়নি, রাতে বাসর জাগাও হয়েছিল। অবশ্য সেখানে পাত্র আর পাত্রী ছাড়া ছিল কেবল দুজন, বরের তরফে অমিত আর কনের তরফে অর্চনা। মজা মস্করা আর রসের কথার মাঝে উৎসাহের আধিক্যে সূরকে কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে গানের দু চার  কলিও  থেকে থেকে  পরিবেশিত হচ্ছিল। লোক কম কিন্তু বয়স তো কম নয় তাই ভোগীদের জাগার নির্ধারিত যে সময় অর্থাৎ ‘রাত্রি দ্বিপ্রহর’এতেই   বাসরের আসর থেকে সব একে একে  অবসর নিল।
    এই বিয়েতে  একটা সমঝোতা হয়েছিল। সেটা হয়েছিল তন্ময় আর বিদিশার মধ্যে, অন্য আর কেউ এর মধ্যে ছিল না। বিদিশা জানিয়েছিল যে পিসিকে এই বয়েসে একা ফেলে তার পক্ষে তন্ময়ের বাড়িতে গিয়ে পাকাপাকিভাবে থাকা সম্ভব নয়। সপ্তাহান্তে মাঝে মাঝে গিয়ে থাকবে। তন্ময় খুশিমনে সম্মতি দিয়েছিল।  শুধু জানতে চেয়েছিল যে সেও মাঝে মাঝে পিসির বাড়িতে এসে থাকলে বিদিশার কোন আপত্তি আছে কি না। আপত্তি করার দিনগুলো বিদিশা অনেক পিছনে ফেলে এসেছে।
    প্রথা অনুযায়ী  বিয়ের পরের দিন বিদিশার শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার কথা হলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী তা হয়নি, কারণ  ওইদিন ছিল বিয়ের ভোজ। বাড়িতে অনেকটা ফাঁকা জায়গা থাকায় ওখানেই প্যান্ডেল করে নিমন্ত্রিতদের  খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।  এবাড়ি ওবাড়ি মিলিয়ে অনেক লোক এসেছিল। গ্রাম থেকে অমিতের বাড়ির লোকজন, জামালপুর থেকে সপরিবারে তন্ময়ের মামা, দূর দুরান্ত থেকে আরো অনেক আত্মীয় বন্ধুরা এসে সেদিনের অনুষ্ঠানে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। মামাশ্বশুরকে নমস্কার করতে উনি বিদিশাকে আশীর্বাদ করে বললেন, “মা, দেরীতে হলেও এই বুড়োটার  কথা রাখার জন্যে অনেক ধন্যবাদ জানাই।  ঈশ্বরে বিশ্বাস কর কি না জানি না।  কেবল জন্ম আর মৃত্যুই নয়, জীবনের প্রতিটা মুহূর্তের চার্ট ওপরওয়ালার কাছে  করা আছে। তার এতটুকু নড়চড় হওয়ার যো নেই। কখনো কখনো দেখবে তুমি একান্ত ভাবে কিছু চাইছ কিন্তু কিছুতেই তা হচ্ছে না, অথচ তা না হওয়ার কোন কারণ নেই। হয়ত একসময় আপনা আপনিই তা হল, কিন্তু  তোমার ঈপ্সিত সময়টা পার করে। জীবনে তোমার অনেক ঝড় ঝাপটা  গেছে, কামনা করি  আগামী দিনগুলোয় অনন্ত সুখ ভোগ কর।”
    বিদিশা ভাবে মামাতো ওর মনের কথাগুলোই বলে গেল। মানুষটা সত্যিই ভাল, প্রথম সাক্ষাৎ বড় অসময়ে হয়েছিল।
    অয়নের অনেক বন্ধুবান্ধব এসেছিল। নিজেদের মধ্যে তারা খুব আনন্দ মজা করছিল। এদের অনেকে আগেও এ বাড়িতে এসেছে, ছেলেগুলো ভাল। এত আনন্দের মধ্যেও সিঁদুর পরা নিয়ে এক  মহিলা  একটু ঠেস দিয়ে গেল, “আগে তো কখনো মাথায় সিঁদুর তেমন একটা দেখিনি, আজ দেখছি মাথা একেবারে   রাঙিয়ে ফেলেছ!”  বিদিশা হেসে পাশ কাটিয়ে গেছে। এতদিনের ফাঁকা  সিঁথিতে কিছুটা অনভ্যাস আর কিছুটা আবেগের বশে  সিঁদুরটা বিদিশা একটু বেশিই দিয়েছিল। বিয়ের পর প্রথম প্রথম অধিকাংশ মেয়েরা এভাবেই সিঁদুর পরে কিন্তু বিদিশা তো অধিকাংশের মধ্যে পড়ে না , চোখে তো পড়বেই।
    দু বাড়ির আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, অয়নের  বন্ধু বান্ধব, বিদিশার স্কুলের সহকর্মী, সবার উপস্থিতিতে সেদিন পিসির বাড়িতে আনন্দের হাট বসে গিয়েছিল।
    পরদিন সকালে বিদায় বেলায় বিদিশা আর পিসি দুজনের চোখেই জল। এইসময় মা আর মেয়ে তো কাঁদবেই, সনাতন চিত্র। কান্নার বেগ বাড়তে অয়ন দিদুকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে গেল।

    তন্ময় ওর বাড়ির অনুষ্ঠান সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ পরিচিত এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাকে দিয়েছিল। নিজেদের দেখাশোনার লোক কম তাই এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না। রিশেপশন এর ব্যবস্থা হয়েছিল একটা বড় কমিউনিটি হলে। ভেনু, মেনু সব কিছুই ছিল রাজসিক। জনসমাগম ভালই হয়েছিল। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এসেছিলেন। তন্ময় খুব বড় চাকরি করে তা জানা থাকলেও ওর পরিচিতির গণ্ডীটা  যে  এত বড় তা বিদিশার জানা ছিল না। আচরণে বা কথাবার্তায় স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের ফাঁক দিয়ে  কখনো কোনভাবে তা প্রকাশ পায়নি। মানুষটার প্রতি বিদিশার আকর্ষণ আর সম্ভ্রম আরো বেড়ে গেল। এ বাড়িতে সিঁদুর সংক্রান্ত কোন মন্তব্য বিদিশাকে শুনতে হয়নি, তার একটা বড় কারণ নিমন্ত্রিতের অধিকাংশই বিদিশাকে আগে  দেখেনি। এছাড়া  সেদিন বিদিশাকে সাজিয়েছিল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের বিউটিশিয়ানরা, তাদের পেশাদারি ছোঁয়ায় মুখের অন্যান্য প্রলেপের মাঝে  সিঁদুরের বিশেষভাবে নিজের অস্তিত্ব জাহির করার সুযোগ ছিল না।
    একে একে সকলে বাড়ি ফিরে গেল। রয়ে গেল পিসি, অমিতরা,  আর মামাদের মত তন্ময়ের কিছু আত্মীয় পরিজন । পিসি কাল ফিরে যাবে, সঙ্গে অলি আর অর্চনা যাবে। ওরা সঙ্গ দেওয়ার জন্য কয়েকদিন পিসির কাছে থাকবে। অমিত একা বাড়ি ফিরে যাবে। মামারা দু একদিন বাদে ফিরবে।
    ফুলসজ্জার ঘরটাও ওরাই মানে ওই গ্রুপের লোকেরাই সাজিয়েছিল। কেবল খাট নয়, এতবড় ঘরটা পুরোটাই ফুল দিয়ে মুড়ে দিয়েছে। দক্ষ হাতে পরিপাটি করে সাজান। কয়েকজন মেয়ে বৌ বিদিশকে সঙ্গে করে ঘরে নিয়ে এল।  এরা অধিকাংশই বিদিশার থেকে বয়সে ছোট, কেউ কেউ তো অনেক ছোট। রঙ্গ রসিকতার সম্পর্ক নয়, তবু একটু আধটু হল।  এমন একটা দিনে একেবারে নিরামিষ তো চলতে পারে না। কিছু পরে তারাও হাই তুলতে তুলতে বিদায় নিল। বিদিশা পোশাক না পালটেই বিছানার এক ধারে  তন্ময়ের  জন্য অধীর  অপেক্ষায় বসে রইল। বিরাগ থেকে আবার  অনুরাগের সরণিতে ফিরে আসার সময় থেকেই এই অপেক্ষার শুরু।  সঙ্কেতের অভাবে নিস্ফলা গেছে সময়টা।  একটু পরে তন্ময় ঘরে এল। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সোফায় এসে বসল।
    “ওখানে বসে রইলে যে! আমার কাছে আসবে না?”—বিদিশা নরম হেসে তন্ময়কে আহ্বান জানাল।
    --অনুমতি দিচ্ছ?
    --এখনো অনুমতির অপেক্ষা? অনুমতি তো কবেই দিয়েছি। মনের ভেতর উঁকি দিলেই বুঝতে পারতে। আর অয়ন সোনা তো ঘোষণাটাও মাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে। এরপরও কিসের কিন্তু?
    -- অবশেষে তাহলে শাপমুক্তি হল। বই পড়ায় দড় হলেও কারো মন আমি ঠিকঠাক পড়তে পারতাম  না। ভাবতাম,  যে  আমার তার সবটুকু নিয়েই সে আমার। কিন্তু তার সবটাই যে নিজের  মত করে ব্যবহার করা চলে না, এ বোধটা আমার ছিল না। বোধোদয়ের পাঠ পেলাম অনেক মাশুল দিয়ে। তাই তো এই নির্বোধের এত কিন্তু।
    বিদিশা খাট থেকে উঠে তন্ময়ের পাশে সোফায় গিয়ে বসল। তন্ময়ের পিঠে একটা হাত রেখে বলল--বুঝতে পারছি, এখোনো তোমার অভিমান যায়নি। কিছু ভুল তোমার ছিল, কিছু ভুল আমি করেছি। দুজনের ভুলে দুজনে কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু আমাদের ছেলে কোন ভুল না করে কেবলমাত্র বাবা মায়ের ভুলের জন্য জ্ঞান হওয়ার পর থেকে  চরম মানসিক যন্ত্রণা পেয়েছে।  ওর কষ্টে আমিও  কষ্ট পেতাম কিন্তু তা  লাঘবের জন্য খোলস ছেড়ে সাহস করে বেরতে পারিনি। অথচ ওইটুকু ছেলের জন্যেই আজ আমরা এক হতে পারলাম। ডাক্তারিতে সুযোগ  পাওয়ার আগে আবদারকরে বলত, “মা, চান্স পেলে যা চাইব তাই দিতে হবে কিন্তু।”  ভাবতাম ছেলে আমার  কাছে না জানি কি চাইবে। কিন্তু ছেলে চাওয়ার ছলে তার মা বাবাকে দিয়ে গেল সুস্থ, স্বাভাবিক, সুন্দর জীবন।  এটাই ওর জীবনে একান্তভাবে কাম্য ছিল। তন্ময় কি একটা বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ  কানে এল “হাঁদা দুটো কি সারারাত এইসব ভাট বকেই কাটাবি?”
    গলাটা বুলির,  কিন্তু কোথায় সে? তন্ময় এদিক ওদিক তাকিয়েও দেখতে পেল না। 

    বিদিশা তন্ময়ের পিঠ থেকে তাড়াতাড়ি হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে—তুই কোথায়  ঘাপটি মেরে আছিস? আর এত রাতে কি করছিস? 
    --এই দিনে কি করে? আড়ি পাতে। বড় জানলার বাইরে মশার জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আছি। আগেকার দিনের খড়খড়ির জানলা তো, বন্ধ থাকলেও দেখায় কোন বাধা সৃষ্টি করে না। 
    বিদিশা হেসে বলে, “এই বয়সে আড়ি পাততে এসেছিস! অমিতদা, অলি এরা জানে?
    --সব জিনিস  সবাইকে জানাতে হবে তার কি মানে আছে। শোন, যৌবনের অনেক ওভার তো  মেডেন চলে গেল। এখন স্লগ ওভারে কোথায় একটু চালিয়ে খেলবি তা না এখনো নড়বড় করছিস। একদিন নিজে হাতে ধরে তোদের মাঠে নামিয়েছি, সেই দায়িত্ববোধ থেকে ছাত্র ছাত্রীদের  ক্লাইম্যাক্স এর পারফর্মেন্সটা দেখতে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম দু এক ওভার দেখে চলে যাব। কিন্তু তোরা আমাকে হতাশ করলি রে। মশার মধ্যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা বেকার গেল। যাকগে এবার আমি চলি, জানলার বড় পর্দাটা টেনে দিয়ে জরুরি কাজগুলোয় মন দে। এই  দিনটা মানুষের স্মৃতির ভান্ডারে অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে।
    “ভাল বন্ধু অনেকেরই থাকে, তবু অর্চনা সবার থেকে আলাদা। আমার প্রতিটা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ও সঙ্গ দিয়েছে। ও ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ”—বিদিশা আপন মনেই কথাগুলো বলল।  
    তন্ময় অর্চনার কথামত জানলার পর্দাগুলো টেনে দিয়ে আবার সোফায় এসে বিদিশার পাশে বসল।
    “বোনের একটা কথা শুনলে, বাকিটা শুনবে না! রাতটা যদি সোফাতেই কাটাও তাহলে এত পয়সা খরচ করে ফুল দিয়ে খাটটা সাজিয়েছ কেন?”,  মুচকি হেসে বিদিশা বলল। খুবই ইঙ্গিতবাহি ছিল হাসিটা।  তন্ময় বাধ্য ছেলের মত বিদিশার সাথে বিছানায় এল। বিদিশা রাজসিক সাজ পোশাক থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে তন্ময়কে কাছে টেনে নিল। বিদিশার বাহুপাশে আবদ্ধ হয়ে তন্ময় ভাবে এই সেই দেহ যার মনের খবর না জেনে ক্ষণিকের দুর্বলতায়  নিজের মত করে পেতে গিয়ে খোয়া গিয়েছিল তার প্রেম। জীবন থেকে হারিয়ে গেল অনেকটা সুন্দর সময়।
    বিদিশার গভীর চুম্বনে এলোমেলো  হয়ে গেল পাওয়া আর না পাওয়ার হিসেবগুলো।  উদ্দাম দৈহিক তাড়নায় মুহূর্তে হারিয়ে গেল  সব অভিমান। নিবিড় শরীরী অনুসন্ধান আর উপভোগের মাধুরীতে ভঙ্গ হল দীর্ঘ উপবাস।
    মনের ছোঁয়ায় তৃপ্ত দেহে পূর্ণতা পেল প্রেম।  

    ******* সমাপ্ত *******
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | শেষ পর্ব
  • ধারাবাহিক | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন