দৈন্য, বাড়িতে অশান্তি, রত্নার প্রত্যাখ্যান সবে মিলে জীবনটা একেবারে বিষিয়ে উঠেছিল। পৈতে হওয়ার পর থেকেই শ্যামল সকাল সন্ধ্যায় আহ্নিক করত। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বিরক্তিকর জীবনের থেকে ক্ষণিকের মুক্তি পেতে ওই পুজোর সময়টা আরো বাড়িয়ে দিল। থাকত চিলেকোঠার ঘরে। ঠাকুর ঘরটা তারই সংলগ্ন। গীতা, উপনিষদের মত নানা ধর্মগ্রন্থ যোগাড় করে এনে রাতে ঘুম না এলে গুন গুন করে আওড়াত। এইভাবে ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিক লাইনের অনেক কিছু তার কণ্ঠস্থ হয়ে গেল। কাটলো কয়েকটা বছর। এই দুঃসময়েতেও সৌম্যদর্শন মিষ্টভাষী যুবকটি নানাভাবে নতুন কিছু মানুষের মন জয় করেছে। তবে এবার আর প্রফেসর পরিচয়ে নয়। পরিচয়টা অনেকটা এইরকম—শিক্ষিত শাস্ত্রজ্ঞ একজন মানুষ, যে জীবনে বহু ভাল ভাল চাকরির সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাতে যোগ দেয়নি। কারণ, সমাজ সেবাই তার ধ্যান জ্ঞান। একই কারণে বিয়েটাও আর করা হয়নি। জীবন ধারণের প্রয়োজনে সামান্য কটা টিউশনি করে। ... ...
শ্মশান থেকে ফিরে বাড়ি ঢুকতেই শাশুড়ি পরম স্নেহে বললেন---আহা চোখ মুখ বসে গেছে। খুব খিদে পেয়েছে তো? যাও বাবা স্নান করে আগে খেয়ে নাও। অমরের সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে। হাতে মুখে জল দিয়ে তাড়াতাড়ি খাবার টেবিলে গিয়ে দেখে সাজান রয়েছে দুধ, সাবু, ফল আর মিষ্টি। খাবারের দিকে তাকিয়ে খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেল। নামমাত্র একটু মুখে দিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সারা দিনে না জুটল খাওয়া আর না হল বিশ্রাম। পাশের ঘরে তখন গল্পের মস্ত আসর বসেছে। মাঝে মাঝেই হাহা হিহি আওয়াজ ভেসে আসছে। সদ্য কাছা নেওয়া শ্বশুর মশাইও ঐ আসরে রয়েছেন। আর রমা তো মধ্যমণি। অমর শুয়ে শুয়ে ভাবে, অন্তরে যেখানে শোকের লেশমাত্র নেই সেখানে কেবলমাত্র লোকলজ্জার খাতিরে খাদ্যে আর বস্ত্রে এই কদিনের কৃচ্ছ সাধনের কি প্রয়োজন! ... ...
রাতে বাড়ী ফিরে দেখে যোগমায়ার শরীর খারাপ। গায়ে জ্বর, চুপচাপ শুয়ে আছে। মুখঝামটা যতই দিক বৌকে নন্দ যথেষ্ট ভালবাসে। ডাক্তার ডাকা মানেই এখনি কয়েকশ টাকা খসবে, তা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করল—হ্যাঁগো, বিপিন ডাক্তারকে একটা খবর দিই? যোগমায়া স্বামীকে মানা করল—অত ব্যস্ত হতে হবে না। সামান্য জ্বর, একটু শুয়ে বসে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। ভাল হওয়া দূরে থাক পরদিন বেলা বাড়ার সাথে সাথে অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু হল। নন্দ আর দেরী না করে বিপিন ডাক্তারকে নিয়ে এল। ডাক্তার যখন এসেছে তখন যোগমায়া প্রায় সংজ্ঞাহীন। ডাক্তার যত শীঘ্র সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলল। একা কিভাবে কি ব্যবস্থা করবে ভাবতে ভাবতে দিশেহারা হয়ে সাহায্যের আশায় নন্দ পাগলের মত ছুটে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল। প্রথমেই নজর গেল বাড়ির থেকে কয়েক পা দূরে চায়ের দোকানের আড্ডাটায়। অনেক গুলো ছেলে ছোকরা গুলতানি করছে। এই চায়ের দোকানের আড্ডাটাকে ও কোন কালেই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এখন ওসব ভাবার সময় নেই। দোকানে গিয়ে কাতর ভাবে বলল—আমার বাড়িতে বড় বিপদ, একটু আসবে ভাই! ঘটনা শুনে নন্দকে আশ্বস্ত করে ছেলেগুলো বলল--কাকু আপনি শান্ত হোন। আমরা সকলে আছি, কোন চিন্তা করতে হবে না। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ কয়েকজন নন্দর বাড়িতে পৌঁছে গেল। আর তাদের অধিকাংশই নন্দর অপছন্দের ওই জানোয়ারের দলের। সত্যিই নন্দকে কিছু করতে হয়নি। ওরাই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে মুমূর্ষু যোগমায়াকে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করল। ভর্তির সময় প্রয়োজনীয় টাকাটাও নিজেরাই যোগাড় করে জমা দিয়েছে। যোগমায়া যে কদিন হাসপাতালে ছিল সে কদিন রাতজাগা থেকে আরম্ভ করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ, সব ওরাই পালা করে করেছে। ডিসচার্জের দিন স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য হাসপাতালে পৌঁছে নন্দ দেখে যে ছেলেগুলো আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। নন্দর দুচোখ জলে ভরে গেল। মানুষকে বোঝা, তার ভালমন্দের বিচার করা খুবই কঠিন। এতবড় একটা বিপদের আঁচও ওরা গায়ে লাগতে দেয়নি। ... ...
সংসারের অন্যান্য দায়িত্বের সাথে সাথে শ্বশুরকে ভোরের চা থেকে আরম্ভ করে রাতের খাবার দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত কিছু বিমলা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে করে। এখন টুকটাক কিছু কাজ ছাড়া মলিনাকে প্রায় কিছু করতেই হয় না। সবই বৌমা করে। কাজের ভার কমলে খারাপ লাগার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা তো অন্য যায়গায়। সারা জীবন এই সংসার একা চালিয়েছেন। যা উচিৎ মনে করছেন তাই হয়েছে। সেই সংসারেই কাজ কমার সাথে সাথে কমে যাচ্ছে কর্তৃত্ব। এখন তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছেটাই শেষ কথা নয়, বৌমার মতটাই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। আর সব থেকে বিরক্তির ব্যাপার হল যে, এতে সত্যেনের প্রচ্ছন্ন আশকারা আছে। শাশুড়ি বউএর মনমালিন্য নতুন কিছু নয়। হয় না এমন বাড়ি খুব কমই আছে। কিন্তু এই তরজার কিছু নিয়ম আছে। শ্বশুরের জীবিতাবস্থায় শাশুড়ি যতদিন কর্মক্ষম থাকে ততদিন এই দ্বৈরথে বিজয় তিলক তাঁর কপালেই থাকে। তারপর ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হয়। কিন্তু এ তো সময় দিল না। আসার কিছুদিনের মধ্যেই মলিনাকে একেবারে নক্ - আউট করে দিল। বৌমা চিৎকার চেঁচামেচি করে না। যা করবে ঠিক করে তা করে ছাড়ে। যেটা মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। তাই চেঁচামেচি তাঁকেই করতে হয়। প্রথম দিকে অল্প ছিল কিন্তু বৌমার দখলদারি বাড়ার সাথে সাথে অশান্তিও পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল। সেবা যত্ন করে শ্বশুরকেও হাত করে নিয়েছে। সেবা তাঁকেও যে করেনা তা নয়। কিন্তু সেটাই তো স্বাভাবিক। যা স্বাভাবিক নয় তা হল বৌমার মাতব্বরি। ... ...
বিদিশার বাহুপাশে আবদ্ধ হয়ে তন্ময় ভাবে এই সেই দেহ যার মনের খবর না জেনে ক্ষণিকের দুর্বলতায় নিজের মত করে পেতে গিয়ে খোয়া গিয়েছিল তার প্রেম। ... ...
আপনজনেরা বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে চেষ্টা করেছে আমার কক্ষচ্যুত বিক্ষিপ্ত মনকে জীবনের সঠিক ট্র্যাকে পুনঃস্থাপন করতে, কিন্তু ধীরে ধীরে ভাবনায় পরিবর্তন এলেও বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন হয়নি। প্রথমদিকে চাইনি আর পরে চেয়েও পারিনি। বাধ সেধেছে চক্ষুলজ্জা। ... ...
বিদেশে যাওয়ার পর তন্ময় অনেকবার এসেছে গেছে কিন্তু বেশ কয়েক বছর কাটানর পরেও কোম্পানি পাকাপাকিভাবে ওকে দেশে ফিরতে দিচ্ছিল না। দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করে, মোটা মাইনে দিয়ে ওকে আটকে রেখেছিল। দেশে এলে আর ওর ফিরতে মন চাইত না। ছেলের যেমন বাবার জন্যে মন খারাপ হত, বাবাও তেমনি বাইরে গিয়ে ছেলেকে খুব মিস করত। দুজনে কেউ কারো কাছে থাকে না ঠিকই তবু এখানে থাকলে একটু দেখা তো হয়। ওইটুকু সম্বল করেই গড়ে উঠেছে ওদের ভালবাসার সাঁকো। দেশে এলে তন্ময়ের সাথে আমার মাঝে মাঝে গল্প গুজব হত। নিজের চাওয়া পাওয়া আর না পাওয়া গুলো আমার সাথে শেয়ার করত। এগুলো শোনার মত তেমন আপনজন তো ওর কেউ ছিল না তাই আমাকে বলে মন হাল্কা করত। ... ...
--আবার আসিস মা, আমাদের একেবারে বাতিল করে দিস না। আর পারলে তনুটাকেও ওর মা বাবার কথাটা একটু মনে করিয়ে দিস।... চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মামি অতি কষ্টে কথাগুলো বলল। পাশেই মামা দাঁড়িয়ে, তারও চোখের কোনায় জল। বাইরে বেরিয়ে অমিত বলল, “এই মানুষগুলো সম্পর্কে তুমি কত খারাপ খারাপ কথা বলছিলে!” --মানুষগুলো নয়, আমি যা খারাপ কথা বলেছি তা সবই আমার মামাকে উদ্দেশ্য করে। তুমি বাল্মীকি কে দেখলে, আমি দেখেছি রত্নাকরকে। মানসিকভাবে রিক্ত হয়েই ওনার আজ এই পরিবর্তন। ... ...
যেন অমিত, সত্তর দশকে আমার সমসাময়িক পরিচিত দুজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রকে সেই সময়ের উত্তাল বামপন্থী আন্দোলনের শরিক হয়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় শামিল হতে দেখেছিলাম। তাদেরকে অনুসরণ করে আরো অনেক সাধারণ ছাত্র ছাত্রী যোগ দিয়েছিল সেই আন্দোলনে। আজ তাদের একজন বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থার একটি নামি প্রতিষ্ঠানে প্রথিতযশা অধ্যাপক। ঘরণীও এসেছে এক উচ্চবিত্ত ঘর থেকে। আর অপরজন এক নামি তথাকথিত বুর্জোয়া সংবাদপত্রের উচ্চপদ অলংকৃত করে রয়েছে। এঁরা এখনও বক্তব্য রাখেন, ওজনদার লেখালিখি করেন। যে ব্যবস্থা নির্মূল করতে একসময় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন আজ আয়েশ করে বসে আছেন তারই সিংহাসনে। ... ...
বিদিশাকে হারিয়ে আমার প্রায় উন্মাদের অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। কোন কিছুই ভাল লাগত না। এই সমস্ত কিছুর জন্য আমি দায়ী, শুধুমাত্র আমি, আর কেউ নয়। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ বিদিশা আমায় দিয়েছিল কিন্তু সাহস করে এগোতে পারিনি। বিদিশা ঠিকই বলেছে, আমি একটা মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ। তা না হলে যে মেয়েটাকে অন্তর দিয়ে ভালবাসি তার বিপদের সময় ওভাবে কেউ গুটিয়ে থাকতে পারে না। আর সব থেকে বড় কথা তাকে সেই বিপদে ফেলেছি আমি। বাবা ওর সাথে যে ব্যবহার করেছে বাবার মত মানুষের কাছে ওই পরিস্থিতিতে সেটাই প্রত্যাশিত। বাবার কাছে ওর থেকে ভাল কিছু আশা করা যায় না। মাও বাবার সিদ্ধান্তের কাছে চিরকালের মত অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল। ... ...