এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • প্রেম দেহ মন - পর্ব ৬ 

    Sukdeb Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২১৪ বার পঠিত
  • প্রেম দেহ মন
    পর্ব ৬ 

    তন্ময়

    অর্চনা সামনের বছরের  শেষে   বিয়ে করছে, একদিন  নাচতে নাচতে এসে  মাকে  জানিয়ে  গেল। সময়টা মোটামুটি   ঠিক হয়েছে কিন্তু  দিন ক্ষণ তখনো  ঠিক হয়নি।   আর আমি,  পাশ  করব  তারপর চাকরি পাব তারপর বিয়ে। সব ঝামেলার মূলে বিদিশা, বায়না ধরল এম টেক করতেই হবে। আরে বাবা এম টেক করে কি আমার ল্যাজ গজাবে। ততদিনে একটা ভাল চাকরিতে ঢুকে সুখে ঘর সংসার করতে পারতাম। সব দেরী করিয়ে দিল মেয়েটা। যাক, যা  হয়েছিল একদিক দিয়ে ভালই হয়েছিল, অধ্যাপনার লাইনটাও খোলা ছিল। অবশ্য  তখন  প্রায় মেরেই এনেছি, খুব বেশি হলে বছর খানেক। দু একটা কোম্পানি তখনই যোগাযোগ  করেছে, তাই চাকরি পাওয়াটা কোন সমস্যার  ব্যাপার ছিল না। ইচ্ছে ছিল বাইরে  কোথাও পোস্টিং নেব, বিয়ের পর একটু স্বাধীনভাবে থাকা যাবে। মায়ের জন্য  একটু মন খারাপ লাগবে ঠিকই, তবু বাইরেই ভাল। বিদিশা চাকরিটা পেয়ে তখন  বেশ ফুর্তিতে আছে। অল্প হোক বা  বেশি, নিজের রোজগারের আনন্দই আলাদা। প্রথম মাইনের টাকায় কিনে সেদিন কি সুন্দর একটা টি শার্ট দিয়ে গেল। ওর সামনে একবার পরেছিলাম তারপর যত্ন করে তুলে রেখেছি ওই অমুল্য  উপহার। ভাবতাম চাকরিটা একবার পাই, আমিও উপহারে ভরিয়ে দেব আমার বিদিশাকে। বিদিশা চাকরি পাওয়ার পর থেকে আমাদের সাক্ষাৎ আর আগের মত অত ঘন ঘন হত না। পড়াশোনার চাপে আমিও একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। মাঝে দুজনে  একটা  সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম, তার পর থেকে প্রায় দিন কুড়ি  ফোনালাপেই যাবতীয় প্রেমালাপ হচ্ছিল।  
    এর মাঝে খবর এল দিদিমার শরীর ভাল নয়। নিজের মাকে দেখতে আমার মা কিছুদিনের জন্য জামালপুরে আমার  মামার বাড়িতে যাবে। এক  শনিবার সকালে  মাকে পৌছে দিতে বাবা জামালপুর যাচ্ছে, ফিরবে সোমবার রাতে।  পরে  সুবিধেমত একসময়  মামা মাকে দিয়ে যাবে। আমাকেও  যেতে বলেছিল,  কিন্তু তখন আমার পক্ষে কলেজ কামাই  করে  যাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে সমস্যা হল একা থাকাটা। কখনও আমি একা থাকিনি। রান্নার লোক আছে রেঁধে দিয়ে যাবে ফলে খাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা হল এত বড় বাড়িতে একা থাকাটা। ভরসা ছিল একমাত্র বলাই কাকু, সেও একান্তে আমায় বলে  রেখেছে “রোববার দিনটা আমকে একটু  ছেড়ে দিও, বাড়ি যাব। চিন্তা কোরোনি, সোমবার সক্কাল বেলাই ফিরে আসব। কাউরে বোলো না যেন।” তার মানে রবিবারটা একেবারে একা, দিনের বেলাটা সমস্যা  নয়,  সমস্যা রাতে। আসলে গোপন কথাটা হল, আমার একটু ভূতের ভয় আছে।  অনেকেই ছোটবেলায় ভূতের ভয় পায় বা বলা ভাল অভিভাবকেরা নিজেদের স্বার্থে পেতে শেখায়,  কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে তা কেটে যায়। দুর্ভাগ্যবশত ছোটবেলায় আমাকে সামলাতে  না পারলে বলাই কাকু সেই যে আমায়  ভূত পেত্নীর  জগতের নানা খবর শোনাত   তা  মনের মধ্যে গেঁথে গেছে।  একা থাকলেই সেগুলো সব ডানা মেলে। একা থাকতেই যখন হবে তখন পড়াশোনা করে, গান শুনে, সিনেমা দেখে রাতটা কাটাতে হবে, মোট কথা ঘুমোনো যাবে না।
    বিদিশাকে ফোনে সব কথা জানালাম, শুনে তো ও হেসে কুটিপাটি। বলে “লজ্জা করে না, এত বড় ছেলে ভূতের ভয় পাও!” সত্যিই লজ্জার ব্যাপার কিন্তু কি করব এর তো কোন ওষুধ নেই যে খেলাম আর সেরে গেল। সব মানুষেরই কোন না কোন ব্যাপারে ভয় থাকে আমার জন্য ওপরওয়ালা ভূতকে পছন্দ করেছেন। মনের মধ্যে বয়ে বেড়ান ছাড়া উপায় নেই।  বিদিশাকে  বললাম, “রোববার তো তোমার ছুটি, আমাদের বাড়িতে চলে এস। গল্প গুজব করে খানিকটা সময় কাটান যাবে।”
    বিদিশা শোনামাত্র না করে দিল। বলল—কাকু কাকিমার  অনুপস্থিতিতে তোমাদের বাড়িতে আমার যাওয়াটা উচিৎ নয়। জানতে পারলে কি ভাববেন। আর তার থেকেও বড় কথা চোরের মত এভাবে যাওয়াতে আমার মনের একেবারে সায় নেই। গেলে ওনারা এলে তারপর যাব।
    অনেক কাকুতি মিনতি করে, অতিকষ্টে বিদিশাকে রাজি করালাম। বলল বিকেলবেলা চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ ঘন্টা দুয়েকের জন্য আসবে। ওর বোন মায়াও সঙ্গে আসতে চাইছে শুনে বলেছিলাম—এনো। ও এলে আড্ডাটা ভালই জমবে।
    রোববার সকালেই দাদাবাবু আসছি বলে বলাই কাকু চলে গেল। রান্নার মাসি, কাজের মাসি, সব একের পর এক আসতে যেতে লাগল। একা থাকার এই আর এক সমস্যা, বাড়ির সব দায় দায়িত্ব সমলাতে হয়। বাজার টাজার অবশ্য সব করা ছিল, ওসব নিয়ে চিন্তা নেই। তবু যতটুকু যা করতে হবে সেটাই আমার কাছে অনেক। আসলে বাড়ির কোন  কাজ কোনোদিন করতে হয়নিতো তাই ঠিক তাল খুঁজে পাইনা। কাজের লোকেরা সব কাজ সেরে বিদায় নিতে আমিও জলখাবার খেয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে বিদিশাদের জন্য কিছু খাবার কিনে দুপুরবেলা বাড়ি ফিরলাম। খেতে খেতে বেলা হয়ে গেল। না কোন কারণ নেই, এমনিই। বিদিশাদের আসতে তখনো দেরী আছে। খাটে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে একটা গল্পের বই  খুলে বসলাম। কয়েক পাতা ওলটাতে না ওলটাতেই ভাতঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে গেল। কখন যেন পৌছে গেলাম এক ধু ধু প্রান্তরে। কিছু মানুষ, যারা মনে হল আমার খুব চেনা অথচ চিনতে পারলাম না, আমাকে একলা ফেলে রেখে দূরে আরো দূরে চলে যাচ্ছে। শেষে ছায়া হয়ে মিলিয়ে গেল। আমি কত ডাকলাম, কিন্তু কেউ ফিরেও তাকাল না। পৃথিবীর ওই শেষ প্রান্তে তখন ঘন অন্ধকার নেমে আসছে। আমি আর্তনাদ করছি কিন্তু সাড়া দেওয়ার কেউ নেই। ঘন্টা ধ্বনির মত কি যেন কানে ভেসে এল। এই মনুষ্যবিহীন প্রান্তরে মন্দির না চার্চ, ও কিসের ঘন্টা! দ্বিতীয়বার  বাজতে বুঝলাম ওটা আমার বাড়ির কলিং বেল। বাস্তবে ফিরলাম, ধড়ে প্রাণ এল। এসির মধ্যেও ঘামে জামা ভিজে গেছে। তৃতীয়বার বেল বাজল। দরজা খুলে বিদিশাকে দেখে দুঃস্বপ্নের অস্থিরতা কেটে গিয়ে মন  খুশিতে ভরে উঠল।
    --মায়া কোথায়, আসেনি?
    --না, বাড়িতে হঠাৎ ওর দুজন বন্ধু এসে যাওয়ায় আসতে পারল না। ওর খুব ইচ্ছে ছিল তোমাদের বাড়িতে আসার। 
    --এলে ভাল লাগত, কি আর করা যাবে।   মুখে একথা বললেও বিদিশা একা আসায় খুশি হয়েছিলাম। একান্তে দুটো কথা বলা যাবে,  মায়া থাকলে যা সম্ভব হত না।
    বিদিশা ভেতরে ঢুকে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল—তুমি এত ঘেমেছ কেন? আমার আসতে একটু দেরী হল বলে  অস্থির হয়ে ছাদে ঘুরছিলে নিশ্চই।
    নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিয়ে দিয়েছে দেখে আসল কারণ না জানিয়ে সম্মতিসূচক হাসলাম। ঘরে ঢুকে বিদিশা নিজেই ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জলের বোতল বার করে জল খেয়ে সোফায় গিয়ে বসল।  বিদিশা অধিকাংশ সময় সালোয়ার কামিজ পরে কিন্তু  সেদিন শাড়ী পরে এসেছিল। আকাশী রঙের শাড়ীতে খুব সুন্দর লাগছিল ওকে। ওর  দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম—আমার মিষ্টি বৌ।
     প্রশংসা কার না ভাল লাগে, শুনে মিষ্টি  করে হাসল। 
    --তোমাদের বাড়িটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবে? আগের দিন কাকিমা সঙ্গে নিয়ে  দেখিয়েছিলেন কিন্তু সেদিন এত নার্ভাস ছিলাম যে ওনার পিছন পিছন শুধু ঘুরেছি দেখা কিছু হয়নি।
    আমি বললাম—এতটা পথ এসেছ ক্লান্ত হয়ে আছ, একটু জিরিয়ে  নাও তার পর যাওয়া যাবে। আর শোন তোমাদের জন্য নিজে গিয়ে খাবার কিনে এনেছি, বাড়ি দেখা হয়ে  গেলে  খাওয়া দাওয়া করে  যাওয়ার সময় মায়ার ভাগেরটা  নিয়ে যাবে।
    --হ্যাঁ তা তো বটেই, মায়ের কাছে ধরা পড়ে মরি আর কি।
    বিদিশা খুব উৎসাহ নিয়ে একটা একটা করে ঘর  দেখতে লাগল। বইয়ের আলমারি গুলো দেখে বলল, “বাবা কত বই! আমাকে দু একটা পড়তে দেবে?”
    --দু একটা কেন তোমার যতগুলো খুশি নিয়ে যাও। এগুলো সব আমার বই।
    ঘর দেখা হয়ে গেলে ওকে নিয়ে ছাদে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় ওকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে একটা চুমু খেলাম। এতদিনের মেলামেশায় চুমু সেদিনই প্রথম, বিদিশা আপত্তি করেনি।
    হেসে বলল-- এই দুষ্টুমি করার জন্যই বুঝি ফাঁকা বাড়িতে আমায় ডেকে এনেছ।
    শরীরে এক অদ্ভুত তরঙ্গ খেলে গেল। ওকে জড়িয়ে ধরেই ছাদে উঠলাম। ছাদে ওঠার আগে নিজেকে আমার হালকা বাঁধন থেকে মুক্ত করে জানাল—ব্যাস আর না, আজকের মত কোটা শেষ।
    এতদিন ওর সাথে মেলামেশা  করছি কিন্তু হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে গল্প করা ছাড়া আর এক ধাপও কোনদিন এগোইনি। ইচ্ছে যে একেবারে করেনি তা নয়, তবে বিদিশা যদি খারাপ ভাবে সেই ভেবে নিজেকে সংযত রেখেছি। কিন্তু ওকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরার পর থেকে আমার অতদিনের অনুশাসিত মন লাগামছাড়া  হয়ে  উঠল। নিচে বেডরুমে  আসার পর  কিছু বোঝার আগেই বিদিশাকে জড়িয়ে ধরে বারে বারে চুমু খেতে লাগলাম। বিদিশা নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে বলল—এ কি অসভ্যতা হচ্ছে তন্ময়? ছাড়ো আমাকে, ছাড়ো লাগছে। 
    আমি তখন আর আমার মধ্যে ছিলাম না। ‘প্লিজ একটিবার’ বলে জোর করে ওকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে  ফেললাম। ও তখন মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করছে। পারেনি, আমার শক্ত বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। বরং আমিই ওকে ওর  আবরণের থেকে মুক্ত করে ওর নগ্ন  দেহের ওপর নৃত্য করেছিলাম। কিছুটা প্রতিরোধের পরে অসহায় বিদিশা নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
    শারীরিক ক্ষুধা মিটে যাওয়ার পরে আমি আমাতে ফিরে এসেছিলাম। চরম পাপ বোধে তাড়িত হয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ খাটের ধারে বসলাম। বিদিশ তখন অঝোরে কাঁদছে। ওর মাথায় হাত দিতে ও ধাক্কা দিয়ে হাতটা সরিয়ে দিল। কোনরকমে টলতে টলতে উঠে জামাকাপড় পরল। ব্লাউজের একটা দিক অনেকটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। ছেঁড়া অংশটা শাড়ীর আঁচল দিয়ে ঢেকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—আমি একটা ধর্ষকের সাথে ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম।  তুমি আমাকে নয় ভালবাস  আমার এই দেহটাকে। তাই প্রথম সুযোগেই সেটার দখল নেওয়ার জন্য এতটা হিংস্র হলে। ছিঃ তন্ময়, ছিঃ।
    ওর সামনে গিয়ে হাত জোড় করে বললাম- বিদিশা আমাকে ক্ষমা করো। বিশ্বাস করো আমি কোনোদিন তোমাকে নিয়ে এভাবে ভাবিনি। আজ ক্ষণিকের দুর্বলতায় আমার জীবনের জঘন্যতম অপরাধ করে ফেলেছি। আমাকে মাফ করে দাও।
    ও তখন বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে। আমি তখন ওর পা দুটো জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলাম। ও কোন উত্তর না দিয়ে ওর পা ছাড়িয়ে চলে গেল।
    টেবিলের ওপর  ওর জন্য আনা খাবারগুলো পড়ে রইল। এ আমি কি করলাম! নিজের সম্পত্তি নিজেই লুঠ করে  নিঃস্ব হয়ে গেলাম। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় সারারাত  ছটফট করেছি। সকালের দিকে চোখটা একটু লাগতেই আবার দেখলাম এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন। ‘আমি একটা জলাশয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কয়েকটা ছায়ামূর্তি দূর থেকে আমার দিকে সমানে ঢিল ছুঁড়ছে। নিজেকে বাঁচাতে আমি  ছুটতে ছুটতে জলাশয়ের অন্য দিকে চলে গেলাম। খুব ঘেমে গেছি, চোখে মুখে জলের ছিটে দেওয়ার জন্য জলাশয়ের দিকে একটু ঝুঁকতেই আঁতকে উঠলাম। একটা হায়নার প্রতিবিম্ব জলে ভেসে উঠল।  ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, ঘুম ভেঙে গেল। আতঙ্কের রেশ কাটার আগেই কলিং বেল বাজল, বলাই কাকু এসেছে। ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল—খোকা বাবু ওরকম ভাবে চেঁচিয়ে উঠলে কেন, স্বপ্ন দেখছিলে?
    সম্মতি সুচক ঘাড় নাড়তে বলল- আসলে কখনো একা থাকোনিতো। কি করব, বাড়িতে এমন একটা দরকার পড়ল যে না গেলেই নয়। তা নইলে তোমারে একা ফেলে কখ্যোনো যেতাম না।
    --এইটুকু সময়ে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে গো বলাই কাকু। তুমি না থাকার জন্য বুঝেছ, শুধু তুমি  না থাকার জন্য।
    বলাই কাকু কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে রইল।
    পরের দিন বিদিশাকে অনেকবার ফোন করলাম, প্রথম দিকে কয়েকবার  কেটে দেবার পর ফোনটাকেই সুইচড অফ করে রেখে দিয়েছিল। কোন উপায় না দেখে একদিন ওর স্কুলের ছুটির সময় সামনেটায় গিয়ে দাঁড়ালাম। গেট থেকে একটু এগিয়ে যাওয়ার পর ওর পাশে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলার চেষ্টা করলাম,  কোন কথার কোনো উত্তর না দিয়ে অপরিচিতের মত হেঁটে চলল। রাস্তার মাঝেই যখন কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, “একটিবারের জন্যও কি আমাকে ক্ষমা করা যায় না। আমার থেকে  অমনভাবে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না বিদিশা, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।”
    বাড়ির দিকে চলে যাওয়ার আগে শুধু বলল— বিশ্বাস ছাড়া কোন সম্পর্ক অর্থহীন।
    অনেক চেষ্টা করেও যখন পারলাম না তখন বাধ্য হয়ে অর্চনাকে সব কিছু খুলে বলে অনুরোধ করলাম বিদিশাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে। অর্চনা সব শুনে যত রকমের কুকথা বলা যায় বলল, আমি চুপ করে শুনে গেলাম। এরপর অর্চনাও  আর আমার সাথে যোগাযোগ করেনি এমনকি ফোন করলেও ধরে না। খুব ভেঙে পড়লাম, লেখাপড়াতেও আর মন বসাতে পারিনা। সারাদিন নিজের মত চুপচাপ থাকি। মাস দেড়েক বাদে বিদিশা  ফোন করে জানাল যে ও আমার সাথে একান্তে দেখা করতে চায়। মনটা আবার  খুশিতে ভরে গেল, অবশেষে মান ভেঙেছে।
    নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট সময়ে দূর থেকে বিদিশাকে আসতে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম। বিদিশার  মুখ গম্ভীর। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দুজনে গিয়ে বসলাম।
    আমি কিভাবে কথা শুরু করব বুঝতে পারছি না তাই চুপ করে রয়েছি। বিদিশাই নীরবতা ভেঙে  জিজ্ঞেস করল—আমি কেন তোমায় ডেকে পাঠিয়েছি জানো?
    --হয়ত আমাকে ক্ষমা করেছ তাই।
    --না। একটা খবর জানাতে এসেছি। আমি সন্তান সম্ভবা। পিতা হিসাবে খবরটা তোমাকে জানান উচিৎ তাই এলাম। 
    এতদিন অপরাধ বোধে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। কিন্তু বিদিশা  যা বলল  তা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।
    চুপ করে আছি দেখে বিদিশা বলল—কি বলেছি শুনেছ? ব্যাপারটা বেশি জানাজানি হওয়ার আগে অবিলম্বে আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি সেরে ফেলা উচিৎ।
    আমার মাথা কাজ করছিল না। বললাম—নষ্ট করে ফেলো না। 
    শুনে বলল—তোমার কাছে এই উত্তরই আমি আশা করেছিলাম। শুনে রাখ, আমি অ্যাবর্ট করাব না। বিয়ের ব্যাপারে তোমার মতামতটা জানাও।
    সিদ্ধান্ত, দায়িত্ব, এইসব ব্যাপারগুলো চিরকাল আমার হয়ে অন্যে নিয়ে এসেছে ফলে এই পরিস্থিতি সামলানর মানসিক শক্তি আমার নেই। তখন আমার দিশাহারা অবস্থা। কি বলব বুঝে উঠতে পারছি না।
    “কি ভাবছ? পালাবার পথ খুঁজছ তাই না?” বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বিদিশা বলল।
    আমি বললাম—ছিঃ ছিঃ, না। তোমাকে বিয়ে করে ঘর বাঁধা তো আমার স্বপ্ন। কিন্তু এইভাবে এখন বিয়ে করলে বাবা বাড়ি থেকে বার করে দেবে। এখন আমি কোন রোজগার করি না, আমাদের চলবে কি করে? তাই তোমাকে অ্যাবর্ট করার কথা বলেছি। আর এই সন্তান তো আমরা কেউ চাইনি। আমার মুহূর্তের দুর্বলতায় এসে গেছে, সম্পূর্ণরূপে আন ওয়ান্টেড বেবি। প্লিস আমার এই অনুরোধটা রাখ। আর তো মাত্র কয়েক মাস, তারপরে চাকরি পেলেই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে চলে আসব। লক্ষ্মীটি কথা শোনো, এখন এই সমস্যা সামলাবার মত ক্ষমতা আমার নেই। অমিতের  সাথে কথা বললেই ও একটা ব্যবস্থা করে দেবে।
    “আমি তোমার পরামর্শ শুনতে আসিনি। একটা গুরুতর বিষয় জানাতে এবং সে বিষয়ে তোমার মত জানতে এসেছিলাম। উত্তর পেয়ে গেছি। যদিও উত্তরটা আমার জানা ছিল কারণ তোমার মত ব্যক্তিত্বহীন, মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষের কাছ থেকে আমি অন্য কিছু আশা  করিনি।”  
    বিদিশা চলে গেল, হয়ত আমার জীবন থেকেও। নিজের কোন রোজগার নেই, নেই এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লড়ে যাওয়ার মত মনের জোর, তাই অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলাম বিদিশার চূড়ান্ত প্রস্থানের দিকে।

    (চলবে) 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২১৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন