এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • মাতলার চর: অন্তহীন আবর্ত - শেষ পর্ব

    অমলেন্দু বিশ্বাস
    গপ্পো | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৯২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • পর্ব এক | পর্ব দুই
    বিধুশেখরের এরকম অভিজ্ঞতা এর আগে কখনো হয় নি। ও অভিভূতের মত উপভোগ করতে থাকল।

    আর এক গানের আসরে তিনি বললেন --- ‘শিল্পী সারা জীবন পরিশ্রম করে সাধনা করে শিল্প সৃস্টি করে তোমাকে যা উপহার দিচ্ছেন তা গ্রহণ করে তোমাকেও তো কিছু দিতে হবে। তোমাকেও তো গ্রহীতার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তোমাকেও প্রস্তুত হতে হবে। তুমি যদি সেই শিল্প পরিপূর্ণ রূপে উপভোগ করতে চাও, সেই সুধা সাগরে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত করতে চাও, তবে একাগ্র মনে সকল ইন্দ্রিয় সজাগ করে শিল্পীর সংগে সামিল হও। একটু পরিশ্রম করে সেই শিল্পের ব্যাকরণ জানার চেস্টা করো। সেই শিল্পের সূক্ষ ও প্রায় অসাধ্য প্রয়োগ কর্মকে চিনতে শ্রুতি, দৃষ্টি ও মনকে তৈরি করো।’ থামলেন জগদীশবাবু, উঠে গিয়ে একই গানের দুই শিল্পীর দুটি রেকর্ড বাজালেন। শেষ হলে বললেন, ‘বলো, কি শুনলে, কেমন শুনলে?’ বিধুশেখর প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলো না। ওর কাছে দুজনের গানই সুন্দর, খুবই ভাল, বার বার শুনতে ইচ্ছে করে। ও চুপ করে থাকলো, কোন কথা বলল না। গজদীশবাবু কোন উত্তর আশা করেননি, বলে চললেন, ‘লক্ষ্য করে দেখ, একজনের উচ্চারণ স্পষ্ট, বলিষ্ঠ, অন্যজনের উচ্চারণ সাধারণ, বৈশিস্ট্যহীন। একজনের স্বরবর্ণের উপর পক্ষপাতিত্ব, অন্যজন ব্যাঞ্জনবর্ণের উপর জোর দিচ্ছেন বেশী। একজন নিষ্ঠাবান শিষ্যের মত স্বরলিপি অনুসরণ করছেন, অন্যজন স্বরলিপির কাঠমোর উপর মূর্তি গড়ে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন। একজন একটা কথার উপর অকৃপণ ভাবে মীড় দিচ্ছেন, অন্যজন সংযমী, মীড়ের যথাযথ ব্যবহার করছেন। অবশ্য এটা আমার মতামত। শ্রোতার বিদ্গধতা ও শিল্পবোধের উপর নির্ভর করছে বিকল্প মতামত। আসল কথা, সচেতনভাবে তোমাকে তোমার নিজের রুচি গড়ে তুলতে হবে।’

    শিক্ষা চলতে থাকল। বিধুশেখর বুঝতে পারছে ও এক বিশাল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ওর চোখের সামনে আস্তে আস্তে একটা নতুন জগতের আবরণ উন্মোচিত হচ্ছে।

    বিধুশেখরের একটা ইংরেজী রচনা দেখছিলেন জগদীশবাবু। এক অতিদীর্ঘ বাক্য কেটেকুটে ছোটো করে দিলেন, বক্তব্য অটুট রেখে। দুচারটি শব্দ বদলে নতুন শব্দ বসালেন। ‘বাঃ, বেশ ভাল লিখছ, অনেক উন্নতি হয়েছে।’ বইএর স্তুপ থেকে গোটা দুই ইংরেজী প্রবন্ধের বই বার করে ওকে দিলেন। বললেন, ‘পড়ো, আরো লেখো। ভালো ইংরেজী লিখতে হলে ইংরেজীতে চিন্তা করতে হবে, ইংরেজীতে স্বপ্ন দেখতে হবে। বাংলাতে ভাবনা-চিন্তা করলে লেখা তোমার ইংরেজী অনুবাদ হবে, স্বাভাবিক ইংরেজী লেখা হবে না।’ তারপর বিষয়ের সম্পুর্ণ পরিবর্তন করে বললেন, ‘এস, তোমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়ে দিই।’ ছোটবেলা থেকেই ও পাঠ্যপুস্তকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছোটগল্প পড়েছে, কিছু গান শুনেছে কিন্তু তার বেশী না। বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ পড়ো, রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে না। আমাদের মত তুমিও খুব ভাগ্যবান। তুমি তোমার মাতৃভাষায় রবীন্দ্রনাথ পড়তে পারছ, বহু মানুষেরই সেই সুযোগ নেই। ইনি এক গভীর মহাসাগর, অসংখ্য মণিমাণিক্যে ভরা। যত পারো তুলে নাও, যা চাও তাই পাবে।’ কারো মুখে কোন কথা নেই। জগদীশবাবু একগুচ্ছ বই টেনে একটার পর একটা কবিতা পড়তে শুরু করলেন। অমিয়বাবু বেহালায় সুর যোগ করলেন। জগদীশবাবু আবৃত্তি করে চলেছেন।

    বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
    এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।
    স্বর্গ কি হবে না কেনা ?
    বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না এত ঋণ ?
    রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন।

    আবিস্ট মনে শুনতে শুনতে বিধুশেখরের শিহরণ লাগল। সিক্তচক্ষু বাস্পাচ্ছন্ন হয়ে উঠল।

    বিধুশেখরের পড়ায় মন বসে না আগের মত। মাথার মধ্যে বাসা বেঁধেছে মার্ক্স আর রবীন্দ্রনাথ। তার সঙ্গে আছে ইউনিয়ন। মার্ক্স পড়ছে, রবীন্দ্রনাথ পড়ছে। যতই পড়ছে ততই ওদের তত্ত্বে, দর্শনে, ব্যক্তব্যে ও অভিভূত হচ্ছে। ওর সময়ের সিংহভাগ অধিকার করে নিয়েছে এই দুই মহারথী। জগদীশবাবু-অমিয়বাবু, মার্ক্স -লেনিন-মাও, রবীন্দ্রনাথ বিধুশেখরকে অন্য বলয়ে নিয়ে গেল, যেখানকার চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা – সবই ভিন্ন রকমের, ওর পরিচিত জগতে আগে যা কখনো অনুভব করেনি।

    দিন যায় মাস যায়। বিধুশেখর সপ্তাহ শুরু থেকেই দিন গুনতে থাকে, কখন অমিয়বাবু-জগদীশবাবুর সংগে সময় কাটাবে। শয়ন-আহার-কলেজে-যাওয়ার মতো এখানে পাঠ নেওয়াও যেন এক অভ্যাস হয়ে গেল। এমনি কাটল প্রায় সতেরো-আঠারো মাস। একদিন অমিয়বাবু সেই অপ্রত্যাশিত সংবাদটা দিলেন। ওঁরা দুজনেই নবনগর কলেজ ছেড়ে দিচ্ছেন। অমিয়বাবু আমেরিকার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার আমন্ত্রণ পেয়েছেন। উনি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। জগদীশবাবু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে যোগ দিচ্ছেন। এঁরা আকস্মিক এসেছিলেন, আকস্মিকই চলে গেলেন। দুই বন্ধু কোন ভূলোক থেকে তাদের যাত্রাপথে এই সরাইখানায় ক্ষণকালের জন্য বিশ্রাম নিতে এসেছিলেন। এই দুই অসাধারণ মানুষ বিধুশেখরকে মুচড়ে ভেঙ্গে নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন।

    ওর চক্ষু ছিল, দৃস্টি ছিল না। ওর কর্ণ ছিল, শ্রুতি ছিল না। ওর বুদ্ধি ছিল, বিশ্লেষণ শক্তি ছিল না। তিল তিল করে এই গুণগুলি দিয়ে এক নতুন বিধুশেখরের জন্ম দিলেন তাঁরা।

    হঠাৎ বিধুশেখরের জীবনটা যেন শূণ্য হয়ে গেল। ও তখন কলেজের তৃতীয় বছরের মাঝামাঝি। কিন্তু পড়াশুনা ঠিকমত হচ্ছে না। ইউনিয়নের কাজে বড় বেশী সময় যাচ্ছে। সামনে ইউনিয়নের নির্বাচণ। জেলা পার্টি কার্য্যালয় থেকে কমরেড মনোরঞ্জন সামন্ত মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে দেখা করতে আসত। মনোরঞ্জনদার কলেজে আসা নিষেধ। কলেজের পাশেই এক চায়ের দোকানে বসে ওরা পরিকল্পনা করতো কেমন করে উইনিয়ন নির্বাচণ পরিচালনা করা হবে।

    অমিয়বাবু চলে যাওয়ার পর মার্ক্স-লেনিন-মাও, পৃথিবীর অন্যান্য চিন্তাবিদদের লেখা ও বই পড়া এবং আলোচনা করার সুযোগ হত না বিধুশেখরের। বামপন্থী তত্ত্ব ও দর্শণ সংক্রান্ত সব পত্র-পত্রিকা ও বই-র উৎস বন্ধ হয়ে গেল। ক্রমে ক্রমে সেই শূণ্যস্থান পূর্ণ করলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ওর সমস্ত সত্ত্বা ঘিরে। রবীন্দ্রনাথে ওর সমগ্র হৃদয় মন নিমজ্জিত। রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গান-গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ-জীবনী-চিঠিপত্র নিয়ে ওর সময়ের একটা বৃহৎ অংশ চলে যেত। বাদ যেত না রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে রবীন্দ্র-উৎসাহী ও পন্ডিতদের লেখা রত্নভান্ডারও। পাঠ্যপুস্তক স্থান নিল পিছনের সারিতে।

    যথাসময়ে পরীক্ষা এল এবং শেষও হল। ফল বেরোতে এখনো অনেক দেরী। হাতে সময় আছে অনেক। ওর ইচ্ছা ছিল জগদীশবাবু-অমিয়বাবুরা যে পাঠ্যতালিকা দিয়ে বলেছিলেন ‘সময় পেলে পোড়ো’, সেই বইগুলো পড়বে। তাছাড়াও আছে ওর নিজস্ব একটা তালিকা। নিশ্চিন্তে নিরিবিলিতে সেগুলো শেষ করবে। যা ভেবেছিলো তা হলো না। বাদ সাধলেন মনোরঞ্জনদা। একদিন হঠাৎ এসে হাজির। বললেন, ‘এখন তো তোমার হাতে অনেক সময়। এসো, আমার সঙ্গে কাজ করো।’ বলে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন এক সভায়। ‘আজ তোমার কোনো কাজ নেই। শুধু আমার কাছে থাকো, শোনো, দেখো আমাদের কর্মীরা কেমন কাজ করছে।’

    প্রায় বিনাপ্রস্তুতিতে বিনাচিন্তাতেই শুধু মনোরঞ্জনদার ব্যক্তিত্বে আকৃ্স্ট হয়ে পার্টির কাজে লেগে গেলো। তবে কারো সঙ্গেই তেমন বেশী বামপন্থী তত্ত্ব বা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে আলাপ আলোচনা হতো না। মনোরঞ্জনদার কাছে কাজের নির্দ্দেশ আসত কলকাতার প্রধান কার্য্যালয় থেকে। ওরা সেই কর্মগুলোর রূপ দিত। প্রথম দিকে বিধুশেখরের কাজ ছিল পোস্টার লেখা আর কাঁধে মই নিয়ে রাতের অন্ধকারে দেয়ালে দেয়ালে সেগুলো লাগানো। অবশ্য কয়েক দিনের মধ্যেই ওকে সে কাজ থেকে সরিয়ে মনোরঞ্জনদা ওকে আরো গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজ দিলেন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে নতুন সদস্য সংগ্রহ করা ও দল সংগঠন করা। মনোরঞ্জনদা বললেন, ‘গ্রামে গিয়ে কাজ করো, গ্রামের মানুষের সুখ দুঃখের শরিক হও। ওদের পানীয় জলের অভাব, রাস্তা ঘাট নেই, পড়াশুনার ব্যবস্থা নেই,চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ওদের মধ্যে একতা নেই, ওদের আত্মবিশ্বাসের বড় অভাব। ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াও, টিউব ওয়েল তৈরি করো, নৈশ বিদ্যালয় করো। ওদের একত্র করো, ওদের মনে আত্মবিশ্বাস এনে দাও।‘ সুন্দরবন অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম বেছে নিয়ে সেখানে কাজের ভার পড়ল ওর উপর। বড় কঠিন কাজ। বিধুশেখর কাজে লেগে পড়লো।

    মনোরঞ্জনদা অদ্ভুত মানুষ, অক্লান্ত পরিশ্রম করেন পার্টির জন্য। হাটে-মাঠে-গঞ্জে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। কখনো কৃ্ষকের চালা ঘরে মাটির দাওয়ায় মাদুর পেতে রাত কাটান, কখনো রেলওয়ে স্টেশনে। যুবকদের সঙ্গে মেলামেশা করেন, বন্ধুত্ব করেন ও তাদের দলের কাজে টেনে আনেন। বিধুশেখর মনোরঞ্জনদার সঙ্গে মার্ক্সীয় তত্ত্ব, দর্শণ, কমিউনিজম, সাম্যবাদ, পার্টি, পার্টির আদর্শ ও লক্ষ্য ইত্যাদি নিয়ে দিনের পর দিন আলোচনা করতো। মনোরঞ্জনদার পড়াশুনা আছে, তবে অমিয়বাবুর মত অত গভীরতা বা পান্ডিত্য নেই। উনি কমিউনিজমে,সাম্যবাদে, শ্রেণী-বৈষম্য দূরীকরণে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন কিন্তু বিভিন্ন তত্ত্ব ও মতবাদের স্ববিরোধী মূল্যায়নে কিছুটা বিভ্রান্ত। পার্টির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে ওঁর মনে কোনো দ্বিধা নেই তবে কোন পথ অনুসরণ করে সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে তা নিয়ে ওঁর মনে অনেক প্রশ্ন আছে। গণতন্ত্রের পরিকাঠামো মেনে নিয়ে নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রতিনিধির মাধ্যমে সেই লক্ষ্যে আদৌ পৌঁছনো সম্ভব কিনা তা নিয়ে ওঁর যথেস্ট সন্দেহ আছে। তবু উনি মনে প্রাণে পার্টির কাজ করে যাচ্ছেন। এক নিঃস্বার্থ নিবেদিত প্রাণ। ওঁকে যত দেখে ততই বিধুশেখর অবাক হয়ে যায়, পার্টিতে কি সবাই মনোরঞ্জনদার মত !

    দেখতে দেখতে তিন মাস হয়ে গেল। পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। ও ভালই করেছে তবে অধ্যাপকেরা যেমন আশা করেছিলেন তেমন হয় নি। এবার কি হবে? এরপর আরো পড়াশুনা করতে হলে কলকাতায় যেতে হবে; সেটা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং বিধিবৎ পরীক্ষা দিয়ে মানপত্র পেয়ে পড়াশুনার এই শেষ। এটাই মেনে নিলো।

    গ্রামের কাজ তেমনি চলছে। তবে পরিশ্রম বড় বেশী ; এত পরিশ্রম ও আগে কখনো করেনি। মাঝে মাঝে তাই শরীরটা বিদ্রোহ করে। মনোরঞ্জনদার মাধ্যমে পার্টির প্রধান কার্য্যালয় থেকে প্রস্তাব এল বিধুশেখরের কাছে, পূর্ণ সদস্য হয়ে পার্টির জন্য ‘ফুলটাইম ক্যাডার’ হয়ে কাজ করার। তার পরিবর্তে পার্টি ওকে মাসিক পারিশ্রমিক বা ‘ভাতা’ দেবে এবং ওর ভালমন্দের সকল দায়িত্ব নেবে। এতদিন ও পার্টির হয়ে যে সব কাজ করছিল তা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে, ভালোবেসে, নিজের ইচ্ছামত। মনোরঞ্জনদার প্রস্তাব গ্রহণ করলে ওর আর স্বাধীনতা থাকবে না। অনেক নিয়ম কানুন মেনে একটা বাঁধাধরা পরিকাঠামোর মধ্যে কাজ করতে হবে। ও ভাবতে থাকলো।

    ঠিক সেই সময়ে ওর পুরানো স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয় ওকে ডেকে পাঠালেন। ও স্নাতক হয়েছে শুনে প্রধান শিক্ষক মহাশয় ওকে অভিনন্দন জানালেন। বললেন, ওঁর স্কুলে ভাল ইংরেজী শিক্ষকের বিশেষ প্রয়োজন। উনি বিধুশেখরকে স্কুলে শিক্ষকতার পদে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানলেন।

    বিধুশেখর মনস্থির করতে পারছে না। এতদিন পার্টির কাজ করে ও মনোরঞ্জনদার সঙ্গে ঘনিস্টভাবে আলাপ করে পার্টির কার্যকলাপ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ইত্যাদি সম্মন্ধে ওর একটা মোটামুটি ধারণা জন্মেছিল। নেতাদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা না বললেও তাদের নিজেদের মধ্যে আদর্শের বিরোধ ও মতানৈক্যের কথা ওর জানা ছিল। ওর নিজের মধ্যেও অনেক প্রশ্ন জমা হচ্ছিল যার সন্তোষজনক উত্তর ও পচ্ছিলো না। তাছাড়া সক্রিয় রাজনীতিতে কোনোদিনই ওর আগ্রহ ছিল না। ওটা ওর মানসিকতায় নেই।

    অনেক চিন্তা ভাবনা করে ও শেষ পর্য্যন্ত শিক্ষকতার পদই নিল। মনোরঞ্জনদাকে ওর সিদ্ধান্ত জানাতে উনি বললেন, ‘তুমি যা ঠিক করেছ তাই কর। তোমায় আমি বাধা দেব না। তবে যোগাযোগ রেখো। শিক্ষকতা করেও পার্টির কাজ করা যায়।’

    প্রায় বছর ঘুরে গেল বিধুশেখর শিক্ষকতা করছে। কিন্তু এই গ্রামের ছোট স্কুলের শিক্ষকতায় ওর মন বসছিল না। ছোটবেলার সেই গন্ডি থেকে ভেঙ্গে বেরোবার ইচ্ছাটা ওকে উতলা করে তুলছিলো। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে ছোট ছোট পরিবারের জন্ম হলেও অবিভক্ত ভিটেবাড়ী ও জমিজমা নিয়ে মনোমালিন্য নিত্যই লেগে ছিল। ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে বাকবিতন্ডা ও গ্রামীন মানসিকতা ওকে পীড়া দিচ্ছিল। স্কুলেও এ থেকে রেহাই ছিল না। গ্রামের স্কুল, সুতরাং আসে পাশের গ্রামের দলাদলি, স্বার্থপরতা, পরচর্চা, রাজনীতি উপচে পড়ত স্কুলের আঙ্গিনায়। বিধুশেখর অবসর সময় কাটাতো ইংরেজী-বাংলা খবরের কাগজে চাকুরির বিজ্ঞাপনের পাতায়। বই পড়ার সময় কমলো, সে স্থান অধিকার করে নিল চাকুরির আবেদন পত্র। নির্বিচারে আবেদন পত্র পাঠাতে লাগলো সর্বত্র। সব দরজায় কড়া নেড়ে যাও, একদিন না একদিন একটা দরজা খুলবেই। এদিকে মা অন্নপূর্ন্নাদেবী ব্যাস্ত হয়ে পড়েছেন ছেলের বিয়ের জন্য। ছেলের পড়াশুনা শেষ হয়েছে, কাজ করে নিয়মিত টাকা আনছে। সংসারের অভাব ঘুচেছে। এবার ওর একটু স্থিতু হওয়া দরকার। সময় পেলেই অন্নপূর্নাদেবী ছেলের কাছে বিয়ের কথা তোলেন। বিধুশেখর একদিন মায়ের কথায় রাজী হলো, বলল, ‘তুমিই তাহলে মেয়ে দেখ।’ মায়ের উপর বিধুশেখরের অগাধ বিশ্বাস। মা মানুষ চেনেন, মা যাকে নিয়ে আসবে সে এ বাড়ীতে ঠিকই মানিয়ে নেবে। মেয়ে অন্নপুর্ণাদেবীর দেখাই ছিল। মালাকে অন্নপূর্ণাদেবী ছোট বয়স থেকেই দেখছেন। হাসিখুশী শান্তশিস্ট। মাধ্যমিক শেষ করে আর পড়াশুনার সুযোগ হয় নি। বিয়ে হয়ে গেল। মালাকে পেয়ে বিধুশেখর হতাশ হয় নি। ওর স্বভাবটা এমনই যে ওকে দেখলেই ভালবাসতে ইচ্ছে করে। অল্পতেই খুশী, বেশী কিছু চাহিদা নেই। মালা ভাবে শিবের মত স্বামী পেয়েছি, আর কি চাই।

    বিয়ের পর বিধুশেখর যে দরজা খোলার জন্য আশা করে বসে ছিল তেমন একটা দরজা হঠাৎ খুলে গেল। ম্যাকমিলান কোম্পানি পৃথিবী বিখ্যাত প্রকাশক, ইংরেজ কোম্পানি, প্রধানত ইংরেজী ভাষার বই প্রকাশ করে। লন্ডনে হেড অফিস। ভারতবর্ষের প্রধান দফতর কলকাতায়। বড় সাহেব টমাস টেলর বিধুশেখরের সঙ্গে কথা বলে খুশী হলেন। বিধুশেখরের মনোরম আচরণ, ইংরেজী বলা, লেখা, বিভিন্ন বিষয় ও বই-র উপর জ্ঞানের ব্যাপ্তি টেলর সাহেবকে প্রভাবিত করল। টেলর সাহেব বিধুশখরকে কাজে বহাল করলেন। বিধুশেখর মনে মনে জগদীশবাবু ও অমিয়বাবুকে প্রনাম জানালো। জীবিকা অর্জনের নতুন সু্যোগ পেয়ে ও খুশী হল কিন্তু তার থেকেও বেশি খুশী হল একথা জেনে যে বই নিয়ে ওকে কাজ করতে হবে, ও সারাক্ষণ বই পরিবৃত হয়ে থাকবে যা ও কোনোদিন কল্পনা করেনি। নিজেকে ও ভাগ্যবান মনে করল। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটে গেল যে ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। বিশ্বাস হচ্ছিল না মালারও। মা-বাবা তো আকাশ থেকে পড়লেন।

    স্কুলের কাজে ইস্তফা দিয়ে বিধুশেখর কলকাতায় একা এসে এক মেসবাড়ীতে আশ্রয় নিল। একদিন মনোরঞ্জনদার সঙ্গে দেখা হলো। বললেন ‘এবার তুমি সত্যিই আমাদের ছেড়ে দিলে।’ গলায় হতাশার সুর। ব্যাঙ্গ করে বললেন, ‘এখন তুমি একেবারে ‘‘পেতি বুর্জোয়া’’ হয়ে গেলে।’ কথাটা ওর মর্মে লেগেছিলো। ওঁর এই উক্তিটা বিধুশেখরকে অনেক ভাবিয়েছে, আজও পর্যন্ত বুঝতে পারেনি যে এটা উপহাস না ভর্তসনা।

    শিয়ালদা-র একটা ছোট মেসে আশ্রয় পেল বিধুশেখর। মেসবাড়ীটা দুতলা। নীচে দুটো ঘর, উপরে দুটো। সিঁড়ির উপর আরো একটা ছোট ঘর আছে। কোনরকমে একটা তক্তাপোষ পাতা যায়। একটা ছোট টেবিল আছে কিন্তু কোনো চেয়ার রাখার জায়গা নেই। টেবিলটা তক্তাপোষের এক প্রান্তে। সেই প্রান্তে বসে ও টেবিলটা ব্যবহার করত,লেখালেখি পড়াশুনা করত। ঘরটা পশ্চিমমুখী, পশ্চিমদিকে একটিমাত্র জানালা। সারা দুপুর-বিকেল রৌদ্র এসে জ্বলন্ত উনুনে চাটুর মত উত্তপ্ত করে রাখত বিছানা। সূর্য অস্ত যাওয়ার পরও সে ঘরে বসা যেত না। তক্তাপোষের নীচে একটা চামড়ার বাক্সে ওর ব্যাক্তিগত টুকিটাকি। দেয়ালে একটা কাঠের পাটা পেরেক দিয়ে আঁটা, তাতে কয়েকটা হুকে কাপড় ঝোলানোর ব্যবস্থা। নীচের দুটো ঘরে দুটো করে খাট পাতা। উপরের ঘর দুটোতে কোনো খাট নেই; এক এক ঘরে তিনজন করে থাকতেন, মেঝেতে বিছানা পেতে শুতেন। মেসবাসীদের মধ্যে বিধুশখর সর্বকনিস্ঠ, অন্য সকলে ওর থেকে কুড়ি থেকে তিরিশ বছরের বড়। শনিবার রাত্রি থেকে সোমবার রাত্রি পর্যন্ত রান্নার ঠাকুর ছাড়া সারা মেসবাড়ী শূণ্য থাকে। সবাই চলে যায় নিজের নিজের গ্রামের বাড়ীতে। সবাই যেহেতু বিধুশেখরের বয়োজ্যেস্ঠ, ওর কাছে তাই সকলেই দাদা বা কাকা। সবাই সরকারি বা সদাগরী অফিসের কর্মী।

    বিধুশেখর এই আবহাওয়ায় নিজেকে মানিয়ে নিল। ও সারাদিন অফিসে কাজ করত, সন্ধ্যায় মেসে এসে স্নান-খাওয়া সেরে একটা বই নিয়ে বসত বা মৃদু স্বরে রেডিও চালিয়ে গান শুনত বা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসত। নীচে কাকা-দাদারা তাসের আড্ডায় ডুবে যেত। এ এক ঘনিষ্ঠ পরিবার। এমনি বৈচিত্র্যহীন জীবন চলছিল।

    একদিন যোগেন কাকা এসে একটা খবর দিলেন। যোগেন কাকা সরকারী কর্মী, রাইটার্স বিল্ডিংসে কাজ করতেন। বললেন, ‘সল্টলেকে জমি বন্টন হবে। কলকাতায় যাদের বাড়ী নেই তারাই শুধু আবেদন করতে পারে। তোমার ইচ্ছা আছে নাকি?’

    বিধান রায়ের স্বপ্ন, বিধান রায়ের উদ্যোগ। কলকাতার উত্তরে বিশাল জলাজমি, সেই জমিতে নতুন শহরের পরিকল্পনা। পৃথিবীর এক দেশ সমুদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে সমুদ্র থেকে জমি ছিনিয়ে নিয়ে তাদের দেশকে বাড়িয়েছে। সে দেশের নাম নেদারল্যান্ড বা হল্যান্ড। সে দেশের ইঞ্জিনীয়াররা জলাজমি বন্দী করে সেই জমির উপর বসতি তৈরি করতে অভিজ্ঞ। এদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। ডাচ ইঞ্জিনীয়াররা এলেন ভারতীয় কুশলী, পেশাদারী কারিগর ও ইঞ্জিনীয়ারদের সঙ্গে কাজ করতে। ধীরে ধীরে জলাজমি ভর্তি হয়ে বাসযোগ্য জমি হয়ে উঠল। বিংশশতাব্দীর চিন্তাধারায় আধুনিক নগর পরিকল্পনা প্রযুক্তির ফসল এই শহর। খোলা নর্দমা থাকবে না, অন্ধকার সরু গলি থাকবে না, গায়ে গায়ে লাগানো ঘিঞ্জি বাড়ীর জঙ্গল থাকবে না। প্রত্যেক বাড়ীর সামনে থাকবে প্রশস্ত রাস্তা, পাড়ায় পাড়ায় থাকবে পার্ক, ছেলে মেয়েদের খেলার মাঠ। স্কুল, কলেজ, বাজার, সরকারি-বেসরকারি অফিস, সিনেমা, থিয়েটার, বিনোদন কেন্দ্র। একটা সম্পূর্ণ শহর। এতো মানুষের স্বপ্ন। তবে একি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যে থাকবে? বিধান রায়ের ইচ্ছা ছিল মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী এখানে বসতি করে স্বচ্ছন্দে থাকে। কলকাতার উপনগরী। বিধান রায় তাঁর স্বপ্নের শহর দেখে যেতে পারেন নি। প্রযুক্তি শেষ হওয়ার আগেই চলে গেলেন। ষাটের দশকে সুরু হল জমি বন্টনের প্রক্রিয়া।

    জীবনে কোন সুযোগ কি রূপ নিয়ে আসে তা কেউ জানে না। বিধুশেখর তাই যে সুযোগই আসুক কেন তাকে দুহাতে আলিঙ্গন করে। জমি পাবে কিনা জানে না, পেলেও সেখানে কখনো বাড়ী করবার সামর্থ্য হবে কিনা তাও জানে না। সে পরের কথা। যখন পাবে তখন চিন্তা করা যাবে। ও আবেদন পত্রে সই করে দিলো।

    যে রাত্রে মাতলার চরের ভিটেবাড়ী মাতলা প্রায় গ্রাস করেছিলো তার পরের দিন সকালেই কিনু সিদ্ধান্ত নিলো যে এখানে আর থাকা যাবে না। মাতলার চরের প্রথম বাসিন্দা কিনুর পূর্ব পুরুষ। সরকারবাবুদের পূর্ব পুরুষ চন্দ্রশেখর সরকার জমিজমা বাড়ীঘর দিয়ে ওদের বসিয়ে ছিলেন এই চরে। কিনু ভাবল ওরা যদি গ্রাম ছেড়ে চলেই যায় তবে সরকারবাবুদের একবার নিশ্চয়ই জানানো প্রয়োজন। কিনু সরকারবাবুদের বাড়ী গিয়ে সকলের দেখা করে ওর দুর্দশার কথা জানিয়ে এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বিদায় নিলো। দেখা হলো বিধুশেখরের সঙ্গেও। যদিও বিধুশেখর ওর সহপাঠী তবুও বিধুশেখরকে কিনু দাদাবাবু বলে ডাকে। বলল, ‘দাদাবাবু, আমার ঘরবাড়ী সব মাতলা নিয়ে নেছে। আমরা গোবিন্দপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছি।’ বিধুশেখরের কিছু করার নেই। সমবেদনা জানিয়ে বলল, ‘আমি কি কিছু করতে পারি!’ মনে মনে বলল --- তোমাকে আর কি বলব। আমিও তো এই গন্ডি ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছি। তবে অন্য কারণে। কিনু জানালো, ওর কিছু দরকার নেই। কিনু কারো কাছ থেকেই কিছু চায় না। সারা পৃথিবীর ওপর রাগ। ও তো কোনোদিন কারো কোনো ক্ষতি করেনি। তবে ওর কেন এমন হল? নিয়তি? ভাগ্য?

    যতটুকু জমিজমা তখনো ছিল সে সব বিক্রি করে দিয়ে বৃদ্ধ বাবা ভানু আর ভানুর মাকে সঙ্গে করে পোঁটলাপুঁটলী নিয়ে কিনু বেরিয়ে পড়ল।

    একটা সরু খাল দুটো বসতিকে আলাদা করে রেখেছে। এক পারে সদ্য গড়ে উঠা নতুন শহর সল্টলেক, অন্য পারে কেস্টপুর, পুরাণো ছোট ছোট বাড়ীর পাশাপাশি চকচকে নতুন বাড়ী উঠছে। নতুন শহর সুপরিকল্পিত, অন্য শহর অপরিকল্পিত, সরু সরু রাস্তার ধারে গায়ে গায়ে বাড়ী, খোলা নর্দমা। বৃষ্টি বেশি হলে নীচু জমির রাস্তা ডুবে যায় নর্দমার উপচে পড়া জলে। দুটো শহর যুক্ত করে রেখেছে কয়েকটা পায়ে-চলা সেতু। সপরিবারে কিনু এসে উঠল এই কেস্টপুরে। একটা বড় বাড়ীতে একটা ঘর আর এক চিলতে বারান্দা ভাড়া নিয়ে কিনু থাকলো বাবা, স্ত্রী পুত্র নিয়ে। এই বাড়ীর ছটা ঘরে সর্ব সাকুল্যে চব্বিশ জন মানুষ থাকে। প্রায় সকলে রিক্সাচালক, ট্যাক্সি ড্রাইভার, দিনমজুর বা ঠিকে ঝি। সারা বাড়ীতে মাত্র দুটি শৌচালয়। সকালে লাইন পড়ে যায় শৌচালয়ের দরজার সামনে। কিনু একটা ভাড়া রিক্সা নিয়ে চালায়। ভানুরমা ভানুকে বাবার কাছে রেখে পাড়ার অবস্থাপন্ন বাড়ীতে কাজ করতে যায়। কিনু আয়ের টাকা থেকে মালিককে ভাড়া দেওয়ার পর যা থাকে তা দিয়ে সংসার চলে না। ভানুর মায়ের রোজগার থেকেও নিতে হয়। কিনু প্রতিদিন সেতু পেরিয়ে সল্টলেকে গিয়ে রিক্সা চালায়। এখানে সওয়ারী পাওয়া যায় বেশী এবং তারা দক্ষিনা দেয়ও বেশী। একটা চৌরাস্তার মোড়ে অনেক রিক্সা দাঁড়িয়ে থাকে। কিনু ওর রিক্সা নিয়ে এখানেই দাঁড়ায়। এখানে যাত্রী পাওয়া যায় প্রায় সবসময়। এমনি করেই কিনুর জীবন কাটছিল। বাবার কি একটা অসুখ করল। ভালভাবে বড় ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাতে পারল না। বাবা স্বর্গে গেল একদিন। ভানু এখন স্কুলে পড়ছে। কিনুর বয়স বাড়ছে। বহুদিন সাইকেল রিক্সা চালিয়ে ওর শরীরটা বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে শ্বাস কস্ট হয়। এখন অনেক ইলেকট্রিক রিক্সা উঠেছে। এগুলো চালাতে কস্ট অনেক কম। ওর আশা ও একটা ওইরকম ব্যাটারী দেওয়া ইলেকট্রিক রিক্সা কেনে। একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছে। ওর স্বপ্ন ভানু কলেজ থেকে পাস করে বাবুদের মত একটা অফিসে চাকুরি করে। ও স্বপ্ন দেখে, এই গন্ডি ভেঙ্গে বেরোতেই হবে।

    বিধুশেখরকে অফিসের কাজে ভারতবর্ষের বহু শহরে ঘুরে বেড়াতে হত। কোনো কোনো সপ্তাহশেষে দেশের বাড়ীতেও যাওয়া হত না। নিষ্ঠা,সততা ও কর্মপটুত্বের জন্য টেলর সাহেব ওকে যথেস্ট স্নেহ করতেন। ওর দ্রুত পদোন্নতি হতে থাকলো এবং সেইসঙ্গে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যও এলো। দুবছর পরে ও মেসবাড়ী ছেড়ে বেলেঘাটা অঞ্চলে একটা বাড়ী ভাড়া নিয়ে মা অন্নপূর্ণা, মালা ও এক বছরের শিশু রাজশেখরকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলো। বাবা গত হয়েছেন কিছুকাল আগে।

    এমনই কাটছিলো দিন। হঠাৎ একদিন সরকারি খামে একটা চিঠি এলো। বিধুশেখর সল্টলেকে জমি পেয়েছে। অন্নপূর্ণাদেবী ও মালা উচ্ছ্বসিত। ও অবাক হয়ে ভাবতে থাকলো, ভাগ্য ওকে কোথায় নিয়ে চলেছে।

    এখনি বাড়ী করার সামর্থ্য নেই ওর। সংসার বেড়েছে। কন্যা বিদিশা জন্ম নিয়েছে। বিধুশেখর তিল তিল করে সঞ্চয় করতে লাগল। এতদিনের লালিত সখগুলো আস্তে আস্তে কমাতে শুরু করল। বই কেনা রেকর্ড কেনা বিরল হয়ে উঠল। গানের আসরে যাওয়া, থিয়েটার সিনেমা দেখা, ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ায় রাস টানতে হল। ওর ঐ স্বেচ্ছাকৃ্ত কৃচ্ছসাধন দেখে মালা চিন্তিত হয়ে পড়ল, বিধুশেখর অসুস্থ হয়ে পড়বে না তো ! যখন নিজস্ব সঞ্চয় যথেস্ট হল তখন ও জীবন বীমা এবং ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে বাড়ীর কাজ শুরু করল। জমি প্রাপ্তির সম্মতিপত্রে সই করার পর সল্টলেকে বাড়ী তৈরী করে উঠে আসতে প্রায় দশ বছর লেগে গেল। ওরা এখন সল্টলেকেরই বাসিন্দা। রাজশেখর ও বিদিশা এখানের স্কুলেই পড়াশুনা করছে।

    কিনুর স্বাস্থ্য ক্রমশঃই ভেঙ্গে পড়ছে। বেশিক্ষণ রিক্সা চালাতে পারে না আর। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেদিন রবিবার বিধুশেখর বাজারের থলিটা নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। দূর থেকে একটা রিক্সা আসতে দেখে রিক্সা থামিয়ে বলল ‘ বাজারে যাবে?’ ও যখন রিক্সায় চেপে বসেছে তখন রিক্সাচালক রিক্সা থেকে নেমে যাত্রীর মুখের দিকে অনিমেষে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পরে অবাক স্বরে বলল, ‘দাদাবাবু, তুমি!’ অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর যাত্রী অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘কিনু, তুমি এখানে!’ মাতলার চরে ওদের শেষ দেখার পর প্রায় আঠারো বছর কেটে গেছে। বিধুশেখরের চেহারায় জৌলুস এসেছে,মেদ লেগেছে মুখে, মধ্যপ্রদেশে। পুস্ট, সুখী মধ্যবিত্তের মত। কিনুর শরীরে রুগ্নতার ছাপ, সেই বলিস্ট,সুঠাম চেহারা নেই আর। মাথায় কালোর চেয়ে সাদা চুল বেশি; মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কিঞ্চিত ন্যুব্জ। সত্যিই চিনতে কস্ট হয়। যেতে যেতে কথা হল অনেক --- পুরাণ দিনের কথা, আজকের দিনের কথা। বাজার থেকে ওই রিক্সাতেই ফিরল বিধুশেখর। বলল, ‘এসো, ঘরে এসো। আমার ছেলে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করে যাও।’ বিদিশা ও রাজশেখরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মালা ওকে জল মিস্টি না খাইয়ে ছাড়ল না, বলল, ‘তোমার ছেলেকে নিয়ে এসো একদিন।’ কিনুর খুব ভাল লাগছিল --- কতদিন পরে গ্রামের লোকের সাথে দেখা। বিধুশেখরেরও।

    ভানু এখন মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। কিন্তু বাবার অসুস্থততা ওকে চিন্তিত করে রাখে --- পড়াশুনায় মন বসে না। কিনু আজকাল আর সব দিন কাজ করতে পারে না। কিন্তু কাজ না করলে সংসার চলবে না। শুধু ভানুর মায়ের রোজগারই যথেস্ট নয়। ভানুর মা উদয়াস্ত কাজ করে, তবুও একুল-ওকুল পাচ্ছে না। ভানুর এসব দেখতে আর ভাল লাগছে না। মাঝে মাঝে স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাবার রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সংসারের সুরাহা হয় একটু। ভানু এমন অবস্থাতেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল। ফল ভাল হয় নি, তবে পাস করেছে কোনোরকমে। পরীক্ষার পর ভানু বাবাকে আর রিক্সা চালাতে দেয় না। ভানু নিজেই চালায়। ওর আর পড়াশুনা হবে না।। সংসারের দায়িত্ব এখন ওর উপর। সেটাই মেনে নিয়েছে ও। মেনে নিয়েছে কিনুও। ওর স্বপ্নের সমাধি এখানেই।

    কাল থেকে বাবা বলছিল বুকে একটু একটু যন্ত্রণা হচ্ছে। সন্ধ্যার দিকে যন্ত্রণা বেড়ে উঠল। ভানু আর দেরী না করে বাবাকে নিয়ে সেতু পার হয়ে রিক্সাতে তুলে সোজা সল্টলেকের সরকারী হাসপাতালে নিয়ে এল। ওরা ভর্তি করে নিল। ভানু নীচে সারারাত বসে থাকল, চোখে ঘুম এলোনা। ভোর রাত্রে হাসপাতালের একজন এসে জানাল ওর বাবা আর নেই। অনেক চেস্টা করেও বাঁচানো গেল না। পরে অবশ্য ভানু জেনেছিল, হৃদরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেদিন আসেন নি, তাছাড়া জরুরী অবস্থার হৃদরোদাক্রান্ত রোগীর আধুনিক চিকিৎসা ব্যাবস্থা এখানে নেই। কিনুর কোনো স্বপ্নই বাস্তবায়িত হয়নি। এই গন্ডি ভেঙ্গে বহু চেস্টা করেও কিনু বেরোতে পারল না। এই গন্ডিতেই দেহ রাখল সে।

    সৎকার সেরে খবরটা দিতে ভানু বিধুশেখরের বাড়ীতে এলো। খবর শুনে বিধুশেখরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল, ‘ভাল করে শ্রাদ্ধ শান্তি কর।’ আসার সময় বিদিশা ছলছল চোখে বলল, ‘ভানুদা, কিছু দরকার হলে বোলো। আবার আসবে কিন্তু।’

    সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে ভানু ওরই সমবয়সি ছেলেদের আড্ডায় যায়। এখানে যারা আসে তাদের মধ্যে প্রায় কারোরই বাঁধাধরা কোনো কাজ নেই। আক্ষরিক অর্থে এরা বেকার কিন্তু এদের সকলেরই কিছু না কিছু আয় আছে। এই আড্ডায় আরও একজন মাঝে মাঝে আসে। তার সঙ্গে এদের কারো কোনো মিল নেই। এর পোষাক পরিচ্ছদ আলাদা, আচার ব্যবহার আলাদা। গায়ে কড়া ইস্ত্রিকরা সার্ট, ঝকঝকে ট্রাউজার, কোমরে দামী চামড়ার বেল্ট, পায়ে চকচকে জুতো। একই পোষাকে তাকে দুবার কখনো দেখেনি ভানু। প্রতিবারই ভিন্ন ভিন্ন পোষাকে দেখা দেয়। বয়স প্রায় সাতাশ আঠাশ। মুখে একটা সরলতার ভাব আছে। সকলকে খুব সহজে বন্ধু করে নিতে পারে। কথা বলে ভাল, লোকে ওর কথা বিশ্বাস করে। নাম সুজয় বোস। সুজয় ভানুর সঙ্গে আলাপ করল। ‘তোমাকে তো আগে এখানে কখনো দেখিনি। কোথায় থাকো, কি করো ?’ ভানু বলল, ও কোথায় থাকে, কি করে। সুজয় বলল, ‘রিক্সা চালিয়ে কি হবে? কত টাকা পাও? ইচ্ছা করলে তুমি আমার সঙ্গে কাজ করতে পার। রোজগার বেশী হবে। ভেবে দেখ।’ আড্ডার অন্য ছেলেরা একটু অবাক হয়ে গেল। সুজয় তো কাউকে কখনো প্রথম আলাপেই কাজ দেয় না। কত ছেলে ওর সঙ্গে কাজ করার জন্য হা-পিত্যেস করে বসে আছে।

    সুজয় এ অঞ্চলে খুব জনপ্রিয়। বাড়ী বাড়ী গিয়ে সকলের খোঁজ খবর নেয় --- আপদে বিপদে সাহায্য করে। কার বাড়ীর মৃতদেহ সৎকার করতে হবে, সুজয় দলবল নিয়ে হাজির। কার ছেলেকে হাজার চেস্টা করেও তার মনোনীত স্কুলে ভর্তি করাতে পারছে না --- সুজয়কে ধরো। ইডেনে টেস্ট খেলার টিকিট পাচ্ছ না, সুজয়কে বলো। সুজয়ের সঙ্গে সকলের জানাশোনা --- স্থানীয় এম এল এ, এম পি, মিউনিসিপ্যালিটির মেয়র, পুলিশের বড়কর্তা ছোটকর্তা, দু-একজন মন্ত্রীমহোদয় --- সকলের সঙ্গেই ওর জানাশোনা, প্রায় সকলের জন্যই কখনো না কখনো কিছু না কিছু কাজ করে দিয়েছে ও।

    সুজয় অন্য সব বাড়ীর মত বিধুশেখরের বাড়ীতে গিয়েছে দু এক বার। বিদিশাকে দেখে কথা বলে ওকে ওর ভাল লাগে। তারপর নিয়মিত সুজয় ওদের বাড়ী যেতে শুরু করে যে কোনো ছল ছুঁতোয়। মালাও ছেলেটিকে পছন্দ করে। ক্রমে ক্রমে বিদিশা ও সুজয়ের বন্ধুত্ব হয়, একসঙ্গে বেড়াতে যায়, কখনো কখনো বিদিশা রাত করে বাড়ী ফেরে। বিধুশেখর মেয়েকে বড় স্নেহ করে। বিদিশার বাস্তবানুগ বুদ্ধি, সততা, মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের পরিচয় পেয়ে বিধুশেখর ওকে মনে মনে শ্রদ্ধা করে। ও তাই বিদিশাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। ওর কোনো কাজে কোনো বাধা দেয় নি। ইদানীং সুজয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশাতেও দেয় নি। মালা প্রথম প্রথম একটু আপত্তি করে, পরে হাল ছেড়ে দেয়। বিদিশা সুজয়কে ভালবাসে, সুজয়ও বিদিশাকে।

    ভানু একটু খোঁজ খবর নিয়ে দুদিন ভেবে সুজয়কে জানালো ও রাজী আছে সুজয়ের কাজ নিতে। সুজয়ের ডানহাত সান্টু। সুজয় নিজে কোনো প্রযুক্তি সোজাসুজি পরিচালনা করে না। ও নির্দেশ দেয় সান্টুকে; সান্টুই সেই নির্দেশমত কাজ করে। ভানুর প্রথম কাজ পড়লো দলের আরেকজনকে সাহায্য করা। এক লরী বালি ঠালতে হবে সল্টলেকের এক জমির সামনে। কেউ কোথাও বাড়ী করার খবর আসলে সান্টু জমির মালিকের সঙ্গে দেখা করে, বলে ওরা বাড়ীর জন্য ইঁট, বালি লোহা ইত্যাদি যাবতীয় সামগ্রী সরবরাহ করতে চায়। মালিক আপত্তি করলে তিনি অসুবিধায় পড়েন, বাড়ী তৈরি করতে অযথা দেরী হয়ে যায়। কিছুদিন এই কাজ করার পর ভানুকে অন্য কাজ দেওয়া হল। সান্টু একটা সাদা মোটা খাম দিয়ে বলল সেটা এক ঠিকানায় দিয়ে আসতে। ভানু এমনি করে এই রকম খাম কাছকাছি সল্টলেক, নিউ টাউন, দমদম ইত্যাদি জায়গার ঠিকানায় পৌঁছিয়ে দিতে থাকল। ও যত পটু এবং বিশস্ত হল তত ওর কাছে আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার পড়ল। আম বা ফলের ঝুড়ি, ছোট ছোট চাল বা ময়দার বস্তা, বই ইত্যাদি নিয়ে যেত দূরের শহরে --- দায়মন্ডহারবার, বনগাঁ বর্ধমান, আসানসোল ও আরো দূর ঠিকানায়। প্রতিবার নির্দিস্ট জিনিষ গন্তব্য স্থানে পৌঁছে দেওয়ার পর সান্টু এসে ওর হাতে টাকাভর্তি একটা খাম গুঁজে দিত। অল্পদিনের মধ্যেই ভানুর অনেক টাকা জমে গেল। ভানু সাদাসিধে সরল ছেলে। রিক্সা চালিয়ে সংসার চালাত। কিছু তলিয়ে বোঝার চেস্টা করেনি কখনো। প্রায় যন্ত্রচালিতের মত কাজ করে যাচ্ছিল। প্রশ্ন এসেছে মনে কিন্তু জিগ্যেস করতে সাহস হয় নি। ঘোর ভাঙ্গলে সন্দেহ হল এই সামান্য কাজের জন্য ওরা যখন অত টাকা দিচ্ছে তখন নিশ্চয় কোনো নিষিদ্ধ বেআইনী কাজ ওকে দিয়ে ওরা করিয়ে নিচ্ছে। ও শরীর খারাপের অজুহাতে দুদিন বাড়ীতে শুয়ে থাকল।

    অনেকদিন ওবাড়ীতে যাওয়া হয়নি। রিক্সা নিয়ে ভানু বিধুশখরের বাড়ীর দিকে গেল। বাড়ীর সামনে গিয়ে দেখে বিদিশা আর সুজন দুজন হাত ধরাধরি বেরোচ্ছে। বিদিশা ওকে দেখে বলল, ‘ওঃ, তুমি এসেছ ভানুদা? আমরা এখন তো একটু বাইরে বেরুচ্ছি। তুমি কাল এসো। ভিতরে বাবা-মা আছেন। দেখা করো।’ সুজয় ভানুকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠল। ওর মুখ থেকে সব রক্ত যেন কোথায় উধাও হল; শুস্ক, ফ্যাকাসে। বিদিশা এসব কিছুই লক্ষ্য করেনি। দুজনে গিয়ে একটা অপেক্ষারত ট্যাক্সিতে উঠল।

    ভানু অবাক। আর ভিতরে গেল না। হতভম্ভ, বিমূড়; কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে রিক্সায় গিয়ে উঠল। ও জানতো না যে সুজয় বিদিশাকে চেনে আর ওদের মধ্যে এমন একটা ঘনিস্ট সম্পর্ক আছে। ওর মাথায় রক্ত উঠে গেল। বিদিশাদিদিমণি কি জানে সুজয়ের আসল পরিচয় ? দিদিমণিকে জানাতে হবে সুজয়ের স্বরূপ। দিদিমণিকে সাবধান করতেই হবে। দিদিমণিকে বাঁচাতেই হবে এই নরক থেকে !

    পরেরদিন আবার এল ভানু। বিদিশাকে ও সব কথা বলল। ওর অভিকজ্ঞতার কথা, সাদা খাম, ফলের ঝুড়ি, ময়দার বস্তা, সব কিছুর বিস্তারিত বর্ণনা। বিদিশার বুঝতে একমুহূর্ত দেরী হলনা ওগুলোর মধ্যে কি বস্তু আছে। ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল, মনে হল যেন উত্তর মেরুর সমস্ত বরফ জমা হয়েছে ওর দেহে।

    সেই সন্ধ্যায় সান্টু এল ভানুর সঙ্গে দেখা করতে। সান্টু ওকে শাসিয়ে গেল, ভানু যদি সুজয় ও ওদের কর্মকান্ডের কথা ঘূর্ণাক্ষরেও কাউকে বলে তাহলে ওর লাস ভাসবে কেস্টপুরের খালে। ভানুর মনে পড়ল ভোলাদার কথা। ভোলাদা খেলাধূলায় খুব ভাল ছিল। সাঁতার, ফুটবল, দৌড়, ইত্যাদিতে পারদর্শী। ভোলাদা ওরই সঙ্গে কাজ করত। ভোলাদাকে দেখেনি কয়েকদিন; হঠাৎ শোনা গেল ভোলাদা কেস্টপুর খালে ডুবে মরেছে। ভানু বুঝল এখানে আর থাকা যাবে না। এখানে থাকলে ও ভোলাদা হয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত নিল এই বিষাক্ত আবহাওয়া থেকে দূরে চলে যাবে। সেই দিনই গভীর রাত্রে ঘরে তালা দিয়ে মাকে নিয়ে ফিরে গেল নিজের জন্মভূমিতে ...মাতলার চরে।

    বিদিশা উদভ্রান্ত দিশাহারা হয়ে ছটফট করতে লাগল। সুজয়ের কাছে গিয়ে বলল ‘তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। চল কোথাও গিয়ে বসি’। সুজয় বিদিশাকে কখনও এমন অবস্থায় দেখেনি। বিদিশা সর্বদাই সাবলীল, সংযত, বিন্যস্ত। বিদিশাকে এ অবস্থায় দেখে সুজয় ত্র্যস্ত পায়ে এগিয়ে এল। বেশ ভয় পেয়েছে, বোঝা গেল। ওরা দুজনে একটা কফির দোকানে গিয়ে বসল। বিদিশা ওকে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে শুরু করল। ‘ তুমি কি ভানুকে চেনো? ও তোমার কি কাজ করে? তুমি ওকে জিনিষ পত্র দিয়ে কোথায় কোথায় পাঠাও? তোমার এই বিলাসী জীবন যাত্রার খরচ আসে কোথা থেকে ?’ সুজয় ওকে থামাতে পারছিল না। ও প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতে চেস্টা করল, মনে মনে বুঝল ভানু বিদিশাকে সব বলেছে। সুজয়ের উত্তরগুলো বিদিশার বিশ্বাস হল না। মৃদুভাষী বিদিশার স্বর ক্রমশঃ উচ্চগ্রামে পৌঁছল। পাল্লা দিয়ে সুজয়ও তারস্বরে কথা বলতে শুরু করল। দুজনের বচসা কদর্যরূপ ধারণ করল। রাগে, অপমানে, আশাভঙ্গের পীড়নে কম্পমান বিদিশা চেয়ার থেকে উঠে দ্রুত গতিতে বাড়ীর দিকে হাঁটতে শুরু করল। বাড়ী এসে সোজা নিজের ঘরে খিল দিয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। দুদিন দরজা খুলল না; মা বাবা কারও কথায় সাড়া দিল না। সুজয়কে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত বিদিশা। ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল অনেক। ওকে ছেড়ে থাকতে ওর প্রচন্ড কস্ট হবে কিন্তু এমন একটা সমাজ-বিনাশক,ভন্ড, কপট মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধার কথা ও কল্পনাই করতে পারছে না। ওর রুচি, শিক্ষা, নীতিবোধ, মানবিকতা ওর ভালবাসাকে হারিয়ে দিল। ও সুজয়ের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করে দিল।

    লন্ডনে ম্যাকমিলান কোম্পানির বড়কর্তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভারতবর্ষে ওঁরা আর ব্যবসা করবেন না। টেলর সাহেব খুব দুঃখের সঙ্গে সে খবর জানালেন। কলকাতার অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। তবে কর্মচারীদের ভবিষ‍্যতের কথা চিন্তা করে সকলকে যথাযত ক্ষতিপূরণ করবে কোম্পানি। বিধুশেখরের উচ্চপদ ও অনেক দিনের কাজ। সুতরাং বিদায় অভিনন্দন স্বরূপ ও মোটা অঙ্কের দক্ষিণা পেলো। তারসঙ্গে আছে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা। সংসারের খরচ একটু কমেছে। রাজশেখর ইঞ্জিনীয়ারিং পড়া শেষ করে বাঙ্গালোরে কাজ নিয়ে চলে গেছে। বিদিশা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী করছে। চাকুরি চলে গেলেও বিধুশেখর খুব একটা বিচলিত নয়। আর কোনো কাজ করার ইচ্ছা নেই। অবসরের জীবন ভোগ করবে। দুবছর ধরে বিধুশেখর ভারত ভ্রমণ করল, কখনো সপরিবারে, কখনো শুধু মালাকে নিয়ে, কখনো বা এক একা। স্বাছন্দ্যের নীড়ে আরাম কেদারায় বসে বই পড়ে ও গান শুনে আলস্যে দিন কাটাতে কাটাতে ওর মনে প্রশ্ন উঠল একসময়। মনে হল এমন করে জীবনের অন্তিমে পৌঁছানোর কোন অর্থ হয় না। এতকাল ধরে সমাজের কাছ থেকে অনেক নিয়েছে, এবার কিছু দেওয়া প্রয়োজন। জগদীশবাবু অমিয়বাবুর কথা মনে পড়ছে ... ‘‘ সমাজকে কিছু দাও। তুমি যদি দুটি আগ্রহী, উৎসাহী ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত, সৎ, নির্ভীক নাগরিক করে গড়ে তোলো, ‘মানুষ’ করে তোলো এবং তারা যদি আরো ক’টি ছেলেমেয়েকে সেই শিক্ষা দেয়, সৎ ও নির্ভীক নাগরিক করে তোলে, তাহলে ক্রমবর্ধমান হারে অদূর ভবিষ্যতে সারা সমাজ শিক্ষিত সৎ ‘মানুষে’ ভরে যাবে।’’ বিধুশেখর ভাবতে থাকে।
    ............

    অমিয়বাবু আমেরিকা থেকে ফিরে ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেস্টার পদ নিয়েছেন। জগদীশবাবু এক নামকরা সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছেন। বিদিশা বিশ্ববিদ্যালেয়ের পড়া শেষ করে কলকাতা ছেড়ে সিমলার এক কনভেন্ট স্কুলে কাজ নিয়ে চলে গেছে। মনোরঞ্জনদা এখন মাননীয় মন্ত্রীমহোদয়। সান্টু কারাবাস করছে। সুজয়ের বিরুদ্ধে বেআইনি মাদক দ্রব্য সরবরাহের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছিল কিন্তু সাক্ষী ও প্রমাণের অভাবে মামলা খারিজ হয়ে গেছে। ও এখন রাজনীতি করে। ভানু মাতলার চরে স্ত্রী পুত্র নিয়ে ঘর-সংসার করছে।

    সল্টলেকের আশেপাশে অনেক ছোট বড় বস্তি আছে। সেখানে পুরুষ-মহিলা-যুবক-শিশুরা গায়ে গা লাগিয়ে বাস করে টিনের চালদেওয়া মাটির বাড়ীতে। যাদের সেখানেও ঠাঁই হয়না তারা ফুটপাথে শুয়ে থাকে অথবা কয়েকটা বাঁশের খুঁটির উপর ত্রিপল ফেলে সংসার করে। বিধুশেখর ঘুরে বেড়ায় তাদের মাঝে। চুলে পাক ধরেছে, মুখে সাদা দাড়ি, পরনে আধ ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা থলি। থলিতে ছোটদের বই, খাতা, পেন্সিল, ছবি আঁকার রং তুলি, লজেন্স, চকোলেট আর কিছু টাকা। বস্তির মানুষের অভাবের শরিক হয়, ওর সামর্থ্য মত তাদের সাহায্য করে। ছোট ছেলেমেয়েরা ওর চারিপাশে এসে ভীড় করে; ও থলিতে হাত ঢোকায়। আর খুঁজে বেড়ায় আগ্রহী উৎসাহী বুদ্ধিমান ছেলেমেয়েদের যাদের ও শিক্ষা দেবে। যারা শিক্ষিত, সৎ, নির্ভীক নাগরিক হবে, ‘মানুষ’ হবে। তারা যদি আরো ক’টি ছেলেমেয়েকে সেই শিক্ষা দেয়, তাহলে ক্রমবর্ধমান হারে একদিন দেশে .........।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব এক | পর্ব দুই
  • গপ্পো | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৯২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন