এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  জাদু দুনিয়া

  • খাজুরাহো

    দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | জাদু দুনিয়া | ২৪ অক্টোবর ২০২৩ | ৮৬৫ বার পঠিত
  • কুরুক্ষেত্র খাজুরাহো এক্সপ্রেস। দিল্লি হজরত নিজামুদ্দিন থেকে পৌঁছতে চোদ্দ ঘণ্টা সময় লাগে। এক্সপ্রেস ট্রেনে এখন হয় বায়ো টয়লেট বা ইলেকট্রিক ফ্লাশ থাকে। কিন্তু এই ট্রেনটার কোচগুলো পুরোনো আমলের। বার্থের পাশের দেওয়ালে একটা বন্দে ভারতের পোস্টার লাগানো ছিল। ঠিক যেন এই পুরোনো ট্রেনটা খুঁড়িয়ে চলতে চলতে একদিন বন্দে ভারত হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছে। 

    ঝাঁসি, ললিতপুর, টিকমগড়, ছাতারপুর হয়ে খাজুরাহোতে এসে ট্রেন লাইন শেষ। তারপর একটা পাহাড় আর ওপারে পান্না জাতীয় উদ্যান। কাছে আছে এককালের আগ্নেয়শিলা জলে কেটে তৈরি রানে জলপ্রপাত। আর ললিতপুরের কাছে মহাবীর স্বামী অভয়ারণ্য পেরিয়ে বেত্রবতী নদীর পূর্ব দিকে আছে ঐতিহাসিক গ্রাম দেওগড় যেখানকার ষষ্ঠ শতাব্দীর বিষ্ণুর দশাবতার মন্দির ভারতের সবথেকে পুরোনো পাথরের তৈরী মন্দির।
    প্রচুর খেজুর গাছ ছিল বলে জনপদটার নাম এককালে  [~৯০০ খ্রীষ্টাব্দ] ছিল খর্জ্জুরবাহক। আদিযুগে বৎস নামে পরিচিত এই অঞ্চলের মধ্যযুগে নাম হয়ে যায় জেজেকাভূতি। কনৌজের গুর্জর প্রতিহারদের প্রভাব কাটিয়ে উঠে তাদের এককালের অনুগামী রাজপুত চান্দেল বংশের রাজা যশোবর্মন খাজুরাহোকে স্বাধীন জেজেকাভূতির রাজধানী করলেন। খেজুর গাছে ঢাকা মরুদ্যানের মত এখানে একগাদা জলাশয় এবং মোট পঁচাশিটা মন্দির ছিল। গজনির সুলতান মামুদের সঙ্গী অল বেরুনীর লেখাতেও খাজুরাহোর কথা আছে। কিন্তু মামুদ খাজুরাহো ধ্বংস করতে পারেননি। 
    তারপর বারোশোতে দিল্লী সুলতানদের মধ্যে দাসবংশের প্রতিষ্ঠাতা কুতুব উদ্দিন আইবক চান্দেলদের খাজুরাহোতে প্রথম আক্রমণ করেছিলেন। চান্দেলরা ধীরে ধীরে নিজেদের অজয়গড়, কালিঞ্জরের সুরক্ষিত কেল্লাগুলোতে এবং রাজধানী খাজুরাহো থেকে মাহোবায় সরিয়ে নিয়ে যান। 
    খাজুরাহো ধীরে ধীরে বড় জনপদ থেকে একটা ছোট গ্রাম হয়ে যায়। তেরোশোতে ইবন বতুতার লেখায় আবার খাজুরাহোর মন্দিরদের কথা আছে এবং মন্দিরগুলোর মূর্তিগুলো ধ্বংসের কথা আছে। চোদ্দোশো শতাব্দীর শেষ দিকে সিকন্দর লোদীও খাজুরাহো আক্রমণ করে অনেকগুলো মন্দির ধ্বংস করেন। অবশিষ্ট মন্দিরগুলো জঙ্গলের আড়ালে ঢেকে যায়। 
    ওদিকে আজমেরের পৃথ্বিরাজ চৌহান চান্দেলদের রাজধানী মাহোবা আক্রমণ করেছিলেন। পরে মুঘলদের সময় হুমায়ুন যখন ভারত ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ইরানে, সেসময় শের শাহ সুরি চান্দেলদের কালিঞ্জর দুর্গ দখল করতে গিয়ে মারা যান। আকবর কালিঞ্জর দখল করার পর জায়গির হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন বীরবলের হাতে। ১৭০০ তে দাক্ষিণাত্য অভিযান চলাকালীন ঔরঙ্গজেব মারা গেলে বুন্দেলা রাজা ছত্রশাল কালিঞ্জর দখল করলেন, বুন্দেলা রাজধানী সরিয়ে আনলেন পান্নাতে। 
    খাজুরাহো ঢোকার আগে একটা জায়গায় হঠাৎ ব্রিজের নিচে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে পড়ল। কি ব্যাপার। দরজার কাছে গিয়ে দেখলাম দু তিনজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে আর অন্য কামরাগুলো থেকে পিলপিল করে লোক নেমে হেঁটে যাচ্ছে সেতুর ওপরের রাস্তার দিকে। সেখানে একগাদা অটো, ছোট বাস এসব দাঁড় করানো। তখন রহস্য সমাধান হল না। এই জায়গাটায় লাইন দিয়ে যত লোক নামল এত লোক নিয়ম মেনে স্টেশনেও নামে না। 
    খাজুরাহো স্টেশনটা ছোট। দিনে হয়ত চার পাঁচটা ট্রেন আসে। জল কিনতে গিয়ে প্ল্যাটফর্ম স্টলের লোকটার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পাহাড় ভেদ করে নাকি আরো দু তিন বছর বাদে ওদিকে ট্রেন লাইন বাড়ানোর কথা চলছে। তাহলে আরো ট্রেন সংখ্যা বাড়বে।  
    আঠেরোশোতে আলেক্সান্ডার কানিংহ্যাম মূলত খাজুরাহো আবার পুনরাবিষ্কার করেন। তিনি জঙ্গলে ঢেকে যাওয়া অবশিষ্ট পঁচিশটা মন্দিরকে তিনভাগে ভাগ করেন। পশ্চিম, পূর্ব এবং দক্ষিণ। সবই মোটামুটি শিব অথবা বিষ্ণুকে উৎসর্গ করে বানানো। এর মধ্যে পশ্চিমের গুলোই অনেকটা জায়গা জুড়ে। পূর্ব দিকে আছে আরো তিনটে - ব্রহ্মা, বামন, জাভারি মন্দির এবং আদিনাথ জৈন মন্দির। সার্বিকভাবেও মন্দিরগুলো নির্মাণে জৈনদের বড় ভূমিকা আছে। দক্ষিণে আছে দুটো উল্লেখযোগ্য মন্দির - দুলহাদেও শিব এবং চতুর্ভুজ মন্দির।
     
     
    'নগর' স্টাইলে মন্দিরগুলো কোনো গাঁথুনি ছাড়াই শুধু পাথরের ব্লক বসিয়ে বসিয়ে বানানো। প্রায় সব পূর্ব মুখী, সূর্যোদয়ের দিকে। অধিষ্ঠান হচ্ছে মন্দিরগুলোর কমন ভিত্তি। তার ওপরে ধীরে ধীরে অর্ধ মন্ডপ, মন্ডপ, মহামন্ডপ, অন্তরাল এবং সবশেষে গর্ভগৃহ। সূর্য ওঠার সময় সূর্যের আলো ধীরে ধীরে দরজা দিয়ে ঢুকে গর্ভগৃহের মূর্তির ওপর পড়বে, মন্দির স্থাপত্যগুলো সেভাবেই তৈরী। গর্ভগৃহের চারদিকে প্রদক্ষিণ করার জায়গা। গর্ভগৃহের ওপরে মন্দিরের বাইরের দিকে প্রধান মিনারটাকে শিখর এবং ছোট ছোট মিনারগুলোকে উরুশৃঙ্গ বলে। শিখরের একদম ওপরে বসানো থাকে একটা কলসী। মন্দিরগুলোর বাইরের এবং ভেতরের বেশিরভাগ মূর্তিই কোনোরকম যৌন অনুষঙ্গ ছাড়া তৎকালীন সাধারণ জীবনযাপনের গল্প। এছাড়াও মন্দিরগুলোর গায়ে কিছু কিছু জায়গায় আছে ব্রহ্মার মূর্তি যেটা অন্য কোথাও দেখা যায় না। 
    ট্রেন স্টেশন থেকে মন্দিরগুলো অনেকটা দূর। অটো সহজেই মেলে। খাজুরাহো একমাত্র জায়গা যেখানে অটোওলা নিজের থেকে বলল অনলাইনে টাকা দিয়ে দিন ক্যাশ লাগবে না। 
    স্টেশন থেকে বেরিয়ে চওড়া ফাঁকা রাস্তা। ডানদিকে ছোট খাজুরাহো বিমানবন্দর। দিনে একটা প্রপেলারওয়ালা ছোট যাত্রীবাহী উড়ান - স্পাইসজেটের বম্বারডিয়ার কিউ ৪০০ যাতায়াত করে। বাঁদিকে বড় বড় রিসর্ট। কুড়ি মিনিট বাদে একটা ছোট মফস্বল শহর। অটো নামিয়ে দিল পশ্চিমদিকের মন্দিরগুচ্ছের সামনে। মন্দির কমপ্লেক্সে ঢোকার সময় সিকিউরিটি চেকের বাইরে দেখেছিলাম একটা কাঁচের বাক্সের ভেতর বাজেয়াপ্ত করা স্তূপাকৃতি খৈনির প্যাকেট। 
     

     
    কমপ্লেক্সে ঢুকে ডানদিকে শিব সাগর জলাশয়। বর্ষাকাল বলে পদ্ম ফুটবে ফুটবে করছে।
     
     
    যেকথা আগে বলছিলাম  - বিদ্যাধরের সময়ে মামুদ জেজেকাভূতি আক্রমণ করেছিলেন দুবার, সফল হননি। দ্বিতীয়বার কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধ করেছিলেন। মামুদের সঙ্গে বিদ্যাধরের শান্তিচুক্তি হয়েছিল এবং তারপর মামুদ গজনিতে ফিরে যান। এই সাফল্য ধরে রাখতে বিদ্যাধর শিবকে উৎসর্গ করে ~১০২৫ সালে কাণ্ডারীয়া মহাদেব মন্দির বানাতে নির্দেশ দেন। কাণ্ডারীয়া কথার অর্থ গুহা। 
     

    কাণ্ডারীয়া মহাদেব এবং জগদম্বী মন্দির 
     
    খাজুরাহোর সর্বোচ্চ মন্দির কাণ্ডারীয়া মহাদেবের আছে ৮৪টা উরুশৃঙ্গ। [ছবি -উইকি ]
     
     
    অর্ধ মণ্ডপ এবং মণ্ডপের বাইরের দেওয়ালে হাতি, ঘোড়া, যোদ্ধা, বাদ্যযন্ত্রী, নর্তকীদের মূর্তি।
     
     
    মন্দিরগুলোর বাইরের দেওয়ালের কোণগুলোয় ভ্যাল বা yali বলে একটি আধা সিংহ আধা গ্রিফিন জাতীয় মিথিক্যাল প্রাণীর মূর্তি। দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলোতে সবথেকে বেশি এই মূর্তি গুলো দেখা যায়। এছাড়াও বহু অন্যন্য গন্ধর্ব, সুরসুন্দরী এবং অপ্সরা মূর্তির মাঝে একটা বা ওপর থেকে নিচে একসারিতে চারপাশের দেবতাদের মূর্তির সঙ্গে সঙ্গতিহীন মিথুন মূর্তিগুলি বিস্মিত করে। গাইডরা দেখলাম পকেট আয়নায় সূর্যের প্রতিফলন ব্যবহার করে মূর্তিগুলোকে আলাদা করে চিহ্নিত করে দর্শকদের বোঝাচ্ছেন - এই দেখুন নরসিংহ অবতার। 
     

    মহা মণ্ডপ এবং অন্তরালের বাইরের দেওয়ালে এক কলাম মিথুন মূর্তি।  স্প্যানিশ মহিলাদের একটা দল মূর্তিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাচ্ছিলেন। 
     
    উল্টোদিকের দেওয়ালের মিথুন মূর্তির কলাম। 
     
     

    কাণ্ডারীয়া মহাদেবের সঙ্গে এক অধিষ্ঠানের ওপরেই আছে তুলনায় ছোট জগদম্বী মন্দির। 
     

    নীরন্ধ্র মন্দির অর্থে যেখানে প্রদক্ষিণ করার জায়গা নেই। যেমন জগদম্বি মন্দির। উল্টোটা হচ্ছে সান্ধ্র মন্দির। জগদম্বী মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরের বেরিয়ে থাকা কলামটির বরাহ অবতার এবং তার নীচে বিষ্ণু এবং লক্ষ্মীর মূর্তি উল্লেখযোগ্য। 
     

     
    চান্দেলদের রাজবংশের প্রতীক ছিল একটি সিংহের সঙ্গে যুদ্ধরত এক মানুষের মূর্তি। অনেক মন্দিরের শিখরেও এই প্রতীকটি বসানো আছে। কাণ্ডারীয়া মহাদেব এবং জগদম্বী মন্দিরের মাঝে আছে সেরকম একটি ছোট shrine.
     

    জগদম্বী থেকে আরেকটু এগিয়ে গেলে আছে  ~১০০০ - ১০২৫ সালে সূর্যকে উৎসর্গ করে বানানো চিত্রগুপ্ত মন্দির। এর বাইরের দেওয়ালে ওপরের রোতে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্মা এবং তার সঙ্গিনীর মূর্তি। ব্রহ্মার মূর্তিগুলোর মুখের নিচে মিশরীয়দের মত একটি দাড়ি দেখে চিনতে হয়। 
     
     

    মন্দির কমপ্লেক্সের মাঝের বাগানে সন্ধ্যেবেলা আলো শব্দময় শো চলে। 
     
    চিত্রগুপ্ত মন্দির থেকে আরো হেঁটে যেতে থাকলে আছে ধঙ্গর আমলে ~১০০২ সালে বানানো বিশ্বনাথ মন্দির।  
     
     

    'নগর' স্টাইলে বানানো মন্দিরের আরেকটা বৈশিষ্ট শিখরের ওই কাটা কাটা গোল চাকা, ওটাকে বলে আমলক।
     
    ১২ টি স্তম্ভের ওপর দাঁড় করানো নন্দী শ্রাইনের নন্দীর মুখ বিশ্বনাথ মন্দিরের দিকে।
     
    নন্দী শ্রাইন থেকে বিশ্বনাথ মন্দিরের সামনের দিক। 
     

    ছাতারপুর রাজ্যের রাজা প্রতাপ সিংয়ের আমলে ~১৮০০ বানানো প্রতাপেশ্বর মন্দির মধ্যযুগীয় মন্দির স্থাপত্যের নিদর্শন। পিছনে বিশ্বনাথ মন্দির দেখা যাচ্ছে। 
    ~৯০০ সালে বেলেপাথরে বানানো বরাহ শ্রাইন ১৪টা স্তম্ভের ওপর দাঁড় করানো। সিলিংয়ে পদ্মপাতার নকশা করা।
     

    ভূদেবীর মূর্তিটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার পা রাখার জায়গাটা অবশিষ্ট আছে। বরাহ অবতারের মূর্তি এত বড় যে এক ফ্রেমে আসছে না। 


     

    বরাহ শ্রাইন থেকে লক্ষ্মণ মন্দির। পাশে শিখরে হলুদ পতাকা লাগানো মন্দিরটি মাতঙ্গেশ্বর। ওটা দেওয়াল দিয়ে আলাদা করা, ASI মন্দির কমপ্লেক্সের অংশ নয়। মাতঙ্গেশ্বর খাজুরাহোর একমাত্র মন্দির যেখানে এখনো নিয়মিত পুজো হয়। 
     
    প্রতিহারদের সঙ্গে এক যুদ্ধে জয়লাভ করার পর যশোবর্মন এই লক্ষ্মণ মন্দিরটা বানান। এখানে আছে বৈকুন্ঠ রূপী বিষ্ণু মূর্তি। মাঝখানে মানুষ, একদিকে বরাহের মুখ, অন্যদিকে নরসিংহের মুখ। আর একটা চতুর্থ দানবের মুখ সাধারণত এই তিনটে মুখের পাথরের পিছনে লুকনো থাকে। এই মন্দিরে বৈকুন্ঠ মূর্তি একটা চওড়া পাথরের দেওয়ালের ওপর খোদাই করা। কাজেই চতুর্থ মুখটা অন্য কোথাও লুকোনো আছে। 
     
     

    লক্ষণ মন্দিরের অধিষ্ঠানের ওপর চারকোণে চারটে ছোট মন্দির। এটা সেরকম একটি। খাজুরাহো মন্দিরগুলোয় দরজার বাইরে মকরবাহিনী গঙ্গা এবং কচ্ছপবাহিনী যমুনার মূর্তি উল্লেখযোগ্য। 
     

    ডানদিকে লক্ষ্মণ মন্দিরের নিচের সারিতে হাতিদের মূর্তি উল্লেখযোগ্য। 
     

     
    লক্ষ্মণ মন্দিরের অন্তরালের বাইরের ভাস্কর্য 
     
    লক্ষ্মণ মন্দিরের বাইরে এই মূর্তিটা চারটে কঙ্কালের মত মূর্তি দিয়ে ঘেরা। 
     

    ডানদিকের ভাস্কর্যে দেখা যাচ্ছে নরনারীকে বিরক্ত করছে একটা বাঁদর।  
     
     
    এই মন্দিরেরই অধিষ্ঠানের গায়ে একটা গলির ভেতর খাজুরাহোর বিখ্যাত বিকৃত কামের মূর্তিগুলো [গাইডদের ভাষায় কামসূত্র মূর্তি] যেন লুকোনো আছে। ওগুলো প্রধান মন্দিরের অংশ নয়। প্ল্যাটফর্মটার গায়ে খোদাই করা আছে। দেখে মনে হয় মন্দির শিল্পী এবং এই প্ল্যাটফর্মশিল্পীরা আলাদা। 
     

    লক্ষ্মণ মন্দিরের অধিষ্ঠানের গায়ে সৈন্যদলের মূর্তি। 
     

     
     
    গানবাজনা হচ্ছে 
     
    মন্দিরের গায়ে গনেশ এবং একদল ভ্যাল 
     
    লক্ষ্মণ মন্দিরের পাশে মন্দির কমপ্লেক্স থেকে বেরোনোর রাস্তা। এই পিছনের দরজাটা দিয়ে বেরোলে ভানুমতীর মোড় বলে একটা জায়গা পড়ে। সেখান থেকে সোজা হেঁটে গেলে খাজুরাহোর পূর্ব দিকের মন্দিরগুলো। জৈনদেরও তীর্থক্ষেত্র হওয়াতে খাজুরাহোর খাবারের দোকানগুলোতে পেঁয়াজ রসুন বিহীন জৈন থালিও পাওয়া যায় , সেটা অবশ্য খাইনি। 
     

    পূর্ব দিকের মন্দিরের রাস্তায়। নেনুরা তাল জলাশয়ের পাশে গ্র্যানাইট পাথরে বানানো ব্রহ্মা মন্দির। 
     
    একটি পাথরের চোঙের চারদিকে ব্রহ্মার চার মুখ খোদাই করা।
     

    ব্রহ্মা মন্দির থেকে আরো এগোলে জাভেরি মন্দির। 
     
    ~১০৫০ সালের বামন মন্দির 
     
    এই দিকের মন্দিরের মূর্তিগুলোর মধ্যে প্রচুর হয়গ্রীবের মূর্তি দেখা যায়। দুই অসুর মধু এবং কৈটভ ব্রহ্মার থেকে বেদ চুরি করেছিল। বিষ্ণু হয়গ্রীব রূপে তাদের থেকে বেদ পুনরুদ্ধার করেছিলেন। শিখরের নিচে আমলক এবং তার নিচে একটা উরুশৃঙ্গে বসানো চান্দেলদের প্রতীক।  
     
    গর্ভগৃহে বামন অবতারের মূর্তি। বাঁদিকে চক্রপুরুষ এবং ডানদিকে শঙ্খপুরুষ। 
     

     
    ঘন্টাই জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর আদিনাথকে উৎসর্গ করে বানানো। একলা দাঁড়িয়ে থাকা স্তম্ভগুলোর গায়ে ঘন্টার কারুকাজ বলে এরকম নাম। 
     
     
    এই পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকের মন্দিরগুলোকে সবুজ একটু লনসমেত ঘিরে দিয়েছে এএসআই। তার পাশেই হয়ত কারুর বাড়ি। আসা যাওয়ার পথে বাচ্চারা হাঁ করে তাকিয়ে দেখে পর্যটকদের। যে এরা একটা বাড়ি দেখতে আসছে, আমরা তো রোজই দেখি। তাদের থেকে একটু বেশিবয়সের বাচ্চারা খাজুরাহোর নানান মূর্তির ছবিওয়ালা ছোট ছোট পকেটবই বিক্রি করছে। পাঁচিলের বাইরে ঠেলাগাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে বনসাই মূর্তি। 
    ছোট ছোট হোমস্টে। বাড়ির দেয়ালে নতুন করা সাদা চুনকাম।এক পাল্লা খোলা নীল রঙের দরজা দিয়ে দেখা যায় উঠোনের মাঝখানে তুলসী বেদী। 
     

    দক্ষিণদিকে নামতে থাকলে ~১১০০তে মদনবর্মনের সময়কালে বানানো দুলহাদেও শিব মন্দির। 
     
     
    তারপর খুদার নদীর ওপরে ছোট কংক্রিটের ঢালাই করা সেতু। গ্রামের হাঁটা পথ। দুদিকে সবুজ ফসলজমি আর মাঝে মাঝে পাথরের স্তুপ। অনেক জায়গায় সবুজ মাঠের মধ্যে পাথরের স্তুপ। এককালে মন্দির ছিল ধ্বংস হবার আগে। বিজামন্ডলে মন্দির পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে এ এস আই। আরো এগোলে চতুর্ভুজ মন্দির। 
     

    ~১১০০ সালে তৈরী চতুর্ভুজ মন্দিরে আছে খাজুরাহোর সবথেকে বড় এবং অক্ষত চার হাতের ত্রিভঙ্গ বিষ্ণুমূর্তি। চতুর্ভুজ মন্দির পূর্বমুখী নয়, ক্যাম্বোডিয়ার আঙ্কোর ভাটের মত দক্ষিণ মুখী। যশোবর্মনের আমলে তৈরী এই মন্দির খাজুরাহোতে একমাত্র যার বাইরের দেওয়ালে কোনো যৌন অনুষঙ্গ যুক্ত মূর্তি নেই। এবং একমাত্র মন্দির যেখানে বিষ্ণুর বিগ্রহ এখনো অনেকটা অটুট। 
     

     
    বিকেলে ফেরার সময় আবার সেই সকালের অটো চালককে ফোন করলাম। এটা সেই এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে স্টেশনে ফেরার রাস্তা। 
     
     
    ফিরতি ট্রেনে কামরার একটা ছেলে যে একটা ল স্কুলে আইন নিয়ে পড়ছে আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি খাজুরাহো কি করতে এসেছিলাম। আমি বললাম মন্দির দেখতে। সে ভেবেছে আমি বাগেশ্বর ধাম সরকার দর্শনে এসেছি। কিন্তু সেটা কি জিনিস? কস্মিনকালে নাম শুনিনি। এমন সময় আরেকজন কামরায় এলেন। তিনি হায়দ্রাবাদ থেকে এসেছেন ওই দর্শনে। তার কাছে শুনে ব্যাপারটা খোলসা হল। একজন বাবাজি সংসারী লোকেদের মাথায় হাত বুলিয়ে জ্ঞানের কথা বিতরণে ব্যস্ত। আসবার সময় সেখানেই অত লোক নামছিল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ২৪ অক্টোবর ২০২৩ | ৮৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২৪ অক্টোবর ২০২৩ ১১:৩২525103
  • খালি খালি পাহাড়ের কাছে যাবার নেশায় এইসব জায়গাগুলো আর দেখাই হচ্ছে না। আপনার এই ক্যাজুয়ালি বেরিয়ে ঘুরে আসার ধরণটা ভারী ভাল্লাগে। 
  • গবু | 202.8.***.*** | ২৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:০৭525112
  • লেখা ভালো লাগছে। কিন্তু ওটা কেন্দ্রীয় মহাদেব নয়, কান্ডারিয়া মহাদেব হবে বলেই জানি। উইকিও তাই বলছে, একটু দেখে নেবেন।
     
  • kk | 2607:fb90:ea0c:cd31:7a6a:9d53:7567:***:*** | ২৪ অক্টোবর ২০২৩ ২০:৩২525117
  • হ্যাঁ, আমারো এই বেড়ানো আর তার বর্ণনার ধরণটা খুব ভালো লাগে। আমি খাজুরাহো দেখিনি। কিন্তু এই লেখা পড়ে অনেক খানিই উপভোগ করা গেলো। ছবিগুলোর ক্ল্যারিটি অসামান্য। লেখাও যথাযথ। অনেক জায়গাতেই তো যাওয়া হয়ে উঠছেনা, হয়তো কখনো হবেও না। তাই গুরুতে যে কজন ট্র‌্যাভেলগ লেখেন, সবাইকেই কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনাদের লেখা পড়ে সেই নারায়ণ সান্যালের ভাষায় দুধের স্বাদ পিটুলি গোলায় নয়, কনডেন্সড মিল্কে মেটে।
  • দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় | ২৫ অক্টোবর ২০২৩ ০১:১৩525134
  • ধন্যবাদ দ , কেকে। এই বেড়ানোর ধরনটা সময়ের অভাবে কিছুটা বাধ্য হয়েই। ওই ছ সাত ঘন্টায় বা সারাদিনে যেটুকু দেখা যায়। 
     
    ধন্যবাদ গবু, ঠিক করে দিয়েছি। আগেও একবার ত্রিউন্ডটা আপনি ঠিক করতে বলে দিয়েছিলেন yes
  • গবু | 202.8.***.*** | ২৫ অক্টোবর ২০২৩ ০২:১৬525138
  • আর দুটো ব্যাপার। 
    ১. যেটা "ঘাঁটাই" বলেছেন, ওটা ওখানে ঘণ্টাই বলে উচ্চারণ করতে শুনেছি।
    ২. চৌষট (৬৪) যোগিনী মন্দিরের (ধ্বংসাবশেষ) কোনো উল্লেখ দেখছিনা, ওটা কি যাননি? পরে ওদিকে গেলে যেতে পারেন। অটো ওয়ালারা জানে, একটু অন্যদিকে বলে বেশি নেয় সামান্য। ওটা বোধ হয় একমাত্র মন্দির চত্বর যা পূর্ব বা পশ্চিম মুখী নয়। সকালের বা সূর্যাস্তের সময় গেলে একটা অন্যরকম আমেজ পাবেন। প্রায় ধ্বংসের মুখে দাড়ানো ছোট ছোট মন্দির, এখন অবশ্য সামান্যই রয়ে গেছে।
  • দীমু | 223.19.***.*** | ২৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:১৩525147
  • হ্যাঁ ঘন্টাই , an একসঙ্গে ছিল বলে সাইনবোর্ড দেখে চন্দ্রবিন্দু ভেবেছিলাম। 
     
    না ৬৪ যোগিনী যাওয়া হয়নি। গুগুল ম্যাপ দেখে হেঁটে ঘুরছিলাম। ম্যাপে দেখেছিলাম ওখানে কোনো মূর্তি নেই , চৌকো মাঠকে ঘিরে ৬৪ টা ছোট ছোট কুলুঙ্গির মতন। পরে ওদিকে গেলে যাবো একবার। 
     
  • sswarnendu | 2406:7400:92:952d:878:e089:7941:***:*** | ২৯ অক্টোবর ২০২৩ ১১:৪৮525306
  • লক্ষণ মন্দিরের বাইরে যেটাকে লেখক কঙ্কাল দিয়ে ঘেরা ব্রহ্মা বলেছেন, ওটা সম্ভবত শিব, আরো টেকনিকালি মহাকাল৷ পিছনের ডানহাতে ডমরু ও সামনের বাঁহাতে নরমুন্ড ছবিতে বেশ স্পষ্ট৷ 
  • দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় | ২৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:২০525313
  • @sswarnendu , আমার ছবিটা নীচ থেকে তোলা বলে ওরকম লাগছে। রঘু রাইয়ের খাজুরাহো সিরিজে সামনে থেকে একটা স্পষ্ট ছবি আছে। নিচের লিংকের ৩ নং ছবিটা। 
     
     
    তবে চারপাশের মূর্তিগুলো শিবগণ /ভূতদের হলেও হতে পারে। কিন্তু কাণ্ডারীয় মহাদেব বা দুলহাদেও শিবের বাইরে শিবের যে মূর্তিগুলো আছে তাদের সঙ্গে এই মূর্তিটা মেলে না। নিচের কাণ্ডারীয় মহাদেবের একটা ছবি দেখতে পারেন। এখানে একটা মূর্তিতে শিবের হাতে ডমরু। 
     
     
  • sswarnendu | 14.139.***.*** | ৩০ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:৩০525344
  • দেখলাম৷ ধন্যবাদ৷ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন