স্বপ্নে দেখা দৃশ্য বা ধারণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিস্কার, বিখ্যাত কাহিনী, চলচ্চিত্র নির্মাণের উল্লেখযোগ্য ঘটনা আছে। যেমন স্বপ্নেই নীলস বোর পেয়েছিলেন এ্যাটমিক মডেলের ধারণা বা মেণ্ডেলিভ পেয়েছিলেন পিরিয়ডিক টেবলের। সেলাই মেশিনের কার্যকর মডেলের আবিস্কারক আমেরিকান উদ্ভাবক এলিয়াস হাও যখন মেশিনে সুতোটা ঘুরে আসবে কী করে ভেবে নাজেহাল, ১৮৪৫ এর এক রাতে স্বপ্নে পেয়ে গেলেন সমাধান। সুতো পরানোর ফুটোটা দিতে হবে ছুঁচের মুখে - যা হাত সেলাইয়ের ছুঁচে থাকে পোনুতে। মেরী শেলীর 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন' বা রবার্ট লুই স্টিভেনসনের 'ডঃ জেকিল এ্যান্ড মিস্টার হাইড' রচিত হয় স্বপ্ন থেকে প্রভাবিত হয়ে।
পরবর্তীতে টাইটানিক, অবতার খ্যাত জেমস ক্যামেরনের পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবি পিরানহা-২ মুক্তি পায় ১৯৮২তে। রোমে সে ছবির ফাইনাল শ্যূট করতে গিয়ে জেমস ঘোর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ১০২ ডিগ্ৰী ধুম জ্বরের মধ্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় দেখলেন এক অদ্ভুত স্বপ্নদৃশ্য। সৃজনশীল মানুষ যে কোনো অবস্থা থেকেই পেতে পারেন স্ফূলিঙ্গ। সেই স্বপ্নদৃশ্যটির ভিত্তিতে ১৯৮৪ সালে জেমস নামিয়ে দিলেন একটি বাণিজ্য সফল সাই-ফাই সিনেমা - দ্য টার্মিনেটর - পর্দায় ফাটিয়ে দিলেন শোয়ারজেনেগার।
তবে বিখ্যাত কার্টুনিস্ট র-বাবুর বৃত্তান্তটি বেশ চমকপ্রদ। তিনি স্বপ্ন থেকে প্রভাবিত হন নি বরং বারংবার দেখা একটি দুঃস্বপ্নকেই করেছিলেন বাস্তবে পরাজিত। ২০০৭ সালে জন্মশতবর্ষে তাঁর কাহিনীগুলি পৃথিবীর ৭০টি ভাষায় অনুদিত হয়ে বিক্রি হয়েছিল ২০ কোটিরও বেশী। বাংলাতেও পড়েছি আমি। অসাধারন ডিটেল সমৃদ্ধ কমিক দৃশ্য ছাড়াও জম্পেশ কাহিনীও হতো তাঁর। টানটান সেসব কাহিনী বড়দেরও টেনে রাখতে সক্ষম।
একবার তিনি ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নে দেখলেন একটা শ্বেত-কঙ্কাল তাঁকে তাড়া করেছে কোনো তুষারাবৃত পাহাড়ি এলাকায়। তিনি প্রাণভয়ে পালাচ্ছেন। হঠাৎ চারপাশ কুয়াশায় সাদা হয়ে গেল, তিনি কিছুই দেখতে পারছেন না, পিছনে ধেয়ে আসছে শ্বেত-কঙ্কাল। কোথায় পালাবেন? ধড়ফড়িয়ে ঘুম ভেঙে গেল। বারংবার দেখতে থাকলেন সেই দুঃস্বপ্ন। সাময়িক মনোবিকলন হয়ে গেল র-বাবুর। শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে গেলেন সুইশ সাইক্রিয়াটিস্ট ফ্রানৎজ রিনকিনের কাছে। তিনি আবার হেঁজিপেঁজি কেউ নন, খোদ কার্ল গুস্তভ জংয়ের ছাত্র। কার্ল তাঁর পূর্বসূরি ফ্রয়েডের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন, দুজনে একসাথে কিছু কাজও করেন। ফ্রয়েডের সাথে তাঁর দীর্ঘদিনব্যাপী মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ পত্রবিনিময় হয়। রিনকিনের সাথে দীর্ঘ আলোচনায় উঠে এলো র-বাবুর দুঃস্বপ্নের অবচেতনে লুকিয়ে থাকা প্রেক্ষাপট।
র-বাবু গোঁড়া রোমান ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী। একদা ছিলেন বয় স্কাউট, ফলে স্কাউটের যে নীতিবোধ - কাউকে প্রদেয় শপথ প্রত্যাহার করা যায় না - এসব তার মনে বসে আছে। অথচ জীবনাচরণে ঘটছে বিচ্যূতি। ৪৯ বছর বয়সে র-বাবু উপলব্ধি করলেন তার সিকি শতাব্দীর বিবাহ সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে মরুভূমি। তাতে আর কোনো মাধুর্য অবশিষ্ট নেই। বরং তাঁর থেকে আঠাশ বছরের ছোট একুশ বছরের ফ-মণির মধ্যে তিনি খুঁজে পাচ্ছেন মরুদ্যানের শান্তি।
যুবতী ফ-মণি তাঁরই স্টুডিওতে কমিক চিত্রের কালারিস্ট। তার সাথে র-বাবু আলোচনা করেন কাজ নিয়ে যা তিনি করতে পারতেন না তাঁর স্ত্রীর সাথে। মামণি তাঁকে নানা ক্রিয়েটিভ আইডিয়া দিতেন। অর্থাৎ যুবতী ফ-মণির মধ্যে র-বাবু শুধুমাত্র নারীত্বের আকর্ষণই বোধ করেন নি, সে ছিল তাঁর সৃজনশীলতার অনুপ্রেরণা। শিল্পীর কাছে এটা খুব দুর্বল জায়গা। যেমন ছিল রামকিঙ্কর বা পিকাসোর কাছে নানা রমণীরা। তবে র-বাবু ও ফ-মণির মধ্যে আকর্ষণ ছিল যৌথ, একতরফা র-বাবুর নয়। তখন তিনি তাঁর মূল্যহীন হয়ে যাওয়া ২৫ বছরের বিবাহিত জীবনে ইতি টেনে ফ-মণিকে বিয়ে করার কথা ভাবছিলেন।
তবে মনে গভীর অপরাধবোধ, নৈতিক সংকটের জন্ম দিচ্ছিল তাঁর ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাস, স্কাউটিংয়ের মূল্যবোধ - কাউকে প্রদেয় শপথ প্রত্যাহার করতে নেই। হিন্দুমতে "যদেতৎ হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম।" গোছের বিবাহের শপথবাক্য ক্যাথলিক ধর্মমতেও 'Marriage Vow' হিসেবে গীর্জায় নেওয়া হয়। সেখানে স্বামী, স্ত্রী দুজনেই বলেন "I take you to be my (husband/wife). I promise to be true to you in good times and in bad, in sickness and in health. I will love you and honour you all the days of my life.
রিনকিন বলেন তাঁর গভীর মানসিক দ্বন্দ্ব বা Moral Dilemmaই নানাভাবে হানা দিচ্ছে তাঁর দুঃস্বপ্নে। সাদা পবিত্রতার প্রতীক। যেহেতু তিনি তাঁর ধর্মবিশ্বাস, স্কাউটিংয়ের শপথ, গীর্জায় নেওয়া বিবাহ শপথের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারেন নি তাই তাঁর হারানো পবিত্রতাবোধ প্রতিশোধ নিতে স্বপ্নে শ্বেত-কঙ্কাল হয়ে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। র-বাবু বলেন, যদি স্ত্রীকে ত্যাগ না করি - ফ-মণিকেও বিয়ে না করি - তবে স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ তলানিতে ঠেকেছে বলে ফ-মণির সাথে মেলামশা করে নিছক আনন্দ পেতে চাই - কেমন হয়? রিনকিন বললেন, এভাবে দু নৌকায় পা দিয়ে চলা শক্ত তবু চেষ্টা করে দেখতে পারেন। যদি দুই মহিলাই, বিশেষ করে আপনার স্ত্রী, তা মেনে নেন তো ভালোই। তবে আমার পরামর্শ এখন কিছুদিন কার্টুন আঁকা থেকে বিশ্রাম নিন, ফ-মণি থেকেও দুরে থাকুন, দেখুন তাও ঐ দুঃস্বপ্ন ফিরে আসছে কিনা।
র-বাবুর সৃষ্ট কমিক চরিত্র, তাঁর অঙ্কনশৈলী ততদিনে পৃথিবীবিখ্যাত হয়ে গেছে। বাজারে বেরিয়ে গেছে ১৯টি বই। হৈহৈ করে বিক্রি হচ্ছে। তবু রিনকিনের শলা অনুযায়ী র-বাবু কমিক ছেড়ে ধরলেন তাঁর দ্বিতীয় প্যাশন - বিমূর্ত চিত্রকলা। তবু তাঁর দুঃস্বপ্নে পবিত্র সাদা তাঁকে তাড়না করে চলে। এমতাবস্থায় র-বাবু দুঃস্বপ্ন মোকাবিলায় একটি সাহসী পদক্ষেপ নিলেন - সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা কোনো সমাধান নয়। স্বামী হিসেবে যেমন তাঁর দায়বদ্ধতা স্ত্রীর প্রতি, শিল্পী হিসেবেও তাঁর দায়বদ্ধতা থাকা উচিত তাঁর সৃষ্টির প্রতি যা বহুজনকে আনন্দ দেয়। জীবন একটাই, শুধুমাত্র শপথের অঙ্গীকার পালনের জন্য জীবন থেকে আনন্দ বিসর্জন দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
১৯৫৭তে ঘোর মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে, তার স্বরূপ উদঘাটন করে আগামী কুড়ি বছর তিনি কাটিয়ে দিলেন তিন নৌকায় পা দিয়ে - মরুভূমি সদৃশ বিবাহিত জীবন কাটিয়ে, মরুদ্যান সদৃশ বান্ধবীর সাহচর্য পেয়ে এবং কাজে মজে থেকে সৃষ্টির আনন্দে। অবশেষে ৪৫ বছরের বিবাহিত জীবনে যবনিকা টেনে ১৯৭৭ সালে র-বাবু যখন একদা একুশীকে বিয়ে করলেন, তখন তিনি ৭০, ফ-মণি ৪২। জীবনের কুড়িটি মধুবসন্ত কেটে গেছে ঘূর্ণিজলে নৌকা বাইতে। বিয়ের পর র-বাবু বাঁচলেন মোটে ৬ বছর। সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে, রিনকিনের শলা না মেনে, আত্মবিশ্বাসে ভর করে, ফ-মণি প্রদত্ত সৃজনী উৎসাহ ও নারীত্বের মোলায়েম সাহচর্যে মানসিক আনন্দে পাখা মেলে ১৯৫৭ থেক ৫৯ এর মধ্যে তাঁর সৃষ্ট কমিক চরিত্র নিয়ে কাজ করে প্রকাশ করলেন - TIT.
TIT যে মুনুর প্রতিশব্দ তা এখন জানি, তখন জানতাম না। কখন? সেই আশির দশকের শুরুতে, যখন বিশ বছরেও ছিলাম নেহাতই গোলা, ছিলনা হোঁচট খেলে দেওয়ার জন্য শলা - সর্বজ্ঞ গুগলদা। তখন কেবল জানতাম 'Tit for Tat' প্রবাদটা। মানে যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল। তখন পুজো সংখ্যা আনন্দবাজারে পড়েছিলাম সুনীলের 'রক্ত মাংস'। শহরতলীর ঝিল্লি রায়ের বাড়িতে অভাব। তবে উনিশ বর্ষীয়া ঝিল্লির ছিল খাজুরাহো সুন্দরীদের মতো দুটি অনুপম সম্পদ। বেচারী জানতো না যে ও দুটিই ছিল তার দুটো অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের চাবিকাঠি। সে চিমনলালের ভরসায় বম্বে গেল। সিনেমায় কোনো ছোটো রোল পেলেও বাড়িতে দারিদ্র্য ঘুচবে সেই আশায়।
কিন্তু চিমনের উদ্দেশ্য ছিল অন্য। কায়দা করে তার নগ্ন ছবি তুলে বিক্রি করা। সে তাকে নিয়ে গেল বিখ্যাত গ্ল্যামার ফটোগ্ৰাফার হরিশ চাওলার কাছে। মেয়েদের মুনু দেখে দেখে চোখে চড়া পড়া হরিশেরও ঝিল্লিকে দেখে চক্ষু ছানাবড়া। ঝিল্লির বুকের দিকে আঙুল দেখিয়ে চিমনকে শুধোয়, 'আর দিজ টিটস রিয়েল?' চিমন বলে, 'হেঃ, হেঃ, হুজুর, এই লাইনে এ্যাদ্দিন আছি, এটুকুন বুঝবুনি। পরখ করে তো দেখিনি, তবে চোখের দেখায় রিয়েল না মনে হলে আনরিলায়েবল জিনিস এ্যাতো খরচ করে কলকাতা থেকে উড়োজাহাজে বম্বে উড়িয়ে আনি'?
সুনীলদা অবশ্য চিমনের মুখ দিয়ে এভাবে বলান নি। এ সব চলভাষের ছুঁই-পর্দায় আমার রসিক তর্জনীর ছ্যাবলামি। সুনীলদার বয়ানে ছিল - হরিশ স্টুডিওতে উপস্থিত একটি মেয়েকে বলে, 'ফিল ইট'। মেয়েটি সবার সামনে টপাস করে ঝিল্লির বুক টিপে 'ফিল করে' বলে, 'নো প্যাডিং, ইটস রিয়েল'। পরে পুরো কাহিনীটি ভুলে গেলেও ঐ অংশটুকু মনে ছিল কারণ ঐ TIT, মানে একটি সমৃদ্ধ বিষয়ে সুনীলদার অমন নির্লিপ্ত বর্ণনের ধরণে। বাংলায় এমএ হয়েও ইংরেজিতে পোক্ত সুনীলদার দৌলতে সেদিন অভিধান না ঘেঁটেও বুঝলুম টিট মানে মুনু। পৃথিবীর পাঠশালায় এভাবেই জ্ঞানবৃদ্ধি হয়।
এবার গরুটাকে নামাই গাছ থেকে, ব্যাটা মাঠ ছেড়ে গাছে উঠে অনেক খেয়েছে মগডালের পাতা। তো ঐ শ্বেত-দুঃস্বপ্নটিকে 'Catch the bull by its horns' আপ্তবাক্য অনুযায়ী জব্দ করতে Georges Prosper Remi, অর্থাৎ র-বাবু যে TIT কাহিনী লিখেছিলেন তা সুনীলের মতো আমিষ নয়, নিরামিষ কিশোরপাঠ্য এক কমিক - Tintin In Tibet, অধম আদ্যক্ষরী ভার্সানে ইচ্ছাকৃত লিখেছিল TIT, নিছক মজা করতে।
পৃথিবীবিখ্যাত বেলজিয়ান কার্টুনিস্ট রেমিরই কলমনাম ছিল হার্জ। ঐ TIT কাহিনী ছিল হার্জের ২৪টি টিনটিন অভিযান কাহিনীর মধ্যে বিংশতিতম। ওটি প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। আজও টিনটিন ও হার্জ গবেষকদের কাছে TIT একটি মাস্টারপিস বলে বিবেচিত। হার্জ TIT কাহিনী লিখেছিলেন তিব্বত তো ছাড়, হিমালয়ে না গিয়েই। তবে পড়েছিলেন প্রচুর - অস্ট্রিয়ান পর্বতারোহী, ভূগোলবিদ হেইনরিখ হারারের পৃথিবীর ৫৩টি ভাষায় অনুদিত তিব্বতের ওপর প্রামাণ্য গ্ৰন্থ 'সেভেন ইয়ারস ইন টিবেট', এভারেস্ট জয়ের তিন বছর আগে ১৯৫০ সালে পৃথিবীর প্রথম আটহাজারী শিখরজয়ী ফরাসি দলনেতা মরিস হারজগের অভিযান কাহিনী 'অন্নপূর্ণা'। হিমালয়ের ওপর ঘেঁটেছিলেন নানা এ্যালপাইন জার্নাল, ন্যাশানাল জিওগ্ৰাফিক পত্রিকা। তাঁর টিমকেও লাগিয়েছিলেন তিব্বতের ওপর তথ্য সংগ্ৰহে। অধিকাংশ বিদেশী পেশাদার মানুষ শর্টকাটে বিশ্বাসী নন। হার্জও ছিলেন তেমন। একটা কিশোরপাঠ্য কমিক লিখতেও খেটেছিলেন অনেক।
নিজে নিয়েছিলেন হারজগের সাক্ষাৎকার। কারণ অন্নপূর্ণা অভিযানে মরিস নাকি ইয়েতি সদৃশ কিছু দেখেছিলেন। TIT কাহিনীতেও উপকারী ইয়েতির উল্লেখ আছে। হার্জের হার্টথ্রব ফ-মণি (ফ্যানী রডওয়েল) তাঁকে প্রস্তাব দেন ESP (Extra Sensory Perception) বা অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি এবং তিব্বতী রহস্যবাদ (Tibetan Mysticism) জাতীয় কিছু উপাদান TIT কাহিনীতে রাখার জন্য। হার্জের পছন্দ হয় ফ্যানীর শলা। সাধে কী তিনি ছিলেন ফ্যানীর গুণমুগ্ধ প্রেমিক!
ফলে টিনটিনের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনী TIT ছোটদের কমিক হলেও তিব্বতী ধর্মগুরু দালাই লামাও এটির প্রশংসা করেছিলেন। সর্বোপরি দু বছর ধরে TIT নির্মাণ পর্ব ছিল হার্জের ব্যক্তিগত সংকট কাটিয়ে ওঠার সফল সংগ্ৰাম। যে শ্বেত বিভীষিকা তাঁকে দুঃস্বপ্নে তাড়িয়ে বেড়াতো, তিব্বতের শ্বেত শুভ্র তুষারাবৃত পটভূমিতে TIT নির্মাণ করে, অজস্র ছবি এঁকে তাকেই নিলেন কষে ক'হাত। দুঃস্বপ্ন থেকে পলায়ন নয়, করলেন তাকেই পরাজিত। TIT নির্মাণ সম্পূর্ণ হতে অবসান হোলো সেই দুঃস্বপ্নের।
তবে এ লেখায় TIT দেখে রক্ষণশীল মহিলাদের ভ্রু কোঁচটানোর কিছু নেই। কারণ বর্তমানকালে মানবীদের গণস্থানে এই সম্পদ প্রদর্শনে চক্ষুলজ্জাহীন বাহুল্যে চক্ষুষ্মান পুরুষের পক্ষেই বরং না দেখার ভান করে থাকা মুশকিল। এছাড়া আছে নানা মিডিয়ামে বিজ্ঞাপনের উদ্ভাবনী কৌশল। হাওয়াই চটি থেকে হাওয়াই জাহাজ বা সাবান থেকে সাইকেলের বিজ্ঞাপনে এই সম্পদ সৃজনশীল নিপুনতায় প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থাপিত হয়।
আমি এক তুচ্ছ প্রাণী। শেলী, ক্যামেরনের মতো কেউকেটা কেউ নই। তবু আম্মোও ঘুমোলেই স্বপ্ন দেখি। সেই ছোট্ট থেকে। যৌবনে হয়তো মধু-মধু স্বপ্ন দেখে ঘুমের মধ্যেও মাখোমাখো হেসেছি। যৌবনে ঘুম থেকে উঠে ঝাঁপালো বোগেনভেলিয়ার ছাওয়ায় উঠোনে উবু হয়ে বসে অনেকক্ষণ ধরে চোখ বুঁজে দাঁত মাজতাম। মা বলতো, কী রে, বেলায় ঘুম থেকে উঠেও তুই কী দাঁত মাজতে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? জলখাবার দিয়েছি, আয়।
আসলে আমি তখন গতরাতে দেখা, সকালে মনে করতে গিয়ে ডেঙেচুরে যাওয়া কোনো ইন্টারেস্টিং স্বপ্ন ছেঁড়া ছেঁড়া সদ্যস্মৃতির ফেভিকুইক দিয়ে জুড়ে রিওয়াইন্ড করে দেখার চেষ্টা করতাম মনশ্চক্ষে। কিছু স্বপ্ন দেখতাম প্রায় সিনেমার মতো। ইসস্ তখন যদি তার কিছুও লিখে রাখতাম 'দেখা স্বপ্নের ডায়েরি' বানিয়ে, তাহলে এই বালাই ষাটের যুবক তর্জনী তার থেকে জুটিয়ে নিতো কিছু গোমাতা - টাচস্ক্রিনে ছাড়লে উঠে যেতো কল্পনার গাছে।
তবে মনের চর্মচক্ষু হয় না তাই ছানি পড়ে ঝাপসা দেখার প্রশ্ন নেই। মন বাস্তবের মাটিতে হাঁটেও না যে গেঁটে বাতে শুয়ে থাকবে। তাই পরিণত বয়সেও ঘুমোলেই দেখি নানা স্বপ্ন। কিছু মধুর, কিছু বিমূর্ত, যার তাৎপর্য জাগ্ৰত চেতনায় ধরা পড়ে না। হয়তো যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা, অপরাধবোধ, অবদমিত ভাবনা পারম্পর্যহীন চিত্রকল্প হয়ে স্বপ্নে হাসায় বা বিষন্নতায় সিক্ত করে। ইদানিং ছাইপাঁশ লেখার নেশায় ধরায় কখনো কিছু স্বপ্নদৃশ্য কোনো লেখার প্রাথমিক প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায় যাতে জাগ্ৰত মন মেশায় সচেতন কল্পনা, দেয় বাঞ্ছিত পরিণতি।
চতুর্দিকে নানা আবিল ঘটনাপ্রবাহে কিছু কল্পচরিত্র সৃষ্টি করে পলায়নবাদী মন খুঁজে নেয় সাময়িক আনন্দ। টাচস্ক্রিনে তর্জনীবাহিত হয়ে জন্ম নেয় - মৌমিতা, কেতকী, পারু, তিন্নি, ঈশু, তুলি, চুনি, মেরী, কাকলী, হিনাল, সঙ্গীতা, ক্যারল, সুচিত্রা বৌদি, হেমাঙ্গিনী… ও বাবা, নয় নয় করেও তর্জনী দেখছি বেশ কিছু কলমকন্যার জন্ম দিয়ে ফেলেছে! অবশ্য জন্ম হয়েছে কিছু মানসপুত্রেরও - সৌমেন, সুমন, সুদীপ, রমেন, জন, সুখরাম, উৎপল, অর্জুন, বলাইদা, প্রণবদা... । তবে শখের পুরুষ লেখক বলেই হয়তো তার একটু পক্ষপাতিত্ব দেখা যায় কলমকন্যা সৃষ্টিতে। কারণ তার ধারণায় নারীত্বের মাধূর্য (Feminine Sensibilities) প্রকৃতির অনুপম উপহার। তাই তার অক্ষম লেখনীতে সৃষ্ট নানা মানসকন্যার গুণকীর্তনে তার তর্জনী কখনো ক্লান্ত হয় না, কখনো তাদেরই মোহে পড়ে যায় তার সৃষ্ট কোনো মানসপুত্র। এ সব তর্জনীর খেয়ালে মায়ার খেলা। চতুর্দিকে নানা কলুষতার মধ্যে এহেন ইচ্ছাপূরণের বাসনাই পলায়নবাদীর বেঁচে থাকার সঞ্জীবনী বটিকা।
.