বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে যে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিনে পরীক্ষা কেন্দ্রে অন্যান্য স্কুল থেকে আসা ছাত্রদের একাংশ চেয়ার টেবিল ভেঙে কল ভেঙে পাখা বেঁকিয়ে এক ধরনের অদ্ভুত উল্লাস করে থাকে। এর জন্য ইদানীং স্কুলে প্রশাসন ও স্কুলের তরফে শেষ দিনে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া ছেলেদের আটকানোর জন্য। কিন্তু ঘটে যায় এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ছেলেরা কিছু করতে পারল না, কিন্তু মেয়েরা যাদের কাছে এহেন আচরণ কেউ প্রত্যাশা করেনি তারাই এক ফাঁকে পাখা দুমড়ে বাল্ব খুলে নিয়ে চলে গেছে।
এখন এই সমান ভাবনার যুগে মেয়েদের এত সাহস ইত্যাদি প্রশ্নে না গিয়ে যে কথাটা ভাবিয়ে তুলছে সেটা হল কেন এই অত্যাচার! সাধারণভাবে এখন স্কুলের উপর দিকে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চেয়ে বেশি। পরীক্ষাতেও তো তাই দেখা যায়। কিন্তু কী এমন হল যে মেয়েদেরও লেখাপড়া নিয়ে এমন অদ্ভুত বিতৃষ্ণা দেখা দিয়েছে। মেয়েদের স্কুলে আনার জন্য, লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার জন্য এখন কত রকমের ব্যবস্থা। আর্থিক অনুদান, প্রশাসনিক সাহায্য, বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সক্রিয়তা তবু কোথাও যেন ফাঁক থেকেই যাচ্ছে। আমরা যা দেখছি যা শুনছি, তার অনেকটাই যে জল মিশানো সেটা আমরা জানি। কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি হল তা নিয়ে আমাদের তলিয়ে দেখার সময় নেই। আর দেখাবেই বা কে?
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা ৫ (২০১৯-২১)শেষ যে রিপোর্ট পাওয়া গেছে সেখানে স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার প্রধান কারণ দারিদ্র বা বাল্যবিবাহ নয়, কারণ এরা পড়াশোনায় আগ্রহী নয়। এর মধ্যে ছাত্রদের প্রায় ৩৫.৭ শতাংশ আর ছাত্রীদের ২১.৪ শতাংশ আছে। এই অনাগ্রহের কারণ কী?
বিনা ব্যয়ে শিক্ষার অধিকার আইন বলে একটি আইন হয়েছিল এই দেশে। তার পরই সকলের জন্য শিক্ষার বিষয়টা নিয়ে ভালোরকম নাড়াচাড়া হয়। স্কুলের পরিকাঠামোর কিছু উন্নতি হয়, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক নিয়োগ হয়। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত তো বটেই তার পরেও বিনামূল্যে বই খাতা দেওয়া হয়। মিড ডে মিল ইত্যাদি তো আছেই। এই সময় থেকে ছাত্রছাত্রী সংখ্যাও বাড়ে। যাবতীয় সরকারি দপ্তরে সংবেদনশীলতা বাড়ানো হয়, হিসাব রাখার জন্য পোর্টাল খোলা হয়, প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর ইউনিক আইডি দেওয়া হয়। পালানোর পথ নেই। ছাত্রছাত্রীরাও আসছিল, প্রত্যন্ত এলাকাতেও স্কুল পৌঁছে গেল। আজকাল যে মাঝে মাঝে শহরের কাগজে বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম দেখে ইংলিশ মিডিয়ামের বাবা মায়েদের চোখ কপালে ওঠে, তারা কখনও বুঝতে পারবেন না এ দেশে তথা এ রাজ্যে এমন জনপদ আছে, সেখানে গুটিকয়েক ছাত্রছাত্রীই আছে। ঘরের কাছে স্কুল না থাকলে তাদের বহু পথ পেরিয়ে দূরের স্কুলে যেতে হতো, অনেকেই যেত না। কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া শিক্ষানীতি ২০২০ অবশ্য শহুরে ভাবনার অনুগামী, তাদের প্রস্তাবে তারা এইসব স্কুল গুলিকে উঠিয়ে এক জায়গায় এনে ফেলবেন বলেছেন, ছেলেমেয়েরা কী করে উঠে আসবে সেটা অবশ্য কিছু বলা নেই।
যাই হোক, এত কান্ডের পর শিক্ষা পৌঁছেছিল তার কাছেই ' যে শিশু জন্ম নিল শিক্ষার বহু দূরে'। কিন্তু শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯ প্রণেতারা কল্যাণকারী রাষ্ট্রের মুখোজ্জ্বল করার সাথে শিক্ষাক্ষেত্রে বাণিজ্যের দরজাটিও হাট করে দিলেন। শিক্ষা যে একটি চমৎকার মুনাফাদায়ী ব্যবসা এটা বুঝে নিয়ে বহু বণিক এতে লগ্নী করলেন আর শিক্ষান্তে সুনাগরিক সক্ষম মানুষ হওয়ার যে সব প্রতিশ্রুতি ছিল, সব উড়ে যেতে লাগল। শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে মুক্তি জাতীয় ভাবনা তো আগেই উবে গেছে। শিক্ষার শেষ লক্ষ্য হল আর্থিক সমৃদ্ধি, যার একমাত্র পথ প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকা। যে শিক্ষা পণ্য, তার জন্য চকচকে মোড়ক লাগবে। তার একেবারে বাইরে জড়িয়ে দেওয়া হল ইংরেজি জানার কেতা। সংক্রামক ব্যাধির মত উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত বিপ্লবী আদর্শবাদী নীতিবাগীশ সবাই ছেলেমেয়েকে এদের হাতেই সমর্পণ করলেন। যার যতটুকু সামর্থ্য সব এদিকেই গেল। এখন যে কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারে গেলেই বাড়ির শিশুটিকে হাত পা নেড়ে রাইম শোনাতে হবে, হেড, আই, নোজ দেখাতে হবে নাহলে অভ্যাগত বা শিশু কারোরই নিস্তার নেই।
বাকি যে বিপুল অংশ রইল, পশ্চিমবঙ্গে সৌভাগ্য জনক ভাবে যে সংখ্যাটি ৮৬ শতাংশ, তারা কিন্তু সরকারি স্কুলেই এল। কিন্তু ব্যবস্থা বদলালো না। একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। পঠন পাঠনের আধুনিকতম পদ্ধতি নিয়ে কথা হলেও বেশিরভাগ স্কুলেই এখনো প্রসন্ন গুরু মহাশয়ের মতই ক্লাস হয়। স্যার বলেন পড়ো, ছেলেমেয়েরা পড়ে। তিনি বলেন লেখো,সবাই লেখে। বোঝাবুঝির কোনো ব্যাপার নেই। সেটার জন্য প্রাইভেট টিউশনি ভরসা যেটি আরেকটি শিক্ষা সংকোচনের কেন্দ্র। মাছের মাথা বা লেজ কিছু সম্পর্কে কোনো ধারণা না দিয়েই সেখানে মাছের মাঝখানটুকু নিয়ে নোট দিয়ে দেওয়া হয়, যেহেতু সেটা পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক বড় পরীক্ষার আগে রাজ্য জুড়ে মিনিটে মিনিটে সাজেশান বিক্রি হয়, বিভিন্ন সমাজ মাধ্যমে ছড়ানো হয়, এমনকি শিক্ষকরাও দিয়ে থাকেন এটা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে যে সাজেশনের সাজেশন নিয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে তার মূল পড়াটাই তো ফাঁকি থেকে গেল। তারপর গদগদ স্তরে প্রথম স্থানাধিকারী বিজ্ঞাপন দেবেন আমার সাফল্যের মূলে অমুক প্রকাশনীর তমুক বটিকা এবং গুচ্ছের গৃহশিক্ষক। গৃহেই সব শিক্ষা হয়ে যাচ্ছে বলে 'ভালো' ছেলেমেয়েদের শনিবার বা অনুষ্ঠানের দিনে স্কুলে দেখা মেলে না। সবার সাথে মিলেমিশে কাজ করাকে কেউ আর শিক্ষার উপাদান বলে মনে করেন না।
অথচ মূল্যায়ন প্রসঙ্গে কথা ছিন সার্বিক নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন অর্থাৎ গোটা বছর জুড়ে ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়া সহ অন্যান্য বিভিন্ন গুণাবলীর বিকাশ পর্যবেক্ষণ করে তার মূল্যায়ন। এ নিয়ে বহু শিক্ষক কিন্তু ভেবেছিলেন, কিন্তু নম্বর সর্বস্ব সমাজ কিছুতেই এটি মানতে নারাজ, শিক্ষকদের এক অংশও বছরের শেষে গোঁজামিল দিয়ে এই ফর্মেটিভ অংশটি পার করে দেন। অভিভাবক ছাত্রী বা শিক্ষক কারো মাথাব্যথা নেই ছাত্রীর নান্দনিকতা, সমানুভূতি উপস্থিতি ইত্যাদির মুল্যায়নে।
নম্বরের রমরমায় আবার ফিরে যাওয়া হচ্ছে পাশ ফেল জাতীয় কুৎসিত প্রথায় যেখানে লিখিত পরীক্ষায় ভালো না করতে পারাই একমাত্র বিচার্য এবং এর সমস্ত দায় ছাত্রীর, অন্যদিকে বিদ্যালয় জুড়ে মহা মহা মণীষীর শিক্ষা সংক্রান্ত অসামান্য উপলব্ধির বাণী লিখে রেখেও শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য চাকরি সেটা প্রতিষ্ঠা করা। বহুকাল আগেই মনে হয় গান্ধীহত্যার পরে পরেই কায়িক শ্রমের সাথে মেধার বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। যারা শ্রমজীবী পরিবার থেকে ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠান তারাও ভাবেন লেখাপড়া শিখে এরা অফিসার হবে, আর অন্যদিকে শিক্ষকেরা ভাবেন এদের দ্বারা কিছুই হবে না। যত বেশি প্রান্তিক মানুষ তত বেশি তার প্রতি তাচ্ছিল্য। প্রতিদিন ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে এই তাচ্ছিল্যের শিকার হয়, আর আজকের সময়ে হিন্দুত্বের প্রচণ্ড আগ্রাসী প্রচারে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আরো অনেক বিদ্বেষের সম্মুখীন হতে হয়। তার উপর সিলেবাসের বোঝা। ভিত তৈরি হতে না হতেই তার উপর চেপে বসছে কঠিন পড়াশোনার ভার, শিক্ষা থেকে ক্রমেই সে দূরে চলে যাচ্ছে। তার জীবনের লড়াই, তার প্রশ্ন, অভিজ্ঞতা কোনো কিছুই মেলেনা ঐ স্কুল ঘরের সাথে বা কোনো বইয়ের পাতায়। টুকলি দেখে লিখে দেয়, কোনোটাই মাথায় পৌঁছায় না। তীব্র অসহায়তা তৈরি করে বিক্ষোভ।
সবাই হাত গুটিয়ে নিয়েছে কিন্তু বিপুল এক শিক্ষা কাঠামো আছে, বহু স্তরের মানুষের অন্ন সংস্থান হয় সেখানে, কিন্তু হাত দিয়ে সেটুকু তুলে নেওয়া ছাড়া সত্যিই কি আর কিছু ভাবা হয়? এত যে শিক্ষক সংগঠন তাদের দাবি দাওয়ায় শিক্ষার এই হাল নিয়ে কোনো দাবি দেখা যায়! শুধু বেতন নিয়ে প্রশ্ন। কখনো শোনা যায় পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা এবং যথেষ্ট উদ্বেগজনক কিন্তু এটাও প্রমাণিত হয়নি যে যথেষ্ট শিক্ষক থাকলেই পড়াশোনা ভালো হবে। মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র বা জুনিয়র হাই স্কুল বন্ধ করার কথা তাহলে ভাবতে হতো না।
ওদিকে শিক্ষাদপ্তর আধুনিকতম হওয়ার জন্য একই তথ্য বিভিন্ন রকম অনলাইন ফর্মে প্রতিনিয়ত চেয়ে যাচ্ছেন, স্কুলের দুএকজন কে এখন ঐ কাজেই ব্যস্ত থাকতে হয়। ছেলেমেয়েদের বেশ কয়েকজনের কাছে ফোন আছে, তা দিয়ে রিলস আর ফ্রি ফায়ার চলছে। অদ্ভুত এক সময় এখন।
তবু বহু প্রয়াস চলছে। এত কিছুর মধ্যেও বহু শিক্ষক আপন তাগিদে পড়াচ্ছেন, শিক্ষা দপ্তরের প্রতিদিনের নতুন নতুন দাবির সাথে তাল মেলাচ্ছেন, স্কুল না আসা ছেলেমেয়েদের বাড়িতে যাচ্ছেন, নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও শিক্ষার্থীদের সময় দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়ানোর মানুষ কম। শিক্ষার গোটা সংজ্ঞাই যে বদলে গেছে তা নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা নেই।
তোতা কাহিনী মনে পড়ে।
'শিক্ষা যদি নাও হয়, খাঁচা তো হইল। পাখির কী কপাল।'