ডিসেম্বরের সূর্য দ্রুত পশ্চিমে ঢলে পড়ে। এসপ্ল্যানেড চারমাথার মোড় মানুষ-ট্রাফিক-ব্যস্ততার দুরন্ত গতির সামনে নাজেহাল। বিশাল বাস, ট্যাক্সি ছুটে আসছে। সেই ভরা যানবাহনের ছুটন্ত গতির দিকে আঙুল তুলে ইন্দু শৌভিককে আদেশ করে—“যাও, এক দৌড়ে পার হয়ে ওপারে পৌঁছও!”
ক-টা বাজে সঠিক জানা নেই। কারণ, আজ ব্রডওয়ে থেকে বেরোনোর মুখে শৌভিকের সস্তার ঘড়িটা ইন্দু তার হাত থেকে টান মেরে খুলে ছুঁড়ে দিয়েছে মাঝরাস্তায়। একটা সরকারি বাস পিষে দিয়েছিল ওটাকে। শৌভিক স্পষ্ট দেখতে পায়, ঘড়ির ভিতরের প্যাঁচালো যন্ত্রপাতি খুলে বেরিয়ে এল। ঠিক যেন অ্যাক্সিডেন্টে ফেটে-যাওয়া মানুষের মাথার ঘিলু। তার একইসঙ্গে গা গুলিয়ে উঠল, সেইসঙ্গে বমি পাচ্ছিল। একটু বাদেই সন্ধে নামবে। তারা কোথায় যাবে জানা নেই। সম্ভবত তারা কোথাও যাবে না। কোথাও পৌঁছবে না। কোনও ডেস্টিনেশন নেই তাদের। আজকের দিনটা শুরু হয়েছিল সকাল এগারোটা নাগাদ, যখন শৌভিক অধীর আগ্রহে ইন্দুর জন্য অপেক্ষা করছিল শোভাবাজার লাল মন্দিরের সামনে। সবাই জানে ভরা অফিসটাইমে কী বিপুলসংখ্যক গাড়ি ছুটে আসে ওই মোড়ে। বাগবাজার থেকে গিরিশ পার্কের দিকে ছুটতে থাকে সেইসব ধাতব গাড়ি। মাত্রই আঠাশ বছর বয়সে শৌভিক কেবল কলকাতার বিরলতম নৈরাশ্যের উপাসকই নয়, সে মৃত্যুবিলাসী। দ্রুতবেগে ছুটে-আসা একেকটা যানকে তার অবিকল মৃত্যুর প্রতিরূপ মনে হয়। যে মৃত্যুর কোনও আদি-অন্ত নেই। যে মৃত্যু কখনোই শ্যামসমান নয়। বরং মর্গের অন্ধকারে থ্যাঁতলানো ইঁদুরের শরীরে বাসা-বাঁধা কীটপতঙ্গের ঘ্রাণ টের পায় সে। ওই ছুটন্ত ধাবমান প্রাইভেট বাসের নোংরা কাদামাখা চাকায়। রাস্তার ওপারে কখন সে দেখতে পাবে ইন্দুর হাল্কা ছুটতে ছুটতে তার দিকে এগিয়ে আসা অবয়ব, অপেক্ষায় থাকে সে। সেইমুহূর্তে তার বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ দুষ্প্রবেশ্য, ঝাপসা ও আলোহীন হয়ে যায়। সে যেন নিজের নিয়তির দিকে পা টিপে টিপে আরও দু-এক কদম এগিয়ে যায়। মৃত্যুর সঙ্গে কথা বলে।
শোভাবাজার রাজবাড়ির মাথা থেকে ঝটপট শব্দে উড়ে যায় একঝাঁক মিশকালো কবুতর!
যেদিন প্রথম সে ঢুকেছিল শ্যামপুকুর থানার ঠিক পিছনদিকে ইন্দু জয়সওয়ালদের দেড়শ বছরের পুরোনো প্রাসাদে, সেদিন কোনও পিছুটান বা আগামীর স্বপ্ন অবশিষ্ট ছিল না তার সামনে। ইন্দুর ছেলের বয়স বারো। তাকে আর্টস গ্রুপ পড়ানোর চাকরি নিয়ে সে প্রবেশ করেছিল দুর্গের মতো ওই বিরাট ভিলায়। যে হাভেলির সিংহদরজার বেশ কিছুটা নতুন করে মেরামতি করা হয়েছে বলেই প্রাচীনতার উপর এই কৃত্রিম মোড়ক এর নিষ্ঠুরতাকে আরও ঢের বেশি বীভৎস করে তুলেছে। ইন্দুর ছেলে, সাকেতের পড়ার ঘর ছিল একতলায়। বেশ কয়েকমাস পড়ানোর পরেও সে জানতেও পারেনি সাকেতের বাবা-কাকা অথবা পরিবারের অন্য সদস্যদের ঠিক কীরকম দেখতে। সামান্য জলখাবার নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াত ইন্দু, সাকেতের মা। সামান্য চোখাচোখি হত তার সঙ্গে। মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মাইনের খামটা ধরে দাঁড়াত এই মহিলা। ঘরের কম-পাওয়ারের আলোয় একদিন সে দেখে ফেলে ইন্দুর গালে নীল শিরার মতো দগদগে পাঁচ-আঙুলের দাগ। কোনও কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠে ইথারসঙ্কেতে। অথবা এইসব আকস্মিক দৈবপ্রেরিত যোগাযোগকে সম্পর্ক বলা ভুল। এগুলো যেন প্রান্ত-আকাশে চকিতে ফুটে-ওঠা বিদ্যুতের ঝলক। যার ঝলসে যাওয়া আলোয় শৌভিক আরেকবার চিনতে পারে নিজেকে। সেই অশোকনগর থেকে কলকাতায় এসেছিল সে। গ্র্যাজুয়েশনের পর আর পড়াশুনো এগোতে পারেনি। পরিবারে সে, মা আর দাদা। বাবা মারা গেছে বহু আগেই। দাদা বিয়ে করে তিন-চার বছর আগে। সামান্য চাকরি-সম্বল এই পিতৃহারা বড়োভাই সেদিন থেকেই টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয় ছোটো ভাইয়ের জন্য। এই অজানা, স্বজনবর্জিত অ্যাপোক্যালিপ্টিক শহর, যেখানে সামান্য একটা সিদ্ধান্ত বা পা ফেলার ভুল খাদের কিনারে তলিয়ে দিতে পারে তার মতো মানুষকে, সেখানে যৎসামান্য টুইশন-সম্বল পথ হাঁটা শুরু হয় এই মফস্সলি যুবকের। ভবানীপুরের এক তস্য গলির ভিতর অবিকল গুদামঘরের মতো একটা মেসে নতুন জীবন শুরু হয় তার। একটা অস্বাভাবিক ছোট্ট ঘরে চারখানা দেড় ফুট চওড়া তক্তপোশ গায়ে গায়ে লাগানো। এতো ছোট ঘর, যে একচিলতে পা ফেলবার সামান্য জায়গাটুকুও নেই। অথচ ঘুম থেকে ওঠার পর মাথার দিকের জানলার পাল্লা খুললেই একটা নির্মীয়মান বহুতলের ফাঁক দিয়ে সূর্য উঠতে দেখা যেত। মফস্সলের ছেলে শৌভিকের স্বভাব খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। কিছুক্ষণ ওই সূর্য ওঠা দেখার পর দরজা খুলে সে বেরিয়ে আসত সামনের সরু গলিতে। পাশের বাড়ি থেকে প্রত্যেক সপ্তাহে গলির মুখটায় পাশের বাড়ির লোকেরা বের করে রেখে যায় একরাশ দামি বিলিতি মদের বোতল। সে একবার পিছন ফিরে ওই তিনতলা বাড়ি আর মনে মনে সেই বাড়ির সদস্যদের মেপে নিত। এরকমই এক সকালে, সেই কলেজের দিনগুলোয় এক প্রফেসরের মুখে শোনা এক আশ্চর্য ব্যাখ্যার কথার মনে পড়েছিল। উনি বলেছিলেন, এই নতুন যুগে গুণিতক হারে গোটা দুনিয়া জুড়ে বাড়বে একটাই শ্রেণি, যার নাম—‘প্রিক্যারিয়েটস’। ‘প্রলেতারিয়েত’ আর ‘প্রিক্যারিয়াস’-এর সংমিশ্রণ এরা। চূড়ান্ত অরক্ষিত, ভরহীন, নির্দিষ্ট স্থায়ী চাকরিহীন কতকগুলো পোকামাকড়ের মতো এরা খুঁটে খাবে তৃতীয় বিশ্বের বিরাট শহরগুলোতে। তারপর একদিন এই পৃথিবীর অলীক নিয়মে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে এরকমই কোনও ঘুপচি মেসবাড়িতে। পলিটিক্যাল সায়েন্স ছিল পাসকোর্সে। অন্য বহু কিছু ভুলে গেলেও এই আশ্চর্য কথাগুলো অবিকল মনে আছে শৌভিকের। আসলে ওই ছোট্ট ঘরে ঘুম আসত না। প্রথম যেদিন সে বোর্ডার হিসেবে থাকতে এল, এমনিতে সেরকম কোনও খারাপ লাগা তৈরি হয়নি প্রাথমিকভাবে। শুধু মাঝরাত্তিরে পাশের চৌকিটা অস্বাভাবিক নড়ছে টের পায় সে। ঘরে আবছা ল্যাম্পের আলোয় বুঝতে পারে পাশের ছেলেটা চাদরের নীচে হস্তমৈথুন করছে। এতো অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে সে নিজের লিঙ্গসঞ্চালন করছে, গোটা মেসের ঘরটাই যেন এক্ষুনি ভেঙে পড়বে, শৌভিকের মনে হয়। সে, পাশ ফিরে ফের ঘুমোনোর চেষ্টা করে। আর কী আশ্চর্য! ঘুমিয়েও পড়ে। না। ঘুমের ভিতরে কোনও স্বপ্নের চলচ্চিত্র দেখার অভ্যাস নেই তার। বস্তুত, তার কোনও স্বপ্ন আছে বলে সে নিজেও মনে করে না। বরং প্রতিমুহূর্তে সে টের পায় নিজের বেঁটে, লঘু, ভারহীন অস্তিত্ব আসলে ন্যাতানো পলিথিন প্যাকেটের মতো, হাওয়া ফুরিয়ে গেলেই যা চেপ্টে যাবে। এরকম মানুষের জীবনেও প্রেম আসতে পারে না কি? সে নিজেই বিশ্বাস করত না, যতোদিন উত্তর কলকাতার এই দুর্গের মতো খাদক বাড়ির প্রাইভেট মাস্টার হয়ে কাজে যোগ দিল সে আর এই বাড়ির ছোটোবউ নানা অছিলায় একটু একটু করে নিজেকে তার সামনে দু-এক কথায় এরকমভাবে মেলে ধরল, যেন সে তার কতোদিনের আত্মীয়। তার স্বজন। যেন পুরোটাই ম্যাজিক। পুরোটাই জাদুবাস্তবতা।
রাজস্থানের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জয়সওয়ালরা তুলে এনে বিয়ে করেছিল ইন্দুকে। কেবল ইন্দু নয়, এই বাড়ির তিন বউই সুদূর রাজস্থানের দেশঘর থেকে তুলে আনা। কলকাতায় সাতপুরুষের ছড়ানো ব্যাবসা থাকলেও এই পরিবারের সামন্ত-সংযোগ এখনও অটুট। প্রত্যেক বছর বিপুল খাদ্যশস্য জোগান দেয় তাদের গ্রামীণ জমিদারি। এই বন্দোবস্তও ওই দেড়শ বছরেরই পুরোনো। এরা বাড়ির মেয়েদের মুখ্যত সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র এবং স্বাভাবিক যৌনদাসী ছাড়া আর কিছু ভাবে না। ইন্দুর গালে যে পাঁচ আঙুলের নীল দাগ দেখে চমকে উঠেছিল সে, পরে জানতে পারে, ইন্দুর গোটা শরীরই এরকম হাজার চাবুকের দাগে ভরা। নিতান্ত খাপছাড়া, অখাদ্য জাতের জলচর মাছ এই গ্রাম্য মেয়েটার ভিতর কোন অদম্য জেদ কাজ করত বোঝা দুষ্কর, অথচ এ কিছুতেই স্বামীর বশ মানেনি। ওর স্বামী নবীন জয়সওয়াল ছিল রাতেরবেলা বদ্ধ মাতাল, স্থূলকায় এবং পুরুষত্বহীন। প্রথমদিন সে যখন বউকে নিয়ে বিছানায় ওঠে, তার লিঙ্গের ক্ষুদ্র মাপ দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে নতুন বউ ইন্দু। এই তীব্র অপমান সহ্য হয় না পুরুষপ্রবরের। নবীন আলমারি থেকে বের করে চামড়ার বেল্ট খুলে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে বউকে। আরও আশ্চর্য! এই ঘটনায় প্রথম সোচ্চার সমর্থন জানিয়েছিল যে মহিলা, সে ইন্দুর শাশুড়ি। এই পরিবারে না কি বেয়াদপ মেয়েছেলেকে চাবুকের ডগায় রাখাই রীতি! কথায় কথায় স্বামীর নিরাপত্তাহীনতা, অক্ষম পৌরুষের আস্ফালন, বাকি দুই ভাইয়ের তুলনায় কম রোজগার নিয়ে ইচ্ছে করে স্বামীকে খোঁটা দিত ইন্দু। ছেলে তখন বড়ো হচ্ছে। অবলীলায় ছেলের চোখের সামনেই এলোপাথারি মারধর করত নবীন, তার বউকে। এই বাড়ির বাকি দুই বউ কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। ইন্দু, ওই প্রত্যন্ত গ্রামে বড়ো হয়েও যে কীভাবে এতোটা জেদি, একগুঁয়ে, প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠল সে এক জ্যান্ত রহস্য।
যেদিন, একথা-সেকথার পরে ইন্দু প্রথম শৌভিককে জানাল সে ঘর ছাড়বে, শৌভিকের গড়পড়তা মন কু ডেকে উঠল। সে একটু অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল:
--আর তোমার ছেলের কী হবে?
--জাহান্নামে যাক ও...
--কীভাবে বলতে পারলে এরকম?
--কেউটের বাচ্চা কেউটেই পয়দা হয়। ওকে দেখলে আমার কেবলই মনে হয় আরেকটা নবীনের জন্ম দিয়েছি... এগুলো সবকটা অবিকল এক!
--তবু, ও তোমার সন্তান...
--হ্যাঁ। ও বড়ো হলে একইভাবে আমার গায়ে হাত তুলবে। অনেক সহ্য করেছি। আর নয়...
--আমার কিন্তু চালচুলো নেই, ইন্দু!
--ওরে আমার মরদ এলো রে! তোমার উপর ভরসা করি না কি আমি?
এটাই ইন্দু। শৌভিকের উপর ভরসা করে না অথচ ওর হাত ধরে এই জেলখানার কূপ থেকে পালাতে চায়। অথচ তাদের পালানোর কোনও নির্দিষ্ট জায়গা নেই। এই কলকাতা শহরে এক অতি দূরসম্পর্কের আত্মীয়া থাকে ইন্দুর। টালিগঞ্জে বাড়ি তার। কিন্তু তাদের সংসারে গিয়ে ওঠার কোনও প্রশ্নই নেই। আদ্যন্ত গোঁড়া স্বভাবের ওই দিদি তার স্বামী-সন্তান নিয়ে একটেরে ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকে। সেখানে গেলে ওরা ফের জয়সওয়ালদেরই খবর দেবে এবং ইন্দুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসে চুলের মুঠি ধরে ফেরত নিয়ে যাবে ওকে। অনার কিলিং ভাগ্যিস এখনও ইউপি-রাজস্থান-হরিয়ানার মতো ছড়ায়নি কলকাতায়। নয়তো খোলা রাস্তায় শৌভিককে গুলি করে মারত ওরা। শৌভিক অল্প কয়েকদিনের ভিতরেই খেলাটা ধরতে পেরেছিল, কেন এই বাড়ির লোকেরা বেছে বেছে গোটা শহরে কোনও পরিজন নেই, এরকম মেয়েদের বিয়ে করে আনে। এটা পরোক্ষ মানসিক চাপ সৃষ্টি করাই এর কারণ। চোখের ইঙ্গিতে কথা হয়েছিল সেইদিন। আর সামান্য কিছু পরিকল্পনা। বলা ভালো প্ল্যানের ভগ্নাংশ। যে, তারা জাস্ট বেরিয়ে পড়বে। কোন রুট ধরে এগোবে জানা থাকবে না কারও। একটা খতরনাক টাইম ট্রাভেল। শৌভিকের মনে হয়। তার বারবার মনে পড়ে অশোকনগরের নিজেদের একটুকরো ছোট্ট বাড়ির কথা। ঠিক বাড়ি নয়। ওটা ছিল বেড়ার ঘর, টিনের ছাউনি দেওয়া। যে বাড়িতে তার উদ্বাস্তু বাবা ’৭১-এর যুদ্ধের পরে এসে উঠেছিল। দাদা তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো। চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেছে তার পরিবার। বাবা ট্রেনে-বাসে হকারি করত। মাত্র একচল্লিশ বছরে বাবা মারা যায়। পেটে একটা অসহ্য ব্যথা হয়েছিল বাবার। কোনও চিকিৎসা হয়নি। ডাক্তার ডাকার মতো সামর্থ্যও ছিল না তাদের। মাত্রই সতেরো বছর বয়সে সংসারের হাল ধরল দাদা। আস্তে আস্তে তাদের একতলা টিনের বাড়ি পাকা হল। সে ততোদিনে কলকাতায় চলে এসেছে। বিয়ের পর থেকেই বদলে গেল দাদা। তখন ওটা দাদার সংসার। মা বেঁচে থাকলেও দাদা-বৌদিই বাড়ির সর্বেসর্বা। কর্তৃত্ব জিনিসটা কখনোই মেনে নিতে শেখেনি শৌভিক। কোথা থেকে এল এই বেয়াড়া ঔদ্ধত্য, সে নিজেও জানে না। কিন্তু মা বলত, এই স্বভাব তার জীবনে নিয়তি হয়ে ফিরে আসবে বারবার। ঠিক সেটাই ঘটল। তার নিয়তি হয়ে জীবনে এল ইন্দু। যে নিজেও, তারই মতো ঘাড়ট্যারা। উদ্ধত। বেপরোয়া।
শোভাবাজার রাজবাড়ির পিছনের গেটের কাছে ইন্দুর চেহারা, অবয়ব একটু একটু করে পরিস্ফুট হচ্ছিল শৌভিকের। যেন কিছুটা উৎকণ্ঠা, কিছুটা সতর্কতা নিয়ে জোরকদমে হাঁটছে সে। কাঁধে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ। বোঝাই যাচ্ছে সে পিছুটান ফেলে রেখে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে আজ। উল্টোদিকে শৌভিকের সঙ্গে কিন্তু কোনও ব্যাগ নেই। এমনকী পকেটে পার্সও নেই। আসলে শৌভিকের এমনিতেও কোনও পিছুটান নেই। মাঝেমধ্যেই সে রাতেরবেলা পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়ে কলকাতার রাস্তায়, রাতের জীবন দেখবে বলে। একাধিকবার ফুটপাতে শুয়ে থেকেছে সারারাত। ভিখারি-চোর-মাতাল-কাগজকুড়ুনিদের সঙ্গে। এরকমই এক রাতে, তার মনে আছে, এক স্বল্পবয়সি ভিখারিনি, যার মরদ একসপ্তাহ অন্য মেয়ের ডেরায় কাটিয়ে ফিরে এসেছে, লোকটাকে চ্যালাকাঠ হাতে শাসিয়েছিল—“আর কোনওখানে নয়। তোর ঠিকি ওইখানটায় মারব। মর্দানি জন্মের মতো ঘুচে যাবে, বাঞ্চোত”। আজও কথাগুলো কানে বাজে। চলন্ত বাসের ভিড় টপকে, ইন্দু ছুটে এসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল তার সামনে। আশ্চর্য! ইন্দুর মুখে কোনও উদ্বেগ নেই। কোনও টেনশন বা আতুরতা নেই। তার দুটো চোখ, ওই তীব্র আওয়াজ, লোকজনের ভিড়েও শৌভিক টের পায়, গভীর দিঘির জলের মতো শান্ত। তার ভয় করে ওই চোখের দিকে তাকাতে। তবে কি ইন্দুও তারই মতো মৃত্যুকে বরণ করে নেবার খেলায় স্বেচ্ছায় মেতেছে? এই আশ্চর্য মোলাকাত আর বেখাপ্পা পথ-চলার শুরু কীভাবে হল, ভাবতে ভাবতেই সে টের পায়, তারা ফুটপাত ধরে হেঁটে গিরিশ পার্ক ক্রস করে ফেলেছে। আরও খানিকটা হাঁটার পরে যখন সামান্য হাঁফ ধরে দুজনের, শৌভিক বলে:
--আমি কিছু খেয়ে আসিনি...তুমি?
--আমিও না। খাও কিছু...
--তুমি খাবে না?
--হ্যাঁ। চলো ওই সামনের দোকানটায় গিয়ে বসি। বেঞ্চি আছে একটা...
--পাঁউরুটি-ঘুগনি খাবে?
--কেন? তুমি খাও না?
একটা ফুটপাতের দোকান। পাশের বেঞ্চিতে বসে পড়ে দুজনে। অদূরে, পার্ক-বরাবর একটা ছেঁড়া- জামার বাচ্চা মেয়ে হাঁ করে তাদের দিকেই চেয়ে ছিল। ঘুগনির বাটি হাতে তুলে নেবার পর বাচ্চাটা আর ওদের থেকে চোখ সরাতেই পারছিল না। শৌভিক, বরাবরের মতো নিজের রুটি থেকে ছিঁড়ে বড়ো অংশটা এগিয়ে দিল মেয়েটার দিকে। বাচ্চাটা একমনে ফুটপাতের উপর বসে পাঁউরুটি চিবোতে শুরু করে। ইন্দু প্রখর চোখে তাকিয়ে দেখে বাচ্চাটাকে। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে। বাচ্চা মেয়েটা ছুটে আসে। ইন্দু নিজের ঘুগনির বাটিটা পুরোটাই তুলে দেয় ওর হাতে। একঝলক হাসির সঙ্গে মেয়েটা হাতে তুলে নেয় ঘুগনির বাটি...শৌভিক বলে ওঠে:
--আর এক বাটি ঘুগনি নেব?
--কেন?
--তোমার তো খাওয়া হল না কিছুই...
--তুমি খেতে পেরেছ?
--না। পারিনি। পারা সম্ভব নয়।
--শোনো মাস্টার। এটা একটা খেলা।
--কী খেলা?
--এখনও বোঝোনি আমি কেন বেরিয়ে এলাম এককাপড়ে? তাও তোমার মতো একটা লোকের সঙ্গে?
--না। বুঝিনি। শুধু জানি তুমি ওই খাঁচা থেকে পালাতে চেয়েছিলে!
--সে তো বটেই। কিন্তু কোথায় উঠব আমরা? তোমার ওই ঘুপচি মেস-এ?
--না। প্রশ্নই ওঠে না...
--তোমার সঙ্গে এইমুহূর্তে কতো টাকা আছে?
--হাজার দুয়েক!
--আমার কাছে ওই হাজার তিনেক মতো...
--এই টাকা তো দ্রুত ফুরিয়ে যাবে!
--মাস্টার! তোমার ভরসায় আমি রাস্তায় নামিনি! আমার অন্য ভাবনা রয়েছে...
--কী ভাবনা?
--সেই ভাবনাটা বোঝানোর জন্য আজ রাস্তায় এলাম। তাও তোমার মতো একটা লোকের সঙ্গে! ইন্দুর চোখে বিদ্রূপ আর করুণার ঝলক...
--আমি শুধু একটা লোক তোমার কাছে?
--না রে! তু আমার মরদ! হেসে লুটিয়ে পড়ে ইন্দু। পাশের ভিখিরি বালিকা ঘুগনির বাটি হাতে অবাক চোখে তাদের দেখে...
মাথা নীচু করে বসে থাকে শৌভিক। হঠাৎ মনে পড়ে তার, অশোকনগরে তাদের পাড়ায় কিছু ছেলেমেয়ের নামই হয়ে গিয়েছিল—‘যুদ্ধশিশু’। ’৭১-এর যুদ্ধের সময় যেসমস্ত হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করে গর্ভবতী করে দিয়েছিল খানসেনারা, তাদের পিতৃপরিচয় কারও জানা নেই। তাদের মায়েরা কেউ ছিল কুমারী, কেউ বা ছিল বিবাহিতা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অথবা তার পরেও যখন শরণার্থীর ঢল নামল পূব থেকে পশ্চিমবাংলায়, ওই ধর্ষিতা মায়েদের বাচ্চারা বড়ো হয়ে উঠল আর পাঁচটা স্বাভাবিক বাচ্চার মতোই। ধর্ষিতার স্বামী, বাপ-মা, আত্মীয়-পরিজন সকলেই অনায়াসেই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল এই পিতৃপরিচয়হীন ছেলেমেয়েদের। কিন্তু, এরকম ছেলেদের মধ্যে যে গুটিকতক বন্ধুবান্ধব ছিল শৌভিকের, তাদের সঙ্গে আড্ডা দেবার সময়, খেলতে যাবার সময়, তার এক একবার মনে হত, তার নিজের জীবনও যেন অতীতশূন্যতায় বাঁধা। যেরকম আজ এই সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের ফুটপাতে বসে তার মনে হচ্ছে কোনও পূর্বসূত্র ছাড়াই যুদ্ধের ধর্ষিত কানীন সন্তানের মতো ছিটকে এসেছে সে এই নরখাদক শহরে। সঙ্গে একটি উন্মাদ মেয়ে, যার উদ্দেশ্য, মতিগতি কিছুই বোঝে না সে। এমনকি সে এটাও বোঝে না কেন সে নিজে এই মেয়েটির একদিনের কথায় রাজি হয়ে গেল এরকম পরিণামহীন হঠকারিতায়। ততোক্ষণে ফের হাঁটতে শুরু করেছে তারা। কী চাইছে মেয়েটা? শৌভিক বুঝে উঠতে পারে না!
জিপিও পেরিয়ে যায় তারা। উষ্ণ দুপুরের আঁচ এসে লাগছে গায়ে। এর আগের সময়টুকু রাস্তায় আরও একাধিক তুচ্ছ অথচ রোমাঞ্চে ঠাসা মুহূর্ত তাকে উপহার দিয়েছে ইন্দু। বৌবাজার ক্রসিং পেরিয়ে আসার সময়, সিগন্যাল খোলা, দুপাশে চলমান অজস্র যানবাহনের ভিতর শৌভিকের হাতে হাত রেখে সে ছুটে পার হয়েছে সেই বিপজ্জনক রাস্তা, এমনকী পুলিশের উদ্যত ভ্রূকুটি উপেক্ষা করেও। একমুহূর্তের জন্য শৌভিকের মনে হয়, মেয়েটা কি পাগল? পরক্ষণেই আশৈশব নিজের নিরালম্ব বেড়ে ওঠার একান্ত ব্যক্তিগত ইতিহাসের সঙ্গে নিজের জীবনের এই অভাবিতপূর্ব ঘটনার আন্তঃসূত্র খুঁজে বের করেই তার মনে হয়, তার মতো মানুষের জীবনে এটাই তো অত্যন্ত বাস্তব। এরকমই হওয়ার কথা সবটাই। অথচ শরীরে শরীরের ঘষা লেগে যাওয়া, মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া চকিত ধোঁয়া-ওঠা-এরোপ্লেনের অপসৃয়মান ক্ষীণ অস্তিত্ব, নীচে পথচলতি অজস্র মানুষ, ট্রাফিক, গাড়ির হুল্লোড়ে তার মনে পড়ে আজ তার জন্মদিন। জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া আরেকটা উদ্যাপন। অনেক দিন আগে অব্দি মা তার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকত সে এই এই দিনটায় অশোকনগর ফিরবে বলে। অথচ মায়ের প্রতি আর কোনও টান অনুভব করে না সে আজ আর। ইন্দু জানেও না আজ শৌভিকের জন্মদিন। ওকে বলার প্রয়োজনও নেই। একটু দ্রুত হাঁটছে ইন্দু। পিছন থেকে ওর দিকে একঝলক তাকায় শৌভিক। ইন্দুর শারীরিক গড়ন একেবারেই আকর্ষণীয় নয়। ছোটোখাটো চেহারা ওর, যেন কী একটা ব্যস্ততা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছে। আর সেই মুহূর্তেই শৌভিকের চোখে ভেসে ওঠে তাদের অশোকনগর টাউন ছাড়িয়ে বিস্তীর্ণ এয়ারোড্রামের ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওখানে মার্কিন আর ব্রিটিশ এরোপ্লেন নামত। স্বপ্নের ভিতর জাম্পকাট হয়ে ভেসে ওঠে কতো ভাসমান প্যারাট্রুপারের ছবি। তারা নামছে আর নামছে। এরকম ঘোর কেন আজও লাগে তার মতো চালচুলোহীন মানুষের? হঠাৎ ইন্দুর ডাকে সম্বিৎ ফেরে:
--হাঁ করে কী ভাবছ?
--কোথায়? আমি তো এগোচ্ছি!
--এগোচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ তুমি?
--তুমি যেখানে যাচ্ছ! বিষণ্ণ হাসে যেন সে!
--চলো আরেকবার সিগন্যাল ভাঙি...
--পাগল তুমি? এইবার নির্ঘাত চাপা পড়বে, ইন্দু...
--ওরে আমার মরদ রে! খিলখিল করে হেসে ওঠে ইন্দু। সেই হাসিতে একটা মরীয়া চেহারা!
--হেসো না! শৌভিক বলে, কিন্তু তার গলায় কোনও প্রত্যয় নেই...
--আমি তো মরেই ছিলাম, এতোগুলো বছর...
--আজ তো আমার সঙ্গে আছো ইন্দু। এখন রাস্তায় আমরা। মরবে কেন?
সেদিন ব্রডওয়ের কোণের টেবিলে বসে আমার সঙ্গে পরপর তিন পেগ হুইস্কি খেল ইন্দু। শৌভিকের নেশা করার তেমন অভ্যাস নেই। ভবানীপুরের মেসে মাঝেমাঝে কেউ না কেউ বোতল কিনে আনত। খাওয়া হত তখন। সেও সামান্যই খেত। যদিও তার নেশা হত না কখনও। ইন্দুর বর নবীন রোজ রাতে নেশায় চুর হয়ে ফিরত। খর চোখে স্বামীকে দেখত ইন্দু। অপেক্ষা করত রাতের প্রথম মারটা কখন তার গালে এসে পড়ে। আজ মদের গ্লাস হাতে নিয়ে ইন্দু তার ছোটোবেলা, গ্রামের বাড়ির কথা বলতে আরম্ভ করল। রাজস্থানের শিকরে তার বাড়ি। এগারো ক্লাস অব্দি পড়েছিল গ্রামে। তারপর বিয়ে হয়ে যায়। গোটা গ্রামের গরিব চাষীরা লড়াইয়ে নেমেছিল সরকারের বিরুদ্ধে। সেই লড়াইয়ে ওর বাবা, গ্রামের সরপঞ্চ, জমিদারের লোকেদের হাতে খুন হয়ে যায়। মৃতদেহটা খালের ধারে পড়েছিল দু-দিন। এমনকী, পুলিশ অব্দি আসেনি বডি নিতে। তারপর, এক রাতে গোটা গ্রামের মানুষ জমিদারের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওর বাড়ির মেয়েরাও গেছে মিছিলে, ইন্দু বলে...
--তুমি অমরা রামকে চেনো?
--না। কে সে?
--আমাদের এমএলএ। জেলে গেছে কতোবার...
--এমএলএ? কোন পার্টির?
--আমরা বলতাম লাল পার্টি?
--তোমার দেশেও লাল পার্টি আছে?
--আছে। আমাদের ডিস্ট্রিক্টে আছে...
--তোমার নেশা হয়ে যাচ্ছে ইন্দু!
--আমার খুন এখনও গরম, মাস্টার...শৌ ভিকের কথায় পাত্তাই দেয় না ইন্দু...
--এরপরেও কী করে এদের বাড়িতে বিয়ে হল তোমার?
--বাবা মরে গেল। মা বাচ্চাকালে মরে গেছে। আমাকে আর দিদিকে জোর করে বিয়ে দিল আত্মীয়রা...
--আর খেয়ো না, ইন্দু!
--না। এবার উঠব আমরা। চলো। বিল দিতে বলো...
--চলো। এখান থেকে কোথায় যাব আমরা, ইন্দু?
--জানি না। আমি জানি না...
এই প্রথম ইন্দুর দুই চোখে মৃত্যুর হিম, নিস্পন্দ ছায়া দেখতে পায় শৌভিক... তার শরীর কেঁপে ওঠে!
রাজস্থানের এক দরিদ্র জেলার কৃষক আন্দোলনের রক্ত বইছে এই মেয়ের শরীরে। এর যাবতীয় তেজ সেই রক্তের। রক্ত কথা বলে। কিন্তু এই ভয়াল কলকাতা শহরে স্বজনহীন, আত্মীয়হারা এই মেয়েটার সঙ্গে কেউ নেই। শৌভিকের থাকা-না-থাকা সমান। শৌভিক যদিও রাজনীতি বোঝে না। সে জানেও না, এই বাংলার বাইরে দেশের ঠিক কোথায় কোথায় লাল-পার্টির অস্তিত্ব আছে। কলেজে পড়ার সময়, রাজনীতি জিনিসটাকেই এড়িয়ে চলত সে। আজ, এই পড়ন্ত বিকেলের আলোয়, ব্রডওয়ে থেকে বেরোতে বেরোতে, একঝলক ইন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে রাজনীতি কথাটার অন্য একটা মানে খুঁজে পায় শৌভিক। লেখাপড়ায় সে বরাবরই খুব সাধারণ। বেশ কিছু বছর তো হয়ে গেল কলেজ ছেড়েছে। দরজায় দরজায় কম ঘোরেনি সে। না। কোনও স্থায়ী আশ্বাস আজও জোটেনি তার...চকিতে আজকের এই বিপজ্জনক খেলায় জড়িয়ে পড়ার তাৎপর্য টের পায় সে। মৃত্যুর নিশ্চিত নিয়তির দিকে ছুটে যাচ্ছে সে। আর ইন্দু। দুজনেই...ভাবতেও কিছুটা অবাকই লাগে, সেই সকাল থেকে তারা দুজনেই রাস্তায়। রাস্তার একদিকের ফুটপাত ধরে হেঁটে গেছে তারা। কেবল একবার, জেব্রাক্রসিং অস্বীকার করে উন্মাদের মতো যানবাহন টপকে ছুটে গেছিল ইন্দু। আর এখন, ইন্দুর দুই চোখে এক মারণ নেশা। যেন এক প্রাণঘাতী যুদ্ধে চলেছে এই একাকিনী মেয়ে।
আরও আশ্চর্যের! ইন্দুর উদাত্ত ঝোঁক শৌভিকের রক্তেও চড়ে গেল বোধহয় আজ। এসপ্ল্যানেডের ওই চলন্ত বিশাল তিনমাথার মোড় অনায়াসে ছুটে পার হয়ে গেল সে। তার একটুও ভয় করল না...স্টেটবাস গুমটির দিকটায় পৌঁছে হাঁফাচ্ছিল সে। জওহরলাল নেহেরু রোডের দিক থেকে উন্মুখ বাসগুলো ছুটে আসছে মৃত্যুদূতের মতো...শৌভিক বিস্ময়ে স্থির হয়ে যায়। দ্যাখে, ইন্দু ওই ভরা রাস্তা অনায়াসে পাখির মতো প্রায় উড়ে পার হয়ে আসছে! তারও দু-চোখে মরীয়া রোখ। অতিক্রম করে যাবার...
তখন সূর্য ডুবে গেছে। তার সামান্য অস্তচ্ছটায় মায়াবী গোটা ধর্মতলা চত্বর। শৌভিক নজর করে...একটা এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে মাঝ-আকাশের বুক চিরে!
বিবাদী বাগের দিকটায় হাঁটতে থাকে তারা। তার পকেটে যা ছিল, প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে গেছে ব্রডওয়েতে। খানিকটা এগিয়ে রাস্তাটা যেখানে গ্রেট ইস্টার্নের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেই মুখটায় প্রবল তেষ্টা পায় তাদের। মশলা লেবুর সরবত খায় তারা। ফের পথ হাঁটতে শুরু করে। ইন্দু তার ঘামে ভিজে-যাওয়া সালোয়ারের ওড়না দিয়ে একবার মুছে নেয় নিজের মুখ। একবার মুছিয়ে দেয় শৌভিকের কপাল। ক্রমশ আরও বেশি শারীরিক নৈকট্যে আসতে থাকে দুজনে। কেউ যদি প্যানোরামিক ভিউ থেকে গোটা ধর্মতলা-বিবাদী বাগ চত্বরকে ক্যামেরায় ধরত, এই শহরের বিরাট ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে এই দুটি ক্ষুদ্র প্রাণীকে লেন্সবন্দী করত, বোঝা যেত কতো তুচ্ছ ওরা। এই শহরের তাণ্ডব, নিষ্ঠুরতা আর অলাতচক্রের ভিতর যেন মুহূর্তে অবলুপ্ত হয়ে যেতে পারে এরকম দুটো প্রাণী ওরা। অথচ কেউই জানবে না, ওদের এই আকস্মিক, খাপছাড়া, দুর্নিবার মর্তুকামের ভিতরেও কীভাবে যেন জন্ম নিয়েছে ভালোবাসার কস্তুরী। যা তাদের নৈকট্যে আনছে। স্টিফেন হাউজের আগের মোড়ে পৌঁছে শৌভিকের হাতের তালুতে নিজের হাত মিশিয়ে দিল ইন্দু, স্বেচ্ছায়। শৌভিক বরং আড়ষ্ট। সে আজকের পুরো ঘটনাবলির কোনও ব্যাখ্যা নিজেই খুঁজে বের করতে পারছে না...
আকস্মিকভাবে এরপর একপশলা বৃষ্টি পড়ে। আরও হঠাৎ করেই রাতের স্ট্র্যান্ড রোডের মায়াবিনী কুহকের ভিতর নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে ওঠে চাঁদ। তখনও বৃষ্টি থামেনি। আকাশ থেকে জল ঝরতেই তারা টের পায়, আজকের এই অসময়ের বৃষ্টির জন্য তারা আদৌ প্রস্তুত ছিল না। ছাতা নেই তাদের সঙ্গে। তাই শিপিং কর্পোরেশনের অফিসের উল্টোদিকে একটা খালি চৌকির মাথায় টাঙানো ত্রিপল দেখে তারা ঢুকে পড়ে সেখানে। এটা এক পথভিখিরির সংসার। কোনও কারণে ফাঁকা পড়ে আছে। সেই ভিজে কাঠের তক্তার উপরে উঠে বসে তারা। শৌভিকের কাঁধে মাথা রাখে ইন্দু। এইসব মুহূর্তেই ইন্দুর মনে পড়ে নিজের গ্রামে ফেলে আসা শৈশবের দিনগুলোর কথা। সে একটানা কথা বলে যায়। শৌভিকের নিজেকে অসহায় লাগে। সে বুঝে উঠতে পারে না ইন্দুর সঙ্গে তার সম্পর্কের ধরণ ঠিক কী! এটাই কি প্রেম? সে কোনওদিন বিশ্বাস করেনি তার জীবনেও কোনও নারী আসতে পারে। তাই বলে এরকম ঝড়ের মতো, মৃত্যুর নিকষ কালো দামাল অন্ধকারের মতো কেউ এসে পড়বে তার জীবনে? কোনওদিনও ভাবেনি সে! অকস্মাৎ, ইন্দু তার গা ঘেঁষে রয়েছে, শৌভিকের মনে হল, এইমুহূর্তে ইন্দুর শ্বশুরবাড়িতে ঠিক কী ঘটছে? বাড়ির বউ এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে— পরিবারের নিটোল থাকবন্দে এই বিপর্যয় জয়সওয়াল-বংশে সম্ভবত এই প্রথম! চেনা লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও খোঁজ না পেয়ে ওরা কি পুলিশে খবর দিয়েছে? পুলিশ ভ্যান কি ওদের দুজনকে খুঁজছে এইমুহূর্তে? কিন্তু এরপর কী? ইন্দুর আর কোথাও ফেরার কোনও পথ নেই। নিজের রাজস্থানের পরিবার আজ ওর জীবনে ধূসর ছবির মতো হয়ে গিয়েছে। কলকাতায় ওই চারজনের মেসে ওকে নিয়ে ওঠা যাবে না। একমাত্র পথ ওর জন্যই একটা নতুন মাথা-গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করা। নিজের সামান্য রোজগারকে বাড়িয়ে অন্তত দুটো লোকের পেট চালানোর মতো সংস্থান করে নেওয়া। কিন্তু ইন্দু কী চাইছে? ইন্দু কি থাকতে চাইবে তার সঙ্গে? এরকম জেদি, একরোখা, তীব্র আত্মসম্মানসম্পন্ন মেয়ে এর আগে কখনও দেখেনি শৌভিক। কিন্তু সে এইমুহূর্তে বুঝতে পারছে, ইন্দুর সঙ্গে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। সেই বন্ধনের নাম কী, তা সে জানে না। কিন্তু এটা এমনই এক গড়ে-ওঠা সম্পর্ক, যাকে আর অস্বীকার করা তার পক্ষে সম্ভব নয়!
রাত বাড়ে। যার চৌকি-ত্রিপল, সে ফিরে আসে। ফলে ফের বাস্তুচ্যুত হয় তারা। এবার রাতের প্রায়-শুনশান স্ট্র্যান্ড রোড ধরে হাঁটতে থাকে দুজনে। এখন আকাশ তারায় আলোয় উজ্জ্বল। ফলন্ত গোল চাঁদ। একছিটে মেঘ নেই কোথাও। ইন্দু একটা পাতলা চাদর গায়ে দিয়েছে। শৌভিকের গায়ে হাফ-হাতা সোয়েটার, যাতে শীত আটকাচ্ছে না। তার মাফলার নেই। হাওড়া ব্রিজে ওঠে তারা। দুপাশে ভিখিরি, পাগল, ভবঘুরে, বেশ্যা, হিজড়েদের আনাগোনা। একটা দুটো ট্যাক্সি-প্রাইভেট কার। ব্রিজের মাঝখানটায় এগোতে থাকে তারা। একদম লোহার রেলিং-এর কিনার ঘেঁষে এগোয়। মাঝরাত এখন। ঘড়ি নেই। কিন্তু ব্রিজের মাথায় গ্লো-সাইন ঘড়িতে রাত দুটো ষোলো। শৌভিক ব্রিজের রেলিং-এ পিঠ দিয়ে দাঁড়ায়। তার শরীরের উপরে ঝুঁকে পড়ে ইন্দু। ইন্দুর চোখে আয়ত গভীরতা। যেন সে বহুদিনের অজস্র না-বলা কথা বলবে বলে নিজের শরীরের ভরকেন্দ্র বদলে ফেলেছে। সেই হিম রাত, উজ্জ্বল চাঁদ, দিগন্তপ্লাবী গঙ্গার জলকে সাক্ষী রেখে শৌভিককে চুমু খায় ইন্দু। গোটা গঙ্গানদীর বুকে অসংখ্য স্টিমার, নৌকোর সারি, মন্থর নদীর জলে মুহূর্তে মুহূর্তে চাঁদের ভেঙেচুরে যাওয়া, আর এক কূলপ্লাবী ঠান্ডা হাওয়া যার উৎস আর গন্তব্য অজানা। ইন্দুর দাঁত গভীরভাবে বসে যায় শৌভিকের ঠোঁটে...
--এরপর?
--এরপর আর কিছুই নেই, মাস্টার... গল্পটা ফুরিয়ে গেছে!
--কিন্তু এইভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে না সবকিছু...
--তুমি এখনও নাদান শৌভিক। তুমি কিচ্ছু বোঝো না...
--কী বুঝি না আমি?
--কিসের পর কী হয়। তুমি জানো না...
--তুমি জানো?
--জানি তো!
--তাহলে বলো, এরপর কী?
--পিছনে মা গঙ্গা। গঙ্গার বুকের ঢেউ!
--মানে? কী বলতে চাইছ তুমি? খোলসা করো...
--আমায় ভালোবাসো, মাস্টার?
--বাসি ইন্দু। আগে জানতাম না। বাসি...
--কখন জানলে, বাসো?
--যখন একমুহূর্তের ভাবনায় সবটুকু ফেলে চলে এলে...
--সে তো আমি আসতামই! কিন্তু এইবার আমি যা বলব, তুমি তাই করবে...
--কী করব আমি? বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে শৌভিকের...
--আমায় আটকিও না মাস্টার...
--কোথায় যাবে তুমি?
ইন্দু জবাব দেয় না। তার স্থির দূরগামী চোখ নদীর বিস্তীর্ণ গতিপথ ধরে এগিয়ে চলে!
--ঝাঁপ দাও মাস্টার!
--তুমি পাগল, ইন্দু... থামো। কোরো না এরকম...
--চলি। তুমি আসবে আমার সঙ্গে?
--দোহাই তোমার। আমরা নতুন করে শুরু করব সবকিছু... প্লিজ, ইন্দু...
--ঝাঁপ দেবে আমার সঙ্গে?
মন্ত্রমুগ্ধর মতো ঘটনাপরম্পরা দেখে যায় শৌভিক। তার সামনে পাখির পালকের মতো ভাসতে ভাসতে রেলিং বেয়ে উঠে গার্ডার টপকে নদীর বুকে ঝাঁপ দেয় ইন্দু। অকস্মাৎ শৌভিকের মনে পড়ে, আজ দুপুরে ইন্দু একবার জানতে চেয়েছিল, শৌভিক সাঁতার জানে কি না! সে, ইন্দু, না কি সাঁতার শেখেনি ছোটোবেলায়। শৌভিকও জানে না সাঁতার। যদিও তাদের দুজনেরই শিকড় গ্রাম আর মফস্সল। চারপাশ থেকে একঝাঁক লোক ছুটে আসছে। থমকে গেছে কয়েকটা গাড়ি। ট্রাফিক পুলিশের হুইস্ল আর বুটের শব্দ শুনতে পায় শৌভিক। সে আর একমুহূর্ত দেরি করে না। গার্ডার টপকে ঝাঁপ দেয় নদীর ঘূর্ণিতে। তাদের দেহ কোথায় ভেসে যাবে, কোথায় হারিয়ে যাবে, কেউই জানবে না। হয়তো পরদিন ব্রিজ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের কোনও কংক্রিটের বোল্ডারে ইন্দুর ওড়না-জড়ানো মৃতদেহ ভেসে উঠবে। হয়তো শৌভিকের দেহ তলিয়ে যাবে আরও দূরে কোথাও। ততোক্ষণ ডুবুরি, জল ও স্থল-পুলিশ, উদ্ধারকর্তাদের হাঁকডাক, ব্যর্থ প্রচেষ্টা, খবরকাগজ ও নিউজচ্যানেলের ক্যামেরায় ঘটনার নাট্যনির্মাণ, গোটা শহরের কয়েকদিনের খোসগল্পের রসালো কেচ্ছায় পরিণত হবে এই দুই অপরিণামদর্শী যুবক-যুবতী। মানুষ গসিপ ভালোবাসে। ইন্দুর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা হয়তো মর্গে ডেডবডি শনাক্ত করতে আসবে। হয়তো তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। তাদের গোটা পরিবারে আর কোনওদিনও মুহূর্তের জন্যও উচ্চারিত হবে না এই দুর্বিনীত, উদ্ধত, বদচলন ছোটোবউয়ের নাম। শৌভিকের মায়ের অন্ধ চোখ জলে ভরে উঠবে। তার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খড়কুটো রোজগার করা দাদা একবার কি দুবার হয়তো আসবে, লোকাল থানার অফিসারের সঙ্গে দেখা করে জবানবন্দি দিতে। ভবানীপুরের মেসবাড়ির অবশিষ্ট তিনটি প্রাণীকে অনর্থক জেরা করবে পুলিশ...ঝাঁপ দেবার আগে ব্রিজের উপর ফেলে যাওয়া ইন্দুর কাঁধের ছোটো ব্যাগটা দাঁতে করে তুলে নিয়ে যাবে একটা নেড়িকুকুর। সেটার দখল নেবে ব্রিজের কোণে বসে-থাকা কোনও ভিখারি!
তারপর তারা চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে এই শহর থেকে। নদীর বুকে গুমরে-মরা থমকানো বাতাস ঘুরতে ঘুরতে একবার স্থির দাঁড়িয়ে ভাববে, এই অনন্ত গঙ্গার স্রোতে এই দুই যুবক-যুবতী কেনই বা ঝাঁপ দিয়েছিল? শেষ অব্দি কোথায় পৌঁছল তারা?