এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো  শরৎ ২০২৩

  • সিন্ধুতট

    অমিতরূপ চক্রবর্তী
    গপ্পো | ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১২৫৮ বার পঠিত
  • মেনকার মেয়ের মাগ্গদশ্শক  | যদি এই জীবনের বন্দরে নানাদেশী তরী এসে নোঙর করে | ঘোড়ামারা দ্বীপ | দ্বিষো জহি | কবি যখন পাহাড় হয়ে যায় | ট্রফি | ফকিরি | বাংলা ভাষার গঠন নিয়ে চর্চা ও কিছু প্রস্তাব | কাঠের মানুষ | তাজ ও মাহোল | কবিতাগুচ্ছ | কোন নাম নেই | টিফিনবেলার গান | সান্দ্র ধাতবসঙ্গীত | মশা-ই | গুনাহ! গুনাহ! | রেনেসাঁস থেকে রসগোল্লা সবই কলোনিয়াল | সু-পাত্রের সন্ধান দেবে অঙ্ক | যদি বল প্রেম | যশপতির একদিন | চোদ্দপিদিম | গভীর জল | লেখা-সাক্ষাৎ | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং - পর্ব ১ | কন্যাকুমারী | সিন্ধুতট | ট্যাঙ্কশংকর, লোকটা ও এক সম্ভাব্য/অসমাপ্ত মহাজাগতিক কিস্যা-১ | ট্যাঙ্কশংকর, লোকটা ও এক সম্ভাব্য/অসমাপ্ত মহাজাগতিক কিস্যা-২ | আনন্দ মঠ – ইতিহাসের সন্তান, ইতিহাসের জননী | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং -- পর্ব ২ | অর্গ্যাজম | কবি-কাহিনি | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং -- পর্ব ৩ | কমরেড গঙ্গাপদ | বিপজ্জনক খেলা | বেলার বেতার | গভীর অসুখে নিমজ্জিত মণিপুর | আবোল তাবোল | শিউলিরা | বিসর্জন | এক রাজা, দুই কবিরাজ | হাওয়া হাওয়া | ভোলবদল | ধৃতরাষ্ট্র ও দশরথঃ মহাকাব্যের দুই পিতা ও তাদের রাজধর্ম | মারীকথা | দামামা | হাওয়া মোরগের জীবন | পলায়নবাদীর সঞ্জীবনী বটিকা | নিত্যগতি | তিনটি কবিতা | চিত্রকর | যাবার কথা


    সমুদ্রের দিক থেকে প্রবল হাওয়া উড়ে আসছিল। ঋষির মাথায় অবিন্যস্ত চুলগুলো এলোমেলো উড়ছিল সেই হাওয়ায়। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশে একবার ভাল মতো চোখ বুলিয়ে নিয়ে ও বলল ‘এক্সেলেন্ট।’

    মাঝারি মাপের একটা জমির ওপর হোমস্টে-টা। তিনদিকে ছোট ছোট ঘর। মাঝখানে একটুকরো ঘাসে ঢাকা লনমতো। বসে বিশ্রাম নেবার জন্য বা সময় কাটানোর জন্য গোল খড়ের চালায় ছাওয়া জায়গা। হোমস্টের পেছনে বড় বড় কেওড়া গাছের জঙ্গল। গড়ান গাছও আছে। এই হোম স্টে থেকে বিশ/পঁচিশ মিটারের মধ্যেই সমুদ্র। সবসময়ই সামুদ্রিক হাওয়া বয়ে যাচ্ছে এই হোমস্টে-এর গা ছুঁয়ে। এমন হাওয়ায় অবিন্যস্ত এলোমেলো হয়ে যেতে খুব ভাল লাগে। চতুর্দিকে সবুজের পাহারাও খুব সুন্দর।

    ঋষির মধ্যে একটা দলপতি দলপতি ভাব আছে। অপেক্ষমান দলটার দিকে চেয়ে ও বলল ‘আর কোথাও যেতে হবে না। এটাই ফাইনাল। এখানেই আমরা ঘাঁটি গাড়ব। তোদের কী মত?’
    সমুদ্র কাছে হলেও রোদের তাপ বেশ কড়া। দলটা হাঁপিয়েও উঠেছিল একটু। নন্দন মাথায় বেশ লম্বা। ও একটু নাক-মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়েছিল। দলের সদস্য বাকি তিনটি মেয়ের বাঁধা চুল হাওয়ার ক্রমাগত ধাক্কায় ঢিলে হয়ে পড়ে মুখে উড়ে উড়ে আসছিল। ঠোঁটের খাঁজে আটকেও যাচ্ছিল।

    অনু বলল ‘ঠিক আছে। এখানেই থেকে যাই। তাজপুরে অতো আলিশান হোটেল পাওয়াও যাবে না’।

    নিবেদিতা বলল ‘আলিশান হোটেলে থাকতে তো আসিনি। অতো ভিড়, হাঁকডাক তাছাড়া আমার সত্যিই ভাললাগে না। এ জায়গাটা কী শান্ত, নীরব। আমি এখান থেকে কোথাও যাব না।
    ঋষি বলল ‘মেজর ভোটে জায়গাটা জিতে গেছে। অতএব আমরা এখানেই রাত্রিবাস করছি অন্তর্বাস সহ। নো সভ্যতামি, নো লজ্জা।’

    -‘অ্যান্ড নো তোর বাজে বকবক।’ অনু বলল।
    -‘ওখে’ ইঁদুরের মতো করে বলল ঋষি নামের ছেলেটি। নিবেদিতা মুখ থেকে মাছি উড়িয়ে তাড়িয়ে দেবার মতো করে ওর এইসব প্র্যাঙ্কও উড়িয়ে দিল। গেট ঠেলে ওদের দলটা কম্পাউন্ডে ঢুকল।

    দু’পাশে সার সার বেশ অনেকগুলোই ঘর। বাইরে থেকে দেখলে ঘরগুলোর চেহারা বেশ সুশ্রী। মাঝখানে যে পলতা বাঁশের বাতা কেটে জালির মতো করে ঘেরা লম্বা টানা ঘরটি- ওটাই ডাইনিং স্পেস। তার ডানদিকে যে ঘরটি, ওটাই বোধহয় ম্যানেজারের কামরা। পেছনের কেওড়া গাছগুলোর বাকলে পাতায় মধ্যাহ্নের রোদ ঝিমিয়ে পড়ে চুপ করে আছে। লোকজনের বিশেষ সাড়াশব্দ নেই। কান পাতলে সমুদ্রের সোঁ সোঁ আওয়াজই শোনা যায় কেবল। একটা ফুলগাছের ঝোপের কাছে আদুল গায়ে একটা লোক ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা করছিল। ঋষি ওকে ডেকে বলল ‘শুনছেন, এই যে দাদা, শুনছেন।’

    ঋষির গলা পেয়ে লোকটি উঠে ঘুরে তাকাল। বুড়োমতো একটা লোক। এই হোমস্টে-তেই কাজ করে বোধহয়। মালিটালি গোছের কেউ হয়তো হবে। মুখের ঢিলে হয়ে আসা চামড়ায় বলিরেখা। কণ্ঠায় চামড়ায় রোদে পোড়া রঙ। লোকটি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই ঋষি বলল ‘আমরা এখানে আজ থাকব। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
    লোকটি বাঁ হাত লম্বা করে ওড়িয়া টানে একটা ঘর দেখিয়ে বলল ‘ওইধারে যান।’

    ঋষি বো-ডাউন হয়ে প্রণাম করে বলল ‘থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।’

    লোকটি সেটা দেখে কিছু না বলে আবার ফুলগাছে ঝুঁকে পড়ে যা করছিল, তাই করতে লাগল।

    ম্যানেজারের ঘরের দিকে যখন ওরা হেঁটে যাচ্ছে, সম্পা বলল ‘ঋষি, এইসব খেটে খাওয়া লোকগুলোকে এভাবে হিউমিলিয়েট করিস না। এতে কিন্তু কোনো বাহাদুরি নেই।
    -‘ধ্যাত্, কাকে কী বলছিস? ও কি এসব ফলো করে কখনো? ও নাকি আই টি সেক্টরে চাকরি করে। কী যে করে। আমার তো মনে হয় টারজানের মতো সারা অফিসে দোল খেয়ে বেড়ায়।’
    ঋষির কানে পৌঁছেছিল কথাটা। ও হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল ‘ইয়েস বেবি। দোল খাই আর ফিমেল কলিগদের ব্রা ধরে টান মারি। ওয়ানা মোর?’
    -‘অ্যাই, কী হচ্ছে কী এসব। সম্পা তুই চুপ করতো। আর ঋষি এখন আর এসব ভাঁড়ামো করিস না। আগে ব্যবস্থাটা ঠিক কর।’

    নন্দন সিগারেট টানছিল। রোদে-বাতাসে একটু রুক্ষ হয়ে উঠেছিল ওর দীর্ঘাঙ্গ চেহারাটা। এখন মাথায় একটা ফেল্ট দেওয়া টুপি থাকলে ওকে একদম কাউবয়দের মতো লাগত। ও বলল ‘দাঁড়া, আমি যাচ্ছি।’
    ওদের গলা পেয়ে ম্যানেজার ইতিমধ্যেই বেরিয়ে এসেছিল। কালো, মধ্যবয়েসি একটা লোক। চেক কাটা হাফ শার্ট আর ঢলঢলে কাপড়ের প্যান্ট পরা। পায়ে ক্ষয়ে যাওয়া হাওয়াই। লোকটি বলল ‘বলুন।’
    -ঘর লাগবে। আপনাদের সিস্টেম কী?’
    -‘ক’জন আছেন আপনারা?’
    -‘পাঁচ জন।’
    -‘এই পাঁচজন?’
    -‘ইয়েস স্যর। ‘ঋষি ফুট কাটতেই অনু ওর কাঁধে চাপড় মারল।
    -‘সবাই কি আলাদা আলাদা রুম নেবেন?’
    -‘না, মেয়েদের জন্য একটা রুম আর ছেলেদের জন্য একটা রুম। সবগুলোই ডাবল বেডের চাই। মেয়েদের রুমে একটা ক্যাম্প খাট দিতে পারেন?’
    -‘ক্যাম্প খাট এখন আমাদের কাছে নেই। তবে ডাবল বেড হয়ে যাবে। মেয়েদের ঘর একদিকে দেব আর ছেলেদের ঘর অন্য পাশে।একই লাইনে হবে না।’
    -‘আরে ডাবল বেডে আমরা তিনজন ম্যানেজ করে নিতে পারব। কী রে তাই না বল?’
    -‘হ্যাঁ, হ্যাঁ হয়ে যাবে।’
    -‘একজন ঝুলে থাকিস। ‘ঋষি ফিসফিসিয়ে অনুর মাথার কাছে বলল। অনু আবার চাপড় মারল।
    -‘খাবারের কী ব্যবস্থা?’
    -‘আমরাই দেব। তার চার্জ আলাদা। সকালে ব্রেকফাস্ট আমরা আমাদের মতো দেব। লাঞ্চ আর ডিনারে কী খাবেন আমাদের বলে দিতে হবে।
    -‘চার্জ?’
    -‘যে ক’দিন থাকবেন তার সঙ্গে খাবার মিলিয়ে প্যাকেজ সিস্টেম। আপনারা যদি একদিন থাকেন, তাহলে ঘর ভাড়া আর খাবার মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।’
    -‘একটু কম করবেন তো?’
    -‘পারব না। তবে আমাদের সার্ভিসে কোনো ত্রুটি পাবেন না।’
    নন্দন জিজ্ঞাসু চোখে বাকিদের দিকে তাকাল। মেয়েরা সামান্য মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।
    ম্যানেজার বলল ‘ক’দিন থাকবেন আপনারা?’
    -‘একদিনই। কাল চলে যাব।’
    -‘আমাদের চেক আউট বেলা এগারোটায়। তবে আপনারা এখনই যদি রুম বুক করেন আপনাদের চেক আউটের সময় দেব কাল বেলা সাড়ে তিনটেয়। বা চারটেও হতে পারে।’
    -‘ঠিক আমরা বুক করছি। আপনি খাতায় এন্ট্রি করে নিন।’

    ম্যানেজার লোকটি ঘরে ঢুকে একটা জাবেদা খাতা হাতে করে বেরিয়ে আসল। বারান্দায় এক কোণে একটা কাঠের নড়বড়ে টেবিল ও হাতলওলা চেয়ার। লোকটি টেবিলে খাতা খুলে বলল ‘বাঁ দিকের বারান্দায় আট নম্বর রুমটা মেয়েদের। ডাবল বেড আছে। অ্যাটাচড বাথরুম আছে আর ডানদিকের বারান্দায় তিন নম্বর রুমটা ছেলেদের। একই ফেসিলিটি। এখানে আপনাদের নাম ঠিকানা ফোন নম্বর লিখে সই করে দিন।
    নন্দন বলল ‘আমার নামই লিখব?’
    -‘আপনার নাম লিখে দিলেই হবে।‘
    নন্দন নাম ঠিকানা ফোন নম্বর লিখে দেবার পর ম্যানেজার লোকটি বলল ‘ফিফটি পার্সেন্ট অ্যাডভান্স দিন।‘
    ম্যানেজার লোকটি কীরকম যন্ত্রের মতো। নন্দন বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল ‘আমি দিয়ে দিচ্ছি এখন। পরে তোরা ফেরৎ দিস।‘
    নিবেদিতা বলল ‘না না, আমরা এখনই দিয়ে দিচ্ছি।’
    মেয়েদের দলটা যখন ব্যাগ খুলে টাকা বের করছে, ঋষি নিবেদিতার মুখের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল ‘তুই তো চাকরি করিস, দিয়ে দে না আমারটা।’
    -‘তুইও তো চাকরি করিস, আমারটা দিয়ে দে।’
    ম্যানেজার ঘর থেকে চাবি এনে ওদের হাতে দিয়ে বলল ‘রুমে বসে ড্রিঙ্ক করবেন না কিন্তু। খেলে বাইরে গিয়ে খেতে হবে।’
    -‘কী বলছেন দাদা? বেড়াতে এসে একটু মদটদ না খেলে চলে? ঋষি একেবারে লাউডগার মতো কাতর হয়ে বলল। ‘ঠিক আছে রুমে বা না-ই খেলাম বাইরে এই যে কী সুন্দর সব বসার জায়গা- এখানে বসে খেতে দিন।’

    লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল ‘খেলে ডানদিকের কোনার ছাউনিটায় বসে খাবেন। পাশে একটা ড্রাম রাখা আছে, ওতে বোতলটোতল ফেলে দেবেন। আপনারা স্নান করে ডাইনিং-এ আসুন। এখন ভাতের সঙ্গে ডাল, আলুপোস্ত, চিকেন দিচ্ছি। ভাজা পমপ্লেট আছে। চাইলে নিতে পারেন।’

    ঋষি বলল ‘চাইলে নিতে পারেন মানে? যা আছে সব দেবেন।’

    খিদে পেয়ে গিয়েছিল ওদের। রুমে গিয়ে স্নান করে ওরা পোশাক বদলে নিল। সম্পা ব্রা ছাড়াই একটা ভেস্ট পরে ফেলল। নিবেদিতা বলল ‘ভেতরে কিছু পরলি না? এভাবেই খেতে যাবি?’
    ‘কিচ্ছু হবে না। এই দ্যাখ হাঁটছি। বোঝা যাচ্ছে?’

    ‘কী জানি কীভাবে পারিস? আমি এক মুহূর্তও পারব না।‘তখনই বাইরে ডাইনিং স্পেসের দিক থেকে ঋষির চিৎকার ভেসে এল। ‘কী রে তোরা খাবি না উপোস থাকবি?’
    ওরা দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল।

    ম্যানেজার বলেছিল সার্ভিসে কোনো ত্রুটি পাবেন না, সত্যিই চমৎকার সব রান্না। অনু দেখল ঋষি প্রায় থালার ওপরে উঠে পড়ে গোগ্রাসে খাচ্ছে। মুখের কষ বেয়ে ডাল-ঝোল গড়িয়ে পড়ছে ওর। নন্দন বেশি কিছু খেল না। বেসিনে হাত ধুয়ে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট খেতে থাকল। সম্পা নিজেরটা শেষ করে নিবেদিতার আধখাওয়া মাছটাও খেয়ে ফেলল।

    রুমে বালিশে মাথা দিয়ে অনু জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিল। গাছপালার গায়ে রোদ নিস্তেজ হয়ে আসছে। শিষ দিয়ে দিয়ে কী একটা পাখি কোথাও ডাকছে। কান পাতলে সমুদ্রের সোঁ সোঁ শব্দ শোনা যায়। কেমন একটা মনখারাপ-করা ভাললাগা তৈরি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল অনুর মনে। ওর মনে হল শৌভিক নন্দিতাদেরও আসার কথা ছিল। ওরা এলে আরও ভাল হত। বাড়ির কথা মনে পড়ল। বাড়িতে অ্যাতোক্ষণে খেয়েদেয়ে সবাই একটু শুয়েছে। দিলীপ নামে যে ছেলেটা ওদের উঠোনে ফুচকার গাড়ি রাখে, ও নিশ্চয়ই অ্যাতোক্ষণে গাড়ি নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিয়েছে। ছাদের তারে ক্লিপ দিয়ে আটকানো শুকোতে দেওয়া জামাকাপড়গুলো এখনও রোদ নিচ্ছে। হঠাৎ অনুর মনে হল ও দুটো প্যান্টি এনেছে। আজ মাসের নয় তারিখ।
    আরেকটা আনলে ভাল হত। প্যাড অবশ্য সবারই কাছে আছে।

    শব্দ করে ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে সম্পা ওর মোটা ঊরু তুলে দিল অনুর কোমরে। অনুর কেমন যেন গা কাঁটা দিয়ে উঠল। সম্পার গা থেকে খুব সুন্দর চাপা একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে। মনকেমন করা। খোলা জানালার বাইরে দিনের হলকা-লাগা নিঝুম দুপুর। গাছের খর বাকলে কমলা কমলা আলো। সেই আলো কত দূরত্ব, কত শূন্যতা, কত শহর-সভ্যতার কোলাহল অলিগলি ছুঁয়ে এখানে এসে থেমেছে কে জানে।

    ছ’টার দিকে ওরা চা খেয়ে বেরোল সমুদ্রের দিকে। দুপুরে চকচকে রোদ ছিল। এরই মধ্যে কখন আকাশটা মেঘলা হয়ে গেছে সমুদ্রের শেষ সীমা অবধি। মেঘলা থাকার কারণে সূর্যাস্ত আর দেখা যাবে না। বেরোনোর সময় ম্যানেজার পইপই করে বলে দিয়েছে বেশি দূরে না যেতে। কারণ তাজপুরে এখনো সেভাবে ইলেকট্রিক নেই। রাস্তাঘাটও অচেনা।

    ওরা কেউ তেমন কথা না বলে হাঁটছিল। ঋষি হঠাৎ হঠাৎ কোথাও দাঁড়িয়ে পড়ে মোবাইলে ছবি তুলছিল। সম্পা এখন ভেস্টের নীচে ব্রা পরেছে। সঙ্গে জিনস। মাথায় একটা স্কার্ফ কেন জড়িয়েছে বুঝল না অনু। এখন যে খুব শীত- তাও নয়। অবশ্য সমুদ্রের ঝোড়ো বাতাস আছে। তাতে ঠাণ্ডা লাগতে পারে। সম্পার মুখে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরা স্কার্ফের একটি কোনা।
    বিচটা একেবারে জনশূন্য। দূর অবধি ছড়িয়ে যাওয়া ভেজা বালু আর ডানদিকের দূরে একটা ঝাউবন ছাড়া কিচ্ছু নেই। সমস্ত বিচের মধ্যে একটাই দোকানের গুমটিঘর। চালায় নীল পলিথিন শিট আটকানো। বাইরে, দোকানের মুখের সামনে বালিতে বসিয়ে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সিনেমার দৃশ্য শ্যুট করার জন্য সাজিয়ে রাখা। বালিতে এবার পা বসে যাচ্ছিল দেখে ওরা সবাই জুতো স্যান্ডেল খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিল।

    সমুদ্রটা এখন গাঢ় ছাই রঙের। সেখান ঢেউ উৎপন্ন হয়ে তীরে ছুটে আসছে। অনুর সমুদ্রকে নতুন কিছু মনে হয় না। কেননা এর আগেও ও অনেকবার বাড়ির লোকের সঙ্গে ওল্ড দীঘা বেড়াতে গেছে। অবশ্য তাজপুরে এই প্রথম। বন্ধুবান্ধদের সঙ্গে এসে হোমস্টে-তে রাত্রিযাপন এই প্রথম।

    নিবেদিতা বলল ‘চল, সমুদ্রের কাছে গিয়ে জলে পা ছুঁইয়ে বসি।’
    ওরা যখন সেইমতো বসেছে, ঋষি এসে বলল ‘তোরা কফি খাবি?’
    -‘কফি আবার এখানে কোথায়?’
    -‘ওই গুমটি দোকানটায় পাওয়া যায়। এগরোল চাউমিন টোস্টও পাওয়া যায়।’
    সম্পা বলল ‘উমমম, কফি খাওয়া যায়।’
    -‘ওকে, কামিং!’ বলে ঋষি বালু দিয়ে দৌড়ে গেল।
    অনু দেখল নন্দন প্যান্ট গুটিয়ে জলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ছবি তুলছে। নন্দন খুব বেশি কথা বলে না কোনোদিনই। খুব গভীরভাবে ভেবে যে-কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অনুরা সবাই জানে ওর প্রতি সম্পার একটু দুর্বলতা আছে। সম্পা সেদিকেই দেখছিল।
    নিবেদিতা বলল ‘সমুদ্র দেখলে আমার ভেতরটা কেমন হু হু করে জানিস। খুব কান্না পায়।’
    -‘তোর কী শৌভিকের সঙ্গে ঝামেলাটা মিটে গেছে?’
    -‘না রে, ও প্রচণ্ড একরোখা ছেলে। নিজে যেটা ঠিক মনে করবে তাই-ই।’
    -‘তবে শৌভিক কিন্তু তোকে ভীষণ ভালবাসে।’
    -‘কী করে বুঝলি?’
    -‘গেস করা যায় তো।’
    -‘গেস করে ভালবাসা থাকা, না-থাকা বোঝা যায় না। এই যে আমরা এখানে এসেছি, ও তো জানে। একবারও ফোন করে খবর নিল?’
    -‘হয়তো করবে।’
    -‘ছাড় তো! দেখ গিয়ে নন্দিতার সঙ্গে টো টো করে বেড়াচ্ছে।’
    -‘সে করুক গে! নন্দিতা তো সবারই বন্ধু!’
    -‘শোন্, বন্ধুত্বের চেহারা বদলাতে বেশি সময় লাগে না।’
    -‘আই মিন, তুই কি ওকে ডাউট করিস?’
    -‘স্বাভাবিক যেটা রেসপন্স, সেটা না পেলে ডাউট তো হবেই ভাই!’
    -‘যাঃ! এ তোর ভীষণ ন্যারো চিন্তাভাবনা।’
    -‘বাদ দে তো! এ নিয়ে আমি বেশি কথা বলতে চাই না।’
    সম্পা বলল ‘আমার জিনস ভিজে গেছে রে! চল ওই চেয়ারগুলোয় গিয়ে বসি।’
    -‘কই কফি তো এল না? দেবদূত যে কফি আনতে ছুটে গেল?’
    ‘দেবদূত’ কথাটা শুনে ওরা সবাই হেসে উঠল সমস্বরে। অনু বলল ‘হয়তো দোকানির সঙ্গে ভাট বকছে।’
    -‘চল চেয়ারগুলোয় গিয়ে বসি।’
    ওরা খালি চেয়ারগুলোয় এসে বসল। দেখা গেল সত্যিই তাই। ঋষি কাগজের কাপে কফি নিয়ে দোকানির সঙ্গে ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে গল্প করছে। ওদের দেখেই বলল ‘ভাল সময়ে এসেছিস। তোদের কফি রেডি।’

    কফি খেতে খেতেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আকাশটা অ্যাতোক্ষণ কালো মেঘে ঢাকা ছিল। একটু একটু করে এরইমধ্যে মেঘটা কেটে গোটা আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। সেই আকাশে একটা ভীষণ জ্বলন্ত চাঁদ। জ্যোৎস্না যেন একদল নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সমুদ্রে, পাড়ের মাটিতে। দূরে ঝাউগাছগুলোকে ছোট ছোট প্যাগোডার মতো দেখাতে লাগল।
    দোকানি বলল ‘সমুদ্রের এই আজিব খেলা স্যর। কখনো মেঘ বারিষ, কখনো চাঁদনি।’

    ২.

    ওই জ্বলন্ত জ্যোৎস্নায় কিছুক্ষণ বোবা হয়ে রইল সবাই। অপার্থিব এক জগতের মতো লাগছে সমুদ্রসহ গোটা বিচটা, যতদূর অবধি দেখা যায়। এই ক’টি মানুষ ছাড়া এই জগতে আর কেউ নেই, কিছু নেই। নিবেদিতা দেখল ওই জ্বলন্ত জ্যোৎস্নায় সমুদ্রের ধার থেকে এদিকেই হেঁটে আসছে নন্দন। সুঠাম গড়নের একটা মানুষের ছায়ার মতো লাগছে ওকে। ওর চারিদিকে দূরদূরান্ত অবধি বিচ, তার সাদা বালু এমনকী ঢেউ নিয়ে উজাগর সমুদ্র- সবকিছু জ্যোৎস্নায় দাউদাউ করে জ্বলছে।

    সম্পা দোকানিকে বলল ‘ভাল হয়েছে তোমার কফি। ইচ্ছে হলে আরও খাব।’

    দোকানি আহ্লাদিত হয়ে মাথা নাড়ল। একটা সাদা বিজলিবাতি জ্বলছে গুমটি দোকানটায়। নন্দন এসে চেয়ারে বসে বলল ‘প্যারানর্মাল।’
    নিবেদিতা তাকাল ওর দিকে। ও তখন বাঁ দিকে দূরে কোথাও চেয়ে আছে।

    সম্পা বলল ‘নন্দন, একটা সিগারেট দিবি?’

    অনু দেখল সম্পার মুখটা তেলে সাঁতলানো লুচির মতো লাগছে এই ফটফটে জ্যোৎস্নায়। নন্দন পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে ডান হাত লম্বা করে বাড়িয়ে দিল সম্পার দিকে। ও তখনো দূরে চেয়ে আছে।

    সম্পা ফস করে লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। কলেজে বন্ধুদের সাথে বেশ ক’বার খেয়েছে, তাই এখন অসুবিধে হয় না ওর। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে জ্যোৎস্নার গায়ে ধোঁয়া ছাড়ছিল ও।

    অনুর অস্বস্তি হচ্ছিল। ও জানে সম্পার এইসব কাজকর্ম পছন্দ করে না নন্দন। সম্পা কি এটা বুঝতে পারে না? আরেকবার পুজোয় ঘুরতে গিয়ে ধাবায় মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছিল। সবাই মিলে একটা খাটিয়া খালি করে ওকে শুইয়ে দেয়। তারপর সেখানেই হড়হড় করে বমি। ইস, কি বিশ্রী অবস্থা। শৌভিক আর ঋষি ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। অনু বলল ‘অ্যাই, সিগারেট খাচ্ছিস কেন?’
    -‘এনজয় করছি রে সোনা! এমন একটা মুহূর্ত আর কখনো পাব না?
    -‘এনজয় করতে গেলে কি সিগারেট খেতে হবে?’
    -‘খেলেই বা কার কী? তোরা তো জানিস-ই আমি একটা বখে যাওয়া মেয়ে। মদ খাই, সিগারেট খাই। বখে যাওয়াদের নিয়ে কেউ ভাবে না।’
    অনু ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে চুপ করে গেল। নন্দন তখন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কফি খাচ্ছে। হঠাৎ ওরা শুনল পেছন থেকে উচ্চারিত হচ্ছে-

    টু ওয়ান হু হ্যাজ বিন লঙ এ সিটি পেন্ট
    টিজ ভেরি সুইট টু লুক ইন টু দ্য ফেয়ার
    অ্যান্ড ওপেন ফেস অফ হেভেন টু ব্রিদ এ প্রেয়ার
    হু ইজ মোর হ্যাপি হোয়েন উইথ হার্টজ কনটেন্ট
    ফ্যাটিগড হি সিঙ্কস ইন টু সাম প্লেজেন্ট লেয়ার
    অফ ওয়েভি গ্রাস অ্যানড রিডস এ ডেবোনেয়ার

    বলেই ঋষি প্রায় এক লাফে টেবিলে অনুদের কাছে এসে বলল ‘কী ভেবেছিলি? রবীন্দ্রনাথ আওড়াব? আমি যে কিটস আওড়াব, ভাবিসনি তো? প্রেডিক্ট করতে পারিসনি তো? পারবিও না। বিকজ আই অ্যাম আনপ্রেডিক্টেবল!’

    সম্পা সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার নন্দনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল ‘নে নন্দন।’
    নন্দন বলল ‘তোর সামনের টেবিলে রেখে দে। আমি নিয়ে নেব।’
    অনু লক্ষ্য করল সম্পার মুখটা জ্যোৎস্নার থেকেও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সম্পা সিগারেট লাইটার ঠক করে টেবিলে রেখে চেয়ার থেকে উঠে সমুদ্রের দিকে হেঁটে যেতে লাগল।
    নিবেদিতা বলল ‘কী রে কোথায় যাচ্ছিস?’
    -‘ডোন্ট ওরি, আমি সুইসাইড করব না। ‘বলে জলের দিকে আরো এগিয়ে গেল সম্পা। অনু দেখল নন্দন একইভাবে সমুদ্র দেখছে। কোনোকিছুর প্রতিই ওর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
    -‘বেবি উড ইউ লাইক টু হ্যাভ এ ওয়াক উইথ মি?’ সেপাইয়ের মতো ভঙ্গিতে একটা হাত নিবেদিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঋষি।
    -‘যেতে পারি কিন্তু ফিরে এসে এগরোল খাওয়াতে হবে।’
    -‘জনমনিষ্যি নেই, এখানে আমি এগরোল কোথায় পাব?’
    -‘আমি সেসব জানি না। বলেছি খাওয়াতে হবে, খাওয়াতে হবে।’
    -‘ওখে বেবি। লেটস গো।’

    ওরা দু’জন জ্যোৎস্নায় চিকমিক করা বালু পেরিয়ে সমুদ্রের দিকে হেঁটে যেতে লাগল।
    -‘অনু, কফি খাবি?’
    -‘খাওয়া যায়। তুই আর আমিই তো পড়ে থাকলাম।’
    -‘বাঁদরামো করার চাইতে বেটার। অ্যাই দুটো কফি দাও তো।’
    -‘তুই অ্যাতো অফ হয়ে আছিস কেন?’
    -‘ভাল লাগছে না রে। বাবার শরীরটা খারাপ। প্রেসারটা খুব বেড়েছে।’
    -‘না এলেই তো পারতিস।’
    -‘বাড়িতেও ভাল লাগছিল না। তাই চলে এলাম।’
    -‘নন্দন, তোকে একটা কথা বলব?’
    -‘নিবেদিতার অ্যাটিচুড আমার কেমন যেন লাগছে?’
    -‘কীরকম?’
    -‘বুঝতে দিচ্ছে না, কিন্তু মাঝে মাঝেই তোর দিকে কেমনভাবে যেন দেখছে।’
    -‘তাতে কী?’
    -‘ওর অনেকগুলো ইললিগ্যাল অ্যাফেয়ার আছে জানিস তো? শুনেছি ফিজিক্যাল রিলেশনও হয়েছে। শৌভিক তাই বোধহয় ওকে অ্যাভয়েড করছে।’
    -‘একটি অ্যাডাল্ট মেয়ে যদি কারো সঙ্গে ফিজিক্যাল রিলেশনে জড়ায়, এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছে। আমি এতে অস্বাভাবিক কিছু দেখি না।’
    -‘তুই শৌভিকের জায়গায় হলে কী করতিস?’
    -‘বলা মুশকিল। এভাবে বলাও হয়তো যায় না।’

    জ্যোৎস্না পুরু হয়ে জমেছিল নন্দনের গালে। ওর মুখটা চৌকো। খুলির গঠন সুন্দর। দুটো তীব্র আশ্লেষ মাখা দৃঢ় ঠোঁট। এই অপার্থিব জ্যোৎস্নায় ওকে ইংরেজি সিনেমার নায়কদের মতো লাগছিল।

    অনু কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। দোকানি লোকটা কফি দিয়ে গিয়েছিল। কফিতে চুমুক দিয়ে নন্দন বলল ‘সমুদ্রটাকে দ্যাখ! জ্যোৎস্নায় কী ভৌতিক লাগছে। প্যারানর্মাল!’
    সত্যিই তাই। তরল এক ধাতুর মতো লাগছে সমুদ্রটিকে। বিশাল বিশাল ধূসর ঢেউ ছুটে এসে ভেঙে লুটিয়ে পড়ছে। হঠাৎ অনুর চোখে পড়ল ডানদিকে বেশ অনেকটা দূরে জলের ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সম্পা। ছোট্ট একটা ছায়াদণ্ডের মতো লাগছে ওকে।

    -‘সম্পাকে দ্যাখ।’
    একপলক দেখল নন্দন। তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনু বলল ‘সম্পার মনে হয়তো কোনো কষ্ট আছে।’
    -‘আমাদের মতো সবারই কষ্ট আছে। আমাদের মতো মানুষ কষ্ট ছাড়া ইমপসিবল। সোনার পাথরবাটি।’
    -‘তুই কেমন অন্যরকমভাবে কথা বলছিস। মনে হচ্ছে তুই নয়, অন্য কেউ কথা বলছে।’
    -‘হতে পারে। ধর এমন একটা জায়গায়, এমন একটা মোমেন্টে আমি পাল্টে গেছি।’

    অনুর ভাল লাগছিল না নন্দনের মুখ থেকে এমন কথা শুনতে। ওর ইচ্ছে করছিল নন্দনের আরেকটু কাছে গিয়ে বসতে। আরেকটু ঘনিষ্ঠ হতে। টেবিলের ওপরে নন্দনের যে চওড়া হাতটা রাখা, তার গায়ে হাত রাখতে। এমনও হতে পারত ওর ছোঁয়া পেয়ে নন্দন ঘুরে বসল। দু’জনেরই গালের একদিকে জ্যোৎস্না। মাথায় জ্যোৎস্নারই চুল। পোশাক-আষাকও জ্যোৎস্নার। নন্দন ওর জ্যোৎস্নার হাত দুটি দিয়ে অনুর জ্যোৎস্নার কাঁধ আঁকড়ে ধরল। তাতে অনুর কাঁধ থেকে খানিকটা জ্যোৎস্না আলগা হয়ৈ উপছে পড়ল বালিতে। নন্দন অনুর ঠোঁটে, গালে গাঢ় চুমু খেল। তারপর আরো গাঢ় চুমু খেল অনুর বুকের ভাঁজে। নন্দনের জ্যোৎস্নার শরীর থেকে, রোম থেকে, মাথার চুল থেকে, এমনকী শ্বাসপ্রশ্বাস থেকে সেই মিষ্টি মনকেমন-করা গন্ধটা বেরিয়ে আসছে, যেমন আজ দুপুরে সম্পার গা থেকে পেয়েছিল অনু। নন্দন ওকে ধীরে ধীরে বালিতে শুইয়ে দিল। বালি নয়, দিগন্তব্যাপী পুরু জ্যোৎস্নার মধ্যে।

    -‘এই যে তোরা এখানে?’
    সম্বিৎ ফিরল অনুর।দেখল নিবেদিতা কেমন আলুথালু হয়ে সাদা বালু পেরিয়ে যেন-বা দৌড়েই আসছে। চুল, পোশাক বিস্রস্ত।
    -‘কী রে, কী হয়েছে?’
    একটা খালি চেয়ারে বসে হাঁপাচ্ছে নিবেদিতা। ওড়না দিয়ে কপাল আর মুখের ঘাম মুছে নিল। বলল ‘জানোয়ার, বাস্টার্ড একটা!’
    -‘কী হয়েছে তোর? কী হয়েছে?’ নিজের অজান্তেই একটু চেঁচিয়ে উঠল অনু।
    -‘কী হয়েছে? আর বলিস না!’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল নিবেদিতা। ‘ঋষির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূরে চলে গেছি। হঠাৎ ও থমকে দাঁড়িয়ে আমাকে জোরাজুরি করতে লাগল। আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল। ঠোঁটে চুমু খেতে চাইল। এক ঊরু দিয়ে আমার ভ্যাজাইনা টাচ করতে চাইল! আর আমি কী করেছি বলতো? দিলাম ওর হাতে কামড় বসিয়ে। কামড় বসিয়ে দিলাম যতো জোরে পারি। দেখলাম ওর হাত দিয়ে কালো রক্ত বেরিয়ে আসছে! বিশ্বাস কর, একদম কুচকুচে কালো রক্ত! হা হা হা!’

    পাগলের মতো মাথা পেছনে হেলিয়ে দিয়ে হাসছিল নিবেদিতা। হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে থেমে গিয়ে আবার নতুন করে হেসে উঠছিল। সমুদ্র তখন সোঁ সোঁ করে ডাকছে। পালে পালে বন্য পশুর মতো ঢেউগুলো এসে তীরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নন্দন চট করে ওর পাশে গিয়ে বসে ওর মাথাটা কাঁধে নিয়ে বলতে থাকল ‘ওকে, ওকে! কিচ্ছু হয়নি। শান্ত হও। শান্ত হও। কিচ্ছু হয়নি।’

    দোকানি লোকটা কিছুক্ষণ থ’ হয়ে ওদের এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে দোকান গোটাতে শুরু করল। অনু ভাবল এই চেয়ার টেবিলগুলো তো দোকানি লোকটার। নিশ্চয়ই ওকে ছেড়ে দিতে হবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে এক হাতে নিতম্বের ওপরে কাপড়টা টেনে টান করে নিল ও। যতদূর চোখ যায়, জ্যোৎস্নার কোনো ঘাটতি নেই। ঘাটতি নেই পর পর ছুটে আসা সশব্দ ঢেউগুলোরও। কী ভেবে বালুর ওপরে পা ফেলে ফেলে সমুদ্রের দিকে হাঁটতে থাকল ও।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    মেনকার মেয়ের মাগ্গদশ্শক  | যদি এই জীবনের বন্দরে নানাদেশী তরী এসে নোঙর করে | ঘোড়ামারা দ্বীপ | দ্বিষো জহি | কবি যখন পাহাড় হয়ে যায় | ট্রফি | ফকিরি | বাংলা ভাষার গঠন নিয়ে চর্চা ও কিছু প্রস্তাব | কাঠের মানুষ | তাজ ও মাহোল | কবিতাগুচ্ছ | কোন নাম নেই | টিফিনবেলার গান | সান্দ্র ধাতবসঙ্গীত | মশা-ই | গুনাহ! গুনাহ! | রেনেসাঁস থেকে রসগোল্লা সবই কলোনিয়াল | সু-পাত্রের সন্ধান দেবে অঙ্ক | যদি বল প্রেম | যশপতির একদিন | চোদ্দপিদিম | গভীর জল | লেখা-সাক্ষাৎ | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং - পর্ব ১ | কন্যাকুমারী | সিন্ধুতট | ট্যাঙ্কশংকর, লোকটা ও এক সম্ভাব্য/অসমাপ্ত মহাজাগতিক কিস্যা-১ | ট্যাঙ্কশংকর, লোকটা ও এক সম্ভাব্য/অসমাপ্ত মহাজাগতিক কিস্যা-২ | আনন্দ মঠ – ইতিহাসের সন্তান, ইতিহাসের জননী | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং -- পর্ব ২ | অর্গ্যাজম | কবি-কাহিনি | ব্ল্যাকআউট ডাইনিং -- পর্ব ৩ | কমরেড গঙ্গাপদ | বিপজ্জনক খেলা | বেলার বেতার | গভীর অসুখে নিমজ্জিত মণিপুর | আবোল তাবোল | শিউলিরা | বিসর্জন | এক রাজা, দুই কবিরাজ | হাওয়া হাওয়া | ভোলবদল | ধৃতরাষ্ট্র ও দশরথঃ মহাকাব্যের দুই পিতা ও তাদের রাজধর্ম | মারীকথা | দামামা | হাওয়া মোরগের জীবন | পলায়নবাদীর সঞ্জীবনী বটিকা | নিত্যগতি | তিনটি কবিতা | চিত্রকর | যাবার কথা
  • গপ্পো | ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১২৫৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kanan Roy | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ০৯:৩১525552
  • অসাধারণ গল্প। 
  • Kuntala | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:০৩525565
  • কি জানি কেন 'আত্মপ্রকাশ' মনে পড়ে গেল। 
    এই সব আচরণ, বেড়াতে গিয়ে সেখানকার মানুষদের ভূদৃশ্যের অংশ হিসেবে গণ্য কর, আমরা শহরে  মানুষ খুব অনায়াসে করে ফেলি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন