এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  কাব্য  summer24

  • পাঁচটি কবিতা

    অমিতরূপ চক্রবর্তী
    কাব্য | ১৫ এপ্রিল ২০২৪ | ৪৫০ বার পঠিত

  • ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়



    কোনো সমুদ্রের হোটেলে


    কোনো সমুদ্রের হোটেলে বন্ধ ঘরের মধ্যে আমি মরে গেছি। ধরো, সেসময় ভোর পেরিয়ে সকাল। ঘরের জানালার কাচে বাইরের সাদা আলো। প্রতিদ্বন্দী অন্য হোটেলের ঘরগুলিতে যারা আছে- যেসব সংসার অথবা একলা মানুষ, তারা এসময় জেগে উঠে প্রকৃতির টানে হয়তো বাথরুমে, হয়তো নির্ভার হয়ে এসে বিছানায়। কেউ রাতের কোঁকড়ানো চুল চিরুনি লাগিয়ে সোজা করছে, কেউ ভুল মোজা ভুল পায়ে পরে তা আবার সংশোধন করছে। সমুদ্রে ঢেউ উঠে পাড়ে ছুটে আসছে পরপর। সকালের নরম, শীতল ঢেউ। সৈকত নির্জন। শুধু বিগতদিনের আস্ফালন, রক্তপাত বা ধস্তাধস্তির ছাপ বালিতে লেগে আছে। জীবন্ত হয়ে আছে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া দুইজোড়া পায়ের ছাপ। বহুদূর তারা পাশাপাশি হেঁটে গিয়ে বাঁক নিয়ে কোথাও অদৃশ্য হয়েছে। ঝাউবন ঠাণ্ডা। তার গোড়ায় গোড়ায় পরিষ্কার বালি। হোটেলের ডেস্কে যে মানুষ কর্তব্য সামলাতে এইমাত্র এসে বসল, সে এখানে আসার আগে বাতাসে তার শেষ হাই ত্যাগ করে এসেছে। সমুদ্রের হোটেলে যে মেয়েরা আছে, এখন তাদের জল দিয়ে ধোয়া পরিচ্ছন্ন যোনি। জামার নীচে শান্ত স্তন। যেসব পুরুষেরা দিগ্বিজয় করে এখানে এসেছে, তাদের পুরুষ্ট লিঙ্গ এখন মৌনসাধকের মতো ক্ষমাশীল। তাদের মুখগহ্বরে শুদ্ধ আত্মার গন্ধ। তাদের আঙুলের গাঁটে বাদশাহের মতো অসংখ্য চুনি-পান্নার আংটি সকালের আলোয় ঝিকমিক করছে

    মনে করো, ঠিক এমনই সময় বন্ধ ঘরে সবার আড়ালে আমি মরে গেছি। হৃদয় বিকল হবার আগে আমি প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি দরজা খুলতে, কাউকে ডাকতে। শেষ অবধি হাতটি ঝুপ করে খসে পড়েছে আমারই পাশে। বিছানায় উবু হওয়া শরীরের পাশে। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে এসেছে ফেনা, গড়িয়ে এসেছে লালা। সমুদ্রে তখনো ঢেউ উঠে পাড়ে ছুটে আসছে পরপর। বিশাল উন্মুক্ত আকাশে ডানা দুদিকে ছড়িয়ে পাখি উড়ছে। হয়তো এই-ই ওদের প্রথম উড়ান। সমুদ্রে ভর দিয়ে হাওয়াও উঠেছে খুব। রাস্তায় বেরোনো বিক্ষিপ্ত মানুষের শাড়ি, জামাপ্যান্ট সে হাওয়ায় গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যাচ্ছে। কোমোটের জলে তখনো আমার প্রস্রাবের কিছুটা হলুদ। সুস্থপতি মানুষের তৈরি পাইপর নকসা দিয়ে তখনো পাতালে পৌঁছে যায়নি আমার বর্জ্য। হয়তো তখন তারা চলমান। তাদের মনিব যে বিছানায় নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে আছে, সেখবর তাদের অজানা। আধাআধি সাবানের গায়ে তখনো হয়তো আমার প্রচেষ্টায় তৈরি হওয়া ফেনা। সগর্জনে ঢেউ ছুটে আসছে পাড়ে পরপর। একটি দোহারা ছেলে বালির ওপরে এসে চা-দোকান পাতল। একটি ছেঁড়া সুখাদ্যের প্যাকেট বালিতে ঠোনা খেয়ে খেয়ে এসে থামল ছেলেটির চা-দোকানেরই সামনে। কপালের ওপরে ছেলেটির বড়ো বড়ো চুল। ওর মস্তিষ্কের রঙ হয়তো কয়লার মতো কালো। ওর লিঙ্গের মুখে চামড়ায় হয়তো সকালের মিঠে মিঠে নিষ্পাপ হিম

    প্রশান্তির দিন


    তোমার আর্দ্র চাঁদের মতো মুখে সরু সরু রেখার মতো অজস্র চুল উড়ে এসে আটকে রয়েছে। পৃথিবীতে সকলের জন্য কিছু প্রসন্নতার দিন, প্রশান্তির দিন নির্ধারিত থাকে। আজ তোমার সেই নির্ধারিত প্রসন্নতার দিন, প্রশান্তির দিন। স্নিগ্ধ কদমের মতো আজ পোশাক তোমার। স্তনের ওপর নিরুপদ্রবে শুয়ে আছে সাদা, খানিকটা নুড়িতাড়িত জলধারার মতো মালা। তোমার চোখের আগে সেইসব সরু সরু রেখার মতো চুল আটকে রয়েছে। গালে সেইসব সরু সরু রেখার মতো চুল আটকে রয়েছে। সেইসব সরু সরু রেখার মতো চুল আটকে রয়েছে তোমার ঠোঁটে। দূরে বৈদ্যুতিক তারের ওপারে পাখি উড়ছে। গাছের পাতায় লুটোপুটি খাচ্ছে বাতাস। আকাশের গায়ে কিছুটা মেঘের উপস্থিতি, মানুষের জীবন থেকে সরে যাওয়া শ্বেতকায় কামের মতো। পৃথিবী চলছে তার নিজের মতো। তৃণভোজী, মাংসাশী সব পতঙ্গেরা যে যার গন্তব্যে চলেছে সেতু পেরিয়ে, পথঘাট পেরিয়ে। তুমি হয়তো- বা সেদিকেই তাকিয়ে আছ। দেখছ বড়ো বড়ো গাছের ছায়ার নকসা সেইসব পতঙ্গেরা পেরিয়ে যাচ্ছে। হাত ও বুকের লোভনীয় পেশী অনাবৃত করে আজ আর তেমন কেউই নেই তোমার কাছাকাছি। শুধু আবছা স্মৃতির মতো শূন্যতা আছে। কবেকার কিছু আঙুলের মতো অংশ থেকে চুইয়ে পড়া উত্তাপের মতো উত্তাপ আছে। আর কিছু নেই। একটি অন্ধ দোকানের সামনে এবড়ো- খেবড়ো খানায় জল জমে আছে

    সেভাবে কিছু কি আজ ভাবছ তুমি? এমন নির্ধারিত প্রসন্নতার দিনে, প্রশান্তির দিনে শুধু আর্দ্র চাঁদের মতো মুখে বসে থাকতে ভাল লাগে। পৃথিবী এসময় শিশুর দেহের চেয়েও নরম। শুধুমাত্র এই ভাবনাটি প্রজাপতির মতো তোমার দিকে উড়ে এসে তোমাকে আবিষ্ট করে ফেলে। তুমি তোমার হাতদুটি ঘুরিয়ে- ফিরিয়ে দেখ। দেখ, কী কোমল মোমের মতো তোমার হাতদুটি। অনামিকায় একটি অস্পষ্ট আংটি। তাতে একটি সোনালি সাপ মুখ উঁচিয়ে একফোঁটা মনোকষ্টকে ধরে আছে। মনে মনে যেন তুমি তখন সচকিত হও। ফের চেয়ে দেখ তৃণভোজী, মাংসাশী সেইসব পতঙ্গের সারিকে। গাছের ছায়ার নকসা পেরিয়ে পেরিয়ে ওরা আরও নতুন সেতু, পথঘাট অতিক্রম করছে। একখানে কয়েকটি পতঙ্গ উঠে পড়েছে আরও কয়েকটি তেমনই পতঙ্গের গায়ে। কীসের একটি গাঢ় ছায়া পৃথিবীতে পড়তেই তুমি ওপরে তাকিয়ে দেখ যে, একটি দীর্ঘ সরীসৃপ সূর্যের গা বেয়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে। তুমি ভাব হয়তো- বা গন্তব্যের ঘ্রাণ সকলেই টের পায়। শুধু আজ এই তোমার নির্ধারিত প্রসন্নতার দিনে, প্রশান্তির দিনে তোমারই কোনো গন্তব্য নেই। শুধু আর্দ্র চাঁদের মতো মুখ আলপনার মতো শূন্যতায় সাজিয়ে তুমি বসে আছ। সরু সরু কালো রেখার মতো অজস্র চুল তোমার উড়ে এসে তাতে আটকে রয়েছে। যেন কুয়াশার ভেতর একটি জাহাজ নিঃশব্দে চলে যাচ্ছে দিগন্ত পেরিয়ে, অথবা যেন ঘাসে কুটো পড়ে

    আছে চেতনার অতীত বহু ঝড়- জলের পর

    ঢেউ


    ঘরের দেওয়ালে কত ছোট ছোট ঢেউ আটকে আছে দ্যাখো। কবেকার ঢেউ এসব। হয়তো তোমার মনে আছে। আমারও মনে আছে। ঢেউগুলোর পাথর আত্মাও হয়তো তোমাকে, আমাকে আমাদের মতোই মনে রেখেছে। স্টেশনের ভীড়ে জরদ্গব মানুষেরা যেমন ঠেলে, ঢুঁসিয়ে এগিয়ে যায় পড়ন্ত, অস্তগামী কোনো ট্রেন ধরবে বলে, আমাদের এলোমেলো অবিন্যাস্ত করে দিনগুলি এগিয়ে গেছে। সেই ভীড়, সেই ছোটাছুটি চিৎকারের পর তুমি আমি আছি। এমন আলস্যে আজ পাশাপাশি ভেঙে পড়ে আছি আর দেওয়ালে আছে ওই স্থির ঢেউ। কখনো তোমার অবর্তমানে দেখেছি, ঢেউগুলি যেন মাছের চোখের মতো জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে। হয়তো অলীক, হয়তো দেখার ভুল। কিন্তু দেখেছি, মাছের চোখের মতো জ্বলজ্বলে চোখে ওরা চেয়ে থাকে। প্রতিহিংসা নয়, বরং যেন কেমন বিষণ্ণ সেই চোখের দৃষ্টি। যেদিন বাইরে সাদা থান পরা বৃদ্ধার মতো বৃষ্টি নামে, মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরস্পরের থেকে, প্রাচীন রোমশ কাঁঠালগাছের ত্বক বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে, মানুষের তেমন করণীয় কিছু থাকে না বলে ঘরে সুখাদ্যের গন্ধ ওঠে, সেইদিন ঢেউগুলি মাছের চোখের বদলে বহুদূরের তারার মতো মিটমিট করে। যেন তাদের পাথর আত্মা, পাথরের ভেতরেই আরও গাঢ় পাথরের দিকে যায়। বাইরে হু হু করে চলে সাদা থান পরা বৃদ্ধার মতো বৃষ্টি। অশিতীপর মানুষের মতোই বিচারের চেতনা লোপ পায় তার। প্রাচীন রোমশ কাঁঠালগাছের ত্বক দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে জল পড়ে। সুখাদ্যের টানে, গন্ধে ঘরের মানুষেরা বেড়ালের মতো ছটফট করে

    আলস্যে যখন আজ পাশাপাশি ভেঙে পড়ে আছি, দেওয়ালে আটকে থাকা কবেকার ঢেউগুলিকে দ্যাখো। তিমির মতো আকারের সব ঢেউ, কোথা থেকে যেন ছুটে এসেছিল। কোনো সমুদ্রের গর্ভ থেকেই হয়তো। এই রহস্যের সমুদ্র কেউ কি কখনো দেখেছে? কোনো যুথবদ্ধ গাছের সীমানা দেওয়া পথ দিয়ে গেলে ফাঁকে ফাঁকে সেই সমুদ্র কি দৃশ্যমান হয়? ভাবি আমি। তুমি ভাব কি? নাকি আড়ষ্ট, ক্লান্ত চুলের ঢলে আঙুলে বিলি কাটতে কাটতে ভাব, জীবনে কিছু তেমন দেখাই হল না শুধু এই চতুর্দিকে মনুষ্যসমান দেওয়ালগুলি ছাড়া, জানালার বাইরে ওই যে কী এক আগাছার শীর্ষ, সেটুকু ছাড়া। মনকে সুদূরে পৌঁছে দেওয়া কোনো সুগন্ধের বদলে, গুপ্তচরের মতো লুকিয়ে থাকা একটি এঁদো নালার কটু গন্ধ ছাড়া। তুমি নও, তোমার শরীরে যে মৃদু বাতাস লেগে থাকে, তারা হাহাকার করে। তোমাকে ঘিরে যে অলীক পতঙ্গগুলি ওড়ে, তারা হাহাকার করে। সেই হাহাকার যেন আমি শুনতে পাই। আমার দেহগত যে আরেকটি মানুষ, সেও শুনতে পায়। শুনতে পায় অন্তরীক্ষে সেসময় অবসর যাপনে বসা তোমার পূর্বসুরীরা। শুনতে পান আরেকজনও, যাঁর বাহুতে শক্ত, লোহার মতো পেশী আছে। এইসব কথা হয়তো- বা ঢেউগুলি জানে। যেহেতু তারা ঢেউ, নিশ্চল একেকটি ঢেউ, আত্মা পাথরের তাই ওরা অমন অবিচল থাকে। হয়তো তুমিও দৈব, তোমার সহচর বাতাস, পতঙ্গদের হাহাকার দৈব, ফলে সেই রহস্যের সমুদ্র থেকে একটি রেশমের ঝুলে সাজান শকট আসে। সদরে দাঁড়িয়ে আওয়াজ দেয় আর তুমি যেন কোনো শূন্যে উবে যাও

    তোমার ঘ্রাণ, গোপনীয়তা রক্ষার পোশাক, চাঁদের মতো একটি অন্তর্বাস, কয়েকজোড়া ক্লান্ত, বুড়ো সহিসের মতো ফিতের চপ্পল ঘরে পড়ে থাকে। ঢেউগুলির চোখ তখন ফের জ্বলজ্বল করে, সবুজ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে

    বিচ্ছেদের পরের বিচ্ছেদ


    গত ভোরে সেই ঋজু, ছায়াশীতল গাছের মতো লোকটি তোমার স্বপ্নে এসেছিল। তার ভাস্করের মতো মুখ। ঝুরি- নামা চুলে হালকা সোনার ছোঁয়া। একটি নৌকোর ছইয়ের আগে বসেছিল লোকটি। একটি নৌকোর ছইয়ের আগে। নৌকোর চারপাশে জল। রাসুল বা যীশুর শিষ্যের মতো আরও কিছু আলোকপ্রার্থী লোকটির আগে। তুমি শুধু দৃশ্যের বাইরে, হয়তো- বা এদিকে, পাড়ে। আলোর ফুলকির মতো রোদ যেন কোথাও উঠেছে। তার আভা আকাশে, মানুষ ও জলের নেপথ্যে ছড়িয়ে আছে। স্বপ্নের ভেতরে দিনের বয়েস নেই, অথবা হয়তো আছে- যা অন্য এক সময়ের ক্রম পিছু করে চলে। লোকটি আলোকপ্রার্থীদের সঙ্গে ঝুঁকে পড়ে কথা বলছে। কী সেই কথা- তা তুমি জান না, শুনতে পাও না। তুমি শুধু দৃশ্যের বাইরে, এপারে থামে বাঁধা বন্দির মতো ছটফট কর। দড়ির বন্ধনে হাত, পিছে মুড়ে বাঁধা দুইহাত ছড়ে যায় তোমার তখন। তুমি শুধু দ্যাখো জলের ওপরে ভাসমান পদ্মের মতো নৌকোয় সেই ঋজু, ছায়াশীতল গাছের মতো লোকটির টকটকে মুখ। লতাপাতার আড়ালে বাঙ্ময় তার দুই ঠোঁট। ব্রহ্মাণ্ডে ছুটে যাওয়া কোনো নীলাভ তারার মতো লোকটির চোখ। কোমল ত্বকের গ্রীবা। তুমি ভাব, থামে বাঁধা বন্দির মতো ছটফট করতে করতে ভাব, স্বপ্নের ভেতরে সম্পূর্ণ চেতনা নিয়ে ভাব, এই লোকটি কখনো তোমার হাত সযত্নে তুলে মুঠোয় নিয়েছিল। ঠোঁট রেখেছিল তোমার ঠোঁটে, যোনিতে। বাঁশির মতো তীব্র এক স্বর তোমার কণ্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে হাওয়ায়, মেঘের শেষে, দূরে সারিবদ্ধ গাছপালার গায়ে মিলিয়ে গিয়েছিল সেদিন। মাখনের মতো তোমার অন্তর্বাস মেঝেয় ছিটকে পড়ে আছে। একটি হাত কেবলই শূন্যে ঝলসে উঠে নিভে নিভে যাচ্ছে আবার

    দৃশ্যের বাইরে তুমি ছটফট করছ। জমাট অন্তর ঠেলে উঠতে চাইছে তোমার গলা দিয়ে। ভাবছ, এখুনি একটি চিৎকার তোমার প্রয়োজন। যে লোকটি নরম মোমের মতো কণ্ঠে কথা বলতে বলতে তোমার সামনে নগ্ন হয়েছে, যার বহুদিনের সাড়া- না- পাওয়া লিঙ্গ তুমি দেখেছ, যার শীর্ণ বুকের অবক্ষেপ ঠাণ্ডা, বরফের স্রোত হয়ে এসে তোমার রোমে, বালিতে মিশেছে- তাকে তুমি দেখছ পবিত্র গ্রন্থের কোনো নায়কের মতো। অথচ তার দমকে দমকে কেঁপে ওঠা তুমি জান। বিড়বিড় করে মাথার ওপরে, আকাশের ওপারে থাকা কাউকে কিছু বলার দৃশ্যটি জান। সেই দুর্বল, অসহায় শরীরের নীচে শুয়ে থেকে জানালার পর্দার দোল, ছোট্ট টুলের ওপরে রাখা একটি ফুলদানির ভীরু, আনত দৃষ্টি, দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে একটি উৎসাহী দিনের গর্জন তোমার মনে আছে। মনে আছে বাইরে কোথাও কোনো অদৃশ্য ফেরিওলার সুর দিয়ে দিয়ে ডেকে যাওয়া হাঁক। মনে আছে অদূরে কাঠবাদামের মতো বাথরুমের দেওয়ালে একটি সুন্দরী পাখির ডিম, হাতে- পায়ে ব্যবহার করার রঙ আর, আর উদ্ভিন্ন হাতলে ঝোলান একটি নরম আয়না। অথচ গত ভোরে, স্বপ্নে সেই লোকটি মুখ নামিয়ে শুধু সম্মুখে বসা আলোকপ্রার্থীদেরই সঙ্গে কথা বলছে। সে তোমার দৃশ্যের বাইরে অস্তিত্ব, তার বিন্দুমাত্র টের পাচ্ছে না। অথচ তোমার যোনিতে ওর ফেলে- যাওয়া আংটি- অলংকার আছে, হাসির টুকরো আছে। চশমার কাচ, গায়ের গন্ধ আছে। তুমি ভাব, মানুষ কী পতঙ্গের মতো শঠ, আত্মপরায়ণ। পিছে মোড়া হাতদুটি নিয়ে থামের গায়ে তুমি ছটফট কর, রাগে অন্ধ হয়ে যাও। স্বপ্নে নৌকোয় ঋজু, ছায়াশীতল গাছের মতো লোকটি লোভনীয় মৃদু হেসে হেসে শুধু সম্মুখের

    শিষ্যের মতো আলোকপ্রার্থীদেরই সঙ্গে কথা বলে। হাতের লণ্ঠন তুলে তাদের দূরের নক্ষত্র দেখায়, আগুয়ান জাহাজ দেখায়

    আরও বিচ্ছেদ


    সেই লোকটির জন্য তোমার কেমন একটা মায়া হতে থাকে। গাঢ় মনোবেদনা এসে জমা হয় স্তনের আড়ালে নোনা শ্যাওলার মতো। তোমার স্তন ব্যথা করে ওঠে, টের পাও যোনিতে কয়েকটি অবুঝ ফুল যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াতে চাইছে। এখানে সেই লোকটি থাকে না, ছিলও না কোনোদিন। ওই যে মানুষের আত্মার মতো জানালা, ঝুলে থাকা পর্দার খুব অস্ফুট দোল, তার বাইরে যে বাঁকান থামের মতো আকাশ, নীচে সব উঁচু- নীচু গাছপালার মাথা বা এ ওর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতা করে দাঁড়িয়ে ওঠা ঘরবাড়ি, জলধারার মতো যেসব রাস্তা- এইসবের মধ্যে কোথাও লোকটি নেই। ছিল না কোনোদিনও। এইসব তোমার জগৎ, তোমার পৃথিবী। এখানে বিভিন্ন মুখোসের পেছনে দাঁড়ানোর পর, বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের মহড়ার পর, তোমার দিকে উড়তে উড়তে একটুকরো নৈঃশব্দ্য আসে। সে সময় তোমার জগৎ, তোমার পৃথিবী জনহীন। শুধু কোথাও পাখি ডাকে। মৃদু উষ্ণতা আস্তিনে রেখে লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাসের মতো হাওয়া বয়ে যায়। তোমার নিকটে- দূরে তখন কেউ- ই নেই। তখন সেই লোকটির কথা তোমার মনে পড়ে। স্তনে, যোনিতে, ফেলে রাখা তোমার বৈদূর্যের মতো শরীরের আরও নানা ভাঁজে গাঢ় মনোবেদনা এসে জড়ো হয়। ভাব, আহা লোকটি জীবনে সেভাবে পেল না কিছুই। না তেমন হৃদয়ের ছোঁয়া, না শরীর। তার শীর্ণ, ফর্সা গুল্মের মতো শরীরটির কাম, তেষ্টা কোথায় আর তেমনভাবে উন্মুক্ত হবার দরজা পেল? দীর্ঘ, শিথিল লিঙ্গটিকে কে আর সেভাবে কাছে টেনে নিয়ে, আপন করে স্নেহ দিল? খ্রীস্টের মতো চুল, দাড়ি আর শুদ্ধপ্রাণ অসংখ্য রোমের ভেতরে লোকটি কেমন অস্পৃশ্যই থেকে গেল। যেন পাইনপাতার আড়ালে প্রকাণ্ড হলুদ এক চাঁদ

    তুমি পাশ ফেরো। মচমচ করে তোমার পাশ ফেরার শব্দ হয়। যেন বিছানা নয়, শুকনো পাতার মধ্যে শুয়ে আছ। কোথাও, কোনো ধাতুর তৈজসে তোমার এমন ছায়াটি দেখা যায়। তুমি অপলকে তোমার ঈষৎ খাটো সেই ছায়াটি দ্যাখো। দ্যাখো, তোমার বন্ধনীমুক্ত চুল বিছানার প্রান্ত উপছে কেমন গড়িয়ে পড়েছে। তোমার দুই স্তনের স্তূপ। পোশাকের ছাট সরে গিয়ে বেরিয়ে থাকা দুধের মতো পা। ভাব, এখনো তুমি সুন্দর। এখনো তোমার মধ্যে অসংখ্য জাহাজ ডুবে যেতে পারে। ছায়া দেখতে দেখতে তুমি তোমার একটি হাত নিয়ে আস গালে, সেখান থেকে নিয়ে যাও কণ্ঠায়, তারপর দীপ্যমান স্তনে। দুধের মতো একটি পায়ের নখ দিয়ে পোশাক সরিয়ে অন্য পা- টিকেও মুক্ত করে দাও। কেমন শিরশির করে তোমার শরীর। গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম আসে। টের পাও কানের লতিতে অস্তগামী সূর্য এসে থেমেছে। ভাব, তোমাকেও কেউ সেভাবে ভালবাসেনি। হয়তো লোকটি পারত। চামড়ায় বাঁধান খুব ভারী, মূল্যবান গ্রন্থের মতো সযত্নে হাতে তুলে পৃষ্ঠা বদলে বদলে তোমাকে পড়ত। কোনো জায়গায় সহসা থেমে দাড়ির ভেতরে রক্তিম ঠোঁট নাড়িয়ে বলত ‘আহ, এই জায়গাটি কী অপূর্ব, কী সুন্দর। কী গভীর দর্শনের কথা এই কয়েকটি লাইনে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জান তুমি?’ তোমার শরীর শিউড়ে শিউড়ে ওঠে। চতুর্ভুজের কর্ণ বরাবর এঁকেবেঁকে চলে যায় যেন একটি বিমূর্ত সাপ। তুমি যেন কাউকে সহসা আগুনের হলকা থেকে বা খাদে পড়বার আগে হাত টান দিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরছ, সেভাবে নিজেকে জড়িয়ে ধর। ঠোঁট কামড়ে সম্ভাব্য ঘটনাটির পরিণতি ভাব কিছুক্ষণ। কোথাও পাখি ডাকে। আলুথালু চুলে ছোঁয়া দিয়ে মৃদু একপ্রস্থ হাওয়া বয়ে

    যায়। তুমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে ভাব, লোকটি তোমার কেউ নয়, কেউ নয়। কোনোদিনই তোমার কেউ নয়। ছিলও না কোনোদিন



    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • কাব্য | ১৫ এপ্রিল ২০২৪ | ৪৫০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন