দ্বিতীয়ার নখের মতন চাঁদখানা শুড়িপুকুরের পাড়ের ঘন নারকোল গাছগুলোর আড়ালে যতক্ষণ না হারিয়ে যেতো পাড়ার কুঁচোকাঁচার দল আকাশের দিকে হাঁ করে পিছন পিছন চলত কিসের অমোঘ টানে। সেদিন বিকেলে বাবুজি-মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে এসেছি গ্ৰামের বাড়িতে। মা আর আমি ব্যাগ পত্তর নিয়ে রিক্সায়, বাবুজি সাইকেলে। আমাদের গ্ৰামের বাড়ি বর্ধমানের মেমারীর কাছে এক গণ্ডগ্ৰামে। নাম বহরমপুর। সে আমলে ও’গ্ৰামে কোন বড় গাছ ছিল না বিধায় লোকে ডাকত নেড়া বরমপুর। বছরের কটা মাস বাদে রাস্তা জুড়ে এত কাদা যে কোন রিক্সা যেতে চাইত না গ্ৰামে। তখন গরুর গাড়ি ভরসা। কতবার গ্ৰামের বাড়ি থেকে মেমারীর ফ্ল্যাটে ফিরেছি ছত্রি দেওয়া গরুর গাড়িতে চেপে। ভিতরে যাতে বসতে অসুবিধা না হয়, তাই খড় বিছিয়ে মাদুর পেতে দিতেন গাড়োয়ান চাচু। স্কুলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অঙ্কের দিদিমনি তখন গ্ৰামের বাড়ির ছোটবৌ। ঘোমটা দিয়ে উঠে বসতেন ছত্রির ভিতর। বড়মা বলতেন,"রওশন মাঝে বসো। নয়ত ঝাঁকানি লাগবে। সাবধানে যেও। আবার এসো বোন।” আর আমি র্যালা নিয়ে গিয়ে বসতুম গায়োয়ান চাচুর পিছনে। হাতে গরম অজুহাত, "ভিতরে খুব গরম।”
অবশ্য সে তো ঈদের পরে ফেরার পর্ব। আমি কিন্তু বলতে বসেছি ঈদের গল্প। তাহলে ফেরা যাক চাঁদের পথ ধরে।
আমরা দেশের বাড়ি যেতুম ২৯ শের রোজায়। সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদ নয়ত আর একদিন মানে তিরিশটি রোজা সম্পূর্ণ করে ঈদ পালন। তখন আর চাঁদ দেখার ঝামেলা নেই। হাদিস মোতাবেক তিরিশটি রোজা হয়ে গেলে অবশ্যই পরদিন ঈদ। এখন যেমন,"যাহ! সৌদিতে আগে ঈদ হয়ে গেল। আমাদের হল না কেন?” বলে বিভিন্ন বিতণ্ডার শুরু তখন সেসব কেউ ভাবতও না। চাঁদ দেখা গেলে ঈদ হবে সেই অঞ্চলে নয়ত রেডিওয় কান পেতে থাকতেন মুরুব্বিরা- নাখোদা মসজিদের ইমামসাহেব যা ঘোষণা করবেন মেনে নিতেন সবাই।
অন্ধবিশ্বাস? হবেও বা। কী এসে যায়। আনন্দই তো মূলমন্ত্র।
সে ছিল সাতের দশকের শেষভাগ। মানুষগুলো ছিল অন্যরকম। তখন আমরা কার কটা পোষাক হল গুণে দেখতুম না। হিসেব কষতুম না কারটা কত দামি? একটা নতুন জামা হলেই হল। আর যদি আত্মীয় স্বজন দেয় দুটো চারটে ছটা আটটা তাহলে ঈদের দিন সে পড়ত আতান্তরে, কোনটা ছেড়ে কোনটা পরবে ভাবতে ভাবতে দিন কাবার।
ঈদের দিন ভোরবেলা, পছন্দের জামাটি নিয়ে আমরা সব বোনেরা মিলে যেতুম পুকুরে স্নান করতে। ওরা বাটি সাবানে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করবে এক ঢাল চুল, একটিমাত্র বাস সাবান, সেটি অতি সাবধানে সযত্নে তুলে রাখা শুকনো জায়গা,'পানি লেগে গলে নষ্ট হয় না যেন’! মাথা ধুয়ে ভিজে গায়ে চট করে মেখে নেবে সেই সুবাসিত সাবান। ভেজা চুলে গামছা জড়িয়ে বড়বুবুরা গায়ে কাপড় আলগোছে ফেলে ছুটে চলে যায় বাড়িতে। হয়ত পরের ঈদে তার বিয়ে হয়ে যাবে। এইঘাটে তার এইভাবে স্নানের কোটা শেষ। আমরা নাবালিকা অবোধ মেয়ের দল সেদিন পুকুর গাবিয়ে স্নান করতুম না। সুবোধ বালিকার মতন স্নান সেরে বাড়ি ফিরতুম গুটিগুটি পায়ে।
বাড়ি ফিরলে মা চুল আঁচড়ে, নতুন জামা পরিয়ে পাঠিয়ে দিতেন ঈদগাহে।
সেদিন ছেলেরা অন্য ঘাটে ছটপট স্নান সেরে ছুটছে গ্ৰামের ছোট্ট ঈদগাহে। ঈদগাহ এবং সেই অভিমুখী সবকটি রাস্তাকে পাড়ার উঠতি যুবকরা রাত্রি জেগে সাজিয়েছে রঙিন কাগজ দিয়ে। উজ্জ্বল রঙ ছড়িয়ে তারা পতপত করে উড়ছে সকালের নিষ্কলুষ হাওয়ায়। কদিন আগে ঈদগাহ রঙ করা হয়েছে। সাদা ধবধব করছে চারদিকের দেওয়াল। মিম্বারের মাথায় সবুজ নক্সা। আলাদা স্নিগ্ধতা এনে দেয় যেন। ইমাম সাহেবের পিছনে নামাজে দাঁড়াবেন পুরুষরা আর একদম পিছনে জটলা করে থাকব আমরা পাড়ার যত খুদের দল। খুতবার আগে বড়রা বারে বারে বলে যাবেন,"চিল্লাচিল্লি করো না। চুপ করে খুতবা শোন। নয়ত গুনাহ হবে।” আমরা আর গুনাহ নেকির কী বুঝি? আশেপাশে পরিচিত মুখ দেখতে না পেলে কান্না পায়, কেঁদে ফেলি, আবার কান্নার মাঝেই অন্য কারোর কোন কীর্তিকলাপ দেখে কাঁদতে ভুলে যাওয়া, এর জামার ফিতে ধরে টানা, ওর টুপি খুলে দেওয়া হতে হতে কখন যেন নামাজ শেষ হয়ে গেছে। বড়রা বাড়ির রাস্তা ধরেছেন ঘরের ছানাটিকে খুঁজে নিয়ে। পথে ভাই বেরাদর, পাড়াপড়শির সঙ্গে দেখা হলে সালাম দিচ্ছেন কোলাকুলি করছেন। নেমতন্ন করছেন সিমুই, সুজি খাওয়ার।
বাবুজি, চাচু, দাদু, চাসত ভাইরা নামাজের পরে ফিরলে শুরু হত ঈদি আদায়। বড়দের পায়ে হাত রেখে সালাম করলে ঈদি দিতেই হবে- এই আমাদের দাবি। বড়রা পইপই করে বলছেন,"আচ্ছা আচ্ছা, ঈদি দেওয়া হবে কিন্তু সালাম করতে হবে না। ও জিনিস করতে নেই। বিদাত। মাথা একমাত্র নিচু হবে আল্লাহর সামনে। আর একান্তই যদি সালাম কর তাহলে সম্পূর্ণ বসে, মাথা উঁচু রেখে পায়ে হাত দিতে পারো।”
তাই তো তাই সই কিন্তু ঈদি চাই। সেই আমলে পাওয়া চারানা, আটানা, দশ পয়সা জুড়ে জুড়ে কারো কারোর ঈদি জমত দুটাকা পাঁচটাকা। সেদিন সে বড়লোক। বিকেলে “আসান সইত” তলার মেলায় গিয়ে সে যে কী কিনবে আর কী কিনবে না তার হিসেব করতে করতে ভুলে যেতো পায়ে হেঁটে পেরিয়ে এসেছে কিলোমিটার আড়াই মেঠোপথ। মেলার মাঠের রঙিন ফিতে, বেলোয়ারি চুড়ি, হাতে ঘোরানো নাগরদোলা, কটকট শব্দ ঘুরতে থাকা নম্বর দেওয়া চাকা, মাটির খুদেখুদে হাঁড়িকুড়ির মাঝে ঈদ মিশে যেতো আমাদের ঝকঝকে চোখের তারার আনন্দে।
এবার বাবুজির কবর জিয়ারত করতে গ্ৰামের বাড়ি গিয়েছিলুম ঈদের দিন। আসান সইত তলায় মেলা বসেছে আগের মতোই। তবে আগে মেলা বসত কেবলমাত্র মাজারের ভিতরের বাগানে। রাস্তার ধারে মস্ত মাঠখানা ফাঁকা থাকত। মেলায় ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলে মাঠে এসে বসতুম আমরা। খানিক জিরিয়ে নিয়ে বাড়ি ফেরার পালা। এবার দেখি সেই মাঠ জুড়ে মিকি মাউস, ট্রাম্পোলিন, জায়েন্ট হুইলের গজল্লা। মনখারাপ হয়ে গেল।
পৈতৃক ভিটেটি আগের মতোই আছে। নেই শুধু দাদু, দাদিবুবু, চাচু, বড়মা, বড়দা, বড়ভাবি। বাড়িতে ঢুকতেই মেজ সেজ ভাবি সালাম দিয়ে এগিয়ে এলেন,"কাকিমা এলো না? কেমন আছে?”
“ভালো। বয়স হয়েছে তো। বোঝই তো আসতে পারে না এভাবে।”
বড়দার বড়মেয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। জল খেতে দিয়ে বসল খাবারের ব্যবস্থা করতে। পাশেই শ্বশুরবাড়ি ওর। আমি যাব বলে সকালে সুজি, সিমাই, লাচ্চা, হালুয়া আর কিমা কারি নিয়ে এসে গুছিয়ে রেখেছে মিটসেফে। দস্তরখানে সযত্নে সাজিয়ে দিল খাবার। সেজভাবি কাচের বাটি ভরে নিয়ে এলেন ঘুগনি,"মিষ্টি খেয়ে মুখ মরে যাবে। তাই ঘুগনি নিয়ে এলাম।”
নিয়ম রক্ষার্থে যৎসামান্য মিষ্টি মুখে দিয়ে ঝাল ঝাল ঘুগনি খেলুম তৃপ্তি ভরে। ফ্ল্যাশ ব্যাকে ভাসছে ছোটবেলার সাদামাটা ঈদ।
হ্যাঁ বদল অবশ্যম্ভাবী। অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ঈদের এই মানুষে মানুষে মেলামেশা, দুটো কুশল সংবাদ, শত্রুমিত্র ভুলে পরস্পরকে হার্দিকতার সঙ্গে জড়িয়ে ধরা আর সিমুই, সুজি, হালুয়ায় মেশানো খুশির বোধহয় বদল হয় না। যেমন বদলায়নি আজও ২৯ শের রোজায় আকাশের পশ্চিম কোণায় নখের মতন চাঁদ খোঁজা আগ্ৰহী চোখের …