সলিলের পড়াশোনায় মাথা ছিল না। তাই মাধ্যমিকের পর কাকা ওকে একটা বিলেতি মালিকানাধীন ফ্যাক্টরিতে হেল্পার হিসাবে ঢুকিয়ে দিলেন। সুপারিশ ছাড়া ওখানে ঢোকা মুশকিল। কাকা বলেছিলেন, পড়ায় যখন তোর ইচ্ছা নেই ভালো করে হাতের কাজটা শেখ। সেটা মন দিয়েই শিখেছিল সলিল। ফলে ক্রমশ হেল্পার থেকে মেকানিকে পদোন্নতি হোলো। মাইনে, ওভারটাইম মিলিয়ে রোজগার মন্দ নয়।
তিনকূলে ঐ কাকাই সলিলের একমাত্র আপনজন। কাকার বাড়ীতেই ছোট থেকে মানুষ। কাকার অবস্থা ভালো। মনটাও দরাজ। তাই চাকরি পাওয়ার পরেও সলিলের থেকে এক পয়সাও নিতেন না তিনি। বলতেন, আমি আর কদিন, পয়সা জমা, তোর একটা নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই তো দরকার।
কাকার উদ্যোগেই সলিল একটা ছোট্ট দু’কামরার ফ্ল্যাট কিনলো। সিংহভাগ অর্থ সাহায্যও কাকাই করলেন। অকালে বাপ মা হারানো শান্ত, নির্বিরোধী ভাইপোটির ওপর তাঁর বেশ অপত্য স্নেহ ছিল। তাঁর নিজের দু ছেলেই দাঁড়িয়ে গেছে। কাকা সলিলকে বলেন, দ্যাখ, ঘর যখন হয়েছে, তাহলে তো এবার একটি সুশীলা ঘরণীও দরকার। কদ্দিন আর কাকিমার হাতের রান্না খাবি? এবার নিজের বাড়িতে নিজের মতো সংসার করতে হবে তো।
সলিলের বিয়েটাও কাকা কাকিমার উদ্যোগেই হলো। এসবের সাথেই বজায় ছিল ছোটবেলা থেকে সলিলের একমাত্র বিনি পয়সার স্পোর্টসের শখ - দৌড়। ১৫০০ মিটার দৌড়ে সলিল ছিল সাবলীল। বছরে কয়েকবার হাফ ম্যারাথনও দৌড়োতো। তাই রোজ সকালে অভ্যাস করতো। একবার রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় প্রথমও হয়েছিল। কিছুদিন বাদে ওদের একটি মেয়ে হলো। সরল আনন্দে তিনজনের ছোট্ট সংসার চলছিল ভালোই।
কিন্তু সহজ সুখও কখনো জীবনে সয় না। একদা চালু কোম্পানি ক্রমশ রুগ্ন হয়ে এল। বাজারের কঠিন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে গিয়ে কোম্পানিতে লোকসান শুরু হলো। বিলেতি মালিকানাধীন কোম্পানিতে শ্রমিকদের মাইনে ছিল ভালো। তখন কোম্পানির আয়ের এক চতুর্থাংশই ব্যয় হোতো কর্মীদের বেতনে। তাই কর্তৃপক্ষ ইউনিয়নের মাথাদের সাথে আলোচনা করে কোম্পানি বাঁচাতে মাইনে অপরিবর্তিত রেখে ওভারটাইম, বোনাস কিছুটা কমানোর প্রস্তাব রাখলেন। গাছ বাঁচলেই যে সবাই ফল খেতে পারে - এই সহজ যুক্তি অপরিণামদর্শী ইউনিয়ন নেতারা মানলেন না। ফলে লোকসানের বোঝায় একসময় কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেল। বিয়ের কুড়ি বছর বাদে সবার সাথে পথে নামলো সলিল। উগ্ৰ ইউনিয়নবাজীর অভিশাপের এ এক পরিচিত সত্যকাহিনী।
কাগুজে যোগ্যতা না থাকায় সলিল আর কোথাও কাজ পেলো না। শুরু হলো জীবনধারণের নিমিত্তে নানা উঞ্ছবৃত্তি। একমাত্র মেয়ে শিখার পড়াশুনোয় মাথা আছে। সরকারি কলেজে ইংরেজীতে অনার্স পড়ছে। তবু শিখার ইচ্ছে বি.এ পাশ করে যে কোনো একটা চাকরি জুটিয়ে সংসারে সাহায্য করে। সলিল রাজি নয়। বলে, দ্যাখ মা, আমার তো পড়াশুনোয় মাথা, মন কিছুই ছিল না বলে জীবনে তেমন কিছু করতে পারলাম না। তোর যখন দুটোই আছে তুই অন্ততঃ এম.এ অবধি পড়। আমি যেভাবে হোক চালাবো। সে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই ট্যূইশানি করে সময় নষ্ট করার কথা ভাববি না।
শিখা গভীর দোলাচলে ভোগে। একদিকে বাবার কষ্ট দেখে সংসারে সাহায্য করার তাগিদ, অন্যদিকে বাবার ইচ্ছাপূরণের বাসনা। তবু খারাপ লাগলেও মন দিয়ে পড়াশুনা করে ভালো ফল করার সংকল্প নেয় শিখা।
সলিলের এখন বয়স সাতান্ন। অনেক ঘাটের জল খেয়ে এখন ও একটা বড় পরিকল্পিত উপনগরীতে হাউসকিপিং বিভাগে কাজ পেয়েছে। হপ্তায় ছদিন সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটে ডিউটি। আট হাজার টাকা মাইনে। মাসে দুটো দিন ছুটি। কাজ বলতে ওর জন্য নির্দিষ্ট চারটি এগারোতলা ব্লকের প্রতি তলার প্যাসেজে ঝাড়ু, পোঁছা মারা ও প্রতিটা ফ্ল্যাট থেকে গারবেজ সংগ্ৰহ করে চাকা লাগানো বিনে করে সীমানার প্রান্তে সেন্ট্রাল ডাম্পে গিয়ে ফেলা। এছাড়া সপ্তাহে একদিন ওর জন্য বরাদ্দ রাস্তা, পার্কের অংশে ঝাড়ু দেওয়াও ওর কাজ। ওদের মধ্যে কেউ কোনোদিন দরকারে ছুটি নিলে সেদিন তার কাজটাও বাকিদের ভাগভাগি করে করতে হয়। কারণ অতিরিক্ত লোক নেই।
সৌমেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তবে সময়ের আড়াই বছর আগে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। চাকরিজীবনে গুজরাটের জামনগরে একটা দু বেডের ফ্ল্যাট কিনেছিল। সেটা বেচে বেহালার কাছে একটা বড় উপনগরীতে তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট কিনেছে। তখন ওরা কর্ণাটকের মনিপালে ভাড়া বাড়িতে থাকে। কলকাতার ফ্ল্যাট কেনা থাকলো - এখন আসবে না। বাড়ীর কিছু জিনিসপত্র মনিপালে নিয়ে গেছে। বাকি মাল ফুল ট্রাক লোডে আপার মতো নয়। অযথা অনেক ভাড়া পড়ে যাবে। তাই সৌমেন ওসব পার্টলোডে জামনগর থেকে কলকাতার ফ্ল্যাটে পাঠিয়েছে গতি ক্যুরিয়ারে।
তাতে অনেকটা সাশ্রয় হয়েছে। তবে চুক্তি অনুযায়ী ওরা বাড়ীর তলায় নামিয়ে দেবে। সৌমেনকে ওর আটতলার ফ্ল্যাটে সেসব মাল নিজের ব্যবস্থাপনায় তুলতে হবে। সৌমেন তাই মাল পাঠানোর আগেই ওর ব্লকের সিকিউরিটি গার্ডের কাছ থেকে সলিলের খোঁজ পেয়ে কথা বলে রেখেছিল। সেইমত চারটেয় ছুটির পর সলিল আর একজনকে এনে দুজনে মিলে ওর সব মাল ফ্ল্যাটে তুলে দিল। লিফট থাকলেও সোফা, আলমারি ও আরো কয়েকটি বড় মাল লিফটে ঢুকলো না। ওসব সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যেতে হোলো। জুনের কলকাতায় ভ্যাপসা গরমে দুজনেরই পরিশ্রমে ঘেমে গলদঘর্ম অবস্থা।
সৌমেন বলে, কত দিতে হবে? সলিল কুণ্ঠিতভাবে হাজার টাকা চায়। ও ভেবেছিল সৌমেন দরাদরি করবে। কিন্তু যারা কায়িক পরিশ্রম করে ন্যায্য পয়সা চায় তাদের সাথে সৌমেন কখনো দরাদরি করে না। তাই ও সানন্দেই সলিলকে হাজার টাকা দিয়ে দেয়। খুশি হয় সলিল। মাল তোলার পর অন্য লোকটির একটু তাড়া থাকায় সে চলে গেল।
সৌমেন জানতে চায়, আপনারা কী ভাবে এটা নিজেদের মধ্যে ভাগ করবেন? সলিল বলে, যেহেতু আমি এই কাজটা ধরেছি তাই আমি রাখবো ছশো, ওকে দেবো চারশো। যদি ও কখনো কাজ ধরে আমায় ডাকে তাহলে সেবার ও রাখবে ৬০% - এটাই আমাদের দস্তুর।
আটতলার জানলা দিয়ে বেশ হাওয়া আসছে। ক্লান্ত সলিলকে সৌমেন বলে, আপনার তাড়া না থাকলে একটু বসতে পারেন। সদ্য তোলা ডাইনিং চেয়ারের একটায় বসে সলিল। সৌমেন জলের বোতল এগিয়ে দেয়। একটু দ্বিধা করছিল সলিল। সৌমেন বলে, নিন না, খুব ঘেমে গেছেন আপনি।
সৌমেন ওর ঘরে বসে একটু গল্প করে ওর সাথে। এমনসব মানুষের সাথে গল্প করতে ভালো লাগে সৌমেনের। কথায় কথায় ওর পশ্চাৎপট জানতে পারে। একসময় সৌমেন বলে, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?
সলিল বলে, বলুন না। সৌমেন বলে, এই যে একসময় আপনি নামকরা ফ্যাক্টরিতে মেকানিক ছিলেন, রাজ্যস্তরে দৌড়ে একবার প্রথম হয়েছেন, এখন ভাগ্যের ফেরে হাউস কিপিংয়ের কাজ করতে হচ্ছে - এর জন্য কি কোনো মনোকষ্ট হয়?
সলিল বলে, ও এই কথা, তা এতে মনে করার কী আছে। হ্যাঁ, দূর্ভাগ্যের ফের তো বটেই। তবে কী করবো স্যার, আমি তো বেশি পড়াশুনো করিনি। চাকরির বাজার খুব খারাপ। অনেক শিক্ষিত ছেলেরাই বেকার। তাদের কেউ গলায় আই কার্ড ঝুলিয়ে শপিংমলে দশ বারো হাজার টাকার চাকরি করছে। আমি তো সে কাজ পাবো না। বা অনেকে ফুড ডেলিভারি করছে।
- তাই আপনি এই কাজ নিলেন?
- তো আমাকে এই বয়েসে কে আর ভদ্রস্থ কাজ দেবে বলুন? তাই বাড়ির কাছে এই কাজটা পেয়ে বর্তে গেছি। বছরে দু সেট ড্রেস, এক জোড়া জুতো, তিন বছরে একটা শীতের জ্যাকেট আর রেনকোট দেয়। আমার বাড়ি এখান থেকে তিন কিমি দুরে। সকালে দৌড়েই চলে আসি। ওতে দৌড়ের অভ্যাসটাও বজায় থাকে।
- তিন কিমি দৌড়ে চলে আসেন!
- স্যার, একসময় মাঠে প্র্যাকটিসে চার মিনিটে দেড় কিমি কভার করতাম। এখন বয়স হয়ে গেছে। রাস্তায় খানাখন্দ, গাড়ি। তাই সকাল সাড়ে সাতটায় বাড়ি থেকে বেরোই। প্লাস্টিক প্যাকেটে টিফিন বক্স প্যাক করি। রুটি আর শুকনো তরকারি - এই থাকে রোজ টিফিনে। ডাল, ঝোল থাকলে চলকাবে। সাথে থাকে এখানকার ইউনিফর্ম আর একটা হাফ লিটার জলের বোতল। সব এই কাপড়ের ব্যাগে ভরি। এটা হাতে নিয়ে হালকা চালে দৌড়ে আসি। মিনিট পনেরো লাগে। সারাদিন কাজের পর একটু ক্লান্ত লাগে। তাই ছুটির পর বিকেলে পা চালিয়ে হেঁটে যাই। তখন আধ ঘন্টা মতো লাগে। দু বেলা এভাবে যাতায়াত করায় শেয়ার অটোর কুড়ি টাকা ভাড়া বাঁচে।
সৌমেন মুগ্ধ হয়ে বলে, বাঃ, এই বয়সেও আপনি রোজ দু বেলা ছ কিমি পথ দৌড়ে, হেঁটেই চলে যান! সলিল বলে, বহুদিনের দৌড়োনোর অভ্যাস স্যার, তাই আমার কাছে এটা জলভাত। মাসে পাঁচশো টাকা বাঁচে। বউ বাড়ীতে চুক্তিতে সেলাইয়ের কাজ করে কিছু আয় করে। আরাম, মান সম্মান এসব নিয়ে ভাবলে আমাদের চলে না স্যার। তাছাড়া কোনো কাজই তো ছোট হয় না স্যার। নীচু হয় মানুষের মন, দেখার নজর। চুরি বা ভিক্ষে না করে সৎপথে পরিশ্রম করে সংসার চালাচ্ছি। সারাদিন খাটুনির পর রাতে শুলে এক ঘুমে রাত কাবার।
সৌমেন খেয়াল করে সলিলের চেহারা এখনো ছিপছিপে। ভুঁড়ির কোনো চিহ্নই নেই। বলে, সাতান্ন বছরেও আপনার শরীর স্বাস্থ্যও কিন্তু বেশ ভালো।
- রোজ দৌড়োই বলে আর ঈশ্বরের কৃপাতেই হয়তো প্রেশার, সুগারের মতো বড়লোকী রোগে এখনও ধরেনি। আপনাদের আশীর্বাদে মাসে এমন এক আধটা ঠাওকা কাজ পেয়েও কিছু উপরি আয় হয়। এভাবেই বেশ চলে যাচ্ছে স্যার। আমাদের চাহিদাও কম। কাকার দৌলতে নিজের বাড়িতে থাকি বলে ভাড়া লাগে না। খরচ বলতে তাই খাওয়া পরা আর মেয়েটার পড়াশোনা। একসময় হন্নে হয়ে একটা কাজের জন্য ঘুরেছি স্যার। যেদিন এই কাজটা পেয়েছি সেদিন আমরা তিনজনে মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়েছি - অবশেষে তাহলে ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন।
স্কুলের পরীক্ষায় সৌমেন বই পড়া বিদ্যায় Dignity of Labour রচনা লিখেছিল। আজ এক স্বল্পশিক্ষিত পিতা তাঁর জীবনাচরণের মাধ্যমে সৌমেনকে তার লেখা রচনার মর্মার্থ বুঝিয়ে দেয়। সলিলের হাত দুটো ধরে সৌমেন আন্তরিক ভাবে বলে, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি আপনাদের মেয়ে যেন ভালোভাবে পাশ করে আপনাদের স্বপ্ন সার্থক করে। সৌমেনের হাত মুঠো করে ধরে কপালে ছুঁইয়ে প্রতিনমস্কার করে সলিল।
তথাকথিত অন্ত্যজশ্রেণীর জন্য নির্ধারিত পেশায় নিযুক্ত অতীতের এক রাজ্যস্তরের দৌড়বাজ। সারাদিন ডিউটির পর আট তলায় ভারী ভারী মাল তুলে প্রবীণ দায়িত্ববান পিতা ক্লান্ত শরীরে কিন্তু প্রত্যয়ী পদক্ষেপে এলিট ব্লকের ঝকঝকে টাইলসে মোড়া উজ্জ্বল প্যাসেজ ধরে ধীরে ধীরে চলে যায়। নির্বাক সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এক সচ্ছল প্রযুক্তিবিদ।