জলের মধ্যে গোলা নীল রংটা নিজের গালে ঘষছে সুদাম।ঘষতে ঘষতে একটা মুখ মনে পড়ছে। সিনেমার মত। তারপর হঠাৎ নিজের আয়না দেখা মুখটা মনে পড়েছে। শুষ্ক, খড়খড়ে। একটা যন্ত্রণা ঠেলে উঠে আসছে। রংটা জোরেই ঘষে দিচ্ছে ও। হঠাৎ ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। ওঠারই কথা। তবে গালের ব্যথায় নয়, মনের ব্যথায়। গৌরী যদিও ইচ্ছে করে মারেনি। সুদাম এক বুক কাদার মধ্যে একেবারে পা ডুবিয়ে সিনেমার হিরোদের কায়দায় গৌরীকে কথাটা বলতে চেয়েছিল। "এখুনি আন্ধার নামবে, তুই পাড়ার ওই ম্যাদামারা ছেলেটা না! কথা বলার মুরোদ নেই, এমন গায়ের কাছে এসেছিস কেন? দেখছিস লা কাজ করতিছি ক্ষেতে! যা এখান থেকে!" কথাগুলো বলেই কোদালটা হাতে তুলে নিয়েছিল গৌরী। কাজ করার জন্যে। সুদাম এত কাছে এসে পড়েছিল যে কোদালের বাঁটের আঘাত লাগতে একটুও দেরী হয়নি।
সুদামের ভেতরটা তখন নাছোড়বান্দা। ধূ-ধূ মাঠ, চাষের ক্ষেত। সেই কবে থেকে গৌরীর ডাগর ঠোঁট, উস্কো খুস্কো চুল, কাদামাখা হাতের ভেতর ধান গাছের শিসের ছায়া দেখতে পেত সুদাম। ঠিক সুদামের মায়ের মত। দিনরাত চোলাই খেয়ে ঝিমিয়ে পড়ে থাকা বাপকে সুদাম চেনে না ঠিক করে। শুধু সেদ্ধ ভাত টুকু বেড়ে দেয় দুবেলা। আর বাপ যখন মাটির দাওয়ায় বমি করে পড়ে থাকে, সুদাম জানে সব 'পোস্কার' করে দিতে হয়। মাও তাই করত। প্রথম প্রথম ঘেন্না করেছিল সুদামের। মায়ের মুখটা মনে করে নিত তখন।
মা চলে যাওয়ার দিনও ওই করছিল। উঠোনটা ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করার সময় হঠাৎ করে মাথা ঘুরে বসে পড়ে সুদামের মা। মুখ দিয়ে সাদা ফেনার মত কী যেন বেরোচ্ছিল। বাপকে ঘরের ভেতর ডাকতে গেল সুদাম। তার জবা ফুলের মত চোখ দেখে সুদাম আর সাহস করেনি। এই বোধহয় তেড়ে এল সুদামকে। দরজার সামনে বেড়ালটা গুটিয়ে শুয়েছিল। সুদামের পায়ে লেগে ‘ম্যাও’ করে ওঠে। সুদামের পিছু পিছু আসে উঠোন পর্যন্ত। উঠোনে ফিরে সুদাম দেখে সব শেষ।
মায়ের শান্ত দুটো চোখ তখনও তাকিয়েছিল। পৃথিবী যেন ছাড়তে চায় না। গৌরীকে দেখেও ঠিক এমন মনে হয় সুদানের। ফুলো মুখ, দুই চোখে জলের মতো প্রবাহ। সেই কোন বয়স থেকে সুদাম দেখছে ওকে। গৌরী তখনো ডাগর হয়ে ওঠেনি। এবার পয়লা বৈশাখের আগেই গৌরীকে নিজের মনের কথা বলবে ভেবেছিল সুদাম। গৌরী সাহসী। মা বলত " ও পাড়ার যে মেয়েটা রোজ জমিতে ধান রুইতে যায়, খুব সাহসী, নিজে ধান রুইতে পারে, জমিতে জল ছেচ দিতে পারে, আর আমার কপালে কেমন মরদ জুটলো দেখো, মাতাল! আরেকজন সারাদিন মাথা নামিয়ে বসে থাকে, আর আমায় লোকের বাড়ি কাজ করে খেতে হয়।" সুদাম তখন সন্ধ্যেবেলা পুকুরধার থেকে ফিরত। যেই থালায় বসে মুড়ি হাতে নিত, মায়ের কথায় থালা ফেলে উঠে যেত বেশিরভাগ দিন। মা আবার পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে খাবারের থালার সামনে বসাত সুদামকে। সুদামের কাজ করতে ইচ্ছে করত না। ওদের মাটির দেওয়ালে যখন চাঁদের আলো পড়ে, সুদামের উঠোনে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মায়ের আঁচলের মত ঠান্ডা মনে হয় ওর। মা বলত “ কাজ না করলে ভাত জুটবে কেমন করে বল দেখি বাপ আমার!” সুদাম উঠে বসত অমনি। গৌরীর মুখটা ভেসে উঠত। কাজ করার কথা মনে হলেই সবে বাপকে বলতে যাবে, বাপ ঘরে ঢুকে হড়হড় করে মদ উগরে দিচ্ছে তখন। আকাশের চাঁদের রংটা আরেকটু উজ্জ্বল ঠেকত সুদামের কাছে।
মা চলে যাওয়ার পর মোহনপুর গ্রামের বাতাস সুদামের গতরখানাকে যেন আরো জড়িয়ে ধরেছে। একবার বসলে আর উঠতে চায় না। আজ বুকে অনেকখানি বল নিয়ে গৌরীর কাছে বলতে গিয়েছিল মনের কথা। গৌরী কি একেবারে মায়ের মত? ঝিমোনো বাপও ওকে বলে 'ম্যাদামারা'! আজ গৌরীও অমন করে বলল! গৌরীকে দেখলেই সুদামের বুকের ভেতর মেঠো হাওয়া বয়ে যায়। জীবন সরকারের জমিতে ধান রুইতে যায় গৌরী। লোকে বলে "গৌরী তো মা দুগ্গা"। দিব্যি আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। চাষ করে। সুদাম ভেবেছিল চড়কের মেলায় ওর হাত ধরে ঘুরবে। বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করেছিল সুদামের। তবুও এক বুক কাদা আর মনে বল যুগিয়ে দাঁড়িয়েছিল গৌরীর সামনে। কোদাল দিয়ে মাটি কোপাতে গিয়েছিল গৌরী, সুদাম অন্যপাশে মুখটা সরাতেই কোদালের বাড়ি। ইচ্ছে করে মারেনি হয়তো। কোদালের বাঁট অসাবধানে লেগে গেছে। তবুও বড় ব্যথা করে সুদামের। এই জুটিয়ে বাড়ি ফিরেছে সুদাম।
জায়গাটার নাম যে কেন বুড়োশিবতলা হল তাই নিয়ে অনেকে অনেক রকম ব্যাখ্যা দেয়। গৌরী কারোর কথাই মানে না। ও মানে এক রাজার গল্প। অনেক যুগ আগে এক রাজা বীরভূমের এই গ্রামে চড়ক উৎসব পালন শুরু করে। এই পুজোকে নীল পূজো বলা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে দুধ, মধু, তেল, ঘি দিয়ে শিবকে স্নান করিয়ে চড়ক গাছের তলায় রেখে দিত। পুজোর আগের দিন এই গাছকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে রাখা হত। তারপর একটা জলভরা বাটিতে শিবের প্রতিকী সিঁদুর মাখা লম্বা কাঠের তক্তা রাখা হতো। রাজার আদেশে এই কাঠের তক্তাকে সকলে বুড়ো শিব মেনে পুজো করেছিল। এই রাজা নাকি গ্রামের কোন এক গরীব মেয়েকে কোন দুর্ঘটনা থেকে উদ্ধার করে বিয়ে করে। কাঠের তক্তাখানা নাকি মানুষের মনের কথা শুনতে পায়! লোকে বলে। তাহলে গৌরীর মনের কথাখানা শুনতে পায় না কেন? একটা ব্যথার কথা কি শুনতে পাচ্ছে?
বুড়ো শিবতলায় আজও চড়কের মেলা হয়। একটা কাঠের তক্তা পরিষ্কার করে তাতে সিঁদুর লাগিয়ে পুজো করে সকলে। গৌরীদের বাড়ির পাশে যে জঙ্গল, জায়গাটা তার কাছেই। গৌরী খানিকটা সিঁদুর এনে মাখিয়েছে তক্তায়। কাল এখানে পুজো হবে। ও এক মুঠো ফুল রেখে যায়। জবা গাছটা কী সুন্দর ফুল দিচ্ছে! লোকে বলে গৌরীর হাতে গাছ ঝিলমিল করে। ধানের শিষ আনন্দে ফল দেয়। তবুও ওর ভেতর ভেতর উচাটন কাজ করে। সারাদিন ক্ষেতের কাজ করে কাদা মেখে বাড়ি যায় গৌরী। বোন ঘরে বসে ঝাল ফুচকা খায়। গৌরী বাড়ি পৌঁছলেই বাটি করে নিয়ে আসে। গৌরীর সব বিস্বাদ লাগে। লম্ফ নিবিয়ে এক একদিন শুয়ে পড়ে। অন্ধকার ঘরে ছায়া-মানুষের মত দুটো চোখ ভেসে ওঠে। গৌরীকে দেখা দুটো চোখ। গৌরীর মনে হয় লোকটা যেন মানুষ নয়। অশরীরী। আদুল গায়ে শুধু তাকাত। সেই কোন কাল থেকে। গৌরীর দেখেছে। একটা ম্যাদামারা ছেলে। “শুধু পিটপিট করে তারিখেই জেবল কাটাবে!” বারান্দা থেকে বোনের খিলখিল করে হাসির শব্দ শোনা যায়। বোন তখন কারোর কথা মনে করে হাসছে। বোন হেসে ওঠে। গৌরীর রাগ হয়। খেঁকিয়ে ওঠে বোনকে। বাপের কাশির শব্দ শোনে গৌরী। শুনেই চলে। মা কলমি শাকের চচ্চড়ি রান্না করে গৌরীকে খেতে ডাকে। রান্নার ক্যাঁচ-কোচ শব্দে ক্লান্ত লাগে। আজ হাতে বড্ড জ্বালা করে গৌরীর। কোদাল ধরার জ্বালা নাকি যন্তন্ণা দেওয়ার ব্যথা? ও যে ইচ্ছে করে কিছুই করেনি!
-"এই ন্যাতাপোনা ছেলে! ওঠ! আজ চড়কের মেলায় একেবারে বুক চিতিয়ে ঘুরবি। একা একা একেবারে মেলা কাঁপিয়ে দিবি, বুঝলি ! যখন লোহার শিক পিঠে ঢোকাবে লাফাতে পারবি তো? পিঠে বেতখানা মারলে সহ্য করতে পারবি তো?"
ছিদাম মুদি লাল চোখ নিয়ে ছেলেকে প্রশ্ন করে। প্রশ্ন করার সময় লোকটাকে দেখতে অনেকটা ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা রাক্ষসের মত লাগে। সুদাম মুখ নামিয়ে নেয়। এই গ্রামে নাকি ঘুসকি ভূত আছে, যারা একা একা থাকে তাদের ধরে। ছোটবেলায় সুদাম মায়ের কাছে শুনেছিল। সেই ভূতটা ওকেও ধরেছে বলে ওর মনে হচ্ছে। সুদামের খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে।
চৈত্র সংক্রান্তির দিন বুড়োশিবতলায় সবচেয়ে বড় চড়কের মেলা বসে। এই দিনে জায়গাটাকে আর চেনা যায় না। সুদামের বাবা ছিদাম মুদি এই মেলায় গরম লোহার শিক নিজের পিঠে গেঁথে দেয়। সুদামের মা স্বামীর পিঠে ঠান্ডা জলে ভেজানো কাপড় লাগিয়ে দিত। সুদাম বরাবর মেলায় আসে। দুটো চোখ দেখার জন্য। এই প্রথমবার ও অন্য কারণে মেলায় এসেছে। ওর ডান হাতের মুঠোটা তীব্র হয়। গালের ব্যথাটা জ্বলে ওঠে। চোখে জলের গরম অস্তিত্ব টের পায় গৌরী।
একজন সন্ন্যাসী অনেকক্ষণ ধরে গৌরীর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। একটা লম্বা লোহার শিকের ফলা উঁচু হয়ে অন্য আরেকজনের পিঠ চিরে দিচ্ছে। মুখখানা শক্ত হচ্ছে ছেলেটার। গৌরী ছেলেটাকে চেনে না। ওর একজোড়া চোখের কথা মনে পড়ে। বোন একটা জিলিপির দোকানে দাঁড়িয়েছে। গৌরী ওর ছেঁড়া ব্যাগ থেকে খুচরো পয়সা বের করে দোকানিকে দেওয়ার আগেই একটা বলিষ্ঠ হাত গৌরীর বোনের হাত চেপে ধরে। ওরা ওপাশে সরে গিয়ে দুজনে মিলে জিলিপি কিনে খায়। গৌরীর চোখ ফেটে জল আসে। সুদামকে দেখেছে এই মেলায়। গৌরীর চোখে চোখ পড়তেই নামিয়ে নিয়েছে মুখখানা। গৌরীর হাতে জ্বালা করে। ওর চেঁচিয়ে ডাকতে ইচ্ছে করে। সুদামের শুকনো চোখ দেখে ভয় করে। ইস! কেন যে সেদিন অমন আঘাত দিল!
"দিদি সুদামদা নাকি ওই দিকে কী সব সন্ন্যাসীর পুজো করছে!" বোন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে গৌরীকে বলে। গৌরীর ভেতর উচাটন শুরু হয়। "দিদি সুদামদা নাকি বেতো সন্ন্যাস নেবে?" গৌরী তাকায় বোনের দিকে। "বেতো সন্নেস কী রে?" হঠাৎ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই প্রশ্নটা করে গৌরী। আকাশে মেঘের রাশি। হুংকার দিচ্ছে সব। চড়কগাছটা দুলে দুলে বলছে ঝড় আসছে। বৃষ্টির বড় ফোঁটা এসে পড়ে গৌরীর চোখে মুখে। বুড়ো শিবতলায় চড়ক গাছের নিচে রাখা কাঠের তক্তাটার সামনে এসে দাঁড়ায় গৌরী। সিঁদুর লেপা তক্তা। পাশে দেখতে পায়, সুদাম সপ সপ করে নিজের পিঠে বেত মারছে। সুদামের কঠিন মুখ। চোখ শুকনো। গৌরীকে সব শক্তি দিয়ে কেউ যেন ঠেলে দেয় সুদামের বুকে। হাত থেকে বেত ছিটকে পড়ে মাটিতে। দুজনেই মাটিতে পড়ে যায়। গৌরী এঁটুলি হয়ে এঁটে থাকে সুদামের বুকে। "তোমার যন্তন্না হলে বুঝি আমার লাগে না, একদিনের যন্তন্না দেখে বাকি দিনের কষ্ট দেখতে পেলেনেকো?" সুদাম শুনতে পায় ওর বাবা চিৎকার করছে "শালা ন্যাতাপোনা ছেলে, তুই নাকি সন্নিসি হবি!" সুদামের কানে ঢোকে না কথাগুলো। মাঠে ভিড়। ভিড়, ব্যথা সব ছাড়িয়ে একটা মিঠে বাতাস সুদামের বুক জুড়ে বয়ে যায়।