“কি দেব গো আজ? ঘুগনি পাঁউরুটি না ডিম টোস্ট?
“ঘুগনিই কেবল দাও একটু। আর পাউরুটি খেতে ইচ্ছে করছে না।” কানুদার কথার উত্তর দিল মল্লিকা।
ঐ ডিভাইন টাওয়ারের চার তলায় ফেলুনি বৌদির কাজটা করেই নর্মদা এপার্টমেনটে খেঁচোবুড়ির বাড়ি দৌড়বে মল্লিকা। তারপরে এসে ঢুকবে বেভুল বৌদির ঘরে।
বেভুল বৌদির কথাটা মনে পড়তেই ও ফিক করে হেসে ফেলল। বেভুল বৌদি আসলে সব ভুলে যায়। এইমাত্র আদা ফ্রিজে রেখে বাসনের ঝুড়িতে খুঁজছে; আবার পরক্ষণেই দুধ জ্বাল দেওয়ার বাটিতে তরকারি ফুটিয়ে ফেলছে।
আশেপাশের বড় টাওয়ারগুলোয় ঘরের কাজ করে মল্লিকারা। ওরা কাজের বাড়ির মালকিনদের এইসব নাম দিয়েছে।
মল্লিকার মত অনেকেই, রুমা, পাপিয়া, শান্তিমাসী, বীথিদি। ওরা কাজের মাঝে মাঝে এসে বসে এই কানুদার দোকানের মত চা, ঘুগনি পাঁউরুটির মতো দোকানগুলোয়।
এর মধ্যেই অনিমা এসে গেছে। অনিমার আবার চা রুটি না হলেও চলবে কিন্তু গুটকা চাই। গুটকার প্যাকেটটা মুখে ফেলে বলল, “টামাকে এট্টা টা ডাও।”
কানুদা বুঝে যায় এই সব ইঙ্গিত। একটা চা এর কাপ এগিয়ে দেয়।
হাঁসফাঁস করতে করতে বীথিও এসে গেছে। বীথি নিজের প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে ছোট গোল টিফিনবাটিতে রুটি নিয়ে আসে। গুটিয়ে গুটিয়ে রুটিগুলোকে কেন্নোর কুণ্ডলীর মত ছোট্ট বাক্সতে ঢুকিয়ে আনে বীথিদি। দোকান থেকে চা নিয়ে তাতে রুটি খুলে নিয়ে ডুবিয়ে খায়।
"তুই কি এবার ভুলোর বাড়ি যাবি নাকি রে মলি?" বীথির কথায় চায়ের গ্লাস থেকে মুখ তোলে মল্লিকা।
“হ্যাঁ গো। যাই গে এবার।” মল্লিকা উঠে পড়ে।
এখানকার ফ্ল্যাটগুলোয় লিফট ব্যবহার করতে দেয়। কোথাও কোথাও আবার মল্লিকাদের মত কাজের মেয়েদের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়।
কিন্তু এই লিফটে উঠলেও মল্লিকার দম বন্ধ হয়ে যায়। তবু উঠতে হয়। আজকাল এতো সিঁড়ি ভাঙা আর সহ্য হয়না। হাঁটুদুটো মাঝেমাঝেই জানান দেয় বয়সের ভার।
একদিন আবার লিফটে উঠে একটা সমস্যা হল মল্লিকার।
তিন আর চার তলার মধ্যে লিফটের ভিতরের আলোটা দপদপিয়ে নিভে গেল। একাই ছিল মল্লিকা। ওর মাথাটা কেমন যেন দুলে উঠল। যেন এক গভীর থেকে নিবিড় জলের গন্ধ ওর স্নায়ুতন্ত্রী ছুঁয়ে গেল। ঘোর লেগে গেল। এ গন্ধ অজানা, নিষ্পাপ। আদিগন্ত খোলা প্রান্তর বা অনিঃশেষ জলের সামনে দাঁড়িয়ে যে ধরণের ঘোর লেগে যায় অনেকটা সেরকম মনে হল।
এই গন্ধের সঙ্গে হাজার বছর পথ হেঁটেছে সে। আর এখন সেই পথের বাঁকের টিলা, সেই পথের জমাট কাদায় যেন ওরই পায়ের ছাপ এঁকে দেওয়ার জন্য কোমরের নিচে থেকে শরীরের নীচের ভাগ তলিয়ে যাচ্ছে ঊর্ধগামী এই লোহার বদ্ধ খাঁচার নীচতলা ভেদ করে। অথচ মাথাটা একেবারে হালকা। দীর্ঘ লড়াইয়ের ভারী জীবন, এপার্টমেন্টের খোপে, খোপে প্রতিদিনের কাজের গ্লানির ছিটের ফোঁটাও নেই সেই চেতনায়। একেবারে নিষ্কলুষ, নির্ভার সেই বোধ। অথচ অজ্ঞান হয়নি ও।
মিনিট এক-দুয়ের মধ্যেই লাইট জ্বলে গেল। ধড়ফড় করে সামনে যে তলা পেল তাতেই নেমে পড়ল মল্লিকা। তখনও আসেনি ওর কাজের ঘরের দরজা, তবু লিফটের ভিতরে থাকতে আর সাহস হয়নি। দু এক তলা সিঁড়ি বেয়ে উঠে কাজের ঘরের ঢুকে পাখার হাওয়ায় বসে হাঁপাতে থাকে।
বৌদি জল দিল। বলল, “একটু বসে জল খাও। চোখে মুখে জল দাও মল্লিকাদি। লিফটের ভিতরে অনেকের এরকম হয়। নিশ্বাস নিতে পারে না। আমার একটা বন্ধুরই এই রোগ ছিল।”
মল্লিকা তর্ক করে না। তবে ওর শ্বাস আটকে আসেনি মোটেই। ও যে একেবারে অন্য একটা জগতে গিয়ে পড়েছিল, সেটা বললে বৌদি বিশ্বাস করবে? ও নিজেই কি ছাই ঠিকঠাক বুঝেছে? হবে হয়তো, বৌদি যা বলেছে তাই ঠিক।
একটু বসে ঝাড়ু-মোছার কাজে লেগে পড়ে মল্লিকা।
একটা নতুন মেয়ে কদিন কাজে আসছে ওদের সঙ্গে।
রিঙ্কু বৌদির বোনের মেয়ে। অনিমাদের পাশের ঘরেই নতুন এসেছে। অনিমাই বলল, “মা টা মরেচে মেয়েলি রোগে। বাপটা নেশা ভাং করে। মেয়েটার চারিদিকে শ্যাল-কুত্তার ছুঁকছুঁকুনি শুরু হয়েছিল। তাই রিঙ্কু নে এসেছে। দ্যাক এখেনে কদিন ঠিকঠাক থাকে। রজনীগন্দার কটা রজনী কাটে এখানে। মাসিই না বেচে দেয়।”
“ছি, ছি কি যে বল? রিঙ্কুরা এমন নয়।” অনিমার কথায় সায় দেয়না মল্লিকা। কিন্তু এই মেয়েটার নাম তো পলি, ওকে রজনীগন্ধা বলছে কেন অনিমা?
বিশ্রী মাড়ি বের করে হাসে অনিমা। “তুমি কোন জগতে থাকো গো মল্লিকাদি? কুমারী মেয়েগুলোই তো বেশি খেপ খাটে এখন। এখন সবাই ফোলোটিং। কেউ আর বাজারে ঘর নিয়ে বসতে যায়না। এইসব মেয়েগুলো মানে পোডাকটগুলোর আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। রজনীগন্দাগুলো পুরুষ্টু হয়েছে, সেয়ানাও হয়েছে কিছুটা। বেলকুঁড়িগুলোর সবে কুঁড়ি ফুটেছে এই ন দশ বচর হবে; এইগুলোর দামই সবচে বেশি। একেবারে টাটকা, বায়নাক্কা কম। বেলুন টেলুন ছাড়াই কাজ মিটে যায়।”
“বেলুন ছাড়া মানে?” অন্য কিছু খেলনা টেলনা দিয়ে ডাকে নাকি কচি মেয়েগুলোকে? মুখ দিয়ে অবশ্য এত কথা বেরল না। ঘেন্নায় মুখটা তেঁতো তেঁতো লাগে মল্লিকার।
অনিমা এবারে একটু বিরক্তিতে ঝাঁঝি দিয়ে উঠল। শ্লেষে মুখ বেঁকিয়ে বলল, “নেকি নাকি রে এটা! বেলুন মানে কনডুম তাও জানো না? ওগুলোর তো মাসকে হয়নি না, তাই কনডুম ছাড়াই দে দনাদন।”
শরীরে ঢেউ তুলে দুলে দুলে হাসে।
মল্লিকা এবার অনিমার দিকে পিছন ফিরে বসল, গোটা গা জ্বলছে ওর রাগে। মনে হচ্ছে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় অনিমার গালে। অনিমা নিজেও তো একটা মেয়েই। কিন্তু এখন ওর চোখে মুখে যেন রেপিস্টের তৃপ্তি। খুব মজা পাচ্ছে।
মল্লিকার চোখ মুখ দেখে ওর রাগ হয়েছে বুঝতে পারে অনিমা। একটু সরে বসে তুতলে বলে, "পয়সা দেয়, পয়সা দেয় তো কাজ করিয়ে। অনেক সময় বাপমায়ে মেয়েগুলোকে ভিড়িয়ে দিয়ে ভালোই মাল্লু বুঝে নেয়। আমাদের মত গায়ে খেটে আর ক’টাকাই বা হয়?"
এবার রাগের থেকেও বেশি ঘেন্না করে মল্লিকার। অনিমার মনটাই হয়তো এরকমই। দয়ামায়াহীন।
না হলে ওই ছোট ছোট মেয়েগুলোর যন্ত্রণা নিয়ে অমন মজা করতে পারে? মজাও কি বলা যায় একে নাকি মনের রোগ?
এইরকম মা বলেই কি অনিমাদির ছেলেটাও কেমন যেন বখাটে হয়ে যাচ্ছে? শুকনো, প্যাঁকাটে মতন শরীর, চোখেমুখে বেপরোয়া একটা ভাব।
মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে মল্লিকা। ওর ছেলে মেয়ে দুটোই ভালো। কারো সাতে পাঁচে থাকে না। এত দুঃখের মধ্যেও ঐটুকু আশার আলো।
এই যে জীবন এতো তাগবাগ করে ওর দিকে দুঃখের যন্ত্রণার কামানবন্দুক বাগিয়ে ধরেছে, তার মধ্যেও ও ছেলেমেয়ে দুটোকে আলোর দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
মোহনাটা পনেরোতে পড়ল। সব ক্লাসে পাশ করেনি কিন্তু পড়া ছাড়েওনি। ভাইটাকে আগলে রাখে আদরে, শাসনে। পলাশের বয়স বারো। মাস্টাররা বলে, দারুণ অঙ্কের মাথা। বয়স বারো হলে কি হবে এখনো মায়ের কোল আঁকড়ে পড়ে থাকে ছেলেটা।
এই সন্তান সুখটুকুই যা বিধাতা লিখেছেন, নাহলে তো মল্লিকার ভাগ্য লিখতে গিয়ে খানিকটা বেভুল বৌদির মতই তাঁরও ভুলের ছড়াছড়ি।
মল্লিকার বাবা লজেন্স ফেরি করত ট্রেনের চলন্ত কামরায়। কাঁচের বয়ামে লাল নীল কালো সবজে মিষ্টি গুলিগুলোর উচ্চতার ওঠা নামার সঙ্গে ওদের সেদিনের খাওয়ার মেনু ঠিক হত। লাল নীল লজেন্স একটু বেশী বিক্রি হলে সেদিন শেষ বাজারের মাছের টুকরো জুটে যেত পাতে।
তবু ওর মধ্যেই পড়াশোনা করছিল মল্লিকা। কিন্তু হঠাতই তাল কেটে গেল । মল্লিকার খুব বন্ধু ছিল
ওদের পাড়ার শোভনা। শোভনা বিহারী একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। ছেলেটার নামটা এখনো মনে রয়েছে মল্লিকার। বাবুলাল।
শোভনার বাপ মা মেনে নেয়নি প্রথম দিকটায়। পাড়ার লোকে ঠোঁট মুখ বেঁকিয়ে নানান কথা বলেছিল। তারপর আস্তে আসস্তে শোভনা বাপের বাড়ি এল।
মল্লিকার বেশ ভালোও লাগত শোভনাকে। শোভনার নতুন শাড়িতে কেমন যেন একটা আমোদী গন্ধ। মাথার মাঝখান চিরে অনেকটা চলে যাওয়া সিঁদুরে পথ। হাতে কাঁচ আর গালার চুড়ির রংবাহার।
শোভনা ওর বাবার কাছ থেকে বাবুলালের জন্য একটা সস্তা স্কুটার চেয়ে নিয়েছিল। সেই স্কুটার চড়েই আসত ওরা।
তারপর আবার বেশ কয়েকদিন এলনা। বুধি পিসিরা বলল, “পেট খসিয়েছে।”
একদিন মল্লিকার সঙ্গে স্কুলের পিছনে বেকারির রাস্তাটায় দেখা হয়ে গিয়েছিল শোভনার। মাথাচেরা সিঁদুরের পিছনে কেমন যেন সাদাটে রক্তশূন্য দেখাচ্ছিল ওর মুখটা।
ম্লান হেসে বলল, “বাচ্চা এসে গেছিলো। বাবুলাল রাখলো না। ধুয়ে এলাম।”
মল্লিকা তো তখন বেশ বড়, তারও মাসিক শুরু হয়ে গেছে বছর দুয়েক আগে। বিবাহিত বন্ধুর সন্তান আসার বিষয়টা তার কাছে অজানা নয়। আবার খুব একটা ভাবনা চিন্তা করেছে বিষয়টা নিয়ে এমনও নয়। তবু “ধুয়ে এলাম” শব্দটা তার কানের মধ্যে দিয়ে গিয়ে বুকে ধাক্কা দিল।
খুব বেশী গভীরে ভাববার মত বড় ছিলনা মল্লিকা। তবু পেটের সন্তানকে ধুয়ে ফেলে দেওয়া যায় এটা আগে কখনো ভেবে দেখেনি বলেই হয়তো কিশোরী মনে অতটা ধাক্কা খেয়েছিল সেদিন।
এরপর ওরা চলে গেল।
মানে বাবুলাল চলে গেল ওর বাইক আর বৌকে নিয়ে বিহারের কোন গ্রামে।
সেখান থেকে তিন চার মাস বাদে যে ফিরল তাকে দেখে আর আগের শোভনা বলে চেনা যায় না।
কানে চুড়ির মত বড় বড় দুল, সকালবেলাই মুখেচোখে ফ্যাটফেটে মেকাপ, লো কাট সালোয়ার পরে এসে শোভনা ওর মাকে একটা স্ট্যান্ড ফ্যান, আর ঝকমকে শাড়ি কিনে দিয়ে গেল।
শোভনা এখন নিজে রোজগার করে। বাবুলাল ওকে গ্রামে রেখে দিয়ে কোথায় চলে গেছিল।
শ্বশুরবাড়ির লোক ওকে তারপরের দিনই বের করে দেবে বলেছিল। কিন্তু ঐ গণ্ডগ্রাম থেকে কোন পথে যে বাড়ি ফিরে আসবে ভেবে আকুল হয়ে ওদেরই হাতে পায়ে ধরেছিল শোভনা।
তখন ওরা বলেছিল যে ওদের একটা গানের দল আছে। বিয়ে বাড়ি, ফাংশান, এসব জায়গায় ওরা গিয়ে নাচে। নাচ মানে হিন্দি, ভোজপুরি গানের সঙ্গে শরীর দোলানো।
ওদের কিছু টাকা থাকে, কিছু ঐ শোভনাদের মত মেয়েদের হাতে দিয়ে দেয়। কিন্তু পুলিশের সামনে বলতে হবে ওকে কেউ জোর করেনি।
শোভনা বলেছিল মল্লিকাকে, সত্যি ওকে কেউ জোর করেওনি।
কিন্তু ও ভেবেছিল বিয়ে করে, বাচ্চা ধুয়ে চলে গিয়ে কোন মুখেই বা ফিরে আসবে?
মা আর শোভনার সঙ্গে কথা বলা পছন্দ করছিল না। তবুও শোভনা ডেকে ডেকে ওর সঙ্গে কথা বলত। মল্লিকাকে বলেছিল, ওদের গ্রামে সব ছেলের নামই বাবুলাল।তাদের সকলের বাবার নাম শিওচরণ। ওরা সবাই একই নামে ঘুরে বেড়ায় দেশের ছোট, ছোট গ্রামে, মফস্বলে। শোভনার মত মেয়েদের বিয়ে করে আনে। কখনো কখনো দহেজও আনে। তারপর আবার অন্য বাবুলাল হয়ে চলে যায় অন্য কোন জায়গায়।
ওর বর বাবুলাল বেশ কয়েকদিন পরে আরও একটি মেয়েকে বিয়ে করে ফিরে এসেছিল গ্রামে। শোভনা ততদিনে বেশ কয়েকটা নাচের জলসায় চলে গেছে।
ওর সঙ্গে শুতেও এসেছিল একদিন বাবুলাল। শোভনা শোয়নি। ওর বেশ নাম হয়েছে নাচের জলসায়। আবার পেট বাঁধাবার মত ঝামেলায় জড়াতে চায়নি।
তবে এখান থেকেও তাড়াতাড়িই চলে গেল শোভনা।
রোজ ওদের ঘর থেকে ওর বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটির আওয়াজ পেত মল্লিকারা।
তারপরেও নাকি ওর মাকে টাকা পাঠাতো মেয়েটা। সেই আজব শ্বশুরবাড়ি থেকে শোভনা নাকি বম্বের মদের বারে নাচতে চলে গেছে।
শোভনার ঘটনাটায় বাবা কিরকম দুশ্চিন্তা করতে শুরু করল। মল্লিকার বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগল। না হলে তাপসের মত ছেলের সঙ্গে বাবা কি ওর বিয়ে দিত?
বাবা আর কিছু দেখল না, কেবল পালটি ঘর দেখে বিয়ে ঠিক করে ফেলল।
তাপসের মা ছিল না আর বাবা ছিলেন মুদির দোকানের কর্মচারী। তাপসের কোন বাঁধা রোজগার ছিলনা। কিন্তু বাজারে মদের দরুন একটি বাঁধা খরচা ছিল।
সংসারটা বাবার আয়েই চলত। তাই দুটো সন্তান রেখে তাপস মরে যেতেও মল্লিকাকে ঘরের বাইরে রোজগার করতে বেরতে হয়নি। কিন্তু শ্বশুরমশাই মারা যেতে পাকাপাকি ভাবে ঝাড়ু-মোছা-বাসন করতে নেমে পড়েছিল।
এতদিনে যেন আসল সংসার শুরু হয়েছে পলাশ আর মোহনার মায়ের। নিয়মিত আয় আর পরিমিত ব্যয়ে শ্রী ফিরিয়ে এনেছে সংসারে।
সেদিন সকাল থেকেই মাথা টিপ টিপ করছিল মল্লিকার।
আজ আর কাজে যায়নি ও। বরং ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য একটু রান্না করতে বসেছিল।
টগবগ করে কড়ায় ফুটছিল মাছের ঝোল। গরম ভাতে ফুট ধরে ফ্যান গড়িয়ে পড়ছিল। ভরপেট খাবারের সুখী গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঘরে দুয়ারে।
কিন্তু উনুনের সামনে বসে থাকতে থাকতে কেমন মাথা ঘুরে গেল মল্লিকার। মোহনাকে ডেকে বাকিটা সামলে নিতে বলে ভর সন্ধ্যেতেই শুয়ে পড়লো ও।
শুলেও প্রথমে ঘুম আসেনি। চোখে ভাসছিল কত রকমের এলোমেলো নক্সা।
চোখ বুজতেই নাকে আবার সেই দিগন্ত বিস্তৃত জলের গন্ধ। কিন্তু এই জলে সমুদ্রের ঢেউ নেই, আসা যাওয়া নেই। স্থির, নিষ্কম্প, বৃহৎ।
এইরকম জলকেই বোধ হয় ভূগোল বইতে হ্রদ বলে। এই হ্রদ অঞ্চল ভারী মনোরম।
এখানে আশেপাশে পাহাড়ের গুহাগুলোতে থাকে মানুষগুলো। সকালে খোপ থেকে বেরিয়ে আসে দলে দলে। কেউ কেউ পাহাড়ের দিকে চলে যায়। জ্যান্ত বা মরা পশু ধরে আনে। কেউ তুলে আনে মাটির নীচের কন্দ মূল। কেউ কেউ বাচ্চাগুলোকে নিয়ে বসে থাকে।
ওর পেটে বাচ্চা আসে, বাচ্চা হবার পর বুকে দুধও আসে। বাচ্চাগুলো অনেকগুলো ‘সূর্য ওঠাপড়া’য় ওর সঙ্গে লেপটে থাকে। যে কটা বাচ্চা হয়েছিল, সবাইকে ওর মনে পড়েনা আর। এখন ওর গুহার চারজনের মধ্যে বড় বাচ্চাদুটো ছেলে। আর সব থেকে ছোটটা মেয়ে। আরও দু একটা ছেলে আর মেয়ে ছিল ওর। কটা মরে গেছে, কেউ বড় হয়ে জোড় বেঁধে চলে গেছে।
ছোট মেয়েটা এখনো ওর কাছ ঘেঁসে থাকে, বাচ্চাটার সবে পাঁচটা শীত কেটেছে। ছেলেগুলো খাবার জোগাড় করে এনে খেতে শিখে গেছে। মেয়েটাকে এখনো খুঁজে পেতে এনে খাইয়ে দিতে হয়।
ঠিক যেন নিজের শরীরের কাছে বাচ্চাটার শরীরের ওম নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল মল্লিকা।
একটা খুব সাবধানী শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।
পলাশ উঠে বাইরে যাচ্ছে, কিন্তু যেন অতি সন্তর্পণে ওর পিছু নিল মোহনা।
আদিম মানবীর মত টিঁকে থাকার বা টিঁকিয়ে রাখার ইচ্ছায় লঘু অথচ ক্ষিপ্র পদে ওদের পিছু নিল মল্লিকা। ভাঙ্গা দরজার কলঘরটার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল মোহনা। বেঁটে বামনের মাথায় ঝাঁকড়া চুলের বাহারের মত ঝুঁজকো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা জবা গাছটার ছায়ায় ছায়া মিশিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।
মোহনা কেন ওভাবে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে?
ভাবে মল্লিকা। মল্লিকা নাকি হ্রদের পাশ থেকে উঠে আসা কোন প্রাচীন জীবন?
আসলে এখন মল্লিকার চেতনায় কোন ধন্দ ছিলনা। শরীরে, মনে, পূর্ণ সত্ত্বায় ও সেই আদিম মানবীকে ধারণ করেছে । কোন এক অজানা যাত্রা থেকে সে আসে, সেদিনও এসেছিল?
কিন্তু মোহনা কী করছে অন্ধকারে? অপেক্ষা করছে কি? পলাশ কলঘর থেকে বেরিয়ে আসলে ও ঢুকবে বলে? না, ও তো কাউকে ইশারায় ডাকছে মনে হয়। ছায়ামানুষের মত কে যেন এসে দাঁড়াচ্ছে মোহনার পিছনে।
বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে মল্লিকার। মেয়েটার বিপদ নাকি? কে এ?
অনিমাদির বলা রজনীগন্ধা, বেলকুঁড়িদের বিপদের কথা মনে পড়ে যায়।
কিন্তু ঘর থেকে দৌড়ে বেরতে যেতে গিয়েও পা দুটো ভারী হয়ে আসে।
মোহনার বিপদ হলে ও চিৎকার করে উঠছে না কেন? ও কেন গভীর ষড়যন্ত্রের ভঙ্গীতে ঐ ছায়ার সঙ্গে কানাকানি করছে? কি বলছে ওরা?
ধীরে, ধীরে ঘর থেকে অন্ধকারের মধ্যেই বের হয়ে আসে ও। মোহনা বা লোকগুলো কেউ খেয়ালই করেনা ঘরের অন্ধকার দরজার দিকে। মল্লিকা সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে এগিয়ে আসে। মোহনা নিজে পিছিয়ে গিয়ে ঐ ছায়ার মত লোকটাকে এগিয়ে দিয়েছে।
এবার পাথরের মত স্থির হয়ে যায় মল্লিকা।
“আজ দশ দিলাম। কাল বাকি তিরিশ নিয়ে যাস। মালটা ফেরেশ হলেও ছোট নয়। তা হলে আরও বেশি পেতিস। যত ছোট, পেছন মারার দাম তত বেশি।”
মোহনা বলল, “বেঁচে থাকবে তো?”
ছায়া ফিসফিসিয়ে বলল, “সেসব তুমি আগে ভাবলে না কেন মামুনি? তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে বিয়ে করে পালাবে বলে ভাইকে বেচে দিচ্ছ। তো এখন আবার ধ্যাস্টামো কিসের? আর মরবে কেন? খুব ত্যাণ্ডাই-ম্যান্ডাই না করলে কেউ মরে না। ওসব ফালতু ঝামেলা। কাল সকালে মোড়ে ছেড়ে দিয়ে যাব। ও ঠিক নিজেই বাড়ি চলে আসবে। পার্টি বড় আছে, মাল পছন্দ হলে আবার ডাকবে। তুমি কেবল মুখ বুজে নিজের মাল বুঝে নাও। আর একবার পেছন মারা গেলে কেউ মুখ খোলেনা। ব্যস।”
মল্লিকা স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছে।
ছায়া বলছে, “ও দুদিন বাচ্চাটা ঘ্যান ঘ্যান করতে পারে। কিন্তু মাকে যদি পয়সার ভাগ দিতিস, দুদিন পর সেই আবার পাঠাতো। এখুন হিস্যার ব্যাপারটা তোদের ফ্যামিলির লাফরা। তোরা বুঝে নিবি।”
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মল্লিকার অস্তিত্ব জুড়ে বসছে প্রাগৈতিহাসিক চেতনা।
আজ সারাদিন খাবার জোটেনি মা আর মেয়ের। বড় ছেলেটা ফিরে এসেছে সূর্য ডুবতেই।
ক্লান্তিতে একটু চোখ বুজে এসেছিল। হঠাৎ বিদ্যুতের আলোয় দেখল বড় ছেলেটা ঝুঁকে পড়েছে মেয়েটার মুখের ওপর। মেয়েটার শিশু শরীরটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর নখওলা লোমশ হাতটা। ও ধাক্কা দিয়ে ছেলেটাকে সরিয়ে দিতে চাইল, সাবধান করতে চাইল মুখে জান্তব আওয়াজ তুলে।
কিন্তু ছেলেটা শুনল না, সেও গর্জন করে উঠল। আবারও ঘেঁসে এগিয়ে আসতে থাকল ছোট্ট মেয়েটার নিম্নাঙ্গ লক্ষ্য করে।
আর অপেক্ষা করেনা ও। পশু তাড়ানোর জন্য হাতের কছে রাখা গাছের ডালটা নিয়ে সজোরে বসিয়ে দেয় ছেলেটার ঘাড়ে। ছেলেটা ঘাড় ধরে বসে পড়ে তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করতে থাকে। হামাগুড়ি দিয়ে আবারও এগিয়ে আসতে থাকে ওদের দিকে।
ও মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য দৌড়তে শুরু করে। সেই ভয়ঙ্কর ঝড় বৃষ্টির মধ্যে। আশেপাশে আর কোন পশু আছে কিনা লক্ষ্যও করে না ওরা। কোথায় দৌড়ে যাবে তারও ঠিক নেই। হয়তো দূরের অন্য কোন গুহায়। বা গুহা ফেলে আরও দূরে। পাথুরে মাটি ছেড়ে হ্রদের দিকেই ছোটে ওরা।
ছুটতে থাকে ওরা। মা ও শিশু, পৃথিবীর প্রথম দল।
হ্রদের পাশের নরম কাদায় গেঁথে যেতে থাকে আদিম মানবীর পায়ের দাগ। নরম ভূত্বকে ইতিহাস আঁকা হতে থাকে ইভের পদচিহ্নে।
কড় কড় করে বাজ পড়ে, সঙ্গে ঝুম বৃষ্টি।
মল্লিকা দেখে ছায়াটা পলাশকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেছে। মুখে গুঁজে দিয়েছে একটা কাপড়ের টুকরো। মোহনা লোকটার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
ওরাও এবার বিদ্যুতের আলোয় দেখতে পেয়েছে মল্লিকাকে।
কিন্তু একটু দেরিই হয়ে গেছে ওদের। মল্লিকার হাতের লাঠি নিপুণ লক্ষ্যে নেমে এসেছে ছায়া ছায়া লোকটার মাথায়। লোকটার মাথার আশেপাশেও। একবার, দুবার, বারবার।
লোকটা নিঃশব্দে পড়ে যায়। ভয়ে সাদা হয়ে আসা মুখে, মাথায় রক্ত মেখে মোহনা তাকিয়ে থাকে মল্লিকার দিকে।
****************************
অনিমা বলল, “যে গেছে, সে তো গেছেই। এখুন ছেলেটার মুখ চ্যায়া তোকে তো বাঁচতে হবে বুন। খাবার না খাস একটু জল অন্তত খা।”
পলাশের ধুম জ্বর। জলপটি পালটে পালটে দিচ্ছে অনিমা।
মল্লিকা একটা কথাও বলছে না। এতটুকু কাঁদছেও না। বসে আছে একেবারে স্থির, নিষ্কম্প। অনিমারা অনেকে মিলে ওকে একটু কাঁদাবার চেষ্টা করেও পারেনি।
সকাল বেলায় কাজে যাবার সময় একটা লোক আর মোহনার মৃতদেহ দেখতে পায় প্লতু মিস্তিরি। মল্লিকাদের ঘরের পেছনে, জলে কাদায় মিশে শরীরদুটো পড়েছিল। প্লতুই হাঁকডাক করে লোকজন ডাকে।
ঘরে মল্লিকা অজ্ঞানের মত ঘুমিয়ে ছিল, পলাশের তখন থেকেই জ্বর।
পুলিশ বলছে, লোকটা একটা আড়কাঠি। গরিবির সুযোগে মেয়েদের দেহব্যবসায় নামানোই ওর কাজ। হয়তো, মোহনার সঙ্গেও সেরকম একটা কিছু করতে গেছিল। মোহনা উল্টে মার দেয়।
অবশ্য মার বা পাল্টা মার দেওয়ার কোন অস্ত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পুলিশ অফিসার পাড়ার কাউন্সিলারকে নিয়ে তদন্তে এসেছিল। মল্লিকাকে বলে গেল, তদন্ত হবে।
তবে এসব কেসে সবাইয়েরই টুকটাক ভাগ থাকে। কতদূর তদন্ত হবে ভগবানই জানে।
প্লতু অবশ্য মড়া দুটো দেখে হাঁকুপাঁকু করে মল্লিকার দরজায় আসতে গিয়ে দুয়ারে একটা অদ্ভুত পায়ের ছাপ দেখেছিল। একটু বেশিই থ্যাবড়া মত, বুড়ো আঙ্গুলটা বেশ বড়।
পরে আড়চোখে মল্লিকা বৌদির পায়ের দিকে তাকিয়েছিল ও। মল্লিকার পা ওরকম নয়।
অবশ্য সে ছাপ আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। গোটা বস্তিটাই ভেঙে পড়েছিল কিনা ডবল মার্ডার দেখতে। কাউকে কিছু বলেনি সে। পুলিশকে তো নয়ই। এমনিতেই সে বডি প্রথম দেখেছে বলে তিন চার বার থানায় ডেকে ফেলেছে ওকে। আর ঐসব পায়ের ছাপের গপ্পো ঘেঁটে ঘ করতে চায়না প্লতু মিস্ত্রি।
আর বস্তির লোকজনকে তো মোটেই বলা যাবেনা, তারা আবার ভূত প্রেতের গল্প ছড়াবে।
সদিবুড়ি কাঠকুটো কুড়িয়ে বেড়ায়। উঠোনে কাঠের উনুন জ্বালিয়ে মাঝে সাঝে এটা সেটা জ্বাল দেয়। সকালে জোড়া খুনের বাড়িটার আশেপাশে ঘুরছিল। তখনও ওখানে জোড়া খুন হয়েছে জানতোনা। বাড়িটার খানিকটা দূর থেকে একটা বেশ মোটা কাঠ কুড়িয়ে এনেছে ।
অনেকদিন ওরকম ভালো কাঠ দেখেনি ও। টুকরো টুকরো করে কেটে রেখেছে। রাতে উনুন ধরাবে।