সানসিল্ক বলে, "বাবা থাকলে আজ আমাদের কাদা প্যাচপেচে রাস্তা দিয়ে মোটেও হাঁটতে হত না।"
ডাভের গলা সবসময় উঁচু,- "এতো প্যাখনা কিসের র্যা? এখুনি তো জলে পা খলবলিয়ে দিবি।"
মার্গো একটু সাবধানে ছুঁচিবেয়ে বুড়ির মতো কাদা এড়িয়ে ঠুনকো পা ফেলে চেঁচালো, "দেখেশুনে চলনালো সব। আজকেও কি তোরা দেরি করিয়ে দিবি না কি?”
হাঁসগুলো এসব বলে নাকি করুণা ভাবে, তা জানেনা করুণা। তবে ওর মনে হয় হাঁসগুলোর ভাষা ও বোঝে। এইসব বলতে বলতেই ওরা ইতুদের বাড়ির পাশের জল ছপছপে পা চলতি পথটা বেয়ে পুকুরে নেমে যায়।
পুরোনো বিশ্বাসবাড়ির পিছনে করুণাদের ঘর।
ওদের বাড়ির কোনাকুনি বিশ্বাসদের ছড়ানো উঠোনটা যেখানে শরিকি পুকুরে এসে মিশেছে ওখানেই অঠৌকভাবে ভাবে ইতুদের টালির চালা। ঘর বানানোর সময় ইতুর বাবা বলেছিল বাড়ির গা ঘেঁষে করুণাদের একটা বেরুনি রাস্তা বানিয়ে দেবে। কিন্তু জিভে ঘা হয়ে ইতুর বাপ মরা ইস্তক তার বলা কথার দাম আর নেই।
করুণাদের বেরুনি কেউ করে দেয়নি। কেই বা দেবে? ইতুর মা বলে, ওর দাদারা কেউ বাড়িতেই খাবার পয়সা দিতে চায়না তারা আবার পড়শিদের রাস্তা! তাই ঐ জলে পড়ো পড়ো রাস্তা দিয়ে করুণা, ওর মা আর ওদের পাঁচ সাতটা হাঁস যাতায়াত করে কেবল।
করুণাদের বাড়ির দুদিক জুড়ে পুকুর আর সামনে বিশ্বাসদের আদিম উদোম বাড়ি। বাড়িটার জায়গায় জায়গায় পলেস্তেরা খসে গেছে। সেই বাড়ির ভেতর থেকে কখনো ভেসে আসে শরিকি খেউর, কখনো টেলিভিশনের সস্তা চটুল গান। এই বিশ্বাস বাড়ির চৌহদ্দিটুকুকেও কত্তারা ছাড়েনি। খুপরি ইটের ঘর বানিয়ে ভাড়া বসিয়েছে। ননা, মনি, সতুদের মত দিন আনা দিন খাওয়া লোকেরা ভাড়া নিয়েছে সেসব ঘর। ননার মা রাতদিনের কাজ করে, মনির বাপটা মিলে কাজ করত, এখন মিল বন্ধ। এখন কেবল নিয়ম করে মনির মাকে পেটায়। সতুর বাপ মুদির দোকানে মাল মাপে, ওরাই এখনো একটু ভালো আছে, গেরস্ত মতো।
ওরা সবাই অবশ্য বিশ্বাসদের পুকুরটা সরে।
ইতুর মা এক ঠ্যাঙে ভর দিয়ে বাসন মাজে। ইতুর মা শাড়িটাকে বিপজ্জনক ভাবে তুলে কোমরে গুঁজে বাসন মাজতে মাজতে ননা, সতুদের বিড়বিড় করে গাল দেয়। মুখ খিঁচিয়ে বলে ওরা এসে বসাতে এই জায়গাটা বস্তি হয়ে গেছে। ননা, সতুরা অবশ্য এসবে কান দেয় না। ওরা ঐ শরিকি উঠোনটাতেই ছেঁড়া ফুটবল দাপিয়ে বেড়ায়।
করুণার অবশ্য ভালোই লাগে ওদের। ননার মা ভালোবাসে করুণাকে।
করুণা ইস্কুলে যখন থেকে আর যায়না তখন থেকেই করুণার হাতে অনেক সময়।
ওদের মা মেয়ের রান্নাটা করুণাই করে নেয়। মায়ের দুতিন বাড়ি রান্না করে, ফিরতে বেলা হয়ে যায়। একেকদিন অবশ্য করুণার তাড়াহুড়ো থাকে। যেদিন ওকে ছেলের বাড়ি থেকে থেকে ওকে দেখতে আসে। দেখতে আসলেও বিয়েটা যে হবে না, তা করুণা জানে। তবুও দিনটা একটু অন্যরকম কাটে।
আগে করুণা মাথায় কেবল শ্যাম্পু দিত। এখন ননার মা সস্তা হেনার প্যাকেট এনে দেয়। ডিমটা বিকেলে ভাজার জন্য রেখে খোলাটা ধুয়ে হেনায় মেশায় করুণা।
ফুরফুরে চুলের মত এই দেখতে আসার দিন গুলোয় করুণার মনটাও ফুরফুর করে। একটু লজ্জা লজ্জাও করে। কার কাছে লজ্জা, কেনই বা লজ্জা তার অবশ্য কোন নিজ্জস কারণ নেই।
তবে করুণার বিয়ে যে হবে না সেটা বুঝতে হলে অনেক পড়া লেখা করার দরকার নেই। করুণার মত এইট ফেল হলেও চলে।
ঘটক এসে ওদের যেমন বলে, যে “বুইলে না দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। দশটা কতা হবে, দেনা পাওনায় মিটবে তবে তো পাকা কতা!”
এরকম সে নিশ্চয়ই ছেলেপক্ষকেও বলে।
তারাও কেউ কেউ হয়তো তাই শুনে শেষ বিকেলের আলো পড়তে না পড়তেই চলে আসে। কারো কারো হাতে মিষ্টির প্যাকেট থাকে, কারো আবার থাকেনা।
করুণার মনে হয়। তারা ঐ ‘দশকথা’ বলতেই আসে।
না হলে এই পুকুর ধারগোড়ায়, এক চিলতে বাড়িতে বাপমরা মেয়েটাকে বিয়ে করবে বলে তো আর তারা আসে না। তাদের হয়তো কথা বলার লোকের অভাব। ঐ ঘটকের কথামত দশ কথা বলার লোকও তো দরকার।
তারা এসে করুণার মায়ের সঙ্গে কথা বলে, করুণার সঙ্গে কথা বলে।
কখনো বাড়ির লোকজনের সঙ্গে পাত্র আসে, কখনো বা আসেনা। ওরা চা সিঙ্গারা খেয়ে চলে যায়। যাবার সময় বলে যায় যে কেউ একজন আসেনি। যে আসেনি তার পছন্দই যে আসল, সে কথা জানিয়ে যেতে ভোলেনা ওরা।
রাতে করুণা আর ওর মা ওদের আনা মিষ্টি খায়। কখনো ননার মাকেও করুণা লুকিয়ে একটা দুটো মিষ্টি দেয়।
একবারই বোধহয় নবগ্রামের মাছের দোকানদার ছেলেটির বাড়ির লোকজনের চোখে বাসন্তী শাড়ি পড়া করুণা পাশ করে গেছিল।
কিন্তু তারপর আর কেউ ওরা আসেনি। ফিরে আসার কথাও নয়। ওদের বাড়ি থেকে হয়তো আসেপাশে করুণার বিষয়ে খোঁজখবর করেছে।
হয়তো ওদের কোন মামা বা কাকা খোঁজখবর নিতে এসেছিল।
মোড়ের সামনের বিলাকাকার দোকানে জিজ্ঞেস করেছে, “দাদা বড় বাড়ির পিছনে ঐ পুকুরধারের বাড়ির মেয়েটাকে চেনেন না কি? আমার ভাগ্নার সঙ্গে দেখাশুনো হয়েছে কি না!”
বিলাকাকা লোক ভালো। করুণাদের মাঝে মধ্যে ধারে জিনিস দেয়। করুণার সঙ্গে ওদের ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে কোণা ভাঙা প্লাস্টিকের টুল ঝেড়ে এগিয়ে দিয়েছে।
-“ ও করুণা তো? দড়িবাড়ির মেয়ে। খুব ভালো মেয়ে দাদা! কোন উকুঝুকু নেই। কোন ছেলেদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি নেই।” বিলাকাকা খৈনি মুখে উত্তর দেয়।
বিলাকাকার কথায় লোকটি হয়ত একটু স্বস্তি পায়, একটু চকিতও হয়। বলে, “বাঃ ভালোই তো তবে। কিন্তু ওরা তো মান্না, দড়িবাড়ি কেন বললেন?”
বিলাকাকা হয়তো ছোট মাটির ভাঁড়ে ততক্ষণে একটু জোলো চাও এগিয়ে দিয়েছে। বিলাকাকা এমনিতে লোক তো আর খারাপ নয়। করুণার খারাপ চায় তাও নয়।
এমনিতে করুণা বাপমরা মেয়ে বলে এখানে আশেপাশে সবাই ওর ভালোই চায়।
-“ওদের বাড়িটাকে আসলে দড়িবাড়িই বলে এখেনে। করুণার বাপ তো গলায় দড়ি দেছিল সে মেয়েটা তখন গুড়গুড়ে। মেয়েটা ছোট বেলা থেকেই কষ্টে কষ্টেই মানুষ দাদা।” টাগরায় টক টক করে সহানুভূতির শব্দ তোলে বিলা।
মামাবাবু বললেন, -“অ, তা ওর বাপে গলায় দড়ি দেছিলেন কেন কিছু জানা আছে?” খোঁজ খবর নিতে এসে মেয়ের বাড়ির টকঝাল গল্পে টাকনা দিয়েছেন মামাবাবু। একটু দোনোমনোতে আছেন হয়তো। দোকানীর কথায় ভাবছেন হয়তো, সত্যি তো মেয়েটার কি দোষ।
বিলাকাকার মুখ অবশ্য থেমে নেই, থেমে নেই হাতও। খদ্দের আসছে যাচ্ছে। বিকোচ্ছে নকুলদানা, সস্তা টফি, কাগজের মোড়কে মৌরি, মেথি বীজ।
-“ তবে শুধু ওর বাপই বা বলি কেন? ঠাকমাটাও তো গেছিল ঐ দড়িতেই। তখন থেকেই পাড়ার ছেলেরা দড়িবাড়ি বলে। অবশ্য ওদেরই বা দোষ দেবে কে? অনেক বচর আগে হরেনের ছোটকাকাও তো দড়িতেই……।
মামাবাবুদের মুখ অজান্তেই হাঁ হয়ে যায়। হাতে হয়তো চলকে পড়ে খানিক জুড়নো জোলো চা।
মাথার মধ্যে ফাটা রেকর্ডের মত কথাগুলো ঘুরতে থাকে, “দড়ি বাড়ি, দড়ি বাড়ি, দড়ি বাড়ি…………
বাপে গলায় দড়ি দিয়েছে! তাও সে খবর কোন মতে গেলা গেলেও, এতো চোদ্দ গুষ্টির গলায় দড়ি। এই রকম বাড়ির মেয়ে কি ঘরের বৌ করে নিয়ে যাওয়া যায়?
কিন্তু দোকানিটি যে বলল মেয়েটির কোন দোষ নেই। তাহলে?
তাহলে আবার কি? গলায় দড়ি শুনলেই কেমন একটা গা শিরশির করে ওঠে না? তার ওপরে ঐ বাড়িতে তিন তিনটে গলায় দড়ি? মেয়েটাকে দেখলেই সে কথা মনে পড়ে যাবে না? এদের তো গলায় দড়ির হিস্টরি আছে রে বাপ।
রক্ষে কর ঠাকুর। তেত্রিশ কোটি দেবতার আশিব্বাদে সব খপরাখপর ঠিক টাইমে পাওয়া গেছে ভেবে মামাবাবু উঠে পড়েন।
চায়ের দাম দিতে গেলেও বিলা নেয় না। নেওয়া যায় না। পাড়ার সম্বুন্ধি হতে চলেছে বলে কথা।
এভাবেই করুণার পাত্রের কাকা, মামা, মেসোরা কেউ বিলার দোকান থেকে, কেউ ননার মার থেকে, কেউ বিশ্বাস বাড়ির ছোটকত্তার থেকে দড়িবাড়ির মেয়ে করুণার সুনাম শুনে টুনে চলে গেছে।
চলেই গেছে, আর ফিরে আসে নি।
ননার মা বলে, “ঐ দিকে পোড়া বটতলার মোড়েই তো ঘুর ঘুর কচ্ছিল গো একটা ঢ্যাঙ্গাপানা লোক। তো আমি আর কি করে জানব বাবা! আমায় বলচে এই গলিতে থাকো ঐ পুকুর ধারের বাড়ির মেয়েটা কেমুন বলতে পারো?”
-“তো আমি তো বলি দিইছি ও করুণা আমাদের দড়িবাড়ির মেয়ে তো, এক্কেবারে সোনার পিতিমে। কেবল বাপটা দড়িতে ঝুললে তাই, নইলে অমন মেয়ের আবার বিয়ের চিন্তা? তা হ্যাঁ গা করুণার মা, কি কি চাইলে ওরা? চাউন্তে ঘর নাকি?”
করুণার মা কখনো বলে, “না দিদি, কথা তো এখনো সেরকম এগোয়নি।”
কখনো আবার, ঢোঁক গিলে বলে, “আর সোনার পিতিমে! আমি মরছি নিজের জ্বালায়।” নিজের অদৃষ্টের দোষ দিতে দিতে করুণার মা হাঁসের ডিম বেচতে চলে যায়।
সোনার প্রতিমা না হলেও একেবারে ফেলে দেবার মতো মেয়েও তো নয় করুণা। খাটিয়ে পিটিয়ে দোহারা সমত্থ চেহারা। এইট অব্দি পড়েওছে।
করুণার বিয়ের সম্বন্ধ না আসার জন্য অবশ্য করুণার বাপকেই দোষ দেয় করুণার মা।
-“মরলি তো মরলি সেই দড়ি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না?”
করুণার মায়ের বিলাপে কেবল ওর বাবার মরার জন্য দুঃখ লেগে থাকে তা নয়। বরং দড়িতে ঝুলে মরতে বাড়িটা যে একেবারে দাগী হয়ে গেছে তাতেই বরং তার বেশী আক্ষেপ। গলায় ফাঁস না দিয়ে, লোকটা যদি রেলে কাটা পড়ত কিম্বা সেঁকো বিষ খেত। নিদেনপক্ষে রোগে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েই আর পাঁচটা লোকে যেমন মরে তেমনি মরত তাতে বোধহয় করুণার মা দুঃখের মধ্যেও স্বস্তি পেত।
তা না, যে মায়ের কথা মনেই নেই হরেন মান্নার, তার মরার গপ্পো শুনে শুনে সেই গলায় দড়ি দিয়ে বসল?
হরেনকে এক বছরেরটা রেখে বাপের বাড়ি গেছিল হরেনের মা। সেখান থেকে ফিরেই সে পুকুরের জলে নেয়ে, ভিজে কাপড়েই ঝুলে পড়েছিল সিঁড়ির পেছনের আলো আঁধারিতে।
হরেন যদিও বৌকে বলেছিল বাপকে না বলে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ায় বাপ মায়ে বেজায় ঝগড়া লেগেছিল সেদিন। তাই রাগের মাথায়…।সেদিনের কনেবৌ, করুণার মা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে সেসব বিশ্বাসও করেছিল।
অবশ্য পরে পরে শাশুড়ির মৃত্যু নিয়ে সে অন্য গল্প শুনেছে।
দূর সম্পর্কের এক পিসিশাশুড়ি থাকে বাজারের ওদিকে।
সেই বলেছে, “আমাদের ঘরে কি আর সোয়ামি ইস্তিরি ঝগড়া হয় না? রাগের চোটে দু একটা চড়থাপ্পড়ও তো দিয়ে দেয় না তোমার পিসে? তাই বলে আমরা রেলে মাতা দিতি যাচ্ছি? না গলায় দড়ি দিচ্ছি? মাগি তুই দুধের বাছার দিকে তাকাবিনি? অমন এক বছরের ছেলে রেখে মরলি কোন মুখে?”
করুণার মার কাছে আর একটু ঘন হয়ে বসে পিসি শাশুড়ি, “তুমি বলেই বলছি বৌ, এসব আবার পাঁচকান ক্রুনি যেন। ভাইপোর কানে তো মোটে তুলুনি। ওসব ঝগড়া টগরা সব বানাউটি। তোমার শাউড়ির চরিত্তির ঠিক ছিলনা। আমাদের কাছে খপর সবই আছে। সেদিন সে ছেলে রেখে বাপের বাড়ি এমনি যায়নি। ওখানে কোন নাগরের সঙ্গে ঢলাঢলি ছিল। সেদিন তার সঙ্গে পালাবার কথা। তা সেও তেমনি স্যায়ানা। এক ছেলের মাকে নিয়ে পালাবে কেন সেই ধিনিকেষ্ট? ইনি সমসার ছেড়ে গিয়ে ডেঁইরে রইলেন কিন্তু সে আর ওমুখো হয়নি। সেই দুঃখেই তোমার শাউড়ি মুখ পুড়িয়ে শ্যাওড়া গাছের পেত্নি হলেন গো!”
কথাগুলো বলে হ্যা হ্যা করে হাসে হরেনের পিসি।
করুণার মা যেন দেখতে পায়, শেষ বিকেলের মরা আলোয় হরেনের মা ভেজা ফুলছাপ শাড়ি পরে পুকুরে চান করে পায়ের জলছাপ দিতে দিতে উঠে আসছে। সদর দরজা থেকে উঠোন হয়ে দাওয়ার পিছনে সিঁড়ির দিকে। চুল থেকে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা জল, চোখে দৃষ্টি শূন্য। হাতে খোপকাটা গামছা, যেটা দিয়ে সে এক্ষুনি গলায় দড়ি দেবে।
ছেলের মুখের দিকে সে আর তাকায়নি বোধহয়।
হরেনের পিসির গল্পই যদি সত্যি হয় তবে ঐ ঠিকদুপুরে পিরিতের লোকের সঙ্গে পালানোর জন্য সন্তানকে তো সে ত্যাগ করেছিল অনেক আগেই। চোখের তারার যে শূন্যতা ছিল তা কেবল নিজের চোখে নিজেকে হারিয়ে ফেলার বা নিজের কাছে নিজেই হেরে যাওয়ার।
না, করুণার মা পিসিশাশুড়ির গল্প শুনে তখনই এসব ভেবেছে তা ঠিক নয়।
এসব সে ভেবেছে অনেক পরে।
হরেন গলায় দড়ি দেবার পরে। কারণ হরেনের চোখে ঐ হেরে যাওয়া শূন্য দৃষ্টি সে দেখেছে।
ছোটকর্তার ইট সিমেন্টের গোলা থেকে সেদিন ফেরার পর হরেনের চোখে করুণার মা ঐ দৃষ্টি দেখেছে। ঐ গোলাতেই কাজ করত হরেন। সেদিন নিজের চোখে নিজে এতটাই ছোট হয়ে গেছিল করুণার বাপ যে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় ছিল না।
পিসি বলেছিল, “মাতৃমুখী ছেলে আমাদের হরেন। চোকে চোকে রাখবি বৌ। মায়ের মত আবার বিয়ের পর পালানো রোগে না ধরে!”
তা কথাটা খারাপ বলেনি। ধরতে যা একটু ভুল হয়েছিল করুণার মায়ের।
পালাল তো সে বটেই। মায়ের পথ ধরেই পালাল, তবে অন্যভাবে। হরেনের লুকোনো পীরিত ছিলনা বলে আঘাতটা অতর্কিতে এদিক থেকে আসবে করুণার মা ভাবতে পারেনি।
ছোট কর্তার দোকানে দুপুরে ক্যাশ না মেলায়, ওরা হরেনের নতুন লুঙ্গিটা কেড়ে রেখে দিয়েছিল। হরেন ছেঁড়া গেঞ্জি আর জাঙ্গিয়া পরে দুপুর তিনটেয় বাড়ি ফিরে এসেছিল একটু ঘুরপথে। সেই মেঠো রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা কম, কিন্তু চোরকাঁটা গায়ে বিঁধেছিল বিস্তর।
মাঠের ধারের বাড়িগুলোতেও ঐ রোদ্দুর তাতে কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে না। আর বাড়ি থেকে দোকান কতটুকুই বা দূর?
-“আর এইটুকু রাস্তা। তুমি পুরুষ মানুষ। যদি কেউ তোমায় দেখেই থাকে তাতেই বা কি? কাল ঠিক ওরা পয়সা খুঁজে পেয়ে ডাকতে আসবে দেখো।” হরেনের অপমানের লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল করুণার মা।
তবু হরেনের কাঁপ দিয়ে জ্বর এসেছিল বিকেলের দিকে।
করুণার মা একটু সাবু করতে গেছিল রান্নাঘরে। সেই সাবু আর খায়নি হরেন। তার আগেই ঝুলে পড়েছিল শোওয়ার ঘরের সিলিং ফ্যান থেকে।
ঝুলন্ত হরেনের ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখের দিকে তাকিয়ে করুণার মায়ের মনে হয়েছিল, লজ্জা আসলে মানুষের লজ্জাস্থানে থাকে না, লজ্জা থাকে অসম্মানে, আত্মার অপমানে।
পিসির কথামতো ঐ রকম ঠিকরানো চোখ, ঐ রকম বেঁকে যাওয়া অল্প খোলা ঠোঁটে হরেনকে সেদিন নিশ্চয়ই ঠিক মাতৃমুখীই লাগছিল।
করুণার মায়ের কথা সত্যি করে ছোটকর্তা রাতের দিকে এসেছিল। পঞ্চাশ হাজার টাকা করুণার মার হাতে দিয়ে গেছিল।
সকালের ঘটনা নিয়ে ঝামেলা করে লাভ নেই ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়ে গেছিল মালিক। এমনিতে কিছু প্রমাণও কিছু নেই তাই এসব ফালতু পুলিসি হ্যাঙ্গামা ওরাই সামলে নেবে তাও বলে গেছিল।
আর সকালে এসেছিল পালান, দোকান ঝাড়ু দিতে গিয়ে হরেনের লুঙ্গিটা পেয়েছে ও।
আর বলে গিয়েছিল, ক্যাশবাক্সের পিছনেই ড্রামের অন্ধকারে একশ টাকার দুটো নোটই ওরা পেয়েছে সেদিনই। ছোটকর্তারই হাত ফসকেই পড়ে গিয়ে থাকবে, সেই ক্যাশবাক্সে বসে কি না!
সে যাই হোক হরেন বা হরেনের মায়ের মরার কারণের থেকে মরার পদ্ধতিটাই লোকে মনে রেখেছে বেশী। হরেন মরার আগে লোকে আড়ালে আবডালে গলায় দড়ির বাড়ি বললেও এখন একেবারে সামনেই বলে থাকে।
করুণার মা মাঝে মাঝে দূর থেকে নিজের সিরিঙ্গে বাড়িটির দিকেই তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয় হরেনের মতো সে গলায় দড়ি দিতে পারেনি হয়তো, কিন্তু গোটা বাড়িটাই যেন একটা মস্ত ফাঁস হয়ে করুণার মায়ের গলায় চেপে বসেছে।
তবু লেগে থাকলে কী না হয়! বিয়ে হয়ে গেল করুণার। বেনাগাছার হাজরাপাড়ায়।
অনন্ত হাজরার একটা ছোট মুদির দোকান আছে। ঐ পাড়ার ভেতরেই। মা ছেলের সংসার।
শাশুড়ির কাছে শুনেছে করুণা কোন এক ভুলে যাওয়া সময়ে হাজরাদের পূর্বপুরুষ সাত-কর্তা এই হাজরা পাড়ায় বাস্তু তুলেছিলেন। সেবারে এক বিশাল বোয়াল উঠেছিল নোনাডাঙ্গার বিলে। সেবছরই সাতভাই হাজরারা বাঁশবন কেটে বসত করেছিল গাঁয়ের একধারে।
তারপর এখন সেই সাতভাইয়ের বংশধরেরা হাজারখানা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
এক-দেড়-দু-তিনতলা, সোজা বা বেঁকা বা ঘাড়ত্যাড়া, নতুন বা পুরনো, রঙ্গিন বা রংচটা ভিন্ন ভিন্ন রকমের বাড়ি নিয়ে হাজরাপাড়ায় হাজরারা বাস করে।
ঝগড়া, বিবাদ নেই তা নয়। তবু মোটের ওপর জ্ঞাতিকাঠামোটা বজায় রেখেছে এরা। কারো মেয়ের বিয়ে, রোগবালাইতে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ায় বটে।
সেই নোনা ডাঙ্গার বিলে বড় বোয়াল ওঠার সময় থেকে সাতসহোদর হাজরাদের রক্ত বয়ে চলেছে এখনো।
এদেরই এক জ্ঞাতির বড়োবাড়ির ছাদের কারনিশ থেকে একটা আধলা ইট অনন্তর মাথায় পড়েছিল ডান কানের গোড়া ঘেঁষে।
“রক্ত, রক্ত, রক্ত। রক্তে ভেসে গেছিল ছেলেটার মাথা, শরীর।” করুণার শাশুড়ি শিউরে ওঠে, সে যেন এখনো দেখতে পাচ্ছে অনন্তর সেই রক্তমাখা মুখ।
তা অমন বিপজ্জনক ভাবে ঐ ইট রাখার দায় তাদের বাড়ির কেউ স্বীকার করেনি মোটেও।
বাড়ির গিন্নি ঠোঁট উল্টে বলেছিল, “আমার বাড়ি থেকে ইট পড়েছে? এদ্দিন রয়েছি এমন কোনদিন হয়েছে? তাহলে ঐ নতুন বৌ, নবাবলন্দিনী এয়েছেন ওরই কাজ হবে”
নতুন সুন্দর বউটি বাউটি ঘুরিয়ে স্বামীকে বললে, “ছিঃ, এ নেশ্চয়ই তোমার মা বোনের কাজ। জ্ঞাতি মেরে আমাকে জেলে দেবে ভেবেচ? তার আগেই তোমাদের সব কটাকে জেলে ঢোকাবো আমি।”
নতুন বৌয়ের বাপ আবার সদরে মুহুরি। বাড়ির কর্তা তারসঙ্গে ঝামেলায় জড়াতে নারাজ।
শ্বশুরের ধ্যাতানি খেয়ে এসে গিন্নি বয়ান বদল করে বললে, “ ক্যা দেকেচে শুনি আমার বাড়ি থেকে ইট পড়েছে? কোথায় খেলতে গে’ লেগে গেছে। হাসপাতালে নে যাও। কত্তা বলেছে সবাই টেকা তুলে ছেলেটাকে দেখাও গা। আমরা নাহয় একটু বেশীই দেব।”
তা সত্যি, বাচ্চা ছেলে দুপুরবেলা খেলতেই তো যাচ্ছিল। আর বড়বাড়ির অনেক পয়সা, সেই পয়সার অনেক রব। একটা রক্তমাখা ইট কি আর তাদের বিরুদ্ধে চেঁচিয়ে সাক্ষী দেবে?
চিকিৎসা তবে অনন্তর হয়েছিল।
অনন্তর বাপ, মা হাসপাতালে পড়েছিল। হাজরা পাড়ার সবাই কিছু কিছু টাকাপয়সা তুলে দিয়েছিল। বড়বাড়ির কর্তাও দিয়েছিলেন।
মোটের ওপর সেই ছ’সাত বছরেই অনন্ত ডান কানে শুনতে পেলনা। ডাক্তারে বলল কোন স্নায়ুতন্ত্রের চোরাগলিতে আঘাতের রক্ত চলকে পড়ে ডান পায়ের ক্ষমতাও কমে গেছে।
সেইসব রক্ত, ইট, হাসপাতাল, উৎকণ্ঠা, আরোগ্য থিতিয়ে গেলে অনন্ত বেঁচে ফিরল বটে, তবে ল্যাংড়া অনন্ত হয়ে।
অনন্ত গোড়ায় নাকি কষ্ট পেত এইরকম ডাকনামে। তবে কি আর করা যাবে? আর ল্যাংড়া অনন্তর জন্য লোকে কিছু করেনি তাও তো নয়।
পয়সা তুলেছে, রাত জেগেছে, কেউ কেউ মনে মনে বড় বাড়ির লোকজনকে গালও দিয়েছে। তা হলে?
ল্যাংড়াকে ল্যাংড়া বলা যাবেনা সেটা কোন কথা হল?
এইসব বেফালতু কারণে জীবন থেমে থাকেনা।
পেটভারি অজগরের মন্থর চলনের মত জীবন চলতেই থাকে। ল্যাংড়া অনন্তরও জীবন চলে গেছে। একটা সামান্য পুঁজির মনিহারী দোকান দিয়েছিল, এখন তবে দোকানটা ভালোই চলছে।
এদের একটা খাটিয়ে পিটিয়ে মেয়ে হলেই চলত। অনন্তর বাপ গেছে অনেকদিনই। মায়ের শরীরও এবার জবাব দিচ্ছে। করুণা এসে সংসারের হাল ধরেছে।
দড়িবাড়ির করুণার বাপ ঠাকুমার মরার গল্প তারা শোনেনি তা নয়। প্রথম দিকে কেউ কেউ কথাটা তুলেছিল বটে, তবে করুণা এখন আর দড়িবাড়ির মেয়ে নেই। বিয়ের পর এমনিতেই মেয়েদের নিজের নামই মুছে যায়, তার ওপর আবার বাড়ির নাম।
করুণা এখন ল্যাংড়া অনন্তর বৌ।
করুণাও তো বিয়ে হয়ে এসে কলে জল তুলতে গিয়ে, মনসা ঠাকুরের থানে বাতাসা দিতে গিয়ে, কৌটো ভরে ভাজা মুড়ি আনতে গিয়ে শুনেছে -
-“ল্যাংড়া অনন্তর বৌয়ের পুজো”,
-“ল্যাংড়া অনন্তকাকার মুড়িটা দে না মা ”
-“ ঐ তো ল্যাংড়া অনন্তদের বাড়ির পাশের আম গাছে খুব বউল এসেছে এবার।”
সে যাই হোক ল্যাংড়া অনন্তের বৌ হয়ে মোটের ওপর ভালোই আছে করুণা। অনন্তর রোজগার কম হলেও মানুষ খারাপ নয়। তাছাড়া ননদকাঁটা নেই। দোকানবাড়ির ভাগ নেওয়ার জন্য দেওর ভাসুর নেই।
ভালো আছে মানে ভালোই ছিল।
অন্তত যতক্ষণ না একসঙ্গে দু দুটো নধর গোলগাল ছেলেমেয়ের মা হয়েছে করুণা।
শাশুড়ি নাম দিয়েছেন আলো আর আলোক।
নিজের সমস্ত জীবন ধরে করুণার হিসেব নিকেশ করে দেখেছে তার সঙ্গে এই প্রাপ্তি মেলে না।
দুহাতে, কোলে কাঁখে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে যেন সৌভাগ্যের ফেনা উথলে উঠছে তার। ছেলেমেয়ে দুটোর রং কালো হলেও স্বাস্থ্য ভালো।
মেয়েটা তো ফোকলা দাঁতে লালা লাগিয়ে হেসে হেসে মায়ের গায়ে ঢলে পড়ে। ছেলেটা উল্টে গিয়ে হামা দিতে চায়।
কিন্তু করুণা একটু বদলেছে।
ওর মধ্যে বিয়ের আগের সেই ফুরফুরে ভাব নেই। বিয়ের পরের সেই আলগা লালিত্যের ভাবটাও নেই।
কিছুটা সন্ত্রস্ত, যেন কি একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে, কি যেন শুনতে চাইছে। কাজকর্ম সবই করছে অথচ সর্বদা কেমন যেন একটা আনচান ভাব।
দরজার বাইরে কেউ এলেই আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। শিকারি বেড়ালের মত কান খাড়া করে কি যেন শুনতে চায়।
লোকে সদরে এসে ডাকে, “অনন্তর মা আছো নাকি?”
কেউ বলে, “ও অনন্তর মা, ছেলে আছে নাকি ঘরে? আসলে একবার পাঠিও দিকি!”
কেউ কেউ অনন্তর নাম ধরেও ডাকে বটে। কিন্তু বৌয়ের নাম ধরে ডাকার তো চল নেই, তবু করুণা যে কি শোনে কে জানে?
শাশুড়ি দেখেন, বলেনও, “নিজের ঘরেই অমন ছটফটিয়ে বেড়াস কেন বৌ? আগে তো এমন করতিস না। এখন মা হইয়েছ, মাথা ঠাণ্ডা কর। নিজে অমন বেঘোর করলে দুটো বাচ্চা সামলাবি কি করে?”
সে তো করুণাও বোঝে। তখনকার মত শান্ত হয়, আঁকড়ে ধরে বাচ্চাদুটোকে।
একদিন অনন্ত ঘরে আসতে করুণা তার একটু গা ঘেঁষে আসে। একটু বুকের মধ্যে নাক ঘষে।
অনন্ত বোঝে কিছু একটু আবদারের সময় করুণা এরকমটা করে থাকে। আর এখন তো একেবারে লক্ষ্মী গণেশ একেবারে এসেছে তার ঘরে, করুণাকে ছোটখাটো কিছু তো একটা গড়িয়ে দেবে একথা ভেবেই রেখেছে সে।
তবু জিজ্ঞেস করে, “কিছু বলবে নাকি?”
করুণা ধীরে বলে, “ একটা জিনিস চাইলে দেবে?”
অনন্ত মাথা নেড়ে সায় দেয়। এই কবছরে সে করুণাকে চিনেছে। তার সাধ্যের বাইরে কিছু করুণা কিছু চেয়ে বসবে না তা সে জানে।
করুণা বলে, “তুমি আমাকে আর ‘কি গো’, ‘হ্যাঁ গো’ বলে ডাকতে পারবে না। বলবে ‘আলোর মা’।
অনন্ত বেঁকা পাটাকে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, “ওঃ এই কথা!”
করুণা আঁকুপাঁকু করে ওঠে কিরকম, বলে, “না না তুমি বললে তবেই তো অন্যরা শুনে শুনে ডাকবে তাই না? বলবে তুমি ‘আলোর মা’, ‘আলোর মা’।”
‘আলোর মা’ শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে করুণার মুখটাই যেন একটা পবিত্র আলোয় ভরে ওঠে। নিজের বউকেই অনন্তর নতুন ঠেকে।
অনন্ত হাসে, বৌ কে কাছে টেনে নেয়, -“খামোখা এত উতলা হচ্ছ কেন? তোমার একটা নিজের নাম আছে তো নাকি?”
করুণা বলে - “সে আছে বটে একটা রেশন কার্ডে, ভোটের কাগজে। আর কোথাও ঐ নাম শুনেছ? কেউ ডাকে? মেয়েছেলেদের কোন নাম হয় না।”
এবার করুণা বেঁকা হাসে। হয়তো ঐ বেঁকা হাসির আড়ালে সে নিজের দড়িবাড়ির মেয়ে, ল্যাংড়া অনন্তর বৌ নামগুলো চাপা দেয়।
অনন্ত অবশ্য এতশত বোঝে না। সে করুণার এই আবদারকে নতুন মাতৃত্বের আলগা আদর বলে ভাবে। ভেবে ভুলেও যায়। হঠাৎ করে তো মায়ের সামনে ‘আলোর মা’, ‘আলোর মা’ বলে ডাকতে পারে না সে। এমনিতেই সে করুণাকে সরাসরি কোনদিনই নাম ধরে ডাকে নি।
এর থেকে যদি করুণা একটা সিল্কের শাড়ি কি রূপোর পায়ের নূপুর চাইত তাহলে হয়তো অনন্ত চেষ্টাচরিত্র করত। সোনা? যদি সোনার চেনও চাইত তাহলেও না হয় অনন্ত দিনরাত এক করে দিত। তা নয়, যতসব ছেলেমানুষী কথা।
তবু অনন্ত করুণাকে এনে দিয়েছে একটা বেগনি পাড়ের বেগমপুরী শাড়ি। পছন্দও হয়েছে করুণার।
সেদিন হঠাৎ বেলার দিকে পাড়ায় বেশ হইচই। একটা লোক ভালুক নিয়ে খেলা দেখাতে এসেছে।
একটু বড় বাচ্চাগুলো ভালুকের খেলা দেখবে বলে জড়ো হয়েছে।
ভালুক একবার হেমামালিনি সাজছে, একবার খোকাবাবু, আবার একবার ব্যাগ নিয়ে বাজার যাচ্ছে।
বুড়োবুড়িরাও ভালুকের সং দেখতে এসে দাঁড়িয়েছে।
সাতু হাজরা বললো - “এই শুনলাম তোকে মধুবাটি থেকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছিল? এইসব জন্তু নিয়ে আমাদের এখেনে আসবিনি। নিজেও মরবি আমাদেরও পুলিশে হয়রান করে মারবে।”
-“ওসব ফালতু কথা কে বলে! এই করেই খাচ্ছি”, লোকটা কালো মাড়ি বের করে হাসে।
ওদের মধ্যেই কুঁচোকাঁচা বাচ্চাগুলো ভালুকের পিঠে ওঠার জন্য বায়না জুড়েছে।
করুণা শাশুড়িও গেছিলো নাতি নাতনিকে নিয়ে অঙ্গনওয়াড়ির খিচুড়ি আর ডিম আনতে। ভাল্লুক দেখেও ওরাও একটু দাঁড়িয়ে পড়ে। করুণার মেয়েটার যেন ভয় নেই। ভালুকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গোল গোল হাত তুলে।
তবে শুধু ভালুক দেখার ভিড়ই যে শুধু জমেছে তা নয়।
বড়বাড়ির বৌ ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের গাড়িতে তুলে দেবার জন্য এসে দাঁড়িয়েছে। ইস্কুলে সে ছেলে কেমন পড়াশুনো করে তা জানা না গেলেও ফরসা সুন্দর লম্বাটে ছেলে কোট, টাই পড়ে যেভাবে গাড়িতে চড়ে স্কুলে চলে যায় পাড়ার লোকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখে বটে।
ছেলেকে স্কুলের গাড়িতে তুলে দিয়ে বড়বাড়ির বৌ ভাল্লুকসঙের গরিবের বিনোদন দেখে মুখ টিপে হাসে। করুণার শাশুড়িকে বলে, “কাকি দাওনা তোমাদের ভেবলিটাকে ভালুকে চড়িয়ে। যা বডি বানিয়েছ মনে হবে যেন বড় ভাল্লুকের ওপর ছোট ভাল্লুক। আর এই ভুচুং? তোমার নাতি ভুচুংটাকে চড়াবে না?”
বলে নিজের রসিকতায় নিজেই গালে টোল ফেলে রিনরিনে হেসে ফেলে চলে যায় বড়বাড়ির সুন্দরী বৌ।
করুণার শাশুড়ি বড়বাড়ির লোকেদের কথার জবাব দেয় না।
কিন্তু জড়ো হওয়া বাচ্চাগুলো হেসে লুটোপাটি খায়।
ওদের খুব ভাল লেগেছে বাচ্চাদুটোর নাম ‘ভেবলি, ভুচুং’। ‘ভেবলি, ভুচুং’ ‘ভেবলি, ভুচুং’ বলে চিৎকার করতে থাকে ওরা।
শাশুড়ির দেরি দেখে করুণাও পায়ে পায়ে এদিকেই আসছিলো।
ওর কানে বড় বাড়ির বৌ এর কথাগুলো যেন কানে গরম সীসে ঢেলে দিয়ে আত্মায় প্রবেশ করে চেতনায় কালি মেড়ে দিয়ে গেল।
যেভাবে নিঃশব্দে এসেছিল, তেমন ভাবে বাড়ি ফিরেও গেল ‘ভেবলি ভুচুং’ এর মা।
পিছনে হাজরাপাড়ার ছেলেরা ভালুক সঙকে ঘিরে ঘিরে গাইতে থাকে ‘ভেবলি, ভুচুং’ ‘ভেবলি, ভুচুং’।
সেদিন ভালুক সঙ দেখে ফিরে এসে শাশুড়ি ডাকাডাকি করেও করুণার ঘরের দরজা খোলাতে পারেনি।
অনন্তকে খবর দেওয়ায়, ও এসে দরজা ভাঙতে দেখা গেল করুণার গলায় সেই বেগনি পাড়ের বেগমপুরীর জমকালো আঁচল, পা দুটো শূন্যে দুলছে।
গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছে করুণা।
মড়া নামাতে ‘বডি’ দেখতে দলের সঙ্গে এসেছিল বড়বাড়ির বৌও।
বৌয়ের দলের ওরাই সব বলছিল, -“জেনেশুনেও যেমন বিয়ে দিয়েছিল কাকি ঐ বাড়িতে। ওদের তো গলায় দড়ি দেওয়াই কাজ।”
-“ ল্যাংড়া অনন্ত তো লোক ভালোই। তবে বৌটা দু দুটো বাচ্চা রেখে কেন মরলে গো?”
-“দেখো মাগির আবার বাপের বাড়িতে নাগর টাগর ছিল নাকি? সেখেনে কিচু করে এয়েছে নাকি? নইলে এমন বাচ্চা ফেলে মরলি কি বলে?”
বড় বাড়ির বৌ বলল, -“ছিঃ তোদের খুব মুখ খারাপ। মরা মানুষের নামে খারাপ কথা বলতে আছে!”