সুন্দর বাগের ঠিক মধ্যখানে নেই তাজমহল। বেশ খানিকটা বাগান আর ফোয়ারা ছাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলে নদীর আভাস। ঠিক তার ধারেই খোলা আশমানের অনেক তলায় তাজমহল। নদীর ওপারে মানুষেরা থাকে। তাদের নদীর অভ্যাস হয়ে গেছে যদিও সে নদী এখন অসুস্থ, পচা প্লাস্টিকে ভরা। সে নদীর ফলে তাদের চোখের কি কোন অসুখ হয়েছে? তারা কি দেখতে পাচ্ছে তাজমহল? হ্যাঁ নদীর পাড়েই তাজমহলটি বসিয়ে ছিল সম্রাট, এখন সেটা সবাই দেখছে, চোখের অসুখ হলেও যে তারা দেখছে এ কথা বলল বারবার।
----- সত্যি দেখতে পাও?
----- বললাম তো, বলিনি?
----- হ্যাঁ তা বলেছ বটে।
----- তবে?
----- কিন্তু কথা কি শেষ হচ্ছে?
----- কথা কি শেষ হবার?
----- তবে বলতে থাকো।
----- প্রথমে তাজ নিয়ে বলতে থাকি?
----- তাজমহল?
----- ধরে নাও তাই।
----- তা ছাড়াও আছে নাকি কিছু?
----- থাকতেই পারে।
----- এখন বল।
সূর্য যখন প্রথম উঁকি দিচ্ছে তখনি মানুষও উঁকি দেয়। সে দেখে বাগান, দেখে ফোয়ারা, নদীর পাড়ে দেখতে পেল তাজমহল সে তখন আরক্ত। সবে তার ওপর পড়েছে আলোরা, মৃদু সূর্যের আলোর সঙ্গে সদ্য স্নাতা যুবতী নারীর তুলনা করেছিল প্রাচীন যুগ। সেটা মেনে নেয় কোন স্থপতি আর সম্রাটকে বলে। সম্রাট তখন বসেছিল আলাদা রকমের আসনে।
----- হুজুর ফজরের নামাজের ওয়াক্ত হবে যখন আপনি দেখবেন .....
----- কী দেখব?
----- তাজমহলকে হুজুর। সে রূপ সকালের রূপ - সুরত উল ফজর।
----- পবিত্র কোরানের আয়াতের কথা বলছ?
----- হ্যাঁ হুজুর।
----- সে রূপ কি দেখা যায়?
----- হ্যাঁ হুজুর।
----- একি তোমার বেয়াদবি?
----- না হুজুর।
----- যদি দেখা না দেয়?
----- দেখবেন হুজুর।
----- কী দেখব?
----- সুরত উল ফজর, সকালের রূপ। আরো দেখবেন হুজুর একটু বেলা বাড়লে সূর্য চনমনে হলে তাজমহলের অন্য রূপ দেখা যায় -সুরত উল দোহা। বেলা বারোটার সময় মাথার ওপর যখন সূর্য সেই সুরত উল সামস অথবা চাঁদনী রাতে তাজমহলের রূপ .....
----- থামো।
---- জি হুজুর।
----- এত কথা বলা বেয়াদবি।
----- জি হুজুর।
----- দেখা দিক আর না দিক, পবিত্র কোরানের আয়াত থেকে যে সব রূপ তুমি বর্ণনা করছ সব লিখে রাখবে।
----- খোদাই হয়েছে হুজুর।
----- কিন্তু নানা রূপ তো দেখাতে পারবে না।
সেদিন খুবই মেঘ করে মধ্য দিনের সূর্যকে আড়াল করে দিয়েছিল। মেঘের সেই রূপের মাঝে তাজমহলকে কী রূপে দেখা যাবে নিশ্চিত ছিলেন না প্রধান স্থপতি তাই তিনি নিশ্চুপ রইলেন। ফলত রাতের তাজমহলের যে কী রূপ তা শোনা হয়নি। মেঘের দল মাহোলকে বিগড়ে দিল। সম্রাট স্মৃতিসৌধের অদেখা রূপ সমুহ নিয়ে ভাবেন, ভাবেন অদেখা নানা শহরের কথা। আদৌ সেসব কীর্তির কতটুকুই বা দেখবেন এ জীবনে, দেখতে পাবেন কি?
এইরকম করেই মেঘেরা বিগড়োচ্ছে মাহোল, সকালে- বিকেলে -রাতে। তাতে অবশ্য তাজমহলের অপূর্ব রূপান্তর আটকায়নি। সেদিনও সকালে সেই রূপে তার গোলাপি আলো এসে পড়ে সারসার বসে থাকা কুস্তিগিরদের ওপরে। হিন্দুস্থানের তাজ সেই দমদার পেহলোয়ানের দঙ্গলে কেন মেয়েরা থাকবে আর উত্তর দিয়েছে মেয়েরাই, তারাও হয়েছে সমান পেহলোয়ান। বসে আছে পেহলোয়ানের দল সারি দিয়ে। বেইজ্জতির মাহোলে বেইজ্জত হয়েছে কোন মেয়ে কুস্তিগির। সুরত উল ফজরের আভায় সত্যি দেখতে দেখতে যেন সত্যিই দেখা যাচ্ছে নাইনসাফির ক্ষত। একটু বেলা হতে তাজমহলের রূপটাও একটু অন্যরকমের খোলে। সেই রূপটাকে কোরানের আয়াতে বলল সুরত উল দোহা। তাজা সূর্যের চনমনে রূপ আবার সারিসারি কুস্তিগিরের ওপর দিয়ে ঠিকরে গিয়ে আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের ঐসব তাজদের বিপন্ন মুখ দেখা গেলেও তারা বেশ চনমনে এমনটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। তারপর দুপুর বারোটা একটা নাগাদ সূর্য যখন ঠিক মাথার ওপর আর গনগনে দেখা যাচ্ছে, রোজ এই সময় -তাজমহলও তার রূপ বদলে নেয়। এইরূপে তাজমহল হল সুরত উল সামস। একইভাবে কুস্তিগীরদের সারটাও দেখা যাচ্ছে বদলে গিয়েছে। এরপর মধ্য আকাশে সূর্য সরে যায়। তার জায়গা নেয় দুরন্ত মেঘেরা। তারা বর্ষার বার্তাও আনতে পারে এমনটাই বরাবর ভাবা হয়েছে কিন্তু এবার একটু অন্যরকম হয়। কুস্তিগিরদের বিছানা বালিশ সব ভিজিয়ে দেয় বারিশ। তারা যেখানে সারসার বসেছিল সেই দেশের তাজদের অবস্থান মঞ্চ হাপুশুটি ভিজে একসা হয়ে গেল। এই রূপকে কী বলে জানতে বেরিয়ে পড়ে তাজমহলের কাছে পৌঁছতে সন্ধে হয়। রাতের ঝোঁকে তাজমহল আবারও, এবারও অন্য এক অপূর্ব লাগতে লাগল। ঘোর লেগে লেগে যখন উচ্চারণ করা হচ্ছে সব আয়াত আর মন্ত্রদের, সেসময় পুলিশ এসে কুস্তিগিরদের দঙ্গলকে সরিয়ে দিল হিঁচকে টেনে। কুস্তিগীরদের হিঁচকে টানা অত সোজা নয় তবু প্রচুর পুলিশ মিলে এ ঘটনা ঘটায়। যখন একজন মহিলা কুস্তিগীর বলে বসে,“ দেশের তাজ আমরা! এই কী কপালে ছিল!” তখন তাকে কয়েকজন মহিলা পুলিশ আরো হ্যাঁচকা মারে।
খাড়া পাহাড়ের ওপর দিয়ে এক কুয়াশাঢাকা অঞ্চল আছে। সে আঁচলটা বেশিরভাগ অচেনা। মন্দির আর মসজিদ হয়ে হয়ে তার যেন আর আশ মিটছে না। হ্যাঁ, সে জায়গাটার কথাই বলা যেতে পারে যেখানে আরো খাড়াই বেয়ে আরো ওপরে রয়েছে হজরতের দরগা,সবাই সেখানে চাদর চড়ায় আর মনের কথা বলে গুনগুন করে। ফিসফাস সেই আওয়াজের সঙ্গে অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস আছে যা কখনো শোনা যাবে না অথচ লোকের কী বিশ্বাস যে হজরত শুনবেনই। কবেই মরে যাওয়া হজরতের কাছে কয়েকজন যায়। হজরত চোখ বুজে ছিলেন। তারপর তিনি চোখ খুলে এই মাহোল পর্যবেক্ষণ করে বললেন,“ রাতের বেলা তাজমহলের রূপটা বড় গভীর হয়,গম্ভীর সে মাহোল। ”
—— কী বলছেন হজরত!
----- রাতের কথা বলছি। তাজের কথা।
----- তাজমহলের কথা?
হজরত বেশি উত্তর করেন না। পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে এক দলা কুয়াশা পচা প্লাস্টিক, ডিজেল আর পেট্রোলের ঝাঁঝালো গন্ধ নিয়ে নিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে ধরে গোটা মাজার। যেন যমুনা নদী অভিযোগ করছেন, সেই নদী যার পাশে তাজমহল আর অনতি দূরে কুস্তিগিররা। সবার ঘুম পায়, কালঘুমে ডুবে যেতে যেতে সবাই শুনছে হজরত হাজার বছরের পুরনো চোখ মেলে বলছেন,“রাতের তাজমহলের রূপ হল সুরত উল লাইল।” এর সঙ্গে এখনকার কী সম্বন্ধ সবাই ঘুমের মধ্যেই ভাবছে তো ভাবছেই।