মায়ের চিন্তার কি আর শেষ আছে? সংসারের হাজারো খুঁটিনাটি কাজ সামলে একটু সময়ের জন্যও নিজের কথা ভাববার জো নেই মেনকার। সারাক্ষণ নানান চিন্তা মাথাতে জাঁতার মতো বনবন করে ঘুরে চলেছে। এদিকে আকাশপটের রঙ বদলানো মানেই হলো মেয়ের বাপের বাড়ি আসার দিন ঘনিয়ে আসা। উঠোনের বাইরে রাখা বড়ো পাথুরে চাট্টানের ওপর খড়ি দিয়ে আঁক কেটে কেটে শুভ সময়ের হিসেব রাখার পর্ব চলছে সেই কবে থেকে ! এখন যত দিন কাছে এগিয়ে আসছে ততই যেন মায়ের উৎকন্ঠা আর উৎসাহ দুইই বাড়ছে। আসলে জামাইয়ের ওপর খুব যে একটা ভরসা আছে মেনকার তা নয়। ওই বাউন্ডুলে, নেশাখোরকেই মেয়ে জীবনসাথী হিসেবে বেছে নেবে তা ভাবতেই পারেনি সে। বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনেক চেষ্টা করেও ঐ জামাইয়ের ওপর থেকে মেয়ের মন সরাতে না পেরে শেষমেশ নিমরাজি হয়েই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন। কথায় বলেনা 'যার যেথা মজে মন, কি বা হাঁড়ি কি বা ডোম'! যাইহোক এখন সবকিছুই কেমন সয়ে গেছে মেনকার। আশপাশের প্রতিবেশীদের মেয়ে জামাইরাও এই সময়ে শ্বশুরবাড়ি দিন কয়েকের জন্য ঘুরতে আসে। তবে তাদের রকমসকম আলাদা, তাঁর মেয়েজামাইয়ের মতো নয়। ছেলেপুলেদের সঙ্গে করে তেনারা সব তিথি নক্ষত্র মেনে জোড়ে আসেন, শউর ঘরের আদর আপ্যায়নের পালা সাঙ্গ হলে জোড়েই ফিরে যান। আর উমা? চার চারটে ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁকে যে একাই এতটা পথ ঐ ধুমসো ষণ্ডদুটোর পিঠে চড়ে আসতে হয়। কতবার মেনকা জামাইকে বলেছে – 'কেমন মনিষ্যি তুমি বাপু! একটা হাল ফ্যাশনের রথ ঠথও কি জোটেনা তোমার কপালে? ওই দুধের বাচ্চাদের নিয়ে উমা একাএকা সেই কৈলাস থেকে এতটা চড়াই উৎরাই পথ পেরিয়ে আসে, তাতে ওদের কষ্ট হয়না বুঝি?' শ্বশ্রুমাতার কথায় কান দিতে বয়ে গেছে ভোলানাথের ! কানে গোঁজা ছিলিমে একটা লম্বা টান দিয়ে 'ব্যোম' বলে এমন সরবে হাঁক ছাড়ে যে ভয়ে মেনকা পালানোর পথ খুঁজে পায়না।
দুপুরবেলা গিরিরাজ ঘরে ফিরতেই মেনকা তাঁকে তাড়া দেন - ' কেমন বাপ তুমি ? কোনো ব্যাপারেই দেখছি তোমার নজর নেই!' গিন্নির এমন আক্রমণাত্মক ভঙ্গি দেখে প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে যান গিরিরাজ। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে গলার উড়নিটাকে খুলে পাখার মতো দুলিয়ে গায়ের ঘাম শুকোতে শুকোতে গিরিরাজ ব্যস্ত শঙ্কিত গলায় বলেন – 'কেন ! আবার কী হলো? এতো তেতে উঠেছো কেন?'
– ' সাধে কি আর বলি, আমার পোড়া কপাল! বলি,হতে আর বাকি আছে কী ? দুদিন বাদে নাতি নাতনিদের নিয়ে তোমার মেয়ে আসবে। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা ,খানাখন্দে ভরপুর। তাতে ভয় হয় ঠিকঠাক চিনে আসতে পারবে কি না? ' মেনকা তাঁর উদ্বেগের কথা জানান।
– ' ও এই কথা! আমি তো অন্যরকম কিছু ভাবছিলাম। এখন তোমার নাতি নাতনিরা আর ছোট্ট খোকা - খুকিটি আছে নাকি ? গানুতো রীতিমতো হোনহার আদমি হয়ে উঠেছে। এই তো একা একা মুম্বাই না কি একটা শহরে পেন্নামি আদায় করে নিয়ে এলো। কেতোটা একটু কাপ্তেন গোছের আছে বটে, তবে ওকে ওর দুই দিদি ঠিকঠাক সামলে নেবে। আর তাছাড়া …..। গিরিরাজ একটু থামেন দম নেবার জন্য।
– ' আর তাছাড়া মানে কী? তোমার হালও তো তোমার গুণধর জামাই ভোলুরামের মতো , না আঁচালে বাপু বিশ্বাস নেই। ' মেনকার গলার স্বর বেশ চড়া। গিরিরাজ তা টের পেয়েই তড়িঘড়ি বলেন,
– 'ও সব আমার ওপর ছেড়ে দাও গিন্নি। তোমার মাথা গলিয়ে কাজ নেই। আমি Haliastur indus কে বলেছি ও ঠিকঠাক উমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে। ' গিরিরাজ গিন্নিকে আশ্বস্ত করে কলঘরের পথ ধরেন। যা গরম পড়েছে! শেষ
এদিকে মেনকা পড়লেন মহা ফাঁপরে! কস্মিন কালে এমন নাম শুনেছেন বলে মনে করতে পারছেন না । শেষে গোগল বাবার স্মরণ নিলেন। গোগল বাবা এখনও এখানে খুব পরিচিত নন, তবে কেতো গতবার এসে চুপিচুপি এই বাবার মাহাত্ম্য কথা তাঁর দিম্মাকে জানিয়ে গেছে।
– ' বুঝলে দিম্মা! রণে বনে জলে জংগলে যখন যেখানে যেমন প্রয়োজন পড়বে, চোখকান বুঁজে এই গোগল বাবাকে সমস্যার কথা বলবে। নিমেষে মুশকিল আসান। এর বলে বলীয়ান হয়ে মর্তের মানুষজনেরা তো নিজেদের মহাপণ্ডিত ভাবে। কথায় কথায় গোগলের বাটনের সেবা লাগি বলে হত্যে দিয়ে পড়ে।
নাতির কথা মাথায় আসতেই মেনকা পরি মরি করে ছুটলেন নিজের ঘরে। কেতোর দেওয়া গোগল বাবা শরণম যন্ত্রটিকে সাবধানে কুলুঙ্গি থেকে বের করে আঁচলে ঘষে , কত্তা মশাইয়ের বলা সেই নামটা উচ্চারণ করলেন। টুং করে একটা আওয়াজ হতেই দেখেন শোঁ শোঁ শব্দ করে এক ঢাউস চেহারার পাখি সামনে এসে দাঁড়ালো। গম্ভীর গলায় সেই পাখি বলে –' ম্যাডাম, কেন ডেকেছেন? আপনার হুকুম তামিল করতে এই বিহঙ্গ বান্দা হাজির। ও বুঝতে পেরেছি, মা কাত্যায়নীকে কৈলাস থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসার জন্য তো ? কোনো চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবো।এটা আমার নবেল্ ডিউটি।'
পাখিটিকে দেখে মেনকা কেমন থতমত খেয়ে যান। একটু ইতস্তত করতে করতে বলেই ফেলেন – 'শোনো বাপু, তোমাকে আগেতো এই তল্লাটে দেখেছি বলে মনে হয়না! কোথায় থাকো?'
– ' আজ্ঞে ম্যাডাম, আমি তো এই এলাকার খেচর নই, তাই আমাকে দেখবেন কী করে? আমার নাম Haliastur indus ওরফে শঙ্খচিল। নিবাস সেই সুদূর দক্ষিণ প্রদেশের বঙ্গ প্রদেশে। আকাশের অনেক উঁচুতে ডানা মেলে উড়ে বেড়াই। তাই নীচের পৃথিবীর সবটুকুই আমার নজরে ধরা পড়ে। গিরিরাজ তো এজন্যই আমাকে বললেন,আপনার মেয়ে কাত্যায়নী ঠাকুরণ আর তেনার ছানাপোনাদের ঠিকঠাক পথ দেখিয়ে আপনার কাছে পৌঁছে দিতে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। এমন এসকর্টের কাজ আমাকে নিয়মিত করতে হয় '। শঙ্খচিলের কথায় আত্মবিশ্বাসের সুর ঝরে পড়ে।
মেনকা যেন এবার একটু আশ্বস্ত হন। তবে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে ওই অদ্ভুত ইংরেজি শব্দগুলো। আর প্রশ্ন করা ঠিক হবে কি হবে না ভাবতে ভাবতে এক রকম মরিয়া হয়ে উঠে শেষে জিজ্ঞাসাই করে বসেন – ' শঙ্খচিল! এমন একটা সুন্দর নাম থাকতে গিরিরাজ আমাকে অমন খটমট একটা নাম বললেন কেন?'
– ' ম্যাডাম!ওটা নিয়ে একদম ভাববেন না। ওটা হলো আমার বিজ্ঞান সম্মত নাম। এই নামেই দুনিয়ার তামাম গবেষকমহলে আমার পরিচয়। আর ওই যে শঙ্খচিল নামটা ,ওটা রেখেছে আমার বাংলাদেশের মানুষেরা। আমার এই ধবধবে সাদা শঙ্খের মতো মাথার জন্যই এমন সুন্দর নাম। বাংলার এক কবি তো শঙ্খচিল হয়ে আবার বাংলাদেশের চেনা ঠাঁইয়ে ফিরে আসতে চেয়েছেন। শুনবেন কবিতাটা? '– নিজের কথা বলার জন্য মন আনচান করে শঙ্খচিলের।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে গিরিরাজ একটু বিশ্রাম নিতে ঘরে আসতেই মেনকা কথাটা কত্তামশাইয়ের কাছে পাড়েন। –' বুঝলেন, আমি না আপনার মতামত না নিয়েই একটা কাজ করে ফেলেছি । আমি আপনার ঐ Haliastur indus কে মাগ্গদশ্শক হিসেবে উমাকে কৈলাস থেকে গিরিধামে নিয়ে আসার দায়িত্ব সঁপে দিয়েছি। বেশ বিশ্বস্ত আর দায়িত্বশীল বলেইতো মনে হলো। আর তাছাড়া চেহারাটাও বেশ। নজর ধারালো। কথাবার্তা খুব সুন্দর। যার তার ওপর তো আর উমার মাগ্গদশ্শকের দায়িত্ব দেওয়া যায়না ! আপনি কী বলেন ? ' গিরিরাজের সম্মতি নিতে মেনকা স্বামীর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। ভেসে এলো সুতীব্র স্বননে নাসিকা গর্জনের শব্দ। আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাসি চাপতে চাপতে নিজের ঘরে যাবার সময় শুনতে পান ঘুম জড়ানো কন্ঠে গিরিরাজ বলছেন – তো থা স্ তু ।
বিকেলে মেনকা নিমকি,কামরাঙা গজা এসব বানাবেন বলে ব্যস্ত হাতে ময়দা ঠুসছেন, এমন সময় শুনতে পেলেন কে যেন বলে উঠল – 'পেন্নাম মা ঠাকুরণ। সব কুশল তো? আপনার আদরের বাবাজীবন মানে বাবা ভোলানাথ হঠাৎ আমাকে এত্তেলা পাঠিয়ে জানতে চাইলেন আপনারা সব আছেন কেমন? তা শুনলুম ওবেলা ঐ হুমদো চিলটা এয়েছিল আপনার সাক্ষাতে। ও বেটার মতলব কী?'
কাজের সময় খেজুরে আলাপ বিলকুল না পসন্দ মেনকার, কিন্তু এ হলো অনেক দিনের চেনা, তার ওপর আদরের কন্যা উমার কৈলাসে ফিরে যাবার মূল মাগ্গদশ্শক। তার সঙ্গে এখন চোটপাট করা ঠিক হবে না মনে করে মোলায়েম স্বরে মেনকা বলেন –' ও বাবা! তুই! আমাদের পক্ষি নীলকন্ঠ! আর বলিস কেন বাছা? সকাল থেকে হাজার কাজের জটলায় একেবারে বেহুদা হয়ে পড়েছি। তা মেয়েটা এখনো এসে পৌঁছলো না, এরমধ্যে যাবার তোরজোড় করাটা কি মানায় রে বাপু ! পাড়া প্রতিবেশী মানুষেরা গালমন্দ করতে শুরু করে দেবে।'
দুই ঠোঁটের মাঝে লুকিয়ে রাখা জিভ কেটে লজ্জায় অধোবদন হয় নীলকন্ঠ পক্ষি । মাথা নাড়িয়ে সে বলে – ছি ছি মা ঠাকুরণ ! অমন কথা মুখে এনোনি, আমার পাপ হবে। তুমি তো জানো লোকজন আমাকে ভোলানাথ নীলের অংশ বলে মান্যি করে। আমাকে দেখলে সকলের মঙ্গল হয়,ধন সম্পদের বৃদ্ধি হয়। সেজন্যই তো দশমীর দিনে আমাকে উড়িয়ে দেবার প্রথা , পরম্পরা রয়েছে। খাঁচা খুলে আমাকে উড়িয়ে দিলে ডানা ঝাপটে উড়তে উড়তে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আমি কৈলাসে গিয়ে বাবাকে মায়ের রওয়ানা হবার খবরটি পৌঁছে দিই। আর কাতুদিদি ঐ ষণ্ড দুটোর পিঠে চেপ্পে ধীরে সুস্থে কৈলাসে ফেরেন। জামাইকে সকাল সন্ধ্যায় অমন বাউন্ডুলে বলে গাল পাড়লে কী হবেগো! বাবার মন খুব নরম। সেজন্যই তো বাবার আরেক নাম হলো মনতোষ।'
পক্ষি নীলকন্ঠের মুখে জামাইয়ের প্রশংসা শুনে মেনকা বেজায় খুশি হন। নিজের মনে মনে বলেন, ভোলানাথ মানুষটা একদম খাঁটি।অন্যদের মতো মুখে এক, কাজে আরেক নয়। কাতুটা একেবারে হীরের টুকরো পছন্দ করেছে।
মেনকাকে একটু আনমনা হতে দেখে পক্ষি নীলকন্ঠ প্রশ্ন করে – ' বলি ,ওই হুমদো চিলটা কি তাহলে উমাদিদিকে কৈলাস পর্বত থেকে পথ দেখিয়ে হেথায় নিয়ে আসবে? সেও হবে আমার মতো মাগ্গদশ্শক? এটা ভালো ব্যবস্থা হয়েছে – ঐ চিল বাবাজি শউর বাড়ি থেকে মা আর তাঁর দুই জোড়া ছানাপোনাদের ঠিকঠাক পথ দেখিয়ে হেথায় নিয়ে আসবে , আর আমি, এই পক্ষি নীলকন্ঠ মায়েরে পথ দেখিয়ে কৈলাসে দিয়ে আসবো।আজ থেকে আমরা দুই বিহঙ্গ হলাম মায়ের এছকর্ট,থুড়ি মাগ্গদশ্শক। দারুণ ব্যাপার! আগামী দিনে এই প্রথা যাতে সকলে মেনে চলে তার ব্যবস্থা তোমায় করতে হবে ঠাকুরণ।তোমায় করতে হবে ……। '
কথা শেষ হয়না। পক্ষি নীলকন্ঠ আনন্দে আত্মহারা হয়ে বারকয়েক জম্পেশ করে ডিগবাজি খায় তারপর তুড়ন্ত ঘনায়মান সাঁঝ আঁধারে মিলিয়ে যায়।
আর মেনকা দুই বড়ো পিরিচে গরমাগরম চা আর রেকাবিতে সদ্য ভাজা কুচো নিমকি নিয়ে অন্দরমহলের উদ্দেশ্যে পা বাড়ান। গিরিরাজের যে এখন সান্ধ্যকালীন চা পানের সময় হয়েছে।