মিষ্টির ক্ষেত্রে বঙ্গ ও কলিঙ্গদেশ বাকি উপমহাদেশের তুলনায় আলাদা। এই দুই জাতি ছাড়া ভারতের আর কেউ বড়ো একটা (বা আদপেই) মিঠাইতে ছানার ব্যবহার করে না। আমাদের জিভে সঞ্চারিত রসের ওপর যদি ঐকান্তিক বিশ্বাস রাখা যায় তাহলে মানব সভ্যতার ইতিহাসের অনেক সত্য আপনি উন্মোচিত হতে পারে। কারণ রসনা এমন এক জায়গা যেখানে আমি আপনি সম্পূর্ণ নগ্ন। এই শিল্প আস্বাদনের ক্ষেত্রে কোন ভন্ডামি চলে না। আপনি লুচি, আলুর দম আর রসগোল্লা খেয়ে খাঁটি বাঙালিয়ানার ঢেঁকুর তুলবেন ভাবলেন – তা হবে না। আপনার বাঙালিয়ানার উদগারের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াবে পর্তুগীজ আর ওলন্দাজরা। রসগোল্লা আবিষ্কার নিয়ে এই যে উড়িষ্যা আর পশ্চিমবঙ্গের এত লড়াই ঝগড়া – অথচ তার মূল উপাদান এসেছে ইউরোপের ভিয়ান থেকে। খাঁটি দেশজ কালচার হিসেবে আর যারাই দাবী তুলুক, বাংলার অত্যন্ত গর্বের মিষ্টি চর্চা সেই অঙ্গীকার করতে পারে না। কারণ মিষ্টিতে বাঙালি তার স্বাতন্ত্র্যের জন্যে ইউরোপের কাছে ঋণী। (বাকি রেনেসাঁস থেকে কমিউনিজম – ভিনদেশী না বাঙালি বলেই সম্ভব তা বিদ্বজ্জনেরা বলবেন।)
ইউরোপীয়রা ডেসার্টে চিজ ব্যবহার করছে খ্রীষ্টের জন্মের আগে থেকে। চিজকেকের ইতিহাস খুঁড়লে প্রায় ৪০০০ বছর আগেকার গ্রীস বেরিয়ে আসবে। ছানাও এক ধরণের চিজ। ইংরিজিতে বলে কটেজ চিজ। শ্বেতাঙ্গরা রেনেট বা বাছুর জাতীয় পশুর পেটের চর্বি দিয়ে দুধ থেকে ছানা কাটাতো। বাঙালি অতোটা ম্লেচ্ছ পথে না হেঁটে, দুধের সঙ্গে লেবুর রসের সংযোগ ঘটালো। মূলত পাতি কিন্তু শৌখিন শীতকালে কমলাও চলতো। তা এ এমন এক সংযোগ যা মিলনের পরমুহূর্তেই বিচ্ছেদ ডেকে আনে। দুধের সার অংশ থেকে জলের বিচ্ছেদ। পড়ে থাকে ছানা বা কটেজ চিজ যা থেকে পরে জন্ম নেবে যুগান্তকারী সব মিষ্টি।
তবে বাঙালির ছানা আবিষ্কারের আগেও কি মিষ্টি ছিল না! বিলক্ষণ ছিল। যে দেশের নগরের নাম গুড়ের নামে (গৌড়) সে দেশের গণরসনায় মধুর ধারা গঙ্গা – পদ্মার সময় থেকেই প্রবাহিত। বাংলার মিষ্টির ইতিহাসকে দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রাক-ছানা ও ছানা-পরবর্তী। বাঙালি ছানার স্বাদ পেল আঠের শতকের একদম শেষের দিকে। পর্তুগীজদের হাত ধরে। তার আগে ছানার মতো বিকারগ্রস্ত দুধ আহার্য বিষয় হিসেবে গণ্য হত না। বিকৃতি যে কিরূপ মনোরম হতে পারে তা ইউরোপীয় ভোজনশিল্পীরা তাদের সহজ ভঙ্গিতে শিখিয়ে দিয়ে গেছিলেন বাঙালিকে। সুকুমার সেনের ‘কলিকাতার কাহিনি’ বই থেকে পাওয়া যাচ্ছে, ক্ষীর-মাখন-ঘি-দই – এগুলো কাঁচা দুধের স্বাভাবিক পরিণাম। কিন্তু কোনটিই দুধের বিকৃতি নয়। ছানা কিন্তু ফোটানো দুধের কৃত্রিম বিকৃতি। অন্য দ্রব্য সংযোগ করে দুধকে ছিন্ন ভিন্ন করা হয়েছে। তাই বাংলায় এর নাম ছেনা, এখন মুখে মুখে হয়েছে ছানা। সংস্কৃত ভাষায় ছানার কোনরকম উল্লেখ নেই। স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দু শাস্ত্র অনুসারী পুজো আচ্চায় তাই ছানার মিষ্টি ঠাকুরকে ভোগে দেওয়া গর্হিত।
প্রাক ছানা পর্বের মিষ্টির কালে মূলত উপাদান হিসেবে ব্যবহার হ’ত নারকেল, গুড় (আখ অথবা খেজুর) এবং চালের বিভিন্ন প্রকার (খই, চিঁড়ে বা চালের গুঁড়ো)। শুধু তাই নয় একটি মাত্র উপাদান নির্ভর মিষ্টিও ছিল বহুল প্রচলিত। এখনও ঠাকুরঘরে দিদিমা- ঠাকুমার কাছে হাত পাতলে পেতে পারেন। বাতাসা, কদমা, মঠ, চিনি বা গুড়ের মন্ড তথা মন্ডা, মোদক ইত্যাদি। নাড়ু বিষয়টি বাংলার আলে-কালে, পালা-পার্বণে, খুব চলতো। সে নারকেল কোড়া দিয়ে গুড়ের নাড়ু হোক বা চিঁড়ে কি মুড়কির নাড়ু হোক। এদেশীদের বিয়ের অনুষ্ঠানে আতপচালের গুঁড়ো, খোয়া ক্ষীর আর তিল দিয়ে তৈরি আনন্দ নাড়ু বাংলার এক বিশেষ ভূ-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করতো, যা এখন বিস্মরণের অতলে চলে গেছে। এছাড়া নবান্ন ও পৌষ সংক্রান্তির সময় চাল আর নতুন গুড়ের তৈরি পিঠের গল্প আমরা সবাই জানি। বিবিধ প্রকৃতির পিঠে বাঙালির জীবনে এখনো প্রাসঙ্গিক ও জনপ্রিয়, তাই রক্ষে। এই কতিপয় উদাহরণ বাদ দিলে ছানা পূর্ববর্তী যে বিপুল মিষ্টির ভান্ডার তাতে ক্রমশ বাঙালির জিভ অনভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। অতএব আস্তে আস্তে সেই সব নাড়ু, মন্ডা ইত্যাদিরা আমাদের মানচিত্রের বাইরে চলে গেছে।
এখানে মাথায় রাখতে হবে মিহিদানা, সীতাভোগ বা দরবেশের মতোন মিষ্টি, যাদের মূল উপজীব্য ডাল-চাল-ঘি ইত্যাদি তাতে ছানার প্রয়োগ নেই। কিন্তু এগুলো বাংলায় জন্ম নিয়েছে ছানা আবিষ্কারের অন্তত একশ বছর পরে। উনিশ শতকের শেষে বা বিশ শতকের একেবারে গোড়ায়। কাজেই তাদের উপাদানে ছানা না থাকলেও স্বাদে ছানা পরবর্তী সময়ের সংস্কৃতির ছাপ রয়ে গেছে। এখনও অসম্ভব জনপ্রিয় থাকার সেটা একটা কারণ হতে পারে।
এই সংস্কৃতি কি? ছানা এসে বাঙালি মিষ্টির চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গিতে এক বিরাট সরণ ঘটিয়েছে। আগেকার মন্ডার ফর্ম ফ্যাক্টর মোটামোটি এক রেখে তার উপাদানে ছানা যোগ করা হল। ফলে আগেকার সেই জাঁকালো - একগুঁয়ে মিষ্টি ভাব ছানার সংস্পর্শে এসে তীব্রতা কমাতে বাধ্য হল। বাঙালির মিষ্টি পেলব ও সংস্কৃত হল।
তার সঙ্গে আরো একটা ঘটনা চুপিসারে ঘটে গেছিল বলে আমার অনুমান। ভুল হলে কেউ শুধরে দেবেন। মধ্য ও প্রাক আধুনিক যুগের মিষ্টি (অর্থাৎ আমাদের এই নিবন্ধ অনুযায়ী ছানা পূর্ববর্তী সময়কালের মিষ্টি) ছিল মূলত গৃহস্থের ব্যক্তিগত হেঁসেলে। অর্থাৎ বাড়ির মহিলাদের হাতে। ফুড হিস্টোরিয়ান চিত্রিতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছেন, ছানার মিষ্টি একচেটিয়া ভাবে ময়রাদের হাতেই তৈরি হত। নারকেল নাড়ুর তুলনায় রসগোল্লার নির্মাণ শৈলী কঠিন। তাছাড়া ছানা কাটানো হয়তো শাস্ত্র সম্মত নয় বলেও বাড়ির মেয়েরা ওই কাজে হাত দেয় নি। যাই হোক ছানার মিষ্টি তার জন্মলগ্ন থেকেই ময়রার দোকানে বাণিজ্যিক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। তাহলে এদেশে আধুনিক যুগের সূচনার সমান্তরালে একে রাখাই যায়। ফলে স্বাদেও কিঞ্চিৎ ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ছোঁয়াচ লাগতে শুরু করেছিল।
তবে সবই কি এত আহ্লাদের? মধুমেহ রুগীদের লোভাতুর আদিখ্যেতার বাইরে যদি বিশ্লেষকের নিরপেক্ষতা আনা যায় তাহলে বাঙালি মিষ্টির অনেক সীমাবদ্ধতা চোখে পড়বে। ‘গ্যাস্ট্রোনমি অ্যানালিটিক’ অনির্বাণ দত্ত মনে করেন বাঙালির মিষ্টিতে জটিলতা কম। কারিগরী কৌশল নৈপুণ্য আছে অঢেল কিন্তু তার চলন সহজিয়া ঢঙে। তার সঙ্গে জাতিগত বৈশিষ্ট্য হেতু আবেগের বাড় বাড়ন্ত। যেকোন শিল্প কর্মে জটিলতার অনুপস্থিতি আর আবেগের আতিশয্যকে কখনোই ভাল চোখে দেখা হয় না। একে কল্পনা আর সংযমের অভাব হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। খাবারের চরিত্র বিচারে তিনটি মাত্রাকে মাথায় রাখা দরকার। গন্ধ (aroma), গঠন-বিন্যাস (texture) ও স্বাদ (flavour)। এই তিনটি মাত্রারও বিভিন্ন স্তর বিন্যাস থাকতে পারে। যেমন লখনৌ এর মালাই গিলোরিতে প্রথমে পেস্তার শিরোস্ত্রাণ তারপর সরের আধা ছিবড়ে আবরণ এবং ভেতরে টুকরো টুকরো মিছরি... জিভের মধ্যে কখনো হালকা খোঁচা দিচ্ছে আবার কখনো মালাইএর আদুরে স্পর্শ দিচ্ছে। ব্ল্যু বেরি চিজ কেকের স্বাদের ও টেক্সচারের তিনটি স্তর তার নামেই বহন করছে। তলায় ক্র্যাকার ক্রাম্বারের কুরমুরে ভাব, ওপরে ব্ল্যুবেরি প্রিসার্ভের আস্বাদ আর মাঝখানে এলাহি চিজ। এই যে স্বাদের বৈপরীত্য তা এক বিচিত্র ও বিস্ময়ের অনুভূতি দেয়। এহেন মাত্রা ও স্তরের বহুত্ব বাংলার মিষ্টিতে প্রায় নেই বললেই চলে। কিছু উদাহরণ বাদ দিলে বাকি সকলেই বড়ো সহজ সরল। রসগোল্লা যতই মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া কাজ হোক না কেন তার প্রথম কামড়ে যা শেষ কামড়েও তাই। কোন রহস্য নেই। বাংলার জিওগ্রাফিকাল ইন্ডেক্স হিসেবে রসগোল্লা বিশ্বজয় করেছে কিন্তু তা বাঙালির পূর্বতন জটিল ও উপাদান বহুল রান্নার ইতিহাসের পরিচয় বহন করে না। অথচ বাঙালি বাড়ির রান্নাঘরে তৈরি বেশ কিছু মিষ্টি অনায়াসেই ‘কমপ্লেক্স কুইজিন’এর আওতায় পড়বে। পাটিসাপটা বা দুধ পুলি ইত্যাদি পিঠে জাতীয় মিষ্টিগুলি স্বাদে ও গঠনে বিবিধ স্তরে বিন্যস্ত। তবে পাটিসাপটা বিষয়টা বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী সব জায়গাতেই বহুল প্রচলিত। এই নিয়ে বাংলার আলাদা করে গর্ব করার কিছু নেই। হায়দ্রাবাদ থেকে কোচিন। দ্রাবিড়রা বলে রাইস পত্রি। হায়দ্রাবাদে ওই সাপটে থাকা মোড়কটি নাকি প্রায় কাগজের মতোন ফিনফিনে হয়ে থাকে। ভেতরে থাকে ড্রাই ফ্রুটের পুর। আর ফোর্ট কোচিতে আমি নিজে খেয়েছি নারকেল আর চিনির পুর থাকে। তবে তাকে সাপটে থাকে চালের গুঁড়ো আর ডিমের ব্যাটারে তৈরি লম্বাটে খাম। বোঝাই যাচ্ছে বিলিতি ক্রেপের আদল।
তবে উল্লেখযোগ্য হল বাংলায় অধুনালুপ্ত নানা ধরণের নাড়ু। তার মধ্যে ঝালের নাড়ু বলে এক আশ্চর্যময় নাড়ুর স্মৃতি রোমন্থন করলেন অনির্বাণ। ‘একবারই খেয়েছিলাম। খুব ছোটবেলায়। কিন্তু এমন একটা চমক ছিল যে খুব ক্ষীণ হলেও স্বাদটা মাথায় রয়ে গেছে।’ শুনে আমিও খানিক চমকে গেলাম। সাদা আর কালো গোটা গোল মরিচ গুঁড়ো, দারুচিনি গুঁড়ো আর অল্প জিরে গুঁড়ো; তার মাঝে মধ্যে মিছরির টুকরো। নিজে না খেলেও আন্দাজ করতে পারি যে এই জিনিস জিভে কেমন দুই বিপরীতমুখী টানা পোড়েন তৈরি করতে পারে। ঝালের নাড়ু গৃহলক্ষ্মীদের রান্নাঘর থেকে দোকানে পৌঁছল না কেন?
আমি বলছি না যে রসগোল্লা বা মিষ্টি দইয়ের সহজ সুরে আনন্দ নেই। অপার আনন্দ। কিন্তু শুধুই আনন্দ! সিনফুল শয়তানি নেই। (যাদের স্বাদে ডেভিলের চরিত্র আছে বলে মনে হয় সেই জিলিপি - মালপোয়ারা একান্ত বাঙালি নয়। এবং বাংলার বাইরে মতান্তরে তাদের স্বাদ উন্নততর।)
তাহলে কি সেই প্রশ্নসূচক রেনেসাঁসের মতো বাংলার এত আহ্লাদের মিষ্টি-চর্চাও ঔপনিবেশিক? আর যাদের শেকড় বাংলায় প্রোথিত তারা আধুনিকতার চাপে গঙ্গাহৃদির কোন অতলে, কে জানে। আমার প্রজন্মের জিভের স্মৃতিতে নেই। এখানে আমার জিভের কথা যখন বললামই, তখন সুযোগ মতো একটা কথা জানিয়ে রাখা উচিত। যে এই পুরো আলোচনা অত্যন্ত ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও স্বাদের অনুভূতি থেকে। প্রাজ্ঞ মিষ্টি বিষারদের এতে ঘোর আপত্তি থাকতেই পারে। আরো একটি কথা না বললে বাঙালির রসনা-চর্চার প্রতি অবিচার হবে। মিষ্টির বাইরে যদি দেখা যায়, তাহলে নিম বেগুন থেকে শেষ পাতে চাটনি পর্যন্ত রন্ধনকলায় আমার স্বজাতির সূক্ষ্ম জটিলতা পর্যাপ্ত। এখানে নানান পদের বহুত্বে ও বৈচিত্র্যে বুদ্ধি ও কল্পনার কোন অভাব নেই।
নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙালীর ইতিহাস’এ বলেছেন চর্চা সংস্কৃতির লক্ষণ হতে পারে কিন্তু চর্যা বা আচরণই সেই চর্চাকে সার্থক করে তোলে। বরং চর্যার ক্ষেত্র আরো বেশি বিস্তৃত। বাঙালির খাবারের প্রতি মূল আর্যাবর্তের ঐতিহাসিক অশ্রদ্ধা স্বত্তেও পালটা ভ্রুকুটি দেখিয়ে আমরা এই ভোজনের বিস্তীর্ণ বর্ণমালা তৈরি করেছি। সেজন্যেই মিষ্টির একমুখী চলনে খটকা লাগে। আর মিষ্টি তো কবিতা বা সিনেমা নয়। এক্ষেত্রে জাতির সার্বিক অবক্ষয় দিয়ে এই স্বাদের সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। এ যেন একদা নোবেল পাওয়া জ্ঞানের কমফোর্ট জোনের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া।