“মেয়েদের কলম খুব শক্তিশালী ও অকপট।”
কথাপ্রসঙ্গে বললেন তিনি। অকপট তিনি নিজেও। নিজের সমস্ত জীবন এবং সৃষ্টি নিয়ে সরল ও অকপট কবি কালীকৃষ্ণ গুহ, যিনি নিরাসক্ত বলে দিতে পারেন, “কোনো বিতর্কিত আলোচনায় আমি ঢুকব না।”
দীর্ঘদেহী তিনি এখনও সোজা হয়ে চলাফেরা করেন। খুব সম্প্রতি একা বাইরে যাওয়া বন্ধ করেছেন, আগের মতো দীর্ঘ পঠনেও এখন কষ্ট, কিন্তু কথা চিন্তা বা স্মৃতিতে কোনো জড়তা নেই। সোশাল মিডিয়াতেও অল্পবিস্তর উপস্থিতি জারি আছে। নতুন লেখা পড়বার ইচ্ছে চলে যায়নি, এই লেখকের উপন্যাস মানসাই পড়বার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।
যা কথা হল সেদিন, তাঁর নিজের জবানিতেই তা রাখলাম। কারণ গতানুগতিক প্রশ্নোত্তরের পর্ব সেদিন ঘটেনি মোটেই, একটা অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা, কবির ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতিমন্থন, চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে একাগ্রে তাঁর কথা শোনা, এইটুকুই! আমি শ্রোতা, মাঝেমধ্যে দু-একটি খেই ধরিয়ে দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছু কাজ ছিল না।
রইল সেই প্রায়-স্বগতোক্তির নির্যাসটুকু।
“আমার জীবনের কথা বলতে গেলে শুরু করতে হয় ফরিদপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম রাজবাড়ি (এখন জেলাশহর) থেকে। ওখানেই ১৯৪৩ সালে আমার জন্ম। প্রকৃতি সেখানে অবারিত। মাঠ খেত খাল বিল, সূর্যোদয় সূর্যাস্তের রঙে ভরা ছিল আমার শৈশব। বাড়ির কাছের একটি স্কুলে ভর্তি হয়ে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিলাম। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য আমার পরিবারকে নির্ভর করতে হত নিজেদের জমির ফসলের ওপর। পিতামহ ছিলেন আমার অভিভাবক, কারণ আমার বাবা ছয় সন্তানের জন্মের পর সংসার ত্যাগ করেছিলেন। বাঁচেনওনি বেশিদিন। আট বছর বয়সে আমি পিতৃহারা হই।
পড়াশোনার জন্য গ্রাম থেকে আমাকে শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বালকের পড়াশোনা তো দূরের কথা, বিন্দুমাত্র যত্ন-আত্তির ব্যবস্থা আমার মাসির বাড়িতে ছিল না। স্বরাট সম্রাটের মতো যখন যা খুশি তাই করে বেড়াতাম। সারাদিন শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতাম,নানা মানুষের সঙ্গে মেশা, খেলাধুলো করাতেই এত আনন্দ পেতাম যে পড়াশোনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। ফলে পরীক্ষায় ফেল করা অনিবার্য হয়ে উঠল।
ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণহলেন আমার ব্যক্তিত্বময়ী মা। তিনি ঠিক করলেন আমাকে কলকাতা গিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। চেতলায় আমার এক সম্পর্কিত ঠাকুমা থাকতেন, বাস্তুচ্যুত সেই পরিবারেই আমার ঠাঁই হয়, আমি স্কুলে ভর্তি হই।
এই অচেনা শহরে আমার না ছিল কোনো খেলার সাথী,না কোনো স্নেহার্দ্র মুখ। বুঝে গেলাম স্কুলে যাওয়া এবং মন দিয়ে পড়া করা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই। তবে অনেক অভাব থাকলেও মনে তেমন কষ্ট ছিল না। ঐটুকু ছেলের কাছে দেশ ছেড়ে চলে আসার কষ্টও তেমন মারাত্মক হয়ে ওঠেনি। অচেনা শহর, স্কুল, সহপাঠী, অচেনা পরিবেশ আমাকে মগ্ন করে রেখেছিল। এইভাবেই স্কুল ফাইনাল পাশ করি, কলেজে ভর্তি হয়। শুরু হয় আমার কবিতা লেখা।
কবিতার প্রতি কেন আকর্ষিত হই, এই যদি প্রশ্ন হয়, তাহলে একটি হাস্যকর প্রসঙ্গের অবতারণা করতে হয়। চেতলা স্কুলে এক সহপাঠী ছিল, সে কবিতা লিখত। তার লেখা ছোটদের পাততাড়িতে ছাপা হত। সেই সুবাদে গোটা স্কুলে তার প্রশংসা ছিল শোনবার মতো। আমার মনে হত, সহপাঠীটি তো আমার থেকে কোনোভাবেই বেশি মেধাসম্পন্ন নয়, তাহলে আমিই বা কেন কবিতা লিখতে পারব না! এছাড়া পাশের স্কুলে পড়াতেন কবি দিনেশ দাস। ওঁর কবিখ্যাতি তখনই ছড়িয়ে পড়েছিল। এইভাবেই হয়ত কবিতার বীজ আমার মস্তিষ্কে উপ্ত হয়।
স্কুল এবং কলেজ ম্যাগাজিনে আমার কবিতা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু পুরোদস্তুর কবি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া আলোচনায় এলে একটি কথা আমাকে বলতেই হবে, তা হল কলেজের আড্ডা। সমমনস্কদের সঙ্গে আড্ডার মধ্য দিয়ে আমি অনেক শিখেছি, ওইটিই আমাদের সব অনুপ্রেরণার ঘাঁটি। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গিয়েই একদিন আলাপ হল কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি তখন পত্রপত্রিকা করতেন। আমাদের অগ্রজ কবি, অনেক শিখিয়েছেন।"
"বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমার জীবনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর সঙ্গে খুবই অন্তরঙ্গতা ছিল। বীরেনদার সূত্রেই তাঁর পরিচিত পত্রিকাগুলিতে লেখার সুযোগ পেয়েছি। যেমন অরুণ ভট্টাচার্যের উত্তরসূরী বা কিরণ শংকর সেনগুপ্তের সাহিত্য চিন্তা পত্রিকা।
আপনি বলছেন, আমার কবিতায় সহজ সুন্দরের অধিষ্ঠান, যাকে অর্জন করা নাকি খুব কঠিন। আমি ঠিক জানি না, সত্যিই যদি এই সহজিয়া ভাব আমার অর্জন হয়ে থাকে, তা আমি কী করে পেলাম। খুব জটিল প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারি না। প্রথম দিকে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম কোনো জ্ঞান, বুদ্ধির বিশেষ চর্চা বা ট্রেনিং ছাড়াই। হয়ত একটা অভিমানের জায়গা ছিল জীবনে, কিন্তু ঐটুকুই। আস্তে আস্তে ছন্দ ভাব আয়ত্তে এসে যায়। আর ভাষার কথা যদি বলেন, আমাকে বলতেই হবে জীবনানন্দ দাশের কথা, যাঁকে পড়ার পর সচকিত হয়ে দেখলাম, একটা অনেক বড় গভীর পৃথিবীর আভাস ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। একটা অন্তহীন সময়ের পরিচয় পাচ্ছি যেন। আর তাঁর ভাষা! যেন দুকূল ভাসিয়ে নিয়ে যায়! এই প্রসঙ্গে তাঁর দুটো কবিতার কথা আমাকে বলতেই হবে।একটা হাওয়ার রাত, আর একটি হল অন্ধকার।
আমি অনেকদিন অবধি মূলত গদ্যছন্দে লিখতাম। গদ্যছন্দ কথাটা আমার নিজের খুব পছন্দ না হলেও এটাই ব্যবহার করছি, কিন্তু তাতে খুব গভীর কথা কী ভাবে বলব সে সম্বন্ধে খুব একটা পরিষ্কার ধারণা ছিল না। এই কবিতাদুটি পাঠ করে আমি যেন দিক নির্দেশ পাই। আমার লেখার মডেল হিসেবে এরা আমার অবচেতনে কোথাও কাজ করে গেছে এ আমি টের পাই। তারপর ছন্দের চর্চা প্রভাবিত হল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং পঞ্চাশের অন্যান্য বড় বড় কবিদের দ্বারা। তবে প্রকাশের সরলতা কখনও আমাকে ছেড়ে যায়নি। আমি খুব জটিলভাবে ভাবতেও পারি না।"
"আপনার মতো অনেকেই অবাক হন, যখন বলি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আমার প্রিয় কবি। আপনিও বলছেন, তাঁর সঙ্গে আমার মিল সামান্যই, মেজাজেও মেলে না। তাহলে কেন এই পছন্দ! আসলে একটা সময়ে নানা প্রখ্যাত কবির ওপর আমাকে প্রবন্ধ লিখতে হয়েছিল। তখন সুধীন্দ্রনাথকে আমি যেন নতুন ভাবে আবিষ্কার করি। তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর এই বৈশিষ্ট্য অন্য কারও চোখে ধরা পড়েছিল কিনা , আমার জানা নেই। মাইকেলের আত্মবিলাপ, মাইকেলের ট্র্যাজিক সেন্স, মানবিক নশ্বরতাজনিত হাহাকার,সব যেন নতুন করে খুঁজে পেয়েছি সুধীন্দ্রনাথের মধ্যে। এ ছাড়া “শাশ্বতী”র মতো কবিতার লেখক প্রেমিক সুধীন্দ্রনাথও আমাকে দীর্ঘকাল আলোড়িত করেছেন। বিষ্ণু দে-র জটিল চিন্তার প্রসারিত জগৎও আমাকে আকর্ষণ করত, কিন্তু সুধীন্দ্রনাথকে মনে হত নিঃসঙ্গ এক ব্যক্তিমানুষ, প্রেমিক কিন্তু বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা বা এলিয়েনেশন আধুনিকতার অন্যতম চিহ্ন।
পঞ্চাশের অন্যান্য কবিদের মধ্যে অলোকরঞ্জনের কবিতায় একটা ম্যাজিক ছিল, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিমোহিত করেছিলেন। আর একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত। আমার খুবই প্রিয় কবি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরও অনেক সাহসের জায়গা ছিল। শঙ্খ ঘোষের লেখা রহস্যময়। সবার কাছ থেকেই কিছু না কিছু শিখেছি। তবে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ওপর আমার ঐকান্তিক টান তাঁর সামাজিক বাস্তবতার প্রতি চির আনুগত্যের জন্যই নয়। তাঁকে আমি একজন বিশুদ্ধ আবেগের কবি বলেও মনে করি। যাই-ই লিখুন না কেন, এই আবেগের বিশুদ্ধতার জন্য তা স্মরণীয় হয়ে থেকেছে। এই জন্যই তিনি আমার কাছে একজন অনেক বড় কবি।
এখন যারা লিখছেন তাদের কার কবিতা ভালো লাগে, এ প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। কারণ সত্তরের পর কারা কেমন লিখছেন সে সম্বন্ধে আমি খুব বেশি ওয়াকিবহাল নই। তবে পড়ি কিছু কিছু, কবিতার সার্বিক চলন নজরে থাকে। এখানে যে কথা আমি খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, সেটা হচ্ছে মেয়েদের লেখা নিয়ে। আমাদের সময়ে যেমন দেবারতি, বিজয়া, এরা অসাধারণ লিখেছেন, তেমন পরবর্তী কালেও অনেকে খুব ভালো লিখেছেন। আমি লক্ষ করে দেখেছি, মেয়েদের লেখার বিশেষত্ব হচ্ছে তাঁদের সততা এবং আন্তরিকতা। পরিসংখ্যানগত ভাবেও দেখেছি দশজন মেয়ে লিখলে পাঁচজনই ভালো লেখেন, সেখানে দশজন পুরুষের মধ্যে বড় জোর তিন জন। এটা কেন হয় আমি জানি না, হয়ত নারীদের মধ্যে একটা আলাদা জাগরণের শক্তি, আলাদা সচেতনতা কাজ করে। তবে এ সবই আমার অনুমান। কিন্তু দেখেছি, অনেক মেয়েই খুবই ভালো লিখতে লিখতে হঠাত করে নারীবাদী ভূমিকায় চলে যান এবং মেয়েদের অবস্থান নিয়ে দ্রুত নৈতিক ভূমিকা নিয়ে ফেলেন। যে কোনো নৈতিক অবস্থান, আমার মতে, লেখার স্বাভাবিকতাকে ক্ষুণ্ণ করে।
বার বার জিজ্ঞাসা করছেন বলে কয়েকটি নাম বলছি, সুতপা সেনগুপ্ত, চৈতালি চট্টোপাধ্যায়ের কিছু কবিতা আমার প্রিয়। আর ইদানীং ভালো লাগছে বর্ণালী কোলে বলে একটি মেয়ের লেখা। মল্লিকা সেনগুপ্তের প্রথম জীবনের কবিতা উল্লেখযোগ্য। আসলে আমার মতে যে কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান কবিতার বিশুদ্ধতাকে নষ্ট করে। কবিতা বক্তব্যপ্রধান হয়ে যায়। আরও কিছু ভালোলাগা কবির নাম এই মুহূর্তে আমি মনে করতে পারছি না।"
"কারও জন্য কোনো উপদেশ বা পরামর্শ দেবার নেই আমার। তবু যদি একান্তই জোর করেন এইটুকু বলব যে একটা বড় বোধের জায়গা থেকে সরে এসে কিন্তু কবিতা লেখা যায় না। সেই বড় বোধ কী, সেটাও একটা প্রশ্ন। আমাদের প্রকৃত অবস্থান এক অন্তহীন সময়, কালোত্তীর্ণ স্থান-কালের মধ্যে, এই বৃহৎ প্রেক্ষাপটটিকে বোধের মধ্যে রাখতে হবে। সেখান থেকে সরে গিয়ে কেবল চমকপ্রদের দিকে ঝুঁকে পড়লে সে চমক টেঁকে না।”