পুজোর লেখার তাড়া তো রয়েইছে। তাই বলে তো আর হুমড়ি খেয়ে সবসময় লেখা যায় না, তাই লেখা, পড়া, সংসারের কাজ, প্রায়ই বিরাট দেশটার অলিগলি চিনে নেবার জন্য বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি, এইসবের ফাঁকে ফাঁকে খুব ভালো বই পেলে এখনও গোগ্রাসে পড়ে ফেলি। সেইরকম বইয়ের সংখ্যা দিন দিন আমার দেরাজে বর্ধমান! এবার আসানসোলে বসেই পড়ে নিলাম জয়া মিত্র-দির “স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন” আর তার পরেই একেবারে অন্য স্বাদের আর একটি, অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর “নয়নজোড়া কৌমুদী।”
জয়াদি তার রাজনৈতিক এবং সমাজসেবামূলক রাজকর্ম, অন্য ধারার সাহিত্যসৃষ্টি, ভূমধ্যসাগরের মতো একটি পত্রিকা চালানোর সুবাদে আমাদের সচেতনতায় একটি লেজেন্ডে পরিণত হয়েছেন। সেইসব নিয়ে তাঁর ব্যস্ততা সবসময় তুঙ্গে, তবু তার মধ্যেই যে এইরকম ব্যতিক্রমী উপন্যাস লেখার প্রেরণা, ধৈর্য ও তথ্য তিনি কীভাবে সংগ্রহ করেন, সে এক বিস্ময়!
সে এক সময় গেছে যখন জয়া মিত্রের হন্যমান, মীনাক্ষী সেনের জেলের ভেতর জেল পড়ে রাতের পর রাত বিবেক দংশনে ছটফট করেছি। ঘুমোতে পারিনি, তীব্র দহনজ্বালার মতো মনকে পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়াবহ রূপ! এঁদের এবং এঁদের লেখায় উঠে আসা আরও অনেক প্রতিবাদী নারীদেরকে শ্রদ্ধা করতাম একেবারে মনের ভেতর থেকে। স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন পড়তে গিয়ে দেখলাম সে শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার ওপর সময়ের পলি পড়েনি মোটেই। বরং এই দীর্ঘ সময় প্রবাহে জয়া মিত্র তার প্রতিবাদী এবং দরদী মনটিকে এমন অটুট রাখলেন কী করে সে রহস্য ভেদ করা সহজ নয় ! যা কিছু ঠিক বলে জেনেছি তার প্রতি শতকরা একশ ভাগ আনুগত্য, তাকে সাকার করার দুর্দম জেদই হয়ত শিরদাঁড়াকে এমন সোজা রাখতে সাহায্য করে!
স্বর্ণাভা একটি দলিত মেয়ে যে “দেবদাসী” এই প্রাচীন পেশার আড়ালে লুকিয়ে থাকা দেহব্যবসায়ে অংশ নিতে চায়নি। কারও ইচ্ছে হলে সে নিতেই পারে, কিন্তু স্বর্ণাভা তা চায়নি। সে তার মতো করে উত্তরণ চেয়েছিল, সাধারণ সুস্থ জীবন চেয়েছিল নিজের জন্য, তার মতো আরও ক্লিষ্ট মেয়েদের জন্য। আর তার জন্য তাকে মরতে হয়েছিল এক বীভৎস মৃত্যু।
না, না, এদের জন্য সরকারি সহানুভূতি নেই একথা ভাবলে চলবে না। খুব “আন্তরিকতা”র সঙ্গে সরকার চায় দেবদাসী প্রথা উঠিয়ে দিতে, শুধু পেরে ওঠে না প্রথা আর পরম্পরার সঙ্গে, এই যা! তার দায় সরকারের না পাবলিকের?
লেখক কী অনায়াস শব্দপ্রবাহে এই উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোকে চিহ্নিত করেছেন!
সরকার সিদ্ধান্ত নিল, এই পিছিয়ে পড়া মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবে। নিয়েও গেল দশদিনের ওয়ার্কশপে। কিন্তু সেখানে কি হল? “শেষ পর্যন্ত দশজন নয়, সাতজন মেয়ে আসে নাগহল্লি থেকে। কুস্তাগীতে একটা গলির মধ্যে একটা ছোট ঘুপচি ঘরে তাদের জায়গা হয়। পাটিলকে একবার বলেছিল ললিতাম্মা তাতে পাটিল দাঁত বার করে হেসে বলে —- তাতে কি! রাত জাগা তো তোদের অব্যেসেই আছে, পালা করে ঘুমুবি।”মেয়েগুলোর দিকে সবাই কিরকম করে যেন চায়! আড়ালে বা সামনেও ডেকে ওঠে “রান্ডিমুন্ডে”, মানে বেশ্যার বাচ্চা। কিন্তু স্বর্ণাভা বা সোনাব্বা ঠিকই করে নিয়েছে লেখাপড়া সে শিখবেই। তার জীবনের সবরকম হীনতাকে জয় করবার ঐ একমাত্র হাতিয়ার আছে তার আয়ুধে। কী দুর্মর আশায় সে মরে যাওয়া দিদির দুর্বল বাচ্চাটির নাম রেখেছে বিদ্যা। তার জেদের কাছে মাথা নুইয়ে এক সময় বিডিও অফিসে অঙ্গনওয়াড়ির চাকরিটা তার হয়েই যায়।
তারপর কি স্বর্ণাভার উত্তরণ হয় তার প্রার্থিত স্বর্গে? শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক আর সরকারি চক্করে তাকে যে মরতেই হবে, এ সিদ্ধান্ত নিল কে? দেবী ইয়েলাম্মা স্বয়ং ?
তেমন লেখকের হাতে পড়লে উপন্যাসটি রহস্যোপন্যাস হয়ে বুদ্ধিমানদের আনন্দ বিতরণ করতে পারত, মেলোড্রামা হয়ে ছিঁচকাদুনেদের গ্যালন গ্যালন চোখের জল ফেলতে সাহায্য করতে পারত। মেকি সমাজ সচেতনতার গালভারী বক্তৃতা হবার সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু কিছুই না হয়ে স্বর্ণকুমারীর জীবন ও মৃত্যু হয়ে ওঠে মানবিকতার এক দলিল, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লাগাতার কিন্তু একক লড়াইয়ের এক বাস্তব খতিয়ান! যারা শাইনিং ইন্ডিয়ায় বা বিদেশে ঝলমলে জীবন যাপন করেন তারা কতজন এই অন্ধকার ভারতবর্ষের খোঁজ রাখেন জানি না। এই দেশের পেটের ভেতরে যে আর এক অচেনা দেশ, যেখানে ক্ষুধা, বঞ্চনা আর বৈষম্যের পাশাপাশি চলে চরম পিতৃতান্ত্রিক নিপীড়ন, নারী যেখানে দলিতেরও দলিত, সেই ভুবনকে জানতে বুঝতে হলে স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন, যা কিনা একটি সত্য ঘটনার ওপর আধারিত, পড়ে ফেলা খুব জরুরি।
জয়া মিত্র-দির বইটি পড়ে ফেলার পরই যদি আপনি অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর “নয়নজোড়া কৌমুদী” নিয়ে বসেন, তাহলে এন্টিডোটের কাজ হবে। মরণপণ একটা লড়াইয়ের পর বেঁচেবর্তে ফিরে এসে প্রিয়মুখ দেখলে যেমন আনন্দ হয় তেমনটিই যেন। জীবন তার সহজ সরল আনন্দের ভাঁড়ার যেন হাট করে খুলে দিল এইমাত্র!
বইটিতে দুটি বড় গল্প আছে, প্রথমটির নাম জীব ও জীবনের বর্ণমালা। করোনা কালের গল্প, কিন্তু মৃত্যু বা বিচ্ছেদের নয়, বরং এসবকে উপচে যায় যে ভালবাসা, মানুষ আর মানুষীর মধ্যে সেই অমৃত-সম্পর্কের কাহিনি!
গল্পটি অনেকের জবানিতে খন্ডে খন্ডে ভাগ করা। নানা দিক থেকে চরিত্রগুলোর ওপর আলো এসে পড়েছে। একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষয়িষ্ণু কিন্তু অভিজাত পরিবারের সাম্যবাদে বিশ্বাসী এক ছেলের সঙ্গে বস্তিবাসী মেধাবী মেয়ের প্রেমের কাহিনি। এর খাঁজেখোঁজেও ওত পেতে বসে থাকে মৃত্যু, কিন্তু তার সাধ্য কী মানুষকে একা করে দেয়! শেষে সেই মেধাবী কন্যে খুঁজে পেয়ে যায় মৃত্যুকে জয় করবার রাস্তা, “আমার দ্বিতীয় লড়াইটা এবার শুরু হবে আয়ুষ্মান। তোমার ইমিউন সিস্টেমে যে জিনগুলি সাইটোকাইন ঝড় তুলে তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল, সেই জিনগুলোকে খুঁজে বের করব আমি। সেগুলোকে চিহ্নিত করে সারাই করবে যে ট্র্যাকার-জিন, আমি তার নাম দেব আয়ুষ্মান।”
দ্বিতীয় গল্পটির নাম “ভগবানের বিয়ে”। খুব সরস ভঙ্গিতে একটি মজার কাহিনি বুনেছেন লেখক, সরসতা তাঁর লেখনীর এক জবরদস্ত বৈশিষ্ট্য, যা বাংলাসাহিত্যে বেশ বিরলও বটে। পৃথ্বীশ আর দোলনের প্রেম-বিয়ে, ইলোপ করে বিয়ে, নানা প্রতিবন্ধকতায় ভরপুর তাদের পথ। কিন্তু কী আশ্চর্য, প্রত্যেকবার ভগবানের মতোই কেউ না কেউ অযাচিত ভাবে এসে তাদের পায়ে বেঁধা কাঁটা তুলে ফেলে দেয়।
“ মুক্তির সন্ধানে পৃথ্বীশ তার পুরনো হস্টেলের দিকে এগোচ্ছিল। রাস্তাতেই তার সঙ্গে দেখা। সাহেবদের মতো গায়ের রঙ…এক মাথা কোঁকড়ানো লাল চুল।…সে যেন পৃথ্বীশের পথ আগলে দাঁড়াল… পৃথ্বীশ তার হাসিটি দেখেই তাকে চিনে ফেলল, তার ভগবান। কিন্তু ভগবানকে কী বলে ডাকা যায়? প্রভু-টভু বলার মতো ভক্তি যে তার নেই। চোখ বুজল সে। আর বোজার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গেল একে বিশুদা বলে ডাকতে হবে।” সত্যিই বস্তির বারোয়ারি বাথরুম আর কলতলা থেকে তাকে আর বউকে বাঁচিয়ে দিল বিশুদা। “ভগবান পকেট থেকে চাবি বের করে খিড়কির ভাঙাচোরা দরজার তালা খুলল,... ভেতরে ঢুকে পৃথ্বীশ মুগ্ধ। বেশ বড় ঘর।একটা বিশাল খাট।তাতে গদিওয়ালা বাহারি বিছানা…ভগবান বলল, বউকে নিয়ে থাকব বলে ভাড়া নিয়েছিলাম ঘরটা। কিন্তু শাশুড়ির একটাই মেয়ে, ছাড়বে না তাকে,বউ-ও আসবে না।… ভগবানকে একটু যেন বিমর্ষ দেখাল। পরক্ষণেই তার সেই সুন্দর হাসিটি ঝলসে উঠল। বলল, পারলে আজকেই বউকে নিয়ে চলে এসো। যতদিন খুশি থাকো।… পৃথ্বীশ বুঝল তার সুবিধে হবে বলেই ভগবান বিয়ে করেছে। নইলে ভগবানের বিয়ে করার কী হেতু? কেউ কি কস্মিনকালে শুনেছে ভগবানের বিয়ের কথা?”
অর্দ্ধেন্দুবাবুর স্মৃতিগদ্যের আমি একনিষ্ঠ ভক্ত, কিন্তু নয়নজোড়া কৌমুদীতেও আমি মুগ্ধ হয়েছি। দুটি গল্পের একটিকে যদি পূর্ণতা দিয়েছে তার বিজ্ঞানচর্চা, অন্যটিকে তার উজ্জ্বল হাস্যরস। পাঠকের নয়ন জুড়ে থাকবার মতোই বই!
ছাপাখানার মুদ্রণ পারিপাট্য ও প্রচ্ছদের প্রশংসা এখন সবার মুখে শুনি। এই বইটিও ব্যতিক্রম নয়।