মণিপুরে দীর্ঘদিন যাবৎ যে আগুন জ্বলছে, তার পেছনে কারণ কী, এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত উঠে এসেছে। হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি থেকে পুরো ভাইরাল করে দেওয়া একটি পোস্টে বলা হয়েছে, কুকি এবং রোহিঙ্গারা নাকি ভাই ভাই, (ধর্মে যারা মুসলমান, তাদের কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে দিতেই হয়) তারা অন্যায়ভাবে মেইতেইদের (আইটি সেলের হাতে ‘মেইতেই’ মাইতি হয়েছে) তাড়িয়ে দিয়ে আফিম চাষ করে পাহাড় ভরিয়ে দিয়েছে। যে গির্জাগুলো পোড়ানো হয়েছে তাতে নাকি আফিম মজুত করা ছিল। আর এইবার এই আফিম চাষের পেছনে মদতদাতা স্বয়ং চীন। ফলে যা হচ্ছে তা ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে খুব ভালো হচ্ছে।
ড্রাগের সমস্যা উত্তরপূর্বের সমস্ত রাজ্যে অল্পবিস্তর আছে। এছাড়া পাঞ্জাবে আছে, কাশ্মিরেও। কিছুদিন আগে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী পোস্ত চাষের পক্ষে অনুকূল মত ব্যক্ত করেছিলেন। হঠাৎ করে মণিপুর কী দোষ করল যে সেখানে জাতিদাঙ্গা বাঁধিয়ে, অজস্র নিরপরাধ লোককে খুন করে পপি চাষের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে হবে! সরকার যদি চায়, ড্রাগপাচার বন্ধ করতে পারবে না, এটা অসম্ভব। আর চীনের জুজুতে ভয় দেখান এখন বেশ চালু ব্যাপার।
বোঝাই যায় বর্তমান শাসকের অনুগত জনেরা কাল্পনিক বয়ানটিকে কেন ভাইরাল করতে উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু আর একটি ব্যাপারও এটা থেকে স্পষ্ট, মণিপুরে রাষ্ট্র চুপ থেকে, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে হিংসাকে বাড়তে দিয়েছে। এর পেছনে প্রচ্ছন্ন রাষ্ট্রীয় মদত আছে। নাহলে এই হিংসাকে পবিত্র এবং যথাযথ হিংসা বলে দেখাবার এতো চেষ্টা কেন!
সরকার ভেবেছিল দেশের অন্যান্য অংশ থেকে মণিপুরকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রেখে সব খবর চেপে দেওয়া যাবে। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ রেখেও যখন একের পর এক ন্যক্কারজনক ঘটনার ভিডিও সামনে আসা বন্ধ করা যায়নি, তখন সর্বোচ্চ মহল অল্পস্বল্প নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে। তবে তা অতি অল্প, আজকের কাগজেও মহিলা কনেস্টবলের মৃত্যুর খবর আছে। এখনও প্রতি ৮ ঘণ্টায় ১ জন করে মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে বলে জানা গেছে এবং দেশের প্রশাসনিক প্রধান এখনও কোনো রা কাড়েননি, মণিপুর নিয়ে কোনো বিবৃতি দেননি।
যাই হোক হিংসার খবর মণিপুরের বাইরে আসা বন্ধ করা যায়নি। সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক বিরোধীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছে।
মোটামুটি যা বোঝা যাচ্ছে, একাধিক কারণ এই হিংসার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। প্রথমটি ধর্মীয় বিভাজনের ওপর পা রেখে নির্বাচনে জিতে আসার পুরনো ছক। মেইতেইরা বেশিরভাগ হিন্দু এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফলে তাদের হাতে ক্রিশ্চান কুকি এবং মুসলমান সংখ্যালঘুর জানমান তুলে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে থেকেছে গণতান্ত্রিক দেশের সরকার, যার কর্তব্য ছিল সংখ্যালঘুকে চোখের মণির মতো রক্ষা করা। মেইতেইদের মধ্যে যারা বিবেকবান, তারা এই হিংসার নিন্দায় মুখর হলেও, সব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবেকহীন মানুষজন থাকে, আর তাদের হাতে যখন ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়,তখন যা ঘটে, মণিপুরেও তাই ঘটেছে। দেশভাগের সময় যে বর্বরতার সাক্ষী হয়েছিলাম আমরা, সংখ্যার নিরিখে তারই একটি ছোট সংস্করণ অভিনীত হয়ে চলেছে মণিপুরে। হাজার হাজার মানুষ শরণার্থী শিবিরে, তারা নিজ ভূমে পরবাসী। নিরপরাধ মানুষের লাশ পড়ে রয়েছে যত্রতত্র, মেয়েদের চরম অসম্মান করা হচ্ছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে শ’য়ে শ’য়ে উপাসনালয়। আর গ্রামে তো বটেই, ইম্ফলের রাস্তাতেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শাসকের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা। তারা আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত। বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলেই এক মেইতেই মা ও কুকি পিতার আট বছরের সন্তানকে মা ও আরো একজন মেইতেই প্রতিবেশীসহ এম্বুলেন্সে জীবন্ত জ্বালিয়ে দিতে তাদের হাত কাঁপে না। কেউ প্রশ্ন করে না দগ্ধ শিশুটি কোন জাতের ছিল, মেইতেই না কুকি!
অনেকের সন্দেহ মণিপুরের পর্বতাঞ্চলে যে মূল্যবান খনিজের সন্ধান পাওয়া গেছে তা কর্পোরেটের হাতে তুলে দেবার কারণেই দাঙ্গা লাগিয়ে ঘরছাড়া করা হচ্ছে ঐ অঞ্চলের অধিবাসীদের। এই সন্দেহ একেবারেই অমূলক নয়, গত ৫ই জানুয়ারি,২০২২ এ মণিপুর সরকারি গেজেটে প্রকাশ হয় মণিপুর মিনেরাল পলিসি, যাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে ব্যক্তি মালিকানাকে এখন থেকে উৎসাহ দেওয়া হবে মাইনিং সংক্রান্ত ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্য (সূত্র ইকনমিক টাইমস, ২৩ জুলাই, ২০২৩)।সোজাসুজি বললে, কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হবে খনিজ পদার্থ লুণ্ঠনের একচেটিয়া অধিকার।
ব্যাপার এখানেই শেষ নয়, কুকিদের একাংশ দাবি করছে যে কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুরের ৬টি জেলার ৬৭ হাজার হেক্টর জমি পাম তেল উৎপাদনের জন্য চিহ্নিত করেছে। বিজেপি সরকারের পেটোয়া শিল্পপতিদের হাতে ঐ জমি যাতে বিনা বাধায় তুলে দেওয়া যায়, সেজন্য দাঙ্গা লাগিয়ে আগে থাকতেই জনজাতিদের হটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই অভিযোগও যে অমূলক নয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই প্রসঙ্গে রাজ্য সরকারের পরস্পরবিরোধী বয়ান। মণিপুরের তথ্য কমিশনার এই অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও গুয়াহাটিতে খুব সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উত্তরপূর্বাঞ্চলের পাম চাষ সম্পর্কিত আলোচনায় হাজির মণিপুরের কৃষি অধিকর্তা ও রাজ্য পাম অয়েল মিশনের উপদেষ্টাকে সামনে রেখে গোদরেজ কম্পানি জানিয়েছে, গত বছরই মোট ৭টি জেলায় পাম চাষের জন্য সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে। সংখ্যালঘু কুকি অধ্যুষিত চুড়াচাঁদপুর তাদের মধ্যে একটি (সূত্র, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩শে জুলাই। ২০২৩)। অন্তর্জালে ঘুরে বেড়ানো একটি ভিডিওর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় পাম বীজের চাষে পরিবেশ প্রতিবেশ উজাড় হয়ে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও অতিকায় জেসিপির বিরুদ্ধে লড়াই করতে এগিয়ে এসেছিল সর্বস্ব হারানো এক নিঃসঙ্গ ওরাংওটাং। ঐরকম ট্রাজিক দৃশ্য কমই চোখে পড়ে। মণিপুরের সবুজ পাহাড় ও বনাঞ্চলের রুক্ষ উর্বরতাহীন মরুভূমিতে পর্যবসিত হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। লড়াই দেবে কে? যারা দিতে পারত, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার নানা কৌশলের মধ্যে এই ভয়াবহ জাতিদাঙ্গাও একটি।
মণিপুর-হিংসার পেছনে কারণ যাই-ই হোক না কেন, তার ব্যাপ্তি এবং প্রভাব আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে ফেলে, মরমে মরে যাই আমরা। সব হিসেবনিকেশকে ভুল প্রমাণিত করা এই হিংসা যেন তছনছ করে দিয়েছে লিঙ্গ, শ্রেণি, নৃতত্ত্ব এবং রাজনীতির সমস্ত চেনা ছককে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিচিত্রটি নিয়ে কিছু আলোচনা থাক এইখানে।
মণিপুরী সমাজে মেয়েদের ভূমিকা খুব শক্তপোক্ত, এই প্রমাণ আমরা বার বার পেয়েছি। প্রতিবাদী ভূমিকায় তাদের প্রবল সাহস আমাদের উৎসাহী করেছে। শর্মিলা চানুর আমরণ অনশনের প্রতিজ্ঞা, ইন্ডিয়ান আর্মিকে নগ্ন মায়েদের ধর্ষণ করবার আহবান, আমাদের আমূল কাঁপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এবার যা ঘটেছে বলে দেশ বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, তাতে দেখা যাচ্ছে এই জাতিদাঙ্গায় অংশগ্রহণকারী কিছুসংখ্যক মহিলা, অত্যাচারিত নয়, অত্যাচারীর ভূমিকাতেও অবতীর্ণ। মেইতেই মেয়েরা কুকি মেয়েদের ধর্ষণে উৎসাহ দিচ্ছে, ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে সংখ্যালঘুর, এইরকম বয়ান থেকে থেকেই উঠে আসছে অত্যাচারিতদের মধ্য থেকে। এমনকি মাইরা পাইবিস বা মণিপুরী অগ্নিকন্যারা, যারা সুশীল সমাজের অভিভাবক রূপে স্বীকৃত এবং নারীদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে সদা সতর্ক, তারাও নাকি এই অভিযোগে অভিযুক্ত। হিংসার একেবারে প্রথমদিকে ঘটা দুই কুকি নারীর লাঞ্ছনার যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে তাতে কিছু গর্জমান উৎসাহদাতা নারীকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। সেগুলি ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী মেইতেই রমণীদের, এই অভিযোগ এসেছে। ৫ই মে মেয়েদুটিকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়। যারা পালিয়ে বেঁচেছে তারা নানা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে মাইরা পাইবিসের সভ্যারা উপজাতীয় পরিবারগুলির রাস্তা আটকে দেয়, যাতে হামলাকারীরা তাদের ধরে ফেলতে পারে। তারপর চলে নারকীয় গণহত্যা। ২০ শে জুন মাইরা পাইবিস রাস্তা আটকে ইউনিটেড লিবারেশনের ধরা পড়া চার অস্ত্রসজ্জিত যুবককে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ২৪ শে জুনও ইম্ফলে প্রায় ১২০০ মাইরা পাইবিস সভ্যা রাস্তা আটকে অভিযুক্ত ছিনতাইয়ের একই ঘটনা ঘটায়।
তবে একথা ঠিক যে মাইরা পাইবিসের মেয়েরা নারী লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে পরে মানব বন্ধনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়। তাতে এনআরসির সপক্ষে স্লোগান দেওয়া হয়, কারণ সংখ্যাগুরু মেইতেই রমণীরা তাদের মাতৃভূমিতে অন্য কাউকে থাকতে দিতে রাজি নয়। তবে নগ্ন করে কুকি রমণীদের হাঁটানোর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর, অভিযুক্তদের বাড়ি ভেঙে দেওয়ার কাজটি করেছে মাইরা পাইবিসরা। কাজটি আইনানুগ কিনা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কিন্তু মেয়েদের লাঞ্ছনায় তারা যে ফেটে পড়েছে, এইটাতে তাদের হৃতগৌরবের কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার হয়।
হিংসা কোনো আদর্শের ধার ধারে না। আদর্শে বিশ্বস্ত থাকতেও দেয় না। লিঙ্গসত্ত্বা আর জাতিসত্ত্বার এই দ্বন্দ্বে মণিপুরের সাহসী মেয়েরাও ভুগছে, ব্যালান্স করবার চেষ্টা করছে, তাদের বিদ্রোহী ভাবমূর্তিতে নানা সন্দেহ আর অভিযোগের কালির ছিটে পড়ছে। রাজ্যে শান্তি স্থাপনের প্রয়াসে তাদেরকে সবচেয়ে বড় অন্তরায় বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে।
আশা করি আগের বহু সংগ্রামের মতো এই মহাসংগ্রামেও মণিপুরী মেয়েরা জয়যুক্ত হবেন।