কলকাতার মানুষজনেরা এইসবের হুজ্জোতির খবর রাখে না। তাদের মন ভুলোবার হরেক চিজ আছে। এইরকম ঝামেলাওয়ালা জায়গায় দুদিনের ছুটি কাটাতেও কেউ আসে না, যতই জাগ্রত তীর্থস্থান হোক না কেন!
এটা একেবারেই সীমান্ত-এলাকা, কাঁটা তারের এ পাশে লাল নিশান ওড়া ভ্রামরী দেবীর মন্দির, খুব জাগ্রত জ্যান্ত তীর্থ, ওপাশে সবুজ মাথাওয়ালা গম্বুজ, সোনা পীরের থান। মানত রাখলে নাকি কেউ খালি হাতে ফেরে না। দুপাশেই যতদূর চোখ যায় সবুজ খেত, যার বুক চিরে দৌড়ে চলে গেছে মানুষ সমান কাঁটাতার। ছুঁচলো কাঁটা, খুব শক্ত তার, আর দবেজ। সেই ছুটন্ত তারের লাইন বরাবর রাতবিরেতে বুটজুতোর মসমস, সন্দেহ জাগলেই ঘন ঘন হুইসিলের আওয়াজ। তবে তাতে কী আর কিছু বন্ধ থাকে! যার যা করার সে তাই করে যায়, কাজের মতো কাজকাম চলে, নদীর মতো নদী বহে যায়। শুধু মাঝেমধ্যে কাঁটাতারের এপাশে ওপাশে আচমকা দুম শব্দের সঙ্গে লাশ পড়ে। চাপা আর্তনাদ, দৌড়োদৌড়ির শব্দ। তারপর সব চুপচাপ।
অবশ্য দুপারের গ্রামের মানুষের এখন সবই সয়ে গেছে। সবাই ভাগ্যের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়েছে। তবুও এপারের মানুষকে কেউ গ্রামের নাম জিজ্ঞাসা করলে তারা একটু ঢোঁক গিলে বলে, তাদের নদীর নাম জলেশ্বর, গ্রামের নাম মধুগঞ্জ।
নদীর নামটি আগে বলে, কারণ নামটি বড় সুন্দর, বিশ্বের প্রভু দেবাদিদেব মহেশ্বরের আর এক নাম, ধার্মিক মানুষজন কানে শুনেই বড় আরাম পায়। তাছাড়া এই নদীর বোরোলি মাছ খুব সুস্বাদু আর সেই কারণে বিখ্যাত। স্বচ্ছ ঢেউয়ের নীচে বোরোলিরা ঝাঁক বেঁধে চলে, সরু রূপোর পাতের মতো শরীর, জমাট আলোর ছোট ছোট টুকরো যেন জলের ওপর লাফিয়ে ওঠে। সাধারণ হাত-জালেই দেদার উঠে পড়ে তারা। ধরার জন্য বেশি কষ্টও করতে হয় না।
গ্রামের নামটিও তো বড় সুন্দর, মধুগঞ্জ, একেবারে সামনের দুটি অক্ষরেই মধুভান্ড উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু মানুষের কন্ঠায় বিস্তর ঠেলাঠেলি করেও সে নামটি আবছা হয়ে বেরোয়, নদীর নামের পরে বেরোয়, কারণ মধুগঞ্জ এখন গরু পাচারের পীঠস্থান। এমনই দুর্নাম তার, যে লোকে ভুলেই গেছে এক কালে ভ্রামরী মন্দিরের খ্যাতিতেই তার খ্যাতি ছিল, পুজো দিতে দূরদূরান্ত থেকে লোক আসত। এখনও একেবারে আসে না এমন নয়।
মন্দিরের ভেতর কালো কষ্টি পাথরের ভ্রামরী দেবীর দেড় হাত লম্বা সর্বাঙ্গে মৌমাছি আটকে আছে। পাথরে খোদাই ছোট ছোট উড়ন্ত কীট। কারিগরের কী হাতযশ, এতো যুগ ধরে দেবীপ্রতিমার গায়ে এন্তার তেল সিঁদুর মাখাবার পরও, তাদের ডানার খাঁজখোঁজগুলো কেমন স্পষ্ট বোঝা যায়! ওরা সবাই ভ্রামরী দেবীর পোষ্য। বাস্তবেও যেখানে যতো মৌমাছি, সব্বার ভালোমন্দের জিম্মেদার দেবী স্বয়ং। দেবীর মহিমা অশেষ। নাহলে কী আর এমনি এমনি মন্দিরের সামনে দুখানা রয়েল গাছ দুপাশে উঠে গেছে আকাশের দিকে, সিধে উঠতে উঠতে এক আশ্চর্য টানে ঝুঁকে পড়েছে পরস্পরের দিকে ! শাখাপ্রশাখায় ঠোকাঠুকি হয়ে দুই গাছের মাথা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে কতো যুগ ধরে কে জানে। থোকা থোকা সবুজ টক ফলে ভরে থাকা গাছদুটোকে দিবাকর তো জন্ম থেকেই অমন দেখছে। দুই গাছের গুঁড়ি তেরছা হয়ে থাকার ফলে তৈরি হয়েছে এক অতিকায় ত্রিভুজ, যেন প্রকৃতির নিজের হাতে বানানো তোরণ, ভ্রামরী দেবীর জন্য।
আশ্চর্য হবার শেষ তো এইখানে নয়। ঐ রয়েল গাছদুটির প্রায় প্রত্যেক ডাল থেকে ঝুলছে আধখানা কলাপাতার মতো বড় বড় মৌচাক। এতো ঘন ঘন এতো চাক, তাদের ঘিরে মৌমাছিদের ব্যস্ত যাওয়া-আসা, গুনগুন গুঞ্জনে মন্দিরের চাতাল দিনেরাতে মুখর হয়ে থাকে। এ ডাল থেকে সে ডালে, দুটো গাছেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাসা বাঁধে শ্রমিক মৌমাছিরা, মধু এনে জমা করে, তাদের পায়ে জড়ানো হলুদ পরাগও নাকি সদ্যোজাত শিশুগুলির খাদ্য। চাকের অনেক গভীরে ছ' কোণা কোন গুপ্ত প্রকোষ্ঠে পুরুষ মৌমাছির সঙ্গে মিলিত হবার অপেক্ষায় জেগে থাকে পৃথুলা রানিমৌমাছি, তার জীবন কেটে যায় বেশি খেয়ে, বেশি পুষ্টি সঞ্চয় ক'রে অগুন্তি সন্তানের জন্ম দিতে দিতে। নিজের শিশুদের যত্নও সে নেয় না, প্রকৃতির কী যে রহস্য, নিষ্কর্মা আজ্ঞাবহ পুরুষদের সঙ্গে আকাশপথে উড়ানের সময় চূড়ান্ত মিলনের জন্যই তার সমস্ত পথ-চাওয়া। প্রায় রোজই দেখা যায় কোনো এক চাক থেকে বেরিয়ে এসেছে মোটাসোটা রানি মৌমাছি, রয়াল গাছের মাথার ওপর তার স্লথ গতি। আর পেছন পেছন ছুটে বেড়াচ্ছে পুরুষ মৌমাছির দল। তাদের মধ্যে একটিই লক্ষ্যভেদে সক্ষম হবে, নিষিক্ত রানিটি শান্ত হয়ে ফিরে আসবে প্রকোষ্ঠে। সন্তানের জন্ম দেবার ধীর অপেক্ষা শুরু হবে। এই যে জীবনপ্রবাহের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে প্রত্যেক চাকের প্রতিটি প্রকোষ্ঠে, বাইরে ঐ গুঞ্জনটুকু ছাড়া কিন্তু তার আর কোনো প্রকাশ নেই, বাতাসে একটি অতিরিক্ত ঢেউয়ের কাঁপনও ওঠে না যেন। একটি মানুষও ফিরে তাকায় না। দু দুটো সমান্তরাল যাপন ধর্মাচরণের সুতোয় খুব পোক্ত ভাবে বাঁধা রয়েছে। দু পক্ষেরই সায় আছে এই সহাবস্থানে।
আরও আশ্চর্য, মানুষের লোভের শেষ নেই, তবু ভ্রামরী দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণের মৌমাছিরা অবধ্য। শুধু মন্দিরে নয়, গোটা মধুগঞ্জ গ্রামেই কেউ মৌচাক ভাঙে না, কেউ মধু আহরণ করে না। এখানে বোতলে করে মধু কেনাবেচাও নিষিদ্ধ । সর্দিকাশি বা হালকা জ্বরে মধু দিয়ে তুলসি পাতার রস খেতে হলে বা শীতকালে বুড়ো মানুষের জন্য মকরধ্বজের পুরিয়া মধু দিয়ে মেড়ে নিতে হলে, সদর থেকে মধুর বোতল ব্যাগে লুকিয়ে আনতে হবে। তারপর সবচেয়ে নিরিবিলি জায়গায় সেটিকে সংরক্ষণ করাই নিয়ম। বোতল থেকে মধু ঢালতে হবে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে। মোদ্দা কথা, ভ্রামরী দেবী যেন না দেখেন, তাঁর সন্তানদের তিল তিল করে সংগ্রহ করা অমৃতরস, মানুষ লুটে নিয়ে নিজের কাজে লাগাচ্ছে। তাই মন্দির চত্বরে তো বটেই, মধুগঞ্জের কোথাও মৌচাক ভেঙে মধু নেওয়া হয়েছে, এরকম শোনা যায় না। কখনও কেউ অতি লোভে যদি করেও ফেলে, পরের একমাস জুড়ে গঞ্জ তো গঞ্জ, গোটা জেলাশহরে যেখানে যতো বিপদ ঘটে, তার প্রত্যেকটির কারণ বলে চিহ্নিত করা হয় ঘটনাটিকে। তারপর আস্তে আস্তে সেই স্মৃতি ফিকে হয়ে আসতে থাকে যতদিন না ফের বেপরোয়া মধু লুঠেরারা হানা দেয়।
মধুগঞ্জের মৌমাছি আর মানুষেরা কেউ কাউকে ঘাঁটায় না। অনেক যুগ ধরে পারস্পরিক সহাবস্থানের মন্ত্র শিখে নিয়েছে দু পক্ষই। দিবাকর সাইকেলে চড়ে স্কুলে যেতে যেতে এইসব ভাবে। ভাবতে ভাবতে দেবীমন্দিরকে পেছনে ফেলে জলেশ্বর নদীর দিকে বেঁকে যায়। এদিকে কাঁটাতার নেই, কারণ ওদিক থেকে নাচতে নাচতে আসা নদীটি এখানে এসে ইংরেজি ইউ বর্ণের আকার নিয়েছে এবং একটি প্রাকৃতিক সীমানা-চিহ্ন হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে। জলভরা এই ইংরেজি ইউ অক্ষরের চ্যাপ্টা তলার দিকে বা দুই বাহুর ধারে ওপাশটা বাংলাদেশ, এপাশটা ভারত, যা আবার ওপাশে মুখে মুখে ইন্ডিয়া। ঐ ইউ-টুকুই ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত, নাহলে বাদবাকি নদী বিদেশী, যে বিদেশ আবার এককালে এদেশের বহু মানুষের স্বদেশ ছিল। এ এক জটিল ধাঁধা, এইসব ভাবতে ভাবতে, নাকি রোদের তাতে, মাথা ধরে যায় সাইকেল আরোহী দিবাকরের। কিন্তু যেতে তো তাকে হবেই। স্কুল তার প্রাথমিক হলেও নদীর খামখেয়ালি মোচড়ে এই গঞ্জে একমাত্র, তাই গুরুত্বপূর্ণও। কো-এড হাই স্কুল আছে বটে মাইল চারেক দূরে, ছেলেমেয়েরা সেখানে ভর্তিও হয়। তবে কোভিডের পর স্কুলছুটের সংখ্যা খুব বেড়েছে। মেয়েরা বেশির ভাগ বিয়ে করবে বলে একঘেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে, নয়তো তাদের রূপশ্রীর টাকা পেয়ে অথবা না পেয়ে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কড়ার এই, স্কুলে টাকা এলে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অনেক ছেলে কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে গেছে, অবরে সবরে বাড়ি আসে, আবার অনেক ছেলে ঘরের খেয়ে গোরু পাচারে হাত লাগিয়েছে। এ লাইনে ঝুঁকি থাকলেও, পয়সা অঢেল। তাই লোভও বেশি।
কিন্তু তাই বলে টাপু! অঙ্কে অমন ভালো মাথা, দিবাকরের শিক্ষক জীবনে আর চোখে পড়েছে কি? আর কী ভদ্র ছেলে! যে কোনও দিন, দিবাকরকে গোরুহাটার পাশ দিয়ে যেতে দেখলে টাপু সঙ্গে সঙ্গে গেঁজের টাকা গোণা বন্ধ করে হাতদুটো পেছনে নিয়ে যায়, বলে, "স্যার, ভালো আছেন?" টাকা পয়সা আঙুল গলে পড়ে গেল কিনা সেদিকে মন দেবে কী, মাস্টারমশাইয়ের পা ছোঁয়ার জন্য সে ব্যাকুল!
সেদিন সদ্য শোনা একটি কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল বলে তাকে হঠাতই ডাকে দিবাকর, "ট্যাঁপা, এদিক আয় তো একটু। চল ঐখানে গিয়া বসি।"
গোরুহাটা যেখানে শেষ, সেইখানে সীমানা আগলে অজস্র ঝুরি নামিয়েছে প্রাচীন বট, তার গুঁড়িতে ছুরি দিয়ে খোদাই করা ছেলেমেয়েদের নাম, সব জোড়া জোড়া, পাশাপাশি, মাঝে যোগচিহ্নের সেতু বাঁধা। নীচে সিঁদুর মাখা ছোট বড় পাথর। তেল গড়িয়ে পড়ছে। ধূপকাঠি জ্বলছে। ধূপের গন্ধমাখা সেই ছায়াতে গিয়ে বসল মাস্টার আর তার একদা ছাত্র। বসেই টাপুকে ধমক, "অমন ছটফট ছটফট করতেছিস ক্যান? হাগা পাইসে নাকি?"
এমন অসংস্কৃত প্রশ্ন শিক্ষকের মুখে মানানসই কিনা, ছাত্র সেটাকে সঙ্গত ভাববে কিনা, এইরকম ভাবনা ভ্রামরী দেবীর কৃপায় মধুগঞ্জে কারও নেই। মানুষ ঐ বেগের কাছে সবচেয়ে বেশি অসহায়, তখনই সে সবচেয়ে বেশি ছটফট করে, একথা তো দিনের আলোর মতো সত্যি। তাই এর থেকে ভালো তুলনা আর কী হতে পারে ! টাপু প্রথমে উত্তর দেয় না। তারপর চোখ তুলে মাথার ওপরে সবুজ পাতার চাঁদোয়া দেখে, যেন নিজের নয়, কাকপক্ষীর বিষ্ঠাত্যাগের সম্ভাবনায় সে বিচলিত। শেষকালে আস্তে বলে, স্যার, আপনে তো জানেন সবই, তবু বার বার …!
টাপু স্যারকে খুলে বলেছে, তার অসহায়তার কথা, পরিস্থিতির চাপের কথা, তবু মাস্টার বার বার তাকে কেন যে বোঝাতে আসে ! বুঝতে চায় না, এই কাজগুলো উঁচু নদীর ঢাল থেকে খেলাচ্ছলে জলের দিকে গড়িয়ে যাবার মতো। ঠান্ডা কালো জলকে যতো ভয়ই লাগুক, মাঝ রাস্তায় উল্টো বাগে উঠে আসা যায় না। শেষ সীমা অব্দি গড়িয়ে যেতেই হবে, তারপর জল তোমাকে ভিজিয়েই দিল যখন, আর কাপড় রোদে শুকোবার চেষ্টা করে কী হবে! প্রথম বারেই ভয় কেটে যায়, তারপর ভেজা কাপড়েই সারাদিনের খেলা। সারা জীবনের খেলা। যদি না বেঘোরে জীবনটাই চলে যায়।
জীবন চলে যাবে, এই ভয় তো প্রতি মূহুর্তের। গভীর রাতে যতটা পারা যায় নি:শব্দে গরুহাটা থেকে লেজ মুচড়ে প্রাণীগুলোর যাত্রা শুরু করিয়ে দেওয়া হয়, অন্ধকার শুঁড়িপথ দিয়ে পালে পালে তারা নদীর কাছাকাছি এসে পড়ে। অনেক দূর দেশ থেকে ট্রাকে ট্রাকে লম্বা পাড়ি দেওয়া জানোয়ারগুলো ক্ষিধে, তৃষ্ণা, পথশ্রমের ধকল সইতে সইতে রোগা হয়ে যায়। শরীরে পুরো তাকত থাকে না, তাই এদিক ওদিক ছোটার কোনো চেষ্টা না করে, তারা শুধু সামনের জাতভাইকে অনুসরণ করতে থাকে অন্ধের মতো। যেন অর্ধচেতন জড়ভরত-প্রায় বিশাল মাংসপুঞ্জ এক। দেশের সীমানা পেরলেই যে পুঞ্জের প্রত্যেকটির মাথাপিছু লাভের অঙ্ক বেড়ে দাঁড়াবে আট থেকে দশ হাজার টাকা।
নদীর কাছে এসে ঠান্ডা হাওয়া আর মিঠে জলের গন্ধে এইবার গোরুগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু ডাকতে পারে না, মুখগুলো সব দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। টাপু আর অন্য রাখালরা গজগজ করে, "এইমাত্র গরুহাটায় জল খাওয়াইসি, দানা খাওয়াইসি, তবু শালাদের নোলা দ্যাখ! বেইমানেরও বেইমান! দাঁড়া, দাঁড়া, দাঁড়ায়া পড় এইখানে।"
তারা প্রাণীগুলোকে এইবার বালির চরে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করায়। সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান গরু আর বলদগুলোকে আলাদা করে রেখে, যেগুলোর কপাল জুড়ে আলকাতরা দিয়ে বিশেষ চিহ্ন আঁকা তাদের লেজ মুচড়ে জলে নামিয়ে দেয়। পাচনের বাড়ি মারে, হ্যাট হ্যাট। অবোধ প্রাণীগুলি প্রাণভয়ে সাঁতরায়, যাতে তাদের কেউ এদিক ওদিক ছিটকে না যায় তাই পাশে পাশে সাঁতরায় রাখালরা। ওপাশের উঁচু নদীর ঘাটে জোনাকির মতো ছোট ছোট টর্চ জ্বলে উঠেই নিভে যায়। ওপারের রাখালরা প্রাণিগুলিকে নদী পার করাবে বলে অপেক্ষা করছে। কপালের ওপর টর্চ ফেলে চিহ্ন দেখে কোন ব্যবসায়ীর কোন পাল তা ঠিক করে সোজা খোয়াড়ে পাঠিয়ে দেবে।
টাপু জানে, বখেরার পরিমাণে একটু বেশিকম হলেই যে কোনো মূহুর্তে গরম সীসার টুকরো গেঁথে যেতে পারে তার পাঁজরে। বা তার সঙ্গীসাথীদের। তবু সুরাতের ঘুপচি ঘরে ঘাড় হেঁট করে বারো ঘন্টার জরি সেলাই বা চিমটে দিয়ে গয়নার ছাঁচে আমেরিকান ডায়মন্ড বসাবার কাজ তাকে টানেনি। কেরালায় কন্সট্রাকশন লেবার হয়ে যেতে পারা তো মন্দের ভালো। ওরা ভালো টাকা দেয়, মানুষের মতো ব্যবহার করে, একপাল গরু ভাবে না। তবু টাপুর অঙ্ক-বোঝা সাফ মাথা অনেক টাকার হিসেব ক্যালকুলেটর ছাড়াই নির্ভুল মিলিয়ে দিয়ে যে উত্তেজনা বোধ করে, তা গরু পাচার ছাড়া আর কোনো কাজে সে পায়নি। পুলিশের পকেট, বিএসএফের পকেট, নেতাদের ব্যাঙ্ক একাউন্ট সব ভরেও তারপর নিজের রাখালদের জন্য শতকরা কতো লাভ হল, নিজে ঘরে কতো নিয়ে যেতে পারল, নিখুঁত সেই অঙ্ক কষে ফেলে টাপুর এমন আনন্দ হয়, যে সারা গায়ে লোমকাঁটা ফুটে ওঠে। গরীবের ছেলে তো সে বটেই। বাবা নেই। মা পরের বাড়ি বাসন মেজে ছেলেকে বড় করে তুলেছে। কিন্তু সেটাই সব নয়, এই কাজের আঙ্কিক নির্ভুলতা, ভুল হলে বিশাল বিপদের ঝুঁকি, বিপুল লাভের পরিমাণ, তাকে কঠিন উত্তর মেলাবার জন্য ক্রমাগত উত্যক্ত করতে থাকে। কিছুদিন দূরে থাকার পর আবার সে বুক বাজিয়ে ফিরে আসে গরু পাচারে।
"তা স্বাস্থ্যবান গরুগুলারে আলাদা কইরা কী করিস?" দিবাকর অন্যমনস্ক ছাত্রকে খোঁচায়, "আলাদাই বা করিস ক্যান?"
এই মানুষটাকে টাপু বিশ্বাস করে সব কথা বলতে চায়। তাতে যেন তার খারাপ কাজের প্রায়শ্চিত্ত হবে, এইভাবে অপরাধী চোখ নীচু করে সে বলে, "বলি স্যার, বলি, কাউরে কইবেন না যেন।" তারপর অনর্গল উজাড় করে দিতে থাকে তার ব্যবসার গোপন কথা।
এই বাছাই গরুগুলো অন্য পাচার হওয়া গরুদের মতো অসুস্থ বা বুড়ো নয়। বিয়োনো বা চাষবাসে সাহায্য করার ক্ষমতা হারানোও নয়। হয়ত দালাল বেশি লাভের আশায় তাদের কিনেছিল, কিম্বা গ্রামের গেরস্তবাড়ির গোয়াল ঘর থেকেই উঠিয়ে নিয়ে এসেছে রাতের অন্ধকারে। গরুচোরেরা সব রাজ্যের সীমান্ত বরাবর প্রত্যেকটি গ্রামে ভয়ংকর সংগঠিত এবং সক্রিয়। এই পশুগুলি স্বাস্থ্যবান, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, নরম তাজা মাংসল ভীরু প্রাণী, সীমান্ত পেরুলেই একেকটার দাম ওঠে দেড় লাখ, দুলাখ। তাই এদের জন্য সুপার স্পেশালিটি ব্যবস্থা। প্রথমে এদের প্রত্যেকের শিঙ-এ নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা হবে প্লাস্টিক-মোড়া অল্প দামের চাইনিজ মোবাইল। তাতে সেভ করা থাকবে আলাদা আলাদা রিং টোনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ওপারের ব্যবসায়ীদের আলাদা আলাদা নম্বর। জলে নামানোর পর এদের দেহের চারদিকে বেড় দেওয়া হবে মোটা সবুজ কলাগাছ দিয়ে, যেন চৌকো ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে দু/তিন লাখি মালগুলোকে। ওপারের রাখালরা কোমর জলে নেমেই থাকে, ভেলাগুলো কাছাকাছি এসে গেছে দেখলেই তারা মোবাইলে রিং করে। অন্ধকার নদীর ওপর ভাসমান শিঙ-এর মাথায় মাথায় আলো জ্বলে, হরেক গান বাজে। নির্দিষ্ট সুর শুনে পয়সার মাল ঠিকঠাক চিনে নিতে বড় সুবিধে হয়। একবার অন্ধকার ঢেউয়ের মাথায় টাপু পাশের গরুর শিং-এ বাঁধা মোবাইলের রিং টোন শুনে ফেলেছিল, তু ধার হ্যায় নদিয়া কি / ম্যা তেরা কিনারা হুঁ / তু মেরা সাহারা হ্যায়, ম্যয় তেরা সাহারা হুঁ…
ঘোষপাড়ার কল্পনাকে মনে পড়ে তার ভেজা শরীরেও লোম-কাঁটা দিয়েছিল, মনে হয়েছিল, এবারই শেষ, আর এ কাজে নয়!
সেসব ফুলটুস কথার বাসা নদীর ঢেউয়ের মাথার ক্ষণস্থায়ী বুদবুদেই। সকালের আলো ফুটলে আর তাদের কারও মনে থাকে না। এখন তাই যেন পরীক্ষার খাতায় সবচেয়ে কঠিন অঙ্কগুলো মিলিয়ে দিতে পেরেছে, এইভাবে স্যারের কোঁচকানো কপালে চোখ রেখে ঠা ঠা করে হাসতে থাকে জোয়ান মদ্দ টাপু, স্যারের আদরের ট্যাঁপা। সবই বলে, কিন্তু একটা কথা সে ভুল করেও স্যারকে বলে না কখনই। ঘোষপাড়ার যাদু ঘোষের মেয়ে কল্পনার জন্য তার পাঁজরের ভেতর লুকোনো অসীম দরদের কথা। মেয়ের এবার হাই স্কুলের পড়া শেষ হবে, তারপর তাকে টাপু মহকুমা শহরের কলেজে ভর্তি করবে, যাতায়াতের জন্য একটি স্কুটার কিনে দেবে। দোহারা চেহারা আর কোঁকড়াচুলো কল্পনা ঘোষেই তার পড়াশুনো শেখার ইতি আবার শুরুও, এইরকম লাগাম-ছাড়া কল্পনার কথা সে কী করে বলে এই পড়া-পাগল মাস্টারকে ! তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ায় তাই, "যাইতেসি স্যার, আর থাকন যাইবে না, গরুগুলানরে খোলজল দিবার সময় বইয়া যায়।"
মাস্টারও আর ছাত্রকে তার সদ্য শোনা কথাটি সময়াভাবে খোলসা করে বলতে গিয়েও বলতে পারে না। সে কথাটি গত সন্ধ্যায় ভ্রামরী মন্দিরে আরতির সময় তার কানে এসেছে। পড়াশুনো জানা ভালো মানুষ হবার সুবাদে এবং হোমিওপ্যাথি নিয়ে চর্চায় ইদানীং কিছু হাতযশ হওয়ায় বিএসএফ ক্যাম্প থেকে যদু ঘোষের ঘর অবধি সর্বত্র দিবাকরের অবাধ গতিবিধি। সব কথাই তার কানে আসে। তার কাছ থেকে পাঁচ কান হবার সম্ভাবনা নেই জেনেই মানুষ যেন তাকে বেশি করে সব গোপন কথা জানিয়ে যায়।
যেমন বিএসএফ জওয়ান পবিত্র কুমার। প্রবল ধার্মিক এই দশাসই চেহারার মানুষটির সঙ্গে মন্দিরে আরতির সময় প্রায়ই দিবাকরের দেখা হয়। আরতি শেষ না হওয়া অব্দি হাত জোড় করে চক্ষু মুদে বসে থাকে পবিত্র কুমার। পঞ্চ প্রদীপ দেবী মূর্তির সামনে ঘোরানোর সময় প্রবল বিক্রমে জয় মাতাদি বলে চেঁচিয়ে উঠেই থম মেরে যায়, যেন আবার ধ্যানস্থ হয়ে পড়ল। মন্দির-ঘেরা ঘোর অন্ধকার ক্রমশ কাছিয়ে আসছে টিমটিমে বালবের আলোকে উপেক্ষা ক'রে, ছমছমে পরিবেশে পুরোহিত ছাড়া আর দু তিনজনই মাত্র ভালো করে পা ঢেকে বসে আছে, পাছে পুরোহিতের ছেটানো পবিত্র শান্তিজল পায়ে পড়ে। আধা অন্ধকারে তাদের মুখ দেখা যায় না, খালি অবয়ব, এইরকম রহস্যময়তার মধ্যে পবিত্র কুমারের আচমকা চিৎকার মাঝে মাঝে যেন শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়। দিবাকরের কলেজে পড়া নবকুমার কপালকুণ্ডলার কথা মনে পড়ে। এখানে সমুদ্র নেই, কিন্তু মন্দিরের পেছনেই ইউ শেপের নদী কুলুকুলু শব্দে বহে যায়। সেখানে কেউ কাঠ কুড়োয় না বটে, তবে জলের ওপর কাঁটাতার থাকে না বলে এই পথেই ইদানিং দেদার গরুচালান চলে। কারা ফিসফাস কথা কয়, মাছের ঘাই মারার মতো সন্তর্পণে বৈঠা চালায়। সব মিলিয়ে খুবই রহস্যময় গা ছমছমে পরিবেশ!
পবিত্র কুমার কি মন্দির থেকে ক্যাম্প অব্দি একা যেতে ভয় পায়! রোজই সে দিবাকরকে অনুরোধ করে তার সঙ্গে যেতে। ভ্রামরী মন্দিরের একেবারে লাগোয়া দিবাকরের বাড়ি। মন্দিরের সীমানার ঠিক পেছনে নদী আর কোনাকুনি সেপাইদের ক্যাম্প। সে অব্দি যেতে বড় জোর দশ মিনিট লাগে। বিয়ে থা করেনি ছেলে, বাড়িতে বুড়ি মা একা, দিবাকর ফিরলে তবে ভাত গরম হবে। তাই তাড়া নেই বলে রোজই সে ডরপোক পবিত্র কুমারের পাশে পাশে সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে যায় ক্যাম্পের গেট পর্যন্ত, যেতে যেতে নানা গল্পগাছা করে। কখনও পবিত্র ওষুধ বিষুধ চায়। কখনও ছেড়ে আসা হরিয়ালি গাঁও আর বালবাচ্চার গল্প করে। মাস্টারজির মতো নীরব শ্রোতা তার খুব পছন্দের। ক্যাম্পের গেটে পৌঁছে সে জোরে জোরে দিবাকরের হাত ঝাঁকিয়ে হ্যান্ডশেক করে, মুখে বলে থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ।
ভুতের ভয়হীন দিবাকরের গত এক বছরের সান্ধ্য রুটিন পবিত্র কুমার সংসর্গে মোটামুটি এইরকমই।
তা গতরাতেই মাস্টারজির কাছে দুঃখ করছিল পবিত্রকুমার, ছ' মাসের পোস্টিং-এ এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসে বছর ঘুরে গেল, তবু তার আর ট্রান্সফার হল না। এদিকে সীমান্তে গরুচালান নিয়ে পার্লামেন্ট অব্দি কথা গড়িয়েছে। পার্টিগুলো সব দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে বিএসএফের ওপর। তাই ওপর মহলের চাপ বাড়ছে। শোনা যাচ্ছে আগামীকাল রাত থেকেই শ্যুট এট সাইট অর্ডার ইসু হবে। এদিক ওদিক চেয়ে ফিসফিস করে পবিত্র কুমার জানায়, এটা সঠিক খবর নাও হতে পারে। সাধারণ জওয়ানরা শুধু হুকুম তামিল করেই খালাস। অপারেশন শুরু হবার দশ মিনিট আগে ছাড়া তারা আসল ব্যাপার জানতে পারলে তো! পবিত্রের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, এখন তার আর এইসব ঝামেলা ভালো লাগে না! দিমাগ ঠান্ডা রাখবার কোনো ওষুধের কথা আছে নাকি মাস্টারজির হোমিওপ্যাথি কিতাবে?
তাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরতি পথে প্যাঁচার ডাক, শেয়ালের হুক্কাহুয়া, রাতচরা পাখির ডানার আওয়াজ, নদীর ছলাৎছল, কিছুই কানে ঢুকছিল না দিবাকরের। সাইকেল চালাতে চালাতে সে কেবল ভাবতে থাকে টাপুর কথা, তার আরও ছাত্রদের কথা, যারা এই গ্যাং-এ সামিল হয়েছে। তার মনে পড়ে যায় দেড় বছর আগে এক রাতে গুলি চলার আওয়াজ শোনা গিয়েছিল মধুগঞ্জে। বুড়ি মা দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বলেছিল, "এহন তুই বাইরালে আর জেবন্ত ফিরতি পারবি না।"
তবুও তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিছুদূর গিয়েছিল দিবাকর, দূর থেকেই অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখেছে জওয়ানরা ঘিরে রেখেছে জায়গাটা, কিন্তু তাদের বড় গোল টর্চের আলো পড়েছে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা একটা ছেলের ওপর, সে কেমন যেন ছেতরে পড়ে আছে, একটা পা ঈষৎ ভাঁজ করা, হাতদুটো ছড়ানো, দেখেই বোঝা যাচ্ছে গুলি খাবার সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। ওরই পাশে পড়ে আছে বড় শিংওয়ালা একটা সাদা গরু। তারও ঘাড় মোচড় খেয়ে আকাশমুখো হয়ে আছে। অন্ধকারে আচমকা গুলি চলতে ওটারও পেট ফুটো হয়ে গেছে। নদীর চরের বালি লেগে ছিল মৃত মানুষ, পশু দুইয়েরই রক্তমাখা চামড়ায়। বড় স্টিল টর্চের জোরালো আলোতে এতো দূর থেকেও দেখা যাচ্ছিল লালের ওপর সাদা অভ্রের মতো কুচি কুচি ঝলকানি। ভাগো হিঁয়াসে, আপনা ঘর চলে যানা, আভি, ইসি ওয়ক্ত, জওয়ানদের বিরক্ত চিৎকারে আর সবার সঙ্গে দিবাকরও চলে এসেছিল। কপালের ঘাম আঁচলে মুছতে মুছতে মা ভাত বেড়ে দিচ্ছিল। মরা ছেলেটাকে সে চিনতো না, চারটে গ্রাম ছেড়ে তবে নাকি ওদের বাড়ি, তবুও কিন্তু সে রাতে দিবাকর না খেয়েই উঠে চলে যায়।
আবার সেইরকম হবে! এবার কার পালা? কে বলি চড়বে? টাপু? গণেশ? নাকি গাছ থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়ে একটু জড়বুদ্ধি মতো হয়ে গেছে যে, সেই আসলাম? সারাদিন ভাবতে থাকল দিবাকর। দুপুরে স্কুল যাবার সময় দেখা হলেও টাপুর কাজের তাড়ায় কথাটা বলা হল না। গত সন্ধ্যায় পবিত্র কুমার বলেছিল, আজ রাত থেকে অর্ডার লাগু হতে পারে। হয়েছে নিশ্চয়ই, কারণ আজ ভ্রামরী মন্দিরে পবিত্রকে খুব অন্যমনস্ক লাগল, কথা কম বলছিল, বেজায় গম্ভীর। নাকি মাঝরাত থেকে বেলা বারটা অবদি ওর এমারজেন্সি ডিউটি। দেবীমায়ের আশির্বাদ চাইতে এসেছে। সবাইকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, এই বলে মাথা ঠান্ডা রাখা ওষুধের পুরিয়া চেয়ে নিয়ে সাগ্রহে গলায় ঢেলেই আজ সে প্রথম বার একা একা ক্যাম্পের দিকে দৌড়ল।
সব লক্ষণগুলিই প্রতিকূল, তাই আর ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। বাহিনীর কাছে নিশ্চয়ই খবর আছে, আজ বিশাল পাল ওপারে চালান হবে। ওবেলা বটের ছায়ায় বসে যে কথা মুখোমুখি টাপুকে সে বলতে পারেনি, এখন তাই-ই বলবে বলে মন্দিরের আরতি ফেরত দিবাকর সাইকেলটা উঠোনে দাঁড় করিয়েই বুক পকেট থেকে ফোনটা তুলে নেয়, "হ্যালো, ট্যাঁপা, আইজ ঘরেই থাক বাবা। হাওয়া খুব গরম। কয় দিন আর নদীর দিকে যাইস না রে।"
ওপাশ থেকে চাপা গলা ভেসে আসে, "ক্যান স্যার, আপনে কিসু শুনছেননি? হ, আমিও ট্যার পাইছি, হাওয়া খুব গরম স্যার, শুনসি আইজ গুলি চইলতে পারে, কিন্তু আপনারে তখন কইলাম যে, দুইশ গরু জমা হইছে গরুহাটায়। কলাগাছের ভ্যালা ট্যালা সব রেডি। ঐ পারের রাখালরা সব টর্চ জ্বালাইয়া খাড়াইয়া আছে। এহন কি আর ক্যানসেল করা যায়? দশ মিনিট পরেই আপনাগো বাসার ধার দিয়া আমি, গণেশ আর আসলাম একসাথে নদীর দিকে যাব। যাওনের সময় মা ভ্রামরীরে পেন্নাম কইরা যাব স্যার। দ্যাখবেন আমাগো আর কুনো বিপদ হইবে না।"
হায় মা ভ্রামরী, তুমি যে চোরাচালানীদের মা নও, এই অবোধ শিশুগুলো তা জানে না! দিবাকরের মনটা যেন ডুকরে ওঠে। কিন্তু আজ ওদেরকে বাঁচাতেই হবে। দু হাত জড়ো করে দেবীকে প্রণাম করে দিবাকর, তারপর এক মূহুর্তে নিজের কর্তব্য ঠিক করে নেয়। গলা বন্ধ জামা, লম্বা প্যান্ট সে আগে থেকেই পরে ছিল। মাথায় এবার পরে নিল টুপি, হাতে দস্তানা। গলায় মাফলার। এই গরমে কিম্ভুত লাগছিল তাকে, তা দিবাকর বুড়ি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝল। কথা না বাড়িয়ে সে উঠোনের একপাশে স্তূপ করে রাখা কাঠকুটো থেকে বেছে নিল একটা লম্বা বাঁশ। শক্তপোক্ত, প্রমাণ-সাইজ। তারপর দৌড়ে চলে গেল মন্দিরের দিকে।
অন্ধকারে দিবাকরকে দেখাচ্ছিল যেন দন্ড হাতে এক বিশাল প্রেত। নাক মুখ চোখ কিছু নেই শুধু দীর্ঘ একটা সচল ছায়া। এমনকি তার হাতে ধরা বিশাল বাঁশটিকেও গিলে ফেলেছিল রয়েল গাছের নীচের অন্ধকার। সে অন্ধকার খুব জাঁকালো, কারণ জনশূন্য মন্দিরে তখন দেবীর সামনে একটি মাত্র তেলের প্রদীপ জ্বলছে। জনশ্রুতি, সারা রাত ভ্রামরী দেবী নিজেই মন্দিরের দেখভাল করেন। নিজেই সারা রাত সলতে উসকে দিয়ে মূর্তির সামনের প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে রাখেন। তাই মন্দির প্রাঙ্গণে আর কোনও রকম প্রদীপ বা ইলেকট্রিকের আলো প্রজ্জ্বলন নিষিদ্ধ। টিমটিমে হলদে বালবটাকেও পুরুতমশাই যাবার সময় নিভিয়ে দিয়ে যান।
এ কথা মনে হতেই দিবাকর যেন পরিষ্কার দেখতে পেল, নদীর দিকের বন্ধ দরজা ভেদ করে ভেতরে ঢুকলো একঢাল কোঁকড়া চুলের এক শ্যামলা কিশোরী। নিজের রক্তবর্ণ শাড়িটি সামলে পেতলের প্রদীপে সলতেটুকুকে উসকে দিল, তারপর কোশাকুশির ওপর সোনার কঙ্কণ-পরা হাতখানি ঝেড়ে নিতেই সেই নিটোল হাতের ওপর থেকে দিবাকরের দিকে গুঞ্জন তুলে উড়ে এল অজস্র মধুমক্ষিকা!
তার রাত-জাগা চোখ আর উত্তপ্ত মস্তিষ্ক তাকে কতো কী-ই না দেখাবে! দেবীকে দেখার মতো কোন পুণ্য সে কখনও অর্জন করেনি, একথা জেনে দিবাকরের ভক্তি জাগে না, বরং ভয়ংকর এক রাগে তার ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে। এইরকমটা বিশ্বাস করতে পারলে তার ভালো হত যে এমন কেউ আজ তার সঙ্গে আছেন, যিনি পাপের শাস্তিতে শুধু মৃত্যু বিধানই করেন না, অসীম আদরে ভালো মন্দ সকলকেই নিজের মধ্যে লগ্ন হবার অনুমতি দেন। কিন্তু বাস্তবে যা দেখেছে সে, তার সবই এই বিশ্বাসের বিপরীতে অবস্থান করে। কেউ কোত্থাও নেই যখন, তখন তিন তিনটে বিভ্রান্তিকে শেষ বারের মতো বাঁচানোর চেষ্টা তাকেই করতে হবে। দরকার নেই তার কোনো দৈবী মহিমা বা লোকবলের। তার দীর্ঘকায় দেহ আর এই মস্ত লম্বা বাঁশ, এই দুইয়ে মিলে মরীয়া শেষ চেষ্টার ক্ষণ নিকটবর্তী হতে থাকে। দিবাকর নিজের বুকের ঢিপঢিপ শোনে, নাকি হাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির টিকটিক, তা সে নিজেই ভালো বুঝতে পারে না।
তার কান হঠাৎ সেই শব্দ শুনতে পায়, যার জন্য সে এতোক্ষণ চরম উৎকর্ণ হয়েছিল। তার বাড়ির পাশের রাস্তার ঝরা পাতায় মৃদু শব্দ তুলে কারা যেন এগিয়ে আসছে ! এই একই পথ দুভাগ হয়ে বাঁয়ের রাস্তা যায় মন্দিরে, ডাইনেরটা ক্যাম্প থেকে দূরে নদীর যে অংশ, সেইদিকে। কানের পেছনে হাত নিয়ে সে আঁচ করার চেষ্টা করে পায়ের শব্দটা কোনদিকে যাচ্ছে।
বাঁয়ে, নির্ভুল বোঝা যাচ্ছে বাঁ দিক পানেই আসছে ওরা, সোজা ভ্রামরী মন্দিরের দিকে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে ওরা তিনজন। একেবারে নি:শব্দে সাবধানী পা ফেলে ওরা মন্দিরের চৌহদ্দিতে ঢুকে এল। রয়েল গাছের আড়ালে লুকিয়ে দিবাকর দেখছে, একটু বাদেই দুজন উঠে গেল মন্দিরের দাওয়ায়, একজন জোড় হাতে নীচে দাঁড়িয়ে রইল। এ নিশ্চয়ই আসলাম। এখানে হিন্দু মুসলমান, সবাই ভ্রামরী দেবীকে সমীহ করে, মেনে চলে। টাপুর বলা কথাগুলো আবার যেন শুনতে পায় দিবাকর, "যাওনের সময় মা ভ্রামরীরে পেন্নাম কইরা যাব, স্যার। দ্যাখবেন, আমাগো আর কুনো বিপদ হইবে না।"
এইবার নিজের ভেতরের ক্রুদ্ধ দৈত্যটিকে এক ঝটকায় জাগিয়ে তোলে দিবাকর। বাঁশ ধরা দুই হাত তোলে মাথার ওপরে। তার অতর্কিত আক্রমণে চাক ছেড়ে মুহূর্তে উড়াল দেবে অজস্র মৌমাছি। আক্রান্ত হয়ে তারা ভুলে যাবে বহু যুগের শান্তি, ঘিরে ধরবে কাছেই দাঁড়ানো বিপথগামী টাপুদের, প্রাণ বাঁচানোর জন্য অন্যদিকে দৌড়ে পালাবে ছেলেগুলো। তারা তো আর দিবাকরের মতো আপাদমস্তক ঢেকে প্রস্তুত হয়ে আসেনি। তবু তাদের জন্য মৌমাছির হুল সিসার বুলেটের থেকে নিশ্চিত ভাবে কম বিপজ্জনক।
তারপর সেই সচল জীবন্ত কীট-মেঘ মন্দিরের চৌহদ্দি থেকে গর্জনরত অবস্থায় বেরিয়ে যাবে, ছেয়ে ফেলবে বন্দুকধারীদের ক্যাম্প। চোরাগোপ্তা এই আক্রমণে বিপর্যস্ত হবে তারাও। যারা এক মুহূর্ত পর মানুষ মারার জন্য বন্দুক উঁচিয়ে ধরবে বলে তৈরি হচ্ছিল, তারাই মার ডালা রে বলে মাটিতে গড়াগড়ি খাবে, টেনে ছিঁড়তে চাইবে গায়ের মোটা উর্দি। নীল ঝকঝকে রাতের আকাশে ছড়িয়ে থাকা বিন্দু বিন্দু গ্রহ, তারা, এলিয়ে পড়া আকাশগঙ্গা আর নীহারিকা মন্ডলীকে যেন তছনছ করে দেবে এইভাবে দিবাকর মাথার ওপর বাঁশটি তোলে। তার নিশ্চিত লক্ষ্যে থাকে মাথার ওপরের সবচেয়ে বড় মৌচাকটি।