চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে কোনো এক সময় যে পাশ ফিরি, সে তো অসন্তোষের ফলেই, পিঠ ব্যথা হয়ে যায় বলেই। নইলে কে আর নড়াচড়া করত পরিশ্রম করে? এই যে আমরা সবাই মিলে বেশ ভাবিত হয়েছি চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে (না, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে এখনো তেমন ভাবনা গণস্তরে চোখে পড়ছে না, শুধু চিকিৎসা পরিসেবা নিয়েই ব্যস্ততা), সেও তো অসন্তোষের খোঁচা খেয়েই। চিকিৎসা বিজ্ঞান রে রে করে উন্নয়নের পথে ধেয়ে চলেছে নোবেল প্রাইজ-টাইজের ঘুঙুর বাজিয়ে, ওদিকে রোগীদের একটু বাজিয়ে দেখলে কেবলই রাগত রাগের তার সপ্তকের কড়ি মা ছাড়া অন্য কোনো সুর বেরোচ্ছে না। অগত্যা খুঁজে দেখার পালা, সুর কোথায় কাটল? অগত্যা আত্মবিশ্লেষণ। গরজ বড় বালাই। পরিসংখ্যান সহ মূল্যবান নিবন্ধ অনেকে লিখবেন। আমার কাজ হল এলোমেলো কথা বলা; মনে যা আসছে, তা অপরিমার্জিত রূপে বলে ফেলা।
চিকিৎসকেরা অনেকে বলছেন, এ হল হিন্দী সিনেমার মাস্টার দীননাথ সিন্ড্রোম। সৎ স্কুল মাস্টারের সততার একমাত্র পরিচয় তার দারিদ্র্য, সন্তানদের ভরণপোষণে অক্ষমতা, আত্মরক্ষা করতে না পারা। তাঁর হেরে যাবার ভিত্তির উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে তাঁর রাগী যুবক পুত্রের ভায়োলেন্স নির্ভর সমাজবদলের গল্প। তাঁর জীবনের সমগ্র যাপন একই রেখে তার গা থেকে দীনতার রোঁয়া ওঠা পুরনো কম্বলটুকু সরিয়ে নিলে আমাদের সামাজিক মনের বিচারালয়ে তাঁর নিষ্ঠার আর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। একাহারী ভিষগ আর বল্কলপরিহিত বুনো রামনাথের ফ্যান্টাসিতে অভ্যস্ত মন সচ্ছল শিক্ষাবিদ বা চিকিৎসককে সন্দেহ করবেই। যুক্তিটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়, বিশেষত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সিংহভাগ যেহেতু আর্থিক, চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশিরভাগ আলোচনাতেই “ওঁ শান্তি”-র মতো এসে পড়ে “মোটা অঙ্কের ভিজিট”-এর প্রসঙ্গ। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাবা-মায়েরা প্রাণপণ অত্যাচারে ছেলেমেয়েদের ডাক্তার বানাতে চান মূলত স্বচ্ছলতার লোভেই !
অযৌক্তিক না হলেও এই তর্ক অসম্পূর্ণ। সকলেরই যে পয়সা বা সাফল্য দেখে চোখ টাটাচ্ছে, এমন ধরে নেওয়ার পিছনে একরকম অহংকার আছে। আর আছে আত্মাবলোকনে অনিচ্ছা। বুনো রামনাথের পাশাপাশি রাজানুগ্রহপ্রাপ্ত সচ্ছল পণ্ডিতবর্গেরও সামাজিক সম্মান চিরকাল অত্যুচ্চ থেকেছে। সবচেয়ে বড় বিলিতি গাড়ি থেকে নামা কোট পরা ডাক্তারের ওপরেই সর্বাধিক ভরসা করেন বেশিরভাগ মানুষ, যাঁরা বাজারের নিয়ম মেনে রোগী সত্তা হারিয়ে ক্রমশ উপভোক্তা বা ক্রেতা হয়ে উঠেছেন। এই বাজার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোভ থাকবেই, কিন্তু যে মানুষ মনেপ্রাণে কাস্টমার, কোম্পানির ছাপ দেখে জামা কেনেন, তাঁর ক্ষোভের একমাত্র কারণ জিনিসের (এক্ষেত্রে ডাক্তারের) দাম হতে পারে না। নিশ্চয় কোথাও গুণমান বিষয়ে অতৃপ্তি বা নিদেনপক্ষে ঠকে যাবার ভয় কাজ করছে। সেই অতৃপ্তি আর ভয়ের কারণ বোঝা জরুরি। পাশাপাশি এটাও বলা দরকার যে আমাদের রাজ্যের বৃহৎ সংখ্যক চিকিৎসক কেন্দ্রীয় সরকারী করণিকদের তুলনায় কম বেতন পান।
দোষারোপের পরিচিত খেলাটার ফাঁদে পড়ে যাবার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক, চরিত্রগত ভাবে চিকিৎসা পেশা কোথায় আলাদা আর কোথায় সমস্যাজনক? অসুস্থতা, স্বাস্থ্য ও রোগ সংক্রান্ত রহস্য, এবং মৃত্যুভয় সাধারণ মানুষকে এক চূড়ান্ত অসহায় অবস্থায় দাঁড় করায়। একইসঙ্গে চিকিৎসককে (হয়ত তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই) তুলে দেয় ক্ষমতার অত্যুচ্চ শিখরে, যেখান থেকে নেমে আসা খুব মুশকিল। সেই শৃঙ্গের নির্বাসনে প্রত্যাশার পাহাড়ের ওপর প্রতি মুহূর্তে পতনের ভয় নিয়ে চিকিৎসক খুঁজতে থাকেন হারিয়ে যাওয়া মইটা, কিন্তু মুখ ফুটে সেকথা বলতে পারেন না কাউকে, কারণ আত্মপ্রত্যয় বা প্রত্যয়ের ভান অস্তিত্বের সঙ্গে কবচ-কুণ্ডলের মতো সেঁটে রাখা ছাড়া তাঁর অন্য উপায় নেই। অত উঁচু থেকে নীচের মানুষগুলোকে যেমন অনেকে লিলিপুটের মতো দেখেন, তেমনি নীচ থেকে টঙে চড়া লোকগুলোর মুখের রেখা দেখা যায় না, শুধু স্যুট-বুট দেখা যায় আর তাদের দেখতে লাগে সন্দেহজনক “অপর”-এর মতো।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, মানুষের জীবন ও তার যাপনের উপর চিকিৎসক যে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে সক্ষম, তা একই সঙ্গে শ্রদ্ধা ও সন্দেহ উদ্রেক করে। আমরা শ্রদ্ধাটাকে গুরুত্ব দিতে অভ্যস্ত এবং ধরে নিই যে এই শ্রদ্ধা আসলে ভালবাসার অন্য রূপ। বাস্তব সর্বদা তেমন নয়। ভালবাসা জন্ম নেবার সুযোগ পায় না উপযুক্ত আঁতুড়্রঘরের অভাবে। চিকিৎসকের প্রতি সম্ভ্রমের উৎস হল ভীতি... রোগের প্রতি, মৃত্যুর প্রতি, এবং চিকিৎসা নামক রহস্যময় (ক্ষেত্রবিশেষে আতঙ্কজনক) তলোয়ারটি মুষ্টিবদ্ধ দক্ষিণহস্তে ধারণ করে আস্ফালন করছেন যিনি, তাঁর প্রতিও। গ্রহীতার এই ভয় ও সভ্রম, এবং নিজের নলেজ প্রিভিলেজ কাজে লাগিয়ে চিকিৎসক অনেক কিছু পারেন, বলা ভালো “পারতেন” গত কয়েক হাজার বছর ধরে। এই অসাম্যের ভিত্তিতেই উপার্জিত হয়েছে সম্পদ ও মর্যাদা, অর্জিত হয়েছে অবাস্তব প্রত্যাশা, পাশাপাশি এসেছে নিখুঁত চরিত্র এবং আকাশ-সমান প্রসারিত হৃদয় বহন করার দায়, যা অধিকাংশ পেশার ক্ষেত্রে থাকে না।
এভাবে চলছিল, মূলত বিঃশ্বাসে ভর করে। কে না জানে, চিকিৎসকের নিদানকে বেদবাক্যজ্ঞানে মেনে চলার অভ্যাসের দরুন বহু অপচিকিৎসা প্রশ্রয় পেয়েছে। গ্যালেন সাহেবের হাতে জনপ্রিয় হওয়া “ব্লাড লেটিং”-এর মতো অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সহস্রাব্দকাল ইউরোপ শাসন করেছে, অথচ তার দ্বারা কোনো রোগীর উপকার হয়েছে (মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়ে যন্ত্রণা লাঘব ছাড়া) বলে মনে করার সঙ্গত কারণ নেই। অবশ্যই গরিষ্ঠ সংখ্যক চিকিৎসক/ বৈদ্য অন্তত মানসিকভাবে মানুষের বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে চাইতেন বলে ভাবা যায়। সেই চেষ্টা থেকেই এসেছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি। পাশাপাশি ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে এসেছে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা,কায়েম হয়েছে সমাজ ও মানবমনের উপর বাজারের নিয়ত্রণ। পুরনো সামন্ততান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা যেভাবে চলত, তাতে বিশ্বাসের বড় ভূমিকা ছিল। এর ফলে চিকিৎসক পরিষেবা প্রদানকারীর বদলে দেবতাসুলভ উচ্চাসনে অতিরিক্ত সম্মান নিয়ে অধিষ্ঠিত থাকতে পেরেছেন এবং তাঁর স্বেচ্ছাচারী হবার সম্ভাবনাও থেকেছে, যা খারাপ। পাশাপাশি বিশ্বাসের বাতাবরণের কিছু সদর্থক ভূমিকাও ছিল। কিন্তু আস্থা বা বিশ্বাস মানুষকে উপভোক্তা হিসেবে স্থবির করে। ক্রেতার একনিষ্ঠতা প্রতিযোগিতাকে অনেকাংশে মঞ্চচ্যুত করে, যা বাজার অর্থনীতির চরিত্রবিরোধী। বাজারের প্রয়োজন তাই উপভোক্তার বিশ্বাসগুলো ভেঙে দেওয়া; তার চাহিদা বাড়ানোই শুধু নয়, তাকে একাকী, অসহায়, অব্যবস্থিতচিত্ত এবং আগ্রাসী করে তোলা। একই সঙ্গে শিল্পী থেকে শিক্ষক, স্তন্যদাত্রী থেকে চিকিৎসক, সবাইকে বিক্রেতায় পরিণত করাও আবশ্যক। সুনিপুণভাবে এই সবের আয়োজন চলছে বিগত শতক (বিশেষত শেষ কয়েক দশক) ধরে। আইনসভা থেকে সংবাদ পরিবেশক, সবাই মিলে যে কনসার্ট গাইছেন, তার মূল উদ্দেশ্য সমাজব্যবস্থায় তথা মানুষের মনে এই নতুন (অ)মানবিক সম্পর্কের বীজ গভীরভাবে বুনে দেওয়া।
বিষবৃক্ষের চারাটিতে সবে নতুন পাতা আসতে শুরু করেছে। আজ যারা নতুন ডাক্তারি পাশ করে হঠাৎ এই অবিশ্বাসের বাতাবরণে নিজেদের আবিষ্কার করছে, তারা বিস্মিত হয়ে ভাবছে, “আমরা কী দোষ করলাম?” এই দীর্ঘ সময়কাল ধরে তারা তো ছিল না, কিন্তু ইতিহাস ছিল, বীজ বপন ছিল, তাকে খেয়াল না করার ভান করে জলসিঞ্চন ছিল।
বাজারের বপু বিস্তারের জন্য ক্রেতার সংখ্যা বাড়াতে হয়। তার জন্য লগ্নি ও বিক্রয়ের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া এবং বিজ্ঞাপনের দ্যুতিতে “উন্নত” জীবন, বিলাস বা পরিষেবার প্রতি ক্রেতাকে মোহগ্রস্ত করার পাশাপাশি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের হাড়-পাঁজর আলগা করে ফেলতে হয়। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও দরিদ্র আর মধ্যবিত্তের মাথা থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিতে হয় রাষ্ট্রের ছাতা, এমনভাবে যাতে তাঁরা সুস্থতা ক্রয় করতে বাধ্য হন। একইসঙ্গে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জীবনশৈলীভিত্তিক সাধারণ প্রণালি এবং রোগ প্রতিষেধমূলক পদক্ষেপগুলি থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া হয় ক্রয়যোগ্য “অত্যাধুনিক” চিকিৎসার দিকে। এভাবে এক বিশাল সংখ্যক অপারগ মানুষ স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা নামক পণ্যটির ক্রেতা হতে গিয়ে নিজের সর্বস্ব বিক্রয় করতে বাধ্য হবার পর্যায়ে পৌঁছান। সংবাদ ও বিনোদনের বিভিন্ন গণমাধ্যম, রাজনৈতিক এবং দেশ ও রাজ্যগুলির বিভিন্ন সরকার, সবাই মিলে এই প্রক্রিয়ায় ছন্দোবদ্ধ অংশগ্রহণ করেছে। ইতস্তত ব্যাতিক্রম অবশ্য থেকেছে, সমসত্ত্ব কিছু তো হয় না।
রোগী ক্রেতা এবং চিকিৎসক বিক্রেতায় পরিণত হলে দ্বিতীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বণিক চরিত্রের জন্ম হবেই। তাও ব্যক্তি চিকিৎসকের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার একটা সীমা আছে, কারণ রোগী এবং তাঁর পরিবার “পরিচিত” হয়ে ওঠেন, ক্রমশ এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারেন, যখন তাঁদের আর্থসামাজিক বাস্তবতার কথা ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের বই আর বাজারের শর্তগুলির কথা মাথায় রাখা সম্ভব হয় না। তাই নানা সময়ে বিভিন্ন আইনের দ্বারা এটা নিশ্চিত করা হয়েছে বা হচ্ছে,যাতে ছোটো পরিসরে একাকী চিকিৎসক নিজের পেশায় টিকে থাকতে না পারেন, যাতে তাঁকে বৃহৎ পুঁজির কাছে অবশ্যই আত্মসমর্পণ করতে হয়। এসব ব্যবস্থা যখন হয়েছে, তখন ডাক্তারকে টাইট দেওয়া হচ্ছে ভেবে অনেক সাধারণ মানুষ আনন্দিত হয়েছেন/ হচ্ছেন, কিন্তু বুঝতে পারেননি তাঁদের পাড়ার অমুক ডাক্তারকেও “ম্যাক্সিমাইজেশন অব প্রফিট”-এর কারখানায় শ্রমিক বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। পরিচিত সেই ডাক্তারটি মানুষ হিসেবে যেমনই হন, তাঁর হাতদুটো ধরে নিজের কষ্টের কথা বলে কিছু সুরাহা হত। এখন দুনিয়াব্যাপী এই চিকিৎসাযন্ত্রের কোথায় হাত আর কোথায় বা হৃদয়?
পরিস্থিতি এই নতুন ব্যবস্থার দিকে বাহ্যিকভাবে ঠেলে দিলেও মানসিক ও আত্মিক স্তরে নিজেদের চিকিৎসক সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারার দায় চিকিৎসকদেরও নিতে হবে। প্রয়োজন, চাহিদা, লোভের ক্ষীণ সীমান্তরেখা রক্ষা করার দায়িত্ব মানুষের নিজেরই। দায় আমাদের প্রশিক্ষণেরও। শরীরকে জানতে যে পরিমাণ পড়াশুনা এবং কাজ করতে হয়েছে, তার কণামাত্র চেষ্টা ছিল না মানুষকে চেনার বা চেনানোর। চিকিৎসা আসলে কিছুটা বিজ্ঞান আর অনেকটা শিল্প, অথচ আমরা বুঝতে শিখিনি শারীরবিজ্ঞানের বাইরে মানবমনের জটিলতা বা তার সৌন্দর্য। ঠিকমত বোঝাতেও শিখিনি, আমরা কী ভাবছি বা করছি। ফলে চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কের অ্যাকিলিস হিল হয়ে দাঁড়ায় কমিউনিকেশন, বলা ভালো, তার অভাব। আরেকটু বেশি করে পরস্পরকে চিনলে, কথা বললে, খোলামেলা হলে, বেশ কিছু সমস্যা মিটতে পারত। অবশ্যই সব সমস্যা মিটত না তাতে। বোঝাতে গিয়ে দেখেছি, সকলে বুঝতে রাজি হন না।
যে বিজ্ঞান নিয়ে এত মাতামাতি, তার সম্বন্ধে দু-একটা কথা। প্রথমত, চিকিৎসাবিজ্ঞান ভয়ানক রিডাকশনিস্ট। মানুষের সমগ্র সত্তাকে শরীরে, শরীর থেকে একটি অঙ্গে (যেমন হার্ট), অঙ্গ থেকে অঙ্গটির একটি নির্দিষ্ট অংশে (যেমন হার্টের ভালব) সংকুচিত করে আনাই আমাদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এভাবেই আমরা এগোতে শিখি এবং তা অনেকাংশে কার্যকর। কিন্তু এই ক্ষুদ্রায়িত পরিসরে সমগ্র মানুষটির জায়গা হয় না, আশ্রয় খুঁজে পায় না তার পরিচয়, তার সর্বাঙ্গীণ (অ)সুখ। ফলে রোগ সারলেও রোগী আর তার পরিবারের মনে অতৃপ্তি থেকে যেতে পারে। রোগ না সারলে সেই অতৃপ্তি প্রকাশিত হতে পারে বিকৃত আকারে।
দ্বিতীয়ত, এভিডেন্স বেসড মেডিসিন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য যে তা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে একটি নির্দিষ্টি রূপরেখা দেয়, নইলে যে যার ইচ্ছামত যে কোনো ওষুধে যে কোনো অসুখের চিকিৎসা করতে পারত, হয়ত ব্লাড লেটিং এর মাসতুতো ভাইয়ের শরণাপন্ন হত। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাই প্রমাণ বা এভিডেন্সের কোনো বিকল্প নেই। আবার এর হাতে সম্পূর্ণ ক্ষমতা তুলে দেওয়ার ফলে চিকিৎসা পদ্ধতি শুধু যে যান্ত্রিক হচ্ছে তাই নয়, এভিডেন্স নথিবদ্ধ করতে এবং প্রচার করতে সক্ষম কিছু প্রভূত ক্ষমতাধর আকাদেমি, জার্নাল, ল্যাবরেটরি বা বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, এরা এভিডেন্স নির্মাণ বা সৃজন করতেও সক্ষম এবং এদের নৈতিকতায় অন্ধের মতো আস্থা রাখার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই।
তৃতীয়ত, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির কুফল আমরা নিয়মিত ভোগ করি। অস্বীকার করার প্রশ্নই নেই, যে চিকিৎসার তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অতি দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। আমরা এখন অনেক বেশি গভীরে গিয়ে রোগের কারণ নির্ধারণ করতে পারি। আগে যাকে একটা রোগ ভাবা হত, তার মধ্যে এখন পাঁচরকম শ্রেণীবিভাগ করা সম্ভব, যাদের চিকিৎসার মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম তফাৎ আছে। স্ট্রোক চিকিৎসা, হৃদরোগের চিকিৎসা বা জটিল হয়ে যাওয়া নানান রোগের “ক্রিটিকাল কেয়ার”-এর ক্ষেত্রে এখন বিভিন্ন নতুন ওষুধ, উন্নত যন্ত্রপাতি, অজস্র খুঁটিনাটি মাপজোখের ভিত্তিতে চিকিৎসার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তন, ইত্যাদি এখন স্বাগত বাস্তব। এসবের দ্বারা মৃত্যুর হার সত্যিই কিছু কমেছে এবং সুস্থ হবার সম্ভাবনা খানিক বেড়েছে। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি বেড়েছে দুটো জিনিস... চিকিৎসার খরচ (নানা নতুন পদ্ধতি এবং ওষুধ প্রয়োগ করার খরচ বিপুল) এবং আধুনিক চিকিৎসা থেকে মানুষের প্রত্যাশা। একদিকে “এভিডেন্স বেস”, বিভিন্ন গাইডলাইন এবং আইনের দ্বারা নিশ্চিত করা হচ্ছে যে আধুনিক বলে গৃহীত (মহার্ঘ্য) চিকিৎসাটি প্রয়োগ না করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, পাশাপাশি প্রচারের ফলে মানুষ ভাবতে শুরু করেছে একবার বড় হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছতে পারলে সব মানুষের সব রোগ সারিয়ে ফেলা সম্ভব, তাও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। অতঃপর ভাবুন, সেই লাখ টাকার চিকিৎসাটি করার পর যদি আশানুরূপ ফল না হয়, তাহলে? মানুষের তৃপ্তি নির্ধারিত হয় প্রত্যাশা আর ফলাফলের সামঞ্জস্য বা অসামঞ্জস্যের দ্বারা। যে পাশ করার জন্য কাতর ছিল, সে ফার্স্ট ডিভিশন পেলে মিষ্টি খাওয়াবে, আর যে ফার্স্ট হবে বলে জেদ ধরেছিল, সে থার্ড হয়ে আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে। জ্বর রোগে দুর্গার মৃত্যুতে সর্বজয়ার মনে যতটুকু বেদনা বা ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি ক্ষোভ-ক্রোধ সঞ্চারিত হতে পারে আজকের দিনে কোনো মেয়ের মনে, তাঁর আশি বছর বয়স্ক মা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে হাসপাতালের আইটিইউ-তে প্রাণত্যাগ করলে। কারণ প্রত্যাশার তারতম্য। প্রত্যাশা আমরাই জাগিয়েছি, হয়ত সম্মান বা বাণিজ্যের লোভে। তাই ক্রোধ, অভিযোগ। ভগবান ভদ্রলোক নীৎসের হাতে খুন হয়ে বেঁচে গেছেন, কর্পোরেট হাসপাতালের মালিকে নাম কেউ জানে না, অতএব পড়ে থাকে ডাক্তার। যমের সাথে লড়তে গিয়ে বেচারা খেয়ালই করে না, কখন যমরাজ তার হাতে গদাটা ধরিয়ে দিয়ে রোগীকে উঠিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। ক্যামেরার ফ্রেমে এখন সে একা মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে, হাতে রক্ত। দর্শকমণ্ডলি সহজেই বুঝে নেন, মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?
নিদারুণ অবিশ্বাসের পরিবেশে ভালো কাজ হয় না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, জটিল রোগীর সঠিক রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত চিকিৎসার ক্ষেত্রে ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের ভূমিকা বিরাট। রোগী দেখার সময় পূর্ণ মনোযোগ রোগীর দিকে দিতে পারলে তবেই মনের সবটা, ষষ্ঠেন্দ্রিয় সমেত, কাজ করে। যদি অর্ধেকটা মন পড়ে থাকে নিজের পিঠ বাঁচানোর দিকে, রোগী দেখার সময় যদি ভাবতে হয় “এই রোগী নিয়ে কী ধরণের কেস খেতে পারি” বা “এর বাড়ির লোক ঝামেলা করতে পারে কিনা”, তাহলে মনের সেই আশ্চর্য রত্নভাণ্ডারে তালা পড়ে যায়, বদলে সামনে আসে কৈকেয়ীর গোঁসাঘর আর মন্থরার ফিসফাস। রোগীকে ভালোবেসে দেখা, তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে “কিচ্ছু হবে না, আমি তো আছি” বলা, বা হাল ছেড়ে দেবার আগে নিজের জ্ঞানবুদ্ধি অনুসারে নিয়মের বেড়া ডিঙিয়ে শেষ চেষ্টা করার বদলে এখন অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি শব্দ খাতায় লিখে রাখা, আত্মীয়দের কটার সময় কী জানানো হয়েছে তা নথিবদ্ধ করে সই করিয়ে নেওয়া, বইতে যেটুকু লেখা আছে তার বাইরে যাবার চেষ্টা না করা, দায়িত্ব নিজের কাঁধে না রেখে অন্যান্য স্পেশালিস্টদের রেফার করে দেওয়া, ইত্যাদি। যেন রোগীকে নয়, নিজেকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসা করছি। এভাবে আর যাই হোক, সুচিকিৎসা হয় না। যাঁদের প্রতি সমানুভূতি লাভ করার কথা, তাঁদেরকেই সম্ভাব্য আক্রমণকারী বা আদালতের প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবতে হবে বলে যদি জানতাম, তাহলে আমরা অনেকেই হয়ত অন্য পেশা বেছে নিতাম, যেখানে এর চেয়ে কম পরিশ্রমে এর চেয়ে বেশি উপার্জন করতে পারতাম। চিকিৎসা পেশার একটা নেশা আছে, যেটা চলে গেলে আমাদের অনেকের জন্যেই কাজটি অর্থহীন হয়ে যায়।
বরং প্রয়োজন ছিল এমন এক পরিসর, যেখানে কিছু না জানার কথা বা বুঝতে না পারার কথা খোলাখুলি বলতে পারব, আরো পাঁচজনেকে ডেকে জিজ্ঞেস করার মধ্যে যেখানে অসম্মান থাকবে না। যেখানে নিজের ভুল বুঝতে পারলে চাপা দেবার প্রয়োজন থাকবে না, বরং তা স্বীকার করে শোধরানোর চেষ্টা করা যাবে চটপট, যেখানে ভুল বা ব্যর্থতা মানেই অপরাধী সাব্যস্ত হওয়া (blameworthiness) নয়। যেখানে আন্তরিকতা, সততা, নিষ্ঠা মূল্যবান। যেখানে নিজের কান্না, নিজের দুর্বলতা, নিজের হেরে যাওয়া নিয়ে পাশাপাশি বসতে পারেন সন্তানহারা পিতা আর সেই সন্তানকে বাঁচাতে না পারা চিকিৎসক... পরস্পরকে দিতে পারেন মন উজাড় করে ভেঙে পড়ার জায়গা এবং জোগাতে পারেন আরেকবার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি।
গাফিলতি কি তবে সত্যি থাকে না? অবশ্যই থাকে। লোভ কি নেই? আছে বলেই তো সমস্যা। চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন কি নেই? অবশ্যই আছে। চিকিৎসা হওয়া উচিত মানবিক। তার উপর নিয়ন্ত্রণ হওয়া উচিত বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তির ভিত্তিতে পরিবর্তনযোগ্য (কারণ বিজ্ঞান পরিবর্তনের উপরেই ভর করে বেঁচে থাকে), বাস্তবসম্মত এবং মানবিক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক। সেটাকে বিষিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে বহুদিন ধরেই। এই অপচেষ্টা আটকানোর জন্য সাধরণ মানুষ, বিচার ব্যবস্থা, সৎ সাংবাদিক, সমাজকর্মী এবং সরকার, সকলকেই সচেতন হতে হবে। চিকিৎসকদের বিশেষ মনোযোগী হতে হবে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধিতে। নীচে নেমে আসতে শিখতে হবে, কথা বলতে শিখতে হবে। হাত বাড়াতে শিখতে হবে। অসহিষ্ণুতা একটি যুগলক্ষণ, যা সর্বব্যাপী আজকের পৃথিবীতে। রোগী-চিকিৎসক উভয় পক্ষকেই সেকথা বুঝতে হবে এবং তার প্রতিকারে সচেষ্ট হতে হবে। শেষ অব্দি মানুষই তো পারে।